Saturday, June 18, 2011

নেই ঢাল তলোয়ার, আছে শুধু আবেগ by মাসুদুল আলম তুষার

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। আইনি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি লোকবল সংকটের কারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান কোনো কাজই করতে পারছে না। এই অচলাবস্থার জন্য সরকার দুষছে কমিশনকে। গত দুই বছরে কমিশন মানবাধিকার ইস্যুতে একটিমাত্র ঘটনার তদন্তে অংশ নিলেও সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাগজে-কলমে কমিশনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন পর্যন্ত বিবৃতি ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করতে পারেনি। তদন্তের বাইরে রয়ে গেছে বহু অভিযোগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শতাধিক ঘটনা। মানবাধিকার কমিশনে বর্তমানে আইন আছে, বিধি নেই।


অভিযোগ আছে, তদন্ত নেই। পদবি আছে, লোকবল নেই। কমিশনের নিজস্ব কোনো অফিসও নেই। ফলে মানবাধিকার ইস্যুতে কমিশনের দৃষ্টান্তমূলক কোনো কাজ নেই। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে সরকার আন্তরিক। আর এ কারণেই মহাজোট সরকার গঠনের শুরুতেই সংসদে আইন পাস করা হয়েছে। আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। লোকবল ও বিধি অনুমোদন করা হয়েছে। সহসাই গেজেট প্রকাশ করে বিধি কার্যকর করা হবে। আইনবিধিসহ কোনো কিছুতে পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কমিশন কোনো তদন্ত প্রতিবেদন অথবা সুপারিশ সরকারকে দেয়নি বলে আইনমন্ত্রী জানান। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কমিশন যতটুকু ভূমিকা রাখতে পারত, তা করেনি বলে অভিমত জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'সেখানে কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে।'
সম্প্রতি র‌্যাবের গুলিতে আহত ঝালকাঠির লিমনকে পঙ্গু হাসপাতালে দেখতে গিয়ে গণমাধ্যমের সামনেই কাঁদলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি। কিন্তু তিনি নিজে তদন্তের উদ্যোগ নিলেন না। এভাবেই হেফাজতে মৃত্যু, লাশ গুম, ক্রসফায়ারসহ নানা ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসব ইস্যুতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত নজির স্থাপনের মতো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান অবশ্য প্রতিদিনই নানা সভা-সেমিনারে মানবাধিকার বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ। জনবল না পেলে তিনি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী নিয়ে কাজ করবেন বলেও কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি।
মানবাধিকার কমিশনের কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়ে প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু কিছুই হয়নি। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের কান্না আর আবেগতাড়িত বক্তব্য আমাদের কাম্য নয়। কার্যকর ও গঠনমূলক কাজ প্রত্যাশিত। সরকার কমিশনকে অনেক কিছু না দিলেও যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, এর নূ্যনতম ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে না। সীমাবদ্ধতার মাঝেও কমিশন চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কারণ যেকোনো ঘটনা তদন্তে কমিশন চাইলেই লোকবলসহ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে পারে। অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোও কমিশনকে নানাভাবে সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু কাজের উদ্যোগ না থাকলে তো কেউ কিছু করতে পারবে না।'
কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটিকে রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ দিতে চেষ্টা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। এর পরও অনেক কাজ হচ্ছে না। বিশেষ করে জনবল দেওয়া হচ্ছে না। প্রকাশ্য বাধা না থাকলেও গোপনে অনেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছে। কমিশনের বিধিমালার অনুমোদন ও জনবল বরাদ্দ হয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে বুঝে পাইনি। মানবাধিকার কমিশনকে সহায়তা করা মানেই হচ্ছে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা জনগণের আস্থা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেখানে কমিশনের কাজ করার সুযোগ নেই, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি, সময় বেশি লাগলেও আমরা সফল হব।'
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা তদন্ত করে সে দেশের মানবাধিকার কমিশন নিজেই দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিশন মামলা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাতে পারবে কেবল। নিজের কিছু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি এ প্রতিষ্ঠানকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া, এমনকি মামলা করারও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কমিশনকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এর প্রতিকার করার কোনো ক্ষমতাও পায়নি কমিশন। শুধু সরকারের প্রতিবেদন চাইতে পারবে তারা এবং এর আলোকে সুপারিশ করতে পারবে। আবার কমিশনের সেই সুপারিশ মানতে সরকার বাধ্য নয়।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কমিশন আইন অনুযায়ী মানবাধিকার-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আদালতে মামলা হলে কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ কারণেই বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের অন্তর্ধান নিয়ে কমিশন উদ্যোগ নিতে পারেনি। আরো বেশ কিছু অভিযোগ একই কারণে নিষ্পত্তি করা যায়নি। পার্বত্যাঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে দুজন কমিশনারসহ তিন সদস্যের টিম কাজ করেছিল। সেটিই ছিল একমাত্র নিজস্ব তদন্ত। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সাংঘর্ষিক এ অবস্থানের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি সুপারিশ কমিশন সহসাই সরকারকে দিতে পারে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছরে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত হলেও তা নিজস্ব ছিল না। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজ করেছে কমিশন। বিধি চূড়ান্ত না হলে কোনো অভিযোগের তদন্ত সম্ভব নয়। বিধির পাশাপাশি লোকবল, যানবাহনসহ নিজস্ব অফিসও জরুরি।
জনবল সংকটের সঙ্গে আইনের নানা দুর্বলতার কারণে কমিশন শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেই বিষয়ে সন্দিহান মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন গঠনে সবাই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কমিশনের কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশের কোনো ঘটনায়ই এ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ভূমিকায় দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক।
মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুসারে বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে পারবে না কমিশন। আবার বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত শেষে শুধু সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কমিশন নিজে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইন অনুযায়ী কমিশন সরকার বা এর কর্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেদন চাইতে পারবে। তবে না পেলে করণীয় স্পষ্ট নয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ' জারি করা হয়। ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের কমিশন গঠিত হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ৯ জুলাই সংসদে 'মানবাধিকার কমিশন আইন' পাস করা হয়। বিধি প্রণয়ন বিষয়ে বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী কয়েক দফা সরকারের সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে নিজেই বিধির খসড়া করে ৪ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। কিন্তু সেই বিধি দুই বছরেও চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে চেয়ারম্যান পদে। প্রস্তাবিত বিধির ব্যাপারে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালের ২২ নভেম্বর বিভিন্ন পদে ৬২ জন লোকের নিয়োগ চাওয়া হয়েছিল। সরকার সম্প্রতি কমিশনের জন্য ২৮ জন লোক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু একজনকেও কমিশনে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কমিশনে আপাতত অন্য প্রকল্পের চারজন কর্মকর্তা ও ১০ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। কমিশনের কাজে সহায়তা দিতে শুরুতেই ইউএনডিপির 'প্রমোটিং একসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ' অস্থায়ীভাবে পাঁচজন কর্মী দেয়। তাঁরাই কমিশনের নানা দাপ্তরিক কাজে সহায়তা দিয়ে আসছেন।

আবাসন শিল্প: ক্রেতা-বিক্রেতাকে কাঁদাবে সরকার!

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে তৃতীয়টি হলো বাসস্থান। আধুনিক ও সভ্য মানুষের জন্য উন্নত আবাসন ব্যবস্থা জরুরি। এ জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও মানুষের উন্নয়ন আর পরিকল্পিত আবাসন একসূত্রে গাঁথা। এই জরুরি কাজটি করার মূল দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের কোনো সরকারই সে দায়িত্ব পালন করেনি। বরং এই গুরুদায়িত্ব যখন কাঁধে তুলে নিয়েছেন বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা, তখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার। নিরুপায় মানুষ মাথা গোঁজার একটু আশ্রয়ের জন্য শরণাপন্ন হয়েছে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে। সব সঞ্চয় দিয়ে তারা ক্রয় করছে এক টুকরো স্বপ্নের জমি; কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনের প্যাঁচে পড়ে তারা আজ অসহায়। অসহায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও। উভয় পক্ষের আজ চোখের পানিতে ভাসার দশা।

গতবারের আবাসন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয় এমন কিছু করবেন না। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? আবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয়, এমন কিছুই হচ্ছে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি আবাসন খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ খাত এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সিদ্ধান্তের অভাবেই মূলত আবাসিক খাতের বিভিন্ন প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার রাজউক সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলায় এগুলো বাতিলও করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা আরো ভেঙে পড়েছেন। আবাসন শিল্পের এ সংকট কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ শ্রমিকসহ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৬৯টি উপখাতে বিনিয়োগ করা অর্থ জলে যাবে এবং এর সঙ্গে জড়িত সারা দেশের অন্তত তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আবাসন খাতের এ সংকটের জন্য রাজউক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছেন এ খাতের ক্রেতা-বিক্রেতারা। ক্রেতাদের ভাষ্য, 'সরকারি লোকজনের চোখের সামনে আবাসন ব্যবসায়ীরা
প্লট ও ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে সেই বিজ্ঞাপন প্রচারিতও হয়েছে। আমরা বিজ্ঞাপন দেখে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা জনগণকে যদি সাবধান করত তবে আমরা অননুমোদিত প্রকল্প থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতাম না। এখন মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো জমি কেনার পর বলা হচ্ছে এটা অননুমোদিত প্রকল্প। আমরা এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব? অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি করার পর তা রেজিস্ট্রি করে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন, তাঁদের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?'
আর বিক্রেতাদের বক্তব্য, 'আমরা ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি। এর মধ্যে তারা কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে, আবার বেশির ভাগ প্রকল্পই অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ঝুলিয়ে রাখা প্রকল্পের বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তও দিচ্ছে না। আমরা ধরেই নিয়েছি, যেহেতু কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হবে।'
এ অবস্থায় বিক্রেতা হিসেবে আবাসন ব্যবসায়ীরা ও ক্রেতারা সম্মিলিতভাবে বিপর্যয়ের জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, বিধিমালা চূড়ান্ত করাসহ এ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে রাজউকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতির জন্যই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ একটি বেসরকারি সংগঠনের জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের আদেশ যেন বিনিয়োগকারীদের মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। তাঁরা বলেন, শেয়ার কেলেঙ্কারির ফলে বিনিয়োগকারীদের যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আবাসন খাতের বিপর্যয় তার চেয়ে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে দেখা দেবে।
প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়া : রাজউকের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক বছরে আবাসিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজউক মাত্র ২৬টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে না, আবার অনুমোদন দেওয়া হবে না_এটাও স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। এ কারণে এসব প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি ও বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ বিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা আবাসন খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা বারবার সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রীকে বলেছি, যেসব প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, সেগুলোর অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হোক। আমারও একটি প্রকল্প আছে, যেটা বন্যাপ্রবণ এলাকা নয়, তার পরও অনুমতি পাচ্ছি না। এখন সরকার বলছে, তারা এগুলো রিভিউ করবে। কিন্তু রিভিউ করতে করতে তো এ ব্যবসার বারোটা বেজে গেছে। এ খাতে মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটি প্লট কিনেছে। কিন্তু সেখানে তারা কোনো বাড়ি বানাতে পারছে না। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।'
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিধিবিধান মেনে যেগুলোর আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর কাগজপত্র ঠিক থাকলে সেটা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। অনুমোদনের জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি আছে। কমিটি সেটা দিয়ে থাকে। আবেদনকারীরা ৯০ শতাংশ শর্ত পূরণ করলেও আমরা সেগুলোকে পাসের ব্যাপারে সুপারিশ করি। আর যারা শর্ত অনুসরণ না করে অনুমোদনহীন প্রকল্পের প্লট বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি আমরা। সাধারণ লোকজন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আমরা ওয়েবসাইটে অনুমোদিত প্রকল্পের নামগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। এমনকি রাজউকে এসেও তারা জেনে যেতে পারে, কোনটা অনুমোদিত আর কোনটা অননুমোদিত। কিন্তু লোকজন সেটা না দেখে কিনে ফেলছে। কেউ জেনেশুনে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিলে সেই দায় তো সরকার বা রাজউক নেবে না।'
বিধিমালা নেই : বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রণয়ন করে বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ওই বিধিমালা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ব্যবসায়ীসহ সব মহলে এ বিধিমালা সমালোচিত হয়। স্ববিরোধী বিধি থাকায় এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সরকারও বিপাকে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিধিমালা যুগোপযোগী করার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিধিমালাটি সময়োপযোগী করার জন্য একাধিক বৈঠক করে নতুন নতুন প্রস্তাবও দেয়। কিন্ত অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাব সংযোজন করে এখন পর্যন্ত বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে না। এর পেছনেও আবাসন খাতকে ধ্বংস করতে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ওই বিধিমালা চূড়ান্ত না করে আবাসন প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিতে গড়িমসি করছে রাজউক। অন্যদিকে সরকার নিজেই একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। ওই সব প্লটে লটারির মাধ্যমে খুব সামান্য সংখ্যক লোকই প্লট পেয়ে থাকে। বঞ্চিতের সংখ্যা হাজার হাজার। প্লট না পেয়ে টাকা ফেরত নিতেও তাদের ভুগতে হয়। যারা বরাদ্দ পায়, তাদেরও সময়মতো প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। প্লট বরাদ্দ যারা পেয়েছে, তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছরের আগে রাজউক কোনো প্লট হস্তান্তর করতে পারে না।
এক দেশে দুই নীতি : সরকার ঘোষণা দিয়েছে, জলাশয় ভরাট করা যাবে না, কৃষিজমি অপরিবর্তিত রাখতে হবে ইত্যাদি। অথচ বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ সরকারের নির্দেশ মেনে চলেছেন। কিন্ত সরকারি সংস্থা রাজউক এ নির্দেশ মানছে না। তারা জলাশয় ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে চলেছে একের পর এক। জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই সরকারের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সেই যন্ত্রকে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে সরকার। সরকার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বেসরকারি আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের প্রতি নানাভাবে অবিচার করে চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্লট ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা করলেও তা দক্ষতার অভাবে খুব বেশি লোককে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না।
সরকারি প্লট জনগণের চাহিদা মেটাতে না পারায়, প্লট বরাদ্দ পেয়ে বা না পেয়ে বিভিন্ন হয়রানির কথা শুনে আবাসনের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ ঝুঁকছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কিন্তু এ খাতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকায় প্লট কেনায় আগ্রহীরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। আবার ঢাকা ও এর আশপাশের আবাসন প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করেছে, তারাও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হাতাশ হয়ে পড়েছে। অথচ প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সবার আশঙ্কা দূর হতো বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত।
হাইকোর্টের রায় : রাজউকের অননুমোদিত আবাসিক প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ড ৩০ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত ৭ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট এ নির্দেশ দেন।
আদালতের আদেশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে রাজউককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। রাজউকের অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার ও মাটি ভরাটসহ তাদের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিট আবেদনটি করেছিল। জানা গেছে, ৭০টি প্রকল্পের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিটটি দায়ের করে বেলা।
হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে আবাসন প্রকল্পগুলোতে আরো স্থবিরতা চলে আসছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজউকে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের নিষ্পত্তি হয় না। তা ছাড়া রাজউক থেকে জানানোও হয়নি যে, এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হবে না। বিভিন্ন আবাসন মেলা হচ্ছে। সরকারের অনুমোদন নিয়েই ওই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্লট বিক্রি হচ্ছে। লোকজন কিনছে। কোনো বাধা আসেনি।
রাজউক একের পর এক জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প করে তা বিক্রি করছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হয় না। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাটি ভরাট করলেই পরিবেশ নষ্ট হয়। এটা আবাসন খাতকে ধ্বংস করারই চক্রান্ত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ড্যাপ বাস্তবায়ন : গত বছর এ খাতের স্থবিরতার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ড্যাপ। অপরিকল্পিতভাবে তড়িঘড়ি করে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করায় আবাসন খাতের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আবাসন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে জনগণ ও আবাসন ব্যবসায়ীরা কিছুই অনুমান করতে পারছে না। ড্যাপে ঢাকা ও আশপাশের বিশাল এলাকাকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ড্যাপ নিয়ে একাধিক নকশা প্রকাশ করেছে রাজউক। নকশায় অন্তর্ভুক্ত জমিতে বহুতল ভবন বা আবাসিক এলাকা করার বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এক টুকরো জমি কিনেছে। আবার এমনও আছে, এসব জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে অনেকে। পারিবারিক কারণেই তাদের বসতবাড়ি বড় করতে হয়। সরকার কোনো দিক বিবেচনা না করে হঠাৎ ওই সব এলাকাকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব কারণে আগ্রহী সাধারণ মানুষ জমি কেনার বিষয়ে এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। একইভাবে ব্যবসায়ীরা এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জমি কিনে প্রকল্প করে রাস্তা, খেলার মাঠ, মসজিদ বানিয়ে খোলা জায়গা রেখে অবশিষ্ট জমি আবাসিক এলাকা হিসেবে উন্নয়ন করেছেন, রাজউক সেই জমিকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে। ফলে শহরমুখী মানুষ ওই এলাকার জমি আর কিনতে চাইছে না। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকে গেছে। বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে আনার বিষয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। যারা প্লট কিনেছে, তাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ১৩ শতাংশ এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে।
যদিও এসব বিবেচনা করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ড্যাপ পর্যালোচনার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জনকল্যাণের বিপক্ষে এমন একটি পরিকল্পনাও বেসরকারি আবাসন খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

