Sunday, January 30, 2011

নতুন বিমানবন্দর কেন

দেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর আছে। এসব বিমানবন্দরের কোনোটারই ধারণক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা হয় না। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে এখন কক্সবাজার বিমানবন্দরকেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর। বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে এই বিমানবন্দরের। তবে এখন ক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী এ বিমানবন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টির মতো বিমান ওঠানামা করলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলা যায়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় (পিক আওয়ারে) সর্বোচ্চ ১০টি বিমান ওঠানামা করে। এর মধ্যে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠানামাও যুক্ত। অর্থাৎ ঢাকায় বর্তমানের পাঁচ গুণ বিমান ওঠানামা এবং যাত্রীর পরিমাণ দ্বিগুণ হলেও এর জন্য হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই যথেষ্ট। তা ছাড়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ বিমানবন্দরের ক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তো রয়েছেই।
এ অবস্থায় সরকার আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে এ বিমানবন্দর করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি তার জন্য আড়িয়ল বিলের মতো স্থানকে নির্বাচন করা নিয়েও সমালোচনা আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এমন কোনো অগ্রাধিকার প্রকল্পের অঙ্গীকার ছিল না।
অবশ্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিমানবন্দরটিকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় বিমান চলাচলের পথে কেন্দ্রস্থলে (হাব) পরিণত করার চিন্তা আছে। এতে এ খাত থেকে দেশে প্রচুর রাজস্ব আসবে।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই-সমীক্ষা করা হয়নি। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিটি’ নামের একটি উপশহর গড়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দর ও সিটির জন্য আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই অধিগ্রহণের ফলে ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলায় বিস্তৃত মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলাধারটির প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কী ক্ষতি হবে, তা নিয়েও কোনো সমীক্ষা হয়নি।
পরিবেশবিদদের মতে, মিঠাপানি ও জীববৈচিত্র্যের বড় আধার এই বিল ধ্বংস করা হলে পরিবেশগত ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকার আশপাশে বন্যার প্রকোপও বাড়বে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম পর্যায়ে এখন ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সব সমীক্ষা করা হবে।
নতুন বিমানবন্দরের সিদ্ধান্ত: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। গত বছরের ২৯ আগস্ট প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা কমিটি সাতটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। এক. ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল, আমিরাবাড়ী, মোক্ষপুর ও মঠবাড়ী ইউনিয়ন। দুই. ত্রিশাল উপজেলার রামপাল, কানহর, কাঁঠাল ও বৈলর ইউনিয়ন। তিন. টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর। এই তিনের মধ্যে প্রথম প্রস্তাবের পক্ষে (ময়মনসিংহের ত্রিশাল) গত বছরের ৭ এপ্রিলের বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সুপারিশ করা হয়।
এরপর কমিটি ১৫ নভেম্বর আবার বিমানবন্দরের স্থান নির্বাচনের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের শিবচর ও রাজৈর, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়ল বিল এলাকা পরিদর্শন করে। ৩০ নভেম্বর বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব সাংবাদিকদের জানান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে আড়িয়ল বিলকেই চূড়ান্ত করার সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি।
গত ১২ ডিসেম্বর আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর এবং পাশেই বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
নতুন বিমানবন্দরের পক্ষে যুক্তি: মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার গত ৬ ডিসেম্বর স্থান নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠান বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। প্রতিবেদনে নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়, দেশে এখন ১৭টি বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বাড়ছে। ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে এর বর্তমান অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। ক্ষমতার ৮০ শতাংশ এখন ব্যবহূত হচ্ছে। এ বিমানবন্দরের একটি রানওয়ে এবং বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিমানযাত্রীর তুলনায় তা অপ্রতুল। এই বিমানবন্দরের চারদিকে আবাসিক এলাকা ও সেনানিবাস থাকায় ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। এর যাত্রী টার্মিনাল ভবন অপ্রশস্ত এবং পাঁচ স্তরের আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের যথেষ্ট সুযোগ নেই। এ ছাড়া বর্তমান বিমানবন্দরে সর্বশেষ প্রযুক্তির সুপরিসর উড়োজাহাজ এয়ারবাস এ-৩৮০ পরিচালনের ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এবং এর সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি।
পাল্টা যুক্তি: সরকারের এসব যুক্তি সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিমানের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এয়ারবাস কোম্পানির সর্বশেষ সংযোজন এ-৩৮০ উড়োজাহাজ এখন পর্যন্ত খুব কম এয়ারলাইনসই ব্যবহার করছে। ঢাকা থেকে যেসব গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট আছে, তাতে উড্ডয়ন ঘণ্টা ও যাত্রীর চাপ বিবেচনায় এখানে এ-৩৮০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সম্ভাবনা নেই। কারণ উড্ডয়ন ঘণ্টা বিবেচনা রেখে এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট পরিকল্পনা করে। কম দূরত্বে সুপরিসর উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করলে লাভ হয় না।
আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের জন্য জরুরি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও দক্ষ জনবল। এখানে বিশাল জায়গা বা অবকাঠামো মুখ্য নয়। ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতে টার্মিনাল ভবন আরও প্রশস্ত করা দরকার। সে জন্য বর্তমান বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত জমি আছে বলে সিভিল এভিয়েশন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এর পরও যদি স্থানসংকুলান না হয়, তাহলে বিমানবন্দরসংলগ্ন ১৩০ একর জমি কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হলো, সে প্রশ্ন উঠছে। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে এটা ইজারা দেওয়া হয়। পরে তা বাতিলও করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আবার তা ইজারা দেয় কান্ট্রি ক্লাব, গলফ ক্লাব, পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেল ইত্যাদি করার নামে। কিন্তু গত ১০ বছরে কিছুই করা হয়নি। বর্তমান সরকারের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ওই জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব করে। বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের ওই সব জমি ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরে সংসদীয় কমিটি ইজারাদারের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। তখন বিমানমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সরকারি জমি ফেরত নিতে মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভবিষ্যতে বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এই জমি দরকার হবে। কিন্তু এখন নতুন বিমানবন্দরের জন্য আড়িয়ল বিলের জমি অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, নতুন বিমানবন্দরকে এ অঞ্চলের বিমান চলাচলের কেন্দ্র করার কথা বলছে সরকার। