Saturday, September 10, 2011

কিডনি লিভার ব্যবসায় ৫৮ চক্র by পারভেজ খান

রাজধানী ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ৫৮টি অপরাধী চক্র রয়েছে যাদের ব্যবসাই হচ্ছে কিডনি ও লিভার বেচাকেনা। গ্রামের সহজ-সরল দরিদ্র মানুষই তাদের মূল শিকার। দারিদ্র্যের সুযোগে এসব সরলমনা মানুষকে তারা নানা প্রলোভনে আকৃষ্ট করে লিভার ও কিডনি কিনে নেয়। তারা ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। এ চক্রকে নানাভাবে সহায়তা করছে দেশের কয়েকটি শীর্ষ পর্যায়ের বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর মাঠ পর্যায়ের কর্মী আর সুদ ব্যবসায়ীরা। সহায়তা করছেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কিছু অসৎ চিকিৎসক আর ক্লিনিক ব্যবসায়ীও। খোদ ঢাকাতেই রয়েছে এ রকম আটটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আর তিনটি সংঘবদ্ধ চক্র।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া জয়পুরহাটের একটি চক্রের নেতা তারেক ওরফে বাবুল, জয়পুরহাটে গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল, সাত্তার, মোস্তফা, ফোরকানসহ র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের গোয়েন্দা ইউনিট এ ব্যাপারে সারা দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। ইতিমধ্যে তারা এ চক্রের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযানও শুরু করেছে।
গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয় গ্রেপ্তার করা কিডনিচক্রের নেতা তারেক ওরফে বাবুলকে। বাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে শতাধিক কিডনি ও লিভার বেচাকেনা করেছে গত আট বছরে। অনেকের কিডনি প্রতিস্থাপন হয় দেশের বাইরেও।
বাবুল সাংবাদিকদের জানায়, সে উচ্চ শিক্ষিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে সে। টানা ছয় বছর এ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও দুই বছর ধরে সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন গার্মেন্টের টুকরা কাপড়ের ব্যবসা করছে। চক্র পরিচালনাকালে সে ৩৫ থেকে ৪০টি কিডনি বেচাকেনা করেছে। মূলত তার কাজ হচ্ছে ক্রেতা আর বিক্রেতা জোগাড় করে তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে দেওয়া। কারো কিডনি নেওয়া হলে তাকে দেওয়া হয় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। আর ক্রেতার কাছ থেকে সে যেটা পায় তা থেকে বিভিন্ন খরচাদি বাদে তার ৩০-৪০ হাজার টাকা থাকে। বাবুল আরো জানায়, প্রথমে মানুষের সহায়তার জন্য সম্পূর্ণ মানবিক ও সেবামূলক কাজ ভেবেই
সে এতে জড়িয়ে পড়ে। এতে করে একজন দরিদ্র ব্যক্তিও টাকা পেয়ে সেটা দিয়ে জীবন চালানোর জন্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আবার কিডনির কারণে যে ব্যক্তিটি মারা যেতে বসেছিল, সেও আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। এসব ভেবেই সে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাকে সহায়তা করেছে গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাকসহ স্থানীয় কয়েকটি এনজিওর কর্মীরাও। ঢাকায়ও তাদের তিনটি চক্র আছে। আছে সরকারি-বেসরকারি আটটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এ ব্যবসা শুরুর পর একপর্যায়ে ভালো আয় হওয়ার কারণে সে পেশা হিসেবেই এটাকে বেছে নেয়। পরে যখন বুঝতে পারে, এটা অপরাধ এবং তার মতো শিক্ষিত একজনের এ কাজ করা উচিত হচ্ছে না, তখনই সে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে।
বাবুলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সে বেশ কয়েকটি এনজিও ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের নাম বলেছে। হাসপাতাল বা ক্লিনিকের চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো খোঁজখবর নিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁরা কি জেনেশুনে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এগুলো করেছেন, নাকি শুধু একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁরা তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন, সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর অদূরে সাভারের কয়েকটি ক্লিনিক ও হাসপাতাল সম্পর্কেও তাঁদের কাছে এ ধরনের খবর আছে। বিশেষ করে একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে, যেটার মালিক নিজেও একজন চিকিৎসক এবং তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এ চিকিৎসক নানাভাবে বিতর্কিত এবং এর আগেও একাধিকবার সংবাদ শিরোনাম হয়ে এসেছেন। তাঁর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
গতকাল এই প্রতিবেদকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় জয়পুরহাটের দুজন কিডনি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। দুজনই তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলে, তারা দুই বছর হলো এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ, শিবগঞ্জ ও কালাই সীমান্ত এলাকায়ই এ চক্রের তৎপরতা বেশি। ঘটনাক্রমে এ চক্রের সঙ্গে স্থানীয় কয়েকটি এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীরাও জড়িয়ে পড়েছে।