Monday, June 13, 2011

পুলিশ ছিল মারমুখো

বিএনপি-জামায়াতের টানা ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে পুলিশ ছিল মারমুখো। ব্যাপক ধরপাকড়, পুলিশি অ্যাকশন আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের ত্বরিত সাজার মধ্যে আতঙ্ক ছিল সর্বত্র। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখো অবস্থানের কারণে রাস্তাতেই নামতে পারেনি হরতালকারীরা। বিভিন্ন স্থানে হরতালের পক্ষে বিক্ষিপ্ত মিছিল-সমাবেশ ও পিকেটিং হলেও পুলিশি অ্যাকশনে নাজেহাল হতে হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের। রাজধানীতে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী এবং মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ।


এ ছাড়াও হরতাল চলাকালে সাবেক দুই এমপি আবুল হোসেন খান ও কাজী সেকান্দার আলী ডালিম, মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী নুরে আরা সাফা, বিএনপির গবেষণা সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, যুবদল কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবুল ইসলাম স্বপন ও কৃষকদল নেতা শাহজাহান মিয়া সম্রাটসহ সারাদেশে ৭ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি।
হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে বরেণ্য সাংস্কৃতিক কর্মী গাজী মাযহারুল আনোয়ার, আবু সালেহ, মনির খান, রিজিয়া পারভিন, বেবি নাজনীনসহ সারাদেশে আহত হয়েছেন কয়েক শ। রাজধানীর রাজপথ ছিল অনেকটাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলে। সেই সঙ্গে নগরীর অলি-গলিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। টানা হরতালে গতকাল রাজধানীতে সীমিত সংখ্যক যান চলাচল করলেও ছাড়েনি কোন দূরপাল্লার বাস। ঢাকার রাস্তায় বিআরটিসিসহ গণপরিবহনের দু’একটি বাস চললেও তাতে যাত্রী সংখ্যা ছিল কম। হরতালে ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। তবে লঞ্চ এবং ট্রেনে যাত্রী ছিল কম। অফিস-আদালতে কার্যক্রম চললেও উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের স্থলবন্দরগুলোতে পণ্য খালাস হলেও ট্রাক না চলায় অধিকাংশ বন্দর থেকেই পণ্য বের করা যায়নি। গতকাল রাজধানীতে তেমন কোন সহিংস ঘটনা না ঘটলেও মিরপুরে দুটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
আলতাফ চৌধুরী ও মেজর (অব.) হাফিজ গ্রেপ্তার : সকাল ১০টার দিকে মহাখালীতে গ্রেপ্তার হন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও পানিসম্পদ মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। পিকেটিংয়ের সময় মহাখালীতে এ দুই নেতার পাশাপাশি আরও ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশান থানার ওসি শাহ আলম জানান, যান চলাচলে বাধা দেয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। সকাল থেকে ওই এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা পিকেটিংয়ের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুপুর পর্যন্ত এ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে।
মিরপুরে ২ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ: গতকাল সকালেই মিরপুরে কে বা কারা দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া হরতাল চলাকালে ওই এলাকায় ৪টি বোমা এবং একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয় ৬ জামায়াত কর্মীকে। জানা যায়, পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক মোড়ে বেলা আড়াইটার দিকে রাস্তার খালি জায়গায় ৪টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রুবেল এবং শামীম নামে ২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে সকাল ৮টার দিকে পল্লবী থানা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি মিরপুর সাড়ে ১১ তে অনিক প্লাজার সামনে এলে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়। শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৬ জামায়াত কর্মীকে আটক করে। এরা হলেন- আমিরুল মুমেনিন, আল ফাত্তাহ হাবিবুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, হুসেইন আহমেদ, জামাল উদ্দিন এবং নূরুল আমিন। পল্লবী থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খলিফা জানান, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ার আভিযোগে ৬ জামায়াত কর্মীকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনস্থ আয়ুর্বেদিক কলেজের পাশে পার্কিংরত মাই লাইনের ঢাকা মেট্টো ব ১১-২৮২৫ নম্বরের গাড়িতে ভোর ৫টার দিকে আগুন দেয় কে বা কারা। ফায়ার সার্ভিস মিরপুর ইউনিটের একটি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গাড়ির মালিক ফরিদ উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। একই সময়ে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা অয়ুর্বেদিক কলেজের পাশে একটি গাড়িতে আগুন দেয়। গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্টো ব ১৪-০৭৭৩। গাড়িটি কৃষি ব্যাংক মতিঝিল শাখার স্টাফ বহনকারী। এ বিষয়ে গাড়ির মালিক আব্দুল কাদের বাদী হয়ে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেছেন। দারুস সালাম থানা পুলিশ জানান, ১ নম্বর সেকশনের চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কে বা কারা একটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সারাদেশে গ্রেপ্তার ৭ শতাধিক: মতিঝিলে সাবেক এমপি আবুল হোসেনসহ ৭ জন, হাইকোর্ট এলাকায় এডভোকেট শরিফউদ্দিন ও নয়ন বাঙালিসহ ১৭ জন, নয়াপল্টনে ১৬ জন, রামপুরায় জাসাস নেতা সোহেলসহ ১১ জন, গুলিস্তানে যুবদল নেতা বেলালসহ ৬ জন, সবুজবাগে ৮ জন, লালবাগে ১৪ জন, শাহ আলীতে ১৩ জন, খিলক্ষেতে স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা সুজনসহ ১৭ জন, পল্লবীতে আজাদ হোসেনসহ ১১ জন, শেরে বাংলায় ১৫ জন, গুলশানে ৬ জন, মহাখালীতে ১৯ জন, সেগুনবাগিচায় বিএনপি নেতা আমির হোসেনসহ ১৭ জন, কেরানীগঞ্জে যুবদল নেতা আরিফ খানসহ ২৫ জন, খুলনা মহানগরে সাবেক এমপি কাজী সেকান্দার আলী ডালিম ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ সাদিসহ ৩০ জন, চট্টগ্রাম মহানগরে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী জেলী চৌধুরীসহ ৩১ জন, হবিগঞ্জে ছাত্রদল নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ৯ জন, নীলফামারীতে যুবদল নেতা আতাউর রহমান পাপ্পুসহ ১৩ জন, ময়মনসিংহে ১৬ জন, কিশোরগঞ্জে ৯ জন, বগুড়ায় ১৫ জন, বরিশালে ১৫ জন, পটুয়াখালীতে ১৩ জন, চট্টগ্রাম উত্তরে ১২ জন, কুমিল্লা দক্ষিণে ১১ জন, পিরোজপুরে ১৯ জন, মাদারীপুরে ১৭ জন, বরগুনায় ১৩ জন ও জয়পুরহাটে ৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া র‌্যাবের হামলায় হবিগঞ্জে কৃষক দলনেতা ইলিয়াস ও শহীদ মিয়াসহ ৪০ জন আহত হয়েছে।
লাঠিচার্জে আহত একঝাঁক সাংস্কৃতিক তারকা: হরতালের সমর্থনে মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন একঝাঁক সাংস্কৃতিক তারকা। রাজধানীর এফডিসি এলাকায় পুলিশের লাঠিচার্জে বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক কাজী মাযহারুল আনোয়ার, জাসাস সভাপতি এমএ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান, বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ, কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভিন, চিত্রনায়ক অমিত হাসানসহ প্রায় ৪০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত আবু সালেহকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় লাঠিচার্জের দৃশ্যধারণ করতে গিয়ে লাঠিচার্জের শিকার হয়েছেন বাংলাভিশনের একজন ক্যামেরাম্যান।
অবরুদ্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়: ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম প্রহর থেকে অবরুদ্ধ ছিল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। র‌্যাব-পুলিশের মারমুখো অবস্থানে কোণঠাসা ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সবাই দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন। আগে থেকেই কার্যালয়ে ছিলেন দপ্তর সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন নেতা। তবে পরবর্তীতে বাইরে থেকে কোন নেতাকর্মীকে কার্যালয়ে ঢুকতে বা বেরোতে দেয়া হয়নি। পুলিশ আশপাশের এলাকা থেকে বিএনপি কর্মী সন্দেহে দিনভর অন্তত ৩৫ জনকে আটক করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা, যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম আজাদ ও কৃষক দলের শাহজাহান মিয়া সম্রাট। এর আগে সকাল ৬টার পর মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দিনের প্রথম মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে পুলিশের বাগবিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তি হয়। বাগবিতণ্ডা থামাতে গিয়ে মির্জা ফখরুল মাটিতে পড়ে যান এবং ডান হাতে ব্যথা পান। পুলিশ এ সময় সেখান থেকে ৮ নেতাকর্মীকে আটক করে। এর কিছু সময় পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিছিলে বাধা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকলে লাগাতার হরতালের হুমকি দিয়ে বলেন, পুলিশ যেভাবে আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তা চলতে থাকলে প্রয়োজনে আমরা ৭২ ঘণ্টা ও ৭ দিনের হরতাল দিতে বাধ্য হব। তিনি বলেন, কোন ধরনের পিকেটিং ছাড়াই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে হরতাল পালিত হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। পৌনে ১১টার দিকে মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে আটক করে পুলিশ। তাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলার দৃশ্যের ছবি তোলার সময় সাংবাদিকদের বাধা দেয় সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এ সময় বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন সাংবাদিকরা। পুরো দিনে বিএনপি কার্যালয়ের আশপাশে ৬টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। সকাল সোয়া ৮টায় ফকিরাপুল মোড়ের কাছে ৩টি, সোয়া ১১টার দিকে মহানগর কার্যালয়ের ছাদে দু’টি ও দুপুর সোয়া ১টায় পার্টি অফিসের সামনে ফের আরেকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এদিকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাকরাইল মোড় থেকে যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করে যুবদল।
পুরান ঢাকার চিত্র: ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালতপাড়া ও সদরঘাট এলাকায় হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকটি মিছিল ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দুপুরে জজকোর্টের পূর্ব পাশের মূল গেটে দু’টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। রাস্তায় যানবাহন চলাচল করলেও সংখ্যায় ছিল অনেক কম। সকালে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। আদালতের ভেতর থেকে তারা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হতে চাইলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ ছাড়া হরতালের পক্ষে কোন পিকেটারকেও রাস্তায় দেখা যায়নি। পুরো এলাকার মোড়ে মোড়ে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। সকাল ১১টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগ হরতালের বিপক্ষে একটি মিছিল বের করে। তাদের এক ঘণ্টা পরে হরতালের পক্ষে আরেকটি মিছিল বের করে জাতীয়তাবাদী ঘাট শ্রমিক দল। তবে পুলিশি বাধার মুখে টার্মিনালের গেটেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দুপুর ১২টায় হরতালের বিপক্ষে একটি মিছিল বের করে সরকারি কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। সাড়ে ১২টায় আদালতের ভেতরে হরতালের সমর্থনে পুনরায় মিছিল বের করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আইনজীবিরা। দুপুর ১টায় জজকোর্টের মেইন গেটের পূর্ব পাশে ন্যাশনাল হাসপাতালের গেটে হঠাৎ করে দু’টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। তবে এতে কেউ আহত হয়নি। কোতোয়ালি জোনের (এসি) কামরুজ্জামান বলেন, নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে পিকেটাররা দুটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এদিকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে যথারীতি লঞ্চ চলাচল করেছে। তবে রাস্তায় যানবাহন কম থাকায় নৌ যাত্রীর সংখ্যাও অনেক কম ছিল। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৩ নং গেটে টিকিট বিক্রেতা আবুল খায়ের জানান, অন্যান্য দিনের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। চার ভাগের এশ ভাগ যাত্রীও নেই। ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মাহফুজ মিয়া বলেন, কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে যাত্রী না থাকায় অনেক রুটে কোন লঞ্চ-স্টিমার ছাড়েনি।
হাইকোর্ট এলাকায় মিছিল সমাবেশ: হরতালের প্রথম দিন হাইকোর্ট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। হরতাল হওয়ায় আদালতের বিচারিক কার্যক্রমও চলেনি। হরতালের সমর্থনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও ইসলামিক ল’ইয়ার্স কাউন্সিল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে সুপ্রিম কোর্টের বাইরে যেতে চাইলে প্রধান গেটের সামনে পুলিশ বাধা দেয়। এতে পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের এডিসি (রমনা) নুরুল ইসলাম বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার কায়সার কামালসহ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীকে গুলি করে হত্যা ও গায়ের চামড়া খুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। পরে আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার সভাপতিত্বে আইনজীবীরা প্রধান গেটের পাশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন প্রমুখ। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, সরকারের অন্যায় ও দেশবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা হরতাল পালন করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকার আমাদের সেই সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করেছে। হরতালে বাধা দিয়ে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হয়রানি ও নির্যাতন করছে। মিছিল সমাবেশ করার সময় হাইকোর্ট এলাকা থেকে তিন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরা হলেন শরিফ ইউ আহমেদ, তাজুল ইসলাম মামীম ও নয়ন বাঙালি।
ঢাবি এলাকা: হরতাল চলকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারের সামনে দুপুরে ২টি ককটেল বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশ এলাকায় বলতে গেলে শান্তিপূর্ণভাবেই হরতাল পালিত হয়েছে। ক্যাম্পাসসহ নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ, কাঁটাবন ও শাহবাগ এলাকায় হরতালের পক্ষে কোন মিছিল হয়নি। ছাত্রদলের কাউকেই ওইসব এলাকায় দেখা যায়নি। অথচ কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার স্পট ছিল যথাক্রমে শাহবাগ এবং ক্যাম্পাস। তবে হরতালের বিপক্ষে দু’টি মিছিল হয়েছে। একটি বের করে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ যৌথভাবে। অন্যটি বের করে ইডেন শাখা ছাত্রলীগ। এছাড়া হরতালের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পরীক্ষা হয়নি। নিজস্ব পরিবহন চলেনি। তবে অফিস ও লাইব্রেরি খোলা থাকলেও তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। হরতালের বিপক্ষে দুপুরের দিকে প্রথম মিছিলটি বের হয় নীলক্ষেত এলাকায়। ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ আহ্বায়ক নিঝুমের নেতৃত্বে ওই মিছিল আশপাশ এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মী গ্রেপ্তার
৩৬ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল পালনের প্রথম দিন গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। এতে পুলিশ শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় প্রায় অর্ধশত শিবির কর্মী আহত হয়েছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৮ শিবির কর্মীকে তাৎক্ষণিক সাজা দিয়েছে। গতকাল বিকালে বড় মগবাজার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, স্বৈরাচার আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন করছে। আতংক সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলীয় কর্মীদের গ্রেপ্তার করে সঙ্গে সঙ্গে সাজা দিচ্ছে। এতে অনেক নিরীহ লোক বা পথচারীও হয়রানির শিকার হচ্ছে। যা আইনের শাসনের পরিপন্থি। তিনি বলেন, কোন গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের আদালত ও সাজা প্রদান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গতকাল সকালে রাজধানীর ধোলাইরপাড় এলাকায় জামায়াতের একটি বিক্ষোভ মিছিলে যুবলীগের হামলায় ৯ জন আহত হয় দাবি করে আজহার বলেন, পুলিশের ছত্রছায়ায় তারা হামলা চালিয়ে আহত করার পরও জামায়াতের ২ কর্মীকে আটক করা হয়। তিনি বলেন, যতই নির্যাতন-নিপীড়ন চালাক গণবিস্ফোরণে এ সরকারের পতন হবে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুল ইসলাম, প্রচার সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম, ঢাকা মহানগর আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সহকারী সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বুলবুল, শিবিরের সাবেক সভাপতি ড. রেজাউল করিম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ।
এদিকে হরতাল চলাকালে গতকাল রাজধানীর কমপক্ষে ১২টি স্পটে বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ করেছে জামায়াত। তবে পুলিশ ও প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে এসব মিছিল সমাবেশের স্থায়িত্ব ছিল কয়েক মিনিট। সকালে শ্যামপুর থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা আমীর আ জ ম রুহুল কুদ্দুস, কদমতলী থানা কর্মপরিষদ সদস্য মনির হোসাইন। মিছিলটি যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে শুরু হয়ে ধোলাইরপাড় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ নামধারী একদল যুবক মিছিলে হামলা চালায়। এতে থানা আমীর আ জ ম রুহুল কুদ্দুসসহ ৮ জন নেতাকর্মী আহত হন। ছাত্রলীগের কর্মীরা দু’জামায়াত নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রায় একই সময় পল্টন থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা আমীর অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন, শাহবাগ থানা আমীর এডভোকেট হেলাল উদ্দিন, পল্টন থানা সেক্রেটারি সাখাওয়াত হোসাইন। মিছিলটি ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি থেকে শুরু হয়ে দৈনিক বাংলা হয়ে ফকিরাপুল মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় পুলিশ বা প্রতিপক্ষ কোন কর্মী ধারে কাছে না থাকায় কোন অঘটন ঘটেনি। বংশাল থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে গুলিস্তানে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া ও বংশাল থানা আমীর এস এম রুহুল আমীন। মিছিলটি ফুলবাড়িয়া থেকে শুরু করে প্‌বার্শবর্তী সড়কে গিয়ে শেষ হয়। হাজারীবাগ থানা আমীর শেখ শরীফ উদ্দিন আহমদ, সেক্রেটারি আবদুল বারী আকন্দ, শিবিরের থানা সভাপতি নজরুল ইসালমের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি ট্যানারি মোড় তল্লাবাগ থেকে টালি অফিস রোড, বাংলা সড়ক, রায়েরবাজার হাইস্কুল, ১৫ নং স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে ধানমন্ডি ১৫নং বাসস্টান্ডে গিয়ে শেষ হয়। গুলশান থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে মহাখালীতে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন গুলশান থানা আমীর এ আর এম মনির, থানা কর্মপরিষদ সদস্য সাইফুল ইসলাম ও জামায়াত নেতা নেছারউদ্দিন, মহানগরী উত্তর শিবির নেতা মিজানুর রহমান খান, গুশলান থানা শিবির সভাপতি মিজানুর রহমান, তিতুমীর কলেজ সভাপতি মো. রাসেল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি হাচান মো. ইউসুফ। মিছিলটি মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে রেলগেট দিয়ে মহাখালী দক্ষিণ গেটে গিয়ে শেষ হয়। সূত্রাপুর থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন থানা কর্মপরিষদ সদস্য রেজাউর রহমান খান, মো. কামরুল আহসান হাসান, ছাত্রশিবির মহানগরী দক্ষিণ সেক্রেটারি শাহ মু. মাহফুজুল হক, ছাত্রনেতা সাদেক বিল্লাহ, মিজানুর রহমান, মু. আবু ইউসুফ, শিহাব উদ্দিন, ইমতিয়াজ হোসেন, জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মাহমুদ বাবুল, মাওলানা রফিকুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। রমনা থানা আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, থানা সেক্রেটারি ড. মু. রেজাউল করিম, রমনা থানা শিবির সভাপতি রওশন আহমেদের নেতৃত্বে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বেইলি রোড থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শান্তিনগরে গিয়ে শেষ হয়। মীরপুর ও কাফরুল থানার যৌথ উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে ১০ নম্বর গোলচত্বরে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন কাফরুল থানা আমীর লস্কর মোহাম্মদ তাসলীম, থানা সেক্রেটারি অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম, মিরপুর পূর্ব থানা সেক্রেটারি মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, জামায়াত নেতা আলাউদ্দিন মোল্লা ও আবদুল মতিন খান, শিবির নেতা সোহেল। মিছিলটি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে শুরু হয়ে কাজীপাড়া গিয়ে শেষ হয়। যাত্রাবাড়ী থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন যাত্রাবাড়ী থানা আমীর আবদুস সবুর ফকির, থানা সেক্রেটারি মাহমুদ হোসাইন, জামায়াত নেতা নাজির আহমেদ ভূঁইয়া ও সিরাজুল ইসলাম, শিবির মহানগরী দক্ষিনের সভাপতি হাফেজ জহির উদ্দিন ও সেক্রেটারি শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, যাত্রাবাড়ী থানা সভাপতি মাঈন উদ্দিন প্রমুখ। মিছিলটি শহীদ ফারুক সড়ক থেকে শুরু হয়ে দয়াগঞ্জ দিয়ে ধোলাইরপাড় গিয়ে শেষ হয়। আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানার যৌথ উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে শ্যামলীতে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদপুর থানা আমীর মাওলানা রফিক আহমদ, আদাবর থানা আমীর দেলোয়ার হোসাইন, সেক্রেটারী আ ন ম হাসান নোমান, মহানগরী পশ্চিম সেক্রেটারি সাজ্জাদ হোসাইন ও জামায়াত নেতা আলী আকরাম মোহাম্মদ ওজায়ের প্রমুখ। মিছিলটি তাজমহল রোড থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। খিলগাঁও থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য কবির আহমদ, খিলগাঁও থানা সেক্রেটারি সগির বিন সাঈদ, শিবির নেতা আবদুল কাদের ও আশরাফুল ইসলাম। মিছিলটি খিলগাঁও তিলপাপাড়া থেকে শুরু হয়ে সিটি করপোরেশন অফিসের কাছে গিয়ে শেষ হয়। পল্লবী থানার উদ্যোগে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ মিছিলকারীদের ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং ৬ জন জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল আমীন, জামালউদ্দিন, হাবিবুল্লাহ, হাফেজ হোসাইন মাহমুদ ও আমিরুল মুমিনিন।

