Tuesday, June 19, 2012

টেকনাফ সীমান্তে দেড় বছরে চার হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে পুশব্যাক

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গত দেড় বছরে টেকনাফসহ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা প্রায় ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করে

টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করেছে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর মধ্যে শুধু গত ৮-১৮ জুনের মধ্যে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রাখাইন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান দাঙ্গার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা দলে দলে প্রবেশের সময় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে পুশব্যাক হয়েছে ৮৮৯ জন রোহিঙ্গা।
বিজিবি সূত্র জানায়, বাংলা-দেশ-মিয়ানমার সীমান্তপথে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পুশব্যাক করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৯ রোহিঙ্গাকে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৬৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭৬ জন, মার্চে ৮৩ জন, এপ্রিলে ১৩২ জন, মে’তে ২৫৫ জন, জুনে ১৩১ জন, জুলাইতে ৭৩ জন, আগস্টে ১২৮ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬১ জন, অক্টোবরে ১শ’ জন, নভেম্বরে ২৮৩ জন এবং ডিসেম্বরে ৩০৫ জনকে পুশব্যাক করা হয়েছে।
আর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ২১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪৫ জন, মার্চে ২৭৫ জন, এপ্রিলে ১৮৮ জন, মে মাসে ১৩২ জন এবং জুন মাসের গত ১৮ দিনে ৮৮৯ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, বুধবার থেকে গত যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে নতুনভাবে এসেছে এমন কেউ নেই। তাদের অনেককে আগেও পুশব্যাক করা হয়েছিল।
সূত্র আরও জানায়, নাফ নদী দিয়ে ২৪টি পয়েন্টে অনুপ্রবেশকারীদের ঢোকা সম্ভব। এর মধ্যে নাজিরপাড়াসহ ৬-৭টি পয়েন্ট আছে, যেগুলো দিয়ে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে এসব পয়েন্ট সিল করে দেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
বিজিবির ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক জানান, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদীপথে বিজিবির নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে। ৯টি জলযান রাতভর নাফ নদীতে টহল দিচ্ছে। এছাড়াও গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গা লুকিয়ে আছে কি-না সেটা জানতেও সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে।
বিজিবি সূত্র জানায়, নাফ নদীর উপকূলে মিয়ানমার এলাকায় ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া আছে। বিজিবি কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, এসব কাঁটাতারের চেকপোস্ট পার হয়ে নাফ নদীতে নামার ক্ষেত্রে নাসাকা বাহিনীও এখন রোহিঙ্গাদের বাধা দিচ্ছে। এর ফলে অনুপ্রবেশের চেষ্টকারীর সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসছে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, নাইক্ষ্যংছড়ির মনজয়পাড়া, রেজুপাড়া ও লেমুছড়ি সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। সরেজমিন পরির্দশনকালে শাহপরীর দ্বীপের বেড়িবাঁধ এলাকার প্রায় চার কিমি সড়কে অতিরিক্ত বিজিবিকে টহলে দেখা যায়। স্থানীয় শ্রমিক আলী হোসেন জানান, গভীর রাতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নদীপথে এসে বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিজিবি বেশ কয়েক রোহিঙ্গাকে আটক করে পুশব্যাক করেছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির ১৫ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির মনজয়পাড়া, রেজুপাড়া এবং লেমুছড়ি সীমান্ত ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। এ কারণে এসব সীমান্ত পয়েন্টের বর্ডার অবজারবেশন পোস্টগুলোকে কড়া প্রহরায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সজাগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
৪২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অপারেশন কর্মকর্তা এইচ কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, গত এক সপ্তাহে অনু-প্রবেশের ৭৮৬ জনকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহাবুবুল হক জানান, চলমান রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশও বিভিন্ন এলাকায় টহল জোরদার করেছে।
এদিকে সজেমিন পরির্দশনকালে স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমারে চলমান জাতিগত সহিংসতার কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অবস্থানরত তাদের আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতায় অনেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে।
বাংলাদেশীরা অবৈধ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে সীমান্ত এলাকার অনেক গ্রামে রোহিঙ্গারা লুকিয়ে থাকতে পারে—এমন সম্ভাবনার ভিত্তিতে বিজিবি কয়েকটি গ্রামে তল্লাশি চালিয়েছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার সময় পাঁচটি ট্রলারযোগে মংডু থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে ১০৩ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা (সোমবার বেলা ৩টা পর্যন্ত) পর্যন্ত তাদের পুশব্যাক করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিজিবি ও কোস্টগার্ড।

