Sunday, January 16, 2011

বিপ্লবের প্রতীক বোয়াজিজি

নগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনেই জাইন এল আবিদিন বেন আলীর পতন ঘটেছে। কোনো একক দল বা নেতা এই আন্দোলন গড়ে তোলেননি। ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রনায়কের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে মানুষকে সাহস জুগিয়েছেন অখ্যাত যুবক মোহাম্মদ বোয়াজিজি।

নিজের জীবন দিয়ে তিনি জাইন এলের অপশাসনের চিত্র তুলে ধরেছেন দেশবাসীর সামনে। তাই সরকার পতনের পর বোয়াজিজি পাচ্ছেন জাতীয় বীরের মর্যাদা।
তিউনিসিয়ায় গণ-আন্দোলন শুরু হয় বোয়াজিজির প্রতিবাদের মাধ্যমেই। ২৬ বছর বয়সী এ যুবক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েও চাকরি পাচ্ছিলেন না। নিরুপায় হয়ে রাস্তায় ফল বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে দোকানদারির অনুমতি নেননি বলে ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ তাঁর ফলের ঝুড়ি ও টাকাপয়সা কেড়ে নেয় এবং নির্যাতন করে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে বোয়াজিজি প্রতিবাদ জানালেও কেউ তাঁকে সহায়তা করেননি। ক্ষোভ-দুঃখ আর অপমানে ওই দিনই সিদি বোজিদ এলাকায় শত শত মানুষের সামনে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। এ ঘটনার পরই বেকারত্ব দূর করার দাবিতে তিউনিসিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে। গত ৪ জানুয়ারি যখন হাসপাতালে বোয়াজিজির মৃত্যু হয়, তখন প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে তিউনিসিয়ার অলি-গলিতে।
তিন সপ্তাহের আন্দোলনে তিউনিসিয়ায় ৬৬ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে বলে দাবি করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এত মৃত্যুর মধ্যেও বোয়াজিজির আত্মাহুতির বিষয়টি বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে। মানুষকে রাস্তায় নামতে অনুপ্রাণিত করার জন্য তাঁর শরীরে আগুন লাগানোর ছবিটিই ব্যবহার করেছে বিক্ষোভকারীরা। বোয়াজিজির নামে ফেইসবুকে একটি পেইজ খোলা হয়েছে, যাতে তাঁর পরিচয় দিয়ে লেখা হয়েছে, 'তিউনিসিয়ার বিপ্লবের প্রতীক'। আর বোয়াজিজির মতো সাহসী ও প্রতিবাদী যুবকের অপেক্ষা করছে অন্যান্য আরব দেশের নিপীড়িত মানুষ। মিসরের মানবাধিকারকর্মী আবদেল হালিম কানদিল যেমন বলেছেন, 'বোয়াজিজির মতো একজন মানুষ দরকার আমাদের।' সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস।

তিন বিভাগে একযোগে শিশু চলচ্চিত্র উৎসব

বার বড় পরিসরে হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব। চতুর্থবারে এসে এ উৎসব একযোগে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হবে। উৎসবে বাংলাদেশসহ মোট ৪০টি দেশের ২৩৩টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখানো হবে। শিশু নির্মিত চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায়ও এবার ব্যাপক সাড়া মিলেছে।