দুই চক্র সদস্য জানায়, সীমান্ত এলাকার মানুষের একটি বড় অংশই অতিদরিদ্র। তাদের মূল ব্যবসা চোরাচালানের পণ্য বহন করা। দুই দেশের পুলিশ, সীমান্তরক্ষীদের দিয়ে তাদের যা থাকে তাতে সংসার চালানো কঠিন। আবার মাঝেমধ্যে মালামাল ধরা পড়লে তারা আরো বিপদে পড়ে। আর এ অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় দাদন বা সুদ ব্যবসায়ী আর এনজিওকর্মীরা ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর নাম করে টাকা ধার দেয়। এ টাকা পরে পরিশোধ করতে না পেরে তারা পড়ে যায় চাপের মুখে। পালিয়ে বেড়াতে থাকে কেউ কেউ। আর এই অবস্থায়ই এনজিওর কর্মী আর সুদ ব্যবসায়ীর দালালরা নানান প্রলোভন দেখিয়ে পরামর্শ দেয় কিডনি আর লিভার বিক্রির। ঋণ শোধের আর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আর লাখ লাখ টাকার প্রলোভনে সেসব সরল মানুষই কিডনি ও লিভার বিক্রি করে দেয়। যেসব ক্রেতার আর্থিক সামর্থ্য বেশি তারা বিক্রেতাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ভারতসহ দেশের বাইরে বিভিন্ন উন্নত দেশেও নিয়ে যায়। তবে এ চক্রের কিছু সদস্য আছে যারা কিডনি বা লিভারদাতাকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেয় না। প্রলোভনে পড়ে কিডনি বা লিভার দেওয়ার পর তারা প্রতারিতও হয়।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জয়পুরহাটের কালাই ব্র্যাক অফিসের শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মাত্রাই ও উদয়পুর ইউনিয়নের কিডনি বিক্রেতাদের মধ্যে আটজন তাঁদের সদস্য ছিল। কিন্তু ঋণখেলাপির কারণে তারা সদস্য থেকে বাদ পড়ে। কাজেই এনজিওর প্ররোচনার কারণে তারা কিডনি বিক্রি করছে_এমন কথা ঠিক নয়।
কালাই ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বলেন, 'এনজিওগুলোর কারণে নয়, বলতে পারেন গ্রাম্য মহাজন বা দাদন ব্যবসায়ীদের কারণেই ঋণগ্রস্তরা কখনো বাড়ি বিক্রি করে, কখনো বা পলাতক থাকে। দালালদের খপ্পরে পড়ে কিডনি বেচাকেনার এ অবৈধ অপকর্ম ঢাকতে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।'
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং বিএমএর সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট শল্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, যে ব্যক্তি লিভার বা কিডনি দেয়, পারতপক্ষে তার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। লিভার নেওয়া হয় আংশিক। এতে ওই ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করতে পারে। সব কিছু আগাম পরীক্ষা করেই এ প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে এ দেশে যা ঘটছে, তা ভিন্ন। লিভার বা কিডনি বিক্রির শিকার হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণী। সমস্যাটা হচ্ছে, এরা সচেতন নন এবং চিকিৎসা নেওয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতাও তাদের থাকত না। এ ধরনের একটি অঙ্গ বা অঙ্গের অংশ দান করার পর বা কাউকে দেওয়ার পর তার যে সেবা বা চিকিৎসা দরকার, সে ব্যাপারে তারা কতটা সচেতন, কতটা সচ্ছল আর কতটুকু করবে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে এর হেরফের হলে তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।

কিডনি ব্যবসায় ঢাকার নামি হাসপাতাল

খোদ রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালগুলো জড়িয়ে পড়েছে অবৈধ কিডনি ব্যবসায়। দালালরা প্রথমে কিডনিদাতাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। এরপর কিডনি গ্রহীতার তথ্য দালাল চক্রের হাতে তুলে দেন চিকিৎসকরা। বিনিময়ে কিডনিদাতাকে দেওয়া হয় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, কিডনিসহ দেহের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোপনে চুরি করে মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে এ চক্র।

অর্থের লোভ দেখিয়ে গ্রামের অভাবী মানুষকে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করছে দালালরা। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার দুটি গ্রামের বেশ কিছু লোক কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত। কিডনি কেনাবেচা চক্রের প্রধান তারেক আজিম ওরফে বাবুল চৌধুরী দেশের কিডনি ব্যবসার এমন ভয়ঙ্কর তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলে তিনি এসব তথ্য জানান। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে তারেককে গ্রেফতার করে পুলিশ। অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, রাজধানীর এমন পাঁচ-ছয়টি হাসপাতালের নামও জানান তারেক। তবে এসব হাসপাতালের জড়িত চিকিৎসকদের নাম বলতে রাজি হননি তিনি। তারেক আজিজের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলো। রাতেই পুলিশ কয়েকটি ক্লিনিকে অভিযান চালায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পরপরই পুলিশের কাছে তারেক পান্থপথের 'কলম্বো এশিয়া হেলথ কেয়ার' ও বনানীর 'ট্রেট ওয়ার্থ' নামে দুই ক্লিনিকের