জাতীয় ঐকমত্য জরুরি by তারেক শামসুর রেহমান

সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে গত ৮ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য ৫১ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি এ সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে।

ওই সুপারিশমালায় কী আছে, তা পাঠক ইতিমধ্যে জেনেও গেছেন। বিশেষ কমিটি গত ১০ মাসে ২৭টি বৈঠক করেছে। তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্যও নিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিদের কেউ কেউ বিশেষ কমিটির আমন্ত্রণে বক্তব্যও রেখেছেন; কিন্তু যেটা অবাক করার বিষয় তা হচ্ছে_ বিশেষ কমিটি কারও সুপারিশই আমলে নেয়নি। সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা ইত্যাদি যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের শাসনামলে এটি পাস হয়েছিল। এরশাদ এখনও চাচ্ছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি সংবিধানে থাকুক। রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে মহাজোটের শরিক বাম দলগুলোর প্রবল আপত্তি রয়েছে। এমনকি সেক্টর কমান্ডার্স ফেরামের সুপারিশও গ্রহণ করা হয়নি। ইতিমধ্যে অষ্টম সংশোধনীকে (১৯৮৭) চ্যালেঞ্জ করা একটি রিট পিটিশন (২৩ বছর আগে করা) পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্ট সরকারের ওপর একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট গত ৫ জুন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে।
উত্থাপিত সুপারিশমালা, বিরোধী দলের তাতে অংশগ্রহণ না থাকা, সর্বোপরি ২৩ বছর আগে করা একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্টের কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান_ সব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশটি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধান সংশোধনের মতো একটি জাতীয় ইস্যুতে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না। এখন সরকার যদি এককভাবে সুপারিশগুলো পাস করিয়ে নেয় তাহলে এর পরিণতির জন্য সরকারই এক সময় অভিযুক্ত হবে। বিশেষ কমিটি অনেক বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তার ধরন রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল; কিন্তু যে বিভক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তারই প্রতিফলন ঘটল সংবিধান সংশোধনীতে। সংবিধান সংশোধনীকে কেন্দ্র করে বেশকিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার জবাব খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তি হচ্ছে, উচ্চ আদালতের একটি রায়। কিন্তু রায়ে একথাটিও বলা হয়েছিল যে, আরও দুটি টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সুপারিশে এটি নেই। তাই সঙ্গত কারণেই সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়_ এ অভিযেগে কাটিয়ে ওঠা এখন কঠিন হবে। সংবিধানে মাত্র দুই টার্মের জন্য এ ব্যবস্থা থাকবে, এ ধরনের বিধান রাখা যায় না। এমনকি মূল সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেভাবে আছে, সেটাও রাখা যাবে না। কেননা তাতে করে সংবিধানে ৫৮গ(৩) ধারা মতে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা, যাতে বিএনপির রয়েছে প্রবল আপত্তি। তাই সংবিধানে নয়, বরং সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এই 'দলনিরপেক্ষ'-এর ব্যাখ্যাও সংসদকে দিতে হবে। সংসদ একটি 'এলডার্স কাউন্সিলের' প্রস্তাব করতে পারে, যেখানে চারজনের একটি টিম (দু'জন আওয়ামী লীগের, দু'জন বিএনপির মনোনীত নিরপেক্ষ ব্যক্তি) নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এখানে কেউ এককভাবে 'প্রধান উপদেষ্টার' দায়িত্ব পালন করবেন না। বিকল্প হিসেবে তিনজন 'সিনিয়র সিটিজেন (একজন প্রবীণ প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন সুশীল অথবা ব্যবসায়িক সমাজের প্রতিনিধি) নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। সংসদ যদি এ ধরনের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ধরে রাখার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগে থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে বলার কিছু থাকবে না। দুই. প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। এটাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা আগামী মাসেই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ পদে নতুনদের নিয়োগ দিতে হবে। এখন সরকার যাদেরই নিয়োগ দিক, তাদের নিয়ে বিতর্ক উঠবে। তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হবে। আর এটা তো ঠিক সামরিক-বেসামরিক আমলারা তাদের অবসরের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার দল ক্ষমতায় গেলেই তারা সরকারের একটা 'পদ' বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে, এখানে 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তি এখন খুঁজে পাওয়া ভার। 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী' হিসেবে যে তত্ত্বই হাজির করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সচিবালয়ের আমলারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেছেন। কেউ এখন বিএনপির আমলা, কেউ আওয়ামী লীগের। সুতরাং সরকার এখন যাদেরই এ পদে নিয়োগ দেবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি। সুতরাং এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিযুক্তি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায়। প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কর্মপরিধির মধ্যেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তিন. বিশেষ কমিটি যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছে ঠিক তখনই অষ্টম সংশোধনী, অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কেন সংবিধান পরিচালিত নয়, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। এখন হাইকোর্ট যদি একটি রায় দেন তাহলে তা সংসদ সদস্যদের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাতে করে হাইকোর্ট অবমাননার প্রশ্ন উঠতে পারে। উপরন্তু সুপারিশমালায় রয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়া, যেখানে বলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। এ ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরস্পরবিরোধী। এমনকি সংবিধানের ২৫(২) ধারায় যেখানে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন'_ সংবিধানের এ অংশটুকু নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে এটি সংযোজন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এ অংশটুকু ছিল না। বিশেষ কমিটি অবিশ্যিই এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করেনি। পঞ্চম সংশোধনী এখন উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ায় যে কেউ এখন সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। চার. সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে 'বাঙালি' এবং নাগরিক হিসেবে 'বাংলাদেশী' হিসেবে পরিচিত হবেন। এটা কি নতুন করে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করবে না? তবে একটি ভালো দিক হচ্ছে, প্রস্তাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কোনো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে কোনো আদিবাস নেই। পাঁচ. খসড়ায় অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মতো কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি নিয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, কেন অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত হয়, সে ব্যাপারে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে তাদের দায় এড়াতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অসহযোগিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা, সংসদ একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া ইত্যাদি কারণেই অসাংবিধানিক শক্তিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ছয়. নির্বাচন কমিশনে চারজন কমিশনার (দু'জনের পরিবর্তে) নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবের কোনো গুরুত্ব নেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোকদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার তার 'পছন্দের' লোকদের নিয়োগ দেয়। ফলে বিতর্ক বাড়ে। সুপ্রিম জডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হবে। এটি একটি ভালো প্রস্তাব। সাত. সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। বরং নারীদের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে এবং সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিতে হবে। সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে এক-পঞ্চমাংশ কিংবা এক-ষষ্ঠাংশ আসনে মহিলাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিএনপির মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা বিএনপি তথা চার দল প্রায় ৩৭ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। স্পিকার নিজে উদ্যোগী হয়ে বিএনপির মতামত নিতে পারেন এবং তা সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধান সংশোধন নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।

