Monday, January 31, 2011

প্রতিশোধের রাতে অনেক রেকর্ড বার্সেলোনার

প্রতিশোধের রাতে দারুণ এক অর্জনে সমৃদ্ধ বার্সেলোনা। যথারীতি এ অর্জনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকা লিওনেল মেসির। আর্জেন্টাইন তারকার ২ গোলে হারকিউলিসকে ৩-০-তে উড়িয়ে স্প্যানিশ প্রিমেরা লিগায় টানা ১৫ জয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেছে পেপ গার্দিওলার দল।

আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর রিয়াল মাদ্রিদের গড়া রেকর্ডটির পাশে দাঁড়াতে পেরে উচ্ছ্বসিত বার্সা কোচের আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতিশোধের সফল মিশনও। মৌসুমের শুরুতে স্প্যানিশ লিগের নবাগত দলটির কাছেই যে হেরেছিল তারা! বার্সেলোনার অনেক পাওয়ার রাতে এসি মিলান আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেও জয়ের উচ্ছ্বাস। কাতানিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে ইতালিয়ান সিরি ‘এ’র শিরোপা-স্বপ্ন আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে মিলান। অন্যদিকে পিছিয়ে পড়েও সাউদাম্পটনের সঙ্গে ২-১ গোলে জিতে এফএ কাপের পঞ্চম রাউন্ডে উঠেছে ম্যানইউ। তবে হতাশার বৃত্তে বন্দি চেলসি ১-১ গোলে ড্র করেছে এভারটনের সঙ্গে।
এবারের স্প্যানিশ লিগে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই হারকিউলিসের কাছে ০-২ গোলে হেরে গিয়েছিল বার্সেলোনা। তাও আবার নিজেদের মাঠ ন্যু ক্যাম্পে! হারকিউলিসের মাঠে সেই হারের প্রতিশোধের লক্ষ্যে নামার আগেই দানি আলভেসকে ফিরে পাওয়ার সুখবর পেয়েছে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা। মেসির দুটি আর পেদ্রোর একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ না হলে শুরুতে তারা এগিয়েও যেতে পারত। তা হয়নি, বরং ২০ মিনিটে স্বাগতিকরা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল বার্সাকে। ১১ সেপ্টেম্বরের সেই ম্যাচে হারকিউলিসের দুটি গোলই করা নেলসন ভালদেজের ব্যাক হেড থেকে গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন ডেভিড ত্রেজেগে। কিন্তু ভিক্টর ভালদেসকে একা পেয়েও ফ্রান্সের সাবেক স্ট্রাইকার বলে ঠিকমতো পা ছোঁয়াতে পারেননি। প্রথমার্ধে প্রায় সমান তালে লড়লেও হারকিউলিস পিছিয়ে পড়েছে বিরতির মিনিট দুয়েক আগে। জাভির কোনাকুনি পাস ধরে ডান পায়ের জোরালো শটে গোলটা করেছেন দলের একঝাঁক তারকার মধ্যেও ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠা পেদ্রো। গোল পেয়ে অনুপ্রাণিত বার্সার আক্রমণাÍক ফুটবলের সামনে আর দাঁড়াতে পারেনি হারকিউলিস। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ডেভিড ভিয়া আর জাভির দুটি শট অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট কিংবা ৬৫ মিনিটে পেদ্রোর আরেকটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিলও বার্সেলোনাকে নিরুৎসাহী করতে পারেনি। একের পর এক আক্রমণ গড়ে প্রতিপক্ষের জালে আরো দুইবার বল পাঠিয়েছে তারা। অবশ্য ৮৫ মিনিটে ফারিনোসের দ্বিতীয় হলুদ কার্ডও সাহায্য করেছে প্রিমেরা লিগায় হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাতালানদের। এর দুই মিনিট পরই ডিফেন্সভেদী এক দৌড়ের পর মেসির বাঁ পায়ের শট ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছে বার্সাকে। শেষ মুহূর্তে দারুণ এক আক্রমণকে পূর্ণতা দিতেও সমস্যা হয়নি ফিফা ব্যালন ডি’অর বিজয়ীর। মৌসুমে এটা মেসির ৩৭ ও লিগে ২১তম গোল। ২২টি নিয়ে এখনো লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার মর্যাদা ধরে রাখলেও মৌসুমের হিসাবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বেশ পিছিয়েই আছেন ৩২ গোল করা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
১৯৬০-৬১ মৌসুমে ‘গ্রেট’ ডি স্টেফানোর দলের গড়া রেকর্ড ছুঁতে পেরে গার্দিওলা বেশ আবেগাক্রান্তই হয়ে পড়লেন ম্যাচ-শেষে, ‘লিগে টানা ১৫টি ম্যাচ জিতে (আলফ্রেডো) ডি স্টেফানোর রিয়াল মাদ্রিদের রেকর্ড স্পর্শ করা সত্যিই এক অসাধারণ সম্মান। ৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়ায়ই প্রমাণিত, কাজটা কতটা কঠিন।’ হারকিউলিস সফর থেকে জয় নিয়ে ফেরায় রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ব্যবধান আবার ৭ পয়েন্টে নিয়ে গেল বার্সা। এ রাউন্ডে রিয়ালের প্রতিপক্ষ ওসাসুনা। ম্যাচটি গত রাতেই হয়ে যাওয়ার কথা।
গত সপ্তাহে বায়ার্ন মিউনিখ থেকে এসি মিলানে যোগ দেওয়া মার্ক ফন বমেলের সিরি ‘এ’ অভিষেক মোটেও ভালো হয়নি। ৫৪ মিনিটে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে বেরিয়ে গেছেন ডাচ মিডফিল্ডার। তবে ১০ জন হওয়ার পরই জ্বলে ওঠা রবিনহো আর ইব্রাহিমোভিচের গোলে প্রতিপক্ষের মাঠ থেকে মূল্যবান তিনটি পয়েন্ট নিয়ে ফিরেছে মিলান। তাই ২২ ম্যাচে ৪৭ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে তারা আরো সুসংহত।
এফএ কাপে তৃতীয় বিভাগের দল সাউদাম্পটনের সঙ্গে বিরতির ঠিক আগে গোল খেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল রুনি-ন্যানি-গিগস-বারবাতভবিহীন ম্যানইউ। তবে দ্বিতীয়ার্ধে মাইকেল ওয়েন আর হাভিয়ের হার্নান্দেজের গোল শেষ ষোলোতে ঠিকই জায়গা করে দিয়েছে ‘রেড ডেভিল’দের। কিন্তু ইংলিশ চ্যাম্পিয়ন চেলসি তা পারেনি। লুই সাহার গোলে পিছিয়ে যাওয়া ‘ব্ল–জ’ সলোমন কালুর লক্ষ্যভেদে সমতায় ফিরলেও জিততে পারেনি। এএফপি, রয়টার্স

মোস্তফা নূরুজ্জামানের বই 'স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসার ডালি'

ব্যতিক্রমধর্মী ও ভিন্ন আমেজের কবিতার বই মোস্তফা নূরুজ্জামানের 'স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসার ডালি'। তিনি যা ভালোবেসেছেন, তাই ধরে রাখতে চেয়েছেন কাব্যিক আঙ্গিকে। অমর একুশে বইমেলা ২০০৯-এ প্রকাশিত হয়েছিল তার এই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি।

চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি বছর পাঁচ আগে। ষাটোর্ধ এই তরুণ কবি নিজস্ব প্রাণ-বন্যায় ভাসেন এবং ভাসান সকলকে। বিয়ে-শাদী-জন্মদিন ও স্মরণীয় মুহূর্তকেন্দ্রিক তাঁর এই কবিতাগুলো উৎসব আনন্দের স্বভাবজ প্রকাশ। তিনি অনন্য তাঁর নাতি-নাতনি তথা শিশু-প্রীতিতে। বইটি উৎসর্গও করেছন তাঁর কাঁচা-পাকা নাতি-নাতনিদের। বিষয় ও বৈচিত্র্যের বিন্যাসে তাঁর কবিতার স্বাদ পাঠককে আমোদিত করবে। লেখক বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে সময়োপযোগী কাব্য, অনুকাব্য ইত্যাদি লিখে দিয়ে প্রয়োজনে তা ফ্রেমে বেঁধে উপহার দিয়েছেন তাঁর প্রিয়জনদের। এসব অনুকাব্য-কাব্য প্রশংসিত হতো সবার কাছে। কিন্তু প্রথমদিকে তিনি এসব কাব্য-অনুকাব্যের কপি নিজের কাছে রাখেননি। তাঁর বন্ধু-বান্ধব-সুহূদদের অনুরোধে সামপ্রতিককালে লেখকের কিছু কবিতা, প্যারোডি গান, ধামাইল গান, আশীর্বাদ বাণী ইত্যাদি নিয়ে প্রকাশ হয়েছে এ বইটি।

বইটির প্রথম কবিতাটি চন্দ্রঘোনাস্থ চম্পাকুঁড়ি খেলাঘর-এর সদস্যদের উদ্দেশ করে লিখেছেন_'তোমরা যারা চম্পাকুঁড়িরা / হয়েছো আজ জড় / দুদিন পরে তোমরাইতো/ হয়ে যাবে বড়।' স্নেহসিক্ত নাতির জন্মদিন উপলক্ষে কবি লিখেছেন_'পূর্ণ শশীর আলোতে যেমন ধরা ঝলমল, / তোমার ব্যক্তিত্ব হোক তেমনি সমুজ্জ্বল।' এরকমভাবে অনেক কবিতাই বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে লেখা। সুন্দর অলঙ্করণে ছাপানো এ কবিতার বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশনী, প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিমান তালুকদার, বইটির দাম আশি টাকা।

ইত্তেফাক সাময়িকী ২১ জানুয়ারি সংখ্যার পাঠপ্রতিক্রিয়া

ত্তেফাক সাময়িকী ২১ জানুয়ারি সংখ্যার মূল আয়োজন ছিল নির্বাচিত দশ কবির বইমেলায় প্রকাশিতব্য কবিতার বই থেকে দশটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা হলেন_মুজিব মেহেদী, টোকন ঠাকুর, আশরাফ রোকন, মজনু শাহ, আপন মাহমুদ, মামুন খান, পিয়াস মজিদ, নওশাদ জামিল, বিজয় আহমেদ ও নির্লিপ্ত নয়ন।

এ বিভাগ সম্পর্কে 'আয়োজনটি সুন্দর' বলে প্রথম মন্তব্যটি করেন শামীম আজাদ। এরপরের মন্তব্য মোহাম্মদ নূরুল হকের। মজনু শাহ-এর কবিতা সম্পর্কে তার মূল্যায়নধমর্ী মন্তব্য, 'মৃতু্য' কবিতাটিতে ক্রমবিবর্তমান মানব আচরণ ও প্রাপঞ্চিক ধারণার পরিবর্তনীয় বিষয়ের স্বীকৃতি রয়েছে। এখানে কবি একই সাথে প্রপঞ্চের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা। পিয়াস মজিদের কবিতা 'রূপনারাণ' সম্পর্কে তার মত, 'কবিতায় পঙক্তিকে প্রবচনীয় মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে তার চেষ্টা মুগ্ধকর। ভাবনায় তাকে রবীন্দ্রনাথের মানসসঙ্গী বলেই ধরে নিয়েছি। প্রকাশে তার স্বাতন্ত্র্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখানেই কবির বিশিষ্ট হয়ে ওঠার সোপান। এভাবেই কবি অগ্রজকে আত্মস্থ করে হয়ে ওঠেন নিজেও স্বতন্ত্রস্বর। আনোয়ার শাহাদাতের মন্তব্য, 'সাধারণ উদ্যোগ। তার চেয়েও অসাধারণ কবিতাগুলো।' এরপরের মন্তব্য প্রদানকারী সৈয়দা আমিনা ফারহিন। তার অনুভূতি, 'হাইরাজ ঘেঁষে আসা ফাটকা বাতাস যখন বীথিটার চুল নিয়ে খেলছিল, অদূরেই প্রান্তরে দাঁড়ানো একলা গাছের নিচে দেশলাইয়ে বিড়ি ধরাতে আমি প্রাণান্ত ছিলামঃ',_মুজিব মেহেদীর অাঁকা ছবিটা চোখে লেগে আছে। টোকন ঠাকুরের 'অসম্ভব সম্ভবত সম্ভব হয়ে ওঠার আগ পর্যন্তই অসম্ভব' লাইনটা পড়ে বিস্ময়ে চোখ ঠিকরে আসছে। আবার 'হতে পারে পাখি বা পালক ছিলাম/হঠাৎ খেয়াল করি, আমার কল্পিত ডানায় রোদ বৃষ্টি ধূলোরাই/ ভুল করে ৪১ না লিখে লিখে দিচ্ছে ১৪ বছর' অসাধারণ। মজনু শাহের 'কেনবা একটা করে বেড়াল বসে থাকতে দেখি সমস্ত অধ্যায় শেষে' গায়ে কাঁটা লাগিয়ে দিচ্ছে'। আশরাফ রোকনের 'পোকাদের সংসারে বোকা হয়ে আছি', পিয়াস মজিদের 'ফিরে ফিরে রোববার ঘণ্টা/ কনফেশন। এত হিমমেঘলা স্মৃতি সন্ধ্যা', বিজয় আহমেদের 'বোনরে আমি হারতে চাই নাই। নিমপাতা আনতে গিয়েই দেখা হলো তেঁতুল তলার ভুত্নীর সাথে', নওশাদ জামিলের 'প্রাচীন অক্ষরগুলো ভেসে ভেসে জানিয়ে দিয়েছ/ ভবিতব্যরেখা। জানি ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠাটিই/ শেষ নয়, শুরু', লাইনগুলো উলেস্নখ করে ভাল লাগার কথা জানিয়েছেন। আবার নির্লিপ্ত নয়নের 'আমার ঘরটি গভীর হতে হতে একমুষ্টি রাত ঢুকে পড়লো' পড়ে বিষণ্নতায় ঘরটাই ভেসে যাচ্ছে বলে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। মামুন খানের 'ঢেউ ছেড়ে জল-কাদা মল ছেড়ে/ হূদয়ের পাড়ে এসে যখন দাঁড়াও/ মনে হয়, এই প্রথম দেখছি- ভোরের পৃথিবী'কে বলেছেন বড় সি্নগ্ধ। আপন মাহমুদের 'অথচ তার মুখের দিকে/ তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নি জীবনে একটাও প্রজাপতি তার/ খোঁপায় বসেছে' কে বড্ড গভীর বলে উলেস্নখ করেছেন। সে সঙ্গে আয়োজন সম্পর্কে অনুভূতি ব্যক্ত করেন অসাধারণ একটা কালেকশন বলে। আলতাফ হোসেন 'খুব ভালো উদ্যোগ' বলে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

'লিটল ম্যাগাজিন আর ব্যবসা এক সঙ্গে হয় না' শীর্ষক আব্দুলস্নাহ আবু সায়ীদের সাক্ষাৎকারের উপর প্রথম মন্তব্যটি মোহাম্মদ নূরুল হকের। তার মতে, আব্দুলস্নাহ আবু সায়ীদের সাক্ষাৎকারের উত্তরগুলো শতভাগ সত্য। সে সাথে এও সত্য, লিটলম্যাগ কখনো কোনো যুগের দাবি মেটায় না, নতুন যুগের সৃষ্টি করে। আব্দুলস্নাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বর যুগের দাবিতে সৃষ্ট একটি কাগজ। যে কাগজ বৈশ্বিক স্রোতের টানে স্বদেশেও একটি স্রোত সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেছিল মাত্র। তাই তার কাগজ কোনো যুগ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়নি। কথাগুলো তার মুখ থেকে শুনতে পারলেই তার সাহিত্যপ্রেম ও আন্তরিক সততার সাক্ষর পেতাম।' এরপর সাবরিনা আনাম উলেস্নখ করেন, 'সাক্ষাৎকারে তাঁর চিরায়ত পরিশীলিত রুচি ও আদর্শিক চেতনা নিয়ে হাজির হয়েছেন। লিটলম্যাগের বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করতে গিয়ে পক্ষান্তরে তিনি লিটলম্যাগ সম্পাদক-লেখকদের জন্য পথ নির্দেশ করেছেন।' জালাদী রায়, 'বরাবরের মতো আব্দুলস্নাহ আবু সায়ীদ এখানেও হূদয়গ্রাহী' বলে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।'

