Thursday, February 10, 2011

পাট জিনোমের আঁতুড়ঘর by সমুদ্র সৈকত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালে। পাটের জিনোম আবিষ্কারের জন্য সিকোয়েন্সিং উপযোগী ডিএনএ তৈরি করা হয়েছিল এই গবেষণাগারেই। ৮৮-র বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষকরা। পাটবীজশূন্য হয়ে পড়েছিলেন চাষিরা। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আনা নিম্নমানের বীজের কারণে পরের বছরও লাভের মুখ দেখেননি তাঁরা।

এ সময় ডিএনএর সাহায্যে পাটবীজ শনাক্ত করার কাজে এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান। গবেষণা শুরু করেন সোনালী আঁশ নিয়ে। নিজ হাতে গড়ে তোলা মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চালিয়ে যান নিরলস গবেষণা। তাঁর হাতেই দেশে প্রথম পাটের জিন নিয়ে গবেষণা শুরু। ২০০০ সালে ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে পাটের জাত নির্ণয় করাই এ গবেষণাগারে পাওয়া প্রথম সাফল্য। এ ছাড়া 'টিস্যু কালচার অনির্ভর পদ্ধতি' উদ্ভাবন করে জেনেটিক ট্রান্সফরমেশনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনাও সম্ভব হয়েছে এখান থেকে। ল্যাবপ্রধান অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, 'এখন গবেষণা চলছে লবণ সহনশীল পাট উদ্ভাবন নিয়ে। এছাড়া পাটের আঁশের পুরুত্বের জন্য লিগনিন নামের যে উপাদানটি কাজ করে, সেটার পরিমাণ কমানো নিয়েও কাজ চলছে।'
গবেষণার জন্য পাটের নমুনা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। এ জন্য নমুনা টিস্যুকে নির্দিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যসহ বিক্রিয়া ঘটিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। এতে দ্রবণের ডিএনএর সঙ্গে কিছু অপদ্রব্য থেকে যায়। এ জন্য ফেনল, ক্লোরোফর্ম ও আইসো-অ্যামাইল অ্যালকোহল নামের রাসায়নিক যোগ করা হয়। এরপর তলানি সংগ্রহ করে তাতে ৭০ শতাংশ ইথানল যোগ করে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। বিশুদ্ধ ডিএনএকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়।
নমুনাকে প্রাইমার, ডিএনটিপি, ট্যাক পলিমারেজ এবং অন্য উপাদানসহ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) করা হয়। এর মাধ্যমে সামান্য পরিমাণ ডিএনএ থেকে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়ে বেশি ডিএনএ পাওয়া যায়। পিসিআর থেকে প্রাপ্ত কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ খণ্ডকে পরে জেল ইলেক্ট্রোফোরেসিস নামক একটি পৃথকীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে আলাদা করা হয়।
নির্দিষ্ট আকারের কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ ব্যান্ডকে রঞ্জিত করা হয়। এই রঞ্জক ব্যবহারের পর অতিবেগুণী রশ্মির মাধ্যমে ডিএনএ খণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় গবেষকরা নিরাপদ চশমা ব্যবহার করতে ভুল করেন না। ইদানীং এ কাজে জেলডক সিস্টেম ব্যবহারের ফলে গবেষণার কাজ আরো সহজ হয়েছে। ন্যানো ড্রপ ব্যবহার করে প্রতি মাইক্রোলিটারে কী পরিমাণ ডিএনএ আছে, তাও চট করে জান যাচ্ছে।
গবেষণার কাজে সব সময়ই বিশুদ্ধ পানির দরকার। ল্যাবের উন্নত ডিস্টিলড ওয়াটার প্ল্যান্ট সেই চাহিদা পূরণ করে। শিক্ষার্থীদের জীবাণুমুক্ত পরিবেশে কাজ করার প্রয়োজন হলে ছুটে যান ল্যামিনার এয়ারফ্লো ক্যাবিনেটে। আর নমুনা জীবাণুমুক্ত করতে তাঁরা ব্যবহার করেন অটোক্লেভ মেশিন।
এ ছাড়া পাটের জিনোমে কোনো নির্দিষ্ট ডিএনএ খণ্ড আছে কি না কিংবা থাকলে এই খণ্ডের সংখ্যা কত, তা নির্ণয় করার জন্য সাউদার্ন ব্লট নামক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কাঙ্ক্ষিত জিনের প্রকাশ ঘটছে কি না, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করার জন্য আছে নর্দার্ন ব্লট।
বর্তমানে পাটের জন্য উপকারী বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণের কাজ চলছে এই ল্যাবে। উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবনের জন্য জেনেটিক ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে বিশেষ জিনের প্রকাশ ঘটানোর কাজ এগিয়ে চলেছে।
এখানে মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা গবেষণার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক মানের এই ল্যাবে ছুটে আসেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গবেষকরাও।
ল্যাব ম্যানেজার ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট সাজিয়া শারমিন জানান, আরো উন্নত গবেষণার জন্য ল্যাবে খুব শিগগিরই মাইক্রো-অ্যারে স্ক্যানার, রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিন এবং টু-ডি জেল ইলেক্ট্রোফোরেসিস মেশিন সংযোজন করা প্রয়োজন।
'মলিকিউলার বায়োলজির গবেষণায় ধৈর্য প্রয়োজন'_জানালেন গবেষক রাজীব আহমেদ। শিক্ষার্থী নূরুন্নাহার ফ্যান্সি তাঁর গবেষণা কাজের ফাঁকে বললেন, 'গবেষণায় কোথাও আটকে গেলে বড় ভাইয়া ও আপুরা আগ্রহ নিয়ে দেখিয়ে দেন। শিক্ষকরা তো আছেনই।'
বাংলাদেশে পাট গবেষণার অন্যতম কর্ণধার ড. হাসিনা খানের নেতৃত্বাধীন এ মলিকিউলার বায়োলজি গবেষণাগারটির সুবাদেই হয়তো দেশের পাট গবেষণা এগিয়ে যাবে অনেক দূর। সেই সঙ্গে পুনরুজ্জীবিত হবে দেশের লুপ্তপ্রায় পাটশিল্পও।

No comments:

Post a Comment