Thursday, February 10, 2011

ঢাকার মগরা by আজিজুর রহমান

কসময় ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করত এমন একটি জ্ঞাতিগোষ্ঠীর নাম হচ্ছে মগ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তসংলগ্ন আরাকান রাজ্য থেকে কয়েক শতাব্দী আগে মগরা বাংলার রাজধানী ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। ঐতিহাসিকদের মতে, অষ্টম শতক থেকেই মগরা বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে।

তবে ১৫ শতক থেকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়ে মগরা মাতৃভূমি ত্যাগ করে বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ১৭ শতকের প্রথমদিকে রাজনৈতিক কারণে মগদের একটি দল তৎকালীন ঢাকার উত্তর এলাকার শেষপ্রান্তে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। আরাকানের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক রাজা মলহনের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা শ্রীসুধর্ম (১৬৩২-৩৮ খ্রিস্টাব্দ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। নরপতি নামে রাজার এক আত্মীয়-মন্ত্রীর সঙ্গে রানী নাৎসিনমির ছিল গোপন প্রণয়। এরা ষড়যন্ত্র করে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা শ্রীসুধর্ম ও শিশুপুত্র মিনসানিকে হত্যা করে। রানী নাৎসিনমি তার প্রেমিক নরপতিকে রাজা বানিয়ে সিংহাসন দখল করে নেয়। সেই সঙ্গে সাবেক রাজার জ্ঞাতি ও সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যার আদেশ জারি করে। ফলে প্রাণভয়ে রাজার হাজার হাজার অনুসারী চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেন। এ হত্যাকাণ্ড ও সিংহাসন জবরদখলের সংবাদ পেয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুবাদার রাজার ছোট ভাই মেঙ্গতরায় ধরমসা ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সিংহাসন জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু নৌবাহিনীর দুর্বলতার কারণে যুদ্ধ জয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হন। সেই রাজনৈতিক গোলযোগের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা এবং দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে কমপক্ষে ৫৫ হাজার মগ বা আরাকানি আশ্রয় নেয়। মেঙ্গতরায় ধরমসা তাঁর পরিবার-পরিজন ও নেতৃস্থানীয় সমর্থকসহ প্রায় ১০-১২ হাজার অনুচর এবং ১৯টি হাতি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি মোগল সুবাদার ইসলাম খান মাসহাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং তাঁকে তিনটি হাতি উপঢৌকন দেন। সুবাদারও মেঙ্গতরায়কে পাঁচ হাজার টাকা উপহার দেন এবং মসনব ও জায়গির প্রদান করেন। মেঙ্গতরায় ধরমসা নিজ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মোগলদের হাতে অর্পণ করে নিজেকে সম্রাট শাহজাহানের করদরাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর সব সমর্থক নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মেঙ্গতরায় ধরমসার নতুন নাম হয় মীর আবুল কাশেম আল হুসেনি আত-তাবাতাবাই আল-সামনি। সুবাদার তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন তখনকার ঢাকা শহরের তিন মাইল উত্তরে এক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে। যা পরবর্তী সময়ে মগবাজার নামে পরিচিতি লাভ করে।

ভর্তি পরীক্ষা পৃথকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয় by ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

মাদের সমাজে সমস্যা হলো অলৌকিক উপদেশ দেওয়ার লোকের অভাব নেই। পণ্ডিত ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক উক্তি করে থাকেন। শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে বর্তমান সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগ আরো ভালো হবে যখন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কেবল মাস্টার্স নয়, এমফিল, পিএইচডির মান আরো উন্নত করা যাবে। এ জন্য অবশ্য প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো কঠোর নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হবে।