৯৮টি চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে চূড়ান্ত বিচারের জন্য ৪৮টিকে মনোনীত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান উৎসব পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বরাবরের মতো এবারও উৎসবের স্লোগান হচ্ছে, 'ফ্রেমে ফ্রেমে আগামী স্বপ্ন'। ২২ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে উৎসব উদ্বোধন করবেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর ১৪টি মিলনায়তনে দর্শকরা এসব ছবি উপভোগ করতে পারবে। প্রতিটি ছবিই শিশুদের জন্য উন্মুক্ত। তবে বড়রা ৩০ টাকার দর্শনীর বিনিময়ে ছবি দেখার সুযোগ পাবেন। ছবিগুলোর মধ্যে থাকছে পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, অ্যানিমেশন ও প্রামাণ্যচিত্র। উৎসব চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত।
সংবাদ সম্মেলনে উৎসব উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মুস্তাফা মনোয়ার, ড. ইয়াসমীন হক, চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বক্তব্য দেন।
উৎসবের মূল ভেন্যু সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার। এর বাইরে ঢাকার শিশু একাডেমী, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজ (ধানমণ্ডি ও উত্তরা), রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, খিলগাঁও মডেল স্কুল, কলেজ অব লেদার টেকনোলজি (হাজারীবাগ)। চট্টগ্রামে উৎসব হবে থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। এর বাইরে কয়েকটি বিদ্যালয় ও মাঠে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। রাজশাহীতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তন এবং জেলা পরিষদ মিলনায়তনে উৎসবের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে।
প্রমা অবন্তির ওড়িশি নৃত্যের মোহনীয় সন্ধ্যা : নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তি ও তাঁর দলের ওড়িশি, বটু, চতুরঙ্গ নৃত্য মুগ্ধ করল রাজধানীর দর্শক-শ্রোতাদের। শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় গতকাল সন্ধ্যায় ওড়িশি অ্যান্ড টাগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার পরিবেশন করে অপূর্ব সব ধ্রুপদী নৃত্য।
প্রথমে ছিল বটু নৃত্য। ওড়িশি নৃত্যের শুদ্ধ পদ্ধতি মেনে নিয়ে সুর, তাল ও ছন্দের মার্গীয় সুধা ও লয়ে এটি পরিবেশিত হয়। এ নৃত্যে মোহনীয় ভঙ্গিতে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন মন্দির গাত্রের ভাস্কর্য কিংবা ভাস্কর্যপ্রতিম অঙ্গসঞ্চালন। একতাল ও কলাবতী রাগে প্রমার দল এ নৃত্য পরিবেশন করে। দ্বিতীয় পর্বে প্রমা পরিবেশন করেন চতুরঙ্গ।
রণেশ দাশগুপ্তের শততম জন্মদিন উদ্যাপন : রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। তিনি তাঁর সাহিত্য, শিল্প ও কর্মের মাধ্যমে গণমানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। তাঁর আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি উদীচী, প্রগতি লেখক সংঘের মতো প্রগতিশীল সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তৈরি করেছেন অসংখ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তের শততম জন্মদিনে এভাবেই তাঁকে স্মরণ করলেন বিশিষ্টজনরা। গতকাল শনিবার মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে রণেশ দাশগুপ্তের শততম জন্মদিন উদ্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উদীচী।
১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি রণেশ দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আগামী বছর রণেশ দাশগুপ্তের জন্মশত বার্ষিকী উদ্যাপনে উদীচীর উদ্যোগে শুরু হলো বছরব্যাপী আয়োজন।

বিচার বিভাগ শুধু সৃষ্টিকর্তা ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ

প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ কেউ কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। এ তিনটি অঙ্গসহ সবাই জবাবদিহি করবে জনগণের কাছে। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। তিনি বলেন, বিচার বিভাগও কারোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। তারা শুধু সৃষ্টিকর্তা ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।

হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. ইমান আলীর লেখা শিশুবিষয়ক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে গতকাল শনিবার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এ কথা বলেন। বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত এ মোড়ক উন্মোাচন অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, ইউনিসেফের প্রতিনিধি ক্যারেল ডি রয় ও বিচারপতি মো. ইমান আলী বক্তব্য দেন।
এ সময় হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক বিচারপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. আশরাফুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ‘টুয়ার্ডস জাস্টিস ডেলিভারি সিস্টেম ফর চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ৬০৯ পৃষ্ঠার বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ (সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) একে অপরের পরিপূরক। কেউ কারোর ঊর্ধ্বে নয়। চাঁদ যেমন সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়, তেমনি রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ জনগণের ক্ষমতার আলোকে আলোকিত হয়। বিচার বিভাগও জনগণের ক্ষমতায় আলোকিত। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছে না। তাই আমরাও অন্য কাউকে বিচার বিভাগের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে দেব না।’
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, বিচার বিভাগেরও একটি জবাবদিহিতা রয়েছে। বিচার বিভাগ কখনোই দাবি করেনি তারা সার্বভৌম। বিচার বিভাগ জনগণের কাছে এবং কৃতকর্মের মাধ্যমে দায়বদ্ধ। বিচারকরা রায় ও আদেশের মাধ্যমে যুক্তি দিয়ে জবাবদিহিতা প্রকাশ করেন।
বিচার বিভাগ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, টিআইবি বিচার বিভাগের ওপর কালিমা লেপন করে দিয়েছে। বিচার বিভাগকে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত উল্লেখ করে টিআইবি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেটি তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও প্রধান বিচারপতি জানান। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতেই কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি দুর্নীতিপরায়ণদের খুঁজে বের করতে কাজ করছে।
শিশুদের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো শিশুই অপরাধী হয়ে জন্মায় না। পরিস্থিতি তাদের অপরাধী হতে বাধ্য করে। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’-এ কথা মনে রাখলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, জাতিকে শিশুদের উন্নয়নের জন্য আরো বেশি কাজ করতে হবে। শিশুদের উন্নতি না হলে জাতির উন্নয়ন হবে না। তিনি শিশুবিষয়ক মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিচালনা করার জন্য বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, শিশুদের বিষয়ে যে আইন আছে, তা সম্পর্কে আইন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহিত হতে হবে। শিশুরা যেন কোনো অবিচার ও অন্যায়ের শিকার না হয় সে বিষয়ে সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে।
বিচারপতি ইমান আলী বলেন, শিশুদের রক্ষার বিষয়ে আইনের বিধান যা আছে, সে ব্যাপারে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট বা আইনজীবীরা পুরোপুরি সচেতন নন। তাঁদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। শিশুদের অধিকার রক্ষা করতে হবে।
গত ২১ ডিসেম্বর কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচার বিভাগ কার কাছে জবাবদিহি করবে সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরপর গত ৩ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় বিচারপতিরা মত প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের সংসদ সার্বভৌম নয়। তাই সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে সুপ্রিম কোর্ট বাধ্য নয়।
এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তখন বলেছিলেন, সংসদই রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। ওই রাষ্ট্রপতিই প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। তাহলে বলা যায়, সবাইকে নিয়োগ দেয় সংসদ।

