Thursday, May 08, 2014

লাশ ডোবাতে ব্যবহার করা হয় রেশনের বস্তা? সেদিন যা ঘটেছিল by কামরুল হাসান

বন্দর গুদারাঘাট থেকে হঠাৎ উধাও নৌকা দুটি। প্রায় চার বছর ধরে এগুলো এ ঘাটেই বাঁধা ছিল। গতকাল বুধবার সকালে সেখানে এগুলো আর দেখা যায়নি। নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে এ নৌকাগুলো ছিল আতঙ্কের। মাঝেমধ্যে রাতের বেলা চোখবাঁধা লোককে তোলা হতো এসব নৌকায়। বন্দর এলাকার মানুষের ধারণা, নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যার পর ইটবাঁধা লাশগুলো নদীতে ডোবাতে এ নৌকা দুটিই ব্যবহার করা হয়েছিল। সে কারণেই এগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নৌকা দুটি সরকারি বাহিনীর লোকজন ব্যবহার করতেন।
এদিকে লাশের সুরতহালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, লাশের সঙ্গে যে বস্তায় ইট বাঁধা ছিল, সেই বস্তাগুলো সরকারি রেশনের জন্য ব্যবহার করা। বস্তায় সরকারি রেশনের সিলও রয়েছে। আর ওই বস্তায় যে ইটগুলো ভরা ছিল, সেই একই ধরনের ইট পাওয়া গেছে একটি বাহিনীর কার্যালয়ের পাশের নির্মাণাধীন ভবনে। নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর বন্দর গুদারাঘাটে পাশাপাশি বাঁধা আছে বিভিন্ন সংস্থার নৌকা। পুলিশেরও তিনটি নৌকা আছে। একই সারিতে ছিল র‌্যাবের দুটি বড় নৌকা। নৌকা চলাচলের জন্য সেখানে ছোট একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষও আছে। গতকাল সকালে সেটিও বন্ধ দেখা যায়। বন্দরের ইজারাদার ইকবাল জানান, নিয়ন্ত্রণকক্ষটি ২৪ ঘণ্টা খোলা ছিল। এখন নৌকাও নেই, কক্ষও বন্ধ।
র‌্যাবের নৌকার খোঁজ করতে শহরের ভেতরের কার্যালয়ে এলে সেখান থেকে জানানো হয়, ওই কার্যালয়ে কোনো কর্মকর্তা নেই। তিন কর্মকর্তা চাকরি হারানোর পর সব কর্মকর্তা এখন ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জ শহরে এখন বলতে গেলে র‌্যাবের কোনো কার্যক্রম নেই। র‌্যাবের কার্যক্রম আপাতত না থাকলেও এ বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম গতকাল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, র‌্যাব তাঁর স্বামীকে অপহরণ করেছে। কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলতে নূর হোসেনের সহায়তা নিয়েছে। লাশের ধরন দেখে তিনি এ ধারণা করেন বলে জানান। এ কথা বলার সময় স্থানীয় সাংবাদিকেরাও উপস্থিত ছিলেন। নজরুলের জীবনযাপন সম্পর্কে সেলিনা ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসী নূর হোসেন দেড় মাস আগে নজরুলকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এ হুমকির পর থেকে নজরুল খুব ভয়ে ভয়ে চলতেন। নজরুল তাঁকে বলতেন, র‌্যাব-পুলিশ নূর হোসেনের কেনা। প্রাণের ভয়ে তিনি মিজমিজির বাসা ছেড়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। দেড় মাস ধরে ঢাকাতেই ছিলেন। মামলার হাজিরার জন্য ২৭ এপ্রিল তিনি নারায়ণগঞ্জে আদালতে এসেছিলেন। আসার আগের দিন শামীম ওসমানকে তিনি বলেছিলেন, 'ভাই, একটু দেইখেন।'
সেলিনা জানালেন, নজরুল ১৭-১৮ জনের দল নিয়ে চলতেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাঁর লোক থাকতেন। প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর তাঁরা যোগাযোগ রাখতেন। ওই দিন আদালতে তাঁর সঙ্গে এসব লোক ছিল। সেলিনার অভিযোগ, র‌্যাব সদস্যরা আগে থেকেই নজরুলকে নজরে রাখছিলেন। আদালতের ভেতরে র‌্যাবের একজন সদস্য সাদাপোশাকে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করার সময় নজরুলের লোকজন তাঁকে সন্দেহবশত আটক করেন। ফতুল্লা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাবের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে পুলিশের কোর্ট পরিদর্শক তাঁকে জানিয়েছিলেন।