একমাত্র গল্পের নাম 'যাপিত জীবন'। লেখক একরামুল হক শামীম। গল্পটি সম্পর্কে মোহাম্মদ নূরুল হক অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে, 'খুব সাধারণ ও প্রথাগত একটি গল্প। সংলাপ রচনায় দৌর্বল্য নবিশি গল্পকারদের প্রাথমিক প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও চিরকালীন অনুভবকে সম্মান দেখানোর জন্য গল্পকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।' ফাতেমা আবেদীন নাজলা, মোহাম্মদ নূরুল হককে উদ্দেশ করে বলেন, 'এই লেখাটা আমার খুব প্রিয় একটা লেখা। এই গল্পটি পড়তে গিয়ে কোথাও থামতে হয়নি। এটাই একটা গল্পের বড় যোগ্যতা হতে পারে।'

এ সংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন ছিল মনির ইউসুফ রচিত 'পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে : দ্বিতীয় দরিয়ানগর কবিতামেলা'। প্রতিবেদনটি সম্পর্কে প্রথম মন্তব্য পাওয়া যায় মোজাফফর হোসেনের। তিনি উলেস্নখ করেন, 'ভালো লাগলো। কবিতা মেলায় থাকতে পারলে আরো ভালো লাগতো।' এরপর মোহাম্মদ নূরুল হক সংশয়সূচক মন্তব্যটি করেন। তার মতে, 'এই উদ্যোগ ভালো। কিন্তু তিনশ কবির মিলনমেলা উলেস্নখ করায় খটকা লাগলো মনে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার মতো যদি ঘরে ঘরে কবিতার রচনা হিড়িক পড়ে তো কবির ভিড়ে পাঠকের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃতু্যবরণ করার ঘটনা ঘটলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।' কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার আপাতত সরল মন্তব্যের প্রতিউত্তরে মোহাম্মদ নূরুল হকের স্বরে ঝরে পড়ে কিছুটা বক্রোক্তি, 'ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি থেকে রুই-কাতলা বের হতেতো কখনো শুনিনি। রুই-কাতলা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে না, কবিরাও না। কবির প্রকৃত আরাধনা একার সন্ন্যাসে। প্রকৃত কবি মাত্রই নিভৃতচারী। হাত তুলে শপথ করা কবির কাজ নয়। কবি পাপপুণ্যে বিশ্বাসী নন, তাই তার শপথবাক্য উচ্চারণও অর্থহীন।' এ মন্তব্যের বিপরীতে মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রতিউত্তর, 'এক পাতায় ১১জন কবির কবিতা ছেপেছে ইত্তেফাক সাময়িকী। সব কবিতাই আমার কাছে সুপাঠ্য বলে মনে হলো।' এরপর সৈয়দ সাইফুর রহমান সাকিব বলেন, 'এ মহতী উদ্যোগের প্রয়াস আরো ব্যাপক আকারে হওয়া উচিত'। ফেসবুকে এ মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া চলে মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত। এরপর মন্তব্য-প্রতিক্রিয়াগুলো গ্রন্থনা শুরু হয়। উলিস্নখিত বিভাগগুলো ছাড়াও প্রতিক্রিয়ার বিভাগ নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন মোজাফফর হোসেন।

স্বপ্নভাষার অনুধাবন by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

য়নরত মানুষের আবক্ষ শরীর দুই হাতে ধরা বই। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েন বই পড়তে পড়তে আর চলে যান স্বপ্নের দেশে। এভাবেই আয়ারল্যান্ডের শিল্পী এরিন কুইন তাঁর স্বপ্ন বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। নানান দেশের স্বপ্নবান শিল্পীরা তুলে ধরেছেন তাদের বিষয়গুলোকে এভাবে।

দৃক আর পাঠশালা ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফির আয়োজনে নগরীর সাতটি ভেনু্যতে এ প্রদর্শনী একযোগে চলছে। বিশ্বের ২৯টি দেশ এ আয়োজনে অংশ নিয়েছে। এবারের ছবি মেলার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়_'স্বপ্ন'।

মানব মনের বিচিত্র ভাবনা, নানান দেশের মানুষের চেতনা, প্রকৃতি, পরিবেশ, সংগ্রাম, সাহসী মানুষের মুখ উঠে এসেছে এ প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশ, মেক্সিকো আর নাইজেরিয়ার তিন আলোকচিত্রী প্রয়াত নাইবউদ্দিন আহমদ, পেদ্রো মেয়ার এবং জে ডি ওখাইওজেইকেরেকে আজীবন সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে প্রদর্শনীর যাত্রা শুরু হয়।

আয়ারল্যান্ডের শিল্পী এরিন কুইন তাঁর স্বপ্ন ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন এভাবে_যখন কোনো ব্যক্তি বেঁচে আছেন কিন্তু ঘুমন্ত তখন তার স্বপ্ন বিছানায়_শান্ত হয়ে বিশ্রামরত। বাহুবন্দি হাতের নিচে তখন আপন স্বপ্ন তার জন্য অপেক্ষা করে। বিভিন্ন বয়সী মানুষের শয়নরত অবস্থানকে স্বাপি্নক একরঙা উপস্থাপনে শিল্পীর স্বপ্নের প্রকাশকে ব্যক্ত করে। আবছা আলোয় ঢেকে যায় শিশুমুখ। লরেন্স লেবলানক এসেছেন ফ্রান্স থেকে স্বপ্নকে এভাবে নিয়ে। স্বপ্ন বলতে ধূসরতা মনে হলেও তিনি ভেবেছেন প্রকৃতিতে মানুষের পাশাপাশি আকাশ, গাছ, মাটি, প্রকৃতির তাবৎ অনুষঙ্গও স্বপ্নে জড়িয়ে পড়ে। তাঁর দেশের প্রকৃতিকে সব সময়ই ভাবনায় রাখতে চান। স্বপ্ন নিয়ে তার ভাবনা একেবারেই অন্যরকম জীবন আর মৃতু্য দুয়ের স্বল্প পরিক্রমাকে তিনি উপলব্ধি করেন গভীরভাবে।

প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ 'নোনা পানির আহাজারি', দেবাশীষ সোমের 'ঢাকা : আমার স্বপ্ন আমার বাস্তবতা' শীর্ষক ছবিগুলো পানিহীন নাগরিকের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, ঢাকার জনজীবনের দুর্ভোগ মুক্তির স্বপ্ন উঠে এসেছে নান্দনিকরূপে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, দৃক গ্যালারি, অলিয়ঁস ফ্রাসেজ, চারুকলা ইনস্টিটিউট লিচুতলা, ব্রিটিশ কাউন্সিল, গ্যেটে ইনস্টিটিউট, এশিয়াটিক গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে একযোগে শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

সাহিত্যের প্রচলিত ছক, শাখা, ভাগ একটা গড় ব্যাপার

ত্তেফাক সাময়িকী : প্রথম গল্প লিখতে গিয়ে কি কখনো প্রশ্ন জাগেনি, কেন আপনাকে গল্পই লিখতে হবে? হাসান আজিজুল হক : আমি আজ পর্যন্ত কখনো বলিনি যে, প্রথম গল্প 'শকুন' লিখতে গিয়ে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, আমাকে গল্পই লিখতে হবে।

বরং এর ঠিক উল্টো কথাই আমি বরাবর বলে এসেছি। সেটা তো তোমাদের খেয়াল করার কথা। আমি বলেছি, বড় লেখা_উপন্যাসই বলো, আর যাই বলো আমার বরাবরই প্রথম ইচ্ছা ছিল । যে গল্পটির কথা বলছো, তার আগেই অন্তত একটি অসমাপ্ত দীর্ঘ লেখা_ছাপলে প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা হতে পারে_লিখেছিলাম। আর তার কিছুকাল পরে একটি পুরো ছোট উপন্যাসও লিখেছিলাম। টুকটাক গল্প বা কবিতাও কম লিখিনি। কাজেই প্রথম গল্প লেখার সময় আমি কখনো মনস্থ করিনি, আমাকে গল্পই লিখতে হবে। খুব ছোটবেলার একটা ঘটনার স্মৃতি মাথায় ছিল। সাঁঝের অাঁধারে রাতকানা এক শকুন এসে পড়েছিল খোলা খামারবাড়িতে। পথ-বিপথে ছোটা, এই বিভ্রান্ত শকুনটির পিছু নিয়েছিলাম আমরা। সেটার বর্ণনা দিয়েই গল্প শুরু হয়। গল্পের কলা-কৌশল, আঙ্গিক, কল-কব্জা কোনো কিছুরই ধারণা ছিল না। গল্পটি বের হওয়ার পর এ পর্যন্ত যত কথা শুনেছি, তা সবই পাঠকদের বিচার-বিশেস্নষণ এবং মন্তব্য। এ সমস্ত বিচার ও মন্তব্যের বৈচিত্র্যের মধ্যে আমার কথা ঘুরতে থাকে। বেশ বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। এই এতগুলো কথা হলো তোমার প্রশ্নের জবাব।

ইত্তেফাক সাময়িকী : সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে গল্প ফর্মটিকে আলাদাভাবে কেন বিবেচনা করা দরকার?

হাসান আজিজুল হক : এ ব্যাপারে বলি, তুমি তো বরং বেশ উল্টো কথাই বলে ফেললে। আমি আগাগোড়া বলে এসেছি, সেদিনও একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে বলেছি_সাহিত্যের প্রচলিত ছক, শাখা, ভাগ একটা গড় ব্যাপার। খুব নির্দিষ্ট কিছু নয়। তাহলে আমি কেন বলতে যাব, ছোটগল্প বলে খুব আলাদা একটা সাহিত্যের ফর্ম আছে?

ইত্তেফাক সাময়িকী : 'শকুন' আপনার লেখা পাঠক সাধারণের কাছে বহুল পঠিত প্রথম গল্প। এই গল্প লেখার আগেও আপনি বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন বলে আমরা জানি। পূর্বের লেখা সেই গল্পগুলোকে ছাপিয়ে 'শকুন' গল্পটি পাঠক এত উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করলো কেন?

হাসান আজিজুল হক : আগে সেই সব লেখালেখি সাধারণ পাঠকদের কাছে তো পেঁৗছায়নি। স্থানীয় কোনো মফস্বল-গঞ্জ থেকে প্রকাশিত ভুলেভরা পত্রপত্রিকা ক'জন পাঠকইবা পড়েছে? সেই সব গল্পের কথা আমার নিজেরও মনে নেই। মনে হয়, বেশি পাঠক পড়লেও নিশ্চয়ই মনে রাখার মতো কিছু সেখানে ছিল না। দু'একটি লেখা হয়তো কোনোদিন প্রকাশিতও হয়নি। কাজেই তোমার প্রশ্নের আর কি জবাব হতে পারে?

ইত্তেফাক সাময়িকী : এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত 'সমকাল' পত্রিকায় ১৯৬০ সালে। কীভাবে গল্পটি এই পত্রিকার দপ্তরে পেঁৗছেছিল? এই গল্পটি পেঁৗছানোর পেছনের গল্পটি একটু বলুন।

হাসান আজিজুল হক : এই পেছনের গল্পটাও আগে নানাভাবে বলেছি। আমার হাতের লেখা প্রায় প্রথম থেকেই দুষ্পাঠ্য_আজও তাই। কাজেই ওই গল্পটির মূল কপি একটা বাঁধানো খাতায় এখনো লেখা আছে। খাতায় গল্পটির মাথার পাশে গল্পটি লেখা শুরু করার তারিখটিও লেখা আছে। আমার বড় বোনের হাতের লেখা সুন্দর ছিল। তিনি গল্পটি কপি করে দিয়েছিলেন। রেজিস্ট্রি করে ডাকে পাঠিয়েছিলাম। ছাপা_অল্পদিন পরেই সমকালের মার্চ সংখ্যাতে বেরিয়েছিল। সমকালে নিজের লেখা চোখে দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম_সন্দেহ নেই।

ইত্তেফাক সাময়িকী : শুধু একটি বিদঘুটে ও হিংস পাখি শকুনকে নিয়ে একটি গল্প তৈরি হতে পারে তা আপনার ভাবনা জগতে কীভাবে ধরা দিল?

হাসান আজিজুল হক : জবাব তো আগেই দিলাম। কোনো পরিকল্পনা-টরিকল্পনার ব্যাপার নেই। বরেন্দ্রের ঝাঁঝাঁ রোদের মধ্যে, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে, চৌকিতে বুকের তলায় বালিশ দিয়ে শুয়ে, একটা সরু নিভওয়ালা শেফার্স কলম দিয়ে এলেবেলেভাবে গল্পটি লেখা শুরু করি। আলো এত কম ছিল, নিজের লেখা নিজেই দেখতে পাই না। এই তো ব্যাপার।

ইত্তেফাক সাময়িকী : ঝপ করে একটি শকুন খামারবাড়িতে নামার পরে গাঁয়ের ছেলেরা তাকে দেখতে পেল। কিন্তু তারা শকুনটিকে ঘিরে একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করল। তার পিছু পিছু দৌড়াল এবং প্রায় সারা রাতে তারা মাঠে মাঠে শকুনটিকে তাড়িয়ে কাটালো। গল্পটির গল্পকার হিসেবে কেন এমন করেছেন বলে আপনি মনে করেন?

হাসান আজিজুল হক : কোনো কারণ নেই। ঘটনাটি ওরকমই ছিল। গল্প বেরিয়ে এসেছে লেখার পরে। আমি লিখতে লিখতে এটা-ওটা-সেটা ভেবে থাকতে পারি। কিছু মিশেল কর্মও করে থাকতে পারি। কিন্তু সেটা কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে করেছিলাম বলে কোনোমতেই আমি মেনে নিতে পারবো না। কাজেই প্রশ্নের জবাব যদি পেতেই হয়, তাহলে গল্পটি পড়ে পাঠকরা নিজেরাই এই প্রশ্নের জবাব বের করে নেবেন।

ইত্তেফাক সাময়িকী : গল্পে কিশোরদের মুখের কথার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও বিত্তের কিশোর ছেলেরা সংঘবদ্ধভাবে কেন একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? বিশেষত শকুনের ওপর সেই কিশোর বালকরা নানাভাবে আনন্দমাখা অত্যাচার করতে উৎসাহী হয়ে উঠল কেন?

হাসান আজিজুল হক : সরল জবাব হচ্ছে, কোথাও কারো কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সাধারণভাবে জিনিসটা নাও না! গাঁয়ের ছেলে-মেয়েরা দুষ্টুমি করে বেড়ায় না! মানুষের উপদ্রবও করে, ক্ষতিও করে ফেলে। এই কারো মাচা থেকে শসা চুরি করছে, কারো গাছ থেকে বাতাবিলেবু পেড়ে ফুটবল খেলছে। পাখির বাচ্চা কেউ পুষছে, কেউ মেরে ফেলছে। ধূসরিত, গরিব, ছন্নছাড়া ছেলেগুলোর স্বভাব নানারকম। সকলের অবস্থাও একরকম নয়। কেউ সচ্ছল। কেউ দুপুরের খাওয়ার পর আর কিছু খেতে পারেনি। কেউ গরু চড়ায়, কেউ স্কুলে যায়। সবারই পরনে নোংরা পোশাক, ধুলায় ধুলায় ধূসরিত এইসব বালক যদি দেখতে পায়, বিরাট এক শকুন তাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে, তখন তাকে নিয়ে মজা করা, সারা প্রান্তর জুড়ে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো, তার পালক খসিয়ে নেয়া_এসব তো করবেই। এটাই স্বাভাবিক। তাই-ই তারা করছে। আর আমি সেটা ফোটাতে গিয়েই অবিকল তাদের মুখের ভাষা ব্যবহার করেছি। আর তাদের কথা ও চিন্তার মধ্যে যেসব কথা লিখেছি সেসব কিছুটা আন্দাজ করেছি। যেমন_পাখিটাকে সুদখোর মহাজনের সঙ্গে তুলনা কিংবা গল্পের একেবারে শেষে অবৈধ, অসামাজিক যৌন সম্পর্ক, আর প্রায় পশু জীবন হয়তো যোগ করেছি। তখন ভাবিনি, এখন ভাবি_লেখা হয়তো এরকম করেই হয়।

ইত্তেফাক সাময়িকী : ৫০ বছর আগে 'শকুন' গল্পটি লিখেছেন আপনি। গল্পটি প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। এখন যদি এই গল্পটির দিকে আবার ফিরে তাকান তাহলে কীভাবে এই গল্পের গল্পকার হিসেবে গল্পটি মূল্যায়ন করবেন?