নয় পুলিশের রক্তে পিচঢালা পথ লাল

রসিংদীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ওসিসহ পুলিশের ৯ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত আরেক পুলিশ সদস্য আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুর উপজেলার ঘাসিরদিয়া এলাকায় একটি মালবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতদের সবাই নরসিংদীর বেলাব থানায় কর্মরত ছিলেন। স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে একটি সভায় যোগ দিতে ওই পুলিশ সদস্যরা নরসিংদী পুলিশ লাইনে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ খান (৪৫), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) জিয়াউল খান (৪০), উপপরিদর্শক (এসআই) কংকন কুমার মণ্ডল (৪২), কনস্টেবল কৃষ্ণ কুমার বর্মণ (৫০), রিয়াজ উদ্দিন (৪০), নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ (৪৫), বজলুর রহমান (৫০), মাসুদ পারভেজ (৪২) ও গাড়িচালক রেজাউল হক (৪০)। আহত কনস্টেবলের নাম প্রিয়তোষ (৫০)।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ১৭ জানুয়ারি নরসিংদী ও মনোহরদী পৌরসভার নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে নরসিংদী পুলিশ লাইনে একটি সভা ডাকা হয়েছিল। সভায় যোগ দিতে সকালে বেলাব থানার ওসি ফারুক আহমেদসহ ১০ জনের একটি দল পুলিশ ভ্যানে করে সেখানে যাচ্ছিল। সকাল সোয়া ১১টার দিকে তাদের গাড়িটি শিবপুরের ঘাসিরদিয়া এলাকা অতিক্রম করছিল। ওই সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মাছবোঝাই ট্রাক (যশোর মেট্রো-ট-১১-২৩৫২) পুলিশ ভ্যানের ওপর উঠে পড়ে। এতে পুলিশ ভ্যানের সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে ট্রাকের ভেতর ঢুকে যায়। ঘটনাস্থলেই জিয়াউল খানসহ পুলিশের আট সদস্য নিহত হন। ওসি ফারুক আহমেদ ও কনস্টেবল প্রিয়তোষকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফারুক মারা যান।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক জানান, মারাত্মক আহত প্রিয়তোষকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাত সোয়া ১২টার দিকে যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাসউদ্দিন ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, প্রিয়তোষের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, দুর্ঘটনার পর ১০ জনকেই জেলা হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে আগেই আটজনের মৃত্যু হয়েছিল। হাসপাতালে আনার ১০ মিনিট পর ফারুক আহমেদের মৃত্যু হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত পুলিশের ভ্যান ও ট্রাকটি মহাসড়কে পড়ে রয়েছে। সংঘর্ষের ফলে পুলিশ ভ্যানের সামনের অংশ ট্রাকের ভেতরে চলে যায়। এতে পুলিশের ভ্যানের সামনে থাকা ফারুক, জিয়াউল ও গাড়িচালক রেজাউল ট্রাকের সঙ্গে আটকে পড়েন। খবর পেয়ে শিবপুর থানা পুলিশ, নরসিংদী পুলিশ লাইনের রিজার্ভ পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তাঁরা ক্রেন দিয়ে দুদিক থেকে টেনে গাড়ি দুটি আলাদা করেন। সামনে থাকা ফারুককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জেলা হাসপাতালে পাঠানো গেলেও বাকি দুজন আগেই মারা যান। নিহতদের রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা পথ। দুর্ঘটনার পর ট্রাকটি আটক করা হলেও এর চালক ও তার সহকারী পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় শিবপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মহাসড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নিলে দুপুর ১২টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) হাসান মাহমুদ খন্দকারকে ফোন করে এ দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানান।
দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া স্থানীয় ঘাসিরদিয়া গ্রামের জসিমউদ্দিন বলেন, ‘ট্রাকের ভেতর পুলিশের গাড়ি ঢুকে যাওয়ায় আহতদের উদ্ধার করা যাচ্ছিল না।’
নরসিংদী জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেতে সারি সারি লাশ। একসঙ্গে এত সহকর্মীর চলে যাওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না অন্যরা। শোকে অনেক পুলিশ সদস্য নির্বাক হয়ে পড়েন। কেউ কেউ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
