Tuesday, September 27, 2011

বদনামের শেষ নেই এমপি বদির by বিপ্লব রহমান ও তোফায়েল আহমেদ

বাংলাদেশের দক্ষিণে একদম শেষ প্রান্তের সাগর-পাহাড়-বনভূমিঘেরা সুন্দর জনপদটি এখন বিষে জর্জরিত। এ বিষ ছড়িয়েছেন সেখানকার খোদ সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি। তাঁর বদনামের শেষ নেই এলাকায়। টেকনাফ ও উখিয়া নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ সংসদীয় আসন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে এমপি বদির চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার দাপটের নজিরবিহীন সব কাণ্ড। তাঁর অপকর্মে এলাকাবাসী এখন অসহায়। বিরোধিতা করলেই নেমে আসে নির্যাতন। এমপি নিজেই মারধর করেছেন সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেককেই।
জানা গেছে, এমপিকে চাঁদা না দেওয়ায় শাহপরীর দ্বীপরক্ষা বাঁধের ঠিকাদার লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। সেই বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় ১০টি গ্রাম। আরো জানা গেছে, টেকনাফের সরকারি স্থলবন্দর, মিয়ানমারের চোরাই পণ্য খালাসের ঘাট, দমদমিয়ার বেসরকারি জাহাজঘাট ও সেন্ট মার্টিনের ঘাটের টোল আদায় থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য_সর্বত্রই রয়েছে এমপি বদির ভাগ। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের ভোট হাতিয়ে নিতে জঙ্গি সম্পৃক্ত একটি সন্দেহজনক এনজিওকে তিনি তোষণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাঁর স্বাক্ষরিত ৭৫ হাজার পরিচয়পত্রে চলছে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ।
এমপি বদির নামে বিভিন্ন সময় খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, সন্ত্রাসসহ নানা অভিযোগে মোট ২৩টি মামলা হয়েছে। অবশ্য তিনি এমপি হওয়ার পর সন্ত্রাসের দু-তিনটি মামলা বাদে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। দুর্নীতিবাজের তালিকায়ও তাঁর নাম উঠেছে। এক-এগারোর জরুরি সরকারের সময় জেলও খেটেছেন তিনি। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরাও এখন কোণঠাসা। প্রকাশ্যেই নেতারা এমপি বদির অনিয়ম-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিক মিয়া ও উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আদিল উদ্দীন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এমপি বদি দলের নীতি, আদর্শ ও সততার রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বন্দর দখল, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এমপি হওয়ার পর তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। এ ধরনের লোক দলকে ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। লুটপাট ও সন্ত্রাসই এমপি বদির শেষ কথা। দলের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও তিনি ভয়ংকর।
তবে এমপি আবদুর রহমান বদি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁর সুনাম নষ্ট করার জন্যই একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা অবনতির সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমি রাজনীতি বুঝি না, দল বুঝি না, আমি দলীয় নেতা-কর্মীদেরও বুঝি না। আমার এলাকার ৭৫ হাজার লোককে ত্রাণের মাধ্যমে খুশি রাখতে পারলেই আমার রাজনীতির ষোলো আনা পূর্ণ।'
কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, গত মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের মতবিনিময় সভায় মো. শফিক মিয়া ও আদিল উদ্দীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এমপি বদির নানা কীর্তিকলাপ তুলে ধরেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তাঁরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমপি বদি হয়ে উঠেছেন আরো বেপরোয়া।
এ বিষয়ে এমপি বদি বলেন, 'তাঁরা যে অভিযোগ করেছেন, তা সবই তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত। এগুলো দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের বক্তব্য নয়।'
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এইচ কে আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, এমপি বদির উত্থান আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে নয়। তাই দলীয় নীতি-আদর্শ নিয়ে তিনি মোটেই চিন্তিত নন। তিনি মারধর, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও চোরাচালান করে দলকে তছনছ করে ফেলেছেন। টেকনাফ বন্দরকে এমপি বদি ব্যক্তিগত বন্দরে পরিণত করেছেন। তিনি বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নিয়ে টেকনাফ বন্দর দখল করেছেন। এ ছাড়া তাঁর পরিবারের সদস্যরাও বন্দর ও ঘাটের সব বৈধ-অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের লোকজন কাছে ঘেঁষতে পারে না।
টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, এমপির দাপটে ঐতিহ্যবাহী পর্যটন নগরী টেকনাফ এখন পর্যটনশূন্য। টেকনাফের বদলে দমদমিয়া থেকে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজগুলোকে চলাচলে এমপি বদি বাধ্য করছেন বলে এখানে পর্যটকরা একেবারেই আসছে না। কারণ দমদমিয়া দিয়ে জাহাজ চলাচলের আয়ে এমপির 'বাড়তি কমিশন' রয়েছে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে বদি এমপির নানা অপকর্মের কথা।
শাহপরীর দ্বীপের দুঃখ : টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ায় বেড়িবাঁধের ৬৬০ মিটার ভাঙা অংশ মেরামত এবং বাঁধের একপাশে সিসি ব্লক বসানোর জন্য চলতি বছর দরপত্র আহ্বান করা হয়। চার কোটি ৭৫ লাখ টাকায় কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'মেসার্স উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল'। ৩০ জুন ছিল কাজ শেষ করার শেষ সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিকাদার কাজই শুরু করতে পারেননি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে শাহপরীর দ্বীপের ১০টি গ্রামের কয়েক শ ঘরবাড়ি প্লাবিত হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানির আশঙ্কায় চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
মেসার্স উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আতিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে কার্যাদেশ পাওয়ার পরপরই প্রকল্প এলাকায় নির্মাণসামগ্রী মজুদ করা হয়। শতাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে কাজও শুরু করা হয়। তিন দিন পরই এমপি বদির লোকজন মোটা অঙ্কের চাঁদার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দেয় এবং প্রকল্প এলাকা থেকে শ্রমিকদের তাড়িয়ে দেয়। ঠিকাদার আতিকুল বলেন, এরপর এমপি বদির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়ে দেন, চাঁদা না দিলে তাঁর এলাকায় কাজ করতে দেওয়া হবে না। এমপির চাঁদা দাবির বিষয়টি লিখিতভাবে গত ২২ মে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারকে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সমাধান না হওয়ায় তিনি কাজ শুরু করতে পারছেন না।
তবে এমপি আবদুর রহমান বদি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম ২০১০ সালে এখানে চার কোটি ৪০ লাখ টাকার কাজ করেছিলেন। কিন্তু বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করায় সেটি স্থায়ী হয়নি, যা এখন সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে একই প্রতিষ্ঠানকে আবার চার কোটি ৭৫ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ জানায়। এরপর ঠিকাদার কাজ না করে পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গত ১৭ জুন জেলা প্রশাসক মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইনুদ্দীন এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা শাহপরীর দ্বীপের ওই ভাঙা বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে যান। এ সময় এলাকাবাসী তাদের দুর্ভোগের কথা জানায়। এরপর ঘটনাস্থলে হাজির হন এমপি বদি। তিনি ঘটনাস্থলেই ঠিকাদার আতিকুল ইসলামের হাত ধরে টানাটানি করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ তোলেন। জবাবে ঠিকাদার তাঁকে জানান, এর আগে তিনি বেড়িবাঁধে ব্লক ফেলার কাজ পেয়ে তা সুষ্ঠুভাবে শেষ করেছেন, বাঁধ নির্মাণ তাঁর কাজের এখতিয়ারভুক্ত নয়। পরে টেকনাফে পাউবোর অতিথিশালায় জেলা প্রশাসকের বৈঠকটি চাঁদা চাওয়া না-চাওয়ার প্রশ্নে উভয়ের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে ভণ্ডুল হয়ে যায়।
সন্ত্রাস ও দখলবাজি : অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ স্থলবন্দর, হাট-বাজার, ঠিকাদারি, পরিবহন, পর্যটকবাহী জাহাজ, টার্মিনাল, জেটিসহ সীমান্ত চোরাচালান ব্যবসা পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি বদি। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছোট ভাই আবদুল আমিন। এখন আবদুল আমিনের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনাফ বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। আমিন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তিনি ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