কক্সবাজার শহরের 'রোহিঙ্গা ডিপো'

মিয়ানমারে চলমান জাতিগত সহিংসতার আগেও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কৌশলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ দেশে। এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে রোহিঙ্গাদের যাতায়াত আছে পর্যটন শহর কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায়।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হচ্ছে শহরের দক্ষিণ পাহাড়তলীর বিশাল পাহাড়ি এলাকা। রোহিঙ্গাদের কারণে উক্ত এলাকায় স্থানীয় লোকজন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে! মাত্র এক দশকের ব্যবধানে দক্ষিণ পাহাড়তলী ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর, বার্মাপাড়া, জিয়ানগর, হালিমাপাড়া, ইসুলুঘোনা, ফাতেরঘোনাসহ বিশাল পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের জাল। এলাকাটি বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ডিপোতে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পর্যটন শহরের নানা অপরাধ।
হালিমাপাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি আবদুশ শুক্কুর (৬৫) জানান, এক দশক আগেও শহরের পাশে দক্ষিণ পাহাড়তলীতে স্থানীয় লোকজনের বসবাস ছিল হাতেগোনা। এখন সেখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গার বসবাস। এমনকি ওই এলাকার পাশেই ইসলামপুর, বার্মা পাড়া, হালিমাপাড়া, জিয়া নগর, ইসুলুঘোনা, ফাতেরঘোনাসহ বেশ কয়েকটি পাড়া গড়ে ওঠে রোহিঙ্গাদের নিয়ে। রোহিঙ্গারা সেখানে পাহাড়ের পর পাহাড় নিধন করে হাজার হাজার ঘর গড়ে তুলেছে।
তিনি আরো জানান, এখানে নিয়মিত রোহিঙ্গারা আসেন। তারা প্রথমে ভাড়া বাসা ও আত্মীয়-স্বজনের বাসায় অবস্থান করেন। সেখান থেকে পাহাড় দখল, কখনো কখনো পাহাড়ের দখল ক্রয় করে বাসা-বাড়ি তৈরি করেন। অনেকে সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন কৌশলে পাসপোর্ট তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়।
হালিমাপাড়া সমাজ কমিটির সহ-সভাপতি মৌলভী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এসব পাড়ায় প্রায় প্রতিদিন ১০/১২ জন করে রোহিঙ্গা আসে। তারা ভাড়া বাসা ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত। তিনি জানান, শহরের পাহাড়ি এসব এলাকায় হাজার হাজার রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে। দিন দিন বাড়ছে রোহিঙ্গাদের বসতি। তারা সরকারি খাস জমি ও বন বিভাগের পাহাড় কেটে তা দখল করে বসবাস করছে। অথচ সেখানে প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকরা বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের কাছে স্থানীয়রা অনেকটা অসহায় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা এলাকায় এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, জরুরি অবস্থার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নে রোহিঙ্গা যাচাই-বাছাই কমিটিতে আমি সদস্য ছিলাম। সেখানে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সমর্থন না দেওয়ায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সামনেই রোহিঙ্গারা আমার ওপর হামলার চেষ্টা চালায়। তিনি আরো বলেন, এসব এলাকায় বর্তমানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জাতীয় পরিচয়পত্র বিহীনভাবে বসবাস করছে। আবার অনেকে টাকার বিনিময়ে ও ভোটের রাজনীতির কারণে কতিপয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছে। এ ধরনেরও শত শত রোহিঙ্গা এলাকায় রয়েছে বলে তিনি জানান।
জিয়ানগর সমাজ কমিটির সভাপতি সোহেল বলেন, এলাকায় ভাসমান রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি। এরা উক্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনো অভিযান না থাকায় তারা এলাকায় এসে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, রোহিঙ্গারা উক্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে খুন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। গ্রুপের সদস্যরা পর্যটন শহরের বিভিন্ন স্পটে অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে এসব এলাকায় এসে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন তাদের কাছে অসহায়।
সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আসা ইসুলুঘোনার নুরুল ইসলাম নিজেকে মিয়ানমারের নাগরিক নয় দাবি করে বলেন, তার প্রকৃত গ্রামের বাড়ি টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায়। তার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার কাছে চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট আছে।' তবে তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কঙ্বাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'কঙ্বাজারের আইনশৃঙ্খলা অবনতির পেছনে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি জড়িত। তারা খুন, ছিনতাই, মাদক পাচার, চুরি, ডাকাতি, জমি দখলসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না। জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলার অধিকাংশ অপরাধের সাথে রোহিঙ্গারা জড়িত বলে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।'
এছাড়া রোহিঙ্গারা গাছকাটা, পাহাড়কাটা থেকে শুরু করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে জড়িত বলে মনে করেন কঙ্বাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।