বেলাব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরবীকুল কাঁদতে কাঁদতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকালে থানায় আমার ডিউটি থাকায় স্যারদের গাড়িতে পুলিশ লাইনে আসা হয়নি। আমি গাড়ির পেছনেই মোটরসাইকেল নিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ করে ঘাসিরদিয়ায় আসার পর দেখি আমাদের গাড়িটি ট্রাকের ভেতরে চলে গেছে। আমাদের স্যাররা মারা গেছেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে আবারও তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্না থামিয়ে তিনি আবার বলেন, ‘আমাদের গাড়িটি অনেক পুরনো। থানায় কোনো নতুন গাড়ি না থাকায় ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। ভালো গাড়ি থাকলে একসঙ্গে এত মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হতো না।’
নিহত ফারুকের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলী আহাম্মদ খান। জিয়াউল খানের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার বাগডোবা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ডালিম খান। কংকন কুমার মণ্ডলের বাড়ি খুলনা সদর উপজেলার পাইকগাছা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নিত্যানন্দ। এ ছাড়া কনস্টেবল কৃষ্ণ কুমার বর্মণ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার উত্তর লস্করচালা গ্রামের শ্রীকান্ত বর্মণের ছেলে, রিয়াজ উদ্দিন কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে, নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভেহিবখলা গ্রামের সাধন কুমারের ছেলে, বজলুর রহমান মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের ফয়জুদ্দিনের ছেলে, মাসুদ পারভেজ জামালপুর সদর উপজেলার দমদমা গ্রামের ছোহরাব আলীর ছেলে ও গাড়িচালক রেজাউল হক জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার গোবিন্দনগর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। আহত প্রিয়তোষ নেত্রকোনা সদর উপজেলার সাতপাই গ্রামের নিরঞ্জন চন্দ্র পালের ছেলে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, নজরুল ইসলাম হীরু, জহিরুল হক মোহন, স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার, আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, উপমহাপরিদর্শক (ঢাকা রেঞ্জ) মো. আসাদুজ্জামান, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক অমৃত বাড়ৈ, পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা, নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনায় পড়লে পুলিশের সদস্যরা তাদের বাঁচাতে ছুটে যেতেন। তাঁরা উদ্ধার করতেন। কিন্তু আজ তাঁদেরই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হলো। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘বেলাব থানা থেকে আমার কাছে ফোন যেত একটি গাড়ির জন্য। কিন্তু আমি তাঁদের নতুন গাড়ি দিতে পারিনি। আজ পুরনো গাড়িতে চড়ে দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের এমন দুঃখজনক মৃত্যু হলো। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ দেখে নির্বাক হয়ে যান। কনস্টেবল নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ ও পুলিশের গাড়িচালক রেজাউল হকের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তাঁর চোখও ছলছল করে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুলিশের আধুনিক যানবাহনের অভাব রয়েছে। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি দিয়ে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এভাবেই আত্মত্যাগ করে যাচ্ছেন। এমন আরো অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা দায়িত্ব পালন করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইজি হাসান মাহমুদ বলেন, পৌরসভা নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় কনস্টেবলদের উপস্থিতি দরকার ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ধ্যার পর নিহতদের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে নরসিংদী পুলিশ লাইনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