আমাদের দেশে যাতে উচ্চশিক্ষার মান আরো উন্নত হয়, সে জন্য সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব অনেকখানি। দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে এ দেশেরই কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমকক্ষতা প্রদান করতে চায় না। এটি কেন হচ্ছে, এর কারণ খতিয়ে দেখে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির অর্থ ব্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আবেদন করার কাজে মোবাইলের ব্যবহার বা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি প্রচলনের ব্যবস্থা করা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু তাই বলে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। বহু ধরনের কোর্স যেখানে পড়ানো হয়। মেডিক্যাল তো মাত্র একটি নির্দিষ্ট বিষয়। সার্বিকভাবে সেখানে অনেক ধরনের বিষয় থাকে। কলা অনুষদের অধীনেই বিভাগ থাকে ১০-১১টি। আইবিএ-বিবিএতে যে মানের স্টুডেন্ট ভর্তি হয়, তা অত্যন্ত উচ্চ। অথচ জোর করে কেউ যদি নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন মেডিক্যালের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একই ধরনের পরীক্ষার আলোকে ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করার জন্য, তা হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তীচ্ছু পরীক্ষার্থীদের বরং বঞ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বজায় রাখার অসুবিধা হবে। আবার ধরুন, একজন অভিভাবক থাকেন লালমনিরহাটে। তাঁর মেয়ে টিকল চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ক্ষেত্রে কী হবে?
মেডিক্যালে মাত্র একটি বিষয় অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০টির মতো বিষয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানো হয়। একই অবস্থা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেমন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় আসা যাক। সেখানে এগ্রিবিজনেস অনার্স পড়ানো হয়। অথচ প্রফেসর পদে ওই বিভাগে শিক্ষক নেই। ঠিক তেমনি নানা জোড়াতালি দিয়ে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তবে বর্তমান সরকার মানোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান একই সমান্তরালে ধরতে চায়, তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেননা সঠিক বেঞ্চ মার্কিংয়ের অভাবে পরিমাপ করার জন্য ইয়ার্ড স্টিক ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে ইয়ার্ড স্টিকের ব্যবহার যথাযথ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে ধরনের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করা হচ্ছে, তা আসলেই একধরনের নিকৃষ্টতম ঘটনা। একদা ভালো ছাত্রছাত্রী ছিলাম, পরবর্তী সময়ে দল করেছি; কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রকাশনা তেমন নেই, সে বিষয়ে মোটেও খেয়াল রাখা হচ্ছে না। হয়তো প্রাথমিক সিলেকশনে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নিয়োগের ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তদন্ত করার ব্যবস্থা নিতে পারেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, তারা আজ তাদের উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা এবং উচ্চশিক্ষায় অধিকতর বিনিয়োগের কারণে পরাশক্তির অন্যতম দাবিদার। সেখানেও কিন্তু বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন তারিখে পরীক্ষা হয়ে থাকে। নির্দিষ্টভাবে পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ায় ভর্তি পরীক্ষারই প্রয়োজন হয় না। আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হতে হলে পূর্ববর্তী পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তি হতে পারছে।
আমাদের দেশের সমস্যা হলো জনসংখ্যার তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা স্বল্প। বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং জাহাঙ্গীরনগরের অত্যন্ত উন্নত। বুয়েটের মানও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মা-বাবা কষ্ট করে সন্তান ভর্তি করাতে চান। এ সমস্যা সমাধানে শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না; বরং অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটান। সেই শিক্ষার মান যাতে বহাল থাকে এবং অভিভাবকরা যেখানে তাঁর সন্তানকে পড়িয়ে সন্তুষ্ট হবেন, সেখানে মেডিক্যালের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকুচিত করার প্রয়াস হবে বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে সমস্যা হলো, এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে গিনিপিগ বানিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। তারই সূত্র ধরে রচনামূলক প্রশ্নের বদলে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন চালু করে জিপিএ ৫-এর ব্যবস্থা করা হয়। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে অথচ শিক্ষার মান উন্নতির বদলে অবনতি হয়েছে। ১৯৮২-তে যেখানে চারটি বোর্ডে প্রায় এক হাজার ৮০০-এর মতো প্রথম বিভাগ পেয়েছিল, এখন সব বোর্ডে জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা হচ্ছে প্রায় শত গুণ।
সম্প্রতি একটি গবেষণাকাজে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে এমন ৩০০ ছাত্রছাত্রী এবং ও-লেভেলে ইংরেজিতে 'সি' পেয়েছে এমন ৩০০ ছাত্রছাত্রীর ইংরেজি জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়ে দেখা গেল ও-লেভেলে যে ইংরেজিতে 'সি' পেয়েছে, তার মান অনেক ভালো। অথচ দেশে হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে ঠিকমতো পড়ানো হয়। বাকিটা নির্ভর করে ও-লেভেল এবং এ-লেভেলে প্রাইভেট পড়ার ওপর। তা হলে প্রশ্ন জাগে, কেন এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রদের এ দৈন্যদশা? বাংলাদেশে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রয়াস নিয়েছে। তাদের এ প্রয়াস সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু ভয় হয়, কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি যখন অলীক স্বপ্ন দেখান বা ভ্রান্তনীতির কারণে বলেন, গুচ্ছ ব্যবস্থায় মেডিক্যালের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে হবে, তখন যদি সরকার এ ধরনের ভ্রান্তনীতি মেনে নেয়, তা হলে আখেরে অধিকাংশ অভিভাবক আশাহত হবেন। বরং কী করে কোচিং ব্যবসা বন্ধ করা যায়, রেজাল্টের ভিত্তিতে সহজভাবে ভর্তি করা যায় এবং জিপিএ ৫ পাওয়া স্টুডেন্টের মান যেন সত্যি উন্নত হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সুন্দর মানস গঠনের হাতিয়ার। সমাজ থেকে দুর্নীতি এবং সামাজিক ব্যাধি, অনাচার কমে যাবে যদি পারিবারিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা ও দেশপ্রেমে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করা যায়। মানবিকতাপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা বাঞ্ছনীয়। চলতি বছর যেভাবে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যবস্থা বজায় রয়েছে তা যেন ভবিষ্যতেও বজায় থাকে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জননেত্রীর কাছে প্রত্যাশা করছি। জননেত্রী ২০২১ সাল নাগাদ দেশের উন্নয়নের জন্য যে রূপরেখা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষার মান উন্নত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আশার কথা, বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করছে। কোনো ধরনের বিভ্রান্তি যেন পিছু হটাতে না পারে।

লেখক : অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন এবং অর্থনীতির অধ্যাপক

পাট জিনোমের আঁতুড়ঘর by সমুদ্র সৈকত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালে। পাটের জিনোম আবিষ্কারের জন্য সিকোয়েন্সিং উপযোগী ডিএনএ তৈরি করা হয়েছিল এই গবেষণাগারেই। ৮৮-র বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষকরা। পাটবীজশূন্য হয়ে পড়েছিলেন চাষিরা। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আনা নিম্নমানের বীজের কারণে পরের বছরও লাভের মুখ দেখেননি তাঁরা।