নাম প্রকাশ করেন, যারা এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। রাতেই ডিবি তারেককে সঙ্গে নিয়ে ওই দুই ক্লিনিকে অভিযান চালায়। তবে কাউকে আটক করতে পারেনি। তারেক বলেন, এদেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষের কাছে আমি কিডনি বিক্রি করেছি। ঢাকার নামকরা হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ কিডনি বেচাকেনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে কিডনি বেচাকেনা যে অপরাধ তা এতদিন জানতাম না।
যেভাবে কিডনি বেচাকেনা হয় : তারেক এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, তিনি ২০০৬ সাল থেকে কিডনি বেচাকেনা করে আসছেন। এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি কিডনি বিক্রি করেছেন। প্রতিটি কিডনি বিক্রিতে তিনি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পান। আর কিডনিদাতা পান দেড় লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। তারেক জানান, তিনি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি প্রয়োজন_ এমন লোকের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। মূলত চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি গ্রহীতার নাম ও ঠিকানা পাওয়া যায় বলে কিডনি কেনাবেচার টাকার ভাগ দিতে হয় তাদেরও। নাম-ঠিকানা পাওয়ার পর তাদের সঙ্গে চুক্তি করে জয়পুরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনিদাতাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। পরে তাদের কিডনি বিক্রিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে ঢাকায় নেওয়া হয়। তারেক সাংবাদিকদের জানান, এভাবে তিনি এ পর্যন্ত সাবেক ডিআইজি আফসার চৌধুরীর স্ত্রী, সাবেক ডিআইজি নুরুল আলম ও গাজীপুরের সাবেক এক সাংসদের স্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কিডনি সরবরাহ করেছেন। এটা তার কাছে মানবিক কাজ হিসেবেই মনে হয়েছে বলে জানান তারেক। এ ছাড়া রাজধানীর 'মুমূর্ষু রোগীর জন্য কিডনি চাই' বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কিডনি সংগ্রহ করতেন তিনি। রাজধানীর বারডেম ও বিএসএমএমইউর দেয়ালে তারেকের মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। কিডনি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
যেসব হাসপাতালে কিডনির অবৈধ প্রতিস্থাপন : তারেকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর বারডেম হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড হাসপাতাল, কলম্বো এশিয়া হেলথ কেয়ার ও ট্রেট ওয়ার্থ ক্লিনিকসহ বেশ ক'টি বেসরকারি ক্লিনিকে তিনি কিডনি সরবরাহ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করে থাকেন। তারেক বলেন, তিনি কিডনিদাতা সংগ্রহ করে শুধু ঢাকায় নয়, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালেও পাঠিয়েছেন। এ জন্য রাজধানীর পান্থপথের এক ব্যবসায়ী ও বেশ ক'জন চিকিৎসক তাকে সহযোগিতা করেন।
তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ : ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারেক জানান, ঝামেলা এড়াতে কিডনিদাতাকে তারা স্বজন পরিচয় দিতেন। পরে মিথ্যা হলফনামা করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে কিডনিদাতা বা গ্রহীতা কিছুই জানতে পারেন না। সবকিছুই দালাল ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ডিবির সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তারেক কিডনি বেচাকেনায় রাজধানীর কয়েকটি বড় হাসপাতালের নাম বলেছেন। তবে এর সঙ্গে জড়িতদের নাম বলেননি। তার দেওয়া প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর দুটি ক্লিনিকে অভিযান চালানো হয়। কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও দালালদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে অভিযান চালানো হবে।
ডিবির সংবাদ সম্মেলন :সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মনিরুজ্জামান জানান, রাজধানীতে কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত তিনটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন তারা। প্রতিটি গ্রুপে সাত-আটজন করে সদস্য রয়েছে। তিনি বলেন, দরিদ্র লোকজনকে নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে এ চক্রটি। তবে এসব দালাল কিডনিদাতাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বেশির ভাগ টাকাই মেরে দেয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জয়পুরহাটের কালাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফজলুল করিম। তিনি সাংবাদিকদের জানান, বেশ কিছুদিন আগে স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, ৫০-৬০ জন লোক কিডনি দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছেন। খবরটি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় কালাই উপজেলার দুটি ইউনিয়নে ৩৮ কিডনি বিক্রেতার নাম-পরিচয় সংগ্রহ করেন। যারা ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারছেন না। প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধসহ তাদের শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
