Thursday, May 26, 2011

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী...

তিনি এসেছিলেন বাংলা কাব্যের অঙ্গনে সম্পূর্ণ নতুন সুর আর কণ্ঠস্বর নিয়ে। দিয়েছিলেন বাংলা গানের এক নতুন ভুবনের সন্ধানও। তিনি মহাবিদ্রোহী, বিষণ্ন, তীব্র রোমান্টিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা কাব্যের প্রচলিত অঙ্গন। 'বিদ্রোহী' কবিতার অভূতপূর্ব উচ্চারণে চমকে দিয়েছিলেন সমগ্র উপমহাদেশ।
'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য'_ এই বিস্ময়কর দ্বৈতসত্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং মানবতায় হৃদয় সংবেদী প্রেমিক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ। সব সংকীর্ণতার দেয়াল ভেঙে বাংলা সাহিত্যে নতুন কাব্যধারা সৃষ্টি করেছিলেন যিনি, সেই চিরবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন শুরু হচ্ছে আজ। আজ থেকে ১১২ বছর আগে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ এক ঝড়ের রাতে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্য সমালোচকরা তাকে যথার্থই 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ ঝড়ের মতোই সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল ছেঁড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের পাশাপাশি তার কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এমন এক মানবিক সমতার সমাজ গড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যে সমাজে মানুষের পরিচয় হবে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্রের সকল ভেদাভেদের ঊধর্ে্ব। তাই মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল তার উচ্চারণ। নজরুল এক আশ্চর্য প্রতিভা! একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে বিদ্রোহী; 'এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।' কী কবিতায়, কী গানে, উপন্যাসে, গল্পে, সাংবাদিকতায় তথা সম্পাদকীয় নিবন্ধে, প্রবন্ধে_ সর্বত্রই মানবমুক্তির প্রেমময় বাণী, দ্রোহের বাণী ঝঙ্কৃত হয়েছে তার সৃষ্টিতে।
বাংলা কাব্যে নতুন যুগের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হয়ে যে দীপ্র তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেই তারুণ্যই শতদল হয়ে ফুটেছিল তার সাহিত্যিক জীবনে। ১৯২১ সালের শেষ দিকে যখন 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখেন (১৯২২ সালে প্রকাশিত), তখনই বাংলা কবিতায় চিরকালের জন্য অমর হয়ে গিয়েছিল তার আসন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগি্নবীণা' আগুনের হল্কা ছড়িয়ে দিয়েছিল শোষিত-বঞ্চিত সমাজে। তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়তে, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ আর সংকীর্ণতার পাষাণ প্রাচীর ভাঙতে এবং শাসন-শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে। অগি্নবীণা, বিষের বাঁশী, ধূমকেতু প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের। একের পর এক নিষিদ্ধ হতে থাকে তার কাব্যগ্রন্থ; কিন্তু প্রতিজ্ঞায় অনড় কবির কলম থেমে থাকেনি। কারাগারেও গেয়েছেন 'ভাঙার গান'। চিরকালের মানবমুক্তির বাণীবাহক নজরুলের পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছিল 'মহা_ বিদ্রোহী রণক্লান্ত,/আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না_।'
'দারিদ্র্য'কে নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি দারিদ্র্যের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন 'অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস...।' হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের মহামন্ত্রে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে তিনি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার সাধনায় সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাও পালন করেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়েও ইসলামী ঐতিহ্য আর হিন্দু পুরাণের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এই অনন্য দর্শন প্রতিষ্ঠা করে সবার হৃদয়ে মানবতার কবি হিসেবে অমর হয়ে আছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার কবিতা ও গান অনন্য প্রেরণা জুগিয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন নাগরিকত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের প্রধান বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণেই হয়েছে তার শেষশয্যা।
কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সকালে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে। বিটিভি ও বেতারসহ দেশের বেসরকারি টেলিভিশন ও এফএম রেডিও স্টেশনগুলো দিবসটি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা।
নজরুলজয়ন্তীর কর্মসূচি হিসেবে আজ ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কুমিল্লার দরিরামপুরে তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠানমালা শুরু হচ্ছে। নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। সেমিনার, আলোচনা সভা, সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে মুখর হয়ে উঠবে ত্রিশালের দরিরামপুর।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেছেন, নজরুল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক শাশ্বত দিকপাল, উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক, জাতীয়তাবোধের ধারক, প্রেমের পূজারি, সাম্য ও শান্তির বাহক।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, তিনি 'বিদ্রোহী কবি', আধুনিক বাংলা গানের 'বুলবুল'। তার শিকল ভাঙার গানে সে সময়কার ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি সমাজ জেগে উঠেছিল। তার সাহিত্যকর্ম মানব অনুভূতির গভীরে প্রোথিত হয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
বিরোধী দলের নেতার বাণী : বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, বাংলা সাহিত্যের এ কালজয়ী পুরুষকে জাতীয় কবি হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখা তার সৃষ্টির পরশে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানমালা : রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন নজরুলজয়ন্তী পালন করবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের অনুষ্ঠানমালা। ত্রিশালে কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে। কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রাম শহরে যথাযথ মর্যাদায় নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। নজরুলের স্মৃতিধন্য জেলাগুলো ছাড়াও দেশের সব জেলায় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। আজ সকালে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে আলোচনা ও কবির সাহিত্যকর্মের পরিবেশনা।
আওয়ামী লীগ : সকাল ৮টায় জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মদিন পালনের জন্য দল, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলা একাডেমী : জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানমালা। বিকেলে একাডেমীতে রয়েছে আলোচনা সভা।
শিল্পকলা একাডেমী : সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে দু'দিনের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
ছায়ানট : ছায়ানট তাদের নিজস্ব মিলনায়তনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আয়োজন করেছে সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে নজরুলের নাটক ও চলচ্চিত্রের গান পরিবেশিত হবে।
এছাড়া নানা আয়োজনে জন্মদিন উদযাপন করবে জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, বিশ্ব কবিতা কণ্ঠ পরিষদসহ নানা সংগঠন।