হাসান আজিজুল হক : এর এক কথায় জবাব হচ্ছে, সাধারণত আমি আমার পুরানো দিনে ফেলে আসা লেখাগুলো আবার কখনোই পড়ি না। 'শকুন' যদি পড়ি, আবার কী মনে হবে সে জল্পনা-কল্পনা করতে চাই না।

ইত্তেফাক সাময়িকী : তাহলে আপনার গল্পের নন্দন ভুবনটি কোথায়?

হাসান আজিজুল হক : আমার গল্পের নন্দন ভুবনটি হচ্ছে, ঠিক এই_মাটির পৃথিবীর কোনো কোনো ভূ-খণ্ডের মানুষ আর তার মৌলিক বেঁচে থাকাটার মধ্যে।

জনতার নিয়ন্ত্রণে কায়রো

মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নামা মানুষের বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। গতকাল রোববার কায়রোর কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ার ছিল বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। স্কয়ারের আশপাশ ও বিভিন্ন রাজপথে ট্যাংকসহ সেনাসদস্যদের দেখা গেলেও তাঁরা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

বরং জনতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই আগ্রহ দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে। আলেকজান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরেও টানা ষষ্ঠ দিনের মতো বিক্ষোভ হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে।
নজিরবিহীন সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে মিসরের বিভিন্ন স্থানে লুটপাটসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির বেশ কয়েকটি কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দী পালিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত ১২৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিক্ষোভের খবর প্রচার করায় কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি সরকার-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ না করতে এবং সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কারফিউ সত্ত্বেও কায়রোর তাহরির স্কয়ারে অনেক বিক্ষোভকারী রাতভর অবস্থান করেন। গতকাল সকালের দিকে বিক্ষোভকারীরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লোকজন দলে দলে বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে এটি প্রেসিডেন্ট মোবারকের ৩০ বছরের শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশে পরিণত হয়। গতকালের বিক্ষোভে বিরোধীদলীয় নেতা মোহাম্মদ এলবারাদি যোগ দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সমাবেশস্থলে যাওয়ার মুখে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের দেহ তল্লাশি করেন। স্কয়ারে জড়ো হয়ে বিক্ষোভকারীরা মোবারকবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা বলেন, ‘মোবারক চলে যাও, তোমার জন্য বিমান প্রস্তুত রয়েছে’, ‘মোবারক, আর নয়’। একজন বিক্ষোভকারী আশা প্রকাশ করে বলেন, মোবারক পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। বিক্ষোভে যোগ দিতে যাওয়ার পথে আরেকজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘মিসরের জনগণ আমূল পরিবর্তন চায়। তার শুরু হতে হবে প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে।’ এলবারাদি বলেন, ‘আমরা নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছি। মোবারককে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে।’
বিক্ষোভের মধ্যে কায়রোসহ বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে, আলেকজান্দ্রিয়ায় ব্যাপক লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন দল বেঁধে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় একজন অভিযোগ করেন, এই লুটপাটের সঙ্গে সরকারের পুলিশ বাহিনী জড়িত। লুটপাটের সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে তাঁরা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন বলেও ওই ব্যক্তি জানান। আলেকজান্দ্রিয়া শহরে একটি সুপার মার্কেটেও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কায়রোতে একটি জাদুঘর লুটপাটের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রত্নসম্পদের জন্য বিশ্বখ্যাত মিসরের এ বিষয়ক সর্বোচ্চ পরিষদের মহাসচিব জাহি হাওয়াস জানান, লুটপাটের উদ্দেশ্যে দুই ব্যক্তি ছাদ দিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করে। তারা কোনো কিছু নিতে না পারলেও কিছু জিনিসের ক্ষতি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারাগারের নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় বন্দীরা কারাগার ভেঙে পালিয়ে গেছে। কায়রোর উত্তরাঞ্চলের একটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে আটজন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনো কারাগারে বন্দীরা দাঙ্গা সৃষ্টি করে ফটক ভেঙে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের মধ্যে দেশটির নিষিদ্ধঘোষিত দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ৩৪ নেতা-কর্মীও রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ওই নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তাহরির স্কয়ারের আশপাশে গতকালও সেনাসদস্যদের ট্যাংক নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়। আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে সেনাসদস্যদের সতর্ক অবস্থান লক্ষ করা গেছে। তবে তাঁদের আগের দিনের মতো অ্যাকশনে যেতে দেখা যায়নি। বরং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেনাদের আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। বিক্ষোভকারীরা ট্যাংকের ওপরে উঠে মোবারকবিরোধী স্লোগান দেন। সেনাসদস্যদের সঙ্গে তাঁদের কোলাকুলিও করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা একজন সেনাসদস্যকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে থাকেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট মোবারক গতকাল দেশটির সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
গতকাল কায়রোসহ বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে পুলিশ দেখা যায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মোবারক এখন বিক্ষোভ দমনে সেনাসদস্যদের দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। আর এই উদ্দেশ্যেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বিশ্লেষকেরা এও বলছেন, রোববার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেনাসদস্যদের আচরণ দেখে মন হয় না জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মোবারককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায় তাঁরা নেবেন। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর তাহরির স্কয়ারের ওপর দুটি জঙ্গি বিমান ও একটি হেলিকপ্টারকে বারবার চক্কর দিতে দেখা গেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মিসরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। মিসরের পরিস্থিতি নিয়ে গত শনিবার জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পরে হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শান্ত থাকতে এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা ও রাজনৈতিক সংস্কার এগিয়ে নিতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা নিরস্ত্র জনগণের প্রতি কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ না করতে ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের মিসর ভ্রমণ না করতে সতর্ক করে দিয়েছে। কায়রোতে মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো মার্কিন নাগরিক মিসর ছাড়তে চাইলে তাকে সহায়তা দেওয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি যুবসংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি।
দেশের মোবাইল ফোন কম্পানিগুলোতে বিদেশি জনবল নিয়োগের পরিমাণ মোট জনবলের ১ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। আর সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা), সিএফও (প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা) এবং সিটিওর (প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা) মতো ব্যবস্থাপনা বা ঊর্ধ্বতন নির্বাহীর পদগুলোর ৫০ শতাংশে বাংলাদেশিদের নিয়োগ করতে হবে। যেসব মোবাইল ফোন কম্পানি এই শর্ত পূরণ করবে না, তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় দেশের মোবাইল ফোন কম্পানিগুলোর লাইসেন্স নবায়নের জন্য যে খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করেছে, তার ৩৪ দফায় ‘এমপ্লয়মেন্ট রেগুলেশন অব দ্য কম্পানি’ পর্বে এই শর্তের কথা জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেলিযোগাযোগ খাতে দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যেই এ শর্ত আরোপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের স্বার্থেই মোবাইল ফোন কম্পানিগুলোর উঁচু পদগুলোতে দেশি জনবল থাকা উচিত বলে আমাদের ধারণা।’
মোবাইল অপারেটররা এ ধরনের শর্ত আরোপের এখতিয়ার ডাক ও টেলিকম মন্ত্রণালয় রাখে কি না তা জানার চেষ্টা করছে। তাদের ধারণা, বিষয়টি বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে না। অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) সেক্রেটারি জেনারেল আবু সাইদ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা খসড়া নীতিমালার বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখছি। আইনগত অসংগতিসহ এ নীতিমালা সম্পর্কে আমাদের মতামত ৯ ফেব্র“য়ারির মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে জানাব।’
এদিকে খসড়া নীতিমালায় লাইসেন্স নবায়ন এবং স্পেকট্রাম ইকুইজিশন ফিসহ অন্য যেসব চার্জের কথা বলা হয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে সরকার চারটি মোবাইল ফোন কম্পানির কাছ থেকে এককালীন রাজস্ব আয় করবে ১৪ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। লাইসেন্স নবায়ন ও স্পেকট্রামের জন্য গ্রামীণফোনকে সাত হাজার ৫৬ কোটি, বাংলালিংককে তিন হাজার ৩০০ কোটি, রবিকে তিন হাজার ১৬৩ কোটি এবং সিটিসেলকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা এককালীন দিতে হবে।
প্রসংগত, চলতি বছরের ১১ নভেম্বরের আগেই মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও সিটিসেলের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এ চার মোবাইল ফোন অপারেটরের গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকসংখ্যা ও গ্রাহকপ্রতি আয়ের ভিত্তিতে আগামী ১৫ বছরে তাদের সম্ভাব্য আয় নির্ধারণ করে লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে তার ১৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায়ের পরোক্ষ প্রস্তাব রয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকপ্রতি মাসে আয় ছিল গ্রামীণফোনের ২২৭, বাংলালিংকের ১৬০, রবির ১৯৭ ও সিটিসেলের ১৮০ টাকা। আর গ্রাহক ছিল গ্রামীণফোনের দুই কোটি ৮০ লাখ, বাংলালিংকের এক কোটি ৮০ লাখ, রবির এক কোটি ১০ লাখ এবং সিটিসেলের ১৯ লাখ। এই গ্রাহকসংখ্যা ও গ্রাহকপ্রতি আয় অনুযায়ী লাইসেন্স নবায়নের পর আগামী ১৫ বছরে এ চার কম্পানির সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রামীণফোন ৯০ হাজার ৭২০ কোটি, বাংলালিংক ৫৮ হাজার ৩২০ কোটি, রবি ৩৫ হাজার ৬৪০ কোটি এবং সিটিসেলের ছয় হাজার ১৫৬ কোটি টাকা সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছে। এই সম্ভাব্য আয়ের ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব হিসেবে আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা লাইসেন্স নবায়নের সময়ই আদায়ের পক্ষে খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে।
কবে নাগাদ এ নীতিমালা চূড়ান্ত হতে পারেএ প্রশ্নে ডাক ও টেলিযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব সুনীল কান্তি বোস গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিষয়ে সময় বাড়াতে চাচ্ছেন। তবে চার মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এটি চূড়ান্ত করা হবে। জনবল নিয়োগের শর্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, বিষয়টি প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

সীমাছাড়া বখাটেপনা

ভ টিজিং বা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে ওঠার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারির মধ্যেও বখাটেদের উৎপাত থেমে নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যৌন হয়রানির ঘটনা। সীমাহীন হয়ে উঠছে বখাটেদের উৎপাত।

এমনকি স্কুলশিক্ষকের কাছেও নিরাপদ নয় ছাত্রীরা। গতকাল রবিবার এ রকমই এক ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অপরাধে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বগুড়ায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ জানানোয় কলেজশিক্ষক বাবাকে রবিবার রামদা দিয়ে কুপিয়েছে এক বখাটে যুবক। গুরুতর আহত ওই শিক্ষক এখন হাসপাতালে। বরগুনায় বখাটেপনার শিকার হয়েছেন এক নববিবাহিত গৃহবধূ। যৌন হয়রানির প্রতিবাদে জুতাপেটা করতে চাওয়ায় প্রতিশোধ হিসেবে এক বখাটে শনিবার ওই গৃহবধূর ওপর হামলা চালিয়ে তাঁর জিহ্বা কেটে দিয়েছে।
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে সদর উপজেলার স্বল্পযশোদল দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুর রহমানের যৌন হয়রানির শিকার হয় পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রী। অভিযোগে জানা যায়, স্কুলের অফিস কক্ষ ঝাড়ু দেওয়ার কথা বলে ওই ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে যৌন হয়রানি করেন ওই শিক্ষক। মেয়েটি বাড়িতে গিয়ে এ ঘটনা তার মা-বাবাকে জানায়। এ ঘটনা শুনে শত শত নারী-পুরুষ স্কুলে এসে প্রধান শিক্ষককে তাঁর কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। তারা প্রধান শিক্ষককে মারধর করে এবং তাঁর বিচারের দাবিতে স্কুলমাঠে বিক্ষোভ করতে থাকে। খবর পেয়ে কিশোরগঞ্জ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং বিষয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অবহিত করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুর রহমানকে তিন মাসের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক মাসের কারাদণ্ড দেন। কিশোরগঞ্জের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকী এ রায় দেন। রফিকুর রহমানের বাড়ি কিশোরগঞ্জ শহরের তারাপাশা এলাকায়।
কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন জানান, রফিকুর রহমানকে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বগুড়া অফিস জানায়, বখাটে যুবকের রামদার আঘাতে আহত আকতার আলম নিশিন্দারা ফকির উদ্দিন (এফইউ) স্কুল ও কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক। তাঁকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত শিক্ষক ও তাঁর সহকর্মীরা জানান, গতকাল বিকেলে কলেজ শেষে তিনি যখন বাসায় ফিরছিলেন, তখন বখাটে যুবক শাকি (১৯) তাঁর পথ রোধ করে তাঁকে রামদা দিয়ে আঘাত করে। তাঁর মাথা লক্ষ্য করে প্রথম আঘাত করতে গেলে তিনি দৌড় দেন। দৌড়ে কিছু দূর গিয়ে তিনি পড়ে গেলে ওই বখাটে তাঁর ডান হাতে কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
আকতার আলমের সহকর্মী গণিত বিভাগের প্রভাষক জাহাঙ্গীর হোসেন মিলকী জানান, তিনি বাড়ি ফেরার পথে হৈচৈ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন আকতার। স্কুল শাখার শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের সহায়তায় তাঁকে শজিমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের ইন্টার্নি চিকিৎসক ডা. লিলি জানান, আকতার আলমের বেশ রক্তক্ষরণ হয়েছে। মাথার আঘাত গুরুতর না হলেও হাতের চোট মারাত্মক। তবে বর্তমানে তিনি বিপদমুক্ত।ত্ম
চিকিৎসাধীন আকতার আলম জানান, তাঁর বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। সেই মেয়েকে প্রতিনিয়ত রাস্তায় উত্ত্যক্ত করাসহ নানাভাবে হেনস্তা করছিল শাকি নামের এক বখাটে। সে নিশিন্দারা ফকির উদ্দিন (এফইউ) স্কুল ও কলেজের স্কুল শাখার শিক্ষক নূরুল হুদার সম্বন্ধীর ছেলে এবং পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হায়দার আলীর ভাতিজা। তিনি নিজে ওই যুবককে কয়েকবার ডেকে উত্ত্যক্ত করতে নিষেধ করেন। কিন্তু তাতে সে কর্ণপাত করেনি। গত মাসে একইভাবে স্কুলের গেটে এসে তাঁর মেয়ের সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে স্কুল ও কলেজ শাখার কয়েকজন শিক্ষক শাকিকে আটক করেন। এ সময় নূরুল হুদা বিষয়টি মধ্যস্থতা করেন। তিনি নিজ জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেন। সে সময় শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে একটি মুচলেকা তৈরি করলেও সেটি নূরুল হুদা নিজের কাছে রেখে দেন। গতকাল বাসায় ফেরার পথে আকতারের ওপর রামদা নিয়ে হামলা চালায় শাকি। ঘটনার পর থেকে বখাটে শাকি পলাতক।
আকতারের ওপর হামলার বিষয়ে শাকির ফুফা ও স্কুল শাখার শিক্ষক নূরুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তারা ছেলেকে ধরে এনে মারপিট করার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে সে এমনটি করতে পারে।’ তবে শাকিই যে এ কাজ করেছে, তা নিশ্চিত নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘আকতার সাহেব বলছেন শাকি তাকে মেরেছে। অন্য কেউ তো তা বলেনি।’
বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হায়দার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। পরে আমার বক্তব্য জানাব।’
বগুড়া সদর থানার ওসি এ কে এম খালেকুজ্জামান বলেন, থানায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি। তবে এমন ঘটনা ঘটলে অবশ্যই বখাটেকে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ বেতাগী গ্রামের গৃহবধূর (২০) শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে শনিবার রাতে তাঁর জিহ্বা কেটে নেওয়া প্রতিবেশী বখাটে শাহজালালকে (২৫) রাতেই বেতাগী থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আহত গৃহবধূকে বেতাগী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত গৃহবধূর মা জাহানারা বেগম জানান, তাঁর মেয়ে বেতাগী ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। দুই বছর ধরে প্রতিবেশী আবদুল গনি হাওলাদারের ছেলে শাহজালাল তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে আসছে। সীমাহীন উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর পরিবার মেয়েকে ওই বখাটের সঙ্গেই বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই বখাটে ও তার পরিবার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। বছরখানেক আগে বেতাগী উপজেলার রানীপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দেয় তাঁর পরিবার।
যৌন হয়রানির শিকার গৃহবধূর পরিবারের অভিযোগ, গত ১০-১২ দিন আগে তিনি বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। সাত-আট দিন আগে শাহজালাল দিনের বেলায় ওই বাড়িতে গিয়ে তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায়। গৃহবধূ সেদিন ঘরের দোতলায় উঠে দরজা বন্ধ করে নিজেকে রক্ষা করেন এবং শাহজালালকে জুতাপেটা করার ভয় দেখান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহজালাল শনিবার রাতে কৌশলে ঘরে ঢুকে আবার তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায়। তাঁর বাধার মুখে একপর্যায়ে সে তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে চলে যায়। এলাকাবাসী এ সময় ডাকাত এসেছে বলে চিৎকার করতে থাকে। বেতাগী থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং শাহজালালকে গ্রেপ্তার করে। বেতাগী হাসপাতালের চিকিৎসক জানান, আহত গৃহবধূর জিহ্বায় পাঁচটি সেলাই দিতে হয়েছে। মাথায় কোপের আঘাত রয়েছে। নাক থেঁতলে গেছে।
বেতাগী থানার উপপরিদর্শক সেলিম জানান, জাহানারা বেগম বাদী হয়ে মামলা করেছেন। জাহানারা বেগম ও তাঁর স্বামী আবদুল আজিজ জানান, তাঁদের মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

