Friday, August 12, 2011

অনিরুদ্ধ হুমায়ুন আজাদ by নওশাদ জামিল

স্পেনের অন্তরতম সন্তান বিশ্বখ্যাত কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা। দেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন আর দেশের জন্য শহীদ হয়েছিলেন দেশেরই হিংস্র শাসক ও সহযোগীদের হাতে। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুও অনেকটা লোরকার মতোই। ঘাতকরা তাঁকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, তবে বিস্ময়করভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরও কিছুদিন বেঁচেছিলেন তিনি। পরে মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করে। বহুমাত্রিক লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার। ২০০৪ সালের এই দিনে জার্মানিতে মারা যান প্রথাবিরোধী এ লেখক। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীতে বইমেলা শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে মৌলবাদীদের হামলার শিকার হন তিনি।
লোরকার স্মৃতি স্মরণে স্পেনে রয়েছে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার। কিন্তু আমাদের দেশে বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিদেশে লেখক-কবিদের বাড়ি সংরক্ষণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে। আমাদের এখানেও নেতা-নেত্রীদের নামে কত কিছু করা হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, দলীয় লোকের নামে সড়ক ও স্থাপনা করা হয়। তবে দেশের বরেণ্য লেখক হুমায়ুন আজাদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা'। তিনিও ছিলেন অনেকটা নিঃসঙ্গ। জীবিতকালে তিনি একাই লড়াই করে গেছেন কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। মৃত্যুর পরও তিনি যেন নিঃসঙ্গ।
হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা কোহিনূর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তাঁর স্মৃতি রক্ষার জন্য কেউ কিছু করছেন না। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে। তাদের কথা শুনে আমরা ভাবি, হুমায়ুন আজাদের হত্যার বিচারটা তাদের দ্বারা হবে এবং তাঁর অবদান স্বীকৃত হবে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষিত হবে। তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হবে যথাযোগ্যভাবে। এই যে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক দেওয়া হয়, হুমায়ুন আজাদ কি তা পাওয়ার যোগ্য নন? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি তো বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন, এমনকি ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও তাঁর যে অবদান সে জন্যও তো তিনি একটি পুরস্কার পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিছুই পাননি। তাঁর নামে একটি সংগ্রহশালা গড়ার উদ্যোগও নিচ্ছেন না কেউ। এমনকি তাঁর কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এটা আমাদের খুব পীড়া দেয়।'
বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সম্মানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে গেছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি অমলিন হয়ে আছেন বাঙালির কাছে, বিশ্বমানবের কাছে। বাঙালির সমাজজীবন, প্রকৃতি ও ঐহিত্যগতভাবে অর্জিত সংস্কৃতি, সাহিত্য আর শিল্পের মাধুর্যকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-সমালোচনাসহ শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট আলোক কণা আমাদের অন্ধকারে পথ দেখায়, প্রাণিত করে। তবে বরেণ্য এ লেখকের নামে ঢাকায় কোনো সড়কের নামকরণ হয়নি কিংবা তাঁর নামে কোনো স্থাপনা নেই। এটাকে অন্যায় হিসেবে দেখছেন তাঁর ভক্ত-সুহৃদরা।
হুমায়ুন আজাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে দেশি-বিদেশি সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার। দেশ-বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পদক পেয়েছেন। অনেক খ্যাতনামা লেখক তাঁকে স্বাক্ষরসহ বই উপহার দিয়েছেন। এসব পদক ও বই সংরক্ষণ করার জন্য যে আর্থিক সামর্থ্য থাকা দরকার, তা তাঁর পরিবারের নেই। এ বিষয়ে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে তাঁরা মত দেন।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কবির হার্দিক সম্পর্ক ছিল। তিনি কবির চিকিৎসার জন্য অনেক কিছু করেছিলেন। এখন কবি নেই। তাঁর স্মৃতিরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে এলে সেটি বাংলা ভাষার একজন বরেণ্য লেখকের প্রতি সমগ্র জাতির সম্মান ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হয়ে থাকবে।
হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদ বলেন, প্রথাবিরোধী এ লেখকের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি আশা করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ সরকার লেখকের স্মৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন, 'সরকার চাইলে আমরা বসে ঠিক করতে পারি। সবার পরামর্শ নিয়ে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে কিছু করা দরকার।'
হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মৌলি আজাদ। তবে হুমায়ুন আজাদের জন্মভূমি মুন্সীগঞ্জের রাঢ়িখালে তাঁর সাহিত্য ও কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
হুমায়ুন আজাদ মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাগ্যকুল ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাঢ়িখাল গ্রামে। তিনি তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাঢ়িখালের জ্যোতির্ময় আঙিনায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
হুমায়ুন আজাদ রাঢ়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। মেধাবী ছাত্র হুমায়ুন আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন।
'অলৌকিক ইস্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ১৯৯৪ সালে তিনি 'ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল' দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত 'সবকিছু ভেঙে পড়ে' বইয়ের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। এ ছাড়া তাঁর প্রবন্ধ, গবেষণা, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, শিশুসাহিত্যসহ প্রায় ৬০টি পাঠকনন্দিত বই রয়েছে।

পুলিশের ঈদ চাঁদাবাজি by আবু হেনা রাসেল ও এস এম আজাদ

ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরের শপিং কমপ্লেক্সে সামনে ফুটপাতের কাছে গত শনিবার মোটরসাইকেলে করে এসে দাঁড়ালেন শাহ আলী থানার এসআই তরিকুল ইসলাম। ফুটপাতের এক দোকানদারকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, 'তাড়াতাড়ি সরা। দুই দিন তো মালপানি দিস না।' দোকানি বললেন, 'স্যার, যে বৃষ্টি, দোকানই তো সাজাইতে পারি না! আপনাগো কী দিমু?' পরে নিজের দোকান গুটানোর সময় সিদ্দিক মিয়া নামের ওই হকার বললেন, "ভাই, পুলিশকে প্রতিদিন ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। একে বলে 'পুলিশের কাবজাব'। টাকা না দিলে ওরা আমগো ধইরা মাজারের পাশে নিয়া আটকাইয়া রাইখা টাকা আদায় করে।"
নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের বিপরীত দিকের গ্লোব শপিং কমপ্লেক্সে সামনে ফুটপাতের গেঞ্জি বিক্রেতা সেলিম বললেন, 'ঈদের সময় বেচাকেনা না অইলেও ট্যাকা বাড়াইয়া দিতে অইতাছে। ওগো ঠিকমতো ট্যাকা না দিলেই বিপদ। কিছুই কওয়ার নাই। কিছু কইলেই রোজার দিনে ইফতারির বদলে লাথি আর লাঠি জুটব কপালে। ঘাড় ধইরা উঠাইয়া দিব।'
সরকারি রাস্তার ওপর ৪০ ইঞ্চি ও ৫২ ইঞ্চি প্রশস্ত দুটি চৌকি-দোকানের জন্য সেলিমকে এখন প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। পুলিশের হয়ে এই টাকা তুলছে 'লাইনম্যান' রফিক ও আকবর।
রমজানের আগে চাঁদা ছিল ২০০ টাকা, ঈদ উপলক্ষে ৩০০ টাকা বেড়েছে।
গত সোমবার বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য সংগ্রহের সময় কালের কণ্ঠকে সেলিম বললেন, 'ভাই, আমি সামান্য হকার। উল্টা-পাল্টা কিছু লেইখেন না। আমি কারো বিরুদ্ধে বলতে চাই না।'