নজরুলের স্ত্রী আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে বের হয়ে স্টেডিয়াম পার হয়ে একটু দূরে গিয়ে নজরুল তাঁকে ফোন করে ঢাকায় যাওয়ার কথা জানান। এর পাঁচ মিনিট পর মনির নামের এক যুবক জানান, নজরুলসহ পাঁচজনের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পরে তিনি পাহারায় থাকা নজরুলের কয়েকজন সহযোগীকে সেখানে পাঠান। তাঁরা ফিরে এসে জানান, র‌্যাবের তিনটি গাড়ি এসে নজরুলের গাড়িটি গতিরোধ করে। তাঁরা প্রথমে গাড়ির সবাইকে মারধর করেন। এরপর জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এ সময় নজরুলের কাছে দুটি অস্ত্রও ছিল। ঘটনাস্থলে থাকা বালুশ্রমিকেরা এ দৃশ্য দেখেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বালুশ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, নজরুলকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি দেখেন, সামনে একটি গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ আদালতের একজন আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেন, নজরুলকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ফেলেন আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার। তিনি কোনো কথা না বলে অপহরণকারীদের গাড়ির পিছু নেন। একপর্যায়ে তাঁর গাড়ি অপহরণকারীদের তিনটি গাড়ির একটির সামনে এসে পড়ে। তখন পেছন থেকে একটি গাড়ি চন্দনের গাড়িতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে দেয়। চন্দন গাড়ি থেমে নামলে চালকসহ তাঁকে ওই গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। সবগুলো গাড়িই চলে যায় নারায়ণগঞ্জ শহরের দিকে। সেলিনা জানান, এ ঘটনা শুনে তিনি প্রথমে শামীম ওসমানের কাছে যান। শামীম ওসমান সব শুনে বলেন, নূর হোসেন এ কাজ করতেই পারে না। এভাবে তিনি অনেক সময় কাটান। তবে এ সময় শামীম ওসমান র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে কথা বলেন। সেলিনা মনে করেন, শামীম ওসমান ভালো করে নূর হোসেনকে বললে নজরুলের মৃত্যু হতো না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল জিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন শামীম ওসমান তাঁকে বলেন, নজরুলকে র‌্যাব-১১-এর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছেন। এ কথা শুনে তিনি শামীম ওসমানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি এটা কী করে জানলেন যে র‌্যাবই তাঁদের নিয়ে গেছে? জবাবে শামীম ওসমান বলেন, আদালতের লোকজন তাঁকে জানিয়েছেন, র‌্যাব-১১-এর লোকজন নজরুলসহ সবাইকে ধরে নিয়ে গেছেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, সবাইকে একটি 'টর্চার সেলে' নেওয়ার পর ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। এরপর মুখে গামছা ঢুকিয়ে দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও শ্বাসরোধের প্রমাণ মিলেছে। ওই সূত্রটি জানায়, সাতজনকে ওই দিনই মেরে ফেলা হয়। এরপর রাতের বেলা বড় নৌকায় করে লাশগুলো নেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীর নির্জন স্থানে। সেখানে নেওয়ার পর বুক-পেট চিরে প্রতিটি লাশের সঙ্গে ১৬টি করে ইট বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আর এ দলে ছিলেন ২০ জনের মতো। এঁদের মধ্যে সরকারি বাহিনীর সদস্যও ছিলেন বলে শোনা যাচ্ছে।

মোদি বনাম ভারত-লড়াই by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় @প্রথম আলো