সংস্কৃতির জয়যাত্রা ও কিছু প্রস্তাবনা by মিলন কান্তি দে

যাত্রা শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা সরকারের আরেকটি সময়োচিত উদ্যোগ। এর ফলে অবহেলিত এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছে। আমাদের নাগরিক সমাজ অন্তত কিছুদিন হলেও নিয়মিত যাত্রা দেখতে পেরেছে। সরকারি অর্থায়নে দুটি বিভাগীয় শহরে দুটি যাত্রা উৎসব করা সম্ভব হয়েছে রাজনীতির কোলাহল যতই থাক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধান সংশোধন এবং আদালতের রায় নিয়ে যতই বিতর্ক চলুক, অন্যদিকে দেশে এখন সুবাতাস বইছে। সেটি হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গন। নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, জাদু, সার্কাস ও যাত্রাপালার ঐকতান বাদনে সরব মাঠ ঘাট প্রান্তর। বলতে গেলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে চলছে সংস্কৃতির মহোৎসব।

এই যে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার একটি আবহ বিরাজ করছে এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে সরকার, এ সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় তেমন ব্যাপক প্রচারণা নেই। ফলে বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশদভাবে জানতে পারছে না সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বর্তমান মহাজোট সরকারের মহতী উদ্যোগের কথা।
২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারের অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের পৃষ্ঠপোষকতা ও মানোন্নয়নে একটি প্রকল্প চালু করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্প থেকে অনুষ্ঠানের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে নাটক, সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য, জাদু ও যাত্রা শিল্পের সংগঠনগুলো। গত মার্চ মাস থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার মেয়াদ ১৫ জুনের মধ্যে। আমাদের কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং শিল্পকলা একাডেমীর সুপারিশক্রমেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি অনুমোদন করে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সমাজ-সংস্কৃতির উন্নয়ন অপরিহার্য। অতীতের সংস্কৃতিবিমুখ সরকারগুলো বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেনি। পাকিস্তান আমলে যে স্বৈরাচার শাসকরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছিল, তাদেরই প্রেতাত্মা ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে কোনো কোনো সরকারের মগজে। বাঙালি সংস্কৃতিকে চিরতরে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছিল তারা। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলার মধ্যেও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া বর্তমান সরকারের একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়ে রইল।
মূলত দেশ ও জাতির যথার্থ পরিচিতি, তার ইতিহাস, সংগ্রাম, ঐতিহ্য সবকিছুই প্রতিভাত হয়ে ওঠে সে দেশের সাংস্কৃতিক দর্পণে। শিল্পোন্নত দেশগুলোয় দেখা যায়, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি তথা নাটক, সঙ্গীত, নৃত্যকলা চর্চায়ও সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ জাপানের 'কাবুকি' ও 'নো' থিয়েটার। শিল্প কারখানা, স্থাপত্যে অধিকতর সমৃদ্ধ এই দেশটি তার ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি। কাবুকি ও নো হচ্ছে সে দেশের এক ট্রাডিশনাল থিটোর আর্ট ফর্ম, যে থিয়েটারকে টিকিয়ে রাখতে জাপান সরকারকে পুঁজি খাটাতে হয় প্রতিবছর। শ্রদ্ধেয় নাট্য ব্যক্তিত্ব, এ দেশে অ্যাবসার্ড নাটকের পথিকৃৎ প্রয়াত সাঈদ আহমেদ একবার বলেছিলেন, এই দুই থিয়েটারের নান্দনিকতা এতটাই হৃদয়স্পর্শী যে, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জাপান সফরে এলে নো ও কাবুকি দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
এত কিছু বলার অর্থ এটাই যে, সংস্কৃতির বহু উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদের এই স্বদেশভূমিতে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতির এক-একটি ধারা। কবিগান, হাফ-আখড়া, মনসামঙ্গল, রয়ানি, গম্ভীরা, পুতুলনাচ_ এসব কালেভদ্রে খুঁজে খুঁজে কোনো বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য নাগরিক সমাজে নিয়ে আসা হয়। কাবুকি ও নো থিয়েটারের মতো বাঙালির পরিচয়বাহী এসব সাংস্কৃতিক শেকড়গুলোকে আমরা কি সমকালীন জীবনধারায় উপস্থাপন করতে পারি না? বর্তমান সংস্কৃতিবান্ধব সরকারই এটা পারে। সংস্কৃতির মানোন্নয়নে যে প্রকল্পটি চালু হয়েছে তার প্রথম মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ মাসেই। আগামী অর্থবছরে শুরু হবে দ্বিতীয় মেয়াদের কর্মসূচি। ওই কর্মসূচিতে লোকসংস্কৃতির উলি্লখিত বিষয়গুলোর জন্য একটা নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব রাখছি।
শিল্পকলা একাডেমীতে আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের পর এখন চলছে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের জাতীয় নাট্যোৎসব। ক'দিন আগে শেষ হলো পথনাট্যোৎসব। এসব উৎসবের উদ্দেশ্য শুধু নাটক মঞ্চায়নই নয়, অভিনয় ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাই তো আমরা দেখি নাটকে এসেছে নতুন প্রাণ, নতুন দায়বোধ।
সংস্কৃতিক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ সংস্কৃতিকর্মীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার এক রকম স্বীকৃতি বলেই আমরা মনে করি। তবে এই প্রকল্পের আওতায় সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক উন্নত রূপ দাঁড় করানো যায় এভাবে_ একটি নাট্য গবেষণাগার ও থিয়েটার ইনস্টিটিউট স্থাপন, প্রতিটি উপজেলায় সঙ্গীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, একটি জাতীয় আবৃত্তি একাডেমী প্রতিষ্ঠা।
যাত্রা শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা সরকারের আরেকটি সময়োচিত উদ্যোগ। এর ফলে অবহেলিত এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছে। আমাদের নাগরিক সমাজ অন্তত কিছুদিন হলেও নিয়মিত যাত্রা দেখতে পেরেছে। সরকারি অর্থায়নে দুটি বিভাগীয় শহরে দুটি যাত্রা উৎসব করা সম্ভব হয়েছে বলেই একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে যাত্রা সম্পর্কে যে গোঁড়ামি, যে উন্নাসিকতা ছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই আয়োজনে দর্শক সুস্থ যাত্রামুখী হতে পেরেছে।
সবশেষে একটা কথা বলা প্রয়োজন, সৃষ্টিশীল ও উন্নয়নমূলক যে কোনো কাজ শুরু করাটাই যথেষ্ট নয়, সার্বিক সাফল্য ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এর ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হয়েছে। এর পরেই শুরু হবে শিল্পকলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে সংস্কৃতিবিষয়ক প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদের বরাদ্দ বণ্টন। আশা করি আমাদের উলি্লখিত প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় আসবে।

দৃষ্টিনন্দন ফুরানোর ফুলরাজি by এমএ ফারুখ

জাপানের সর্ব উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইডোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি চমৎকার শহরের নাম 'ফুরানো'। শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে পাহাড়-পর্বত এবং বনাঞ্চল। তবে এই পাহাড়-পর্বতের গায়ে চাষ করেই ফুরানো কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সমগ্র জাপানে গাজরের চাহিদার সিংহভাগ উৎপাদিত হয় ফুরানো থেকে। চমৎকার আবহাওয়া, নৈসর্গিক শোভা, অপেক্ষাকৃত বড় দিনদৈর্ঘ্য এবং ঈষৎ ঠাণ্ডা রাত ফুরানোতে কৃষিকাজের জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

জাপানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে ফুরানো একটি বিখ্যাত পর্যটনস্থল মূলত দুটি কারণে। এর একটি হলো ফুরানোর অতি সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ 'ল্যাভেন্ডার ফিল্ড' এবং দ্বিতীয়টি হলো 'স্কি রিসোর্ট', যা প্রধাণত ইউরোপ, আমেরিকার পর্যটকদের কাছে সমধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ফুরানোর সবচেয়ে বড় ল্যাভেন্ডার ফিল্ডটি 'তমিতা ফার্ম' এর অংশ। তমিতা ফার্মটি হোক্কাইডোর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ফুলের ফার্ম। এটি মূলত একটি ল্যাভেন্ডার ফার্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন এখানে বৃহদাকারে চেরি, টিউলিপ, লুপিনসহ বহুবিধ ফুলের চাষ হয়। শত শত হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত এই ফার্মের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানটির নাম 'রেইনবো ফিল্ড', যেখানে বিভিন্ন বর্ণের ফুলের সারি খুব সন্তর্পণে পাহাড়ের গা বেয়ে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। তমিতা ফার্মে একটি 'গ্রিনহাউস' রয়েছে, যেখানে সারাবছরই কিছু ফুলের চাষ করা হয় পর্যটকদের জন্য। ফার্মে ঢুকতে কোনো প্রবেশ ফি দিতে হয় না এবং যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটানো যায়।
তমিতা ফার্মের কর্ণধার হলেন তাদাও তমিতা, যিনি ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রায় তিন পুরুষ ধরে হোক্কাইডোতে বসবাস করছেন। তাদাও তমিতা ২৫ বছর বয়স থেকে ফুরানোতে ল্যাভেন্ডারের চাষ শুরু করেন। সে সময় তমিতা ফার্মের এই প্রধান কর্তাব্যক্তিটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ফুরানোর ঠাণ্ডা ও শুকনো আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ল্যাভেন্ডার থেকে সুগন্ধী দ্রব্য তৈরি করা। ষাটের দশকে জাপানের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতির প্রাক্কালে তাদাও তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্মের কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ হেক্টরে উন্নীত হয়। কিন্তু এই দশকের শেষের দিকে জাপানের ক্রমবর্ধমান অতি আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ভাটা পড়ে তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্মের অগ্রগতিতে। মানুষ ঝুঁকে পড়ে কৃত্রিম প্রসাধনীর দিকে। ফুরানো এলাকায় তমিতার কাজে ও সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা ল্যাভেন্ডার চাষে আগ্রহী হয়েছিলেন, তারা প্রায় সবাই ল্যাভেন্ডার ফার্মের কাজ গুটিয়ে অন্য কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাদাও তমিতা। তিনি মনেপ্রাণে জানতেন সুসময় একদিন আসবে, মানুষের কৃত্রিমতার ঝোঁক সাময়িক মাত্র। এর পরের কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। তমিতার অর্থনৈতিক ও মানসিক খরার কোনো এক সকালে একজন সাংবাদিক অভ্যাসবশত ল্যাভেন্ডার ফার্মের কিছু ছবি তুলে নিয়ে যান। এই ছবিগুলোর একটি পরবর্তী বছরে জাপান রেলওয়ে জাতীয় ক্যালেন্ডারের জুন পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এরপর তমিতাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতিবছর মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অসংখ্য পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্ম।
মে মাসের হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় যখন চারদিকে ঘেরা পাহাড় থেকে ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে থাকে, যখন ছোট ছোট মেঘরাশি সেই পাহাড়ে আছড়ে পড়ে রৌদ্রস্নাত ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি করে, ঠিক সে সময়ে চারদিকের অবারিত, সি্নগ্ধ, অপার অসীম সুন্দর ফুলরাজির মাঝে নিজের দৃষ্টিকে তৃপ্ত করার মতো ভালো স্থান আর হতে পারে না। চেরি, টিউলিপ, লুপিন, পপি এবং জার্মানিকা'র দৃষ্টিনন্দন রঙ এবং চাপা মিষ্টি গন্ধ মনটাকে সি্নগ্ধ করে তোলে, মনে হয় এটি পৃথিবীর মাঝে একটি ছোট্ট স্বর্গ। এই ফার্মে ফুল চাষের ক্রমবিন্যাস ঠিক করা হয় ফোটা ফুলের রঙের কথাটি বিবেচনায় রেখে। সে জন্যই ফুল ফোটার পর তার রঙ বৈচিত্র্য ও বিন্যাস মানুষকে বিমোহিত করে। পর্যটকদের কাছে এখানে আসার সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়টি হলো জুলাই মাস। কারণ জুলাই মাসে মাঠে প্রায় ৯ ধরনের ফুল ফোটে; লাল টকটকে পপি, হলুদাভ ও হালকা লাল গোলাপ, হলুদ সরিষা, গাঢ় সবুজ ঝোপালো গাছে সাদা আলুর ফুল, পিংক রঙের জাপানিজ গোলাপ, পারপল ল্যাভেন্ডার, হলুদ ও কমলা গাঁদা, গাঢ় হলুদ সুর্যমূখী এবং লাল ও হলুদাভ রঙের মিশ্রণে স্কারলেট সেজ। মাঠের পর মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ফুলগুলোর সারি তাদের রূপমাধুর্য দিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি ও চিত্ত নন্দিত করে। ফুরানোর ফুলরাজির র্নিমাণশৈলী ও তার উপস্থাপন কৌশল যেন মানুষকে মুগ্ধ, বিমোহিত করে তার স্মৃতিপটে বহু দিনের জন্য জায়গা করে নেয়। নিষ্কলুষ ফুল মানুষকে শিক্ষা দেয় সি্নগ্ধ, নমনীয়, পবিত্র এবং উদার হতে।
সাপ্পোরো, হোক্কাইডো, জাপান