এমপির অন্য তিন ভাই মৌলভী মজিদ, আবদুস শুকুর ও মো. শফিকও বন্দরের কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এমপি বদির দুই ভগি্নপতি শওকত আলী ও আবদুল গফুর এবং আরেক ভগি্নপতি রাউজান থানার ওসি আবদুর রহমানের ছেলে নিপু, ফুপা হায়দার আলীও বন্দর ব্যবসা করছেন। এমপির চাচা মোজাহের কোম্পানি বন্দরের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এমপির নিজস্ব বন্দর বলে খ্যাত অবৈধ কাইয়ুকখালী ঘাটের চিংড়ি মাছ, কাঠ, ফলমূল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর আরেক ভগি্নপতি গিয়াস উদ্দীন ও ফুফাতো ভাই সৈয়দ আলম। এমপি তাঁর প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা মালামাল অবৈধভাবে এ ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। এই বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটি মালবাহী নৌকা ও ট্রাকের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা। এ ছাড়া উখিয়া থানা প্রশাসন চলছে এমপির দুই শ্যালক হুমায়ুন কবির মন্টু ও জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর ইশারায়।
অন্যদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের চাহিদা পুঁজি করে জাহাজ জেটিতে চলে চাঁদাবাজি। ফলে পর্যটকদের খরচ অনেক বেড়ে যায়। টেকনাফের কয়েক কিলোমিটার আগে দমদমিয়ায় একটি অবৈধ বেসরকারি জেটি দিয়ে পর্যটকরা এখন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়া-আসা করে। 'কেয়ারি সিন্দাবাদ' নামের একটি মাত্র জাহাজ দমদমিয়া ঘাট থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত মাত্র ৩৬ কিলোমিটার যাওয়া-আসার ভাড়া নেয় সাড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ সরকারি হিসাবে ভাড়া প্রতি কিলোমিটার মাত্র এক টাকা ২০ পয়সা। উপরন্তু এসব জাহাজ ভাড়ার সঙ্গে পর্যটকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫০ টাকা করে 'বাড়তি কমিশন' আদায় করেন এমপি বদির লোকজন। অভিযোগ আছে, অবৈধ ব্যবসাটি টিকিয়ে রাখতে তিনি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল চালু করছেন না। ফলে টেকনাফ এখন পর্যটনশূন্য হয়ে পড়েছে।
তবে এমপি বদি তাঁর পরিবারের মাদক, চোরাচালান ও চাঁদাবাজির সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে এলাকায় আমাদের সুনাম রয়েছে। আমার পরিবারের সদস্যরা সবাই বৈধভাবে বহু বছর ধরে ব্যবসা করছেন। আমরা সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কর দিয়ে আসছি। রাজনৈতিক কারণে আমাকে হেয় করার জন্য বিভিন্ন মহল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।'
এদিকে 'অবাধ্যতার দায়ে' বিভিন্ন সময় এমপি বদি নিজেই মারধর করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছেন। গত সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর ২২ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধর করেন বদি। এরপর তাঁর হাতে প্রহৃত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া ভোটার তালিকা তৈরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফের প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক আবদুল জলিল ও পুলিন দে প্রহৃত হন বদি এমপির হাতে। টেকনাফের কুলালপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হাজি মোস্তফা, কক্সবাজারের সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম, উখিয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য রাখালচন্দ্র মিত্রও এমপির হাতে প্রহৃত হন। টেকনাফের সাবরাং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুফিজ উদ্দিন, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিনকেও মারধর করেছেন এমপি। গত ১৫ জানুয়ারি টেকনাফ পৌর এলাকায় এমপির চাচা হাজি ইসলামের নির্বাচনী সভার ভিডিও করার সময় কক্সবাজার সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুর রহমানকে ধরে এমপি বদি বেধড়ক পিটুনি দেন। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। সবশেষ গত ৩ জুলাই আবদুর রহমান বদি টেকনাফের শামলাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলমকে (৫২) প্রকাশ্যে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। আহত হওয়ায় পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে ছেড়ে দেয়। মঞ্জুর আলমকে উদ্ধার করতে গিয়ে শামলাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল্লাহ কোম্পানিও এমপির হাতে নাজেহাল হন। পরে আহত শিক্ষককে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সবার বড় বদি : আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার ছিলেন টেকনাফের এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। নিরাপত্তা বাহিনীর তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ চোরাচালানির ১২ জন স্ত্রীর ২৬ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবদুর রহমান বদি। জানা যায়, বাবার বিশাল চোরাই ব্যবসায় কিশোর বয়সেই হাতে খড়ি হয় তাঁর। বঙ্গোপসাগর দিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের টানেলখ্যাত টেকনাফের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ একসময় চলে আসে বদির হাতে। রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক।