এ সময় ডিএনএর সাহায্যে পাটবীজ শনাক্ত করার কাজে এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান। গবেষণা শুরু করেন সোনালী আঁশ নিয়ে। নিজ হাতে গড়ে তোলা মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চালিয়ে যান নিরলস গবেষণা। তাঁর হাতেই দেশে প্রথম পাটের জিন নিয়ে গবেষণা শুরু। ২০০০ সালে ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে পাটের জাত নির্ণয় করাই এ গবেষণাগারে পাওয়া প্রথম সাফল্য। এ ছাড়া 'টিস্যু কালচার অনির্ভর পদ্ধতি' উদ্ভাবন করে জেনেটিক ট্রান্সফরমেশনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনাও সম্ভব হয়েছে এখান থেকে। ল্যাবপ্রধান অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, 'এখন গবেষণা চলছে লবণ সহনশীল পাট উদ্ভাবন নিয়ে। এছাড়া পাটের আঁশের পুরুত্বের জন্য লিগনিন নামের যে উপাদানটি কাজ করে, সেটার পরিমাণ কমানো নিয়েও কাজ চলছে।'
গবেষণার জন্য পাটের নমুনা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। এ জন্য নমুনা টিস্যুকে নির্দিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যসহ বিক্রিয়া ঘটিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। এতে দ্রবণের ডিএনএর সঙ্গে কিছু অপদ্রব্য থেকে যায়। এ জন্য ফেনল, ক্লোরোফর্ম ও আইসো-অ্যামাইল অ্যালকোহল নামের রাসায়নিক যোগ করা হয়। এরপর তলানি সংগ্রহ করে তাতে ৭০ শতাংশ ইথানল যোগ করে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। বিশুদ্ধ ডিএনএকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়।
নমুনাকে প্রাইমার, ডিএনটিপি, ট্যাক পলিমারেজ এবং অন্য উপাদানসহ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) করা হয়। এর মাধ্যমে সামান্য পরিমাণ ডিএনএ থেকে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়ে বেশি ডিএনএ পাওয়া যায়। পিসিআর থেকে প্রাপ্ত কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ খণ্ডকে পরে জেল ইলেক্ট্রোফোরেসিস নামক একটি পৃথকীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে আলাদা করা হয়।
নির্দিষ্ট আকারের কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ ব্যান্ডকে রঞ্জিত করা হয়। এই রঞ্জক ব্যবহারের পর অতিবেগুণী রশ্মির মাধ্যমে ডিএনএ খণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় গবেষকরা নিরাপদ চশমা ব্যবহার করতে ভুল করেন না। ইদানীং এ কাজে জেলডক সিস্টেম ব্যবহারের ফলে গবেষণার কাজ আরো সহজ হয়েছে। ন্যানো ড্রপ ব্যবহার করে প্রতি মাইক্রোলিটারে কী পরিমাণ ডিএনএ আছে, তাও চট করে জান যাচ্ছে।
গবেষণার কাজে সব সময়ই বিশুদ্ধ পানির দরকার। ল্যাবের উন্নত ডিস্টিলড ওয়াটার প্ল্যান্ট সেই চাহিদা পূরণ করে। শিক্ষার্থীদের জীবাণুমুক্ত পরিবেশে কাজ করার প্রয়োজন হলে ছুটে যান ল্যামিনার এয়ারফ্লো ক্যাবিনেটে। আর নমুনা জীবাণুমুক্ত করতে তাঁরা ব্যবহার করেন অটোক্লেভ মেশিন।
এ ছাড়া পাটের জিনোমে কোনো নির্দিষ্ট ডিএনএ খণ্ড আছে কি না কিংবা থাকলে এই খণ্ডের সংখ্যা কত, তা নির্ণয় করার জন্য সাউদার্ন ব্লট নামক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কাঙ্ক্ষিত জিনের প্রকাশ ঘটছে কি না, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করার জন্য আছে নর্দার্ন ব্লট।
বর্তমানে পাটের জন্য উপকারী বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণের কাজ চলছে এই ল্যাবে। উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবনের জন্য জেনেটিক ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে বিশেষ জিনের প্রকাশ ঘটানোর কাজ এগিয়ে চলেছে।
এখানে মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা গবেষণার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক মানের এই ল্যাবে ছুটে আসেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গবেষকরাও।
ল্যাব ম্যানেজার ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট সাজিয়া শারমিন জানান, আরো উন্নত গবেষণার জন্য ল্যাবে খুব শিগগিরই মাইক্রো-অ্যারে স্ক্যানার, রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিন এবং টু-ডি জেল ইলেক্ট্রোফোরেসিস মেশিন সংযোজন করা প্রয়োজন।
'মলিকিউলার বায়োলজির গবেষণায় ধৈর্য প্রয়োজন'_জানালেন গবেষক রাজীব আহমেদ। শিক্ষার্থী নূরুন্নাহার ফ্যান্সি তাঁর গবেষণা কাজের ফাঁকে বললেন, 'গবেষণায় কোথাও আটকে গেলে বড় ভাইয়া ও আপুরা আগ্রহ নিয়ে দেখিয়ে দেন। শিক্ষকরা তো আছেনই।'
বাংলাদেশে পাট গবেষণার অন্যতম কর্ণধার ড. হাসিনা খানের নেতৃত্বাধীন এ মলিকিউলার বায়োলজি গবেষণাগারটির সুবাদেই হয়তো দেশের পাট গবেষণা এগিয়ে যাবে অনেক দূর। সেই সঙ্গে পুনরুজ্জীবিত হবে দেশের লুপ্তপ্রায় পাটশিল্পও।

দূষণ ঠেকাবে তিন অণুযোদ্ধা by তৌহিদ এলাহী

ট্যানারিগুলোতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রচুর ক্রোমিয়াম। প্রক্রিয়া শেষে এর কিছু উচ্ছিষ্ট চলে যাচ্ছে নদীনালায়, আর কিছু হচ্ছে পশুপাখি ও মাছের খাবার। এভাবে মানুষের দেহে ঢুকে যাচ্ছে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম, ঘটাচ্ছে ক্যান্সারসহ অনেক রোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক ও তাঁর গবেষক দল এমন তিনটি অণুজীব শনাক্ত করেছেন যেগুলো ওই বিষাক্ত ক্রোমিয়ামকে বানিয়ে দেবে পুরোপুরি নির্বিষ।

