Wednesday, September 21, 2011

অর্থনীতি সামাল দিতে পারছে না সরকার by শওকত হোসেন ও মনজুর আহমেদ

হা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না সরকার। বরং দাতাদের শর্ত মেনে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এতে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৈরি চাপ কিছু কমলেও সংকট বাড়বে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতির চাপ আরেক দফা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির একটি দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ। শিগগির এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকেই যাবে।
সম্পদ কোথা থেকে আসবে, তা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, কম দামে সেচসুবিধা ও সার প্রদান, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বাঁচাতে কম মূল্যে চাল বিতরণ এবং বর্তমান মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। এতে ব্যয় বেড়েছে অনেক। কিন্তু এখন ব্যয় ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না সরকার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতেই মূলত সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দিয়েই ওই রাতেই অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ১৪ সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোসহ কয়েক দফা সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন সরকারকে দিয়েছে। আর সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর।
এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ আবারও মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ মনে করে, এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে। তবে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে না চাহিদা বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তা আর এভাবে পৃথক করা যাবে না। কেননা, একটা পর্যায়ে উঠে গেলে এটা আর আলাদা করা যায় না। ফলে আমরা একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি বলা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী অর্ধবার্ষিক ভিত্তিতে বাজেট পর্যালোচনার কথা বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় পর্যালোচনার সময়টা আরও একটু এগিয়ে এনে ব্যয় সাশ্রয়ের সময় এসেছে।’
অর্থবছরের শুরুতেই সংকট: নতুন অর্থবছরের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন খাতে দেওয়া ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ে তৈরি হচ্ছিল ভারসাম্যহীনতা। রাজস্ব আদায় এবং রপ্তানি আয় বাড়লেও সে তুলনায় সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বেশি। এতে এক দিকে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়াও বেড়েছে। সব মিলিয়ে চাপের মধ্যে আছে সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলাম যে, সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝামেলা আছে। কিন্তু সরকার এটা আমলে নেয়নি। উপরন্তু অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে নিয়েছে। এতে একটা লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে।’
রাজস্ব আয়ের চেষ্টায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে সম্পদের জোগান পেতে ঋণ করার বিকল্প নেই। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ আগের অর্থবছরেই ৩০ শতাংশ কম হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ করার আগেই দুর্নীতির অভিযোগসহ টানাপোড়েনের কারণে এবারও পর্যাপ্ত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। ফলে ভরসা এখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের ঋণ ততটা সফল হয়নি। ফলে সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। সরকার বেশি ঋণ করায় বেসরকারি খাতের ঋণের জোগান কমে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা উঠলেই সরকার খালি বলে প্রবৃদ্ধি তো ভালো হচ্ছে। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধি একটা উপাদান মাত্র। আর এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হবে। এ জন্য পরিকল্পনা করে বছর ভিত্তিতে অর্জন ধরে রাখতে হবে। ঋণের টাকায় এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কতটা সম্ভব, তা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।’
শুরুতেই ব্যাংকঋণ: বড় অঙ্কের ধার দিয়েই বছরটি শুরু হয়েছে সরকারের। সূত্র জানায়, গত ২১ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করেছে পাঁচ হাজার ২২৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে দুই হাজার ৮৬৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে তুলে দিয়েছে দুই হাজার ৩৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
বলা হয়, তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে আসে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করলে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে তা তুলে নিতে না পারে তবে বাজারে নতুন টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়। আর এতে বাড়ে দ্রব্যমূল্য, চাপ বাড়ে মূল্যস্ফীতিতে।
২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ করেছিল প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা একটি নতুন রেকর্ড। এই ঋণের প্রায় অর্ধেকটা নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছেপে সরকারের এই চাহিদা মিটিয়েছে।
সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি: নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবমতে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত ৪৩ মাসের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সময়ে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি।
দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির চাপ রয়ে গেছে। সরকারও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ব্যর্থ হয়ে মূল্যস্ফীতিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, এর ক্ষতিকারক দিকও আছে। ব্যবসায়ীরা যখন বুঝে নেবেন যে বছর বছর এটা চলবে, তখন তাঁরা তাঁদের পণ্যমূল্যের মধ্যে আগেভাগেই নতুন মূল্যস্ফীতিকে হিসাব করে নেবেন। এতে মূল্য পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
এদিকে, ভর্তুকি সমন্বয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাবে আরেক দফা বাড়বে মূল্যস্ফীতি। মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই ভোক্তা মূল্যসূচকে গিয়ে যুক্ত হচ্ছে। আবার এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে চাপ আরও বাড়াবে।
এম এ তসলিম বলেন, ‘এই অবস্থা কারও জন্যই ভালো হবে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে রাজনৈতিক বিবেচনা উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত হাতে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা করে মূল্যস্তরকে সামাল দিতে পারবে, আমি তা মনে করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ আমি দেখছি না। ফলে আগামী দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকেই যাবে।’
লেনদেনের ভারসাম্যেও চাপ: চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে ৯০ কোটি ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমা শুরু হয়েছে। বর্তমান মজুদ দিয়ে মাত্র দুই মাসের কিছুদিন বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এবার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ এবং আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কাছাকাছি হলে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবেই। এর মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য ও প্রবাসী-আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন না। এ রকম বাস্তবতায় বিনিময় হারও বাড়বে। এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের গড় বিনিময়মূল্য ছিল ৬৯ টাকা ৫৮ পয়সা। আর এখন তা ৭৪ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ এবারও বেশি দাম দিয়েই পণ্য আমদানি করতে হবে। আর এর চাপ পড়বে আবারও মূল্যস্ফীতিতে।

সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল নিয়ে গুঞ্জন

ড়াই লাখ মার্কিন তারবার্তা ফাঁস করেছে উইকিলিকস। মার্কিন কূটনীতিকদের ভাষ্যে এসব তারবার্তায় বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার অন্দরমহলের খবর।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি ঘাটতি এবং বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘ব্যর্থতার’ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের প্রথম থেকেই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণের কথা তখন বলা হচ্ছিল। কারাবন্দী দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা-ও পরিষ্কার নয়। এ অবস্থায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, রাজনৈতিক কাঠামোয় একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেনানিবাসে।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি ওই সময় ওয়াশিংটনকে এসব কথা জানান। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভুল পদক্ষেপের কারণে আরেকটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তবে ওই অবস্থায় সেনাবাহিনী কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারে বলে তাঁর মনে হয়নি। ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট গীতা পাসির পাঠানো ওই তারবার্তা গত ৩০ আগস্ট উইকিলিকসের ফাঁস করা বার্তাগুলোর একটি।
তারবার্তায় বলা হয়, ওই গুঞ্জন নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহানের সঙ্গে কথা বলেন দূতাবাসের কর্মকর্তা। তাঁদের মত ছিল, সেনাবাহিনীর সক্রিয় হওয়ার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দেওয়া। এ প্রসঙ্গে ফারুক সোবহান বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অনেক মামলা বিচারাধীন।
তারবার্তার ভাষ্য অনুযায়ী, ফারুক সোবহান বলেন, সেনাপ্রধানের চারপাশে ঘিরে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আতাউর রহমানের মতো স্বনিয়োজিত কিছু উপদেষ্টা। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার জন্য সেনাপ্রধানকে উৎসাহিত করছেন। সব মিলিয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছেন, যেখানে মনে হবে কেবল সেনাপ্রধানই দেশকে ‘রক্ষা’ করতে পারেন।
তবে ফারুক সোবহান স্বীকার করেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি ঘাটতি, বন্যাসহ অনেক সমস্যাই মোকাবিলা করতে হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। প্রধান উপদেষ্টার চেয়ে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের অধিকতর সক্রিয়তা নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছিল, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, সেনাপ্রধানই সরকারের মূল দায়িত্বে—এ ধারণা যে সত্যি নয়, তা বোঝানোর জন্য গণমাধ্যমে আরও বেশি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তারবার্তায় বলা হয়, এ বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ টি এম মো. আমিনের সঙ্গেও কথা বললে তাঁর সোজাসাপ্টা প্রশ্ন, ‘দেশের সব সমস্যার বোঝা কেন আমাদের ঘাড়ে নিতে যাব?’ তাঁর মতে, সেনাবাহিনী এখন যে কাজ করছে তার জন্য তারা একদিন বীর হিসেবে বিবেচিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সেনাবাহিনীও ২০০৮ সালের শেষ নাগাদ নির্বাচন দেখতে চায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক সোবহান প্রথম আলোর কাছে তারবার্তার বক্তব্য অস্বীকার করে বলেন, ‘তাদের সঙ্গে অবশ্যই কথা হয়েছে। কিন্তু এখানে আমাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।’