নরওয়ের পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ অ্যাসাঞ্জ

রওয়ে থেকে প্রকাশিত পত্রিকা আফটেনপোস্টেন-এর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, গোপন মার্কিন কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে তারা ভিন্নধারার সংবাদমাধ্যম উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ক্ষিপ্ত করেছে। আফটেনপোস্টেন নিজেদের মর্জিমতো বার্তাগুলো প্রকাশ করার কারণেই অ্যাসাঞ্জের এই ক্ষোভ।
গত ডিসেম্বর থেকে আফটেনপোস্টেন নিয়মিতভাবে উইকিলিকসের ফাঁস করা প্রায় আড়াই লাখ গোপন মার্কিন কূটনৈতিক বার্তা নিজেদের মর্জি অনুযায়ী প্রকাশ করে আসছে।
গত নভেম্বরে প্রথম গোপন কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেয় উইকিলিকস কর্তৃপক্ষ। ওই সময় তারা ঘোষণা দেয়, তাদের হাতে এ ধরনের আড়াই লাখের বেশি বার্তা রয়েছে।
ওই বার্তাগুলো নিয়মিতভাবে প্রকাশ করার জন্য বিশ্বে বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় পাঁচটি পত্রিকার সঙ্গেও চুক্তি করে উইকিলিকস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আফটেনপোস্টেন ওই পাঁচটি পত্রিকার মতো কোনো চুক্তি বা শর্ত মেনে বার্তাগুলো প্রকাশ করছে না। নরওয়ের ওই পত্রিকা কর্তৃপক্ষের মাত্র তিনজন জানেন কীভাবে উইকিলিকসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ওই সব গোপন নথি পাওয়া গেছে।
আফটেনপোস্টেন-এর বার্তা সম্পাদক ওলে এরিক আলমলিদ বলেন, ‘এগুলো (গোপন নথি) পাওয়ার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শুধু একটি ই-মেইলের মাধ্যমে এগুলো আমাদের হস্তগত হয়নি। তবে আমরা এর জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করিনি এবং এগুলো দেওয়ার বিনিময়ে কোনো শর্তও আরোপ করা হয়নি। আমাদের স্বাভাবিক কঠোর সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণ করেই আমরা এই বার্তাগুলো প্রকাশ করতে পারি।’
নরওয়ের রাজধানী ওসলোতে সুসজ্জিত কার্যালয়ে ৩০ জন সংবাদকর্মী দিনরাত পরিশ্রম করে সতর্কতার সঙ্গে ওই আড়াই লাখ গোপন মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে। উইকিলিকস যেভাবে বুঝেশুনে সতর্কতার সঙ্গে ওই নথিগুলো প্রকাশ করছে, সেই নীতি না মেনে আফটেনপোস্টেন তাদের নিজেদের মর্জিমাফিক আগেভাগেই বিভিন্ন বার্তা প্রকাশ করে দিচ্ছে।
চলতি মাসের শুরুতে অ্যাসাঞ্জ নরওয়ের একটি অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকাকে বলেছিলেন আফটেনপোস্টেন তাদের ‘মিডিয়া পার্টনার’।
তবে তাঁর এই দাবি পুরোপুরি সমর্থন করে না ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। অ্যাসাঞ্জের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পাঁচটি পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, দের স্পিগেল, এল পাইস ও লা মঁদ এবং উইকিলিকস হিসাব করে নিজেদের নীতিমালা অনুযায়ী গোপন বার্তাগুলো ফাঁস করবে। কিন্তু নরওয়ের পত্রিকাটি ওই নীতিমালা না মেনে নিজেদের মতো করে গোপন নথিগুলো প্রকাশ করে দিচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহে পত্রিকার পাতাগুলোয় ওই সব গোপন কূটনৈতিক বার্তার বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। একটি সংবাদে জানানো হয়, ইসরায়েল গাজার অর্থনীতি ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল, আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে একটি বাণিজ্যিক কৃত্রিম উপগ্রহের ছদ্মবেশে একটি গোয়েন্দা উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করেছে।
অন্য একটি খবরে জানানো হয়েছে, দামেস্কে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলোর দূতাবাসে চালানো হামলায় সমর্থন দিয়েছে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ। এএফপি।

পিরামিড ভেঙে এখন পেটমোটা প্রশাসন

প্রশাসনের আদর্শ কাঠোমো ধরা হয় পিরামিড আকৃতিকে। এ দেশের প্রশাসনের মূল কাঠামোও এত দিন ছিল পিরামিড। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে সেটা ভেঙে হয়ে গেছে ‘পেটমোটা প্রশাসন’। আর এ কারণে দেখা দিচ্ছে নানান ‘অসুস্থতা’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিকৃত চেহারার প্রশাসন আর চলতে পারছে না।
এর আশু নিরাময় দরকার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্ধারিত পদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে প্রশাসনিক কাঠামোর মাঝের দুই স্তর। আবার অর্ধেকের বেশি পদ খালি থাকায় নিচের দুই স্তর হয়ে গেছে সরু। ফলে মোটা পেট নিয়ে জনপ্রশাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ায় একে গতিশীল করতে গত দুই বছরে সরকারের ওপর মহল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ১১টি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি, শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেওয়ার সময় অডিটর জেনারেল অফিস থেকে আপত্তি তোলা হয়; কিন্তু সেটাও আমলে নেওয়া হয় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সংস্থাপনসচিব ড. এ এম এম শওকত আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি অব্যাহত রাখার জন্য প্রথম কাজই হচ্ছে শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শূন্য পদ না থাকার পরও অতিরিক্ত পদোন্নতির কারণে প্রশাসনের কাঠামো অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। এতে কাজের স্বাভাবিক গতিও হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় পদায়নের জন্য তদবিরের মাত্রাও বেড়ে গেছে। পদায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট
কম মেধাবীরা তদবিরের মাধ্যমে ভালো পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। আর মেধাবীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। ওএসডি হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরাও একই পথ ধরেন। সব মিলিয়ে গোটা জনপ্রশাসন মেধাশূন্য হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসন সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ এখনই নেওয়া প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খানও বলেন, প্রশাসনের মূল কাঠামো ভেঙে পড়ায় পদে পদে ফাইল আটকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই এ প্রশাসনের কাছ থেকে আর ভালো কিছু আশা করা যায় না। নির্ধারিত পদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে অহেতুক ওএসডি করে রাখতে হচ্ছে। এঁদের কাছ থেকে সার্ভিস পাওয়া না গেলেও তাঁদের পেছনে ব্যয় হচ্ছে সরকারের বড় অঙ্কের অর্থ। এসব কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় হচ্ছে গোটা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো। জরুরি হয়ে পড়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার।
তবে সংস্থাপনসচিব ইকবাল মাহমুদের মুখে ভিন্ন সুর। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রশাসন কাঠামোর তেমন কোনো বিকৃতি হয়নি। কাজের স্বাভাবিক গতি অব্যাহত আছে। বরং উপসচিব পর্যায়ের ডেস্ক থেকেই অনেক কাজ শুরু হয়। এতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এক ধাপ কমে এসে কাজ দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে।’
‘পদ না থাকার পরও বিপুলসংখ্যাক কর্মকর্তাকে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি কেন দেওয়া হয়েছে?’জানতে চাইলে সচিব সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আমরা সুপার নিউমারি (নির্দিষ্ট মেয়াদে অস্থায়ী পদ) পদ সৃষ্টি করছি।’
উল্লেখ্য, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের জন্য নির্ধারিত পদের বাইরে এ মুহূর্তে ৭৮৯ জন অতিরিক্ত কর্মকর্তা থাকলেও সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু উপসচিবের জন্য, মাত্র ২৬০টি।
‘স্বাভাবিক থাকলে কাজের গতি বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে কিছু দিন পর পর সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নানা ধরনের নির্দেশনা পাঠাচ্ছে কেন?’জানতে চাইলে সংস্থাপনসচিব বলেন, এটি রুটিন ওয়ার্ক।
এক হিসাবে দেখা গেছে, পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হওয়ায় ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যাঁদের কোনো কাজ নেই) হয়ে আছেন ৪৯৩ জন। এ ছাড়া শূন্য পদের অভাবে পদায়ন না পাওয়া বিভিন্ন স্তরের প্রায় ৯০ জন কর্মকর্তাকে প্রেষণে প্রশাসনের বাইরে সরকারের অন্যান্য দপ্তরে নিয়োগ দিতে হয়েছে এবং তাঁদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ প্রেষণ-ভাতা দিতে হচ্ছে। এতে করেও সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে গত দুই বছরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যে ১১টি বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে২০০৯ সালের ১২ মার্চ খোদ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দেয় তাঁর কার্যালয়। যাঁদের কারণে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয় ওই চিঠিতে। এ ছাড়া সচিবরা রুলস অব বিজনেসের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে প্রশাসনে ফাইলজটের সৃষ্টি করছেন অভিযোগ এনে ওই বছরের ২৬ এপ্রিল অর্থসচিব ও ৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং পরের বছর ২৪ নভেম্বর আবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব তিন দফা চিঠি ছাড়েন। ওদিকে তদবিরবাজদের চাপে মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ৪ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে সচিবালয়ের পাস ইস্যুর সংখ্যা সীমিত রাখাসংক্রান্ত সরকারের এক আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরে আনে।
এ ছাড়া ২০০৯ সালের ১ জুলাই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের উদ্দেশে একটি চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লাহ ওয়াহেদুজ্জামান। এ চিঠিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সর্বশেষ জারি করা প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণসংক্রান্ত আদেশের তথ্য, অনিষ্পন্ন পেনশন কেসের সংখ্যা ও নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ, অডিট আপত্তির সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণসহ ১১টি বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির ব্যাপারে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ সামান্যই। পেনশন নিষ্পত্তিতেও ঢিলেঢালা ভাবটাই চলছে। আর প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টির বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ফলে উপসচিব, যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিবের ডেস্ক থেকে যেসব নথি নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেগুলো কোনো কারণ ছাড়াই সরাসরি সচিব বা মন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সচিবালয় নির্দেশিকা অনুযায়ী নথি ছাড়ার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৭২ ঘণ্টা কার্যকর হচ্ছে না।
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাইল ছাড় করার ব্যাপারে নানা দিক চিন্তা করেন তাঁরা। নেতিবাচক মন্তব্য দিলে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বিরাগভাজন হয়ে ওএসডি হতে পারেনএমন আশঙ্কায় কোনো স্তরের কর্মকর্তাই ঝুঁকি নিতে চান না। আর পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা তো জুনিয়রদের অধীনে চলে যাওয়ায় এখন কাজের স্পৃহাই হারিয়ে ফেলেছেন।
এসব কারণেই মূলত বারবার নির্দেশ হাঁকার পরও তেমন ফল হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত প্রশাসনের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৯৫০ জনকে পদোন্নতি দিয়েছে। আর প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন ৬৯৭ জন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তিনজন সচিব, চারজন অতিরিক্ত সচিব ও তিনজন উপসচিব (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) প্রশাসনিক কাজের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ২৭ শতাংশ। একই সময় গত অর্থবছরে এ হার ছিল ২৯ শতাংশ।
তবে সংস্থাপনসচিব ইকবাল মাহমুদ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। শেষ ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসন কাঠামোর মাঝের দুই স্তরে যুগ্ম সচিবের জন্য নির্ধারিত ৪৩০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫৬৮ জন এবং উপসচিবের ৮৩০ পদের বিপরীতে আছেন এক হাজার ৪৮১ জন। অর্থাৎ এ দুই পদে অতিরিক্ত কর্মকর্তা আছেন ৭৮৯ জন। অন্যদিকে প্রশাসনের নিচের দুই স্তরসহকারী সচিবের জন্য নির্ধারিত পদ দুই হাজার ৯৪টি হলেও এ মুহূর্তে কর্মরত আছেন এক হাজার ৪৫০ জন ও সিনিয়র সহকারী সচিবের এক হাজার ৭৭৪টি পদের বিপরীতে আছেন ৭৭৩ জন। অর্থাৎ নিচের দুই স্তরে কর্মকর্তার ঘাটতি এক হাজার ৬৪৫ জন। পদ না থাকার পরও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে ৫৬৯ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়াতেই মূলত প্রশাসনিক কাঠামোর নিচের দিক সরু ও মাঝের স্তর মোটা হয়ে গেছে। আবার শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি না দিয়ে যুগ্ম সচিব পদে ২৪৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়ায় মাঝের স্তর আরো মোটা হয়ে গেছে।
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মরত ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশ করতে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও সরকারের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল আহমেদ আতাউল হাকিম কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্ধারিত পদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়ায় সরকারের বাজেটবহির্ভূত ব্যয় বেড়ে যায়, আর এটা আইন লঙ্ঘনের শামিল। কারণ একটি অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট হচ্ছে একধরনের আইন। যখন পদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেওয়া হয়, তখন অডিটর জেনারেল অফিস থেকে আপত্তি দেওয়া হয়। তবে সরকার যদি বিশেষ প্রয়োজনে নির্ধারিত পদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়া জরুরি মনে করে, সে ক্ষেত্রে সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Sunday, January 30, 2011