দেশে প্রায় ৩০০ ট্যানারি আছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারেই শতকরা নব্বই ভাগ চামড়া কারখানা। এগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ২২০ মেট্রিক টন চামড়া প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৬০০-১০০০ কেজি উচ্ছিষ্ট পড়ছে নদীতে। কিছু কিছু আবার মুরগি ও মাছের খাদ্য এবং সার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিয়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রচুর ক্রোমিয়াম যৌগ, ক্রোম পাউডার, লিকার ইত্যাদি। এখান থেকে কোনোভাবে এই বিষাক্ত ক্রোমিয়াম মানুষের দেহে ঢুকে গেলে বা সংস্পর্শে এলে তৈরি হয় ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ। শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যদ্রব্য বা পানীয়ের মাধ্যমে মানুষের সংস্পর্শে এলে ত্বকের প্রদাহ, অ্যালার্জি, ক্ষত, অ্যাজমা ঘটায়। নাকের সেপ্টাম পর্দা ছিদ্র করে ফেলতে পারে এই ক্রোমিয়াম। শ্বাসনালি ও পাকস্থলির বিষক্রিয়াও ঘটায়। পাকস্থলি ও অন্ত্রের প্রদাহ, যকৃৎ এবং মূত্রনালির সমস্যা তৈরি করতেও এর জুড়ি নেই।
গবেষণা দলের সহকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতেখার মো. রফিকুল্লাহ রোমান জানান, ক্রোমিয়াম মানবদেহের ক্রোমোজোমের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ক্ষতিকর মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটিয়ে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি অর্থাৎ ক্যান্সার তৈরি করে। পাশাপাশি ক্রোমিয়ামযুক্ত চামড়া শিল্পের আবর্জনা জলজ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার বাস্তুসংস্থানও নষ্ট করে। এর কারণে স্বাভাবিক অণুজীবের জীবনও বিপন্ন হয়। আর আমাদের চামড়া শিল্পের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্য ও জৈবসার তৈরির প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানভিত্তিক পন্থাও অনুসরণ করা হয় না। ক্রোমিয়ামযুক্ত উচ্ছিষ্ট চামড়ার শতকরা ৫৩ ভাগের সঙ্গে কোনো যন্ত্রের সংস্পর্শ ঘটে না। সেগুলো থেকে খালি হাতেই তৈরি হচ্ছে মুরগি-মাছের খাবার। এর ধারাবাহিকতায় ক্রোমিয়াম ঢুকে যাচ্ছে শাকসবজিতে। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষের দেহে ঢুকে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
আগের এক গবেষণায় দেশের হাঁস-মুরগির খামার ও মাছের খাবারে ২.৪৯ শতাংশ ক্রোমিয়াম উপাদান পাওয়া গেছে। আর চামড়া শিল্প সংলগ্ন খালে ৪.০৬ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) ঘনমাত্রায় এবং নদীতে ০.৪৪৩ পিপিএম ঘনমাত্রায় ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে।
অধঃক্ষেপণ, আয়ন বিনিময় ছাড়াও ক্রোমিয়াম দূষণ রোধে আরো কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে এগুলো সাশ্রয়ী নয়। প্রয়োজন প্রচুর রাসায়নিক বিক্রিয়ক ও জ্বালানি। এ কারণেই দেশে এগুলোর ব্যবহার চোখে পড়ে না। আবার পদ্ধতিগুলো অন্যভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে। আর এ কাজে ড. মোজাম্মেল হকের গবেষণাপ্রাপ্ত অণুজীব ব্যবহার হবে সাশ্রয়ী ও শতভাগ পরিবেশবান্ধব।
রোমান জানান, চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম সাধারণত দু'ভাবে দ্রবণে মিশে থাকে। এর একটি ক্ষতিকর ও অন্যটি নিরীহ। এটিই গবেষণার মূল ভিত্তি। আবিষ্কৃত তিনটি অণুজীব হলো ইশেরিকিয়া, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস, পেডিয়োকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস। এরা ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ নামের এক ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক তৈরি করে। এই ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ এনজাইম ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামকে নিরীহ ক্রোমিয়ামে পরিণত করে।
এ গবেষণায় প্রথমে চামড়া শিল্প এলাকা সংলগ্ন খাল ও নদী থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আর উচ্ছিষ্ট চামড়াজাত দ্রব্য থেকে প্রস্তুত খাদ্যের জন্য হাজারীবাগ, নিমতলীর প্রাণী ও মৎস্য খাদ্য তৈরির কারখানাগুলো থেকে নমুনা খাদ্য সংগ্রহ করা হয়। পানির নমুনা থেকে 'লুরিয়া বারটানি আগার' নামের বিশেষ ব্যবস্থায় ইশেরিকিয়া, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস এবং পেডিওকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস ব্যাকটেরিয়া তিনটি শনাক্ত করা হয়। পরে আরেকটি পরীক্ষার মাধ্যমে অণুজীবগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। আর বিভিন্ন পর্যায়ে রাসায়নিক ও শারীরিক প্রক্রিয়াজাতকরণের পর খাদ্য উপাদানগুলো থেকে অ্যাটমিক অ্যাবজর্বশন স্পেকট্রোফটোমিটার (এএএস) যন্ত্রের সাহায্যে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি এতে ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামের পরিমাণ ও ঘনমাত্রাও বের করা হয়। এরপর শনাক্ত করা ব্যাকটেরিয়াগুলো ক্রোমিয়ামযুক্ত নমুনায় প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলোর কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, অণুজীব নিঃসৃত ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ এনজাইমের প্রভাবে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম নিরীহ ক্রোমিয়ামে পরিণত হয়েছে। শনাক্তকারী তিনটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পেডিয়োকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস সর্বোচ্চ কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
গবেষণা দলের প্রধান ড. মো. মোজাম্মেল হক জানান, এটি গবেষণার প্রাথমিক ধাপ। এটি শিল্প পর্যায়ে প্রয়োগের আগে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি চামড়া, খাদ্য ও পরিবেশসংশ্লিষ্ট মহলের ভূমিকা রাখতে হবে।
এই গবেষণাকর্ম নিয়ে ইতিমধ্যে দুটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। 'বাংলাদেশ জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ' এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রকাশিত তৃতীয় বাংলাদেশ-জাপান জয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের 'ফুড সেফটি অ্যান্ড হাইজিন' নামের বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধ দুটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ড. মো. মোজাম্মেল হকের এই গবেষণা দলে আরো ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস, শিক্ষার্থী শাহনেওয়াজ বিন মান্নান, বিজয়চন্দ্র দেবনাথ ও সফিউল ইসলাম।

সংযমী হতে হবে

শেয়ারবাজারে হঠাৎ করেই বড় ধরনের ধস নামে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক। কিন্তু এ পরিস্থিতি সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমস্যা নয়। পরদিন অর্থাৎ সোমবারই দেখা গেছে, সূচক আবারও কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এখানে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নেওয়া রবিবারের কিছু সিদ্ধান্ত সহায়ক হয়েছে_এটা মনে করা যায়। এর পরও বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হয়েছেন_এমনটা বলার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সত্যি হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের বিকল্প ব্যবস্থা সামনে না থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এসইসি এবং ডিএসইর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়টিও। বিনিয়োগকারীরা স্পষ্টত দায়ী করেছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে। এর ফলে চক্রবিশেষ অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পকেট থেকে।
এর পরও অধৈর্য হয়ে কেউ যেন শেয়ার বিক্রি না করেন_এমন পরামর্শ দিয়েছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এ মুহূর্তে রাজপথে বিক্ষোভকারী বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সরকারের নৈতিক সমর্থনও বাজারের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা সহযোগিতা করতে পারে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের শান্ত কিংবা অশান্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। সেই বিবেচনা মাথায় রেখেই সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনকে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
শেয়ারবাজারে দরপতন কিংবা দাম বাড়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে এ প্রবণতা যদি ক্রমহ্রাসমান কিংবা ক্রমবর্ধমান হয়, তাহলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা কিংবা আতঙ্ক তৈরি হতে পারে এবং এর পরিণতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনারও জন্ম হতে পারে। বর্তমানে বাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এর অন্যতম কারণ এটি।
যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কিছু দিন আগেও এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি সম্পর্কে বাজারে নানা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেছে। তাঁদের দক্ষতা, এমনকি সততা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, যা প্রায়ই তাঁরা ব্যক্ত করে থাকেন। কিন্তু সরকার এসব জানার পরও এসইসির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। একই কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতার জন্য সরকারকেও দায়ী করছেন। যদিও বাজারের ওপর সরকারের হাত খুবই সীমিত। শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী ঝুঁকি কিংবা লাভ-লোকসানের হিসাবটা বিনিয়োগকারীকেই নিতে হয়। সেখানে সরকারের সার্বক্ষণিক খবরদারির বিষয়টি কাঙ্ক্ষিতও নয়।
এই দরপতনের প্রক্রিয়ায় ষড়যন্ত্রকারীদের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কথাও কেউ কেউ বলছেন। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়েও সেদিকে নজর দিতে পারে। কারণ, হালে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ভর করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাশকতা চালানোর কথাও ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শেয়ারবাজারেও এমন কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে কি না তা-ও দেখার দায়িত্ব সরকারের। আর বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে শেয়ারবাজার শুধু লাভেরই বাজার নয়, এখানে লোকসানও একটি স্বাভাবিক বিষয়। ব্যবসায়িক মানসিকতা পোষণ করলেই এই ক্ষোভ প্রশমিত হবে।

আশঙ্কা অমূলক নয়

বেশ কিছু দিন ধরেই এমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এবার প্রধানমন্ত্রীও সেই একই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকায় কিছু দিন আগে বড় ধরনের গোলযোগ হয়েছে। গোলযোগ হয়েছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায়। গার্মেন্ট সেক্টরে একের পর এক অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির পেছনে নাশকতার কোনো ছক থাকতে পারে_এমন আশঙ্কা অনেক দিনেরই।