জাগরণের কবি নজরুল

সাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক, মানবতার কবি, জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি ... নজরুল। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, সকলের কবি ... নজরুল।

জাতীয় কবি নজরুল আমাদের বড়ই আপন। বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আনন্দ-বেদনার সাথী। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির কর্ণধার। তার আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের দেহে ও প্রাণে সঞ্চার করেছে তারুণ্যের বিপুল ঐশ্বর্য। তাঁর অগি্নঝরা লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ পরিবর্তনের দর্শন, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেতনা। তাঁর সৃষ্টি আমাদের জাতির অঙ্গ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কবিতা ও গান মুক্তিযোদ্ধাসহ গোটা বাঙালি সমাজকে করেছে উজ্জীবিত, যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ প্রবাদপুরুষের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি আমি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্য গগনে পূর্ণ আভায় দেদীপ্যমান তখনই এক নতুন শৈলী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অপর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। উজ্জ্বল এই নক্ষত্রটি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২১ সালে 'বিদ্রোহী' কবিতা নিয়ে নজরুলের আবির্ভাবের পর বাংলা কাব্য ও ছন্দের জগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন ঘটে, যা অপরাপর কবি-সাহিত্যিকদের কাব্যধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। তাঁর আবির্ভাবটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে সচকিত করেছিল। তিনি কবিতার ভাষায় নজরুলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন_
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগি্ন-সেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ-শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে'
আছে যারা অর্ধ-চেতন।
বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের এই আহ্বানে বিদ্রোহী কবি সাড়া দিয়েছিলেন।
নজরুলের শৈশব জীবন একটি নিশ্চিন্ত স্বাভাবিক জীবন ছিল না। চরম দারিদ্র্য ও প্রবল চাঞ্চল্য তাঁর জীবনে একই সঙ্গে বিরাজমান ছিল। গৃহের শৃঙ্খলা ভেঙে অচেনা পথে বেরিয়ে পড়ার একটি স্পৃহা ছিল তার। তবুও জীবন-জীবিকার জন্য কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই কৈশোর বয়স থেকে। জীবনের প্রথম পেশা মসজিদে আজান দেওয়া শুরু করেন তিনি কৈশোরে। তারপর রুটির দোকানে চাকরি, লেটোর দলে গান বাঁধা, যাত্রার দলে যোগ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নজরুল গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেশেন, তাদের কথা, সুর ইত্যাদি রপ্ত করেন। তিনি দেখেছিলেন জীবন অত্যন্ত কঠিন। সমাজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। তাই সাহিত্যের উপাদান ও উপজীব্য হিসেবে তিনি দারিদ্র্য, অবহেলা ও বঞ্চনাকেই গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের বিরাজমান অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি 'বিদ্রোহী' হয়ে ওঠেন। তাই দ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে। পরাধীন দেশে সাধারণ মানুষকে তিনি দারিদ্র্য ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির গান শুনিয়েছেন।
জন্মসূত্রে তিনি মুসলমান। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার হিন্দু পুরাণ ও মহাভারতের কাহিনীকে তিনি আত্মীয়করণ করেছিলেন অবলীলায়। তিনি লিখেছেন :
আমি হোম-শিখা, আমি সাগি্নক জমদগি্ন,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগি্ন।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য;
নজরুলের গানের শিল্পগুণ, সুর, মাধুর্য ও গায়কী ঢং অন্যান্য গানের চেয়ে সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বে ভরপুর। বাণীর ঐন্দ্রজালিক সমন্বয়ে রচিত গানগুলো অতিমাত্রায় উচ্চ মার্গীয়। গানের ভাষা, প্রকরণশৈলী ও সুর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তাঁর গানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। আশৈশব দেশজ সঙ্গীতের যেসব ধারায় তিনি অবগাহন করেছেন যেমন বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, সাঁওতালি এগুলোকে তিনি নিপুণ হাতে প্রয়োগ করেছেন তাঁর নতুন গানে। অনেক নতুন গানে অপ্রচলিত রাগ-রাগিণীকে প্রয়োগ করেছেন। তিনি ১৮টি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দোলনচাঁপা, দেবযানী, মীনাক্ষী, অরুণ রঞ্জনী, নির্ঝরিণী, রূপমঞ্জুরি, সন্ধ্যা-মালতী, বনকুন্তলা, অরুণ ভৈরব, শিবানী ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, উদাসী ভৈরব ও বেনুকা।
নজরুল কাব্যে আমপারা, অসংখ্য হামদ ও নাতে রাসূল (সা.) রচনা করেছেন। আবার শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এবং বৃন্দাবন গীতও রচনা করেছেন অনেক। এত উচ্চমানের হাম্দ ও নাত অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিক লিখতে পারেনি। অপরদিকে প্রেম ও ভক্তিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তন কোনো কবি-সাহিত্যিক লিখতে পেরেছেন কি-না আমার জানা নেই। তাঁর হাম্দ ও নাত শুনলে অনাবিল আনন্দে হৃদয়-মন ভরে যায়। আবার কীর্তন ও শ্যামসঙ্গীত শুনলে অদৃশ্য আবেগে দেহমন আবিষ্ট হয়। আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তিনি একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে রূপায়িত করেছেন।
১৯৪২ সালের কথা। সৃষ্টিশীল জীবনের সায়াহ্নে তিনি 'বাঙালির বাংলা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নবযুগ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি প্রমাণ করে নজরুল একজন মহান কবি বা সাহিত্যিকই নন বরং তিনি একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। প্রবন্ধটির শুরুতে তিনি লিখেছেন, 'বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে 'বাঙালির বাংলা'_ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে'। এই প্রবন্ধের শেষে নজরুল লিখেছেন_ 'বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।'
তাঁর কবিতা ও গানে যুগে যুগে এ দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের অগি্নঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান আমাদের দেহে ও প্রাণে প্রবল শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে_
'এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/
কারার এই লৌহ কপাট-ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম/
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে/
একি অপরূপ রূপে মা তোমার
হেরিনুপল্লী জননী/
এবং দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নীশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার'
তিনি রচনা করেছেন এ ধরনের আরও অনেক গান ও কবিতা।
নজরুলের কাব্যে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়েছে চিরকল্যাণময়ী নারীর শতরূপ। প্রেম, মমতা, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের কথা রূপায়িত হয়েছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন :
নর নহে, নারী, ইসলাম, পরে প্রথম আনে ঈমান
আম্মা খাদিজা জগতে সর্বপ্রথম মুসলমান।
পুরুষের সব গৌরব ম্লান, এই এক মহিমায়।
তার শ্যামা সঙ্গীতেও মায়ের প্রতি ভক্তিরসের ধারা প্রবহমান_
ভক্তি, আমার ধূপের মত
ঊধর্ে্ব উঠে অবিরত
শিবলোকের দেব দেউলে
মা'র শ্রীচরণ পরশিতে।
নজরুল আরও লিখেছেন :
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
অর্থাৎ নজরুল এখন থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে পরাধীন সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য লক্ষ্য করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে একটি স্বাধীন দেশে এখনও কি নারীরা সমান অধিকার বা মর্যাদা ভোগের সুযোগ পাচ্ছেন? আর নারীর অধিকার কিছুটা সমুন্নত করতে উদ্যোগী হলে আজও এ দেশে প্রবল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়। তবে যত বাধাই আসুক বাংলাদেশে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক। তার গুণ ও অবদানের কথা বলতে গেলে বহু সময়ের প্রয়োজন। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে নজরুলই প্রথম ও শেষ বাঙালি, যিনি সৃজনশীল প্রতিভায় বাঙালি চেতনাকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করতে সক্ষম হন। আর এসব কারণেই তিনি বাঙালির জাতীয় কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
একটি পরিশীলিত সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার মাধ্যমে আমরা তার প্রতি সত্যিকার অর্থে সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত জাতীয় কবি