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা বা সমীক্ষার ভিত্তিতে এ সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে? দুবাই ও সিঙ্গাপুর হাব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেশ দুটির বিমান সংস্থা এমিরেটস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের। এ দুটি এয়ারলাইনস এখন বিশ্বের শীর্ষপর্যায়ের বিমান সংস্থা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশে ও গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। তারা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে বিমান চলাচলে নিজ দেশের বিমানবন্দরকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। দুবাই ও সিঙ্গাপুর এমনিতে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র। তাদের রয়েছে আনুষঙ্গিক এমন সব সুবিধা, যা তাদের নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। ঢাকাকে দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মতো বিমান চলাচলের আঞ্চলিক কেন্দ্র করতে হলে তার জন্য পুরো রাজধানীকে ওই রকম পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে ঘিরে সরকারের এখন পর্যন্ত তেমন চিন্তা-পরিকল্পনার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
বিমান চলাচল বৃদ্ধির চিত্র: জানা গেছে, কুর্মিটোলায় বর্তমান বিমানবন্দরটির জমির পরিমাণ দুই হাজার একর এবং রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। রয়েছে পরিমিত প্রয়োজনীয় সুবিধাদি। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান চলাচল বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তাতে ২০২৫ সালে এখানে মোট ৫৭ হাজার ফ্লাইট পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। ২০১৫ সালে এটা ৩২ হাজার এবং ২০২০ সালে ৪২ হাজার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় ঢাকায় বিমান ওঠানামা করবে ১৪টি। ২০২০ সালে তা ২০ ও ২০২৫ সালে ২৯টিতে উন্নীত হতে পারে।
এই সমীক্ষা অনুযায়ী আগামী ২০ বছরে যাত্রীসংখ্যা তিন গুণ হতে পারে। বর্তমান সুবিধাদি ও রানওয়ে দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে। তবে কিছু আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির দরকার হবে এবং তা বর্তমান বিমানবন্দরেই করা সম্ভব।
বিমানসচিবের যুক্তি: আরেকটি বিমানবন্দর নির্মাণ কেন দরকার, এ প্রশ্নের জবাবে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহজালালে একটিমাত্র রানওয়ে, যদি কোনো কারণে কোনো প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে রানওয়েতে বসে পড়ে, সেটা সরানো না যায়, তখন তো পুরো বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়বে। আর এখানে আগামী ১০ বছরে বিমান চলাচল ও কার্গো বহন দ্বিগুণ হয়ে পড়বে। তা ছাড়া আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই।
তুলনামূলক পর্যালোচনা: দেশে-বিদেশে বিমান পরিবহন-বাণিজ্যে জড়িত একজন পরামর্শক একটি রানওয়ের কারণে নতুন বিমানবন্দর করার যৌক্তিকতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যের গেটউইক বিমানবন্দরে একটি রানওয়ে ছিল। সম্প্রতি তারা দুটি করেছে। কিন্তু একটি রানওয়ে থাকা অবস্থায় সেখানে বছরে সাড়ে তিন কোটি যাত্রী পরিচালন করা হতো। আর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের এখন পরিচালনক্ষমতা ৮০ লাখ, গত বছর প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী এখানে আসা-যাওয়া করেছে। তাঁর মতে, এখানে ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাহিদা মেটাতে আরেকটি বিমানবন্দর বা রানওয়ে নির্মাণ সমাধান নয়। এখানে জরুরি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করা দরকার। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে টারমাক ও টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত জমি শাহজালালেই আছে।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহজালালে বর্তমান রানওয়ের ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতার ৪০ শতাংশ ব্যবহূত হয়। জাপানের নারিতা বিমানবন্দরও একটি রানওয়ে দিয়ে চলছে। সেখানে ঢাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিমান ওঠানামা করে।
বিকল্প হিসেবে আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরকে পুনরুদ্ধার করে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে এবং শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ওড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে।
সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানের মতে, ‘প্রয়োজন হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের ট্যাক্সিওয়েকে দ্বিতীয় রানওয়েতে পরিবর্তন করার (পরীক্ষা সাপেক্ষে) সুযোগ আছে। এ ছাড়া রানওয়ের পশ্চিম দিকে কিছু কিছু স্থাপনার যুক্তিসংগত পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে দ্বিতীয় রানওয়েও নির্মাণ করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, বর্তমান রানওয়ের লাইটিং সিস্টেম, অ্যান্টিফগ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের আধুনিকায়ন, হাইটেক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
আড়িয়ল বিলে কারিগরি ঝুঁকি: সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ বাতাসের বিপরীতে করতে হয়। বাংলাদেশে বছরের ৭০ শতাংশ সময়কালে বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যায়। বাকি ৩০ শতাংশ সময়কালে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে থাকে। ফলে প্রায় ৭০ শতাংশ উড্ডয়ন ও অবতরণ হয় উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশনায়। বাকি সময় ৩০ শতাংশ দক্ষিণ-উত্তর দিকনির্দেশনায়। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েও উত্তর-দক্ষিণমুখী।
কিন্তু আড়িয়ল বিলটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। পশ্চিমে শেষ প্রান্তে পৌঁছে পশ্চিম-উত্তরে বেঁকে গেছে। তাই প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে পূর্ব-পশ্চিম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি তা হয়, তাহলে সারা বছর আড়াআড়ি বাতাসের (ক্রস-উইন্ডের) মধ্যে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে হবে। এটা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জটিলতা বাড়াবে, খরচও বাড়বে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আড়িয়ল বিলের মাটি মূলত পিটজাতীয় জৈব মাটি (গাছপালা পচে তৈরি হওয়া নরম মাটি)।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, বিলে বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি করতে পুরো এলাকা ২০-৩০ ফুট বালু দিয়ে ভরাট করতে হবে। কিন্তু এখানে গভীর জৈব মাটির (পিট সয়েল) স্তর থাকায় বিমানবন্দরসহ নির্মিত স্থাপনা দেবে যাওয়ার সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে থাকবে। ৪০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন ওজনের বিমান ওঠানামার জন্য জৈব মাটি বড় কারিগরি ঝুঁকি হিসেবে দেখা দেবে।