কক্সবাজার বান্দরবান ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে

আগামীকাল বুধবার বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের সুখ-দুঃখের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য প্রতি বছর ২০ জুন শরণার্থী দিবস পালন করা হয়।

বাংলাদেশে এবার দিবসটি পালন হতে যাচ্ছে এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে। বর্তমানে মিয়ানমারে ফিরে যাবার অপেক্ষায় বাংলাদেশে অবস্থান করছে ২৫ হাজার ৩২৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী। এই ২৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে এদেশে রয়েছে আরো চার লাখ রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গার পরিচিতি 'শরণার্থী' নয়। তারা প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের আরাকান থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজার ও বান্দরবান এমনকি বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা স্থানে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
দুই দশক ধরে ঝুলে আছে এ রোহিঙ্গা সমস্যা। ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর ভোর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার রেজু বিডিআর (বিজিবি) ফাঁড়ি আক্রমণ করেছিল মিয়ানমারের সেনারা। সেই আক্রমণে ২ বিডিআর জওয়ানকে হত্যার পর মিয়ানমারের সেনারা লুঠ করে নিয়েছিল ৩১ টি অস্ত্র। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তদানীন্তন বিএনপি সরকার ও মিয়ানমারের সেনা সরকারের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থানের সৃষ্টি হয়। এমনকি দুই দেশই সীমান্তে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির মুখে পড়ে। পরে মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সরকার ফিরে আসে। সেই সময়কালের চট্টগ্রামের বিতর্কিত বিভাগীয় কমিশনার এবং পরবর্তী সময়ের '১০ ট্রাক অস্ত্রের' আলোচিত ব্যক্তি ওমর ফারুক নাফ নদী তীরে দাঁড়িয়ে 'ওয়া আহলান-ওয়া সাহলান' জানিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। এভাবেই ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারে অবস্থান নেয় ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী। এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর লালন-পালনের অজুহাতে সেই সময়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশন (ইউএনএইচসিআর) সহ আন্তর্জাতিক বহুসংখ্যক এনজিও। তারা এসে নানা কূটকৌশলে ও চাপ দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে শুরু করে। এরিমধ্যে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে বর্তমানে ১১৯৮ পরিবারের ১০ হাজার ৩৫০ জন এবং টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে ১৭৭১ পরিবারের ১৪ হাজার ৯৭৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে ফিরে যাবার অপেক্ষায় রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসি) ও যুগ্ম সচিব ফিরোজ সালাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যাচাই বাছাইয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে গিয়েই প্রত্যাবাসন ঝুলে রয়েছে।'
মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। তবে কক্সবাজারের প্রশাসন এবং রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে এ সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশি। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরসি) অফিস সূত্রে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার এবং টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবির সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। এসব অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা একটি স্থানে জড়ো হয়ে থাকায় তাদের সংখ্যা বলা সহজ হচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে আরো কমপক্ষে ৩ লাখেরও বেশি।
এলাকাবাসীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
প্রায় প্রতিদিনই কক্সবাজার জেলা শহরসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে। এসব সমাবেশে 'আর একজন রোহিঙ্গাও না' বলে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হচ্ছে-এমনিতে চার লাখ রোহিঙ্গা আমাদের কাঁধে ভর করে আছে তার ওপর আবার রোহিঙ্গা আসলে আমাদের বারটা বাজবে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও উখিয়া বঙ্গমাতা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, 'আমরা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে কিছুতেই তাদের আর এখানে জায়গা দিতে পারি না। কেননা আমরা তাদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ। অর্থনৈতিক কারণও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।' কঙ্বাজারের প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক কঙ্বাজার সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, 'রোহিঙ্গাদের কোনো সময়ই আমরা ফিরিয়ে দিইনি। কিন্তু এখন আর আমরা তাদের স্থান দিতে অপারগ। কেননা আমাদের জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। আর সেই তুলনায় জায়গা কমে গেছে। তদুপরি রোহিঙ্গাদের একবার স্থান দিলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমপ্রদায় এবং এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গীরা তাদের নিযে ফায়দা লুটে নেয়।'
কঙ্বাজার আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'সেই ১৯৭৮ সালেও আমরা তিন লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু দিন এখন পাল্টে গেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এখন রাজনীতি ও ব্যবসা শুরু হয়েছে।'