নৈরাজ্যের অচলায়তন by রাশেদ মেহেদী

রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে।

রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না ভালো বাস আমদানির কথা উঠলেই এখনকার প্রভাবশালী পরিবহন নেতারা হায় হায় করে ওঠেন। কী বলেন! উন্নত, ভালো বাস নিয়ে আসতে গেলে বাসপ্রতি দেড়-দুই কোটি টাকা দাম পড়বে। সেক্ষেত্রে মতিঝিল-উত্তরার ভাড়া নিতে হবে দেড়শ' টাকা। এটা কি সম্ভব? পরিবহন নেতাদের এই যুক্তি আরও একটি বড় প্রতারণা। কারণ বড় বড় পরিবহন নেতারা ঢাকার রাস্তায় উন্নত বাস সার্ভিস চান না। এ কারণে কম দামের উন্নত বাস সার্ভিস হাতের কাছে থাকলেও তাদের চোখে পড়ে না। গণপরিবহনের জন্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশসহ নিউজিল্যান্ড, ইউরোপের ফ্রান্স, চেক, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমদানি করা হয় জাপানের উন্নতমানের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। এই গাড়িগুলো জাপানের রাস্তায় দশ বছর চলার পরও কমপক্ষে ত্রিশ বছর চলার নিশ্চয়তা থাকে। আরামদায়ক, উন্নতমানের এই গাড়িগুলো এখনও সর্বোচ্চ দাম গড়ে ২৫-৩০ লাখ টাকায় পাওয়া সম্ভব। যদি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নিম্নমানের নতুন বাস কিনে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া হয়, তাহলে জাপানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উন্নতমানের বাস ২৫ লাখ টাকায় আমদানি করলে সেই ২৫ টাকা ভাড়াতেই পোষাবে। চীনের নিম্নমানের নতুন বাসের যেখানে একশ' বছর সুস্থভাবে চলার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে জাপানি রিকন্ডিশন্ড শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ৩০ বছর পর্যন্ত চলার নিশ্চয়তা আছে। তাহলে এসব বাস গণপরিবহনের জন্য আমদানি করতে বাধা কোথায়? এক সময় কিন্তু ঢাকার রাস্তায় রিকন্ডিশন্ড উন্নতমানের গাড়ি চলত। নিরাপদ এবং রোড স্টার সার্ভিসের কথা অনেকেরই মনে আছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় নেমেছিল প্রিমিয়াম বাস, ২০০০ সালে নিরাপদ এবং ২০০২ সালে রোড স্টার। এর পাশাপাশি বিআরটিসির ভলভো দোতলা বাস। মানুষ এসব বাসে অনেক নিরাপদে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারত। এসব উন্নত বাস চলার সময় মূল সমস্যা দেখা দেয় তথাকথিত প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের। নামে শ্রমিক নেতা হলেও তারা রীতিমতো বড় বড় মালিক। পুরনো গাড়ি দফায় দফায় ৮-১০ লাখ টাকার মধ্যে হাত বদল করে ভালোই চালাচ্ছেন তারা। এই নেতাদের মূল ব্যবসা অবশ্য চাঁদাবাজি। উন্নত বাসের মালিকরা চাঁদা দিতে চান না, আবার উন্নত বাস চলার কারণে লোকাল বাস, সিটিং বাস এবং অন্যান্য কাউন্টার সার্ভিসের বাসে যাত্রী পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয়। ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানো সহজ হয় না। এই নেতাদের ইশারাতেই বিআরটিএ নিরাপদ পরিবহন ও প্রিমিয়াম সার্ভিসের রুট পারমিট নবায়ন করেনি।
রাজধানীতে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হয় কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি মাসে। এ সময় গুলিস্তান-গাজীপুর রুটের মুড়ির টিন বলাকাসহ উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রুটের সব ঝরঝরা লোকাল বাস সিটিং সার্ভিস হয়ে যায়। দশ টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া হয় না তখন থেকেই। মুড়ির টিনের মতো এসব বাসে ত্রিশ আসনের জায়গায় বিয়ালি্লশ আসন বসিয়ে গরু-ছাগলের মতো যাত্রীদের বসানো হয়। তখন থেকেই রাস্তায় বাস সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো সংবাদ হয়েছে। বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে কেউ দেখেনি। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে কর্তা-ব্যক্তিরা সেটা কোনোমতেই বুঝতে চাচ্ছেন না। গণহারে ডাইরেক্ট আর সিটিং হওয়ার কারণে বিপাকে পড়ছেন রাজধানীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করা মানুষ। যে যাত্রী ফার্মগেট থেকে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া কিংবা মোহাম্মদপুর যাবেন কিংবা মহাখালী থেকে এমইএস, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত কিংবা উত্তরা যাবেন, তারাই বিপদে পড়ছেন। তাদের জন্য এখন কোনো বাস নেই। মগবাজার থেকে মহাখালী যাওয়ার বাস কিংবা অন্য কোনো যানবাহন নেই। এসব জায়গার যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর অসংখ্য গাড়িতে উঠতে গিয়ে তথাকথিত সিটিং সার্ভিসের কন্ডাক্টর-হেলপারের গলাধাক্কা খান। সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে মন্ত্রীদের গালাগাল করেন। শেষ পর্যন্ত ৭ টাকার ভাড়া ১৫-২০ টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য হন। কখনও কখনও মহাখালী থেকে বিশ্বরোড যেতে হচ্ছে ৩০ টাকাতেও। অথচ বাস সেই মুড়ির টিন। এই মধ্যবর্তী যাত্রীদের জন্য বিআরটিসি কি পারে না সার্কুলার বাস চালু করতে? কিছু বাস তো শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর-১০ পর্যন্ত চলতেই পারে। কিংবা কিছু বাস তো মগবাজার থেকে মহাখালী হয়ে উত্তরা পর্যন্ত চলতেই পারে। এসব বাসে ৫ টাকা এবং ১০ টাকার দু'ধরনের টিকিট থাকবে। যেমন শাহবাগ থেকে ফার্মগেট ৫ টাকা, শাহবাগ থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত ১০ টাকা। মগবাজার থেকে বনানী ৫ টাকা, উত্তরা পর্যন্ত ১০ টাকা_ এই ভাড়াতেই কিন্তু দিব্যি সার্কুলার বাস চলতে পারে অফিস সময় এবং বিকেলে অফিস ছুটির পর। না পোষালে আরও ৫ টাকা ভাড়া বেশি নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষকে অফিসে যাওয়ার সময় এবং ঘরে ফেরার সময় বাস পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অথচ বিআরটিসির বাসও বেসরকারি পরিবহন মালিকদের মতো করেই চালানো হচ্ছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে যদি বিআরটিসির ভূমিকা না থাকে তাহলে সরকারি মালিকানাধীন এই পরিবহন সার্ভিসের গুরুত্ব কোথায়? ২০০৪ সালে কিন্তু ঢাকার বিআরটিসির বেশ কিছু এ ধরনের সার্কুলার বাস চালু হয়েছিল। দুই-তিন মাস চলার পর সেই বেসরকারি পরিবহন মালিকদের চাপেই এসব বাস বন্ধ করা হয়। কারণ তাদের কম দূরত্বে বেশি ভাড়া নেওয়ার কৌশল মার খায়। রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে। রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার বাস সার্ভিসকে উন্নত করার জন্য বিআরটিসিকে কাজে লাগাতে পারে সরকার। ঢাকার প্রধান দশ-বারোটি রুটের পুরো দায়িত্ব বিআরটিসিকে দিলে কেমন হয়? এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পরিবহন নেতাদেরও বিআরটিসির পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিআরটিসি দশ-বারোটি রুটে তিন ধরনের বাস সার্ভিস রাখবে। একটি হবে ডবল ডেকার লোকাল সার্ভিস স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য, একটি হবে মধ্যআয়ের মানুষের জন্য নন-এসি কাউন্টার সার্ভিস এবং আর একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সার্ভিস। নির্দিষ্ট মডেলের বাস নির্দিষ্ট রুটে চলবে। বেসরকারি মালিকরা বিআরটিসি অনুমোদিত মডেলের বাস কিনে বিআরটিসির মাধ্যমে চালাতে পারবেন। বিআরটিসি তাদের লাভ বুঝে দেবে। বেসরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় কোনো বাস সার্ভিস প্রধান দশ-বারোটি রুটে চলবে না। বিআরটিসির চুরি বন্ধে একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম থাকবে, প্রয়োজনে গোপন টিম রাখা হোক। এর ফলে সরকার অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে। একই মডেলের বাস একটি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলার কারণে যানজট কমবে। পরিবহনে শ্রমিক সংগঠন, মালিক সংগঠন এবং পুলিশ, বিআরটিএর চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। যখন-তখন পরিবহন মালিকরা ভাড়া নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে না। একই কর্তৃপক্ষের বাস হওয়ার কারণে বেপরোয়া বাস চালানো, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ হবে, ফলে দূর্ঘটনাও কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর সাধারণ মানুষ কম খরচে উন্নত বাসসেবা পাবে। সিএনজির দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া নিয়ে বেসরকারি মালিকরা যে নৈরাজ্য এবং ভাড়ার নামে গণডাকাতির নজির স্থাপন করেছেন, তাতে আজ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রধান দশ-বারোটি রুটে সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিকল্প থাকবে না।

ফুটন্ত কড়াই by গওসল আযম

রব বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তাদের ধর্ম একটি ইসলাম এবং ভাষা আরবি। একই ধর্ম এবং ভাষার কারণে, আরবদের ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতার কারণে। তাদের পশ্চাৎপদতার কারণে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রয়োগকে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এদের মাটিতে জন্ম নিয়েছিল অনেক সভ্যতা।
এতদসত্ত্বেও এদের শিক্ষার অভাব এবং ধর্মের অভ্যন্তরে অনেক অপব্যাখ্যাকে পুঁজি করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের স্বার্থকে অব্যাহতভাবে ধরে রাখার জন্য বিভক্ত করেছে। ইহুদি রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই রাষ্ট্রটির কর্ণধাররা বলে আসছে, যুদ্ধ ছাড়া শান্তির প্রত্যাশা অমূলক। তাদের দর্শনের চালিকাশক্তি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অব্যাহত নির্লজ্জ সাহায্য এবং মারণাস্ত্রের সরবরাহ। তাদের তেল স্বার্থ সংরক্ষণের কারণে তারা বেহায়াভাবে ইরাকের মানববিধ্বংসী অস্ত্র আছে অজুহাত তুলে ইরাক আক্রমণ করে তাদের ক্রমঅগ্রসরমাণ অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। মেরেছে হাজার হাজার ইরাকি জনসাধারণ। আরবের রাজারা রাজতন্ত্রের রক্ষা, স্বৈরশাসকরা স্বৈরতন্ত্র রক্ষার জন্য আরব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহন করেছে। গণতন্ত্র, সৌভ্রাতৃত্ব, সমতা , ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতির কথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুখে বললেও, আরব বিশ্বের জ্বালানি শক্তি যতদিন থাকবে, ততদিন তারা রাজতন্ত্র এবং স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়ে যাবে। এ জন্য যে কোনো মূল্যে, ইহুদি রাষ্ট্রটিকে সম্মিলিত আরব শক্তির চেয়ে অব্যাহতভাবে শক্তিধর রাখবে। অন্য কথায়, আরব বিশ্বের তেল নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের হাওয়া বইতে দেবে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাহরাইনে স্বৈরশাসকের সমর্থনে সৌদি আরব সৈন্য পাঠিয়েছে গণতন্ত্রীদের দমনের জন্য। অন্যদিকে লিবিয়ার স্বেচ্ছাচারী শাসককে উৎখাত করার জন্য রাষ্ট্রসংঘ লিবিয়াকে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করিয়ে নির্লজ্জভাবে বিদ্রোহীর সাহায্য করেছে আকাশ থেকে বোমা এবং স্থল থেকে কামান দাগাতে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা যেতে পারে, আরবদের দাবিয়ে রাখার জন্য আমেরিকাকে সামরিক এবং অর্থশক্তি জোগান দিতে হয় ইসরায়েলকে। ইসরায়েলের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ভারসাম্য বজায় রেখে অস্ত্র দিতে হয় আরব রাজশক্তি এবং কিছু কিছু স্বৈরশাসককে। অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা এই, অস্ত্রগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যবহৃত হবে আরবের গণতন্ত্রকামী মানুষের বিরুদ্ধে এবং হয়েছেও তা-ই। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর দ্ব্যর্থহীনভাবে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা শুরু করেছিলেন বিশ্বের মুসলমানদের আস্থাভাজন হওয়ার জন্য। মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিয়েছিলেন মিসরে। তারপর একদিন সম্ভবত মুখ ফসকে বলেছিলেন যে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির বীজ নিহিত ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় ইসরায়েলের ফিরে যাওয়ায়। আর যায় কোথায়, শুরু হলো তার ওপর চাপ। এ চাপের প্রয়োগ করল আমেরিকার ইহুদি লবি। কারণ আমেরিকার সর্বস্তরে ইহুদিরা এত ক্ষমতাধর যে তারা দিনকে রাত আর রাতকে দিন করতে পারে। বারাক ওবামা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে এখন বেশ নীরব। এরপরও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন। কিন্তু ইসরায়েল বলল, মধ্যপ্রাচ্যে সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের বিজয় ইসরায়েলের জন্য অশনিসংকেত। কারণ এতে ক্ষমতার বর্তমান ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটবে, যা ইসরায়েলের জন্য হবে মরণফাঁদ।
ওবামা নড়েচড়ে বসলেন, মোবারককে হটিয়ে তাদের পোষা লোকজনকে ক্ষমতায় বসালেন। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট দেশত্যাগ করলেও ক্ষমতা পশ্চিমা বিশ্ব প্রভাবিত ব্যক্তিদের হাতে। তিউনিসিয়া এখন পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদারদের হাতে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার নেপথ্য শক্তি পশ্চিমারা বলে অনেকেই মনে করেন। অন্য কথায়, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা গণতন্ত্রের খেলা খেলবে। মধ্যপ্রাচ্যে সার্বিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে না যতদিন না মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ নিঃশেষ হয়।

স্থানীয় উদ্যোগও হতে পারে আলোকবর্তিকা by আবু সাঈদ খান

জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ক্ষমতাবাজির নীতিহীন খেলায় মত্ত, তখন জনগণই ভরসাস্থল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা আশা করি। হয়তো প্রত্যুত্তরে তাদের কাছ থেকে শুনতে হবে যে, ইচ্ছা থাকলেও সীমাবদ্ধতা আছে, লোকবলের অভাব আছে। কথাটি সত্য। তা সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠন, কমিউনিটি নেতা ও স্থানীয় সচেতন মানুষের সহায়তায় প্রার্থীদের জনতার মুখোমুখি করার কার্যক্রম প্রসারের বিষয়টি কঠিন কিছু নয়।