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহের কিংবা প্রেমের কবিই নন, তিনি আমাদের জাতীয় কবিও। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে এ মর্যাদা দেওয়া হলেও তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ এবং সৃষ্টিকর্মের প্রসারে নেই আন্তরিক কোনো উদ্যোগ। নজরুল গবেষকরা জানান, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমেও অবহেলিত এ কবি। সরকারি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি উপেক্ষিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে উদ্‌যাপন করলেও নজরুলজয়ন্তী পালনের ক্ষেত্রে এমন কোনো চিন্তা সরকারের নেই।


জানা যায়, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হলেও প্রচারের অভাবে এটি পড়ে রয়েছে অন্তরালে। একই অবস্থা নজরুলবিষয়ক ওয়েবসাইটেরও। বন্ধ হয়ে গেছে নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থানকেন্দ্রিক পর্যটন কার্যক্রম। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় কবির ১১২তম জন্মোৎসব।
জাতীয় কবির মৃত্যুর সাড়ে তিন দশক পরও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রকাশ সম্ভব হয়নি তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী। নির্মাণ করা হয়নি কোনো তথ্যচিত্র। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুল এখনো অনেকটাই অচেনা, অজানা।
নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানগুলোকে ঘিরে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিলেও কখনোই সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারি না থাকায় নজরুলের নামে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধের পথে। এ সবের পাশাপাশি চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নজরুলের নামে জাতীয় পর্যায়ে আজও কোনো পদক বা পুরস্কার চালু করা হয়নি।
নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেই পর্যাপ্ত বাজেট। জানা যায়, নজরুল ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও প্রকাশনা খাত মিলিয়ে বাজেট ১৫ লাখ টাকা। আর নজরুলের নামে একমাত্র সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে গবেষকের পদ মাত্র একটি। অন্যদিকে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান 'নজরুল একাডেমী' এখন গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে শুধু সংগীতচর্চাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নজরুল বিষয়ে গবেষণার দুঃখজনক দিক হচ্ছে, যাঁরা এ বিষয়ে পিএইচডি করেন, তাঁরা চাকরি পান না। আমি আমার তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত পাঁচজন শিক্ষার্র্থীকে পিএইচডি করিয়েছি। তাঁদের কারোরই চাকরি হচ্ছে না।'
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতেও উপেক্ষিত জাতীয় কবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে তাঁর রচনা পড়ানো হয় মাত্র ২৬ নম্বরের জন্য। আর সেটাও ঐচ্ছিক, আবশ্যিক নয়। শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিষয়ে পাঠ্যসূচি সাজানো হয়েছে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পাঠক্রম দিয়ে। নজরুলের ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা আড়াল করার উদ্দেশ্যেই ওই মডেলকে অনুসরণ করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠসূচিতে জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের রচনা এক শ নম্বরে আবশ্যক করার প্রস্তাব দিয়ে বেশ কয়েকবার তিনি তিরস্কৃত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সংগীত বিভাগেও অবহেলিত ক্ষণজন্মা এই সংগীতস্রষ্টা। সংগীত বিভাগে পাঁচজন রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষকের বিপরীতে নজরুলসংগীতের শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে যেসব বিভাগ খোলার কথা ছিল, তার বেশির ভাগই খোলা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু নজরুলের নামে করেই যেন তাঁর প্রতি দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে রাষ্ট্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমেও সেভাবে স্থান পাচ্ছে না জাতীয় কবির রচনাবলি।
সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে দেশের একমাত্র গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতেও উপেক্ষিত নজরুল। একাডেমী খ্যাতিমানদের পাশাপাশি অনেক অখ্যাত ব্যক্তির জীবনী প্রকাশ করলেও জাতীয় কবির জীবনী প্রকাশ করেনি। এখনো পূর্ণাঙ্গ নজরুল রচনাবলি প্রকাশ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। কবির অনেক বই এখন পুনর্মুদ্রণ করার মতো সময় নেই বাংলা একাডেমীর! জানা যায়, ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমীকে নজরুলের শতাধিক গানের স্বরলিপি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর তিন খণ্ডে স্বরলিপি প্রকাশ করা হলেও, পরে তা আর প্রকাশ করা হয়নি। একই সঙ্গে, একাডেমীতে নির্মিত 'নজরুল মঞ্চ' বইমেলার সময় ছাড়া ব্যবহার করা হয় না। বইমেলার সময় মোড়ক উন্মোচন করার কাজে এই মঞ্চটি ব্যবহৃত হয়। বাকি সময় মঞ্চটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে।
সরকারি আরেকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত আড়াই শতাধিক বই, এগারোজন শিল্পীর চিত্রপ্রতিলিপি, বিশজন শিল্পীর চিত্রকর্মের ভিউকার্ড প্রকাশ করেছে। অনেক বিদেশি শিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশিত হলেও নজরুলের আঁকা চিত্রকর্মের বই প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে তাঁর নাটক, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত বইও একাডেমী প্রকাশ করেনি। শিল্পকলা একাডেমী নিজস্ব প্রযোজনায় নাটক নির্মাণ করলেও, তাতে ঠাঁই হয় না নজরুলের। অথচ বিদেশি নাট্যকারের নাটক অহরহ প্রযোজনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু নজরুলের লেখা আশিটি নাটকের একটিও এখনো প্রযোজনা করেনি শিল্পকলা একাডেমী।
জাতীয় কবির গান এখন অবহেলিত। নজরুলের প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো গান রয়েছে। কিন্তু সব গান না বাজিয়ে ঘুরেফিরে শ'খানেক গানের মধ্যেই আটকে আছে নজরুলসংগীতের চর্চা। সরকারি বেতার-টেলিভিশনেও নজরুলবিষয়ক অনুষ্ঠান ও নজরুলসংগীতের প্রচার বাড়েনি। এমনকি দেশের রণসংগীতও অবহেলিত। সেনাবাহিনীর রণসংগীত 'চল চল চল' নজরুলের লেখা। কিন্তু সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রণসংগীতকে বাদ দিয়ে বাজানো হয় অন্যান্য দেশাত্মবোধক গান। এমনকি জাতীয় প্যারেডের সময়ও তেমন মর্যাদা পায় না গানটি। আর দশটি গানের মতোই বাজানো হয় এটি।
কবির স্মৃতিধন্য স্থানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সংরক্ষিত না হওয়ায় বদলে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে কবির স্মৃতিচিহ্ন। অন্যান্য দেশে জাতীয় কবির স্মৃতিজড়িত সব স্থান সংরক্ষণের আওতায় নেওয়া হলেও, এদেশে তা হয়নি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থান, স্থাপনাগুলো দেখার সুযোগ করে দিতে নজরুল ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন 'নজরুল পর্যটন' চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এ কার্যক্রম গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বন্ধ। এ প্রসঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার বলেন, নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানগুলোর সংস্কার চলছে। সংস্কার সম্পন্ন হলে এই প্রকল্প আবার শুরু হবে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নজরুল চিকিৎসাধীন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলার ১১৭ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষটিও সংরক্ষিত নয়।
নজরুল ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ঢাকায় নজরুলের স্মৃতিধন্য ৩১টি স্থান রয়েছে। সেসব স্থান সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিফলক বসানোর জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাছে নজরুল ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে আবেদন করা হয়েছিল। সে আবেদনে সাড়া দেয়নি ডিসিসি। ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত কবি ধানমণ্ডির যে বাড়িতে বাস ছিলেন, পরিকল্পনার অভাবে সে বাড়িটি এখন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। বাড়ির সামনের যে বাগানে কবি হাঁটতেন, তা পরিণত হয়েছে গ্যারেজে। এভাবেই জাতীয় কবিকে অবহেলিত করে রাখা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পরিকল্পনাও নেই সরকারের।

Sunday, May 15, 2011

পার্লামেন্টে সর্বসম্মত প্রস্তাবঃ যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের হুমকি

পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঢুকে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যায় মার্কিন কমান্ডোদের একতরফা অভিযানের পর এত দিন চুপচাপ ছিল ওয়াশিংটনের মিত্র ইসলামাবাদ। কিন্তু নিজেদের ক্ষোভ আর চেপে রাখত পারল না তারা। ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযান চালালে এবং মার্কিন ড্রোন হামলা বন্ধ করা না হলে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইসলামাবাদ।