লাশের পকেটে বেজে উঠল ফোন

রসিংদী জেলা হাসপাতালের লাশঘরে গতকাল সারি সারি রাখা নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ। হঠাৎ বেজে ওঠে মোবাইল ফোন। শব্দ আসছিল নিহত কনস্টেবল রেজাউল করিমের পোশাকের ভেতর থেকে। একজন কনস্টেবল মোবাইল ফোনটি বের করে কল ধরেন।

ও প্রান্তের কথা শুনে বলেন, ‘আমি রেজাউল না। আপনারা দ্রুত জেলা হাসপাতালে আসেন।’ ফোনের লাইন কাটার পর কারো সঙ্গে কথা না বলেই নীরবে কাঁদতে থাকেন ওই কনস্টেবল। হাসপাতালে একইভাবে আরো দুজন নিহত কনস্টেবলের পকেটে মোবাইলের রিং বেজে ওঠে। কনস্টেবল মঞ্জুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “নিহতের স্বজনরা ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানতে চেয়েছেন। কেউ বলেন, ‘আমার ছেলে এখন কেমন আছে?’ কেউ বলেন, ‘অজয়ের বাবার কী অবস্থা?’ কিন্তু আমি কিভাবে বলব, দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেছে! ”
সকালেও কথা হয়েছিল : ‘পৌরসভা নির্বাচনের কারণে খুব ব্যস্ত থাকতে হবে।
মেয়েদের বলবা, ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া করতে।’ স্ত্রী জয়নবুন্নেসা স্মৃতিকে সকালে মোবাইল ফোনে বলেছিলেন নরসিংদীর বেলাব থানার ওসি ফারুক আহমেদ খান। এর দুই ঘণ্টা পর স্ত্রী খবর পান, তাঁর স্বামী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার থেকে তিন মেয়ে অনিকা (৯), অর্ণা (৭) ও প্রিয়ন্তিকে (৪) নিয়ে নরসিংদী ছুটে যান স্মৃতি। গিয়ে পান স্বামীর নিথর দেহ।
‘ও দাদা, আমার বাবা কথা বলে না কেন, কী হয়েছে আমার বাবার? গায়ে এত রক্ত কেন?’ দাদা আলী আহাম্মদ খানকে প্রশ্ন করে অনিকা। কী জবাব দেবেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আলী আহাম্মদ খান? বুকচাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ওরা আমার সোনারে কাইড়া নিছে!’ ওদিকে স্বামীর লাশ দেখে স্মৃতি বিলাপ করছিলেন, ‘তোমাকে ছাড়া ওরা কিভাবে বাঁচবে? কাকে বাবা বলে ডাকবে?’ মায়ের কান্না দেখে প্রিয়ন্তিও কাঁদতে থাকে। বাবাকে হারিয়ে কাঁদছিল অর্ণাও।
রিক্তর কী থাকল? : কনস্টেবল নারায়ণচন্দ্র দাস স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেলাব থানার পাশেই ভাড়া বাসায় থাকতেন। ছেলে অজয় প্রসাদ রিক্ত (৭) স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে সমিতা রানী চন্দ্রের বয়স চার বছর। সংবাদ পেয়ে বেলাব থেকে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ছুটে এসেছেন নারায়ণচন্দ্র দাসের স্ত্রী সুবর্ণা রানী চন্দ্র।
সহ্য করতে পারবেন না ভয়ে সুবর্ণাকে স্বামীর লাশের সামনে যেতে দিচ্ছিলেন না নারায়ণের সহকর্মীরা। সুবর্ণা হাসপাতালের বারান্দায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বসে বিলাপ করতে থাকেন। মায়ের কান্না দেখে দুই পাশে অবুঝ দুই সন্তান নির্বাক হয়ে যায়। রিক্ত সাংবাদিকদের জানায়, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাবা বাড়ি থেকে বের হন। যাওয়ার সময় বলেন দুষ্টুমি না করতে। আমি কথা দিয়েছি, দুষ্টুমি করব না। কিন্তু এখন আংকেলরা বলছেন, বাবা নাকি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাহলে কি বাবা আর ফিরে আসবেন না!’
কাঁদতে কাঁদতে সুবর্ণা রানী চন্দ্র বলেন, ‘রাতে নারায়ণের ডিউটি ছিল। ভোর ৫টার দিকে বাড়ি ফেরেন তিনি। আবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ লাইনের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন।’ সকাল ১১টায় আসে দুর্ঘটনার সংবাদ। কাঁদতে কাঁদতে একসময় মূর্ছা যান সুবর্ণা। জ্ঞান ফেরার পর বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘দুটি ছোট ছেলে-মেয়েকে এখন কিভাবে আমি মানুষ করব?’
সহকর্মীদের কান্না : সহকর্মীদের লাশ নিজ হাতে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে লাশঘরে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য কনস্টেবলরা। আবার সেই লাশ তাঁরাই নিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ লাইনে। লাশ বহনের সময় প্রতিটি সহকর্মীর চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছিল। কনস্টেবল মোস্তফা বলেন, ‘মাসুদ পারভেজ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দেখা হলেই বাড়ির খোঁজ নিতেন। গতকালও আমাদের কথা হয়। আজ তাঁর লাশ বহন করতে হচ্ছে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এখন মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।’
সহকর্মীদের মরদেহ গাড়িতে তোলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাকও। এ সময় উপস্থিত অন্যরাও অশ্র“ সংবরণ করতে পারছিলেন না। বিজয় বসাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালেও তাঁরা সবাই ছিলেন সহকর্মী। আর এখন তাঁরা আমাদের মধ্যে নেই, আছে তাঁদের নিথর দেহ। এটা কোনো পুলিশের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’ নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন দুর্ঘটনার পর থেকে ছোটাছুটি করছেন। তিনি বলেন, ‘নরসিংদী পৌরসভার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় আসতে গিয়ে এভাবে প্রাণ হারাতে হবে আমার লোকজনকে, ভাবতেই পারছি না।’
নিহত পুলিশ সদস্যদের মরদেহ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের চোখই ছলছল করে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশে এমন দুর্ঘটনা কখনো দেখিনি।’ তিনি নিহতের পরিবারকে সরকার থেকে বিশেষভাবে সহায়তা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। তিনি সনাতন ট্রাফিক আইন পরিবর্তন করে তা যুগোপযোগী করার ব্যাপারেও মত দেন।
আনোয়ার হোসেন নামের একজন সহকর্মী বলেন, ‘বিশ্বাসই করতে পারছি না। গাড়িতে ওঠার আগেও একসঙ্গে চা খেলাম, গল্প করেছি, সেই মানুষগুলো এখন লাশ!’