যেভাবে গোয়েন্দা জালে তারেক : ডিবি পুলিশ মূলহোতা তারেকের সহযোগী সাইফুল ইসলাম দাউদকে বাগেরহাটের মোল্লাহাট থেকে গ্রেফতার করে। সাইফুল বুধবার জয়পুরহাট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কিডনি বেচাকেনার কথা স্বীকার করে মূলহোতা হিসেবে তারেকের নাম জানায়। এর আগে ২৮ আগস্ট কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের আবদুস ছাত্তার, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম ওরফে ফোরকানকে এবং ৩ সেপ্টেম্বর মোশাররফ হোসেন নামে এক দালালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় তারেককে।
পুলিশ জানায়, তারেকের আসল নাম বাবুল চৌধুরী। তার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের ছোট হোসেনপুর গ্রামে। তারেক নিজেকে কখনও তারেক হোসেন আবার কখনও তারেক আজিম বা বাবুল চৌধুরী পরিচয় দিতেন। ঢাকার কয়েকটি ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিপুল অঙ্কের টাকা এবং শ্যামলী ও মিরপুরে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পারে।
আইনে যা রয়েছে : মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯-এর ৯ ধারায় বলা হয়েছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুস্থ স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি অন্যের দেহে সংযোজনযোগ্য কিডনি, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, চর্ম, টিস্যুসহ ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময়ে কোনো সুবিধা লাভ, সেই উদ্দেশ্যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রদান বা প্রচার চালাকে পারবে না। একই আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। আইনে বলা হয়েছে, আত্মীয়র মিথ্যা পরিচয়ে কেউ কিডনি বিক্রি করলে দাতা ছাড়াও ক্রেতা, সহায়তাকারী দালাল ও কিডনি সংযোজনে জড়িত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
দালাল চক্র : কিডনি ব্যবসার মূলহোতা তারেক হোসেন। তার সহযোগী ও দালাল চক্রের সদস্যরা হলো_ সাইফুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, আখতার আলম, জাহান আলম, আবদুল ওহাব, ফারুক হোসেন, রেজাউল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, সৈয়দ আলী, মোকাররম হোসেন, রুহুল আমিন, আবদুল মান্নান ও মোজাম।
আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, বাবুল চৌধুরীকে ঢাকায় গ্রেফতারের পর গতকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জয়পুরহাটে নেওয়া হয়েছে। জেলার কালাই থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তারেক আজিম।
এদিকে এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া কিডনি পাচার চক্রের দালাল সাইফুল ইসলাম দাউদ বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলমের আদালতে কিডনি পাচারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর গতকাল গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামি আবদুস সাত্তার কিডনি কেনাবেচার সঙ্গে নিজে জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে উভয়েই বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩০ থেকে ৪০টি কিডনি পাচারে সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এদিকে কিডনি পাচারকারী দালাল চক্রের প্রধান রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ অনুযায়ী, নিকটাত্মীয়ের বাইরে অন্য কারও মধ্যে কিডনি আদান-প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, কিডনিদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সপক্ষে গ্রহণযোগ্য তথ্য-প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরই অস্ত্রোপচার করা হয়।
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক মেজর (অব.) ডা. মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সপক্ষে কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কি-না তা যাচাইয়ের পরই অপারেশন শুরু হয়। কাগজপত্র যাচাইয়ে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড রয়েছে। তিনি বলেন, দালালের খপ্পরসহ অন্যান্য অপকর্ম বন্ধ হোক_ সেটি আমরা চাই। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার মারপ্যাঁচে প্রতিস্থাপন চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হলে কিডনি বিকল রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বারডেম হাসপাতাল থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৫ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরুর পর ৮৯টি সফল প্রতিস্থাপন হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রণীত আইন মেনে প্রতিস্থাপন হয় এবং দাতা-গ্রহীতা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের দলিলপত্র যথাযথভাবে পরীক্ষা এবং হাসপাতালে সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় দালাল বা তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞপ্তিতে এ অপকর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের আইনানুগ শাস্তির দাবি জানানো হয়।
কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশিদ সমকালকে বলেন, বাবা-মা, ভাই-বোনের বাইরে কেউ দাতা হলে সেগুলো যাচাই করার চেষ্টা চালানো হয়। এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনা অঙ্গীকারনামা দেখে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিই আমরা। কিন্তু এর মধ্যে যে এত ভুতুড়ে ব্যাপার লুকিয়ে রয়েছে, তা গণমাধ্যমে প্রকাশের আগে জানা ছিল না। দালাল চক্রের মূলহোতা ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দেন। সমকালকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। দালাল চক্রের অপকর্মের সঙ্গে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা মোটেই জড়িত নন। নিয়ম মেনেই কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অপকর্মকারীদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

তারেকের ফোনে জঙ্গির মুক্তি, জামায়াতের বিপক্ষে বিএনপির ৫০ এমপি

ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশকে (জেএমবি) সহযোগিতা করেছেন। এমনকি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান টেলিফোন করে জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের ডানহাত বলে পরিচিত কামারুলকে (মাহাতাব খামারু) ছাড়িয়ে নিয়েছেন।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ত্যাগ করে অনেক নেতা-কর্মী জেএমবিতে যোগ দিয়েছিলেন। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের বিতর্কিত অবস্থানের কারণে তাদের চারদলীয় জোটে রাখা নিয়ে জোটের ভেতরেই অসন্তোষ ছিল। খোদ বিএনপির অর্ধশত সংসদ সদস্য জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
২০০৫ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকার সময় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স জুডিথ চামাসের সঙ্গে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের
পৃথক বৈঠকে এ কথা উঠে এসেছে। ওই বৈঠক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে চার্জ দি অ্যাফেয়ার্সের পাঠানো গোপন বার্তা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি বিকল্প ধারার গণমাধ্যম উইকিলিকস অন্য অনেক গোপন তারবার্তার সঙ্গে এটিও প্রকাশ করে।
কামাল সিদ্দিকী দেশজুড়ে একযোগে জেএমবির বোমা হামলার কথা তুলে ধরে জুডিথ চামাসকে বলেন, সরকার ওই হামলা ঠেকাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বরং সরকার জেএমবির অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং বিএনপির প্রভাবশালী অনেক নেতা জেএমবির শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিদের রক্ষা করেছেন। সিদ্দিকী বলেন, বিএনপির সঙ্গে জোট করায় জামায়াতের কিছু নেতা-কর্মী দলছুট হয়ে জেএমবিতে যোগ দেন। তবে এ ব্যাপারে চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে সিদ্দিকী কারো নাম উল্লেখ করেননি। সিদ্দিকী অবশ্য বলেন, 'জেএমবির সঙ্গে বিদেশি কিছু ব্যক্তি জড়িত আছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।'
চারদলীয় জোটে জামায়াতকে রাখা নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার কথা জানিয়ে সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ জামায়াতকে ভালো চোখে দেখে না। আর তাদের জোটে রাখাটা বিএনপির জন্যই বিব্রতকর।
জঙ্গি নেতা খামারুর পক্ষে তারেকের দূতিয়ালি প্রসঙ্গে সিদ্দিকী বলেন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) জেএমবি নেতা বাংলা ভাইয়ের সহকারী খামারুকে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে তারেক রহমান ও তখনকার ভূমি প্রতিমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পৃথক বৈঠকে লুৎফুজ্জামান বাবর নাম উল্লেখ না করে চার্জ দি অ্যাফেয়ার্সকে জেএমবি জঙ্গি অভিযোগে আটক এক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা আটক ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পায়নি এবং থানায় তার নামে কোনো মামলাও ছিল না বলে তিনি দাবি করেন। ওই ঘটনার সময় বাবর সিঙ্গাপুরে ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব অবশ্য তারেক রহমানের টেলিফোনের পর খামারুকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান।
বাবর চার্জ দি অ্যাফেয়ার্সের কাছে স্বীকার করেন, জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ ওঠার আগে সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রী বাংলা ভাইকে তাঁর কাজে সহায়তা করেছেন। তাহলে ওই মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে কি না_চার্জ দি অ্যাফেয়ার্স এ প্রশ্ন করলে বাবর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, 'আমার পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।'