সামান্য কারণেও গার্মেন্ট কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে গার্মেন্টে অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও। এর পাশাপাশি ঝিনাইগাতী থেকে প্রায় ১৪ হাজার গুলি উদ্ধারের ঘটনা থেকে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ সারা দেশে এ ধরনের অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের আরো বড় বড় মজুদ থাকতে পারে। সব মিলিয়েই দেশের বিরুদ্ধে নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও সেই আশঙ্কাই ব্যক্ত করেছেন। আশঙ্কা অমূলক নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকাংশেই গার্মেন্টনির্ভর। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের অনেকটাই নির্ভর করে এই সেক্টরের ওপর। সেই সেক্টরে সম্প্রতি নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির একটা অপচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, তার পেছনে তিনি যুক্তিও দেখিয়েছেন। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতৃস্থানীয় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উপরন্তু মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের পুরনো আইনটি নতুন করে ফিরে আসছে। এ অবস্থায় দেশের ভেতরে থেকে একটি চিহ্নিত মহল যে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার সব রকম চেষ্টা করবে, তাতে সন্দেহ নেই। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বার্থ সংরক্ষণে অনেক কিছুই করা হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। গত ৩৫ বছরে নিজেদের অনেকখানিই গুছিয়ে নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এর পাশাপাশি দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটানো হয়েছে। চিহ্নিত একটি শক্তির সরাসরি সহযোগিতায় দেশে জঙ্গিবাদ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। জঙ্গিবাদের পেছনে একটি চিহ্নিত মহল অর্থায়ন করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় দেশে নাশকতার চেষ্টা যে রাজনৈতিক ধর্মান্ধগোষ্ঠী করতে পারে, এমন ভাবনা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে ঝিনাইগাতী এলাকায় আবার গুলি উদ্ধারের ঘটনা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এ এলাকায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা তো এটাই প্রথম নয়। এর আগেও এ এলাকা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ঝিনাইগাতীর পানবর এলাকা থেকে ১০টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে ঝিনাইগাতীর বাঁকাকুড়া এলাকায় একটি ঘরের মাটি খুঁড়ে প্লাস্টিকের ড্রামভর্তি ২৯ হাজার ১০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড় এলাকার বাঁকাকুড়া ও গজনী থেকে বিডিআর আরো ১০ হাজার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছিল। এসব অস্ত্রের পেছনে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যেমন যোগসাজশ থাকতে পারে, তেমনি তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্যসম্পন্ন এ দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোরও সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। পুুলিশ ও বিভিন্ন মহল থেকে এমনটাই সন্দেহ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। নাশকতা যে চলছে, তাতে কোনো সন্দেহ না রেখে এই নাশকতার নেপথ্যের অপনায়কদের চিহ্নিত করতে হবে। সারা দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের সর্বাত্মক তৎপরতা চালাতে হবে।

বলয় রহস্য by জুবায়ের হোসেন

নির নাম শুনলেই মাথায় আসে গ্রহটাকে ঘিরে থাকা বলয়ের ছবি। সৌরজগতের বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুনেরও এমন বলয় আছে, তবে এরা শনির বলয়ের কাছে পাত্তা পায় না। কেননা শনির বলয়টা দৃশ্যমান ও দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু এ সৌন্দর্যের পেছনের কাহিনী একেবারে নিষ্পাপ নয়। বলয় সৃষ্টির মূলে রয়েছে এক 'মহাজাগতিক হত্যাকাণ্ড'! মার্কিন গবেষকরা জানালেন, শনির এ বলয় তৈরির জন্য বহুকাল আগে ধ্বংস হয়েছিল অতিকায় এক উপগ্রহ।

এক সময় ভাবা হতো, শনি গ্রহের দুটি উপগ্রহ ধাক্কা লেগে কিংবা ধূমকেতুর আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে যায়। ধীরে ধীরে ওই কণাগুলো গ্রহটির চারদিকে জায়গা মতো জেঁকে বসে। তবে নাসার অভিযানে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ভিন্ন ধারণার ইঙ্গিত দেয়। কেননা বলয়টির ৯৫ শতাংশই বরফ। যদি উপগ্রহের খণ্ডে বলয় তৈরি হতো তবে এতে বরফের সঙ্গে অনেক বেশি পাথরকণা থাকার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথওয়েস্ট গবেষণা সংস্থার তৈরি মডেল জানাল আরো চমকপ্রদ এ তথ্য। বলয় তৈরির সময় শনি সবে জমাট বাঁধতে শুর করেছিল। চারপাশ ঘিরে ছিল হাইড্রোজেন গ্যাসের মেঘ। এখনকার সবচেয়ে বড় চাঁদ টাইটানের চেয়েও বড় উপগ্রহ ছিল শনির। ভালোভাবে কক্ষপথে থিতু হওয়ার আগেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি খাটিয়ে একটু একটু করে ওই উপগ্রহের বায়ুমণ্ডল থেকে বরফ কেড়ে নেয় শনি। আর ওই বরফেই তৈরি হয়েছে বলয়। শুরুর দিকে বলয়টা ছিল এখনকার চেয়ে ১০-১০০ গুণ বেশি পুরু। পরে ওই বরফের বলয়ে মিশে গেছে যৎসামান্য পাথরখণ্ড ও ধূলিকণা। আর ভর কমে আসায় ওই উপগ্রহ প্রবল বেগে শনির গায়ে আছড়ে পড়ে চূর্ণ হয়ে যায়। গবেষণা বলছে, বলয়ের মধ্যে হারানো বরফ থেকে তৈরি হয়েছে আরো অনেক ক্ষুদে উপগ্রহ।

বিধবার ৬০ কোটি টাকার জমি সাকার দখলে

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে এবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অসহায় এক বিধবার ৩০ কাঠা জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। বিগত জোট সরকারের সময় দলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসী দিয়ে জমির মালিক ও তাঁর লোকদের উচ্ছেদ করে তাতে কিউসি প্রপার্টিজ লিমিটেডের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন সাকা চৌধুরী।