এ-সংক্রান্ত একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গতকাল শনিবার পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে পাস হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের বিষয়টিও পর্যালোচনা করে দেখবে পাকিস্তান। আর, যুক্তরাষ্ট্রের ওই একতরফা অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল আহমেদ সুজা পাশা পার্লামেন্টের কাছে তাঁর পদত্যাগের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। বিন লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে না পারার ব্যর্থতা আর জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সব সমালোচনার তীর এখন ছুটছে পাশার দিকে।
প্রস্তাব গ্রহণ: ২ মে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যায় মার্কিন কমান্ডোদের অভিযান এবং গত শুক্রবার দুটি বড় আত্মঘাতী বোমা হামলার পর গতকাল পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন বসে। অধিবেশন চলে ১০ ঘণ্টার বেশি সময়। প্রস্তাবে মার্কিন অভিযানের নিন্দা জানানো হয়। আইনপ্রণেতারা বলেন, ওই অভিযানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। পরে তাঁরা একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত হচ্ছে কি না, এ বিষয়টি মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ‘অ্যাবোটাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অভিযানের মতো কোনো পদক্ষেপ পাকিস্তানের মানুষ আর বরদাশত করবে না। এ ধরনের পদক্ষেপের পুনরাবৃত্তি হলে এ অঞ্চলসহ বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।’
অ্যাবোটাবাদের অভিযানের দায়দায়িত্ব নিরূপণ ও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে করণীয় নির্ধারণের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনেরও আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবে।
পাকিস্তান ভূখণ্ডে মার্কিন চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) হামলা ‘অগ্রহণযোগ্য’ অভিহিত করে প্রস্তাবে বলা হয়, ড্রোন হামলা বন্ধ করা না হলে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করবে পাকিস্তান সরকার।
আফগানিস্তানে ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন বিদেশি বাহিনীর জন্য খাদ্য, গোলাবারুদ ও অস্ত্রসরঞ্জাম পাঠানোর জন্য পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করা হয়। ওই পথে সরবরাহ-বহরের ওপর মাঝেমধ্যেই হামলা চালায় জঙ্গিরা।
গত এক বছরে পাকিস্তান ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা দ্বিগুণ করেছে মার্কিন বাহিনী। এ পর্যন্ত ১০০-র বেশি ড্রোন হামলায় মারা গেছে প্রায় ৭০০ মানুষ। গত বৃহস্পতিবারও উত্তর ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন হামলায় তিন জঙ্গি নিহত হয়। গোয়েন্দাসূত্র বলে থাকে, পাকিস্তান সরকার কৌশলে ওই হামলার অনুমোদন দেয়। তবে পাকিস্তানি নেতারা বরাবর তা অস্বীকার করে এসেছেন। আর এ ধরনের একের পর এক হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ।
সুজার পদত্যাগের প্রস্তাব: গতকাল পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণের আগে শুক্রবার আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলেন আইএসআইয়ের প্রধান আহমেদ সুজা পাশা। তাঁদের আলোচনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে কিছু জানানো হয়নি। তবে পার্লামেন্টের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানায়, আইএসআই-প্রধানের পদ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন সুজা পাশা। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, অ্যাবোটাবাদের ঘটনা তদন্তে পার্লামেন্টের গঠিত যেকোনো কমিশনের সামনে তিনি হাজির হবেন।
অন্য একটি সূত্র জানায়, পার্লামেন্ট চাইলে যেকোনো সময় পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন আইএসআই-প্রধান।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ও সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি আইএসআইয়ের প্রধানকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এ তথ্য নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি।
তথ্যমন্ত্রী ফেরদৌস আশিক আওয়াজন জানান, আইএসআই-প্রধান পাশা আইনপ্রণেতাদের কাছে বলেছেন, যেকোনো ধরনের ব্যর্থতার দায় নিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। পাশা বলেন, তাঁদের পূর্ণ অবগতি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে পাকিস্তানে কোনো অভিযান চালাতে দেওয়া হবে না।
নওয়াজ শরিফের অবস্থান: বিরোধী দল মুসলিম লীগের (এন) নেতা নওয়াজ শরিফ বলেছেন, কোনো বিদেশি শক্তিকে পাকিস্তানে কর্মকাণ্ড চালাতে দেওয়া হবে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে নওয়াজ বলেন, ‘মার্কিনদের বুঝতে হবে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে পাকিস্তান কোনো ছাড় দেবে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে চলার নীতিও পাকিস্তান সরকারকে ছাড়তে হবে।’
নওয়াজ শরীফ জানান, পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

নওয়াজের চাপে নত সরকার by হামিদ মির

পাকিস্তানে গত শুক্রবার যখন পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন চলছিল, তখন সেখান থেকে কয়েক শ মাইল দূরে রাইউইন্ড শহরে নিজের বাসায় ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) দলের প্রধান নওয়াজ শরিফ। তার পরও সেখান থেকেই তিনি সরকারকে বারবার চাপ দিচ্ছিলেন, ২ মে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনীর অভিযানের ঘটনা তদন্তে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের জন্য।