তারবার্তায় জুডিথ চামাস উল্লেখ করেন, কামাল সিদ্দিকী তাঁদের কাছে বহুবার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তারেককে 'অনভিজ্ঞ' ও 'ভয়ংকর' বলে উল্লেখ করেন সিদ্দিকী। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ মুখ্য সচিব বিএনপি ও খালেদা জিয়ার প্রতি অনুগত ছিলেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনে অপরাধের সুযোগ by তৌফিক মারুফ

বাংলাদেশে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপনের ব্যবসার নামে অপরাধে নেমেছে বিভিন্ন চক্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকারের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাব ও আইনের যথাযথ প্রয়োগে দুর্বলতার ফাঁক গলেই সহজ হয়ে উঠেছে এ অপরাধ। এই অশুভ প্রবণতা বন্ধে দেশে এখন মৃত্যুপথযাত্রীদের স্বেচ্ছায় কিডনি ও লিভার দান কার্যক্রম চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কিডনি ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, বাংলাদেশে কিডনিজনিত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার লোকের কিডনি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ১০ বছর আগে এর হার ছিল অর্ধেক। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ তাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বা তার উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না তা জানে না বলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। লক্ষণ দেখা দিলেই ছোটে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে আক্রান্তদের প্রায় ৭০ ভাগের কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। তখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালিসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ দুটোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, তাদের পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের কিডনি রোগীদের ৪ শতাংশের ডায়ালিসিস করার সামর্থ্য আছে। দেশে বর্তমানে ৪২টি ডায়ালিসিস সেন্টার আছে। আর কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বা কিডনি প্রতিস্থাপন সেন্টার আছে মাত্র আটটি। এসব সেন্টারজুড়ে একটি দালালচক্র অনেক আগে থেকেই তৎপর। নিরুপায় রোগীর স্বজনরা এসব দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে একদিকে যেমন কিডনি হারায়, অন্যদিকে আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়। এদিক বিবেচনায় ১৯৯৯ সালে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন আইন হয়। এ আইনে নিকটাত্মীয় ছাড়া কারো পক্ষে কাউকে কিডনি দান সম্ভব নয়। এ ছাড়া কিডনি বা মানুষের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর চাইলেই কিডনি বা লিভার দেওয়া যায় না। প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে কিডনি প্রতিস্থাপন এ দেশে জটিল ও কঠিন। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫০ মানুষের দেহে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরে বিদেশে আরো ৩৫০ বাংলাদেশি রোগীর দেহে দেশীয় দাতাদের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত দুই প্রক্রিয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ব্রেন ডেথ বা নিশ্চিত মৃত্যুর আগমুহূর্তে উপনীত কোনো ব্যক্তির এবং আরেকটি হচ্ছে জীবিত কোনো নিকটত্মীয়ের স্বেচ্ছায় দান করা কিডনি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেবল জীবিত কোনো নিকটাত্মীয়ের কিডনি দানের আইনগত পদ্ধতিটিই চালু। তবে কোনো রোগীর দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে তাকে বিকল্প পন্থায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় ডায়ালিসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা ও সনোগ্রাম করে কিডনির অবস্থান ও আকার দেখা, জিএফআর অথবা সিআর ইত্যাদি পরীক্ষা করে কিডনি অকেজো কি না নির্ণয় করা হয়। কিডনি অকেজো জানার পরই ডায়ালিসিসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর একজন রোগীর সব দিক বিবেচনা করেই কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যিঁনি কিডনি দেবেন তাঁর সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক কী তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইনানুসারে হলফনামা ও স্থানীয় নির্ধারিত জনপ্রতিনিধির সনদ দেখা হয়। এ ছাড়া দাতার শরীরের অনেক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া আরো জানান, আইন অনুসারে কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের ওপরে এবং ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। আর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার বা কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দুটি কিডনিই সম্পূর্ণভাবে ভালো থাকতে হবে। কিডনিদাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনিদান করতে হবে, জোর করা চলবে না।