দখলে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি আনসার বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জমির মালিক নাজমা বেগম। বর্তমানে ওই জমির একাংশে আনসারের তেজগাঁও থানা অফিস স্থাপন করা হয়েছে। দখল করা জমির নিরাপত্তা দিচ্ছেন ১০ জন আনসার সদস্য। সাকার অবৈধ স্বত্ব টিকিয়ে রাখতে সশস্ত্র আনসার বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন ১/ই ও ৩/৩, দক্ষিণ বেগুনবাড়ী (এফডিসি-সংলগ্ন পূর্ব পান্থপথ) নামক স্থানে ৩০ কাঠা জমির মালিক নাজমা বেগম। তিনি এই জমি সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ডে মালিক আব্দুস সোহবান বেপারীর কাছ থেকে সাফ কবলা দলিলমূলে প্রায় ৩০ বছর আগে কিনেছিলেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। সর্বশেষ মহানগর জরিপেও জমির মালিক হিসেবে নাজমা বেগমের নাম রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। সেখানে দোকানপাট ও গাড়ির শোরুম নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছিলেন তিনি। বিগত জোট সরকারের সময় জাল দলিল করে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাকা চৌধুরী জমিটি দখল করে নেন বলে অভিযোগ করেন নাজমা বেগম। সে সময় থানা-পুলিশ, আদালত ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা আনসার কর্মকর্তা আলীম জানান, আনসার হেডকোয়ার্টার ও মহানগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশেই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সাকা চৌধুরীর দাবি করা জমির নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ওই জমি দখলে নিলেও সাকা চৌধুরী সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারেননি। এমনকি সীমানা-প্রাচীরও নয়। প্রয়োজনীয় পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে না পারায় আনসারের পক্ষ থেকে কিউসি প্রপার্টিজকে একাধিকবার নোটিশ দেন জেলা কমান্ড্যান্ট। এ ছাড়া গত বছরের ১৯ এপ্রিল আনসারের পক্ষে প্লাটুন কমান্ডার মো. আব্দুল খালেক এ সম্পত্তি থেকে ফোর্স প্রত্যাহারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ওই চিঠিতে আনসারের অস্ত্র নিরাপদ নয়_এমন কথাও বলা হয়েছে।
পাহারারত ১০ সদস্যের আনসার দলের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) আবদুস সাত্তার জানান, জমির মালিকানা-স্বত্ব সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। তবে শুনেছেন, চট্টগ্রামের সাকা চৌধুরীর পারিবারিক কম্পানি কিউসি প্রপার্টিজ এ জমি গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়েছে। যদিও লিজের জমিতে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা। তিনি বলেন, কম্পানি আনসারদের জেনারেটর, এলপি গ্যাস ও পানি কেনার টাকা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য জানান, সঠিক দলিলপত্র ও জমির স্বত্ব না থাকার কারণে কিউসি প্রপার্টিজের পক্ষে এসব সংযোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট মো. ঈশান আলী রাজা কিউসি প্রপার্টিজের কম্পানি সেক্রেটারি বরাবর লেখা এক চিঠিতে সেখানে আনসার ক্যাম্প রাখা আনসারের নীতিমালা পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যার কথা উল্লেখ করে গত ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব সমস্যা সমাধান না হলে ১১ ডিসেম্বর আনসার প্রত্যাহার করা হবে বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আনসার প্রত্যাহার করা হয়নি।
নাজমা বেগমের পরিবারের লোকজন বলেন, একটি অসহায় পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পক্ষে আনসারের সরকারি অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ বর্তমানে সরকারের নির্দেশে দেশের সব বিরোধপূর্ণ জমির নিরাপত্তায় থাকা আনসার বাহিনীর অস্ত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে খোদ আনসার কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন। তাঁরা আরো জানান, দখলের আগে ওই জমিতে নাজমা বেগমের নামে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের লাইন ছিল। পরে তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দখল হয়ে যাওয়া জমি থেকে এসব লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়।
নাজমা বেগমের ভাতিজা বাহার অভিযোগ করেন, প্রশাসনের কেউ কেউ এখনো যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পক্ষে কাজ করছেন। জমি দখলে নেওয়ার জন্য সাকা চৌধুরীর লোকজন নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মিথ্যা মামলা করেছে। এর মধ্যে জমির সঠিক দলিল উপস্থাপন ও আদালতে হাজির না হওয়ার কারণে ছয়টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে। বর্তমানে ৯টি মামলা বিচারাধীন।
নাজমা বেগম অভিযোগ করেন, বিগত জোট সরকারের সময় সাকা চৌধুরী একবার তাঁকে মতিঝিলের অফিসে ডেকে এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার হুমকি দিয়ে বলেন, 'কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিই, জমির দাবি থেকে সরে যান।'
তেজগাঁওয়ের কিউসি প্রপার্টিজের দখলে থাকা এ জমি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন কম্পানির মহাব্যবস্থাপক মানিক রতন রায় ও ব্যবস্থাপক এমদাদুল হক। দখলে থাকা জমির স্বত্ব-মালিকানা প্রসঙ্গে তাঁরা জানান, ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক সাকা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান কিউসি প্রপার্টিজ। কিন্তু জমি কিভাবে কেনা হয়েছে, সেই দলিলপত্র ও রেকর্ড-পর্চা দেখতে চাইলে পরে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সেসব কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত জোট সরকারের সময় সাকা চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে জমিটি দখল করার পর প্রচার করেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে শিল্প প্লট হিসেবে তা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেখানে ফ্ল্যাট নির্মাণের সাইনবোর্ড টাঙানোর বিষয়টি জানতে চাইলে কিউসির কর্মকর্তারা কোনো জবাব দিতে পারেননি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'একজন যুদ্ধাপরাধীর দখল করা জমিতে তেজগাঁও থানা আনসার অফিস স্থাপনের বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর। একদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আদালতে সাকা চৌধুরীর বিচার হচ্ছে, অপরদিকে তাঁরই দখল করা সম্পত্তি রক্ষায় কাজ করছে আনসার!'
তেজগাঁও থানা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা শরীফ রেজানুল হক বলেন, বারবার চিঠি দিয়ে জানানো সত্ত্বেও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের অফিস থেকে আনসার প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সুবিধা না থাকায় বর্তমানে তাঁদের মানবেতর অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে আনসার সদস্যরা জানান।
কিউসি প্রপার্টিজের মহাব্যবস্থাপক রতন মানিক রায় বলেন, জমিটি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক কম্পানির জন্য মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে কেনা হয়েছে। তিনি এরশাদ সরকারের সময় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জমিটি দীর্ঘ মেয়াদে বরাদ্দ নিয়েছিলেন। জমির রেকর্ড সূত্রে মালিক সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। এটি সরকারের অধিগ্রহণ করা জমি বলে তিনি দাবি করেন। ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তি কিভাবে অধিগ্রহণ হলো এবং অধিগ্রহণের মামলা নম্বর কত, জানতে চাইলে তিনি এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বেগুনবাড়ী মৌজার বেশ কিছু জমি নিচু এলাকার অন্তর্ভুর্ক্ত ছিল। একসময় সেখানে ধান ও মাছের চাষ হতো, যার সঙ্গে তেজগাঁও শিল্প এলাকার কোনো সম্পর্ক নেই। বিগত এরশাদ সরকারের সময় নিচু জমিগুলো ভরাট করে বরাদ্দের নামে কিছু প্রভাবশালী লোক দখল করে নেয়।