আট দফায় লোকসভার ৫০২ আসনের ভোট শেষ হয়ে অপেক্ষা এখন শেষ পর্যায়ের। বাকি মাত্র ৪১ আসনের ভোট, ১২ মে যা অনুষ্ঠিত হবে। ১৬ মে জানা যাবে ভোটের ফলে কারা হাসছে। তার আগে নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়, ষোড়শ লোকসভা ভোট হয়ে দাঁড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদি বনাম অবশিষ্ট ভারতের লড়াই। একদিকে একজন ব্যক্তিবিশেষ, অন্যদিকে দেরিতে হলেও তাঁকে রোখার এক সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এটাই ভারতের এবারের সাধারণ নির্বাচনের বিশেষত্ব। চার মাস আগে বিজেপি নানা টালবাহানার পর আদর্শিক মিত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) সিদ্ধান্তের কাছে মাথা নুইয়ে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তখনো লড়াইটা এভাবে ভাগাভাগি হয়নি। তবে যত দিন গড়িয়েছে, সংঘ ও দলকে ছাপিয়ে মোদির মাথা ততই উঁচু হয়েছে এবং ক্রমে তিনি লড়াইকে ব্যক্তি বনাম সমষ্টিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। আজ সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপন কিংবা 'আউটডোর পাবলিসিটি', যেখানেই চোখ যায়, সর্বত্র একটাই স্লোগান, 'এবার, মোদি সরকার'। ১৯৯৮-৯৯ সালের ভোটেও এ রকম স্লোগান উঠেছিল, 'আব কি বারি, অটল বিহারি'। কিন্তু সেই ভোট এবারের মোদির মতো শুধুই বাজপেয়িকেন্দ্রিক ছিল না। অথচ এবারে প্রচারে মোদি ও দলীয় প্রতীক পদ্ম ফুল ছাড়া আর কারও উপস্থিতি সেভাবে চোখে পড়ে না। ব্যতিক্রম শুধু উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষেৗ। সেখানে মোদির সঙ্গে সহাবস্থানে রয়েছেন 'জীবন্মৃত' অটল বিহারি বাজপেয়ি, যাঁকে উপেক্ষা করার মতো ধৃষ্টতা মোদি এখনো অর্জন করেননি।
গতকাল বুধবার সাত রাজ্যের যে আসনগুলোতে ভোট হলো এবং ১২ মে যে রাজ্যগুলোতে ভোট আছে, সেগুলোর মধ্যে উত্তর প্রদেশে ৩৩, বিহারে ১৩, হিমাচল প্রদেশে চার ও উত্তরাখন্ডে পাঁচটি আসন রয়েছে। ক্ষমতায় আসতে হলে এই ৫৫টি আসনের অধিকাংশ বিজেপিকে কবজা করতে হবে। উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের ৩৩ আসনের মধ্যে ২০০৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র চারটি। কংগ্রেস ও বহুজন সমাজ পার্টি পেয়েছিল ১০টি করে। মোদির বারানসি থেকে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যই এই পূর্বাঞ্চলে আসন বাড়ানো এবং তার প্রভাব বিহারে ছড়িয়ে দেওয়া। সে লক্ষ্যে তিনি প্রচারের শেষবেলায় দুটি কৌশল নিয়েছেন। নিজের জাতিগত অনগ্রসর সত্তা ও চা বিক্রির অতীত পেশাকে বড় করে তুলে ধরে 'নিম্নবর্গীয় মানসিকতায়' নাড়া দিতে চেয়েছেন। পাশাপাশি অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ নতুন করে তুলে ধরেছেন। কেন? কারণ, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দলিতরা মায়াবতী ও অনগ্রসর মানুষ মুলায়মকে ছাড়া অন্যদের ভরসা করেন না। তাঁদের সঙ্গেই এত বছর ধরে লেপ্টে থাকতে বাধ্য হয়েছে অতি অনগ্রসর 'সাব কাস্ট'-এর মানুষজন, যাঁরা দলিত 'জাটভ' ও অনগ্রসর 'যাদব'দের দাপাদাপিতে সংকুচিত বোধ করেন। মোদি যেহেতু জাতিগতভাবে এই গোষ্ঠীভুক্ত, তাই সেই সত্তায় সুড়সুড়ি দেওয়ার রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন। এঁদের ভোট পেতেই বিজেপি জোট বেঁধেছে 'আপনা দল'-এর সঙ্গে, উত্তর প্রদেশে যাদের ১০-১২ শতাংশ ভোট আছে। ভোটের অনেক আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদির নিজের হাতে সাজিয়ে নেন প্রচারের ছকটা। সেই ছকে প্রত্যক্ষ প্রাধান্য পায় তাঁর 'গুজরাট মডেল', 'দৃঢ়কঠিন উন্নয়নমুখী' মানসিকতা এবং 'চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার' ক্ষমতা। অতিমাত্রায় গণতন্ত্রী না হয়ে দেশের স্বার্থে 'উপকারী একনায়ক' হয়ে ওঠাকেই ওই প্রচারে হাতিয়ার করা হয়। সেই সঙ্গে প্রাধান্য দেওয়া হয় মোদির একদা অতিদরিদ্র সামাজিক চরিত্রকে, যা এক বিপুল জনসমষ্টিকে 'আমরাও এমন হতে পারি' স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। প্রচ্ছন্নভাবে এই প্রচারের পাশাপাশি পরোক্ষে উসকানি দেওয়া হতে থাকে আর্যাবর্তের গো বলয়ের হিন্দুত্বসর্বস্ব মানসিকতায়। অর্থাৎ একদিকে 'ইয়ং ইন্ডিয়ানদের' বড় হওয়ার কল্পনায় সাত রঙের পোঁচ আর অন্যদিকে কট্টর হিন্দুদের রামমন্দির গড়ার স্বপ্নে বাতাস দেওয়া। বিজেপি খুব চতুরভাবেই এই দুই জনসমষ্টিকে জুড়ে দিল। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির নেতা ও মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য জাফরইয়াব গিলানি লক্ষেৗতে নিজের বাড়িতে প্রথম আলোকে বলেন, 'মোদি বিজেপির প্রচারকে বহুমুখী করতে পেরেছেন। এ কারণে এবার উত্তর প্রদেশে ৩৫-৪০টি আসন তিনি আশা করতেই পারেন।' প্রদেশ কংগ্রেসের বড় নেতা সত্যদেও ত্রিপাঠি কিংবা বীরেন্দ্র মদনও প্রতিপক্ষের এতগুলো আসন পাওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করেননি। তাঁদের ব্যাখ্যা: বিজেপির উচ্চবর্ণের ভোটব্যাংকের পাশে অনগ্রসর জাতিদের সমর্থন মিললে ও মুসলমান ভোটে বিভাজন হলে মোদির রণকৌশল সফল হতেই পারে।
লড়াই শুরুর আগে বিজেপির নজরে ছিল উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মোট ১২০টি আসনের মধ্যে অন্তত ৬০টি। এনডিটিভির সর্বশেষ জরিপে শুধু উত্তর প্রদেশ থেকেই দলটিকে ৫৩টি আসন দেওয়া হয়েছে! এটা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রমেশ দীক্ষিত বলেন, 'একেবারে অসম্ভব বলব না। তার একটা বড় কারণ, নরেন্দ্র মোদির ভালো-মন্দ সম্বন্ধে সবাই বিশেষ একটা অবগত নন। আবার লাগাতার প্রচার তাঁর সম্বন্ধে একটা আকর্ষণীয় ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। তাঁকে গুজরাটের কসাই বলা হচ্ছে, কিন্তু হিন্দুপ্রধান ভারতে, বিশেষত দাঙ্গাপ্রবণ গো বলয়ে সেটা তাঁর পক্ষে যেতে পারে। মোদি একজন 'নো ননসেন্স' নেতা, এটা যত প্রচার পাচ্ছে, কট্টর হিন্দুদের মধ্যে ততই তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। লোকসভার ভোটে অধিকাংশ মানুষ কেন্দ্রে একজন শক্তপোক্ত নেতাকে পেতে বেশি আগ্রহী।'
জাতীয় স্তরে বিজেপিকে রোখার মতো শক্তি এখন পর্যন্ত কংগ্রেসেরই রয়েছে। কিন্তু সেই কংগ্রেসকে অন্য 'ধর্মনিরপেক্ষ' দলগুলো গত দুই বছরে যেভাবে কোণঠাসা করেছে, কখনো কখনো বিজেপির সঙ্গে তাল ও হাত মিলিয়ে, তাতে দলটি দিন দিন দুর্বল হয়েছে। এই যে আট দফায় ভোট হয়ে গেল, তাতে বিরোধীদের টনক নড়েছে অনেক দেরিতে। কংগ্রেস ও মোদি দুজনকেই রুখে বিশ্বস্ত ও স্থায়ী বিকল্প সরকার গড়া যে সহজ নয়, সেই উপলব্ধি যখন হয়েছে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন এই শেষবেলায় বারানসিতে মুসলমান ভোট একজোট রাখার চেষ্টায় একটা উদ্যোগ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শুধুই তা কি মোদির রথ ঠেকাতে পারবে?
এবারের ভোট মোদিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার অনেক কারণের একটি যদি হয় প্রচারে 'টিম মোদির' উদ্ভাবনী ক্ষমতা, অন্যদিকে তা হলে থাকবে তাঁকে রুখতে কংগ্রেসের সার্বিক ব্যর্থতা। মনমোহন সিংকে নিয়ে দলের টালবাহানা, মোদির মোকাবিলায় রাহুলকে এগিয়ে দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে দীর্ঘ দোলাচল এবং স্বাভাবিক মিত্রদের (তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, টিআরএস) সঙ্গে সম্পর্কহানি এই লড়াইটা ক্রমে একপেশে করে তোলে। এখন কংগ্রেসের পক্ষে আশার আলো একটাই—প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। মত্ত ষাঁড়ের শিং ধরে মোকাবিলার মতো যেভাবে তিনি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন, তাতে দেশের আপামর কংগ্রেসি এখন থেকেই তাঁর মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। প্রিয়াঙ্কাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ গান্ধী পরিবার দেবে কি না, মোদিময় ভোট শেষ হওয়ার আগেই এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। সেই প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ষোড়শ লোকসভার ভোটে মূল লড়াই কংগ্রেস বনাম বিজেপির নয়, আঞ্চলিক দল বনাম কংগ্রেস বা বিজেপির মধ্যে নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতারও নয়; লড়াইটা নরেন্দ্র মোদি বনাম অবশিষ্ট ভারতের।