বিএনপিকে পাশে পেয়েই জামায়াত বেপরোয়া by আবদুল্লাহ আল ফারুক

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাসমৃদ্ধ জামায়াতে ইসলামী বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শুরু থেকেই কোণঠাসা ছিল। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া, অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ধরপাকড়ে দিন দিন অসহায় হয়ে পড়ছিল দলটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিরোধের সামনে তারা দাঁড়াতেই পারছিল না আন্দোলনের মাঠে।

কিন্তু হঠাৎ করেই গত সোমবার জামায়াত রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। পুলিশের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। তাদের গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ সেদিন কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত-শিবিরের 'যৌথ বাহিনীর' কাছে। বিএনপিকে পাশে পেয়েই জামায়াত এই শক্তি ও সাহস পেয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে জামায়াতকে একমঞ্চে নিয়ে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটি কার্যকর হবে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে। আর সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়েই জামায়াত শক্তি প্রদর্শনে নেমেছিল। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতকে নিয়ে একমঞ্চে আন্দোলনের পক্ষে নন_এমন বিএনপি নেতারা বলছিলেন, 'জামায়াতের সেই শক্তি নেই। তারা নিজেরাই আন্দোলন করতে পারছে না। অসহায় হয়ে বিএনপিকে পাশে চাইচ্ছে'_এই অভিযোগ পাওয়ার পর জামায়াত গত সোমবার শোডাউন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করল, তাদের আন্দোলন করার মতো শক্তি ও সাহস আছে। তারা হারিয়ে যায়নি। জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি আবদুল হালিম বলেন, কেউ কেউ বলছিলেন, জামায়াত শক্তি-সাহস হারিয়ে ফেলেছে। সোমবার জামায়াত প্রমাণ করেছে, তারা শক্তি হারায়নি।
বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত বেপরোয়া হওয়ার মতো শক্তি ও সাহস পেয়েছে_এ কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও বিএনপি নেতারা অস্বীকারও করছেন না। তাঁরা বলছেন, বিষয়টি জামায়াত নেতাদেরই জিজ্ঞেস করুন। জামায়াত নেতারা বলছেন, বিএনপিকে পাশে পাওয়ার কারণে নয়, জামায়াত যে শক্তি ও সাহস রাখে, সেটিই তারা দেখিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, জামায়াতের যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, সোমবারের ঘটনায় সেটা প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব ঘুচে গেছে গত ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। ওই দিন রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জামায়াতকে একমঞ্চে নিয়ে তারা কর্মসূচি পালন করবে। ২৭ সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশে একমঞ্চে থাকবেন জামায়াতসহ শরিক নেতারা। জামায়াতের আমির থাকবেন মহাসমাবেশে বিশেষ অতিথি। সেখান থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই গত সোমবার জামায়াতের প্রথম শোডাউন হলো রাজধানীর পল্টন, বিজয়নগর ও কাকরাইল এলাকায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশেই। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আপাতত একমঞ্চে আন্দোলন করবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্য ড. খন্দকার মেশাররফ হোসেন, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও নজরুল ইসলাম খান ওই রিপোর্টে স্বীকার করেছিলেন যে জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেই বিএনপির। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি কারণে বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কারণগুলো হচ্ছে_বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রভাব খাটিয়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধার করেছে জামায়াত। অথচ তারা এমন আচরণ করেছে যে দুর্নীতির অভিযোগ শুধু বিএনপির বিরুদ্ধে, তাদের বিরুদ্ধে নয়। ওয়ান-ইলেভেনের পরও তাদের আচরণ বিএনপি ভালোভাবে নিতে পারেনি। বিশেষ করে ওই সময় জামায়াত বিএনপিকে এড়িয়ে চলেছে এবং ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছে। জামায়াত বিএনপিকে ব্যবহার করে এবং টপকে বড় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টাও করেছে বলে তাঁরা মনে করেন। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে যে, জামায়াত ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমর্থিত ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপিসহ কিংস পার্টিগুলোকে সমর্থন জানিয়েছিল। এ ছাড়া বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার কারণেও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছিল।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই জামায়াত বিএনপিকে পাশে টানার চেষ্টা করছিল। বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল, শুধু নির্বাচনী জোট, একমঞ্চে আন্দোলন নয় জামায়াতের সঙ্গে। কিন্তু বিএনপি এককভাবে আন্দোলন জমাতে পারছিল না। সরকারপক্ষের হামলা-মামলারও শিকার হচ্ছিলেন নেতারা। এ অবস্থায় তাদের একটি শক্তিশালী সহযোগী প্রয়োজন বলে ভাবা হচ্ছিল। সে জন্যই ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে দূরত্বটুকু দূর করা হয়।
তবে সোমবার জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের পরদিন বিএনপির হরতাল ডাকার বিষয়টি একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন অনেকে। সোমবার রাতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে হরতালের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গটিও আলোচনা করা হয় বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কি না_এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা তাদেরই জিজ্ঞেস করুন। তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সোমবার রাতে যোগাযোগ হয়েছে আন্দোলনের ব্যাপারে, বিশেষ করে ২৭ সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশ নিয়ে। জামায়াতের ওপর পুলিশি হামলা বা গ্রেপ্তারের সঙ্গে হরতালের কোনো সম্পর্ক নেই। জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও একতরফাভাবে জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়েছে। এই হরতাল জনগণের দাবি আদায়ের হরতাল। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এবারের হরতাল একেবারেই জনস্বার্থে ডাকা হয়েছে। জামায়াতের ওপর পুলিশি হামলার জন্য এই হরতাল ডাকা হয়নি। বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত বেপরোয়া হয়ে উঠল কি না জানতে চাইলে তিনিও বলেন, 'এটা আমি জানি না। জামায়াত নেতাদের জিজ্ঞেস করুন।'
জামায়াত দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। হঠাৎ করে সোমবার কেন পুলিশের সঙ্গে এত বড় সংঘর্ষে জড়াল, এর পেছনে রহস্য কী_ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহকারী প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিএনপির সঙ্গে যৌথ কর্মসূচির কারণে শক্তি প্রদর্শন করা হয়নি। ২৭ সেপ্টেম্বরের মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণার আগেই কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দুদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। মূলত সে কারণেই জামায়াত সোমবার মাঠে নেমেছিল, শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত দুটি রাজনৈতিক দলই ধ্বংসাত্মক শক্তি। এরা স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। 'তাদের তাণ্ডব পরিকল্পিত' মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা শক্ত হাতে দমন করতে হবে। গত সোমবার রাজধানীতে যে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত, তাতে এটা স্পষ্ট হলো, এ চক্রটির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে মাত্র। তিনি বলেন, লক্ষ করবেন, বিএনপির হরতাল কর্মসূচিতে জামায়াতের দাবি-দাওয়াগুলোর উল্লেখ রয়েছে।