মানুষের গ্রাস নিয়ে কাউকে চালবাজি করতে দেব না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'যত দিন ক্ষমতায় আছি, মানুষকে খাবারের কষ্ট করতে দেব না। প্রয়োজনে সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করব।' মিল মালিক ও আড়তদারদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'যারা সাধারণ মানুষের গ্রাস নিয়ে চালবাজি করবে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের সব মিল মালিক ও আড়তদারের তালিকা আমার কাছে রয়েছে।

তাদের কাছে কত মজুদ আছে, এরা কী করে-না করে, কোন পন্থী_সে তথ্যও সংগ্রহ করছি।' এ সময় মজুদদার আইন পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ৩০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাসদের হাসানুল হক ইনুর প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আরো বলেন, খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়ার পর এত দাম বাড়ার কথা নয়। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী আছে, তাদের কারসাজি রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে জিনিসপত্রের দাম কমে_এ দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আওয়ামী লীগ এখন ৩৫-৩৬ টাকায় মোটা চাল খাওয়াতে পারছে। এখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে মানুষকে ৮০-৯০ টাকায় চাল খেতে হতো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওরা ১০ টাকার চাল ৪০ টাকা করেছে। বাড়ানোই ওদের অভ্যাস। আর আমরা কমাই।'
পুঁজিবাজার দ্রুত পড়ে যাওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক পুঁজিবাজারের চলমান অস্থিরতা নিয়ে বজলুল হক হারুনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পুঁজিবাজারের ঘটনায় কিছু চক্র খেলা করছে, সন্দেহ নেই। আমরা তদন্ত করছি। পুঁজিবাজার কখনো উঠবে, কখনো পড়বে। এটাই স্বাভাবিক। তবে এত দ্রুত পড়ে যাওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক।'
শেয়ার ব্যবসায়ীদের ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেয়ারবাজার পড়ে যাবে এটা তারা কিভাবে জানল? বাজার পড়ে যাওয়ার পর ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে যাওয়া, ভাঙচুর চালানো ও অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা দেখে সত্যিই সন্দেহ জাগে। কখন ব্যানার হলো? ভেতর থেকে কারা কী খেলছে?'
পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, শেয়ারবাজারে যারা কেনাবেচা করতে যাবে তাদের এই ঝুঁকি নিয়েই যেতে হবে_কখনো কমবে, আবার কখনো বাড়বে। দাম কমলে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করা ঠিক হবে না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত। শেয়ারবাজার নিয়ে নিজের অনভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি শেয়ারবাজার ততটা বুঝি না।'
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'শেয়ারবাজার স্থিতিশীল রাখতে যা যা করার দরকার, সরকার তা করছে। একটা তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সে কারণে অনেক কথা বলার থাকলেও বলা ঠিক হবে না। তাই এখন বললাম না। যা করার আমরা করে যাচ্ছি। কেন এমন হলো তা খতিয়ে দেখছি। কারা ভাঙচুর করল, এগুলোও খুঁজে বের করতে হবে।'
২০০৮ সালে তাঁর নির্বাচনী বক্তব্য নিয়ে বিরোধী দল অপপ্রচার চালাচ্ছে_এ অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'তারা প্রচারণা চালাচ্ছে, আমরা নাকি নির্বাচনের আগে ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর কথা বলেছি। ওরা (বিএনপি) যখন চালের দাম ১৮-২০ টাকায় নিয়ে গিয়েছিল, ছিয়ানব্বই সালে সেটাকে ১০ টাকায় নিয়ে আসার কথা বলেছিলাম। ক্ষমতায় এসে আমরা পাঁচটি বছর চালের দাম ১০ টাকায় রেখেছি। পরে তারা ক্ষমতায় এসে সেই চাল ১০ টাকা কেজি ধরে রাখতে পারল না কেন? জনগণের কাছে তার জবাব দিতে হবে। তারা ১০ টাকা কেজি ধরে রাখতে পারলে তো এখন মানুষকে ৩৫-৩৬ টাকায় চাল খেতে হতো না। মানুষকে আজ কষ্ট পেতে হতো না।'
চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে খেলা চলছেই_মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় চালের দাম ছিল ৪০-৪৫ টাকা কেজি। আমরা তা ১৮-২০ টাকায় নামিয়ে আনি। পরে কৃষকদের ন্যায্যমূল্যের কথা চিন্তা করে ২৫ টাকা করি। আমরা এক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। বেশি দামে চাল কিনে মানুষকে কম দামে খাওয়াচ্ছি।'
খাদ্যশস্যের বর্তমান মজুদ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আমরা উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মজুদ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। মজুদ ঠিক রাখার লক্ষ্যে ভিয়েতনাম থেকে দুই লাখ, থাইল্যান্ড থেকে দুই লাখ, ভারত থেকে তিন লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করছি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন চাল ও ৪ দশমিক ৩৫ টন গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। মিয়ানমার ও রাশিয়া থেকে 'সরকার টু সরকার' চাল ও গম আমদানির আলোচনা চলছে। বর্তমানে আমাদের আট লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন মজুদ রয়েছে। দুই লাখ মেট্রিক টন বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে। জাহাজীকরণেও কিছু রয়েছে। সব মিলিয়ে ১২-১৪ লাখ টন চাল ও গম মজুদ হবে।"
এর আগে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের লিখিত প্রশ্নের উত্তরে সংসদ নেতা জানান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মূল্য পরিস্থিতি এবং অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন রপ্তানিকারক দেশগুলোতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিবেচনায় রেখে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন বন্দরের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী খালাসের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্টকহোল্ডার যথাক্রমে ব্যবসায়ী সংগঠন, এফবিসিসিআই, পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে যৌথ ও পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমদানিনির্ভর পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে মূল্য নির্ধারণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বাজার মনিটরিং টিম নিয়মিত বাজার অভিযান পরিচালনা করছে। টিসিবির আইনি কাঠামো সংশোধন, জনবল বৃদ্ধি ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিও ব্যবস্থার পরিবর্তে ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পদ্ধতি প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

মহাস্থানগড় রাতের আঁধারে তছনছ

য়েক দফায় আদালত নিষেধাজ্ঞা দিলেও বগুড়ার মহাস্থানগড়ে খননকাজ বন্ধ হয়নি। পুরাকীর্তি ধ্বংসও চলছে অবিরত। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিতে এখন রাতের আঁধারে সেখানে কাজ চলছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে মহাস্থানগড়ের মূল মাজার এলাকায় উঁচু স্থানের ওপর ১৪০০ থেকে ১৫০০ শতাব্দীর পুরনো পুণ্ড্র গেট 'পুণ্ড্র নগরীর প্রবেশদ্বার' এলাকায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়।