‘রোহিঙ্গা প্রতিহতে’র ডাক সুজন’র

‘দেশপ্রেমিক জনগণে’র প্রতি ‘রোহিঙ্গাদের প্রতিহত’ করার আহ্বান জানিয়ে কক্সবাজারে মানববন্ধন করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে রোববার সকালে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে বক্তারা বলতে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের স্থানীয়রা অস্থিত্বের সংকটে পড়েছেন। তারা রোহিঙ্গাদের প্রতিহত করতে ‘দেশপ্রেমিক জনগণ’কে এগিয়ে আসার আহবান জানান। এছাড়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও কক্সবাজারে অবস্থানকারি রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোরও দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধনে বক্তৃতা করেন দৈনিক কক্সবাজার সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান, অধ্যাপক এম. এ. বারী, সাংবাদিক তোফায়েল আহমদ ও সুজন সম্পাদক মাহবুবুর রহমান।

রোহিঙ্গা হত্যার ৭ প্রতিবাদকারী কক্সবাজারে গ্রেফতার

মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের দাবিতে কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলনকারী ইসলামী ঐক্যজোট ও নেজামে ইসলাম পার্টির সাত নেতা-কর্মিকে সোমবার আটক করেছে পুলিশ।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আছেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মুফতী এনাম, মাওলানা আবদুল হক ও মাওলানা আবছার।

দুপুরে শহরের লালদীঘির পাড়ের পালংকী নামের একটি হোটেলে তারা ‘রাখাইন কর্তৃক মুসলমান রোহিঙ্গাদের নির্যাতন বন্ধের দাবি’ জানাতে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। এই সংবাদ সম্মেলন শেষে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার পরই তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশ দাবি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে। তবে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছেন, তারা রাষ্ট্র বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কোনো চেষ্টা করেনি। আরকানে মুসলিম নির্যাতন বন্ধে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন।

কক্সবাজারে আগ্নেয়াস্ত্রসহ কিশোর আটক

কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকা থেকে দেশীয় ২টি এলজি বন্দুকসহ মোহাম্মদ রুবেল (১৬) নামের এক কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ।

সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফিরোজ আহমদ ও মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে তাকে আটক করা হয়।

রুবেল কুমিল্লা জেলার মাছিম পুল এলাকার মনির হোসেনের ছেলে।

কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক (ওসি) কামরুল হাসান বাংলানিউজকে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ এ অভিযান চালায়। এ ব্যাপারে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছে।

পুলিশি হেফাজতে থাকা রুবেল বাংলানিউজকে জানায়, শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার কানা ভূট্টো নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে সে দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকে।  সে মহেশখালী-কক্সবাজার নৌ পথে স্পিড বোট চালায়।

মহেশখালীর আলী নামের এক ব্যক্তি এ অস্ত্রগুলো তাকে কক্সবাজার আনার জন্য দেন। বিনিময়ে তাকে পাঁচশ’ টাকা দিতে চেয়েছেন। কক্সবাজার থেকে এসে দু’ব্যক্তির এসব অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। তার আগেই পুলিশ তাকে আটক
করেছে।