শেয়ারবাজার ধসের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশের শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয়ের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে তাদের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিষ্কার করে যে, বাজার কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট এসইসি, ডিএসই ও গবেষকদের কয়েকজনকে ডেকে এনে একটি নির্বাহী সেমিনারে গবেষণা সমীক্ষাপত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিপর্যয় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাজার বিশ্লেষণ করা হয়। এর পরপরই ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে।
গবেষণায় বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশের শেয়ারবাজার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার এবং বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার বিপর্যয়ের সঙ্গে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয়, পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ আয় ও মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে যে ব্যবধান তা কতটা বেড়েছে এবং ব্যবধানের কোন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে ও বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার পতন হয়েছে।
সেমিনারে এসইসি ও ডিএসইর দিক থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি বলতে চাইছে যে, দেশের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর্যায়ে (বাবলস) উপনীত হয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা বাবলস আছে কি না সেটা বলছি না, এটা বলবেন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমরা শুধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার যে পর্যায়ে বাবলস তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে ডিএসইর পরিস্থিতি লেখচিত্রে উপস্থাপন করেছি।’
গবেষকদের কাছে প্রশ্ন তোলা হয়, ’৯৬ আর আজকের বাজার তো এক নয়। জবাবে গবেষকদের তত্ত্বাবধায়ক আহসান হাবীব মনসুর বলেন, ‘বাজারের কতগুলো মৌলিক দিক (মার্কেট ফান্ডামেন্টাল) বিশ্বের সব দেশে এবং সব সময়ের জন্য একই।’
গবেষণা অনুযায়ী, প্রদর্শিত সব কটি দেশ ও ’৯৬ সালে বাংলাদেশে বাজার ধসের পরিস্থিতির তুলনায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্য পরিস্থিতি অনেক বেশি তীক্ষভাবে বাড়তে শুরু করে এবং এ সময় শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ আয় ও মূল্য আয় অনুপাত (পিই) এবং মূল্যসূচকের ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি অংশ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এসইসির তৎকালীন সদস্য মনসুর আলম, নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ, পরিচালক হাসান মাহমুদ, ডিএসইর তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, নির্বাহী আফজালুর রহমান, সিপিডির তারিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাসহ নীতিনির্ধারণী কয়েকটি বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান হাবীব মনসুরের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আবদুল ওয়াহাব ও সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক এই গবেষণা সমীক্ষাটি তৈরি করেন।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুধু বলব গবেষণাপত্রে পরিষ্কার একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই বার্তাটি এসইসি ও ডিএসইর কাছে পৌঁছে দিয়েছে।’ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই গবেষণার দিকনির্দেশনাটি পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো দেখলেই তার মধ্যে পরিষ্কার জবাব পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গবেষণা ধরে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, এর আগ থেকেই বাজার সামাল দিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসে এসে এসইসি বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা সতর্ক করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও ছাপে বলে জানান চেয়ারম্যান।
গবেষণার কিছু দিক: গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের আগে একটা বড় উত্থান হয়। যেমনটি হয়েছে ’৯৬ সালে বাংলাদেশের বাজারে। একই পরিস্থিতি পাওয়া যায় জাপানের নিক্কি, চীনের সাংহাই, আমেরিকার ন্যাসডাক, ভারতের বোম্বে-সেনসেক্স, হংকংয়ের হ্যাংসেং, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও সৌদি আরবের তাসি মূল্যসূচকে। বাংলাদেশে ডিএসইর ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূচক উত্থানকে গবেষণায় বিবেচনা করা হয়। তার আগের দুই বছরের সূচক পর্যালোচনাও ছিল এতে।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৫৭৪৫ দশমিক ৭৮, ডিএসআই সূচক ছিল ৪৭০০ দশমিক ৮৭ আর ডিএসই-২০ সূচক ছিল ৩১৩৪ দশমিক ৩৫। এ সময় বাজারের মূল্য আয় অনুপাত ছিল ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অন্যদিকে লভ্যাংশ আয় ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার ধসে পড়ার সময় লভ্যাংশ আয় ও বাজারের মূল্যস্তরের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হওয়ার উপাত্ত মেলে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উত্থানের হার বেশি থাকায় বড় ঝুঁকির সংকেত পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০০৯ সালের আগস্ট থেকে একটা বড় ধরনের উত্থান ছিল বাজারে। এ সময় বাজারের উত্থান সামলে নেওয়া হয় গ্রামীণফোনের বড় একটা আইপিও দিয়ে। ওই সময় বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের হয়ে পড়ে। আবার নতুন শেয়ার যুক্ত হলে সামলে ওঠে বাজার। কিন্তু ডিএসই ভুলভাবে সূচক হিসাব করায় প্রকৃত বাজারের চিত্র এতে প্রকাশ পায়নি।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরু হওয়ার পর বাজারে আবারও একটা দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যায়। গবেষণায় দেখানো হয়, এমনকি ডিএসই সঠিকভাবে সূচক হিসাব করলেও উত্থান ছিল দ্রুত ও তীক্ষ। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এ সময় বাজারের মৌলশক্তি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং লভ্যাংশ আয়ের সঙ্গে মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের সময় সেখানে বাজার পিইর সঙ্গে লভ্যাংশ আয়ের তুলনা করা হয় গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএসইর পিই সর্বাধিক ৩০ দশমিক ৬-তে ওঠে। তখন লভ্যাংশ আয়ের হার হয় ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাজার বিপর্যয়ের সময় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ২০ দশমিক ৩ (জানুযারি ’০৮) ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় (সেপ্টেম্বর ’০৭) পিই ছিল ১৪ দশমিক ৪৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। জাপানে বাজার (ডিসেম্বর ’৮৯) বিপর্যয়ের সময় পিই ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। চীনে (অক্টোবর ’০৭) পিই ছিল ১৮ দশমিক ৩ ও লভ্যাংশ আয় ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ, সৌদি আরবের (ফেব্রুয়ারি ’০৬) পিই ৪৭ দশমিক ৩ ও আয় ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ইউএসএর ন্যাসডাক (মার্চ ২০০০) স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ৩৫ দশমিক ৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
পরবর্তী পরিস্থিতি: ডিএসইর বাজারে ফেব্রুয়ারির শেষে এসে লভ্যাংশ আয় কমে ও পিই বাড়ে। তবে জুনে গ্রামীণফোন লভ্যাংশ দিলে পিই কিছুটা কমে আসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে মূল্যসূচক কিছুটা সংশোধনের মধ্যে ছিল। মধ্য মে পর্যন্ত ৫৫০০ সূচকের মধ্যে ওঠানামা করে বাজার। তারপর থেকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে দ্রুত বেড়ে চলে বাজার। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সূচক ৭৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এ পর্যায়ে আবার তীক্ষ উত্থান শুরু হয়ে ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক গিয়ে ঠেকে ৮৯১৮ দশমিক ৫১-তে। এরপরই ধসের কবলে পড়ে বাজার।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডিএসইর সূচকে এই বৃদ্ধি বাজারে মৌলশক্তির সঙ্গে যায় না। ফলে বাজারের উত্থানপ্রবণতা জানুয়ারির প্রথমভাগে বা ডিসেম্বরের শেষ সময়ে আর টেকসই হয়নি।’
আহসান হাবীব মনসুর গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুঁজি ও মুদ্রাবাজারের সব দিক নিয়েই এ গবেষণা করা হয়। আমরা এর মাধ্যমে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছি বাজারে। বলেছি, “বাজার অতি মূল্যয়িত।” ধারণা করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তাদের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’
গবেষণা ধরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গবেষণার ভিত্তিতে আমি তো মনে করি এখনো বাজার অতি মূল্যায়িত। কৃত্রিমভাবে বাজারকে সহায়তা দেওয়া কারও জন্যই শুভ হবে না।’