ওই সময়ে তিনি নিজের দলের নেতা চৌধুরী নাসির আলী খান ও ইসহাক দারকে ১২ বারের বেশি টেলিফোন করেন। নিরপেক্ষ কমিশন গঠনে সরকারের দিক থেকে বেশ অনীহা ছিল। কেননা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে ঘটনা তদন্তের একটি ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু নওয়াজ শরিফ গত বুধবারই সেনাবাহিনীর এ তদন্ত নাকচ করে দেন। এ ছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো মার্কিন ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলা।
দলীয় নেতাদের নওয়াজ শরিফ জানিয়ে দেন, আবারও ড্রোন হামলা হলে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি যদি প্রস্তাবে থাকে, কেবল তখনই ওই প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া যাবে। এমনকি তিনি প্রস্তাবের দাঁড়ি, কমা, পূর্ণচ্ছেদ পর্যন্ত ধরে ধরে অবহিত করেন নেতাদের।
পার্লামেন্টের প্রায় ১০ ঘণ্টা অধিবেশনের পর গতকাল শনিবার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন পাকিস্তানি আইনপ্রণেতারা। ওই প্রস্তাবে শুধু একতরফা মার্কিন অভিযানের নিন্দাই করা হয়নি, এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনারও আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসলামাবাদে নিযুক্ত একজন ইউরোপীয় শীর্ষ কূটনীতিক বলেছেন, ‘পাকিস্তানের ৬৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।’
পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবের ফলে ইসলামাবাদের কূটনৈতিক মহলের মধ্যে বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক সবচেয়ে ভয়াবহ কী অবস্থায় পৌঁছাতে পারে, তা পর্যালোচনা করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য ইসলামাবাদে নিযুক্ত কূটনীতিককে নির্দেশ দিয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর বিভিন্ন দেশ। অনেক কূটনীতিক এখন বোঝার চেষ্টা করছেন, এখন পাকিস্তানে যদি আবারও ড্রোন হামলা হয়, তাহলে কী ঘটতে পারে। পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটোর সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেবে? বেশির ভাগ কূটনীতিক নিশ্চিত, পাকিস্তান এখন তা-ই করবে। কেননা পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনীর এখন দেশের মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
জানা গেছে, অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক ইতিমধ্যে তাঁদের দেশকে জানিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দেশের সেনাবাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থনই দিয়েছে এবং আইএসআই এখন একা নয়। ১০ ঘণ্টার অধিবেশনের প্রথম তিন ঘণ্টায় অনেক কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে আইএসআইয়ের প্রধানকে। কিন্তু এরপর পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) নেতা জাভেদ হাশমি, সাদ রফিক ও ইশহাক দার তাঁদের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার করেছেন যে তাঁরা এত সব প্রশ্ন তুলছেন কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নয়, ভালোর জন্যই।
জাভেদ হাশমি বলেন, ‘পার্লামেন্ট আপনাদের মায়ের মতোই। এখানে আপনাদের প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের আছে। তাই বলে বাইরের কাউকে আপনাদের ওপর দোষারোপ করার সুযোগ আমরা দেব না।’ দেশের ৬৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম জবাবদিহির স্বার্থে পার্লামেন্টের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন আইএসআইয়ের প্রধান।
রাজনীতিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে গত শনিবার বিকেলে নওয়াজ শরিফ বেশ কঠোর মন্তব্য করেন। নওয়াজ পরিষ্কার করে দেন, তিনি সেনাবাহিনীর বিপক্ষে নন, তবে অবশ্যই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নাক গলানোর বিরুদ্ধে। পিপিপির মন্ত্রী ফেরদৌস আশিক আওয়ান অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন নওয়াজ এই বক্তব্যকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করতে। কিন্তু তাঁর সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। পার্লামেন্টের অনেক সদস্যই লক্ষ করেছেন, ক্ষমতাসীন পিপিপির সদস্যরা সেনা নেতৃত্ব ও নওয়াজের দলের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকা থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য মুনির ওরাকজাইয়ের অভিযোগ, ‘আইএসআইয়ের মহাপরিচালককে যখন পিএমএল(এন) নেতা চৌধুরী নিসার আলী খান প্রশ্ন করছিলেন, তখন পিপিপির সদস্য ফৌজিয়া ওহাব পিএমএল(কিউ) সদস্যদের নিয়ে এর বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছেন।’ এসব সত্ত্বেও অধিকাংশ পার্লামেন্ট সদস্য খুশি এই কারণে যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত একটা মতৈক্যে পৌঁছাতে পেরেছেন।