নতুন বিমানবন্দর কেন

দেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর আছে। এসব বিমানবন্দরের কোনোটারই ধারণক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা হয় না। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে এখন কক্সবাজার বিমানবন্দরকেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর। বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে এই বিমানবন্দরের। তবে এখন ক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী এ বিমানবন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টির মতো বিমান ওঠানামা করলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলা যায়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় (পিক আওয়ারে) সর্বোচ্চ ১০টি বিমান ওঠানামা করে। এর মধ্যে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠানামাও যুক্ত। অর্থাৎ ঢাকায় বর্তমানের পাঁচ গুণ বিমান ওঠানামা এবং যাত্রীর পরিমাণ দ্বিগুণ হলেও এর জন্য হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই যথেষ্ট। তা ছাড়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ বিমানবন্দরের ক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তো রয়েছেই।
এ অবস্থায় সরকার আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে এ বিমানবন্দর করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি তার জন্য আড়িয়ল বিলের মতো স্থানকে নির্বাচন করা নিয়েও সমালোচনা আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এমন কোনো অগ্রাধিকার প্রকল্পের অঙ্গীকার ছিল না।
অবশ্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিমানবন্দরটিকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় বিমান চলাচলের পথে কেন্দ্রস্থলে (হাব) পরিণত করার চিন্তা আছে। এতে এ খাত থেকে দেশে প্রচুর রাজস্ব আসবে।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই-সমীক্ষা করা হয়নি। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিটি’ নামের একটি উপশহর গড়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দর ও সিটির জন্য আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই অধিগ্রহণের ফলে ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলায় বিস্তৃত মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলাধারটির প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কী ক্ষতি হবে, তা নিয়েও কোনো সমীক্ষা হয়নি।
পরিবেশবিদদের মতে, মিঠাপানি ও জীববৈচিত্র্যের বড় আধার এই বিল ধ্বংস করা হলে পরিবেশগত ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকার আশপাশে বন্যার প্রকোপও বাড়বে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম পর্যায়ে এখন ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সব সমীক্ষা করা হবে।
নতুন বিমানবন্দরের সিদ্ধান্ত: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। গত বছরের ২৯ আগস্ট প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা কমিটি সাতটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। এক. ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল, আমিরাবাড়ী, মোক্ষপুর ও মঠবাড়ী ইউনিয়ন। দুই. ত্রিশাল উপজেলার রামপাল, কানহর, কাঁঠাল ও বৈলর ইউনিয়ন। তিন. টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর। এই তিনের মধ্যে প্রথম প্রস্তাবের পক্ষে (ময়মনসিংহের ত্রিশাল) গত বছরের ৭ এপ্রিলের বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সুপারিশ করা হয়।
এরপর কমিটি ১৫ নভেম্বর আবার বিমানবন্দরের স্থান নির্বাচনের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের শিবচর ও রাজৈর, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়ল বিল এলাকা পরিদর্শন করে। ৩০ নভেম্বর বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব সাংবাদিকদের জানান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে আড়িয়ল বিলকেই চূড়ান্ত করার সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি।
গত ১২ ডিসেম্বর আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর এবং পাশেই বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
নতুন বিমানবন্দরের পক্ষে যুক্তি: মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার গত ৬ ডিসেম্বর স্থান নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠান বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। প্রতিবেদনে নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়, দেশে এখন ১৭টি বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বাড়ছে। ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে এর বর্তমান অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। ক্ষমতার ৮০ শতাংশ এখন ব্যবহূত হচ্ছে। এ বিমানবন্দরের একটি রানওয়ে এবং বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিমানযাত্রীর তুলনায় তা অপ্রতুল। এই বিমানবন্দরের চারদিকে আবাসিক এলাকা ও সেনানিবাস থাকায় ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। এর যাত্রী টার্মিনাল ভবন অপ্রশস্ত এবং পাঁচ স্তরের আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের যথেষ্ট সুযোগ নেই। এ ছাড়া বর্তমান বিমানবন্দরে সর্বশেষ প্রযুক্তির সুপরিসর উড়োজাহাজ এয়ারবাস এ-৩৮০ পরিচালনের ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এবং এর সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি।
পাল্টা যুক্তি: সরকারের এসব যুক্তি সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিমানের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এয়ারবাস কোম্পানির সর্বশেষ সংযোজন এ-৩৮০ উড়োজাহাজ এখন পর্যন্ত খুব কম এয়ারলাইনসই ব্যবহার করছে। ঢাকা থেকে যেসব গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট আছে, তাতে উড্ডয়ন ঘণ্টা ও যাত্রীর চাপ বিবেচনায় এখানে এ-৩৮০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সম্ভাবনা নেই। কারণ উড্ডয়ন ঘণ্টা বিবেচনা রেখে এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট পরিকল্পনা করে। কম দূরত্বে সুপরিসর উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করলে লাভ হয় না।
আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের জন্য জরুরি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও দক্ষ জনবল। এখানে বিশাল জায়গা বা অবকাঠামো মুখ্য নয়। ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতে টার্মিনাল ভবন আরও প্রশস্ত করা দরকার। সে জন্য বর্তমান বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত জমি আছে বলে সিভিল এভিয়েশন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এর পরও যদি স্থানসংকুলান না হয়, তাহলে বিমানবন্দরসংলগ্ন ১৩০ একর জমি কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হলো, সে প্রশ্ন উঠছে। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে এটা ইজারা দেওয়া হয়। পরে তা বাতিলও করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আবার তা ইজারা দেয় কান্ট্রি ক্লাব, গলফ ক্লাব, পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেল ইত্যাদি করার নামে। কিন্তু গত ১০ বছরে কিছুই করা হয়নি। বর্তমান সরকারের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ওই জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব করে। বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের ওই সব জমি ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরে সংসদীয় কমিটি ইজারাদারের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। তখন বিমানমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সরকারি জমি ফেরত নিতে মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভবিষ্যতে বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এই জমি দরকার হবে। কিন্তু এখন নতুন বিমানবন্দরের জন্য আড়িয়ল বিলের জমি অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, নতুন বিমানবন্দরকে এ অঞ্চলের বিমান চলাচলের কেন্দ্র করার কথা বলছে সরকার। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা বা সমীক্ষার ভিত্তিতে এ সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে? দুবাই ও সিঙ্গাপুর হাব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেশ দুটির বিমান সংস্থা এমিরেটস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের। এ দুটি এয়ারলাইনস এখন বিশ্বের শীর্ষপর্যায়ের বিমান সংস্থা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশে ও গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। তারা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে বিমান চলাচলে নিজ দেশের বিমানবন্দরকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। দুবাই ও সিঙ্গাপুর এমনিতে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র। তাদের রয়েছে আনুষঙ্গিক এমন সব সুবিধা, যা তাদের নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। ঢাকাকে দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মতো বিমান চলাচলের আঞ্চলিক কেন্দ্র করতে হলে তার জন্য পুরো রাজধানীকে ওই রকম পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে ঘিরে সরকারের এখন পর্যন্ত তেমন চিন্তা-পরিকল্পনার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
বিমান চলাচল বৃদ্ধির চিত্র: জানা গেছে, কুর্মিটোলায় বর্তমান বিমানবন্দরটির জমির পরিমাণ দুই হাজার একর এবং রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। রয়েছে পরিমিত প্রয়োজনীয় সুবিধাদি। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান চলাচল বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তাতে ২০২৫ সালে এখানে মোট ৫৭ হাজার ফ্লাইট পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। ২০১৫ সালে এটা ৩২ হাজার এবং ২০২০ সালে ৪২ হাজার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় ঢাকায় বিমান ওঠানামা করবে ১৪টি। ২০২০ সালে তা ২০ ও ২০২৫ সালে ২৯টিতে উন্নীত হতে পারে।
এই সমীক্ষা অনুযায়ী আগামী ২০ বছরে যাত্রীসংখ্যা তিন গুণ হতে পারে। বর্তমান সুবিধাদি ও রানওয়ে দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে। তবে কিছু আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির দরকার হবে এবং তা বর্তমান বিমানবন্দরেই করা সম্ভব।
বিমানসচিবের যুক্তি: আরেকটি বিমানবন্দর নির্মাণ কেন দরকার, এ প্রশ্নের জবাবে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহজালালে একটিমাত্র রানওয়ে, যদি কোনো কারণে কোনো প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে রানওয়েতে বসে পড়ে, সেটা সরানো না যায়, তখন তো পুরো বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়বে। আর এখানে আগামী ১০ বছরে বিমান চলাচল ও কার্গো বহন দ্বিগুণ হয়ে পড়বে। তা ছাড়া আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই।
তুলনামূলক পর্যালোচনা: দেশে-বিদেশে বিমান পরিবহন-বাণিজ্যে জড়িত একজন পরামর্শক একটি রানওয়ের কারণে নতুন বিমানবন্দর করার যৌক্তিকতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যের গেটউইক বিমানবন্দরে একটি রানওয়ে ছিল। সম্প্রতি তারা দুটি করেছে। কিন্তু একটি রানওয়ে থাকা অবস্থায় সেখানে বছরে সাড়ে তিন কোটি যাত্রী পরিচালন করা হতো। আর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের এখন পরিচালনক্ষমতা ৮০ লাখ, গত বছর প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী এখানে আসা-যাওয়া করেছে। তাঁর মতে, এখানে ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাহিদা মেটাতে আরেকটি বিমানবন্দর বা রানওয়ে নির্মাণ সমাধান নয়। এখানে জরুরি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করা দরকার। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে টারমাক ও টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত জমি শাহজালালেই আছে।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহজালালে বর্তমান রানওয়ের ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতার ৪০ শতাংশ ব্যবহূত হয়। জাপানের নারিতা বিমানবন্দরও একটি রানওয়ে দিয়ে চলছে। সেখানে ঢাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিমান ওঠানামা করে।
বিকল্প হিসেবে আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরকে পুনরুদ্ধার করে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে এবং শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ওড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে।
সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানের মতে, ‘প্রয়োজন হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের ট্যাক্সিওয়েকে দ্বিতীয় রানওয়েতে পরিবর্তন করার (পরীক্ষা সাপেক্ষে) সুযোগ আছে। এ ছাড়া রানওয়ের পশ্চিম দিকে কিছু কিছু স্থাপনার যুক্তিসংগত পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে দ্বিতীয় রানওয়েও নির্মাণ করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, বর্তমান রানওয়ের লাইটিং সিস্টেম, অ্যান্টিফগ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের আধুনিকায়ন, হাইটেক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
আড়িয়ল বিলে কারিগরি ঝুঁকি: সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ বাতাসের বিপরীতে করতে হয়। বাংলাদেশে বছরের ৭০ শতাংশ সময়কালে বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যায়। বাকি ৩০ শতাংশ সময়কালে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে থাকে। ফলে প্রায় ৭০ শতাংশ উড্ডয়ন ও অবতরণ হয় উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশনায়। বাকি সময় ৩০ শতাংশ দক্ষিণ-উত্তর দিকনির্দেশনায়। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েও উত্তর-দক্ষিণমুখী।
কিন্তু আড়িয়ল বিলটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। পশ্চিমে শেষ প্রান্তে পৌঁছে পশ্চিম-উত্তরে বেঁকে গেছে। তাই প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে পূর্ব-পশ্চিম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি তা হয়, তাহলে সারা বছর আড়াআড়ি বাতাসের (ক্রস-উইন্ডের) মধ্যে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে হবে। এটা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জটিলতা বাড়াবে, খরচও বাড়বে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আড়িয়ল বিলের মাটি মূলত পিটজাতীয় জৈব মাটি (গাছপালা পচে তৈরি হওয়া নরম মাটি)।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, বিলে বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি করতে পুরো এলাকা ২০-৩০ ফুট বালু দিয়ে ভরাট করতে হবে। কিন্তু এখানে গভীর জৈব মাটির (পিট সয়েল) স্তর থাকায় বিমানবন্দরসহ নির্মিত স্থাপনা দেবে যাওয়ার সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে থাকবে। ৪০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন ওজনের বিমান ওঠানামার জন্য জৈব মাটি বড় কারিগরি ঝুঁকি হিসেবে দেখা দেবে।

শেয়ারবাজার ধসের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশের শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয়ের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে তাদের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিষ্কার করে যে, বাজার কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট এসইসি, ডিএসই ও গবেষকদের কয়েকজনকে ডেকে এনে একটি নির্বাহী সেমিনারে গবেষণা সমীক্ষাপত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিপর্যয় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাজার বিশ্লেষণ করা হয়। এর পরপরই ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে।
গবেষণায় বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশের শেয়ারবাজার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার এবং বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার বিপর্যয়ের সঙ্গে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয়, পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ আয় ও মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে যে ব্যবধান তা কতটা বেড়েছে এবং ব্যবধানের কোন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে ও বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার পতন হয়েছে।
সেমিনারে এসইসি ও ডিএসইর দিক থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি বলতে চাইছে যে, দেশের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর্যায়ে (বাবলস) উপনীত হয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা বাবলস আছে কি না সেটা বলছি না, এটা বলবেন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমরা শুধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার যে পর্যায়ে বাবলস তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে ডিএসইর পরিস্থিতি লেখচিত্রে উপস্থাপন করেছি।’
গবেষকদের কাছে প্রশ্ন তোলা হয়, ’৯৬ আর আজকের বাজার তো এক নয়। জবাবে গবেষকদের তত্ত্বাবধায়ক আহসান হাবীব মনসুর বলেন, ‘বাজারের কতগুলো মৌলিক দিক (মার্কেট ফান্ডামেন্টাল) বিশ্বের সব দেশে এবং সব সময়ের জন্য একই।’
গবেষণা অনুযায়ী, প্রদর্শিত সব কটি দেশ ও ’৯৬ সালে বাংলাদেশে বাজার ধসের পরিস্থিতির তুলনায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্য পরিস্থিতি অনেক বেশি তীক্ষভাবে বাড়তে শুরু করে এবং এ সময় শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ আয় ও মূল্য আয় অনুপাত (পিই) এবং মূল্যসূচকের ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি অংশ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এসইসির তৎকালীন সদস্য মনসুর আলম, নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ, পরিচালক হাসান মাহমুদ, ডিএসইর তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, নির্বাহী আফজালুর রহমান, সিপিডির তারিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাসহ নীতিনির্ধারণী কয়েকটি বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান হাবীব মনসুরের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আবদুল ওয়াহাব ও সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক এই গবেষণা সমীক্ষাটি তৈরি করেন।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুধু বলব গবেষণাপত্রে পরিষ্কার একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই বার্তাটি এসইসি ও ডিএসইর কাছে পৌঁছে দিয়েছে।’ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই গবেষণার দিকনির্দেশনাটি পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো দেখলেই তার মধ্যে পরিষ্কার জবাব পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গবেষণা ধরে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, এর আগ থেকেই বাজার সামাল দিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসে এসে এসইসি বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা সতর্ক করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও ছাপে বলে জানান চেয়ারম্যান।
গবেষণার কিছু দিক: গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের আগে একটা বড় উত্থান হয়। যেমনটি হয়েছে ’৯৬ সালে বাংলাদেশের বাজারে। একই পরিস্থিতি পাওয়া যায় জাপানের নিক্কি, চীনের সাংহাই, আমেরিকার ন্যাসডাক, ভারতের বোম্বে-সেনসেক্স, হংকংয়ের হ্যাংসেং, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও সৌদি আরবের তাসি মূল্যসূচকে। বাংলাদেশে ডিএসইর ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূচক উত্থানকে গবেষণায় বিবেচনা করা হয়। তার আগের দুই বছরের সূচক পর্যালোচনাও ছিল এতে।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৫৭৪৫ দশমিক ৭৮, ডিএসআই সূচক ছিল ৪৭০০ দশমিক ৮৭ আর ডিএসই-২০ সূচক ছিল ৩১৩৪ দশমিক ৩৫। এ সময় বাজারের মূল্য আয় অনুপাত ছিল ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অন্যদিকে লভ্যাংশ আয় ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার ধসে পড়ার সময় লভ্যাংশ আয় ও বাজারের মূল্যস্তরের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হওয়ার উপাত্ত মেলে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উত্থানের হার বেশি থাকায় বড় ঝুঁকির সংকেত পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০০৯ সালের আগস্ট থেকে একটা বড় ধরনের উত্থান ছিল বাজারে। এ সময় বাজারের উত্থান সামলে নেওয়া হয় গ্রামীণফোনের বড় একটা আইপিও দিয়ে। ওই সময় বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের হয়ে পড়ে। আবার নতুন শেয়ার যুক্ত হলে সামলে ওঠে বাজার। কিন্তু ডিএসই ভুলভাবে সূচক হিসাব করায় প্রকৃত বাজারের চিত্র এতে প্রকাশ পায়নি।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরু হওয়ার পর বাজারে আবারও একটা দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যায়। গবেষণায় দেখানো হয়, এমনকি ডিএসই সঠিকভাবে সূচক হিসাব করলেও উত্থান ছিল দ্রুত ও তীক্ষ। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এ সময় বাজারের মৌলশক্তি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং লভ্যাংশ আয়ের সঙ্গে মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের সময় সেখানে বাজার পিইর সঙ্গে লভ্যাংশ আয়ের তুলনা করা হয় গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএসইর পিই সর্বাধিক ৩০ দশমিক ৬-তে ওঠে। তখন লভ্যাংশ আয়ের হার হয় ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাজার বিপর্যয়ের সময় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ২০ দশমিক ৩ (জানুযারি ’০৮) ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় (সেপ্টেম্বর ’০৭) পিই ছিল ১৪ দশমিক ৪৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। জাপানে বাজার (ডিসেম্বর ’৮৯) বিপর্যয়ের সময় পিই ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। চীনে (অক্টোবর ’০৭) পিই ছিল ১৮ দশমিক ৩ ও লভ্যাংশ আয় ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ, সৌদি আরবের (ফেব্রুয়ারি ’০৬) পিই ৪৭ দশমিক ৩ ও আয় ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ইউএসএর ন্যাসডাক (মার্চ ২০০০) স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ৩৫ দশমিক ৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
পরবর্তী পরিস্থিতি: ডিএসইর বাজারে ফেব্রুয়ারির শেষে এসে লভ্যাংশ আয় কমে ও পিই বাড়ে। তবে জুনে গ্রামীণফোন লভ্যাংশ দিলে পিই কিছুটা কমে আসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে মূল্যসূচক কিছুটা সংশোধনের মধ্যে ছিল। মধ্য মে পর্যন্ত ৫৫০০ সূচকের মধ্যে ওঠানামা করে বাজার। তারপর থেকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে দ্রুত বেড়ে চলে বাজার। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সূচক ৭৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এ পর্যায়ে আবার তীক্ষ উত্থান শুরু হয়ে ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক গিয়ে ঠেকে ৮৯১৮ দশমিক ৫১-তে। এরপরই ধসের কবলে পড়ে বাজার।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডিএসইর সূচকে এই বৃদ্ধি বাজারে মৌলশক্তির সঙ্গে যায় না। ফলে বাজারের উত্থানপ্রবণতা জানুয়ারির প্রথমভাগে বা ডিসেম্বরের শেষ সময়ে আর টেকসই হয়নি।’
আহসান হাবীব মনসুর গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুঁজি ও মুদ্রাবাজারের সব দিক নিয়েই এ গবেষণা করা হয়। আমরা এর মাধ্যমে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছি বাজারে। বলেছি, “বাজার অতি মূল্যয়িত।” ধারণা করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তাদের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’
গবেষণা ধরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গবেষণার ভিত্তিতে আমি তো মনে করি এখনো বাজার অতি মূল্যায়িত। কৃত্রিমভাবে বাজারকে সহায়তা দেওয়া কারও জন্যই শুভ হবে না।’