বিক্ষোভে জ্বলছে মিসর, সংঘর্ষে নিহত ৭৪

প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে অব্যাহত বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে পড়েছে মিসর। গতকাল শনিবার বিক্ষোভের পঞ্চম দিনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে ৭৪ জন নিহত হলো।

গণবিক্ষোভের মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন হোসনি মোবারক। গত শুক্রবার মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন তিনি। তবে নিজে পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন মোবারক। বিক্ষোভকারীরা তাঁর এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, মোবারককে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। এই দাবিতে তারা গতকাল কারফিউ ভেঙে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। এতে করে আরও বিপাকে পড়েছেন মোবারক।
বিক্ষোভের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট মোবারক (৮২) গতকাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ওমর সুলাইমানের (৭৫) নাম ঘোষণা করেন। এরপর একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী আহমেদ শফিকের নাম ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালে মিসরের ক্ষমতা নেওয়ার পর এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন মোবারক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করায় অনেকে ধারণা করছেন, মোবারক হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এর আগে শুক্রবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট মোবারক বলেন, জ্বালাও-পোড়াও করে, ব্যক্তিগত বা সরকারি সম্পদ ধ্বংস করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। আলোচনা, সচেতনতা ও বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিক্ষোভকারীদের কষ্টের কারণ বুঝতে পারছি। কিন্তু কোনোভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল হতে দিতে পারি না।’ বক্তব্যে তিনি মিসরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রতিশ্রুতি দেন।
মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে গতকাল ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে ভাঙচুর চালাতে গেলে সেনারা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে রাফার সিনাই শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ নিহত হয়। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে মোট ৭৪ জন নিহত হলো। বিক্ষোভে আহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ। কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে কারফিউয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার বিক্ষোভ দমনে রাজপথে সেনাবাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। সেনাসদস্যরা ট্যাংক নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। প্রথমে বিক্ষোভকারীরা সেনাদের স্বাগত জানালেও পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারী মারজুক বলেন, ‘সেনাবাহিনী জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেনাসদস্যরা তাহরির স্কয়ারে এলে আমরা তাঁদের স্বাগত জানাই। কিন্তু খুব দ্রুতই তাঁরা দাঙ্গা পুলিশের মতো আচরণ করতে থাকেন। আমরা বাধ্য হয়ে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ি।’
মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের সরকার ভেঙে দেওয়ার ঘোষণার পরও তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে তামাশা বলে উল্লেখ করেন। একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘শুধু সরকার ভেঙে দেওয়া নয়, প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছি আমরা।’ বিক্ষোভকারীদের স্লোগান ছিল, জনগণ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে টিয়ার গ্যাস শেল ও জলকামান ব্যবহার করে। বন্দরনগর ইসমাইলিয়াসহ বেশ কিছু এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
কায়রোতে গত শুক্রবার বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে ক্ষমতাসীন দলের সদর দপ্তর গতকালও জ্বলতে দেখা যায়। কায়রোর মোহান্দিসেন জেলায় একটি স্বর্ণালংকারের দোকান ও একটি ব্যাংকে লুটপাট চালানোরও খবর পাওয়া গেছে। বিক্ষোভকারীরা মিসরের প্রায় ৬০ শতাংশ থানায় হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বিবৃতিতে গতকাল জানানো হয়, কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে স্থানীয় সময় বিকেল চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ ছিল।
প্রেসিডেন্ট মোবারকের ভাষণকে ‘হতাশাজনক’ উল্লেখ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাবেক প্রধান এলবারাদি। ফ্রান্স ২৪ টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা যথেষ্ট নয়। এতে করে বিক্ষোভ থামবে না। এলবারাদি বলেন, বিক্ষোভের মাধ্যমে দেওয়া জনগণের বার্তা প্রেসিডেন্ট মোবারক বুঝতে পারছেন না। মোবারকের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। এদিকে এলবারাদিকে গৃহবন্দী করা হয়েছে বলে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দেশটিতে নিষিদ্ধঘোষিত বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড শান্তিপূর্ণভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ না করতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট মোবারকের সঙ্গে টেলিফোনে ৩০ মিনিট কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পদক্ষেপ নিতেও প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে একটি পক্ষ দেশটিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে।
প্রেসিডেন্ট মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি সংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি।