পার্লামেন্টে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবের ব্যাপারে দুই বড় দলের (পিপিপি ও পিএমএল-এন) অভিন্ন অবস্থানে অনেক কূটনীতিকই বিস্মিত। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই বিষয়ে দুই দলের মধ্যে পার্লামেন্টে বেশ জোরালো মতানৈক্য ও বাক্যবিনিময় হবে। এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ২ মের (বিন লাদেনের হত্যার দিন) ঘটনার তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সরকারপক্ষ কবে নওয়াজের দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী গিলানির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ‘আমরা গোটা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তাই এ থেকে সরে আসার কোনো উপায় নেই আমাদের। শিগগিরই এ ব্যাপারে আমরা কাজ শুরু করব।’
গতকাল এক কূটনীতিক চুপিচুপি ইসলামাবাদে এক মন্ত্রীর বাসভবনে গিয়েছিলেন। ওই কূটনীতিক জানতে চান, আসলেই ন্যাটোর সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার কতটা কঠোর অবস্থানে আছে। ওই মন্ত্রীর জবাব ছিল এ রকম, ‘কিছুদিনের মধ্যে সব দল নির্বাচনের মুখোমুখি হতে চলেছে। তাই আমরা আর ভোটারদের সামনে পুরোনো তামাশা দেখাতে পারি না। ওই দিন শেষ। এখন আমরা যদি ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিই, তবে ভোটাররাই ধর্মীয় দলগুলোকে ভোট দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তার চেয়ে দয়া করে যুক্তরাষ্ট্রকে চালকবিহীন বিমান থেকে হামলা চালানো বন্ধ করতে বলুন, না হলে এখানে আমরা শেষ হয়ে যাব, আর আফগানিস্তানে আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন।’
হামিদ মির: পাকিস্তানি সাংবাদিক, জিয়ো টিভিতে কর্মরত।

ওবামাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন ওসামা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন আল-কায়েদার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেন। ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বানচাল করার জন্যই তিনি ওবামাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার ব্লুমবার্গ টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
ওসামাকে হত্যার পর তাঁর কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। সেগুলো থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এসব বিষয় জানা যায় বলে উল্লেখ করেন এরিক হোল্ডার। তিনি জানান, ওসামার কম্পিউটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এখনো পর্যালোচনা করে দেখছেন। জব্দ করা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন নথি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পেতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যালোচনা করা হতে পারে। এরিক হোল্ডার জানান, নাইন-ইলেভেনের দশম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হামলা চালানোরও পরিকল্পনা ছিল ওসামার।
হোল্ডার বলেন, একজন ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি এখনো উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সেই ব্যক্তি হলেন আল-কায়েদার অন্যতম নেতা আনোয়ার আল আওলাকি। ২০০৯ সালে ডেট্রয়েটগামী একটি বিমানে নাইজেরিয়ার একজন নাগরিকের হামলা চালানোর চেষ্টার সঙ্গে আওলাকির সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওই হামলার চেষ্টারও মূল হোতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। কমান্ডোদের জব্দ করা নথি থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, এটা একেবারেই স্পষ্ট যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওসামা আল-কায়েদা পরিচালনা করছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদের নিষ্ঠুর কৌশল ব্যবহার করেই ওসামার অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে হোল্ডার বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’ তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় সিআইএর কর্মকর্তারা কোনো ভুল করেছেন কি না, তার তদন্ত চলছে। এ ব্যাপারে অনেক অগ্রগতিও হয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওই তদন্ত শেষ হতে পারে।
ওসামার কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফি?: মার্কিন কমান্ডোদের জব্দ করা ওসামার কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফির ভিডিওচিত্র ছিল। গতকাল শনিবার মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে মার্কিন এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ওসামা বা ওই বাড়িতে থাকা অন্য লোকজন পর্নো ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করেছেন বা দেখেছেন, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি না, তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান ওই মার্কিন কর্মকর্তা।
গত ২ মে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অদূরে অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ওসামাকে হত্যা করে মার্কিন কমান্ডোরা।

