Thursday, February 10, 2011

বিধবার ৬০ কোটি টাকার জমি সাকার দখলে

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে এবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অসহায় এক বিধবার ৩০ কাঠা জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। বিগত জোট সরকারের সময় দলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসী দিয়ে জমির মালিক ও তাঁর লোকদের উচ্ছেদ করে তাতে কিউসি প্রপার্টিজ লিমিটেডের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন সাকা চৌধুরী।

দখলে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি আনসার বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জমির মালিক নাজমা বেগম। বর্তমানে ওই জমির একাংশে আনসারের তেজগাঁও থানা অফিস স্থাপন করা হয়েছে। দখল করা জমির নিরাপত্তা দিচ্ছেন ১০ জন আনসার সদস্য। সাকার অবৈধ স্বত্ব টিকিয়ে রাখতে সশস্ত্র আনসার বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন ১/ই ও ৩/৩, দক্ষিণ বেগুনবাড়ী (এফডিসি-সংলগ্ন পূর্ব পান্থপথ) নামক স্থানে ৩০ কাঠা জমির মালিক নাজমা বেগম। তিনি এই জমি সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ডে মালিক আব্দুস সোহবান বেপারীর কাছ থেকে সাফ কবলা দলিলমূলে প্রায় ৩০ বছর আগে কিনেছিলেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। সর্বশেষ মহানগর জরিপেও জমির মালিক হিসেবে নাজমা বেগমের নাম রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। সেখানে দোকানপাট ও গাড়ির শোরুম নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছিলেন তিনি। বিগত জোট সরকারের সময় জাল দলিল করে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাকা চৌধুরী জমিটি দখল করে নেন বলে অভিযোগ করেন নাজমা বেগম। সে সময় থানা-পুলিশ, আদালত ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা আনসার কর্মকর্তা আলীম জানান, আনসার হেডকোয়ার্টার ও মহানগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশেই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সাকা চৌধুরীর দাবি করা জমির নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ওই জমি দখলে নিলেও সাকা চৌধুরী সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারেননি। এমনকি সীমানা-প্রাচীরও নয়। প্রয়োজনীয় পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে না পারায় আনসারের পক্ষ থেকে কিউসি প্রপার্টিজকে একাধিকবার নোটিশ দেন জেলা কমান্ড্যান্ট। এ ছাড়া গত বছরের ১৯ এপ্রিল আনসারের পক্ষে প্লাটুন কমান্ডার মো. আব্দুল খালেক এ সম্পত্তি থেকে ফোর্স প্রত্যাহারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিলেও তা কার্যকর হয়নি। ওই চিঠিতে আনসারের অস্ত্র নিরাপদ নয়_এমন কথাও বলা হয়েছে।
পাহারারত ১০ সদস্যের আনসার দলের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) আবদুস সাত্তার জানান, জমির মালিকানা-স্বত্ব সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। তবে শুনেছেন, চট্টগ্রামের সাকা চৌধুরীর পারিবারিক কম্পানি কিউসি প্রপার্টিজ এ জমি গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়েছে। যদিও লিজের জমিতে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা করতে পারেনি তারা। তিনি বলেন, কম্পানি আনসারদের জেনারেটর, এলপি গ্যাস ও পানি কেনার টাকা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য জানান, সঠিক দলিলপত্র ও জমির স্বত্ব না থাকার কারণে কিউসি প্রপার্টিজের পক্ষে এসব সংযোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট মো. ঈশান আলী রাজা কিউসি প্রপার্টিজের কম্পানি সেক্রেটারি বরাবর লেখা এক চিঠিতে সেখানে আনসার ক্যাম্প রাখা আনসারের নীতিমালা পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যার কথা উল্লেখ করে গত ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব সমস্যা সমাধান না হলে ১১ ডিসেম্বর আনসার প্রত্যাহার করা হবে বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আনসার প্রত্যাহার করা হয়নি।