ভর্তুকির সার যাচ্ছে রঙে by শফিকুল ইসলাম জুয়েল

মুড়ি তৈরিতে ইউরিয়া সার ব্যবহারের খবরটি পুরনো। এবার জানা গেল কাপড় ও সুতার রং টেকসই করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন এই সার ব্যবহার করছে। নাইট্রোজেন কাপড় ও সুতার রং পাকা করে। এই নাইট্রোজেনের প্রয়োজন মেটাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষকের ইউরিয়া সার।

ফলে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ হওয়া ভর্তুকি মূল্যের অন্তত তিন লাখ টন ইউরিয়া চলে যাচ্ছে শিল্পসহ অকৃষি খাতে। এতে সরকার বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রায় সাড়ে সাত হাজার গার্মেন্ট (প্যান্ট, শার্ট, সোয়েটার) ও নিট শিল্পের (গেঞ্জি-জাতীয় কাপড়) চাহিদা মেটাতে তিন শতাধিক টেক্সটাইল ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা সুতা ও কাপড় প্রস্তুত করে। এসব কারখানায় নাইট্রোজেনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে ইউরিয়া সার। কর্মকর্তাদের হিসাবে ডাইং ও প্রিন্টিং শিল্পের চাহিদা মেটাতে বছরে অন্তত তিন লাখ টন ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলক বেশি কাপড় প্রস্তুতকারক একেকটি ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা মাসে এক টনেরও বেশি ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকে।
সাভারে অবস্থিত মোশারফ ডাইং কারখানা ও রুবেল প্রিন্টিং কারখানার দুজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, কাপড়ের রং পাকা করতে তাঁরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা রঙের সঙ্গে মেশাতে ইউরিয়া সার প্রথমে পানিতে ভিজিয়ে গুলে নেন। এরপর রঙের সঙ্গে মেশানোর পর মেশিনের সাহায্যে কাপড়ে লাগানো হয়। কর্মচারীরা জানান, প্রতি কেজি রঙে অন্তত ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশাতে হয়। সার কিভাবে সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে একটি কারখানার কর্মচারী কোনো মন্তব্য করেননি। অন্য কারখানার কর্মচারীটি বলেন, ‘বাজার থেকেই সার কেনা হয়, এখনো তিন বস্তা সার মজুদ আছে স্টোর রুমে।’ পরে স্টোরকিপার ও মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মোশারফ ডাইং কারখানার মালিক মোশারফ হোসেন খন্দকার ভর্তুকির সার তাঁর কারখানায় ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাপড়ের রং পাকা করতে আমরা অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করি। কিছু টাকা বেশি দিয়ে বাজার থেকেই সার কিনে আনি।’ তিনি দাবি করেন, ‘শুধু আমরাই নই; দেশের প্রায় সব ডাইং কারখানায় আমাদের চেয়েও বেশি সার ব্যবহার করে।’
কৃষকের সার কিনে এনে কাপড় রং করার কথা স্বীকার করেছেন রুবেল প্রিন্টিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আবদুস সালামও। গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বেশি সার ব্যবহারকারী বড় কারখানার মালিকরাই আমদানি করে না। সেখানে আমি তো ছোট ব্যবসায়ী; তাই আমদানির চিন্তা করি না।’ তিনি দাবি করেন, ‘বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দিলেই সার পাওয়া যায়।’
ভর্তুকি মূল্যের ইউরিয়া সার শুধু কৃষি ফসল ও কৃষকের জন্য বরাদ্দ। এর পরও শিল্পমালিকরা সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ও উৎকোচের বিনিময়ে সংগ্রহ করে অকৃষি খাতে ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। অথচ নির্দেশনা রয়েছে, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে যে কেউ আমদানি করতে পারবে। ভর্তুকির সার ব্যবহার করা যাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, শিল্প খাতে সার দেওয়ার জন্য মন্ত্রী-এমপিসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুপারিশ করেন। ফলে চাপে পড়ে এবং তাঁদের মন রক্ষায় সার দিতেই হয়। উৎকোচের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নেই না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাত্র কিছুদিন আগে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি সাভারের এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে ভর্তুকির সার এক কাপড় রং কারখানার মালিকের কাছে বিক্রির জন্য চাপ দেন। কর্মকর্তা দিতে অস্বীকার করেন এবং এর কিছুদিন পরই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ম্যানেজার (মার্কেটিং) মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষির নামে বরাদ্দ হওয়া ভর্তুকির সার শিল্পসহ নানা খাতে যায়, এমন খবর আমরাও জানি। তবে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ, সার ডিলারদের নামে বরাদ্দ দেওয়ার পর আমাদের আর দায়িত্ব থাকে না। সেটা মনিটর করার কথা জেলা সার কমিটির।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের কৃষি ফসলের জন্য ৬৪ জেলায় ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারের ইউরিয়া বরাদ্দ ২৮ লাখ ৩১ হাজার টন। এর মধ্যে বরাদ্দ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ৫০ হাজার টন ও আপৎকালীন ৫০ হাজার টন। এ ছাড়া মৎস্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩০ হাজার টন ও প্রাণিসম্পদ খাতে এক হাজার টন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, ডাইং-প্রিন্টিং শিল্পসহ তামাক, ইটখোলা, গো-খাদ্য, মুড়িসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া সার। যার চাহিদাও পূরণ হয় ভর্তুকি মূল্যের সার দিয়েই। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বরাদ্দ ৫০ হাজার টন থাকলেও ব্যবহার করা হয় (চা বাগান, চিনি করপোরেশন, রাবার বাগানসহ সংশ্লিষ্ট খাতে) এক থেকে দেড় লাখ টন ইউরিয়া সার।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটাতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় এবং তা নেওয়া হয় ভর্তুকির সার থেকেই। প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরিয়া আমদানি করে না। তবে গত ছয় মাসে চারটি কম্পানি সার আমদানির অনুমতি নিয়েছে। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে বিআরবি কেব্ল্ ইন্ডাস্ট্রিজ আমদানি করেছে তিন হাজার টন ইউরিয়া সার।
কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের কারখানাগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদন কমে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ টন ইউরিয়া আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ববাজারের মূল্য অনুযায়ী (প্রতি টন ৩৮০ ডলার) ইউরিয়া আমদানি ও ডিলার পর্যায়ে বিক্রির পর প্রতি টনে সরকারের ভর্তুকি যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা। এ হিসাবে শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে যাওয়া তিন লাখ টনে প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে সরকারের।
কৃষিসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক কোটার বাইরে অতিরিক্ত সারের প্রয়োজন হলে শিল্পমালিকরা স্বাধীনভাবে আমদানি করতে পারবেন। তবে কৃষকের ভর্তুকির সার কোনোভাবেই শিল্পে ব্যবহার করতে পারবেন না। কৃষি ফসলের চাহিদা অনুযায়ী সার আমদানি ও বরাদ্দ হয়। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, সার বিতরণ ব্যবস্থাপনায় কঠোর মনিটরিং রয়েছে। এর পরও কেউ অনিয়ম করলে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক সময় বরাদ্দ না থাকলেও শিল্পমালিকদের অব্যাহত চাহিদা ও তদবিরের মুখে বিপাকে পড়েন সার ডিলাররা। তবে রপ্তানিমুখী খাত শিল্পের চাহিদা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