কেবল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেই নয়_ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, সর্বোপরি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি মডেল হতে পারে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অসহিষুষ্ণতা এখন চরমে। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দল_ একে অপরকে ঘায়েল করতে মরিয়া। কেবল কাদা ছোড়াছুড়ি করেই ক্ষান্ত নয়, পরিস্থিতি দেখে মনে হয় সরকার ও বিরোধী দল শক্তি পরীক্ষায় নেমেছে। দেশের বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিক সমাজের প্রবল সমালোচনার মুখেও নেতা-নেত্রীরা সমঝোতার নীতি গ্রহণ করছেন না, আলোচনার টেবিলে বসছেন না। অথচ আলোচনার টেবিল ছাড়া সমাধানের কোনো পথ নেই। দেশের রাজনীতির যখন এমনই হতাশাব্যঞ্জক হাল, তখন আশার আলোকচ্ছটা অনুভব করলাম রাজধানী থেকে দূরে, ময়মনসিংহ জেলার শম্ভুগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে।
৯ জুন, সকাল ১১টা। শম্ভুগঞ্জ হাইস্কুলের মাঠে মুক্তমঞ্চ; হাজির হয়েছেন চরনিলক্ষিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সাত চেয়ারম্যান প্রার্থী। উপস্থিত কয়েক হাজার নর-নারী। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রতি 'জনতার প্রশ্ন' শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির ওপর একটি নাটক প্রদর্শিত হলো। এ নাটকে কেবল জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম-দুর্নীতির কথাই বলা হলো না, ভোটারদের দায়িত্বহীনতা ও অর্থের বিনিময়ে ভোট দেওয়ার মানসিকতার জন্য কঠোর ভর্ৎসনা করা হলো। তারপর শুরু হলো জনগণের মধ্য থেকে উত্থাপিত লিখিত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পালা।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবদুল হক মণ্ডল, নূর মোহাম্মদ মীর, ফারুকুল ইসলাম রতন, ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান ফকির, রফিকুল ইসলাম ও মানিক মিয়া_ প্রত্যেকেই একে একে জনতার কাছ থেকে আসা প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। যখন এক প্রার্থী জবাব দিচ্ছিলেন, তখন অন্য প্রার্থীরাও মাথা নেড়ে তার কথার সঙ্গে একাত্ম হচ্ছিলেন। ভিন্ন মত থাকলে সম্পূরক উত্তরও দেওয়ার সুযোগ ছিল। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর সবাই যার যার মতো করে দিলেন।
এরপর সমবেত জনতার সরাসরি প্রশ্ন। এ পর্যায়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা বাকবিতণ্ডাও হলো। তবে অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার আখন্দ ভালোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিলেন। উপস্থিত নর-নারীর স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সমন্বয়কের অনুরোধে তারা হাততালি দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। মনে হচ্ছিল, তারা ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য, প্রার্থীদের বাজিয়ে নিচ্ছেন। মতামত দেবেন ব্যালটের মাধ্যমে।
প্রশ্নগুলো ছিল এলাকার উন্নয়ন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার_ পরিবেশ এবং পরিষদের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে। বেশিরভাগ উত্তরই ছিল অভিন্ন। তবে ক্ষেত্রবিশেষ মতদ্বৈধতা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, সন্ত্রাস-মাদক-জুয়া-ফতোয়া-যৌতুক-বাল্যবিবাহ-নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা, রাস্তাঘাট-পয়ঃনিষ্কাশন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার প্রসার, পাঠাগার নির্মাণ ইত্যাদি নিয়ে আশার কথা সবাই বলেছেন। বেআইনিভাবে দখলকৃত খাসজমি উদ্ধার করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন। শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা রক্ষায়ও প্রার্থীরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। বলা হলো, একাত্তরের চার শহীদের নামে চারটি রাস্তার নামকরণ করা হবে। সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তমঞ্চ তৈরি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার ওয়াদাও করা হলো।
সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এখতিয়ার তাদের ছিল না। স্থানীয় কার্পেট ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের মানবেতর অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাওয়া হলো, তাদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে কী করা হবে। প্রার্থীরা এক বাক্যে বললেন, বিষয়টি নিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে অভিন্ন মত পোষণ করলেন প্রার্থীরা। সব পরিকল্পনা জনগণের মতামত নিয়ে করা হবে, সরকারি বরাদ্দের অঙ্ক যথাযথভাবে জানানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো। গ্রাম বা ওয়ার্ড সভা করে তথ্য জানানো ও জনগণের মতামত গ্রহণ করার ব্যবস্থা হবে। দুস্থ, প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়া হবে যোগ্য প্রাপকদের। বিজয়ী হলে কোনো প্রার্থীই দলীয়করণ-আত্মীয়করণ করবেন না। কারও কাছ থেকেও অর্থ নেবেন না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে_ যিনি নির্বাচিত হবেন অন্যরা তাকে স্বাগত জানাবেন এবং সহযোগিতা করবেন।
এসব বক্তব্য রেকর্ড করার এক পর্যায়ে উদ্যোক্তারা স্মরণ করিয়ে দেন, আপনাদের সব প্রতিশ্রুতির কথা আমাদের কাছে রেকর্ডবন্দি হয়ে থাকল। অর্থাৎ কথার ব্যত্যয় হলে তাদের নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। জনগণ প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে দাবি তুলতে বা আন্দোলন করতে পারবে।
আমাকে অভিভূত করেছে যে, আয়োজকরা সবাই অনূর্ধ্ব ২৫ বছরের তরুণ; বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ, শম্ভুগঞ্জ শাখার সদস্য। মনে পড়ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-উত্তর পরিস্থিতির কথা। তখন সর্বক্ষেত্রেই তরুণদের নেতৃত্ব ছিল সমাদৃত। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান সেই পটভূমি রচনা করেছিল। আজ কোনো ঊনসত্তর ঘটেনি সত্য, তবে আজকের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্পাঠ তরুণ সমাজকে উদ্বেলিত করেছে, নতুন এক জাগরণ এনেছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমরা সংবাদপত্রে যে তরুণদের লেজুড়বৃত্তি, লাঠালাঠি বা বন্দুক লড়াই করতে দেখি, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। এর বাইরে ব্যাপক তরুণ সমাজ স্বাধীন চিন্তায় বেড়ে উঠছে। তারা পথনির্দেশ পেলে অসাধ্য সাধন করতে পারে, শক্ত হাতে নেতৃত্বের হাল ধরতে পারে।
এই তরুণরা আমাদের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তাদের সম্পৃক্ত করেই আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। আর যত দ্রুত তরুণ নেতৃত্বকে পথ করে দেওয়া হবে, ততই দেশের জন্য তা মঙ্গলজনক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শম্ভুগঞ্জে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো তা কি কেবল ওই এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে, না ছড়িয়ে দিতে হবে? ইতিমধ্যে এমন আরও উদ্যোগের কথা আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর ইউনিয়নের চার প্রার্থী একযোগে আচরণবিধি ও ফলাফল মেনে নেওয়ার শপথ নিয়েছেন। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নে সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) উদ্যোগে প্রার্থীরা এক অনুষ্ঠানে জনতার মুখোমুখি হয়েছেন।
এসব অনুষ্ঠান গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় আলোকবর্তিকা। এটি যেমনি নির্বাচনের আচরণবিধি অনুসরণে সহায়তা দেবে, তেমনি ইউনিয়ন পরিষদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। সঙ্গত কারণে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এমন উদ্যোগকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে তা সৃষ্টি করবে নতুন গণজাগরণ। বলা আবশ্যক, রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দু'ভাবেই হওয়া সম্ভব। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের ধারা সূচনা করতে পারে, অপরদিকে তৃণমূলের জাগরণও রাজনীতিতে নতুন উপাদান যুক্ত করতে পারে, বদলে দিতে পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ক্ষমতাবাজির নীতিহীন খেলায় মত্ত, তখন জনগণই ভরসাস্থল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা আশা করি। হয়তো প্রত্যুত্তরে তাদের কাছ থেকে শুনতে হবে যে, ইচ্ছা থাকলেও সীমাবদ্ধতা আছে, লোকবলের অভাব আছে। কথাটি সত্য। তা সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠন, কমিউনিটি নেতা ও স্থানীয় সচেতন মানুষের সহায়তায় প্রার্থীদের জনতার মুখোমুখি করার কার্যক্রম প্রসারের বিষয়টি কঠিন কিছু নয়।
কেবল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেই নয়_ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, সর্বোপরি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি মডেল হতে পারে। সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমকেও এমন বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। শম্ভুগঞ্জের ওই অনুষ্ঠান থেকে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি প্রদর্শিত হলে তা হতো বড় কাজ। এ দৃষ্টান্ত দেখে অন্য এলাকার মানুষও উদ্বুদ্ধ হতো।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে আমরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েছিও। তবে জাতির মনোভূমি যে সচেতনতার বীজ ধারণ করে আছে তা অনন্য। সেই চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে, যা সব আগাছা ছাপিয়ে ফসলের নতুন বান ডেকে আনতে পারে।

অগ্রসর প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাতে হবে

গ্রসর ও অধিকতর কার্যক্ষম হলেও নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাতে অনেকেই দ্বিধান্বিত থাকেন। আর নতুন কোনো উদ্যোগের সঙ্গে যদি রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা থাকে তবে তো কথাই নেই। যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ না করে আগেভাগেই কোনো না কোনো পক্ষ অনাস্থা জানিয়ে রাখে। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ ও সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে নতুন উদ্যোগের পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধটাই সর্বাগ্রে নাকে এসে লাগে।

তাই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যে নির্বাচন কমিশনের তরফে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম চালুর প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দিল তাতে অনেকেই বিস্মিত হবেন না। যদিও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণের যুগে পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত বহু দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন যন্ত্র অনেক বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এটি বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অতি অল্প সময়ে ভোট গণনা করে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি রীতিমতো বিস্ময়কর কাজ করেছে। জানা গেছে, পাকিস্তানেও ইভিএম পদ্ধতি শুরু হতে যাচ্ছে। যে ব্যবস্থাটি বিশ্বের বহু দেশে আস্থা পাচ্ছে সে ব্যবস্থাটি আমাদের দেশে চালু করতে গিয়ে কেন হোঁচট খেতে হচ্ছে, এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠবে। এ প্রশ্নে উত্তর মেলা জরুরি আবার একই সঙ্গে নতুন উদ্যোগগুলো নিয়ে সমাজে খোলামেলা আলাপ-আলোচনাও হওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশন গত শনিবার গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইভিএম নিয়ে আলোচনা করেছে। আমরা মনে করি, আলোচনার এমন উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে এমন আলোচনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও হতে হবে। বিশেষত প্রধান বিরোধী দলকে আলোচনায় আসতে হবে। সন্দেহ, সংশয়ে দোদুল্যমান না থেকে খোলামনে নতুন প্রযুক্তিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ নিয়ে কথা বলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্যোগ গ্রহণ করে বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে বসাতে হবে। শুধু ইভিএমের ক্ষেত্রেই নয়_ অন্য সকল নির্বাচনী বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজের সকল পক্ষই আজ স্বীকার করেন, একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দলগুলোর বিবাদ-বিশৃঙ্খলার মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু এ জন্য কমিশনকে স্বাধীন হতে হবে। সরকারকে যেমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, তেমনি কমিশনকেও স্বাধীন উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি দল, বিরোধী দল সকলকে নিয়ে কাজ করতে হবে। কমিশনকে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইভিএম ব্যবস্থা সহজ, নির্ভুল ও দ্রুতগতির ভোটিং ব্যবস্থা, গণনার ক্ষেত্রেও এটি বিদ্যুৎগতির। ভোটের ফল বিপর্যয়, ম্যানিপুলেশন, গণনায় দেরি ঠেকাতে এর বিকল্প নেই। তবে এটি সত্য যে, সারাদেশে ইভিএম পদ্ধতি একযোগে চালু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের কর্মীদের যেমন যথাযথ প্রশিক্ষণ দরকার, তেমনি দরকার ভোটারদের প্রশিক্ষণও। সমাজের নানা স্তরের মানুষের পরামর্শ নিয়ে ইভিএম পদ্ধতির সমস্যা ও ত্রুটিগুলোও আমলে আনতে হবে। সারাদেশে একযোগে চালু করা না গেলেও সামনের নির্বাচনগুলোতে শহরাঞ্চলগুলোতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চট্টগ্রামে ইভিএম সীমিত আকারে ব্যবহার করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এটি বিস্তৃত হতে পারে। তবে এ পদ্ধতি চালুর আগে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই আস্থায় আনতে হবে। সবার অংশগ্রহণে, পরামর্শে একটি নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি চালু হলে সেটি হবে সবচেয়ে খুশির খবর।

সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন হোক

দেশের ছয়শ' বিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা শনিবার সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। এর ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রের বিধিবিধানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং সৃষ্টি হবে সহিষ্ণুতার মনোভাব। রোববার সমকালে 'হাতে-কলমে গণতন্ত্রের পাঠ' শিরোনামের খবরে বলা হয়, ছাত্রছাত্রীরা বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভোট দিয়ে তিনটি শ্রেণীতে ৭ জন করে প্রার্থী নির্বাচন করেছে।
এদের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবে এবং নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হবে। এ উদ্যোগ উৎসাহব্যঞ্জক। ওপরের শ্রেণীগুলোতেও একই চর্চা করা সম্ভব। নির্বাচিতদের যেন তাদের বয়স অনুযায়ী কাজের সুযোগ থাকে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। তবে কর্তৃপক্ষের কাজে যদি গণতন্ত্র অনুশীলন না হয় তা হলে কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হবে। শিশুরা যদি দেখে যে তাদের বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে তাহলে নিজেদের কাজেও তারা উৎসাহিত হবে। অন্যথায় শুরুতেই এ মহতী উদ্যোগ হোঁচট খাবে। একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ের প্রতিও আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন কার্যত অনুপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। কলেজগুলোর চিত্রও অভিন্ন। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাবই এর প্রধান কারণ। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের অনুশীলন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে তারা যদি প্রশ্ন করে যে, বড় ভাই ও বোনেরা কেন একই কাজ করছে না, তার কোনো জবাব কারও কাছেই নেই। ছাত্ররাজনীতি চলা উচিত কি উচিত নয়, সে প্রশ্নে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকাই উচিত এবং তার আয়োজন হতে হবে নিয়মিত। এ নির্বাচন দলগতভাবে হবে নাকি নির্দলীয় হবে, সেটা আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু যা চলছে, তার যত দ্রুত অবসান ঘটে শিক্ষাঙ্গনের জন্য ততই মঙ্গল। ছাত্র সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বছরের পর বছর যে নির্বাচন হচ্ছে না তার প্রধান দায় কিন্তু তাদের ওপরেই বর্তায়।

আলতো এক গুঁতোয় যদি সব সমাধান হতো ... by ওবায়দুল কবির

৭ এপ্রিল, রবিবার। সকাল সাড়ে সাতটায় স্ত্রীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে যাই। সাংবাদিক হিসেবে কোন রকম সুযোগ-সুবিধা না নিয়ে স্ত্রীকে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকের কৰের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে কিছু দূরে বসে থাকি। অনেকৰণ লাইনে দাঁড়ানোর পর চিকিৎসকের দরজার সামনে পেঁৗছে যান আমার স্ত্রী।