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, পেশাদার চাঁদাবাজদের পাশাপাশি পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন রাজধানীর ফুটপাত ব্যবসায়ীরা। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, ঈদকে সামনে রেখে নিউমার্কেটের এসব ফুটপাতও ব্যবসায়ীদের কাছে রীতিমতো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। হকার-ব্যবসায়ীদের কাছে এটার নাম 'পজিশন বাণিজ্য'। ৪০ ইঞ্চি ফুটপাতের পজিশন শুধু চলতি মাসের জন্য বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। ঈদের কারণে দৈনিক চাঁদার হারও তারা বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ফুটপাতে ব্যবসা করতে গেলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, ছাত্রনেতা, পেশাদার সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজসহ অনেককেই টাকা দিতে হয়। আর পুলিশকে টাকা না দিয়ে দোকান বসানোর তো প্রশ্নই ওঠে না।
নিউমার্কেটের আটটি ফুটপাত-মার্কেটসহ রাজধানীর প্রধান প্রধান ফুটপাত-বাজারগুলো ঘুরে পুলিশের চাঁদাবাজির ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। জানা গেল, মিরপুর রোডের নেওয়াজ পাম্পের সামনে থেকে নিউমার্কেট ফুট ওভারব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে পুলিশের হয়ে টাকা ওঠায় লাইনম্যান রফিক ও আকবর। রফিক নিজেকে হকার্স লীগের নেতা বলেও পরিচয় দেয়।
বাংলাদেশ জাতীয় হকার্স ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক কামাল সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হকাররা এখন চলে গেছে পুলিশের লাইনম্যানের নিয়ন্ত্রণে। এরা মূলত পুলিশের দালাল। ওদের ভয়ে হকাররা প্রতিবাদও করতে পারে না।'
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি হকার বসে নিউমার্কেট ও গুলিস্তান এলাকায়। ছিন্নমূল হকার্স সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গুলিস্তান এলাকায় হকারের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। নিউমার্কেট এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার। এর পরই হকারের সংখ্যাধিক্য সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী, তারপর ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার এলাকায়।
পুরানা পল্টনের ৬২/২ নম্বর ভবনের সামনের ফুটপাতের টুপি বিক্রেতা আবুল বাশার বললেন, 'এত দিন ৩০ ট্যাকা কইরা দিয়া আসতাছি। হুনলাম আজ থাইক্যা ২০ ট্যাকা বাড়াইয়া ৫০ করছে। অহনো দেই নাই। তয় দিতে অইব।' তিনি আরো জানান, দৈনিক বাংলা মোড় থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত পুরো ফুটপাতে পুলিশের হয়ে চাঁদা আদায় করে লাইনম্যান নূর মিয়া ওরফে কাইল্যা নূর, শাহজালাল, কামরুল ও গোলাপ।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বায়তুল মোকাররমের মোড় থেকে গুলিস্তানের সব ফুটপাতেই দোকানপ্রতি এখন প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে। কিছুদিন আগেও এ হার ছিল ৩০ টাকা। গুলিস্তানের ২২টি ফুটপাতই নিয়ন্ত্রণ করছে আবদুস সালাম নামে পুলিশের এক লাইনম্যান। সালাম নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে থাকে। তবে জানা গেছে, গত সরকারের আমলেও সালাম ওই এলাকায় লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেছে।
বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পাশ হয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ফুটপাতে পুলিশের হয়ে চাঁদা তোলে লাইনম্যান কোটন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আশপাশে আকতার হোসেন এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতে দোকানপ্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা নেয় লাইনম্যান আবুল হোসেন। ভাষানী হকি স্টেডিয়ামের সামনে ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গেটে দীর্ঘদিন ধরেই পুরনো এবং চোরাই ইলেকট্রনিঙ্ পণ্যের ফুটপাত-বাজার চলছে। এই এলাকায় টাকা তুলছে পল্টন থানার লাইনম্যান আলী। সে নিজেকে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দেয়। তার সহযোগীরা হচ্ছে জুনিয়র লাইনম্যান সোহেল, পায়েল, আনোয়ার ও কবির। বায়তুল মোকাররম মসজিদের ২ নম্বর গেট এলাকার লাইনম্যানগিরি করে পটল আর মসজিদের সামনে কাদির। রমনা ভবনের পাশে ফুটপাত থেকে দোকানপ্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান রানা। পাশের রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে ফল বাজার। দোকানদাররা জানান, থানার জন্য চাঁদার টাকা ওঠায় লাইনম্যানরা। আর প্রতিদিন টহল পুলিশ নিজেরাই এসে নিয়ে যায় দোকানপ্রতি ২০ টাকা করে। পুলিশের ভাষায় এটা চাঁদা না, 'চা খরচা'।