বিক্ষোভ-সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ মিসর

মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল শনিবারও মিসর ছিল অগ্নিগর্ভ। কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ দেশটির সব বড় শহরে বিক্ষোভ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেও মুবারক তাঁর নিজের পদত্যাগের দাবি নাকচ করে দেওয়ার খবর বিক্ষোভকারীদের আরো উত্তেজিত করে তোলে।

গতকাল রাত ১০টার দিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাজধানী কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, ইসমাইলিয়া, সুয়েজসহ পুরো দেশে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা অবস্থান করছিল। গতকাল কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত ৭৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেনা জানায়, দেশের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ওমর সোলাইমান ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ৩০ বছরের শাসনামলে মুবারক এই প্রথম এ পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন। এ ছাড়া সাবেক বিমানমন্ত্রী আহমাদ শফিককে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হোসনি মুবারক তাঁকে নতুন সরকার ঠিক করতে বলেছেন। এদিকে মুবারক তাঁর কাছের লোকদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন বলেও খবর দিয়েছে মেনা। বিক্ষোভ পরিস্থিতির কারণে আজ শেয়ারবাজার এবং সব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। দেশটির সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মুবারকের প্রতি সংযত আচরণের আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরো বলেছে, মিসরের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য এটিই উপযুক্ত সময়। তবে সৌদি আরব মুবারকের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে।
সহিংসতার কারণে বিভিন্ন দেশ মিসর ভ্রমণের ওপর সতর্কতা জারি করেছে। হাজার হাজার বিদেশি মিসর ছাড়তে বিমানবন্দরে ভিড় করে আছে বলে গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
সম্প্রতি তিউনিসিয়ায় সফল গণ-আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে মিসরে বিক্ষোভ শুরু হয়। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ একনায়কের বিরুদ্ধে এটি প্রথম বড় কোনো আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর মুবারকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে ইন্টারনেটে প্রচারের মাধ্যমে এ বিক্ষোভ আয়োজন করে তরুণরা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার থেকে দেশটির সব শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে তারা। বিক্ষোভকারীরা শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে সর্বাÍক আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেয়। এ পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হলেও জনগণ রাতভর রাস্তায় অবস্থান নেয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রধান কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় দেশটির প্রধান জাদুঘর কায়রো মিউজিয়ামেও অগ্নিসংযোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। রাতেই মিসরের প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছে, তাদের একটিই দাবি, মুবারকের পদত্যাগ।
শেষরাতের দিকে অনেক বিক্ষোভকারী ঘরে ফিরে গেলেও গতকাল সকাল হতেই তারা আবারও রাজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনী বলেছে, রাতে কারফিউ লঙ্ঘন করা হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। মিসরের তথা বিশ্বের গৌরব পিরামিডগুলো রক্ষায় গাজা উপত্যকায় সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনী সুরক্ষা দেয়াল গড়ে তুলেছে।
এদিকে গতকাল বিকেলে কারফিউ উপেক্ষা করে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী কায়রোর প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগোতে থাকলে সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এ সময় লুটপাট ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট, গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে সিনিয়র এক নেতা টিভি সাক্ষাৎকারে বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে জানিয়ে দেশের জনগণকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। এ সময় সেনাবাহিনীকে যেকোনো মূল্যে সহিংসতা মোকাবিলা করে মিসর রক্ষায় সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। দলের পক্ষ থেকে শিগগিরই নতুন মন্ত্রিসভা ঘোষণার কথা জানান তিনি।
অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর একাংশ জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিসরে সহিংসতা কমাতে দেশবাসীকে নিজেদের এবং দেশকে রক্ষার আহ্বান জানায়।
এ বিক্ষোভে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার অস্ট্রিয়া থেকে দেশে ফেরেন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান মোহামেদ এল বারাদি। আগের তিন দিন নিষ্ক্রিয় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডও শুক্রবারের বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই বেশির ভাগ স্থানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিলেও গতকাল তা খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে ফেইসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট বন্ধ রয়েছে। সূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, এএফপি।

