Sunday, January 30, 2011

ভর্তুকির সার যাচ্ছে রঙে by শফিকুল ইসলাম জুয়েল

মুড়ি তৈরিতে ইউরিয়া সার ব্যবহারের খবরটি পুরনো। এবার জানা গেল কাপড় ও সুতার রং টেকসই করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন এই সার ব্যবহার করছে। নাইট্রোজেন কাপড় ও সুতার রং পাকা করে। এই নাইট্রোজেনের প্রয়োজন মেটাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষকের ইউরিয়া সার।

ফলে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ হওয়া ভর্তুকি মূল্যের অন্তত তিন লাখ টন ইউরিয়া চলে যাচ্ছে শিল্পসহ অকৃষি খাতে। এতে সরকার বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রায় সাড়ে সাত হাজার গার্মেন্ট (প্যান্ট, শার্ট, সোয়েটার) ও নিট শিল্পের (গেঞ্জি-জাতীয় কাপড়) চাহিদা মেটাতে তিন শতাধিক টেক্সটাইল ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা সুতা ও কাপড় প্রস্তুত করে। এসব কারখানায় নাইট্রোজেনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে ইউরিয়া সার। কর্মকর্তাদের হিসাবে ডাইং ও প্রিন্টিং শিল্পের চাহিদা মেটাতে বছরে অন্তত তিন লাখ টন ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। তুলনামূলক বেশি কাপড় প্রস্তুতকারক একেকটি ডাইং ও প্রিন্টিং কারখানা মাসে এক টনেরও বেশি ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকে।
সাভারে অবস্থিত মোশারফ ডাইং কারখানা ও রুবেল প্রিন্টিং কারখানার দুজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, কাপড়ের রং পাকা করতে তাঁরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা রঙের সঙ্গে মেশাতে ইউরিয়া সার প্রথমে পানিতে ভিজিয়ে গুলে নেন। এরপর রঙের সঙ্গে মেশানোর পর মেশিনের সাহায্যে কাপড়ে লাগানো হয়। কর্মচারীরা জানান, প্রতি কেজি রঙে অন্তত ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশাতে হয়। সার কিভাবে সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে একটি কারখানার কর্মচারী কোনো মন্তব্য করেননি। অন্য কারখানার কর্মচারীটি বলেন, ‘বাজার থেকেই সার কেনা হয়, এখনো তিন বস্তা সার মজুদ আছে স্টোর রুমে।’ পরে স্টোরকিপার ও মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে মোশারফ ডাইং কারখানার মালিক মোশারফ হোসেন খন্দকার ভর্তুকির সার তাঁর কারখানায় ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাপড়ের রং পাকা করতে আমরা অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করি। কিছু টাকা বেশি দিয়ে বাজার থেকেই সার কিনে আনি।’ তিনি দাবি করেন, ‘শুধু আমরাই নই; দেশের প্রায় সব ডাইং কারখানায় আমাদের চেয়েও বেশি সার ব্যবহার করে।’
কৃষকের সার কিনে এনে কাপড় রং করার কথা স্বীকার করেছেন রুবেল প্রিন্টিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আবদুস সালামও। গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বেশি সার ব্যবহারকারী বড় কারখানার মালিকরাই আমদানি করে না। সেখানে আমি তো ছোট ব্যবসায়ী; তাই আমদানির চিন্তা করি না।’ তিনি দাবি করেন, ‘বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দিলেই সার পাওয়া যায়।’
ভর্তুকি মূল্যের ইউরিয়া সার শুধু কৃষি ফসল ও কৃষকের জন্য বরাদ্দ। এর পরও শিল্পমালিকরা সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ও উৎকোচের বিনিময়ে সংগ্রহ করে অকৃষি খাতে ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। অথচ নির্দেশনা রয়েছে, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে যে কেউ আমদানি করতে পারবে। ভর্তুকির সার ব্যবহার করা যাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, শিল্প খাতে সার দেওয়ার জন্য মন্ত্রী-এমপিসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুপারিশ করেন। ফলে চাপে পড়ে এবং তাঁদের মন রক্ষায় সার দিতেই হয়। উৎকোচের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নেই না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাত্র কিছুদিন আগে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি সাভারের এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে ভর্তুকির সার এক কাপড় রং কারখানার মালিকের কাছে বিক্রির জন্য চাপ দেন। কর্মকর্তা দিতে অস্বীকার করেন এবং এর কিছুদিন পরই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ম্যানেজার (মার্কেটিং) মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষির নামে বরাদ্দ হওয়া ভর্তুকির সার শিল্পসহ নানা খাতে যায়, এমন খবর আমরাও জানি। তবে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ, সার ডিলারদের নামে বরাদ্দ দেওয়ার পর আমাদের আর দায়িত্ব থাকে না। সেটা মনিটর করার কথা জেলা সার কমিটির।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের কৃষি ফসলের জন্য ৬৪ জেলায় ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারের ইউরিয়া বরাদ্দ ২৮ লাখ ৩১ হাজার টন। এর মধ্যে বরাদ্দ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ৫০ হাজার টন ও আপৎকালীন ৫০ হাজার টন। এ ছাড়া মৎস্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩০ হাজার টন ও প্রাণিসম্পদ খাতে এক হাজার টন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, ডাইং-প্রিন্টিং শিল্পসহ তামাক, ইটখোলা, গো-খাদ্য, মুড়িসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া সার। যার চাহিদাও পূরণ হয় ভর্তুকি মূল্যের সার দিয়েই। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বরাদ্দ ৫০ হাজার টন থাকলেও ব্যবহার করা হয় (চা বাগান, চিনি করপোরেশন, রাবার বাগানসহ সংশ্লিষ্ট খাতে) এক থেকে দেড় লাখ টন ইউরিয়া সার।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশের অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটাতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় এবং তা নেওয়া হয় ভর্তুকির সার থেকেই। প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরিয়া আমদানি করে না। তবে গত ছয় মাসে চারটি কম্পানি সার আমদানির অনুমতি নিয়েছে। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে বিআরবি কেব্ল্ ইন্ডাস্ট্রিজ আমদানি করেছে তিন হাজার টন ইউরিয়া সার।
কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের কারখানাগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদন কমে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ টন ইউরিয়া আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ববাজারের মূল্য অনুযায়ী (প্রতি টন ৩৮০ ডলার) ইউরিয়া আমদানি ও ডিলার পর্যায়ে বিক্রির পর প্রতি টনে সরকারের ভর্তুকি যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা। এ হিসাবে শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে যাওয়া তিন লাখ টনে প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে সরকারের।
কৃষিসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক কোটার বাইরে অতিরিক্ত সারের প্রয়োজন হলে শিল্পমালিকরা স্বাধীনভাবে আমদানি করতে পারবেন। তবে কৃষকের ভর্তুকির সার কোনোভাবেই শিল্পে ব্যবহার করতে পারবেন না। কৃষি ফসলের চাহিদা অনুযায়ী সার আমদানি ও বরাদ্দ হয়। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, সার বিতরণ ব্যবস্থাপনায় কঠোর মনিটরিং রয়েছে। এর পরও কেউ অনিয়ম করলে এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক সময় বরাদ্দ না থাকলেও শিল্পমালিকদের অব্যাহত চাহিদা ও তদবিরের মুখে বিপাকে পড়েন সার ডিলাররা। তবে রপ্তানিমুখী খাত শিল্পের চাহিদা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

No comments:

Post a Comment