Wednesday, March 02, 2011

লিবিয়ায় হামলার প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের

লিবিয়ায় সামরিক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির কয়েকটি নৌবহর ও বেশ কিছু সামরিক বিমান এরই মধ্যে লিবিয়ার চারপাশে অবস্থান নিতে শুরু করেছে। পরে বড় ধরনের সামরিক হামলার প্রয়োজন হলে রাশিয়াকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে গত সোমবার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

অন্যদিকে লিবিয়া ছাড়তে উদগ্রীব বিদেশিরা তিউনিসিয়া সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। এরই মধ্যে এই সীমান্ত দিয়ে ৭৫ হাজার বিদেশি লিবিয়া ছাড়লেও গতকালের পরিস্থিতি ছিল রীতিমতো উদ্বেগজনক। গতকাল এই সীমান্তে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় দুই হাজার বিদেশি জড়ো হয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশিও আছেন।
লিবিয়ার ওপর নৌ ও বিমান আক্রমণের বিশেষ পরিকল্পনার কথা গতকাল পেন্টাগন ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাতের জন্য লিবীয় সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করেছে। তাদের নৌ ও বিমানবাহিনী লিবিয়ার চারপাশে অবস্থান নিচ্ছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র কর্নেল ডেভ লাপান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, 'এ মুহূর্তে আমরা একাধিক পরিকল্পনা নিয়ে
ভাবছি। তবে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও মহড়া অব্যাহত আছে। এরপর সবচেয়ে উপযোগী পরিকল্পনা অনুসারে আমরা সামনে অগ্রসর হব।'
এর আগে দেশটিতে সামরিক হামলা চালিয়ে গাদ্দাফি যাতে তাঁর বিরোধীদের নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে না পারেন সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নেতারা লিবিয়ায় একটি নিরাপদ আকাশসীমা বা নো ফ্লাই জোন গঠনে একমত হন। ন্যাটোর সামরিক বিমানগুলোকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সম্ভাব্য বিমান হামলার পরিকল্পনায় রাশিয়াকেও পক্ষভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার কিছু যুদ্ধবিমান এ মুহূর্তে লোহিত সাগর এলাকায় রয়েছে এবং সেগুলোকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন লাপান। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাতের পর লিবিয়ার ওপরে সামরিক হামলার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে বিপ্লবীদের সংঘাতের কারণে দেশটি থেকে হাজার হাজার বিদেশি ও লিবীয় তিউনিসিয়া সীমান্তে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় সেখানে হাজার হাজার বিদেশি ও উদ্বাস্তু প্রাণ বাঁচানোর আশায় জড়ো হচ্ছে। বিবিসি জানিয়েছে, পরিস্থিতি ভীষণ উদ্বেগজনক। প্রতি ঘণ্টায় সেখানে দুই হাজারের বেশি শরণার্থী জড়ো হচ্ছে। এদের অধিকাংশই বিদেশি। এদের মধ্যে মিসরীয়, চীনা এবং বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কমিশনের হাইকমিশনার মেলিসা ফ্লেমিং জানিয়েছেন, গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার মানুষ লিবিয়া ছেড়ে তিউনিসিয়ায় ঢুকে পড়েছে। গতকাল পরিস্থিতি ছিল ভীষণ উদ্বেগজনক। গতকাল সেখানে প্রায় ২০ হাজারের বেশি শরণার্থী জড়ো হয় যাদের অধিকাংশেরই কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এদের অধিকাংশই মিসরীয়। এ ছাড়াও এদের মধ্যে চীনা ও বাংলাদেশি শরণার্থী রয়েছে। মিসরীয়রা অভিযোগ করেছে, তাদের ব্যাপারে মিসর সরকারের কোনো নজরদারি নেই। শরণার্থীদের অনেকেই একবস্ত্রে চলে এসেছে। তিউনিসিয়া সীমান্তে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা দেওয়ায় শীতের পোশাকের অভাবে তাদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকিতে আছে। এর সঙ্গে খাবারের কষ্টও আছে প্রচণ্ড। সীমান্তটিতে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকেন্দ্র খোলা হলেও সেখানে খাবার সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