জালালউদ্দিন রুমির কবিতা

ই রকম
কেউ যদি শুধায় স্বর্গের হুরিরা কেমন
নিজের মুখখানা দেখিয়ে বলো, এই রকম।
কেউ যদি শুধায় চাঁদ কেমন, ছাদে উঠে বলো, এই রকম।

কেউ যদি উর্বশী খোঁজে, তাকে নিজের মুখখানা খুলে দেখাও
কেউ যদি শুধায় মৃগনাভীর সৌরভ কেমন, নিজের খোঁপা খুলে দাও, বলো, এই রকম।
কেউ যদি বলে, মেঘে ঢাকা চাঁদ কী করে প্রকাশিত হয়?
শাড়ির এক একটি ভাঁজ খুলে ফেলো, বলো, এই রকম।
কেউ যদি শুধায়, মৃতকে জাগিয়ে তুলতেন কী করে যিশু? তার ঠোঁটে চুম্বন করে বলো, এইভাবে।
যদি কেউ জানতে চায় প্রেমে আহুতি দেয় যারা, তারা কেমন? আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো তাকে, বলো, এই রকম।
কেউ যদি শুধায় আমি কতটা লম্বা, তোমার বাঁকানো জোড়া ভুরু দেখিয়ে বলো, এই রকম।

ভূমিকা ও অনুবাদ: হাসান ফেরদৌস
ফার্সি কবি জালালউদ্দিন রুমির কবিতা কেউ পাঠ করে ঈশ্বরের খোঁজে। কেউ বা প্রেমের। যারা প্রেমিক ও ঈশ্বরের কোনো তফাত দেখে না, তারা রুমির কবিতায় দুজনকেই খুঁজে পায়। এ যেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য পর্যায়ের কবিতাগুলোর মতো, যেখানে প্রভু ও প্রেমিকের কোনো তফাত থাকে না।
রুমির জন্ম আফগানিস্তানের বালখ শহরে ১২০৭ সালে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম তার সাড়ে ৬০০ বছর পর, ১৮৬১ সালে। রুমি প্রথম পারস্যের খোরাসানে, পরে তুরস্কের কনিয়া প্রদেশে শিক্ষালাভ করেন মুখ্যত তাঁর মৌলবি পিতার পরিচর্যায়। এই তুরস্কেই তিনি কবি ও মৌলানা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথম জীবনে রুমি ধার্মিক ছিলেন কোনো সন্দেহ নেই, আর দশটা-পাঁচটা মাদ্রাসা-মক্তবের মৌলবির মতো। কিন্তু তাঁর যখন ৩৭ বছর বয়স, সে সময় পরিচয় হয় পারস্যের তাবরিজ থেকে আসা এক পথভোলা দরবেশের সঙ্গে। তাঁর নাম শামস-আল দিন। এই লোকটির ভেতরে রুমি তার প্রার্থিত ঈশ্বরের প্রতিরূপ দেখতে পেলেন। কিন্তু কেবল ঈশ্বর নয়, শামস-আল দিন তাঁর কাছে আবির্ভূত হলেন প্রেমিক হিসেবেও। যে ‘ঈশ্বরসম-প্রেমিক’ তিনি এত দিন খুঁজছিলেন, রুমি তার দেখা পেলেন শামস-আল দিনের ভেতর।
রুমি ও শামসের প্রেমের স্বরূপ আমাদের জানা নেই। এটুকু জানি, তাঁদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা প্রবল বিতর্কিত হয়ে ওঠে এবং একসময় রুমির ভক্তদের আক্রমণের মুখে শামস-আল দিনকে কনিয়া ছেড়ে পালাতে হয়। রুমি তাঁকে পাগলের মতো খুঁজেছেন, পুত্রকে দামেস্ক পাঠিয়েছেন তাঁকে ফিরিয়ে আনতে। শামসের উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফিরে এসো, ফিরে এসো, তোমা বিনা আমার হূদয় শুষ্ক, বিশ্বাস পলাতক।’ ফিরে এসেছিলেন শামস, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আততায়ীর হাতে নিহত হন। রুমি বিশ্বাস করেননি তাঁর শামস—যার অর্থ সূর্য—আর নেই। ‘এ কী করে হয় যে সূর্য আর উঠবে না?’ শামসের জন্য তাঁর অন্বেষণ ও বেদনার আধার হয়ে ওঠে কবিতা। ‘সে নেই, স্বর্গও এখন আমার কাছে নরকসম’, লিখেছেন রুমি।
যে ঐশ্বরিক প্রেমিকের খোঁজে ছিলেন রুমি, সে কি রক্তমাংসের মানব, নাকি বিদেহী ঈশ্বর? এ প্রশ্নের জবাব আমরা তাঁর কবিতা থেকে যে যার মতো করে খুঁজে নিই। যেমন নিই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। এখানে মুদ্রিত কবিতাটি ফাতেমেহ কেশাভারজের ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণে রচিত।