বিক্ষোভে জ্বলছে মিসর, সংঘর্ষে নিহত ৭৪

প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে অব্যাহত বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে পড়েছে মিসর। গতকাল শনিবার বিক্ষোভের পঞ্চম দিনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে ৭৪ জন নিহত হলো।

গণবিক্ষোভের মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন হোসনি মোবারক। গত শুক্রবার মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন তিনি। তবে নিজে পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন মোবারক। বিক্ষোভকারীরা তাঁর এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, মোবারককে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। এই দাবিতে তারা গতকাল কারফিউ ভেঙে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। এতে করে আরও বিপাকে পড়েছেন মোবারক।
বিক্ষোভের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট মোবারক (৮২) গতকাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ওমর সুলাইমানের (৭৫) নাম ঘোষণা করেন। এরপর একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী আহমেদ শফিকের নাম ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালে মিসরের ক্ষমতা নেওয়ার পর এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন মোবারক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করায় অনেকে ধারণা করছেন, মোবারক হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এর আগে শুক্রবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট মোবারক বলেন, জ্বালাও-পোড়াও করে, ব্যক্তিগত বা সরকারি সম্পদ ধ্বংস করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। আলোচনা, সচেতনতা ও বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিক্ষোভকারীদের কষ্টের কারণ বুঝতে পারছি। কিন্তু কোনোভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল হতে দিতে পারি না।’ বক্তব্যে তিনি মিসরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রতিশ্রুতি দেন।
মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে গতকাল ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে ভাঙচুর চালাতে গেলে সেনারা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে রাফার সিনাই শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ নিহত হয়। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে মোট ৭৪ জন নিহত হলো। বিক্ষোভে আহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ। কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে কারফিউয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার বিক্ষোভ দমনে রাজপথে সেনাবাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। সেনাসদস্যরা ট্যাংক নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। প্রথমে বিক্ষোভকারীরা সেনাদের স্বাগত জানালেও পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারী মারজুক বলেন, ‘সেনাবাহিনী জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেনাসদস্যরা তাহরির স্কয়ারে এলে আমরা তাঁদের স্বাগত জানাই। কিন্তু খুব দ্রুতই তাঁরা দাঙ্গা পুলিশের মতো আচরণ করতে থাকেন। আমরা বাধ্য হয়ে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ি।’
মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের সরকার ভেঙে দেওয়ার ঘোষণার পরও তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে তামাশা বলে উল্লেখ করেন। একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘শুধু সরকার ভেঙে দেওয়া নয়, প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছি আমরা।’ বিক্ষোভকারীদের স্লোগান ছিল, জনগণ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে টিয়ার গ্যাস শেল ও জলকামান ব্যবহার করে। বন্দরনগর ইসমাইলিয়াসহ বেশ কিছু এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
কায়রোতে গত শুক্রবার বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে ক্ষমতাসীন দলের সদর দপ্তর গতকালও জ্বলতে দেখা যায়। কায়রোর মোহান্দিসেন জেলায় একটি স্বর্ণালংকারের দোকান ও একটি ব্যাংকে লুটপাট চালানোরও খবর পাওয়া গেছে। বিক্ষোভকারীরা মিসরের প্রায় ৬০ শতাংশ থানায় হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বিবৃতিতে গতকাল জানানো হয়, কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে স্থানীয় সময় বিকেল চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ ছিল।
প্রেসিডেন্ট মোবারকের ভাষণকে ‘হতাশাজনক’ উল্লেখ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাবেক প্রধান এলবারাদি। ফ্রান্স ২৪ টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা যথেষ্ট নয়। এতে করে বিক্ষোভ থামবে না। এলবারাদি বলেন, বিক্ষোভের মাধ্যমে দেওয়া জনগণের বার্তা প্রেসিডেন্ট মোবারক বুঝতে পারছেন না। মোবারকের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। এদিকে এলবারাদিকে গৃহবন্দী করা হয়েছে বলে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দেশটিতে নিষিদ্ধঘোষিত বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড শান্তিপূর্ণভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ না করতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট মোবারকের সঙ্গে টেলিফোনে ৩০ মিনিট কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পদক্ষেপ নিতেও প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে একটি পক্ষ দেশটিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে।
প্রেসিডেন্ট মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি সংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি।

ভর্তুকির সার যাচ্ছে রঙে by শফিকুল ইসলাম জুয়েল

মুড়ি তৈরিতে ইউরিয়া সার ব্যবহারের খবরটি পুরনো। এবার জানা গেল কাপড় ও সুতার রং টেকসই করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন এই সার ব্যবহার করছে। নাইট্রোজেন কাপড় ও সুতার রং পাকা করে। এই নাইট্রোজেনের প্রয়োজন মেটাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষকের ইউরিয়া সার।

ফলে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ হওয়া ভর্তুকি মূল্যের অন্তত তিন লাখ টন ইউরিয়া চলে যাচ্ছে শিল্পসহ অকৃষি খাতে। এতে সরকার বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রায় সাড়ে সাত হাজার গার্মেন্ট (প্যান্ট, শার্ট, সোয়েটার) ও নিট শিল্পের (গেঞ্জি-জাতীয় কাপড়) চাহিদা মেটাতে তিন শতাধিক টেক্সটাইল ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা সুতা ও কাপড় প্রস্তুত করে। এসব কারখানায় নাইট্রোজেনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে ইউরিয়া সার। কর্মকর্তাদের হিসাবে ডাইং ও প্রিন্টিং শিল্পের চাহিদা মেটাতে বছরে অন্তত তিন লাখ টন ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলক বেশি কাপড় প্রস্তুতকারক একেকটি ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা মাসে এক টনেরও বেশি ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকে।
সাভারে অবস্থিত মোশারফ ডাইং কারখানা ও রুবেল প্রিন্টিং কারখানার দুজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, কাপড়ের রং পাকা করতে তাঁরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা রঙের সঙ্গে মেশাতে ইউরিয়া সার প্রথমে পানিতে ভিজিয়ে গুলে নেন। এরপর রঙের সঙ্গে মেশানোর পর মেশিনের সাহায্যে কাপড়ে লাগানো হয়। কর্মচারীরা জানান, প্রতি কেজি রঙে অন্তত ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশাতে হয়। সার কিভাবে সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে একটি কারখানার কর্মচারী কোনো মন্তব্য করেননি। অন্য কারখানার কর্মচারীটি বলেন, ‘বাজার থেকেই সার কেনা হয়, এখনো তিন বস্তা সার মজুদ আছে স্টোর রুমে।’ পরে স্টোরকিপার ও মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মোশারফ ডাইং কারখানার মালিক মোশারফ হোসেন খন্দকার ভর্তুকির সার তাঁর কারখানায় ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাপড়ের রং পাকা করতে আমরা অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করি। কিছু টাকা বেশি দিয়ে বাজার থেকেই সার কিনে আনি।’ তিনি দাবি করেন, ‘শুধু আমরাই নই; দেশের প্রায় সব ডাইং কারখানায় আমাদের চেয়েও বেশি সার ব্যবহার করে।’
কৃষকের সার কিনে এনে কাপড় রং করার কথা স্বীকার করেছেন রুবেল প্রিন্টিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আবদুস সালামও। গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বেশি সার ব্যবহারকারী বড় কারখানার মালিকরাই আমদানি করে না। সেখানে আমি তো ছোট ব্যবসায়ী; তাই আমদানির চিন্তা করি না।’ তিনি দাবি করেন, ‘বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দিলেই সার পাওয়া যায়।’
ভর্তুকি মূল্যের ইউরিয়া সার শুধু কৃষি ফসল ও কৃষকের জন্য বরাদ্দ। এর পরও শিল্পমালিকরা সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ও উৎকোচের বিনিময়ে সংগ্রহ করে অকৃষি খাতে ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। অথচ নির্দেশনা রয়েছে, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে যে কেউ আমদানি করতে পারবে। ভর্তুকির সার ব্যবহার করা যাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, শিল্প খাতে সার দেওয়ার জন্য মন্ত্রী-এমপিসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুপারিশ করেন। ফলে চাপে পড়ে এবং তাঁদের মন রক্ষায় সার দিতেই হয়। উৎকোচের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নেই না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাত্র কিছুদিন আগে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি সাভারের এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে ভর্তুকির সার এক কাপড় রং কারখানার মালিকের কাছে বিক্রির জন্য চাপ দেন। কর্মকর্তা দিতে অস্বীকার করেন এবং এর কিছুদিন পরই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ম্যানেজার (মার্কেটিং) মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষির নামে বরাদ্দ হওয়া ভর্তুকির সার শিল্পসহ নানা খাতে যায়, এমন খবর আমরাও জানি। তবে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ, সার ডিলারদের নামে বরাদ্দ দেওয়ার পর আমাদের আর দায়িত্ব থাকে না। সেটা মনিটর করার কথা জেলা সার কমিটির।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের কৃষি ফসলের জন্য ৬৪ জেলায় ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারের ইউরিয়া বরাদ্দ ২৮ লাখ ৩১ হাজার টন। এর মধ্যে বরাদ্দ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ৫০ হাজার টন ও আপৎকালীন ৫০ হাজার টন। এ ছাড়া মৎস্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩০ হাজার টন ও প্রাণিসম্পদ খাতে এক হাজার টন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, ডাইং-প্রিন্টিং শিল্পসহ তামাক, ইটখোলা, গো-খাদ্য, মুড়িসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া সার। যার চাহিদাও পূরণ হয় ভর্তুকি মূল্যের সার দিয়েই। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বরাদ্দ ৫০ হাজার টন থাকলেও ব্যবহার করা হয় (চা বাগান, চিনি করপোরেশন, রাবার বাগানসহ সংশ্লিষ্ট খাতে) এক থেকে দেড় লাখ টন ইউরিয়া সার।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটাতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় এবং তা নেওয়া হয় ভর্তুকির সার থেকেই। প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরিয়া আমদানি করে না। তবে গত ছয় মাসে চারটি কম্পানি সার আমদানির অনুমতি নিয়েছে। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে বিআরবি কেব্ল্ ইন্ডাস্ট্রিজ আমদানি করেছে তিন হাজার টন ইউরিয়া সার।
কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের কারখানাগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদন কমে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ টন ইউরিয়া আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ববাজারের মূল্য অনুযায়ী (প্রতি টন ৩৮০ ডলার) ইউরিয়া আমদানি ও ডিলার পর্যায়ে বিক্রির পর প্রতি টনে সরকারের ভর্তুকি যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা। এ হিসাবে শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে যাওয়া তিন লাখ টনে প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে সরকারের।
কৃষিসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক কোটার বাইরে অতিরিক্ত সারের প্রয়োজন হলে শিল্পমালিকরা স্বাধীনভাবে আমদানি করতে পারবেন। তবে কৃষকের ভর্তুকির সার কোনোভাবেই শিল্পে ব্যবহার করতে পারবেন না। কৃষি ফসলের চাহিদা অনুযায়ী সার আমদানি ও বরাদ্দ হয়। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, সার বিতরণ ব্যবস্থাপনায় কঠোর মনিটরিং রয়েছে। এর পরও কেউ অনিয়ম করলে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক সময় বরাদ্দ না থাকলেও শিল্পমালিকদের অব্যাহত চাহিদা ও তদবিরের মুখে বিপাকে পড়েন সার ডিলাররা। তবে রপ্তানিমুখী খাত শিল্পের চাহিদা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

বিক্ষোভ-সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ মিসর

মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল শনিবারও মিসর ছিল অগ্নিগর্ভ। কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ দেশটির সব বড় শহরে বিক্ষোভ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেও মুবারক তাঁর নিজের পদত্যাগের দাবি নাকচ করে দেওয়ার খবর বিক্ষোভকারীদের আরো উত্তেজিত করে তোলে।