নাজমা বেগমের পরিবারের লোকজন বলেন, একটি অসহায় পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পক্ষে আনসারের সরকারি অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ বর্তমানে সরকারের নির্দেশে দেশের সব বিরোধপূর্ণ জমির নিরাপত্তায় থাকা আনসার বাহিনীর অস্ত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে খোদ আনসার কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন। তাঁরা আরো জানান, দখলের আগে ওই জমিতে নাজমা বেগমের নামে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের লাইন ছিল। পরে তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দখল হয়ে যাওয়া জমি থেকে এসব লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়।
নাজমা বেগমের ভাতিজা বাহার অভিযোগ করেন, প্রশাসনের কেউ কেউ এখনো যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পক্ষে কাজ করছেন। জমি দখলে নেওয়ার জন্য সাকা চৌধুরীর লোকজন নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মিথ্যা মামলা করেছে। এর মধ্যে জমির সঠিক দলিল উপস্থাপন ও আদালতে হাজির না হওয়ার কারণে ছয়টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে। বর্তমানে ৯টি মামলা বিচারাধীন।
নাজমা বেগম অভিযোগ করেন, বিগত জোট সরকারের সময় সাকা চৌধুরী একবার তাঁকে মতিঝিলের অফিসে ডেকে এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার হুমকি দিয়ে বলেন, 'কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিই, জমির দাবি থেকে সরে যান।'
তেজগাঁওয়ের কিউসি প্রপার্টিজের দখলে থাকা এ জমি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন কম্পানির মহাব্যবস্থাপক মানিক রতন রায় ও ব্যবস্থাপক এমদাদুল হক। দখলে থাকা জমির স্বত্ব-মালিকানা প্রসঙ্গে তাঁরা জানান, ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক সাকা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান কিউসি প্রপার্টিজ। কিন্তু জমি কিভাবে কেনা হয়েছে, সেই দলিলপত্র ও রেকর্ড-পর্চা দেখতে চাইলে পরে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সেসব কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত জোট সরকারের সময় সাকা চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে জমিটি দখল করার পর প্রচার করেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে শিল্প প্লট হিসেবে তা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেখানে ফ্ল্যাট নির্মাণের সাইনবোর্ড টাঙানোর বিষয়টি জানতে চাইলে কিউসির কর্মকর্তারা কোনো জবাব দিতে পারেননি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'একজন যুদ্ধাপরাধীর দখল করা জমিতে তেজগাঁও থানা আনসার অফিস স্থাপনের বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর। একদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আদালতে সাকা চৌধুরীর বিচার হচ্ছে, অপরদিকে তাঁরই দখল করা সম্পত্তি রক্ষায় কাজ করছে আনসার!'
তেজগাঁও থানা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা শরীফ রেজানুল হক বলেন, বারবার চিঠি দিয়ে জানানো সত্ত্বেও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের অফিস থেকে আনসার প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সুবিধা না থাকায় বর্তমানে তাঁদের মানবেতর অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে আনসার সদস্যরা জানান।
কিউসি প্রপার্টিজের মহাব্যবস্থাপক রতন মানিক রায় বলেন, জমিটি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক কম্পানির জন্য মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে কেনা হয়েছে। তিনি এরশাদ সরকারের সময় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জমিটি দীর্ঘ মেয়াদে বরাদ্দ নিয়েছিলেন। জমির রেকর্ড সূত্রে মালিক সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। এটি সরকারের অধিগ্রহণ করা জমি বলে তিনি দাবি করেন। ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তি কিভাবে অধিগ্রহণ হলো এবং অধিগ্রহণের মামলা নম্বর কত, জানতে চাইলে তিনি এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বেগুনবাড়ী মৌজার বেশ কিছু জমি নিচু এলাকার অন্তর্ভুর্ক্ত ছিল। একসময় সেখানে ধান ও মাছের চাষ হতো, যার সঙ্গে তেজগাঁও শিল্প এলাকার কোনো সম্পর্ক নেই। বিগত এরশাদ সরকারের সময় নিচু জমিগুলো ভরাট করে বরাদ্দের নামে কিছু প্রভাবশালী লোক দখল করে নেয়।

No comments:

Post a Comment