বঙ্গবন্ধু হকার্স মার্কেটের পাশে ফুটপাতের দোকানগুলোতে চাঁদা আদায় করছে লাইনম্যান দুলাল ও মনির, গোলাপশাহ মাজার থেকে ঢাকা ট্রেড সেন্টার পর্যন্ত দেড় শ টাকা করে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান বিমল বাবু। জাতীয় গ্রন্থাগারের পাশে বাবুল ও শহীদ, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের আশপাশে জজ মিয়া, জিপিওর সামনে কবির, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পেছন দিকে সালাম, হিন্দু বাবুল ও বিমল বাবু, গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনে স্বেচ্ছাবেক লীগ নেতা পরিচয়ধারী বাবুল এবং জুতাপট্টিতে মঙ্গল নামে আরেক যুবলীগ নেতা পুলিশের হয়ে টাকা তোলে। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের পাশে আহাদ, পুলিশ বঙ্ জুতাপট্টিতে ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সেক্রেটারি রাহাত এবং ট্রেড সেন্টারের পাশ থেকে নিউ রাজধানী পর্যন্ত ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাছির পুলিশের লাইনম্যান। তাদেরকে চৌকিপ্রতি প্রতিদিন ১০০ ও সপ্তাহে আলাদাভাবে ২০০ টাকা করে দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে থেকে গুলিস্তান আন্ডারপাস পর্যন্ত টাকা তোলে লাইনম্যান হারুন, গুলিস্তান গার্ডেনের সামনে আল মুনসুর থেকে হল মার্কেট পর্যন্ত বড় মিয়া এবং উল্টো পাশের ফুটপাত দেখে হাসান ও সুলতান। কাজী বসিরউদ্দিন নাট্যমঞ্চের পেছনে টাকা ওঠায় রিপন।
এদিকে ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে থেকে গ্লোব শপিং সেন্টার পর্যন্ত হকার্স লীগ নেতা রফিক, ৫২ নং ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা ইসমাইল, হোসেন ও আকবর দোকানপ্রতি ৫০ থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা তুলছে। প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের সামনে থেকে সানমুন টেইলার্সের কোনা পর্যন্ত ৫২ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সভাপতি ফরিদ ও সাধারণ সম্পাদক মিজানের নামে লাইনম্যান বাচ্চু; গাউছিয়া মার্কেট এলাকায় বাংলাদেশ হকার্স সমিতির সভাপতি হোসেন মোল্লা ও ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আমির হোসেন এবং নিউমার্কেট ৪ নম্বর গেট থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত চাঁদা তোলে নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাত্তার মোল্লা। জানা গেছে, নিউমার্কেটের দুটি ফুটপাত ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নেন ৫২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুখলেছুর রহমান ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মামলাও করেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এ দুটি ফুটপাতে তাঁরা দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন ২৮০টি। এখন দুই ফুটপাতে পজিশন বিক্রি করে ও টাকা তোলে লাইনম্যান সাত্তার মোল্লা। রাফিন প্লাজার সামনে স্থানীয় যুবলীগের মাইনুল ইসলাম, আনন্দ বেকারির পাশ থেকে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার পর্যন্ত আবদুল জলিল, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে মনির, ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাতে বিভিন্ন দোকান থেকে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে চাঁদা আদায় করে কয়েকজন। পুলিশও নিয়মিত ১০ টাকা করে নিয়ে যায়।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহীদ ফারুক সড়কসহ আশপাশে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান মান্নান, মনির, সোনা মিয়া, অনু ও তোরাব আলী। প্রতিদিন লাইম্যানরা এই টাকা বুঝিয়ে দেয় যাত্রাবাড়ী থানার এসআই হোসেনের হাতে।