তিনজন রোগীর পেছনে তাঁর অবস্থান। এমন অবস্থায় এক কর্মচারী আমার স্ত্রীকে নিজের লাইন থেকে সরিয়ে অন্য আরেকটি লম্বা লাইনের পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অন্য লাইনে যেতে অস্বীকৃতি জানালে স্ত্রীকে অশালীন ভাষায় লাইন থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়। ততৰণে দৃশ্যটি আমার নজরে পড়ে। স্ত্রীকে তার নিজের লাইনে রাখার অনুরোধ করলে ওই কর্মচারিটি আমাকে ধমক দিয়ে বের হয়ে যেতে বলেন। দ্বিতীয়বারের মতো লাইন থেকে বের হয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানালে প্রথমে তিন/চার কর্মচারী আমার ওপর চড়াও হয়। টেনেহিঁচড়ে আমাকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে আরও ৬/৭ কর্মচারী যোগ দেয়। কর্মচারীদের কয়েকজন আমাকে লাথি ও কিলঘুষি দিতে থাকে। ওই স্থানে দাঁড়ানো আনসার সদস্য ও সাধারণ লোকজন আমাকে কর্মচারীদের আক্রমণ থেকে রৰা করেন। পরে হাসপাতালের অন্য কর্মচারীদের সহায়তায় আমি হামলাকারীদের মধ্যে হাবিব, বাবু ও মাসুম নামে তিন কর্মচারীকে শনাক্ত করতে পেরেছি।
এ অবস্থার রেশ না কাটতেই আমার কানে এলো প্রতিদিনের রম্নটিন মাফিক বিএসএমএমইউ-এর পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভূঁইঞা আইটডোর পরিদর্শনে আসছেন। এ খবর শুনে মনে মনে স্বস্তি বোধ করছি। ভাবছি তিনি এলে আমার কথা শুনে এবং পরিচয় পেয়ে নিশ্চয়ই এমন কিছু উদ্যোগ নেবেন যাতে কিছুৰণ আগে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ৰিত ঘটনার লজ্জা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাব। তিনি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হওয়ায় এ বিশ্বাস জন্মেছে আরও বেশি। তিনি ঘটনা স্থলে আসার দেরি দেখে আমি নিজেই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিয়ে সব কিছু খুলে বললাম। তিনি মুখে কোন কথা বললেন না। সামনের দিকে হাঁটতে থাকলেন। আমি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করলাম। ঘটনার যে নায়ক তার কাছে আসতেই জোরেশোরে গলা বাগিয়ে দেখিয়ে দিলাম। তিনি তাঁর হাতে থাকা ছোট্ট স্টিকটি দিকে ওর পেটে একটি আলতো গুঁতো দিয়ে শুধু বললেন: ডিউটি চেঞ্জ করে দেব কিন্তু। এই শেষ। আমি আবার তাঁর পিছু হাঁটছি। শেষে যখন চলে যাবেন তখন বললাম, স্যার আমার করণীয় কি? আমি কি লিখিত অভিযোগ জমা দেব। তিনি শুধু বললেন, দেন।
লজ্জা ও অপমানের হাত থেকে বাঁচতে আমার চীফ রিপোর্টার ওবায়েদ ভাইকে বিষয়টি ফোনে জানালাম। তিনি স্বাস্থ্য বিটের সাংবাদিক নিখিল মানখিন দাদাকে জানাতে বললেন। তারপর নিখিল দাদা আমাকে অপেৰা করতে বলে মহাখালী থেকে রওনা দিলেন হাসপাতালের দিকে। ঘটনা জানালাম রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি জাকারিয়া মুক্তা ভাইকে। এরপর অপেৰা করতে লাগলাম। কিভাবে যেন খবর পেয়ে একে একে হাসপাতালে হাজির হলেন সাংবাদিক রাজন ভট্টাচার্য দাদা, মিথুন কামাল ভাই, পবন আহমেদ ভাই, মশিউর রহমান ভাই, আতিকুর রহমান ভাই, হাবিবুর রহমান হাবিব, উমর ফারম্নকসহ অনেক সাংবাদিক। সম্মিলিতভাবে তাঁরা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। দীর্ঘৰণ ধরে তাঁরা উপাচার্যের কার্যালয়ে অবস্থান করেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদনত্ম ও জড়িতদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি দাবি করে তাঁরা হাসপাতালের পরিচালক বরাবর একটি আবেদনপত্র জমা দেন। পরিচালক(উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভী ও পরিচালক( হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভূঁইঞা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা নিয়ম-কানুনের কথা বলে কালৰেপণ করেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের আনত্মরিক হসত্মৰেপে অভিযুক্তদের তিন জনকে সাময়িক বরখাসত্ম ও তদনত্ম কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় সংশিস্নষ্টরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰের বিরম্নদ্ধে। তবে ৩ দিনের মধ্যে তদনত্ম রিপোর্ট জমা দেয়ার কথা থাকলেও প্রায় এক মাস পেরিয়ে যাচ্ছে কোন খবর পাইনি এখনও।
এ সময় পরিচালক মহোদয় নির্লজ্জভাবে অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত স্যারকে জানান, ঘটনার তো ওখানেই বিচার হয়েছে। আমি তাঁর কথার প্রতিবাদ করলে তিনি বলেন_ কেন আমি ওর পেটে গুঁতো দিলাম না।
তখন আমার বার বার মনে হয়েছিল আপনাকে লাথি দিলে আমার বস যদি আমার পেটে আলতো গুঁতো দেন তা হলে বিষয়টি মিটে যাবে? কিন্তু বলতে পারিনি। শুধু ভেবেছি, এ রকম গুঁতোর মাধ্যমে যদি সব কিছু ঝামেলা শেষ হয়ে যেত তা হলে দেশটি সোনার বাংলা না হওয়ার কোন উপায় ছিল না। আশার কথা হলো, এখনও এদেশে ভূঁইয়াদের বিপরীতে প্রাণ গোপাল দত্তের মতো মানুষও আছে।
হামিদ-উজ-জামান মামুন

বারানসির শেষ বিকেলে
৮ মে, রবিবার । দিলস্নী সফর শেষ। সকাল থেকে মনটা বেশ খারাপ। অনেক সময় এমনিতেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপের কারণ খুঁজে বের করতে নিজেরই বেশ সময় লাগে। খুব ছোটখাটো কারণ। প্রত্যাশা অনুযায়ী সব কিছু না ঘটলে আমার মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে চেহারা দেখে বোঝা যায়। সফরসঙ্গী কয়েকজনই মন খারাপের কারণ জানতে চাচ্ছেন। আমার কাছে কোন জবাব নেই। কিছু সময় চিনত্মা করলাম কেন মন খারাপ হলো। যে কারণ খুঁজে পেলাম তাতে নিজেরই হাসি পেল। তবুও মন খারাপ গেল না। রওনা হই বারানসির উদ্দেশ্যে।
কিংফিশার এয়ারের ফ্লাইট সকাল দশটায়। ভোর সাড়ে ৬টায় হোটেল থেকে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় পৌনে ৮টা বেজে গেল। দিলস্নী ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে পেঁৗছে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করতে কিছুটা তাড়াহুড়াই লেগে গেল। এর মধ্যে আনিস আলমগীরের বোর্ডিং বাতিল করা হয় হ্যান্ড লাগেজে ছুরি রাখার অপরাধে। দ্বিতীয় দফা তাকে বোর্ডিং পাস নিতে হলো। যথাসময় বিমান আকাশে উড়ে বারানসিতে পেঁৗছে ঠিক ১১টায়। বারানসি ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা শহর। উত্তর প্রদেশ হলেও এটি বিহারসংলগ্ন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কাশীর রাষ্ট্রীয় নাম আগে ছিল বেনারসি। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বারানসি। সুন্দর ছিমছাম বিমানবন্দর। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নামে বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের লাগেজ পেয়ে যাই। বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজে। ভারত সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। ভারত সফরে আমাদের কার্যসূচীতে বারানসি যুক্ত হওয়াতে আমি খুবই উৎফুলস্ন হয়েছিলাম। ওখানে হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে আমার কন্যা লোটাস লেখাপড়া করেছে। সময়ের অভাবে অবশ্য তার ইউনিভার্সিটি দেখা হয়নি। লোটাস এখন কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা। ওখান থেকে ফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছি।
জেলা শহরে আমরা ভিআইপি অতিথি। সামনে-পেছনে পুলিশের গাড়ি। সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হোটেলে। তারকা খচিত বিশাল হোটেল। আগে ছিল হোটেল তাজ। দিলস্নী তাজ হোটেলে জঙ্গী হামলার পর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে হোটেল গেটওয়ে। ৭০ একর জায়গার ওপর দু'টি হোটেল। মফস্বল শহরে অবস্থানের কারণে খুব একটা জৌলুস নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। হোটেলের অধিকাংশ কর্মচারীই বাঙালী। খড়রোদের কারণে বাইরে প্রচ- গরম। দুপুরে খাওয়ার পর হাল্কা বিশ্রাম নিয়ে আমরা যাই সরনাথ জাদুঘর দেখতে। সঙ্গে প্রটোকল কর্মকর্তা ছাড়াও এক ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ। ৫টায় জাদুঘর বন্ধ হয়ে যায়। আমরা পেঁৗছতেই ৫টা বেজে যায়। তবুও খোলা রাখা হয়েছে আমাদের জন্য। একজন স্মার্ট বয়স্ক গাইড আমাদের জাদুঘরে রৰিত প্রত্নতত্ত্বগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। যিশুর জন্মের এক হাজার বছর আগের একটি বৌদ্ধ মূর্তি দেখিয়ে গাইড বলছেন, এটি বুদ্ধের আসল মূর্তি। এর দিকে মনোযোগ দিলে দেখতে পাবেন মহামতী বুদ্ধ আপনার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। আপনি কিছু প্রার্থনা করলে দেখবেন তাঁর চোখ থেকে আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে। আশীর্বাদ বর্ষিত হয় কিনা জানিনা, তবে মূর্তিটি সত্যিই মোনালিসা ছবির মতো মৃদুহাস্য। জাদুঘরের পাশেই রাজা অশোকের দুর্গ। এখনও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। গাইড আমাদের দেখালেন বিখ্যাত অশোক সত্মম্ভ। পাশে একটি বৌদ্ধ মন্দির। কিছু ছবি তুলে ফেরার সময় গাইড খাঁটি বাংলায় বললেন, আপনারা বাংলাদেশের সাংবাদিক? আমরা অবাক হয়ে তার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকি। প্রশ্ন করলাম, আপনি বাঙালী। মৃদু্যহাস্যে তিনি জবাব দিলেন, খাঁটি বাঙালী। হুগলীতে আমার জন্ম। এতৰণ ইংরেজী বললেন যে- তিনি বললেন, গাইডের কাজ ইংরেজীতেই ভাল হয়। বাঙালী কায়দায় তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি হোটেলে। সন্ধ্যায় বের হই গঙ্গা ঘাটের 'আরতি' দেখতে। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় শুরম্ন হয় আরতি। গঙ্গার কয়েকটি ঘাটেই আরতি হয়। সবচেয়ে বড়টির নাম ডা. রাজেন্দ্র কুমার ঘাট। স্রোতের মতো ঘাটের দিকে চলছে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ। আমরা যখন ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছি তখন মসজিদের মাইকে মাগরিবের নামাজের আজান দিচ্ছে। একদিকে মসজিদের আজান, অন্যদিকে গঙ্গা ঘাটমুখী মানুষের স্রোত_ উলুধ্বনি। হিন্দু-মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অপূর্ব সহাবস্থান। আমাদের ড্রাইভার মুসলিম। নাম জাকির। জানাল, কাশিতে তিন ভাগের একভাগ লোকই মুসলমান। শুধু হিন্দু-মুসলিম নয়, অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোকও রয়েছে এখানে। তিন ধর্মের লোকদের সহাবস্থানে কখনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় না। পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমাদের পেঁৗছে দিল ঘাটে। স্রোতের মতো ঘাটমুখী ধর্মপ্রাণ লোকগুলো বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। আমরা যে রাষ্ট্রীয় অতিথি। আমাদের নিয়ে বসানো হলো ঘাটের এক পাশে বাঁধানো একটি টিলার ওপর। লাল গালিচার ওপর চেয়ার পাতা। আমরা ছাড়াও ভিআইপি রয়েছেন সেখানে। এটি বারানসি প্রশাসনের স্থায়ী ব্যবস্থা। প্রায়ই ভিআইপিরা আসেন আরতি দেখতে। তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে বসে ঘাটের সবটাই দেখা যায়। শুধু ঘাটের ওপর নয়, নদীতেও কয়েক শ' নৌকায় হাজার হাজার ভক্ত বসে আরতি দেখছে। ঘণ্টাখানেক ওখানে বসার পর আমরা ফিরে আসার সিদ্ধানত্ম নেই। সফরসঙ্গী তিন মেয়ে মুন্নী, সুপ্রীতি এবং কঙ্কা বেঁকে বসেন। তাঁরা আসবেন না। আরও বসবেন। আমাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের রফিকুল বাহার ধূপের গন্ধে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমরা সিদ্ধানত্ম নিলাম কেউ কেউ ওখানে থাকবে এবং আমরা কয়েকজন হোটেলে চলে যাব। পুলিশ ইন্সপেক্টর কিছুতেই দল ভাঙ্গতে রাজি নন। তিনি বলেন, দল ভাঙ্গলে আমি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব না। শেষ পর্যনত্ম তাঁকে অনেক বুঝিয়ে আমরা ক'জন হোটেলে ফিরে আসি। অল্প সময় পরেই আমি এবং সালাম ভাই বের হয়ে যাই বেনারসি শাড়ির সন্ধানে। ড্রাইভার জাকির আমাদের নিয়ে যায় একটি শাড়ির ফ্যাক্টরিতে। তিওয়ারী ইন্টারন্যাশনাল। মালিক কিষান তিওয়ারী। ঠিকানা ১০/৪৮ হুকুলগঞ্জ এমএ রোড। দু'টি খাঁটি বেনারসি সিল্ক শাড়ি কিনে হোটেলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। হোটেলে ফিরে দেখি সবাই যার যার মতো করে সিল্ক ফ্যাক্টরিতে গেছেন এবং একাধিক শাড়ি কিনেছেন।