গতকাল রাত ১০টার দিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাজধানী কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, ইসমাইলিয়া, সুয়েজসহ পুরো দেশে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা অবস্থান করছিল। গতকাল কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত ৭৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেনা জানায়, দেশের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ওমর সোলাইমান ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ৩০ বছরের শাসনামলে মুবারক এই প্রথম এ পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন। এ ছাড়া সাবেক বিমানমন্ত্রী আহমাদ শফিককে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হোসনি মুবারক তাঁকে নতুন সরকার ঠিক করতে বলেছেন। এদিকে মুবারক তাঁর কাছের লোকদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন বলেও খবর দিয়েছে মেনা। বিক্ষোভ পরিস্থিতির কারণে আজ শেয়ারবাজার এবং সব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। দেশটির সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মুবারকের প্রতি সংযত আচরণের আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরো বলেছে, মিসরের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য এটিই উপযুক্ত সময়। তবে সৌদি আরব মুবারকের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে।
সহিংসতার কারণে বিভিন্ন দেশ মিসর ভ্রমণের ওপর সতর্কতা জারি করেছে। হাজার হাজার বিদেশি মিসর ছাড়তে বিমানবন্দরে ভিড় করে আছে বলে গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
সম্প্রতি তিউনিসিয়ায় সফল গণ-আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে মিসরে বিক্ষোভ শুরু হয়। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ একনায়কের বিরুদ্ধে এটি প্রথম বড় কোনো আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর মুবারকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে ইন্টারনেটে প্রচারের মাধ্যমে এ বিক্ষোভ আয়োজন করে তরুণরা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার থেকে দেশটির সব শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে তারা। বিক্ষোভকারীরা শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে সর্বাÍক আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেয়। এ পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হলেও জনগণ রাতভর রাস্তায় অবস্থান নেয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রধান কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় দেশটির প্রধান জাদুঘর কায়রো মিউজিয়ামেও অগ্নিসংযোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। রাতেই মিসরের প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছে, তাদের একটিই দাবি, মুবারকের পদত্যাগ।
শেষরাতের দিকে অনেক বিক্ষোভকারী ঘরে ফিরে গেলেও গতকাল সকাল হতেই তারা আবারও রাজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনী বলেছে, রাতে কারফিউ লঙ্ঘন করা হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। মিসরের তথা বিশ্বের গৌরব পিরামিডগুলো রক্ষায় গাজা উপত্যকায় সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনী সুরক্ষা দেয়াল গড়ে তুলেছে।
এদিকে গতকাল বিকেলে কারফিউ উপেক্ষা করে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী কায়রোর প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগোতে থাকলে সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এ সময় লুটপাট ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট, গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে সিনিয়র এক নেতা টিভি সাক্ষাৎকারে বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে জানিয়ে দেশের জনগণকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। এ সময় সেনাবাহিনীকে যেকোনো মূল্যে সহিংসতা মোকাবিলা করে মিসর রক্ষায় সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। দলের পক্ষ থেকে শিগগিরই নতুন মন্ত্রিসভা ঘোষণার কথা জানান তিনি।
অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর একাংশ জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিসরে সহিংসতা কমাতে দেশবাসীকে নিজেদের এবং দেশকে রক্ষার আহ্বান জানায়।
এ বিক্ষোভে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার অস্ট্রিয়া থেকে দেশে ফেরেন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান মোহামেদ এল বারাদি। আগের তিন দিন নিষ্ক্রিয় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডও শুক্রবারের বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই বেশির ভাগ স্থানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিলেও গতকাল তা খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে ফেইসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট বন্ধ রয়েছে। সূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, এএফপি।

জালালউদ্দিন রুমির কবিতা

ই রকম
কেউ যদি শুধায় স্বর্গের হুরিরা কেমন
নিজের মুখখানা দেখিয়ে বলো, এই রকম।
কেউ যদি শুধায় চাঁদ কেমন, ছাদে উঠে বলো, এই রকম।

কেউ যদি উর্বশী খোঁজে, তাকে নিজের মুখখানা খুলে দেখাও
কেউ যদি শুধায় মৃগনাভীর সৌরভ কেমন, নিজের খোঁপা খুলে দাও, বলো, এই রকম।
কেউ যদি বলে, মেঘে ঢাকা চাঁদ কী করে প্রকাশিত হয়?
শাড়ির এক একটি ভাঁজ খুলে ফেলো, বলো, এই রকম।
কেউ যদি শুধায়, মৃতকে জাগিয়ে তুলতেন কী করে যিশু? তার ঠোঁটে চুম্বন করে বলো, এইভাবে।
যদি কেউ জানতে চায় প্রেমে আহুতি দেয় যারা, তারা কেমন? আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো তাকে, বলো, এই রকম।
কেউ যদি শুধায় আমি কতটা লম্বা, তোমার বাঁকানো জোড়া ভুরু দেখিয়ে বলো, এই রকম।

ভূমিকা ও অনুবাদ: হাসান ফেরদৌস
ফার্সি কবি জালালউদ্দিন রুমির কবিতা কেউ পাঠ করে ঈশ্বরের খোঁজে। কেউ বা প্রেমের। যারা প্রেমিক ও ঈশ্বরের কোনো তফাত দেখে না, তারা রুমির কবিতায় দুজনকেই খুঁজে পায়। এ যেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য পর্যায়ের কবিতাগুলোর মতো, যেখানে প্রভু ও প্রেমিকের কোনো তফাত থাকে না।
রুমির জন্ম আফগানিস্তানের বালখ শহরে ১২০৭ সালে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম তার সাড়ে ৬০০ বছর পর, ১৮৬১ সালে। রুমি প্রথম পারস্যের খোরাসানে, পরে তুরস্কের কনিয়া প্রদেশে শিক্ষালাভ করেন মুখ্যত তাঁর মৌলবি পিতার পরিচর্যায়। এই তুরস্কেই তিনি কবি ও মৌলানা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথম জীবনে রুমি ধার্মিক ছিলেন কোনো সন্দেহ নেই, আর দশটা-পাঁচটা মাদ্রাসা-মক্তবের মৌলবির মতো। কিন্তু তাঁর যখন ৩৭ বছর বয়স, সে সময় পরিচয় হয় পারস্যের তাবরিজ থেকে আসা এক পথভোলা দরবেশের সঙ্গে। তাঁর নাম শামস-আল দিন। এই লোকটির ভেতরে রুমি তার প্রার্থিত ঈশ্বরের প্রতিরূপ দেখতে পেলেন। কিন্তু কেবল ঈশ্বর নয়, শামস-আল দিন তাঁর কাছে আবির্ভূত হলেন প্রেমিক হিসেবেও। যে ‘ঈশ্বরসম-প্রেমিক’ তিনি এত দিন খুঁজছিলেন, রুমি তার দেখা পেলেন শামস-আল দিনের ভেতর।
রুমি ও শামসের প্রেমের স্বরূপ আমাদের জানা নেই। এটুকু জানি, তাঁদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা প্রবল বিতর্কিত হয়ে ওঠে এবং একসময় রুমির ভক্তদের আক্রমণের মুখে শামস-আল দিনকে কনিয়া ছেড়ে পালাতে হয়। রুমি তাঁকে পাগলের মতো খুঁজেছেন, পুত্রকে দামেস্ক পাঠিয়েছেন তাঁকে ফিরিয়ে আনতে। শামসের উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফিরে এসো, ফিরে এসো, তোমা বিনা আমার হূদয় শুষ্ক, বিশ্বাস পলাতক।’ ফিরে এসেছিলেন শামস, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আততায়ীর হাতে নিহত হন। রুমি বিশ্বাস করেননি তাঁর শামস—যার অর্থ সূর্য—আর নেই। ‘এ কী করে হয় যে সূর্য আর উঠবে না?’ শামসের জন্য তাঁর অন্বেষণ ও বেদনার আধার হয়ে ওঠে কবিতা। ‘সে নেই, স্বর্গও এখন আমার কাছে নরকসম’, লিখেছেন রুমি।
যে ঐশ্বরিক প্রেমিকের খোঁজে ছিলেন রুমি, সে কি রক্তমাংসের মানব, নাকি বিদেহী ঈশ্বর? এ প্রশ্নের জবাব আমরা তাঁর কবিতা থেকে যে যার মতো করে খুঁজে নিই। যেমন নিই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। এখানে মুদ্রিত কবিতাটি ফাতেমেহ কেশাভারজের ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণে রচিত।

শিল্পশিক্ষার আনন্দযজ্ঞ

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নতুনত্ব সৃষ্টি এবং মানসিক উৎকর্ষ সাধনে বহুমাত্রিক চিন্তার প্রয়োগের উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে চলছে শিল্পশিক্ষার এক আনন্দযজ্ঞ। ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) অংশ হিসেবে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সপ্তাহব্যাপী চিত্রকলার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলো।

দুই বাংলার চারুশিল্পের প্রসিদ্ধ শিক্ষক ও শিল্পীদের সমাগম ঘটেছে বাংলাদেশে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প—এই পাঁচটি বিভাগ মিলে এ আয়োজন। ২০১০ সালের শেষ দিকে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুজন শিক্ষক বিশ্বভারতীতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করেছেন। পরে শান্তিনিকেতন থেকে ১২ জন শিক্ষক-শিল্পী এ দেশে এসেছেন। গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী এবং চারুকলা অনুষদের শিক্ষকদের সমন্বয়ে শুরু হয়েছিল দুই দিনের একটি কর্মশালা। ভারতীয় শিল্পের পুরোধা কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ এই কর্মশালা উদ্বোধন করেন একটি ক্যানভাসে ছবি এঁকে। শুধু ছবি আঁকা নয়, ছিল শিল্পবিষয়ক নানা মতবিনিময়, সেমিনার এবং মুক্ত আলোচনা। প্রথম দুই দিন ভারতীয় শিল্পী এবং এ দেশের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ ঘটেছে ছাত্রছাত্রীদের। পরবর্তী চার দিন ভারতীয় শিল্পীরা বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের শিল্পকর্ম-শিল্পভাবনা বিনিময় করেছেন। সেমিনারে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সচিত্র উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল। এ ক্ষেত্রে কলা ভবন এবং নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, বাংলাদেশের লোকশিল্প, বাংলাদেশের মূলধারার শিল্পকলা—এ রকম নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে প্রতিদিন। দুই দেশের শিল্পের তাত্ত্বিক বিষয়াবলির পর্যালোচনা নতুনভাবে উঠে এসেছে।
বিশ্বভারতীর কলা ভবনের অধ্যক্ষ পঙ্কজ পাঁওয়ার এই শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নানা দেশের এ ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তা বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময় বেশি। এ ধরনের কার্যক্রমে বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়; সম্ভব হয় প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতাকে দূর করা।
গতানুগতিক ধারার বাইরে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা-চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিনিকেতন। পাশ্চাত্যের শিল্প-শিক্ষাকে গ্রহণ না করে নিজস্ব সমৃদ্ধ কৃষ্টি-শিল্প-সংস্কৃতির বৈভবকে আত্তীকরণ করেছে শান্তিনিকেতন। পঙ্কজ পাঁওয়ার মনে করেন, শিল্পের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কারণেই সাধারণের চেয়ে আলাদা হয় শিল্পীরা। তার কাজ মানুষের জীবনকে করে তোলে আরও অনুভূতিশীল ও আনন্দময়। বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পের প্রতি আগ্রহ তীব্র। তাদের শিল্পকর্মে একটা তাগিদ অনুভব করা যায়। এ দেশের শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উষ্ণ আতিথেয়তায় আমরা অভিভূত।
শিল্পী সঞ্চায়ন ঘোষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, এই শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নির্ভর করছে এর পরিকল্পনার ওপর। শিল্প-শিক্ষায় শিক্ষার্থীর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়; একটা পদ্ধতি শিখে তা অনুশীলন, চর্চা এবং নতুন কী সৃজন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শুধুই তাকে নানা পথের সন্ধান দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ না করে বিস্তৃত করে দিতে পারে।
ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) প্রথম অংশে অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান শিল্পী ফরিদা জামান গিয়েছিলেন। তিনি জানালেন, পরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম নিয়ে তাঁরা ভাববেন। এ ছাড়া এই ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর্থিক সমস্যাও রয়েছে; এবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আর্থিক-সহায়তা সাময়িক সমাধান দিয়েছে।
আয়োজকদের একজন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমাদের শিক্ষা বিনিময়ের এই উদ্যোগ সফল হয়েছে শিল্পী রফিকুন নবীর মাধ্যমে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই কার্যক্রমে ব্যবহারিক বিষয়ের বাইরে তত্ত্বীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জাদুঘরে ভ্রমণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় শিল্পীরা হলেন—নন্দদুলাল মুখার্জি, দিলীপকুমার মিত্র, সুমিতাভ পাল, ঋষি বড়ুয়া, সলিল সাহানি, অর্পণ মুখার্জি, প্রবীরকুমার বিশ্বাস, প্রসুনকান্তি ভট্টাচার্য, সৌমিক নন্দী মজুমদার, পঙ্কজ পাঁওয়ার, সঞ্জয়কুমার মল্লিক, সঞ্চায়ন ঘোষ প্রমুখ।
শিল্প পৃথিবীকে অনুভব করার আবেগময় কৌশল। শিল্পী সর্বদা চেষ্টা করেন তাঁর স্পন্দিত অনুভূতিকে শিল্পকর্মে প্রকাশ করতে। বাংলার শিল্পকলার এই বিভাজন রাজনৈতিক; একই ভাষা, একই অনুভূতি, একই মানুষ, একই প্রকৃতির মেলবন্ধন এবং শিল্প ও ভাব বিনিময় আমাদের নিজেদের চিনতে সাহায্য করবে।