এ ছাড়া মতিঝিলের জনতা ব্যাংক ভবনসংলগ্ন ফুটপাতে বড় হারুন, লিটন ও চুইলা বাবু, ফার্মগেট এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে যুবলীগ নেতা শাহআলম ও বিএনপি নেতা দুলাল আর ফুটপাতে টাকা তোলে লাইনম্যান হায়দার, বরিশাইল্লা হারুন, চুন্নু, আলমগীর, ঘড়ি সাইদ, সাইদ, মোবারক, শামসু, তোয়ালে কামাল, তৌহিদ, কাজল ও মোফাজ্জল। কারওয়ান বাজার এফডিসিসংলগ্ন রেলক্রসিং এলাকায় কমিউনিটি পুলিশ নেতা সিরাজ ও জিআরপির কনস্টেবল নুরু টাকা তোলে। পুলিশের হয়ে পুরো কারওয়ান বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আনোয়ার হোসেন, এল রহমান এবং সাহেব আলী নামের তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি। চেয়ারম্যানবাড়ী থেকে কাকলী ব্রিজ পর্যন্ত আবদুল ও মাসুম, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে বাদল, খলিল ও আকরাম আর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় জিআরপির এসআই নজরুল নিজেই হকারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।
বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই চাঁদাবাজরা আসলে পুলিশের লাইনম্যান ও দালাল। পুলিশ নিজেরা চাঁদা তুলতে পারে না বলে এদের ব্যবহার করছে। এসব বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়েও প্রতিকার মিলছে না। কারণ, এই চক্রে সব সময়ই সরকারি দলের নেতারা জড়িত থাকেন।'
ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে গুলিস্তানের সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের দায়িত্বরত টিএসআই শাহাবুদ্দিন বলেন, 'এখানে ফুটপাতে দোকান বসতে দেওয়া হয় না। চাঁদা কারা নেয় তা ভালো করে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। বক্স পুলিশ এসবের সঙ্গে জড়িত না।'
চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে আবদুস সালামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ভাই পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বলেন, 'এই এলাকায় সালাম একা চাঁদা নেয় না। মূলত সে প্রশাসনের দিকটা দেখে।'
পল্টন থানার ওসি শহীদুল হক ফুটপাত থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, 'থানা পুলিশের মাঠপর্যায়ের কেউ কেউ এ কাজ করতে পারে, তবে তিনি বা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানেন না। আসলে পুলিশ নয়, রাজনৈতিক দলের নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করে ফুটপাত। বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা তোলা হয়। ফুটপাত হকারমুক্ত করতে গিয়ে গত বছর পুলিশের ওপর হামলা হয়েছিল। মানবিক কারণে হকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।'
অথচ মিরপুর এক নম্বরের ফুটপাতের কয়েকজন হকার জানান, এই এলাকায় পুলিশ নিজেরাই সরাসরি মাঠে নেমেছে। শাহআলী থানার সিভিল টিমের এসআই বাবু কৃষ্ণ সাহা ও লতিফ কাঁচাবাজার, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটসহ আশপাশের প্রতিটি দোকান থেকে মাসে চার হাজার টাকা ওঠান। সঙ্গে থাকে সাঈদ নামে তাঁদের লাইনম্যান। কো-অপারেটিভ মার্কেটে তৈরি পোশাক বিক্রেতা শামছু ও মিজান জানান, প্রতিদিন দোকানপ্রতি থানা পুলিশকে দিতে হয় ১৫০ টাকা। কালু মিয়া নামে শাহআলী থানার ওসির এক লাইনম্যান কাঁচাবাজার থেকে প্রতি মাসের জন্য ছয় হাজার করে টাকা তোলে। গাবতলী টার্মিনাল ও দারুস সালামে পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই) তৈয়বুর রহমান নিজেই টাকা তোলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দিয়াবাড়ী এলাকায় পুলিশের লাইনম্যান কালাম টাকা ওঠায় দারুস সালাম থানার ওসি আবদুল মালেক ও অপারেশন অফিসার আবদুস সালামের নামে। ব্যবসায়ীরা এই অভিযোগ করলেও কালের কণ্ঠের কাছে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে হকাররা গড়ে তুলেছে ফুটপাত মার্কেট। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি লেডিস মার্কেট নামে পরিচিত। এখানকার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শাহজাহানপুর পুলিশ ফাঁড়ি ও মতিঝিল থানা তাঁদের কাছ থেকে লাইনম্যানদের মাধ্যমে প্রতিদিনই টাকা নেয়। সাইফুল ও ফল বেপারি নামে পরিচিত এক লাইনম্যান এসব চাঁদা তুলে থাকে।
এই অভিযোগের ব্যাপারে মতিঝিল থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, 'শুক্রবারে রাস্তায় বসে হকাররা। আর অন্য দিন ফুটপাতে। পুলিশের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ বহু আগে থেকেই শুনে আসছি। এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করি না।'

স্ত্রীকে বিক্রি!