ন্যাটোর বোমা আমার নাগাল পাবে নাঃ মুয়াম্মার গাদ্দাফি

লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি বলেছেন, তিনি এখন এমন অবস্থানে রয়েছেন, ন্যাটোর বোমা তাঁর নাগাল পাবে না। গত শুক্রবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক অডিওবার্তায় তিনি এ কথা বলেন। এর আগে ইতালি দাবি করে, গাদ্দাফি আহত হয়েছেন এবং দৌড়ের ওপর রয়েছেন। লিবিয়া সরকার তাদের এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে।
গাদ্দাফি বলেন, ‘প্রতিপক্ষ কাপুরুষদের জানাতে চাই, আমি এমন এক স্থানে আছি, যেখানে পৌঁছানো বা আমাকে হত্যা করা সম্ভব না। আমি আছি লাখো মানুষের অন্তরে।’ তিনি বলেন, ন্যাটো জোট বৃহস্পতিবার ত্রিপোলিতে তাঁর বাব আল-আজিজিয়া কম্পাউন্ডে বিমান হামলা চালায়। এতে ‘তিনজন নির্দোষ সাংবাদিক’ নিহত হন।
লিবীয় সরকার অভিযোগ করেছে, দেশটির তেলসমৃদ্ধ নগর ব্রেগায় ন্যাটো জোটের ওই বিমান হামলায় বেসামরিক লোকজন মারা গেছে। তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে ন্যাটো জোট।
ইতালি-ভিত্তিক বার্তা সংস্থা এএনএসএ জানায়, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্কো ফ্রাত্তিনি বলেছেন, বৃহস্পতিবার চালানো ওই বিমান হামলায় সম্ভবত গাদ্দাফি আহত হয়েছেন এবং তিনি ত্রিপোলি ছেড়ে পালিয়েছেন। এ ব্যাপারে ত্রিপোলির বিশপ বলেন, ‘গাদ্দাফি সম্ভবত আহত’ হয়েছেন। কিন্তু ইতালির কাছে গাদ্দাফির অবস্থান ও তাঁর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ নেই।
ফ্রাত্তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কোনো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় খুঁজতে পারেন গাদ্দাফি।’
আল-আরাবিয়া টেলিভিশন জানায়, পশ্চিমাদের এসব প্রতিবেদনের পরপরই লিবীয় সরকারের মুখপাত্র মুসা ইব্রাহিম পশ্চিমাদের দাবি নাকচ করে বলেন, গাদ্দাফি আহত হননি। লিবিয়ার জনগণের মনোবল দুর্বল করার উদ্দেশে পশ্চিমারা গাদ্দাফি আহত হওয়ার খবর ছড়িয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিমান হামলায় বেসামরিক লোকজন নিহত হওয়ার খবরের জবাবে ন্যাটো জোট গতকাল ব্রাসেলসে এক বিবৃতিতে বলেছে, বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে নয়, ত্রিপোলি থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি সামরিক নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে এই হামলা চালানো হয়।
দুই সপ্তাহ আগে ন্যাটো জোটের এক বিমান হামলায় গাদ্দাফির ছোট ছেলে সাইফ আল-আরব গাদ্দাফি ও তিন নাতি-নাতনি নিহত হওয়ার পর ওই হামলায় লিবীয় নেতা গাদ্দাফিও মারা গেছেন বলে গুজব ছড়ায়। কিন্তু গত বুধবার টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, লিবীয় নেতা কয়েকজন উপজাতীয় নেতার সঙ্গে বৈঠক করছেন।
লিবিয়ার সরকারি টেলিভিশনে বলা হয়েছে, ব্রেগা নগরে ন্যাটো বিমান হামলায় অন্তত ১৬ জন মারা গেছে। তবে তা এখনো গাদ্দাফি-সমর্থিত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখানকার একটি অতিথিশালাকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে চ্যানেলটি দাবি করেছে।

বামদের কেন এই বিপর্যয়?

মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। মমতা সেটা বুঝেছিলেন। বামেরা বুঝতে পারেনি। এ কথাই বললেন বাম নেতা গৌতম দেব, যিনি নির্বাচনের আগে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন বিপর্যয় তা নিয়ে বামফ্রন্টের মধ্যেই ‘চুলচেরা’ বিশ্লেষণ চলছে। সেটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। ১৭ মে সিপিআইএম এ ব্যাপারে বৈঠক করবে।

রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি মানস ভূঁইয়া বলেছেন, শুধু নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে ভোট করেছে বলেই এ ফল হয়েছে। আগের নির্বাচনও যদি এমনভাবে হতো, তাহলে তাদের পতন তখনই ঘটত।
বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত। দলের যে মূল্যায়নের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার আমরা ১৯৯ আসনের কাছাকাছি আসন পাব বলেছিলাম, সেটি ছিল ভুল।’ ভোটের পরে সাংবাদিকদের সাঁড়াশি প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, ‘পরাজয়ের কারণ আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করব। সে মতে আমরা শিক্ষা নেব। পরে আপনাদের জানাব।’
দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ১৩ মে বলেছেন, বামদের ভোট আগের নির্বাচনের চেয়ে আট শতাংশ কমেছে। মমতার দলের ভোট আট শতাংশ বেড়েছে। এই ভোট কংগ্রেসের। জয়-পরাজয় এ কারণেই।
তবে বামদের পরাজয়ের জমি অনেক আগে থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল। ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর হুগলি জেলার সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকার টাটাদের মোটর কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়। মমতা এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেন। ধর্মতলায় টানা ২৭ দিন অনশন করেন। এর ফলে তৃণমূলের মাটি আস্তে আস্তে শক্ত হতে থাকে। একইভাবে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে নন্দীগ্রামে রাজ্যসরকার কেমিক্যাল হাব করতে জমি অধিগ্রহণে উদ্যোগী হন। ওই জমি উর্বর এবং এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত। সেখানে গুলিতে ১৪ জন নিহত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা মৌনতা ভেঙে রাজপথে নামেন। এর সুফল আসে ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে। প্রথমবারের মতো তৃণমূল ১৯ জেলার মধ্যে দুটি জেলা পরিষদ দখল করে। অন্যদিকে কংগ্রেস পায় তিনটি জেলা। স্থানীয় সরকারের পঞ্চায়েতব্যবস্থা তিন স্তরের। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। প্রায় সব জেলায় প্রথম দুটি স্তরে তৃণমূল ও কংগ্রেস যথেষ্ট সাফল্য পায়। ওই সময় তৃণমূল ও কংগ্রেস অলিখিত আসন সমঝোতা করেছিল। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওই ধারাবাহিকতায় দুটি দল জোট গড়ে। ওই নির্বাচনে তৃণমূল আগের একটি আসনের পরিবর্তে ১৯টি ও কংগ্রেস সাতটি আসন পায়।
তবে সবচেয়ে বড় কারণ কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসকে কাছে আসতে দেওয়া। ২০০৮ সালে বামদলগুলো কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের ওপর থেকে বামরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ওই সময় প্রণব মুখার্জি বামদের বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রে আমাদের দূরে ঠেলে দিলেও আমরা বাঁচব। কিন্তু রাজ্যে আপনারা খেসারত দেবেন।’
কংগ্রেসের এই প্রবীণ রাজনীতিকের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল।