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, রোগীর স্বজনরা নিকট কোনো আত্মীয়কে কিডনি দানের জন্য না পেলে কিংবা টিস্যু বা অন্য উপাদানগুলোর মিল না হলে রোগীকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের অগোচরেই অবৈধ পথে পা বাড়ান। এতে করেই তাঁরা দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন। দালালদের সঙ্গে হয়তো কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অসৎ চিকিৎসক বা অন্য কারো যোগসাজশ থাকলেও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই চক্র আত্মীয় নয় এমন কাউকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসে, এসব ক্ষেত্রে সনদ প্রদানকারী জনপ্রতিনিধিরাও দায়ী থাকেন।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, যেমন করে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে একজন রোগীর প্রয়োজনীয় উপাদানে অমিল থাকে, তেমনি অনেক অনাত্মীয়ের সঙ্গেও যে কারো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর মিল থাকতে পারে। দালালচক্র রোগীর স্বজনদের সঙ্গে মিলে এমন ব্যক্তিকেই দাতা হিসেবে খুঁজে বের করে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে যদি ব্রেন ডেথ বা নিশ্চিত মৃত্যুর আগমুহূর্তে উপনীত কোনো ব্যক্তির কিডনি দানের প্রচলন চালু হয়, তখন এসব অপরাধ থেমে যাবে। এজন্য সামাজিক ও মানবিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যেমনটা হয়েছে রক্তদান বা চক্ষুদান কার্যক্রমের ক্ষেত্রে।
হাসপাতাল সূত্র মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এ হাসপাতালে ১৯৮৮ সাল থেকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চলে আসছে। ফলে কিডনি বিক্রির সঙ্গে জড়িত চক্রটি এ হাসপাতালেই বেশি সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এ দেশের সর্বোচ্চ এ হাসপাতালে এ চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করার জন্য মাঠে নেমেছে।
তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভুঁইয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই হাসপাতালে এ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর জানা নেই। এখানে যতটা সম্ভব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর তদন্ত করেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
কিডনি নিয়ে এ দেশে অবৈধ ব্যবসার কারণ সম্পর্কে কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিজেরা কিডনি দিলেও কিডনি প্রতিস্থাপনে সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ, থাইল্যান্ডে আট থেকে ১০ লাখ এবং ভারতে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা লাগে। ফলে দেশে সরকারিভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন সহজলোভ্য হলে এই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।
বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে বড় সমস্যা হলো, যার টাকা আছে, তার ডোনার নেই। আবার যার ডোনার আছে, তার টাকা নেই। ডোনার যাও পাওয়া যায় তারা হচ্ছে, লিভিং ডোনার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ব্রেন ডেথ ডোনার আছে। এতে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশে ব্রেন ডেথ কোনো ডোনার গড়ে তোলা গেলে অপরাধ কমে যাবে।
সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ১৯৯৯ সালে এ দেশে কিডনিসহ মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইন চালু হয়। আইনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথেষ্ট যৌক্তিক। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য এ আইনটি করা হয়েছিল। এ জন্য মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ব্রেন ডেথের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার এখানে সমস্যা হলো, একেবারে ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়নি। এ জন্য দেশব্যাপী একটা নেটওয়ার্ক গড় তুলতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যার কিডনি লাগবে এবং যে কিডনি দিতে চায়, তাদের ডাটা এন্ট্রি করা থাকে। পরে মিলে গেলে তাদের খোঁজ দেওয়া হয়। এখানে এমন প্রক্রিয়া নেই। বাংলাদেশে যদি পর্যাপ্ত পরিবেশ এবং কিডনি দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এ প্রক্রিয়া এখনই চালু করতে পারি। এ ছাড়া লিভার ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্টও এ দেশে সহজ হয়ে উঠছে।
স্বাস্থ্যসচিব হুমায়ুন কবীর গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে এই কিডনি বেচাকেনার খবরগুলো তাঁদের নজরে এসেছে। আগে এর ব্যাপকতা তাঁদের জানা ছিল না। ফলে সরকার এই প্রবণতা বন্ধ বা অপরাধী চক্রকে আইনের আওতায় আনতে খুব দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে তিনি জানান।