Monday, January 24, 2011

রৌদ্রছায়া:'সময়ের বয়ান' by মাকিদ হায়দার

মাদের স্কুলে নিচের ক্লাসের ক্ষিতিশ পণ্ডিত জোড়া বেত হাতে বিশুদ্ধ বাংলা, শুদ্ধ উচ্চারণ, কথন, পঠন শেখাতেন। লেখাতেনও। সেই সাথে শেখাতেন নীতিকথা। প্রাথমিক পর্যায়েই দিতেন নৈতিক শিক্ষা। নীতি কথাগুলো মনে আছে। মনে আছে মাঝে-মধ্যে ভুল উচ্চারণ এবং ভুল বাংলা লেখার দায়ে জোড়া বেতের ব্যবহারের কথা।

১. সদা সত্য কথা বলিবে, ২. চুরি করা মহাপাপ, ৩. অহংকার পতনের মূল ইত্যাকার নীতিকথা। আমাদের বাংলা অভিধানে 'সাবেক' শব্দটির অর্থ করা হয়েছে প্রাচীন পূর্বেকার, পুরাতন শব্দটির ব্যবহার বোধকরি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে। নাট্যকার, গীতিকার, সেক্সপিয়র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আমার অভিধায় ওঁরা কেউ-ই সাবেক হননি। সম্রাট অশোকের আমল থেকে পঞ্চদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম এখন অবধি সাবেক হননি। এমনকি বিষাদ সিন্ধুর নিষ্ঠুর এজিদ। তিনি সেই সময়ের একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন [আরবী কবিতা, আবদুস সাত্তার অনূদিত] বাংলা অভিধানে নীতিকথা বলতে বলা হয়েছে ১. হিতোপদেশ, ২. ভালো-মন্দ বা কর্তব্য অকর্তব্য বিষয়ে বোধসম্পন্ন। নৈতিক সম্বন্ধে লেখা আছে ১. নৈতিক শক্তি, ২. নৈতিক অবনতি।

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষক ভুল বাংলা লিখে তিরস্কৃত হলেও সম্প্রতি তিনি 'ডঃ' শব্দটি নামের আগে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। উক্ত ডক্টরেট শিক্ষককে বলতে শুনলাম 'সাবেক' শব্দটি শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রসঙ্গ পাল্টে জানালেন, শিক্ষার মান, শুদ্ধ বানান, লেখন, পঠন এবং কিছু নীতিকথা। কিছু নৈতিকতার কথা। অনেকেই জানি ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, বিভিন্ন এনজিওতে কনসালটেন্সি থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেসরকারি) খণ্ডকালীন ক্লাস নিয়ে থাকেন। তাঁর শব্দ উচ্চারণেই স্পষ্ট হয়ে গেলো তিনি শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা বলতে পারেন না, আঞ্চলিকতার লক্ষণ স্পষ্ট।

আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে গ্রীসের দুইজন দার্শনিক পেস্নটো এবং এরিস্টটল তাদের দর্শন চিন্তায় বার বার জানিয়েছেন, সত্যিকারের সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক হতে হলে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। অন্যতিবে পেস্নটোর 'রিপাবলিক' গ্রন্থে নৈতিকতার উপর যেমন জোর দেয়া হয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই বলা হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শুধু জ্ঞানের জন্যই নয়, পড়ালেখা শিখে তারা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে। ভালো মানুষই ভালো নাগরিক হতে পারেন। নৈতিকতার বিরুদ্ধে আমরা সকলেই, তবে এর মধ্যে দু'একজন আছেন তাদের নৈতিকতাকে এখনো বিসর্জন দেননি।

বৃটিশ শাসনামলে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে দুটি স্কুলের অনুমোদন দিয়েছিলেন বৃটিশরা। তৎকালীন বাংলা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নৈতিকতার উপর সর্বপ্রথম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গুরুত্ব দিয়েছিলেন; এমনকি নৈতিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তভর্ুক্ত করেছিলেন ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যাসাগর। তিনি বিদেশী বইয়ের অনুবাদের মাধ্যমে শিশুদের জন্য রচনা করেছিলেন 'বোধোদয়' ও 'বর্ণপরিচয়' ১ম ও ২য় ভাগ। তিনি শিশু-কিশোরদের বইগুলোতে নৈতিক শিক্ষার দিকে দৃষ্টিও দিয়েছিলেন এবং একইসঙ্গে শিশু-কিশোররা যেন মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে শেখে সেদিকও ছিলো তাঁর প্রখর দৃষ্টি। নৈতিকতা নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। নৈতিকতার বালাই নেই অনেক শিক্ষকের কর্মকাণ্ডেও।

নৈতিকতার অধঃপতন চারদিকে। আজকাল সদা-সর্বদা সত্যকথা না বলে, আমরা মিথ্যে বলাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তবু এই সমাজে দুই-একজন এখনো আছেন যারা সত্য বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সম্প্রতি সাবেক সচিব মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের 'সময়ের বয়ান' নামে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটিতে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন 'তাঁর পিতা মহিউদ্দিন ভুঁইয়া পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনায় বাটা সু কোম্পানিতে শ্রমিকের চাকরি করতেন। ১৯৪৪ সালের দিকে তাঁকে বাটানগর থেকে খিদিরপুরের ওয়াটগঞ্জ স্ট্রীটে অবস্থিত বাটা সু কোম্পানির জুতার দোকানে সেলসম্যান এবং নিকটস্থ মসজিদের ইমাম হিসেবে কলকাতায় তাকে বদলি করা হয়।' আমার মনে হয় নৈতিকতার জয় এখানেই। শুদ্ধ ভাষায় যিনি সত্য বলতে অভ্যস্ত তাঁর মুখে মিথ্যে আটকে যায়।

No comments:

Post a Comment