এদিকে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি বিদেশি প্রচারমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবারও বলেছেন, তাঁর জনগণ এখনো তাঁকেই পছন্দ করে। ত্রিপোলিতে তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ ওঠার প্রশ্নই আসে না। তিনি এখনো এই সংকট সৃষ্টির জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করে যাচ্ছেন।
গাদ্দাফির অনুগত লিবীয় বিমানবাহিনী গাদ্দাফির হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অংশগুলো পুনরুদ্ধারে গতকাল সামরিক মহড়া দিয়েছে। পশ্চিম লিবিয়ার তিউনিসিয়া সীমান্তের কাছে নালুত শহরের ওপর দিয়ে কমপক্ষে দুটি যুদ্ধবিমানকে টহল দিতে দেখা গেছে। যুদ্ধবিমান থেকে একটি অস্ত্র গুদামের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। সে সময় সেখানকার অধিবাসীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং লিবীয় নেতার বিরুদ্ধে গগনবিদারী স্লোগান দেয়। তবে সেখানকার বিপ্লবী নেতারা দুটি যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে একটি সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গতকাল লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, দেশটি এখন গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি এবং এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি লিবিয়ায় একটি নিরাপদ আকাশসীমা তৈরির পক্ষে মত দেন এবং দেশটির শান্তিরক্ষায় ব্রিটিশ সৈন্য পাঠানোর দরকার হলে ব্রিটেন তার জন্য তৈরি বলেও জানিয়েছেন তিনি।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন গতকাল বলেছেন, গাদ্দাফি তাঁর জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশ শাসনের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি আরো বলেন, 'লিবিয়ার এই শাসক তাঁর জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এর অর্থ জনগণ আর তাঁর পক্ষে নেই। তাই লিবিয়ায় তাঁর পরিবর্তন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। জনগণ আর তাঁকে চাইছে না। আমরা জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশটির জনগণ পরিবর্তন চায়, সেই পরিবর্তন বাস্তবায়নে জাতিসংঘ লিবীয় জনগণকে সহযোগিতা করে যাবে। গাদ্দাফির উচিত জনগণের মনোভাব বোঝা এবং এক্ষুনি তাঁর পদ থেকে সরে যাওয়া।' গতকাল ওয়াশিংটনের হলোকাস্ট জাদুঘরের সামনে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, 'তিউনিসিয়া, মিসর, বাহরাইন থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বা এর চেয়েও বেশি এলাকাজুড়ে জনগণ এখন নতুন অধিকার ও নতুন স্বাধীনতার পক্ষে। এসব এলাকার রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধানদের আমি বরাবরই অনুরোধ করে আসছি জনগণ কি বলতে চায় সেটা ভালো করে শুনুন। অযথা রক্তপাত না ঘটিয়ে তাদের দাবিগুলো মেনে নিন অথবা দরকারি সংস্কারের চেষ্টা করুন। নইলে এর পরিণতি শুভ নাও হতে পারে।'
বারাক ওবামার সঙ্গে লিবিয়ার সংকট উত্তরণে তাঁর খোলামেলা কথা হয়েছে এবং তিনি জানান এ বিষয়ে তিনি সন্তুষ্ট। বান কি মুন আজ বুধবারের সাধারণ অধিবেশনে সব সদস্য রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানান।
এর আগে জাতিসংঘের মহাসচিব গত সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে তাঁর ওভাল অফিসে বৈঠকে মিলিত হয়ে লিবিয়ায় প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং লিবীয় জনগণের মানবাধিকার অক্ষুণ্নের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। সে সময়ে লিবিয়ার পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একজন ঊর্ধ্বতন সমন্বয়ক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকের পর লিবিয়ায় সামরিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
বৈঠক সম্পর্কে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সুসান রাইস বলেন, 'লিবীয় নেতা এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছেন এবং তাঁর মানবাধিকারবহির্ভূত আচরণগুলোর জন্য সারা বিশ্ব কেমন উদ্বিগ্ন হয়েছে সেটা এখনো বুঝতে পারছেন না তিনি। রাইস বলেন, 'বৈঠকে লিবিয়ার জনগণকে গাদ্দাফির অপশাসন থেকে বাঁচাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।' সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ, এএফপি, বিবিসি, জি নিউজ, দ্য হিন্দু অনলাইন।