বুধবারের মধ্যে শপথ নেবেন মমতা

গামী বুধবারের আগেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করেন মমতা। আজ-কালের মধ্যে রাজ্যপাল মমতার দলকে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন।

তৃণমূলের একটি সূত্র জানায়, দিন চূড়ান্ত না হলেও আগামী ১৮ মে বুধবারই নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিতে পারে। ২০০১ ও ২০০৬ সালের ১৮ মে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তবে তৃণমূলের অন্য একটি সূত্র বলেছে, বুধবারের আগেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারেন মমতা। একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রথম অবস্থায় ১৫ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারে। বামফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ছিল ৪৪ সদস্যের।
এদিকে আজ রোববার বিকেলে তৃণমূল কংগ্রেসের নবনির্বাচিত বিধায়কদের বৈঠক বসার কথা। এই বৈঠকে মমতাকে বিধানসভার নেতা নির্বাচন করা হবে।
মন্ত্রিসভায় কংগ্রেসকে যোগদানের আমন্ত্রণ: তৃণমূল কংগ্রেস জোটের অন্যতম শরিক কংগ্রেসকে রাজ্য মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মমতা। গতকাল রাতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে মমতা এ আমন্ত্রণ জানান। মমতা আরও বলেন, ‘আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী আমাদের শপথ গ্রহণের দিন উপস্থিত থাকবেন। আমি প্রণবদার সঙ্গে নয়াদিল্লি যাব এবং তাঁদের আমন্ত্রণ জানাব।’ তবে মন্ত্রিসভায় কংগ্রেস যোগ দেবে কি না, তা এখনো দলটি নিশ্চিত করেনি।
মন্ত্রী হচ্ছেন যাঁরা: মমতা আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, মন্ত্রিসভায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা স্থান পাবেন। মন্ত্রী হতে পারেন বলে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: অমিত মিত্র, মনীশ গুপ্ত, রবি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভন দেব চট্টোপাধ্যায়, জাভেদ খান, ববি হাকিম, মদন মিত্র, সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার, সুদীপ্ত রায়, হায়দার আজিজ শফি, অশোক দেব, গৌতম দেব ও তাপস রায়।
এদিকে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিক টাইমস গতকাল বলেছে, মন্ত্রিসভার আকার ছোট হবে কি না, সে ব্যাপারে কোনো আভাস না পাওয়া গেলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দফায় প্রায় ২৪ জন মন্ত্রী নিতে পারেন। নতুন মন্ত্রিসভায় দু-একজন নারীও থাকতে পারেন বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি। এ ক্ষেত্রে শশী পাঁজা ও স্বাতী খন্দকারের নাম শোনা যাচ্ছে। স্বাতী হুগলি থেকে নির্বাচিত প্রয়াত তৃণমূল সাংসদ আকবর খন্দকারের স্ত্রী। শশীও তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তৃণমূলের রাজনীতিতে যোগ দেন।
ইকোনমিক টাইমস বলেছে, ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সাধারণ সম্পাদক অমিত মিত্র এবং বিধানসভার সাবেক বিরোধী নেতা পার্থ চ্যাটার্জি উভয়েই মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পেতে পারেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়টি মমতা নিজের হাতে রাখতে পারেন। মন্ত্রিসভায় গৌতম দেবকে অন্তর্ভুক্ত করে মমতা উত্তর বাংলার জনগণকে সন্তুষ্ট করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মমতা ওই অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজ শুরুর ইঙ্গিত দেবেন।
মুসলমানদের সন্তুষ্ট করতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকেও এক বা দুজন মন্ত্রী নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মমতার। এ ক্ষেত্রে ববি হাকিমের নাম এখন সবার মুখে। নির্বাচনী প্রচারণায় মমতার খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা গেছে ববি হাকিমকে। তিনি কলকাতা বন্দর আসন থেকে জয়ী হয়েছেন।
৫৩ মুসলিম বিধায়ক: রাজ্যে এবার ৫৩ জন মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে ২২, কংগ্রেস থেকে ১৩ এবং বামফ্রন্ট থেকে ১৮ জন।
২৭ মন্ত্রী পরাজিত: মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ ৩৫ জন মন্ত্রী নির্বাচনে অংশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীসহ ২৭ জন পরাজিত হয়েছেন। জয়ী হয়েছেন আবদুর রেজ্জাক মোল্লা, সূর্যকান্ত মিশ্র, আনিসুর রহমান, সুশান্ত ঘোষ, দশরথ তিরকে, দেব লীনা হেমব্রম, পরেশ অধিকারী ও সুভাস নস্কর।