১৯৯৬ সালের দিকে আবদুর রহমান বদি প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেন। সেই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে প্রথমে বিএনপির টিকিটে মনোনয়ন পাওয়ার দেনদরবার করেন। ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। একই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও পরে দলের পক্ষ থেকে তা বাতিল করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১২ জুনের নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক মো. আলী নির্বাচিত হন। নির্বাচিত এমপির ছত্রচ্ছায়ায় উখিয়া-টেকনাফের সব ধরনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসায় ব্যাপক সাফল্য আসে তাঁর। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে বদির অর্থ-বিত্ত ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে।
২০০০ সালের দিকে আওয়ামী লীগের সমর্থনে টেকনাফ পৌরসভার প্রশাসক হন বদি। তবে এক মাসের মাথায় দলীয় সিদ্ধান্তে তাঁকে অপসারণ করা হয়। ২০০৩ সালের পৌর নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে জয়ী হন বদি। একমাত্র জামায়াত দলীয় কমিশনারকে ১ নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান করায় দলীয় কমিশনাররা তাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় একের পর এক ধর্ষণ, খুন, মারামারি, নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় যৌথ বাহিনীর 'অপরেশন ক্লিন হার্ট'-এর সময় বদি ছিলেন পলাতক। জোট সরকারের শেষ সময়ে টেকনাফ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। এক-এগারোর জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেও তিনি এক দফা গ্রেপ্তার হন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি ডজন দুয়েক মামলা থেকে একে একে খালাস পান। তবে এখনো তাঁর বিরুদ্ধে দুই-তিনটি সন্ত্রাস-মারধরের মামলা রয়েছে।
'আমি সন্ত্রাসী নই, ব্যবসায়ী' : টেকনাফ বন্দর দখল, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের বিষয়ে এমপি বদি বলেন, 'বন্দর দিয়ে আসা ৮০ ভাগ মালই আমার। তাই আমি চাঁদাবাজি করব কিভাবে? আমি ব্যবসায়ী মানুষ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ নই। আমার পরিবারের সবাই বৈধ ব্যবসায়ী। মাদক বা অন্য কোনো চোরাচালানমূলক অপরাধের সঙ্গেও কেউ জড়িত নয়। প্রতিবছর আমরা সরকারকে বিপুল পরিমাণ কর দিই। '
এমপি বদি বলেন, 'টেকনাফ বন্দরের বেশির ভাগ ব্যবসাই মিয়ানমারের সঙ্গে। মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের বেশি বিশ্বাস করেন। এ কারণে তাঁরা বেশির ভাগ ব্যবসা আমার সঙ্গে করতেই আগ্রহী। তবে আমি তো কাউকে ব্যবসা করতে বাধা দিচ্ছি না। অন্যরা চাইলেই ব্যবসা করতে পারে।'
কাইয়ুকখালী নামে নিজের অবৈধ ও ব্যক্তিগত বন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক, অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ চোরাই মালামাল ঢোকার কথা অস্বীকার করে এমপি বদি বলেন, 'এ নামে আদৌ কোনো বন্দরই নেই। আমার ব্যক্তিগত কোনো ঘাটও নেই। টেকনাফের বেশির ভাগ তরুণ-যুবক ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।'
বিভিন্ন সময় অনেককে মারধর করার বিষয়ে জানতে চাইলে এমপি বদি বলেন, 'সব ঘটনা সত্য নয়। আপনারা অনেক খবরই জানেন না। নির্বাচনী ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধরের মামলটি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন, তাই আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। তবে সবশেষ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলমকে মারধরের যে খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ওই শিক্ষক নিজেই সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ। তিনি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। একজন স্কুলশিক্ষক কিভাবে বাজার কমিটির সভাপতি হন? তিনি শিক্ষক হয়ে কিভাবে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হন?'