সমকালীন শিল্পঃ শিল্পীর ক্যানভাসে by শাশ্বতী মজুমদার

শিল্পী রোকেয়া সুলতানার কাজের মূল বৈশিষ্ট্য ছন্দোময় কম্পোজিশন আর উষ্ণ রঙের ব্যবহার। নারী ও প্রকৃতি তাঁর কাজের প্রধান বিষয়। আশির দশকে ম্যাডোনা সিরিজ এঁকে বিখ্যাত হয়েছিলেন এ শিল্পী। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি সিরিজ হলো জল, বায়ু, মাটি, সম্পর্ক।
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা তাঁর কর্মের অনুপ্রেরণা। টেম্পারা, মিক্সড মিডিয়া, এক্রেলিকে তিনি বেশির ভাগ ছবি এঁকেছেন। ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, ফোরগ্রাউন্ডের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রভেদের অনুপস্থিতি, ছন্দোময় রেখার মাধ্যমে ফিগারের উপস্থাপন শিল্পীর কাজে এনে দিয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাই কাজের ভিড়েও তাঁর কাজকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়।
ক্যানভাসকে শিল্পী তুলনা করের তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির সঙ্গে। কারণ তাঁর প্রতিদিনকার আবেগ আর অনুভূতিরই রূপদান করেন তাঁর শিল্পকর্মে। নিজের শিল্পকর্ম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো ‘আমি আমার শিল্পকর্মকে নির্দিষ্ট কোনো শিল্প আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না বরং বিশুদ্ধভাবে নিজস্বতা বজায় রাখতে চাই।’
সমকালীন বাস্তবতা নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে তাঁর শিল্পকর্মে।
‘ধরণী’ নামের চিত্রকর্মটি তিনি সম্প্রতি এঁকেছেন। এখানে বিশাল ক্যানভাসে একটি নারী-ফিগারকে চিত্রায়িত করেছেন, যার শরীরের বিভিন্ন অংশ ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে ভাগ করা, ফিগারটির পাশেই একটি কালো রঙের চেয়ার।
ছবিটি নিয়ে শিল্পী তাঁর নিজস্ব ভাবনা সম্পর্কে বলেন, মেয়েরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই থাকে বঞ্চিত। তারা তাদের কথা, চাওয়া-পাওয়া সব সময় প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। তাই তাদের অবদমিত গোপন ইচ্ছাগুলো লুকিয়ে থাকে তাদের মনের নিভৃত কোণে। দৈনন্দিন কাজে ব্যবহূত ড্রয়ারে আমরা যেমন আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখি, তেমনি মেয়েদের এই গোপন ভালো-মন্দ আকাঙ্ক্ষাগুলোও তারা লুকিয়ে রাখে মনের এক একটি কোণে। আর পাশের চেয়ারটি হয়তো বা কেউ আসবে বা তাদের আত্মিক মুক্তিকে আহ্বান করবে, এরই প্রতীক।
শিল্পী তাঁর প্রিয় রং লাল আর হলুদ ব্যবহার করে ছবিটি এঁকেছেন। তাঁর সংবেদনশীল সত্তার প্রকাশ ঘটেছে ছবিটিতে। এই ছবির ধারাবাহিকতায় আরও ছবি আঁকবেন বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থান নিয়ে শিল্পী উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ইভ টিজিং এবং এর শিকার মেয়ে ও তাদের আত্মীয়স্বজনের দুর্ভোগ নিয়ে শিল্পী মর্মপীড়ায় ভোগেন। এ বিষয়ে তিনি মানুষের সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন। পরবর্তী সময়ে এ বিষয় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করবেন বলে ভাবছেন।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানার জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১৯৮০ সালে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাপচিত্রে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। রোকেয়া সুলতানা প্রথম নারী শিল্পী, যিনি ১৯৯৯ সালে এশিয়ান বিয়ানালে পুরস্কার লাভ করেন।