শিল্পশিক্ষার আনন্দযজ্ঞ

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নতুনত্ব সৃষ্টি এবং মানসিক উৎকর্ষ সাধনে বহুমাত্রিক চিন্তার প্রয়োগের উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে চলছে শিল্পশিক্ষার এক আনন্দযজ্ঞ। ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) অংশ হিসেবে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সপ্তাহব্যাপী চিত্রকলার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলো।

দুই বাংলার চারুশিল্পের প্রসিদ্ধ শিক্ষক ও শিল্পীদের সমাগম ঘটেছে বাংলাদেশে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প—এই পাঁচটি বিভাগ মিলে এ আয়োজন। ২০১০ সালের শেষ দিকে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুজন শিক্ষক বিশ্বভারতীতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করেছেন। পরে শান্তিনিকেতন থেকে ১২ জন শিক্ষক-শিল্পী এ দেশে এসেছেন। গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী এবং চারুকলা অনুষদের শিক্ষকদের সমন্বয়ে শুরু হয়েছিল দুই দিনের একটি কর্মশালা। ভারতীয় শিল্পের পুরোধা কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ এই কর্মশালা উদ্বোধন করেন একটি ক্যানভাসে ছবি এঁকে। শুধু ছবি আঁকা নয়, ছিল শিল্পবিষয়ক নানা মতবিনিময়, সেমিনার এবং মুক্ত আলোচনা। প্রথম দুই দিন ভারতীয় শিল্পী এবং এ দেশের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ ঘটেছে ছাত্রছাত্রীদের। পরবর্তী চার দিন ভারতীয় শিল্পীরা বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের শিল্পকর্ম-শিল্পভাবনা বিনিময় করেছেন। সেমিনারে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সচিত্র উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল। এ ক্ষেত্রে কলা ভবন এবং নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, বাংলাদেশের লোকশিল্প, বাংলাদেশের মূলধারার শিল্পকলা—এ রকম নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে প্রতিদিন। দুই দেশের শিল্পের তাত্ত্বিক বিষয়াবলির পর্যালোচনা নতুনভাবে উঠে এসেছে।
বিশ্বভারতীর কলা ভবনের অধ্যক্ষ পঙ্কজ পাঁওয়ার এই শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নানা দেশের এ ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তা বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময় বেশি। এ ধরনের কার্যক্রমে বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়; সম্ভব হয় প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতাকে দূর করা।
গতানুগতিক ধারার বাইরে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা-চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিনিকেতন। পাশ্চাত্যের শিল্প-শিক্ষাকে গ্রহণ না করে নিজস্ব সমৃদ্ধ কৃষ্টি-শিল্প-সংস্কৃতির বৈভবকে আত্তীকরণ করেছে শান্তিনিকেতন। পঙ্কজ পাঁওয়ার মনে করেন, শিল্পের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কারণেই সাধারণের চেয়ে আলাদা হয় শিল্পীরা। তার কাজ মানুষের জীবনকে করে তোলে আরও অনুভূতিশীল ও আনন্দময়। বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পের প্রতি আগ্রহ তীব্র। তাদের শিল্পকর্মে একটা তাগিদ অনুভব করা যায়। এ দেশের শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উষ্ণ আতিথেয়তায় আমরা অভিভূত।
শিল্পী সঞ্চায়ন ঘোষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, এই শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নির্ভর করছে এর পরিকল্পনার ওপর। শিল্প-শিক্ষায় শিক্ষার্থীর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়; একটা পদ্ধতি শিখে তা অনুশীলন, চর্চা এবং নতুন কী সৃজন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শুধুই তাকে নানা পথের সন্ধান দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ না করে বিস্তৃত করে দিতে পারে।
ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) প্রথম অংশে অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান শিল্পী ফরিদা জামান গিয়েছিলেন। তিনি জানালেন, পরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম নিয়ে তাঁরা ভাববেন। এ ছাড়া এই ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর্থিক সমস্যাও রয়েছে; এবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আর্থিক-সহায়তা সাময়িক সমাধান দিয়েছে।
আয়োজকদের একজন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমাদের শিক্ষা বিনিময়ের এই উদ্যোগ সফল হয়েছে শিল্পী রফিকুন নবীর মাধ্যমে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই কার্যক্রমে ব্যবহারিক বিষয়ের বাইরে তত্ত্বীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জাদুঘরে ভ্রমণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় শিল্পীরা হলেন—নন্দদুলাল মুখার্জি, দিলীপকুমার মিত্র, সুমিতাভ পাল, ঋষি বড়ুয়া, সলিল সাহানি, অর্পণ মুখার্জি, প্রবীরকুমার বিশ্বাস, প্রসুনকান্তি ভট্টাচার্য, সৌমিক নন্দী মজুমদার, পঙ্কজ পাঁওয়ার, সঞ্জয়কুমার মল্লিক, সঞ্চায়ন ঘোষ প্রমুখ।
শিল্প পৃথিবীকে অনুভব করার আবেগময় কৌশল। শিল্পী সর্বদা চেষ্টা করেন তাঁর স্পন্দিত অনুভূতিকে শিল্পকর্মে প্রকাশ করতে। বাংলার শিল্পকলার এই বিভাজন রাজনৈতিক; একই ভাষা, একই অনুভূতি, একই মানুষ, একই প্রকৃতির মেলবন্ধন এবং শিল্প ও ভাব বিনিময় আমাদের নিজেদের চিনতে সাহায্য করবে।