তবে কি ঘুম ভাঙল আরবদের by ইব্রাহীম বিন হারুন

ণ-আন্দোলন কিভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা শাসককে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে, এর সর্বশেষ নজির তিউনিসিয়া। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই নজির ঢের থাকলেও তেল-সমৃদ্ধ আরব দেশগুলো কখনোই এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েনি। সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জায়িন এল আবিদিন বেন আলী।

উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জায়িন এল আবিদিন গত শুক্রবার গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। অথচ তিন সপ্তাহের আন্দোলনেই তাঁর 'ফাঁপা' মসনদ গুঁড়িয়ে গেছে। আর এ ঘটনাই নতুন বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে আরব বিশ্বে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তিউনিসিয়া থেকে বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ আরবের অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিউনিসিয়া ভৌগোলিকভাবে উত্তর আফ্রিকার অংশ হলেও জাতিগত বিচারে আরব বিশ্বের অংশ। শুধু জাতিতে না, পরম্পরায়ও মিল আছে এসব দেশের মধ্যে। বেশির ভাগ আরব দেশেই আজও জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কয়েকটি দেশ রাজতন্ত্র থেকে সরে এলেও সত্যিকার অর্থে সেখানে গণতন্ত্র আসেনি। একবার ক্ষমতা দখল করা শাসকরা নানা কৌশলে বছরের পর বছর ক্ষমতা আঁকড়ে রাখছেন। প্রকাশ্যেই বিরোধীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়ে মসনদ নিরাপদ রেখেছেন তাঁরা। তিউনিসিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা একনায়করা (লিবিয়ায় গাদ্দাফি ৪১ বছর, মিসরে মোবারক ২৯ বছর, সুদানে বশির ১৮ বছর, আলজেরিয়ায় আজিজ ১২ বছর) এ প্রবণতার প্রমাণ। তবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকলেও তাঁরা কখনো গণ-আন্দোলনের মুখে পড়েননি। তাই একটি ধারণা সৃষ্টি হয় যে, আন্দোলনের মাধ্যমে আরব বিশ্বে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। কিংবা আরবরা বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে না।
গণ-আন্দোলন না ঘটলেও আরব দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা বিদেশি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। এ ভয় থেকেই প্রতিবেশী একনায়কদের মতো সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল জায়িন এলের। সাদ্দাম হোসেনের মতো ভুল করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকেও খেপিয়ে তোলেননি। যাবতীয় সুরক্ষা-ব্যবস্থা থাকায় ৭৪ বছর বয়সী এ নেতা তিউনিসিয়ায় পরিচিত ছিলেন 'বিন এ ভাই' বা 'আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট' হিসেবে। তবে শেষ রক্ষা হলো না। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন প্রতিবেশী একনায়করাও। বিশ্লেষকরা এ ঘটনাকে দেখছেন আরব জনগণের 'ঘুম ভাঙা' হিসেবে। প্যারিসের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বুরহান ঘালিউন বলেছেন, 'বছরের পর বছর ঘুমিয়ে থাকা আরবদের জাগিয়ে তুলবে তিউনিসিয়া।' এক মিসরীয় তাঁর টুইটার বার্তায় লিখেছেন, 'আরব নেতারা ভয়ে ভয়ে তিউনিসিয়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে। আর আরব নাগরিকরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন দেশটির দিকে।'
বিশ্লেষকদের মতে, লিবিয়া বা মিসরের মানুষ কখনো অভিন্ন দাবি নিয়ে একনায়কের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হতে পারেনি। যদিও অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এসব দেশের জনগণের জন্য অভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করছে। কারণ, আরব দেশগুলো ধনী হলেও এসব দেশেও সাধারণ মানুষের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বেড়েছে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। এ পরিস্থিতিতে একনায়ক, তাঁদের স্বজন ও কাছের লোকদের দুর্নীতি ও বিপুল অর্থবিত্ত স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ করে তুলছে জনগণকে। তিউনিসিয়ার আন্দোলনও শুরু হয় বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে। ইতিমধ্যে আরব বিশ্বের জর্দান, লিবিয়া, মরক্কো, মিসর ও আলজেরিয়ায়ও একই দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা তিউনিসিয়ার ঘটনা থেকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। গতকালই কায়রোতে একটি মিছিল থেকে স্লোগান দেওয়া হয়, 'মোবারকের পতন চাই। জায়িন এলও প্রতারক, মোবারকও প্রতারক, গাদ্দাফিও প্রতারক।' মিছিলেরই একজন চিৎকার করে বলেন, 'জায়িন এল, মোবারককে বলে দিও_তাঁর পালানোর জন্যও একটি বিমান অপেক্ষা করছে।'

তিউনিসিয়ায় স্পিকার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট

ণবিক্ষোভের মুখে তিউনিসিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলীর দেশত্যাগের পর সেখানে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিউনিসিয়ার অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার ফুয়াদ মেবাজা।

অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট বিরোধীদের নিয়ে তিউনিসিয়ায় একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এদিকে, সাবেক প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের পর থেকেই রাজধানী তিউনিসসহ সারা তিউনিসিয়ায় ব্যাপক লুটপাট শুরু হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করছে। পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনাও ঘটছে।
গতকাল শনিবার তিউনিসিয়ার পর্যটন নগর মোনাসিরের একটি কারাগারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৪২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাত্ক্ষণিকভাবে এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা জায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কারাবন্দীরা পালিয়ে যাওয়ার জন্য এ ঘটনা ঘটাতে পারে। দেশটির অন্য কারাগারগুলোতে সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
পুরো দেশেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। দেশজুড়েই বিভিন্ন বিপণি-বিতান ও ঘরবাড়িতে ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বেন আলী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরই বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
এই অরাজক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে কারফিউ বলবত্ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্টের অনুসারীরাই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও অরাজক করতে এসব সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে।
গতকাল শনিবার দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বেন আলী জনতার তীব্র রোষের মুখে পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বেন আলী সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে বিক্ষোভ চলছিল। রয়টার্স, বিবিসি অনলাইন, আল-জাজিরা।