বিয়ের তিন দিন পর মেয়েটি (২২) জানতে পারেন, তাঁর স্বামীর আরেকটি স্ত্রী রয়েছে। এ নিয়ে তাঁদের ঝগড়া হয়। পরে মেয়েটিকে মাদারীপুরের যৌনপল্লিতে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন প্রতারক স্বামী।
খবর পেয়ে র‌্যাব-৮-এর সদস্যরা গত রোববার মেয়েটিকে মাদারীপুর শহরের পুরানবাজার এলাকার যৌনপল্লির সামনে থেকে উদ্ধার করেন; গ্রেপ্তার করেন প্রতারক স্বামী আবদুল আজিজ সরদারকে (৩৮)। আজিজকে গতকাল সোমবার আদালতের মাধ্যমে মাদারীপুর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে মেয়েটিকে তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মেয়েটির বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায়। আজিজের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ কৃষ্ণনগর গ্রামে।
উদ্ধার হওয়া মেয়ে ও তাঁর স্বামীর ভাষ্যমতে, প্রায় এক বছর আগে শ্রীপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গেলে আজিজের সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের তিন দিন পর মেয়েটি জানতে পারেন, আজিজের আরেকটি স্ত্রী রয়েছে। এরপর দুজনের ঝগড়াঝাঁটি হলে আজিজ মাদারীপুরে চলে আসেন। গত শুক্রবার আজিজ শ্রীপুর গিয়ে স্ত্রীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাদারীপুরের পুরানবাজার এলাকার যৌনপল্লিতে নিয়ে আসেন।
উদ্ধারের পর মেয়েটি সাংবাদিকদের বলেন, মাদারীপুরে বোনের বাসায় রাখার কথা বলে আজিজ তাঁকে যৌনপল্লির সর্দারনি সুরমা বেগমের কাছে রেখে যান। পরদিন শনিবার তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে যৌনপল্লিতে রাখা হয়েছে। তখনই স্বামীকে অনুরোধ করেন, তাঁকে সেখান থেকে আজিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু আজিজ তাঁকে জানান, ১০ হাজার টাকায় তাঁকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁকে খারাপ কাজ করতে হবে।
প্রচণ্ড দুঃখে শনিবার সারা রাত মেয়েটি কান্নাকাটি করেন। রোববার সকালে মেয়েটির ছবি তুলে যৌনপল্লির লোকজন; এবং মেয়েটি যে স্বেচ্ছায় যৌনবৃত্তিতে নেমেছেন, এ জন্য তাঁর কাছ থেকে জোর করে হলফনামায় স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে তারা।
র‌্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি হলফনামায় স্বাক্ষর করতে না চাইলে তাঁকে মারধর করতে থাকে যৌনপল্লির লোকজন। খবর পেয়ে র‌্যাব-৮-এর মাদারীপুর ক্যাম্পের একটি দল মেয়েটিকে উদ্ধার ও নারী পাচারকারী আবদুল আজিজ সরদারকে গ্রেপ্তার করে।
তবে যৌনপল্লির অন্য কাউকে গ্রেপ্তার করেনি র‌্যাব। আজিজ র‌্যাব ও সাংবাদিকদের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার স্ত্রীকে বিক্রি করেছি। তবে সর্দারনি সুরমা আমাকে মাত্র ৭০০ টাকা দিয়েছেন। স্ত্রীকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে ভুল করেছি। কাজটি করা ঠিক হয়নি।’
মাদারীপুর সদর থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, উদ্ধার হওয়া মেয়েটি তাঁর স্বামী আজিজের বিরুদ্ধে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। আজিজকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।