রাতে শ্রমিক লাগিয়ে মাজার উন্নয়ন কমিটির পক্ষে এই খননকাজ চালানো হয়। খননের সময় সেখানে অমূল্য ব্ল্যাক স্টোন, প্রাচীন ইট, টেরাকোটা, মূর্তির ভাঙা অংশ বেরিয়ে এলে সেগুলো পাশেই একটি স্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। গতকাল বুধবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা মাটি খুঁড়ে নিদর্শনগুলো উদ্ধার করেন। তাঁরা জানান, রাত ১২টার পর শ্রমিক লাগিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। মূল মসজিদ থেকে ১৫ ফুট দূরের এই অংশটি নামাজের স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে সেখানে খননকাজ করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। অথচ ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে সব ধরনের খননকাজ বন্ধ এবং ওই স্থানটি সংরক্ষণের জন্য হাইকোর্ট থেকে দুই দফা নির্দেশনা এসেছে।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাইট পরিচালক রেজাউল করিম জানান, তিনি মাজার এলাকার দায়িত্বে রয়েছেন। সেখানে এর আগেও অন্ধকারে খননকাজ হওয়ায় প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁকে ডিউটি করতে হয়। মঙ্গলবারও রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি ডিউটি করেছেন। তখন সেখানে কোনো শ্রমিক ছিল না। তিনি চলে যাওয়ার পর গভীর রাতে শ্রমিকরা কাজ করে। কারণ সকালে এসে তিনি পুণ্ড্র গেটসংলগ্ন স্থানে বালি বিছানো দেখতে পান। পরে আশপাশের লোকজনকে (যাঁরা রাতে অবস্থান করেন) জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সেখানে রাতে শ্রমিকরা খনন কাজ করেছে।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) নাহিদ সুলতানা কালের কণ্ঠকে জানান, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, যারা খনন কাজ করেছে তারা প্রথমে চিন্তা করেনি সেখানে প্রাচীন পুরাকীর্তি থাকতে পারে। পুরনো নিদর্শন বের হয়ে আসতেই সেগুলো রাতেই সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। আগে খনন করা একটি গর্তের মধ্যে নিদর্শনগুলো মাটি চাপা দেয় তারা। গতকাল সকালে নতুন মাটি দেখে সন্দেহ হলে তারা মাটি সরিয়ে ব্ল্যাক স্টোন, প্রাচীন ইট, টেরাকোটা ও মূর্তির ভাঙা অংশ উদ্ধার করেন। এ ঘটনার পর থেকে মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনাটি প্রকাশ না করতে তাঁদের মাঠকর্মীদেরও বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, বারবার খননের জন্য টার্গেট করা স্থানটির নিচেই লুকিয়ে আছে পুণ্ড্র নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভবন। কারণ মূল মাজার ও মসজিদসংলগ্ন টিলার মতো উঁচু জমিটি মূল পুণ্ড্র নগরীর অংশ। এখানেই থাকতেন রাজা এবং তাঁর লোকজন। ফলে রাজপ্রাসাদ ও প্রশাসনিক ভবন এখানেই থাকার কথা। তবে জমিটি মাজার কমিটির হলেও এর প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্ব নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগের। এখানে ইচ্ছে করলেই কেউ খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু তাঁদের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাতের আঁধারে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালানো হচ্ছে। নাহিদ সুলতানা জানান, তিনি ঘটনাটি দেখার পর এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছে।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুণ্ড্র নগরীর একেবারে হার্ডপয়েন্টে হজরত শাহ সুলতান বলখি (রা.)-এর মাজারের পশ্চিম পাশে ২০ ফুট বাই ১০ ফুট এলাকায় খনন কাজ করা হয়। রাতে খনন কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন সোলেমান আলী। তাঁর বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। তিনি জানান, রাতে শ্রমিকরা যখন কাজ করে তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন জেনেছেন, উলি্লখিত স্থানে নামাজের জায়গা করার জন্য টাইলস বসানো হবে। এরপর বেশ কিছু পাথর ও ভাঙা ইটের অংশ সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতেও তিনি দেখেছেন। স্থানীয় ভিক্ষুক মোকারম বলেন, 'শুনিচনু এটি বলে আর কাম হবি না। কিন্তুক আত্রে ক্যামা কাম করিচ্ছে। তালে ব্যান কিছু একটা করবি। হামাকেরে একটা থ্যাকার জ্যাগা লাগবি। সেডা করলে ভালোই হলোনি।'
গর্ত খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের একজনের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে জানায়, রাতে সেসহ ১০ শ্রমিক কাজ করে। মজুরি নিয়েছে ২০০ টাকা করে। সে আরো জানায়, তাদের কাছে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা আড়াই হাজার বছর আগের নিদর্শনের কোনো দাম নেই। এ কারণে তারা ভেঙে ফেলছে অবলীলায়।
মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ জানান, তাঁরা আদালতের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। কাজেই সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। বাইরের কেউ এই কাজ করতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জিন্নাহ জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর জানা নেই। কাজেই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছেন না। তবে উলি্লখিত স্থানটিতে তাঁরা বালি ফেলে রেখেছিলেন মসজিদের ভেতরে কাজ করার জন্য বলে তিনি স্বীকার করেন। মহাস্থান মাজার কমিটির সভাপতি বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি বিষয়টি জানেন না। কারা খুঁড়ল, এটা খুঁজে বের করতে শিবগঞ্জ থানার ওসিকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
উল্লেখ্য, এর আগেও কয়েক দফা মহাস্থানগড় এলাকায় খনন করে পুরাকীর্তি ধ্বংস করার কয়েকটি প্রতিবেদন কালের কণ্ঠে প্রকাশ করা হয়। এরপর হাইকোর্টের রায়ে ঐতিহাসিক এই স্থানে নির্মাণ কাজ বন্ধ করাসহ মহাস্থানগড় সংরক্ষণ কমিটি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পরও ধ্বংসযজ্ঞ থামেনি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য মতে, অতি প্রাচীনকালে বগুড়ার মহাস্থানগড় একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্র ছিল। এই স্থানটি ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ছাড়াও আন্তপ্রাদেশিক বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ১৫ শতক পর্যন্ত এই সমৃদ্ধ নগরী একটি সমৃদ্ধ জনপথ সৃষ্টি করেছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থানটি বিখ্যাত মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন এবং অন্যান্য হিন্দু সামন্ত রাজারা প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষই এখন বগুড়া জেলার একটি গৌরবোজ্জ্বল সম্পদ।