একই গগনের দুই জ্যোতিষ্ক by নিয়ামত হোসেন

ঠাৎই যেন চলে গেলেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। শিল্পী কিবরিয়া। দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি ভুবনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। চারুকলা ৰেত্রের একজন দিকপাল। অগণিত ভক্ত, ছাত্র ও অনুরাগীরই শুধু নয়, আমাদের দেশের একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। বয়স যাই হোক, এভাবে তিনি চলে যাবেন সেটা কেউ আশা করেনি। সেজন্যই তাঁর চলে যাওয়ার খবর যিনিই শুনেছেন, তিনি চমকে ওঠেছেন।
যেন হঠাৎ করেই চলে গেলেন বিশিষ্ট এই চিত্রশিল্পী। এ দেশে আধুনিক বিমূর্ত চিত্ররীতির অন্যতম প্রবর্তক তিনি। এই ৰেত্রে তাঁর অবদান বিরাট। দেশে শিল্পীমহলে তিনি এর স্বীকৃতি পেয়েছেন। একই সঙ্গে আর যেসব শিল্পী এই ধারা প্রবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন তাঁরাও আজ দেশে খ্যাতিমান। আজ দেশের শিল্পকলার ৰেত্রে যে অগ্রগতি এসেছে তার পেছনে অবদান রয়েছে অনেকেরই। শিল্পী কিবরিয়া তাঁদেরই অন্যতম। আমাদের চিত্রকলা আজ অনেক দূর এগিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন চিত্রকলা ছিল না বলা যাবে না, ছিল, কিন্তু আধুনিক চিত্রকলা ছিল না। বেশ কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর হাত ধরে আমাদের চিত্রকলা এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে এসেছে আধুনিক রীতি। এদেশে সে রীতির অন্যতম প্রবর্তক মোহাম্মদ কিবরিয়া। এদেশে চিত্রশিল্পের এগিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁরা অক্লানত্ম পরিশ্রম করেছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমদ প্রমুখের পরবর্তী ধাপেই আছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। এদেশে আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে তাঁর অবদান বিরাট। এই ধারারই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। এঁরা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান। এদেশে আধুনিক চিত্রকলার প্রবর্তন ও প্রসারের ৰেত্রে এঁদের প্রত্যেকের অবদান অনস্বীকার্য।
বিমূর্ত চিত্রকলা বোঝেন না এ কথা অনেকে বলেন। কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। শিল্পী কিবরিয়ার মৃতু্যর পর এক স্মরণসভায় বিশিষ্ট শিল্পী হাসেম খান তাঁর স্মৃতিচারণে ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে স্মৃতিচারণ করে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
মোহাম্মদ কিবরিয়ার চিত্র প্রদর্শনী চলছে। বহু লোক দেখতে আসছে। একদিন এল বোরকাপরা এক বধূ ও তাঁর স্বামী এক রিকশাচালক। ওই মহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটি ছবি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। একবার সামনে একবার পাশে এভাবে কয়েকবার দেখার পর স্বামীকে ডেকে ছবিটা দেখে বললেন, দেখো দেখো এটা সরষে খেত না? ছবিটি বুঝতে পেরে আনন্দিত এই মহিলা। শিল্পীর স্বার্থকতা এখানেই। দর্শকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করছেন এবং বিশেষ ধরন বা ভঙ্গিতে উপস্থাপন করছেন তাঁর বিষয়বস্তু।
অমায়িক মানুষ ছিলেন শিল্পী কিবরিয়া। রুচিবান মানুষ। অনেকটা নিভৃতচারী। তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রচ- ভক্ত ছিলেন তিনি। এদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখকদের গল্প উপন্যাস তিনি নিয়মিত পড়তেন। সাহিত্যের সঙ্গে ছিল তাঁর আজীবন সখ্য। চিত্রকলা এবং সাহিত্যের অবস্থান দূরে নয়, নিকটে। সাহিত্য যেমন একটা মাধ্যম তেমনি চিত্রকলাও একটি গুরম্নত্বপূর্ণ মাধ্যম যার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় মনের ভাব বা অনুভূতি। দুটির রূপ ভিন্ন হলেও তাদের অবস্থান পরস্পরের কাছাকাছি। সঙ্গীতও তাই। তাই বলা যায়, এগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক দূরের নয়, নৈকট্যের। কবি গুরুকে তাই দেখা যায়, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং তার সঙ্গে সঙ্গীতচর্চার এক পর্যায়ে কবি চলে আসেন চিত্রকলায়।
আমাদের দেশে অনেক শিল্পীই সাহিত্যের অনুরাগী, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁদের হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক। লেখকদের বইয়ের ছবি বা প্রচ্ছদ অাঁকার ৰেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে শিল্পীরা সাহিত্য অঙ্গনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। কোন কোন শিল্পী সাহিত্য রচনার সঙ্গেও সংশিস্নষ্ট। শিল্পী কিবরিয়া ছিলেন সাহিত্য অনত্মপ্রাণ মানুষ। বাংলা সাহিত্যের প্রচ- অনুরাগী ছিলেন। তাঁর শিল্পপ্রেম এবং সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ মিশে গিয়েছিল একাকার হয়ে। বিদগ্ধ এই মানুষটি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে একাধারে শিল্পের প্রতি অনুরাগ এবং সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা যেমন জাগিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন দেশপ্রেমও। আমাদের আধুনিক চিত্রশিল্পী তাঁকে মনে রাখবে। তিনি আমাদের শিল্পকলার ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন তাঁর অগণিত সহকর্মী, ছাত্র ও অনুরাগীর মধ্যে।
শিল্পী কিবরিয়ার চলে যাওয়ার অর্থ বাংলাদেশের শিল্প গগন থেকে এক উজ্জ্বল নৰত্রের বিদায়।
প্রতিবেশী ভারতের শিল্প গগনের এক নৰত্রের চলে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেল এ সময়েই। তিনি শিল্পী হুসেন। পুরো নাম মকবুল ফিদা হুসেন। তবে হুসেন নামেই পরিচিত তাঁর দেশব্যাপী এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপীও। আপাদমসত্মক শিল্পী তিনি। তাঁর চালচলন জীবনযাপন সবই একজন প্রকৃত শিল্পীর মতো। কোন ভনিতা নেই, সহজ-সরল সুন্দর জীবন। বিলাসিতার ধার ধারেন না। শিল্পী হুসেন বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পক্বকেশ ও শ্মশ্রম্নম-িত এক সরল মানুষের চেহারা। বিলাসিতা দূরের কথা অনেক সময় তিনি পায়ে জুতা স্যান্ডেলও ব্যবহার করতেন না।
দেশ-বিদেশে তাঁর নাম। অগণিত ভক্ত। ছবির দামও অনেক। এক নিলাম ঘরে তাঁর একটা ছবির দাম উঠেছিল ২০ লাখ ডলার পর্যনত্ম। সহজ-সরল এই মানুষটি থাকতেন সাদাসিদ্ধাভাবে। পশ্চিমা দেশের এক ম্যাগাজিনে তাঁকে বলা হয় 'ভারতের পিকাসো।' আসলে বড় মাপের মহৎ সব শিল্পী নিজ নিজ ৰেত্রে অনন্য। কারও সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। সবাই নিজ নিজ ৰেত্রে অনন্য। পিকাসো পিকাসোই। তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। হুসেন হুসেনই। তাঁর সঙ্গেও তুলনা চলে না কারও।
হুসেনের বিষয়ে সর্বপ্রথম যে কথাটি বলা যায়, সেটি হচ্ছে হুসেন স্বশিৰিত শিল্পী। কোনদিন কোন একাডেমী বা স্কুল থেকে চিত্রকলায় শিৰা নেননি। নিজের ভেতরেই ছিল শিল্প। নিজেই সেটাকে বিকশিত করে জগদ্বিখ্যাত হন।
নিজ দেশে ছিলেন খুবই জনপ্রিয় একজন মানুষ। পথে ঘাটে শহরে নগরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শিল্পীর চোখে দেখেছেন মানুষ ও পরিপাশর্্ব। ছবি অাঁকতেন যেখানে সেখানে। কাগজ পেন্সিল কলম তুলি একটা হলেই হলো। সাবলীল দৰতায় একের পর এক হয়ে যেত স্কেচ। সকল পর্যায়ে মানুষ তাঁর ছবি ভালবাসত। তাঁর ছবি বুঝত সাধারণ মানুষও। ভারতের অনেক সম্মান তিনি পেয়েছেন। পেয়েছেন পদ্মশ্রী ১৯৫৫ সালে। তারপর পেয়েছেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণও পেয়েছেন।
জন্ম তাঁর ভারতের মহারাষ্ট্রে। সেই মহারাষ্ট্রের মুম্বাইতে সিনেমার বিশাল বিশাল ছবি অাঁকার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরম্ন। সিনেমার ব্যানার বা পোস্টার ইত্যাদি অাঁকার মাধ্যমে বাসত্মব শিল্পী জীবনের সূচনা তাঁর। পাশাপাশি চলে নিজের ছবি অাঁকা। ১৯৫২ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় সুইজারল্যান্ডে। সেই থেকে তিনি পান আনত্মর্জাতিক খ্যাতি।
চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন শিল্পী হুসেন। মাধুরী দীৰিতকে নায়িকা করে তিনি তৈরি করেন একটি চলচ্চিত্র। তার নাম 'গজগামিনী।' এরপর আরেকটি চিত্র নির্মাণ করেন টাবুকে নিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন ১৯৬৭ সালে। তাঁর প্রথম ছবি 'থ্রম্ন দ্য আইজ অব এ পেইন্টার।' ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে 'গোল্ডেন বিয়ার'-এ সম্মানিত হয়।
ভারতজুড়ে খ্যাতিমান শিল্পী হুসেন হিন্দুদের দেবী সরস্বতীর একটা ছবি অাঁকায় হিন্দু উগ্রবাদী কট্টরপন্থীদের রোষানলে পড়েন। তাঁর বাড়িতে উগ্রপন্থী একদল লোক হামলা চালিয়ে তাঁর অনেক ছবি নষ্ট করে দেয়। তাঁরা তাঁকে হত্যার হুমকিও দেয়। উগ্রপন্থীরা এই মহান শিল্পীর অাঁকা ঐ ছবির ব্যাপারে নগ্নতার অভিযোগ তোলে।
শিল্পী হুসেন ২০১০ সালে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান কাতারের নাগরিকত্ব নিয়ে। তিনি বাস করতে থাকেন লন্ডনে। সেখানেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ভারতের এই বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন সে দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রিয় শিল্পী, ভারত সরকারও তাঁকে দিয়েছে উচ্চতর সব সম্মান ও মর্যাদা। অথচ ধর্মান্ধ মৌলবাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের একটি গ্রম্নপ তাঁর বিরম্নদ্ধাচরণ করে অসম্মান করে তাঁকে। শিল্পী হুসেন বেঁচে থাকবেন তাঁর দেশ ভারতের শিল্পকলার ইতিহাসে। বেঁচে থাকবেন বিশ্বের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসেও।
লেখক শিল্পীদের জন্ম হয় কোন না কোন দেশে। কিন্তু তাঁরা কোন একটি দেশের সম্পদ নন। তাঁদের কাজ বিশ্বের সকল দেশের সকল মানুষের। সাহিত্যই হোক চিত্রকলাই হোক এবং যে কোন দেশেই সেগুলো রচিত বা অঙ্কিত হোক, সেগুলো বিশ্ব শিল্প ভুবনের অংশ। শিল্পীদের তাই নিজস্ব দেশ থাকলেও তাঁরা সব ধরনের গ-ির উর্ধে, সকল দেশের তাঁরা। শিল্পী কিবরিয়া যেমন আমাদের তেমনি সবার, শিল্পী হুসেন যেমন ভারতের, তেমনি তিনি আমাদেরও। এই দুই শিল্পীর মৃতু্য তাই শুধু বাংলাদেশ ও ভারতেরই ৰতি নয়, ক্ষতি বিশ্ব শিল্প ভুবনেরও।
এই দুই মহান শিল্পীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।

বাজেটের পর বাজার

দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খবর প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ খবরটি হচ্ছে 'বাজেট ঘোষণার পর আরেক দফা বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম।' ভুক্তভোগীদের কাছে এ খবর সঙ্গত কারণেই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমনিতেই উচ্চ দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে পড়ে লোকজনের ভোগানত্মি বেড়েছে তার ওপর বিভিন্ন ছল ছুঁতোয় যদি জিনিসপত্রের দাম বাড়তেই থাকে তাহলে তারা যাবে কোথায়? বাজেট এলেই একটি প্রবণতা দেখা যায় কোন কোন ব্যবসায়ীর মধ্যে।

বাজেটের আগে ও পরে দুই দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় তারা। বাজেটে দাম কমুক বা বাড়ুক সেদিকে কোন ভ্রূৰেপ নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে বাজেটে দাম বাড়েনি এমন পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা এবং তা বাজেটের উছিলায়। বাজেটে কোন জিনিসের দাম বাড়লে তাৎৰণিকভাবে তা বাড়িয়ে দেয়া হয় কিন্তু কমলে সেটি কার্যকর হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে।
ঘোষিত বাজেটে ভোজ্যতেলের দামের ওপর কোন কর বাড়ানো না হলেও বাজেট ঘোষণার পর পরই দুই থেকে পাঁচ টাকা লিটারপ্রতি দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে সিন্ডিকেট চক্র। ফলে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমনিতেই এ বছর দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমনকি মাত্র এক সপ্তাহ আগেও কোম্পানিগুলো সব ধরনের সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ না যেতেই বাজেট ঘোষণার পর আবারও তেলের দাম বাড়ানো হয়। এক লিটারের সয়াবিনের বোতল ১১৬ টাকার স্থলে ১২০ টাকা এবং দুই লিটার ২৩৪ টাকার স্থলে ২৪০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কোম্পানি ভেদে দামের তারতম্য রয়েছে। সে ৰেত্রে দাম আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১০ জুলাই থেকে ২০১১-এর ২৫ মে পর্যন্ত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৫২ হাজার ৫১৮ মেট্রিক টন। যা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট। অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন সরবরাহ কমে যাওয়ার কথা।
ব্যবসায়ীরা যখন এই ধরনের দাবি তুলছেন তখন আনত্মর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে আসছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে উল্টো তেলের দাম বাড়ছে। দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে কোন জিনিসের দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারেও তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দাম কমলে তার প্রভাব পড়তে অনেক সময় লাগে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখান আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীরাও প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। বিশেষ করে আসন্ন রমজানে যাতে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকে সেটি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যবসায়ীরা এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাজারে তো এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বাজেট ঘোষণার পরপরই জিনিসপত্রের দাম বাড়ল কেন? আনত্মর্জাতিক বাজারে যেখানে ভোজ্যতেলের দাম কমছে সেখানে স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা তো সদিচ্ছার লৰণ নয়। এখন থেকেই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে টেনে ধরতে না পারলে রমজানে কি তাকে বাগে আনা যাবে?
মানুষজন বিশ্বাস করতে চায় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া ব্যবসায়ীদের আশ্বাস কেবল কথার কথা নয়, এজন্য বাজারে এর প্রতিফলন দেখতে চান ভুক্তভোগীরা।

সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, 'সরকার ও বিরোধী দলকে সমঝোতার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে।' তাঁর কথার মধ্য দিয়ে সমকালীন গণতান্ত্রিক বিশ্বের বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর উচিত নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন ও শক্তিশালী করার লৰ্যে ভূমিকা রাখা। বিএনপি দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, গ্যাস, পানি ও বিদু্যতের সঙ্কটসহ অন্য যেসব সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছে তা মূলত জাতীয় সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। হরতালের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রবিবার সকাল ছয়টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যনত্ম ৩৬ ঘণ্টা একটানা হরতাল আহ্বান করেছে। দল দুটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, জোটগতভাবে নয়; তাঁরা যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে হরতাল পালন করছেন। তারা মূলত সরকারের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধানত্মের প্রতিবাদে এবং সেই সঙ্গে অন্য বেশ কয়েকটি দাবিতে এ হরতাল ডেকেছেন। উলেস্নখ্য, বিএনপি ৰমতায় থাকাকালে সর্বদা হরতালের বিরোধিতা করে। সম্প্রতি বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। সমাজের সর্বসত্মরে বাজেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ঠিক এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বানের কোন যৌক্তিকতা আছে কি? দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীল নাগরিক ইতোমধ্যে এ হরতালের নিন্দা করেছেন। তারা বলেছেন, এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হবে। অফিস, আদালত, কল-কারখানায় স্বাভাবিক কাজকর্ম বাধাগ্রসত্ম হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের স্বীকার হবেন।
যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে; আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার সহজ সমাধান সম্ভব ছিল। ৩৬ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যসত্ম করে লাভ করোরই হবে না; বরং সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ৩৬ ঘণ্টার হরতাল আহ্বানের আসল উদ্দেশ্য কি? এতে কার লাভ? এ ধরনের হরতালে জাতীয় অর্থনীতি আরও বেশি বিপর্যস্ত হবে।