Saturday, January 29, 2011

বই এবং খানিকটা অথবা অনেকটা সংশয় by শান্তনু কায়সার

র তিন দিন পর ১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১১। বইমেলা নিয়ে ‘সাহিত্য সাময়িকীর’ বিশেষ আয়োজন
Remember
First to possess his books, for without them
He is but a sot, as I am.
(The Tempest/Act 3, Scene 2)
উদ্ধৃতাংশটি ক্যালিবান বলছে প্রসপেরোর শত্রুদের উদ্দেশে, কী করে তাকে জব্দ করা যায়।
অন্যদিকে প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে ক্যালিবানই তার প্রভু প্রসপেরোকে বলছে—You taught me language, and/My profit on’t/Is, I know how to curse। অর্থাৎ আপনি আমাকে ভাষা শিখিয়েছেন, তাতে সুবিধা হচ্ছে, আমি এখন জানি কীভাবে অভিশাপ দিতে হয়। এ থেকে বইয়ের দ্বান্দ্বিক সত্যকে বোঝা যায়। ভাষা নিজে ভালো বা মন্দ না হলেও বই কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক অথবা নিরপেক্ষ নয়। আমাদের একুশের গ্রন্থমেলার বয়স যেহেতু এখন খুব একটা কম নয়, সেহেতু এটাকে নিয়ে খানিকটা ভাবনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে।
তার আগে বলি, বাংলা একাডেমীর একুশের ঐতিহ্যের রয়েছে দ্বান্দ্বিক চারিত্র্য। কী করে ভুলি, একজন পরিচালককে (তখনো মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি) তাঁর ভুল ভূমিকার জন্য এবং ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিতা যিনি লিখেছেন, সেই রকম একজনকে স্বৈরাচারী শাসকের মন্ত্রী হওয়ার কারণে বটতলার অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে স্বৈরাচারী ওই আমলে আহমদ শরীফ বেশ কয়েকবার ২০ ফেব্রুয়ারির বৈকালিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে নির্জলা যে সত্য কথা বলতেন, তাতে তৎসম-কণ্টকিত দুরূহতা অতিক্রম করে তা জনসাধারণের এতটাই সানন্দ অনুমোদন পেত যে সমস্ত প্রাঙ্গণ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
বই যতই প্রিয় হোক, হোক তা পাঠকের প্রেরণা ও অনুপ্রেরণার উৎস, সবাই ত্যাগ করলেও বইয়ের মতো বন্ধু যে পাঠককে ত্যাগ করে না, বরং তাকে ভরিয়ে তোলে; তা সত্ত্বেও প্রকাশকের কাছে বই একটা পণ্যও বটে। তিনি হিসাব করে দেখেন, কী বই, কত দিনে বিক্রি হবে; তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ কত দিনে ফেরত পাওয়া যাবে, আদৌ অথবা কতটা মুনাফা পাবেন এবং এ বই তাঁকে আর কী কী ও কী পরিমাণ দেবে। আমাদের যতই ভালো লাগুক, বাজার অর্থনীতিতে বই তো আর আলাদা কিছু হতে বা পেতে পারে না।
যে প্রকাশক বলেন তিনি মানসম্মত বই প্রকাশে আগ্রহী, তিনিই আবার নানা চাপ ও স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। যে প্রকাশকেরা বলেন, তাঁদের প্রকৃত প্রকাশকের সংখ্যা ৭০-৭২ বা বড়জোর ১০০, তাঁরা একুশে গ্রন্থমেলার আগে দ্বিগুণ/তিনগুণে কী করে পৌঁছান; সেই প্রকাশকেরা যেসব সময় নীতি মেনে চলেন, তা-ও নয়। চাণক্যনীতির সুযোগ নিতে তাঁরাও খুব পিছিয়ে থাকেন না।
সেদিন এক প্রকাশক বলেন, লেখক যদি প্রকাশকের সঙ্গে লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে বই না দেন, তাহলে তিনি কী করে আইনি অধিকার দাবি করতে পারেন। কিন্তু আমরা জানি, লেখক দুর্বল পক্ষ। বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটেকে যেমন জিম্মি হয়ে থাকতে হয়, সাধারণভাবে লেখকের অবস্থাও তা-ই। আর যেসব লেখক ক্ষমতাবান অর্থাৎ অসম্ভব জনপ্রিয়, তাঁদের রয়্যালিটির টাকা তো প্রকাশকেরা বাড়িতে গিয়ে আগামও দিয়ে আসেন। লেখক হলেও তাঁরা ব্যতিক্রম।
মানসম্মত নয় এমন বই প্রকাশ করা আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মুদ্রণ-বিস্ফোরণের এই সময়ে এর প্রকাশ রুদ্ধ কিংবা অন্তত সীমিত করা যে অসম্ভব, সেকথা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই স্বীকার করবেন। এখন বঙ্কিমের যুগ নয় যে ‘লেখক’রা ‘যশের জন্য লিখিবেন না।’ এই ধরনের ব্যক্তিরা বিশ্বাসও করেন না যে ‘তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না।’ বঙ্কিম যে বলেছিলেন, ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না, কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন’—সেই ধৈর্যও সবার নেই। এত সুযোগ থাকতে গ্রন্থকার না হওয়াই বরং মূর্খের কাজ!
অতএব যা ঘটার তা-ই ঘটে। আবুল মনসুর আহমদ ভোট-ভিক্ষুকদের কথা বলেছিলেন, আমরা প্রায়ই বই-ভিক্ষুকদের দেখা পাই। লাইন ধরে তাড়া খাওয়া গ্রন্থকারেরা যেভাবে নিজের বইয়ের কথা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে বলেন, তাতে খাঁটি পাঠকের লজ্জার শেষ থাকে না।
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যেভাবে ‘ভালো’ ফল করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে, তাতে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার বাস্তব পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে, তার নির্মোহ জরিপ হলে বোঝা যেত, সাধারণত পাঠকেরা কী পড়েন বা পড়তে চান। এ অবস্থায় বইয়ের ভালো কাটতি আমাদের সৃজন ও মননচর্চায় কতটা ভূমিকা রাখে বা রাখতে পারে, সে ভাবনাকেও তুচ্ছ করে দেখা যায় না।
অর্থনীতির গ্রেশামস ল যে বলে মন্দ টাকা ভালো টাকাকে তাড়িয়ে দেয়, আমাদের গ্রন্থমেলারও সেই চারিত্র্য দাঁড়াচ্ছে কি না, এখন থেকেই বুঝি তা একটু একটু করে দেখা দরকার। আর এই ফাঁকে সারপ্লাস ভ্যালু তথা উদ্বৃত্ত মূল্য কোথায়, কার পকেটে ঢুকছে, সেটাও জনস্বার্থে দেখা প্রয়োজন।
দুই.
সারা দেশেই নানা গ্রন্থাগার রয়েছে। গ্রন্থাগারগুলো কতটা ভালো চলছে কিংবা সৎ ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত নিচের পর্যায়ে গ্রন্থাগারের প্রকৃত ভূমিকার কথা কেউ আর ভাবেই না। দুর্বৃত্তায়িত নানা পথে এসব ক্ষেত্রে যে বইগুলো কেনা হয়, শিক্ষার্থীদের বোধহয় সেসব বই না পড়াই ভালো। তাতে অন্তত তাদের পক্ষে দূষণমুক্ত হওয়া অথবা থাকা সম্ভব। আর সাধারণ ও গণগ্রন্থাগারগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাছে পঠন-পাঠন কোনো বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও কর্তৃত্বের প্রকাশ।
কিন্তু কী হওয়া উচিত ছিল বা কী হতে পারত, তার একটি পুরোনো উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এর সভাপতি ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১১ সাল থেকে আমৃত্যু এই গ্রন্থাগারের সহসভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র বইয়ে শ্যামল চক্রবর্তী প্রফুল্লচন্দ্র সংগৃহীত বইয়ের যে তালিকা ও বিবরণ দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, তিনি রোমান্টিক কবিদের ও নন্দনতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থাবলি অত্যন্ত খুঁটিয়ে পড়ছেন এবং মার্জিনে এ বিষয়ে মন্তব্য লিখে রাখছেন।
তাহলে প্রশ্ন, একুশ শতকে এসে আমরা কি এগিয়ে, না পিছিয়ে গিয়েছি অথবা যাচ্ছি?
তিন.
তবুও একুশে গ্রন্থমেলার সার্থকতাই আমাদের কাম্য। অনেক অপূর্ণতা থাকলেও বাংলাদেশ যেমন আমাদের অনেক দিয়েছে, বইয়ের জগতে এসেও তেমনি আমাদের প্রাণ ভরে যায়। বই হাতে নিয়ে এটিকে দেখতে দেখতেও আমরা অন্তত এই মেলার অনেক অপূর্ণতার কথা ভাবতে পারি। আর সৎভাবে অপূর্ণতার কথা ভাবলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনার কথাও আমাদের না ভেবে উপায় নেই। পরিমাণগত বাস্তবতাই একসময় আমাদের গুণগত পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। যাবেই। এ ছাড়া তো আমাদের ভিন্ন কোনো পথ নেই।

সূচক আশাজাগানিয়া তবু অর্থনীতি মন্থর

র্থনীতির ক্ষেত্রে চাপের মধ্যে রয়েছে সরকার। পণ্যবাজারের অস্থিরতার মধ্যে দুই বছর আগে দায়িত্ব নিয়েছিল সরকার। কিছুদিন নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সেই অস্থিরতা আরো বেড়েছে। ঘনীভূত হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। চলতি বছরটা শুরু হয়েছে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ ধস দিয়ে।
এসব চাপ সামলে দেশের অর্থনীতির গতিধারা বজায় রাখা, বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির কোনো সহজ পথ বাতলাতে পারেননি অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির মূল সূচকগুলো বেশির ভাগই ইতিবাচক থাকলেও মূল অর্থনীতিতে তেমন গতি নেই। বিনিয়োগের প্রস্তাব বাড়লেও বাস্তবায়ন কম। বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি গোল্ডম্যান স্যাক্স ও মুডিস বাংলাদেশকে ভারতের পরেই এ অঞ্চলে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) পরিচালিত এক জরিপে ২৮তম অবস্থান থেকে ২০১০ সালে ১৫তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বড় বড় কম্পানি বাংলাদেশকে বিনিয়োগের বিকল্প স্থান হিসেবে মনে করছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসেনি। এর মূল কারণ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা হিসেবে জমির অভাব। সমস্যাটি ভবিষ্যতে শিল্পায়ন, আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে দাবি করছেন মন্ত্রীরা। কিন্তু এর জন্য যে উদ্যোগ প্রয়োজন, তা নেই। মন্ত্রীদের এমন দাবির ভিত্তি হচ্ছে গত ছয় মাসে রপ্তানি আয়ে ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ নিবন্ধন বেশি হওয়া। কিন্তু এ কয়েকটি সূচক বাদে বাকি দিকগুলোতে দুর্বলতা রয়েই গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা খারাপ হচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া, বিদেশ থেকে লোক ফেরত আসা বেড়ে যাওয়া ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ায় সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে মানুষকে সস্তায় খাদ্য দেওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আগামী গরমে লোডশেডিং নিয়ে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে-এমন আশঙ্কা রয়েছে। শেয়ারবাজার ও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে ইতিমধ্যেই মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে সরকার।
এসব বিষয়ে আগামী দিনে সরকারকে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, তা সরকারকে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। শেয়ারবাজারের দরপতন যেমন একটি সমস্যা, তেমনি বিদ্যুৎ সংকটও একটি সমস্যা। কাজেই সমস্যাগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করার ওপরই আগামী দিনে সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভর করবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের বিষয়ে নিঃসন্দেহে সরকার বেশ চাপেই আছে। শেয়ারবাজারে যা ঘটেছে, তা থেকে সরকারকে অবশ্যই সতর্ক হয়ে শিক্ষা নিতে হবে। পাশাপাশি এসইসি, বিনিয়োগকারী সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। ড. মোস্তাফিজ বলেন, বিশ্ববাজারের পাশাপাশি পণ্যের দাম স্থানীয় বাজারেও বাড়ছে। তবে সব কিছুর পরও নিত্যপণ্য স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়াতে হবে। রেশনিং অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকারি খাতে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকির মতো বিষয়কেও মেনে নিতে হবে।
দ্রব্যমূল্যে নাকাল : ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সরকারের মেয়াদ দুই বছর পার হওয়ার পর এখনো এক নম্বর সমস্যা হিসেবেই তা রয়েছে। সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচন ও কয়েকটি আসনে উপনির্বাচনে বিরোধী দল প্রচারণার ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ২০১০ সালে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সরকারি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকায়ও দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় পণ্যের দাম অনেক বেশি। টিসিবির সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, গত এক বছরে চারটি প্রধান পণ্য-মোটা চালের দাম ৩৩.৩৩ শতাংশ, আটার দাম ৪৩.৭৫ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম ৩৬.৪৯ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ২৪.৫৬ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের মন্ত্রীরাও স্বীকার করছেন, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তবে তাঁদের ভাষ্য, প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য কম।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন কমে যাওয়া ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে এ অস্থিরতার হাওয়া লাগবে বাংলাদেশেও। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘খাদ্য পূর্বাভাস’ নামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার ৬ শতাংশ কম খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজারে আসবে। আর সরবরাহ কমায় এরই মধ্যে খাদ্যের দাম ৪.২ শতাংশ বেড়েছে। এফএওর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্য বাড়ায় বাংলাদেশসহ ৭৭টি খাদ্য ভর্তুকির দেশকে অতিরিক্ত ১২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বার্ষিক গড় হিসাবে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির ভয়ের দিক হলো, খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেশি এবং শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বেশি হারে। এরই মধ্যে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
গ্যাস-বিদ্যুতে আলো জ্বলছে না : বিগত দুই বছরে ১০২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ২০৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করেছে দাবি করছে সরকার। তবে ১০২১ মেগাওয়াটের মধ্যে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ বর্তমান সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব কাজ করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রথম বছর পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় বছর সিদ্ধান্ত ও চুক্তি করতেই পার করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ২৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ১৬টি কুইক রেন্টালসহ ৩৩টি চুক্তি করা হয়েছে। এর অধিকাংশ হয়েছে ২০১০ সালে। এ ছাড়া ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে চুক্তি, ২৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতীয় এনটিপিসির সঙ্গে চুক্তি এবং বৃহৎ ও মাঝারি আকারের বেশ কয়েকটি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজের অগ্রগতি হতাশাজনক। এখন পর্যন্ত তিনটি ছাড়া বেশির ভাগ কেন্দ্র নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনে আসতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস উৎপাদন বাড়লেও বর্তমানে মোট উৎপাদনের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। গত বছর এ সময়ে দৈনিক ১৯৭ থেকে ১৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হলেও তা এখন নেমে এসেছে ১৯৪ থেকে ১৯৬ কোটি ঘনফুটে। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন, ক্ষেত্র উন্নয়ন ও সংস্কারে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় গ্যাস ঘাটতি আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রথম বছরে সরকার ফার্স্ট ট্র্যাক কর্মসূচি নিলেও তা যথাসময়ে বাস্তবায়নে হাত দিতে পারেনি। এতে চলতি বছরেও চটজলদি পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ শিল্প খাতে বিনিয়োগ হতে হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এ পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে সক্ষম। এ জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকে কাজ করতে হবে।
এডিপি বিশাল, বাস্তবায়ন কম : চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ৩৮ হাজার কোটি টাকা। আকারে বিশাল হলেও বাস্তবায়ন হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম। ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ২৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ২৯ শতাংশ। এ সময়ে ৯১৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা ছাড় করা হলেও ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মাত্র এক-চতুর্থাংশ এডিপির বাস্তবায়ন হওয়ায় বাকি সময়ে অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হলে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি কাজ না হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগও থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজ এডিপির বাস্তবায়ন হার নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন যথাসময়ে না হলে তা মানসম্পন্ন হবে না। অনেক প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আর তা হলে সরকারি উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গতি নেই : গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এর সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পে অস্তিরতার কারণে শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এর বিপরীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে ১০ লাখ। ফলে ১০ লাখ লোক নতুন করে বেকারত্বের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দারিদ্র্য কমাতে বেশকিছু অঙ্গীকার করেছিল। এর মধ্যে ছিল প্রতি পরিবারে একজনকে কাজ দেওয়া। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি হাতে নেয়। এখনো এটি কুড়িগ্রাম ও গোপালগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিলুপ্ত হওয়া একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। বিএনপি সরকারের সময় বন্ধ থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ বর্তমান সরকারের সময় চালু করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষিতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা কঠিন। মানুষকে কাজ দিতে শিল্পায়ন বাড়াতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ নিবন্ধন বাড়লেও গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কারখানা চালু হচ্ছে না।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর এই ১১ মাসে মোট এক হাজার ৬২৭টি প্রকল্পে ৬২ হাজার ৫৬৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করেছেন উদ্যোক্তারা। এতে মোট চার লাখ ১২ হাজার কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু এসব বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নে গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা নেই এখনো।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, প্রতিবছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে। দেশে বর্তমান দুই কোটি ৭০ লাখ বেকার ছাড়াও কর্মবাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
রেমিট্যান্স-প্রবাহ ধীরগতি, জনশক্তি রপ্তানি কমেছে : জনবল রপ্তানি কমে যাওয়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও গতি হারিয়েছে। ২০১০ সালের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) সময়জুড়ে দেশে মোট প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে এক হাজার ১০০ কোটি ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে গেল বছরটি সরকার স্বস্তিতে কাটিয়ে দিলেও চলতি বছর বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারণ বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি দু-তিন বছর ধরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নেমে এসেছে। এসব দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ফেরতও এসেছে।
অবকাঠামোর বাধা ভূমি : অবকাঠামোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে সরকার। জমি হারিয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে। আর সরকারের জন্য তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে।
মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের জন্য ২৫ হাজার একর জমি প্রয়োজন সরকারের। কিন্তু ওই এলাকার জনগণ এরই মধ্যে বিক্ষোভ শুরু করেছে। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের জমি নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। বিনিয়োগ বোর্ড ও বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন্স অথরিটির (বেপজা) কর্মকর্তারা জানান, শিল্প স্থাপনের জায়গা দিতে পারলে গত বছর ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে কমপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ আসত। জমি না পেয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে গেছেন।
ভূমি অধিগ্রহণ সরকারের জন্য বড় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. বিনায়ক সেন। টাটার গাড়ি তৈরির কারখানার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এমন অবস্থা তৈরি হতে পারে। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তার পরামর্শ দেন।