৪৫ হাজার চাষি এ বছর লবণ চাষ করছে না

বণের দেশীয় উৎপাদন চাহিদার চেয়েও বেশি। তবুও ভারত থেকে আমদানি করে পথে বসানো হচ্ছে দেশীয় লবণচাষিদের! বছরের পর বছর ধরে লোকসান দিয়েও লবণচাষ টিকিয়ে রেখেছে চাষিরা। কিন্তু চলতি বছর তারা একেবারেই অসহায়।

ক্ষতির আশঙ্কায় দেশের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের ৪৫ হাজার লবণচাষি এ বছর লবণ চাষ করছে না। গতকাল শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে লবণচাষিরা এসব কথা জানায়। নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে তারা ভারত থেকে লবণ আমদানি বন্ধের দাবি করে। পাশাপাশি তারা কৃষকপর্যায়ে লবণের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবিও জানায়। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কঙ্বাজারের লবণচাষি সমিতি।
লবণ শিল্পকে রক্ষার দাবিতে চাষিরা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তারা ২২ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও শোভাযাত্রা করারও ঘোষণা দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, কক্সবাজারের ও বাঁশখালিতে কৃষকপর্যায়ে প্রতি কেজি লবণের দাম মাত্র এক টাকা। এই লবণ প্রক্রিয়াজাত করে কম্পানিগুলো ১৮-২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। এতে কম্পানির মালিকরা ফুলেফেঁপে উঠলেও চাষিরা নিঃস্ব হচ্ছে। উচ্চমুনাফার পরও কম্পানিগুলো আরো মুনাফার আশায় ভারত ও মিয়ানমার থেকে ৪৫ পয়সা কেজি দরে লবণ আমদানি করছে। এতে দেশের লবণ অবিক্রীত থাকছে। সংবাদ সম্মেলনে লবণ শিল্পের উন্নয়ন প্রকল্পের উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশ লবণ উৎপাদনে সাবলম্বী। গত অর্থবছরে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৩ দশমিক ৩৩ লাখ টন। ওই বছর প্রকৃত উৎপাদন হয়েছে ১৭ দশমিক ৪০ লাখ টন। আমদানি উন্মুক্ত হওয়ায় গত বছর বিপুল লবণ অবিক্রীত থেকে গেছে। এ কারণে এই বছর লবণ মৌসুম শুরু হলেও প্রায় ৪৫ হাজার চাষি ক্ষতির আশঙ্কায় মাঠে নামছে না।
মূল রচনা উপস্থাপন করেন লবণ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক এফ এম নুরুল আলম। তিনি বলেন, 'ভারতে লবণের উৎপাদন খরচ খুবই কম। ভারতের কৃষকরা একরপ্রতি মাত্র ৯৫ রুপি খরচে লবণ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এ খরচের পরিমান ১৭-১৮ হাজার টাকা।' তিনি বলেন, 'কৃষকের কাছে লবণের কেজি মাত্র এক টাকা। কিন্তু ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ১৮-২০ টাকা দরে! পুরো মুনাফাই লুটে নিচ্ছে সিন্ডিকেট।'
যেকোনো অজুহাতে লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করা, চোরাইপথে লবণ আমদানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, মাঠপর্যায়ে মূল্যনির্ধারণ করে দেওয়া, লবণ বোর্ড গঠনসহ তিনি সরকারের কাছে লবণচাষিদের ১১টি দাবি উপস্থাপন করেন।
সমিতির সভাপতি এইচ এম শহিদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'ভারত এখন আমাদের কমদামে লবণ দিচ্ছে বাজার দখলের জন্য। দেশীয় বাজার ভারতের দখলে চলে গেলে এ দেশের লবণচাষ ধ্বংস হবে। এরপর ভারত দাম বাড়িয়ে দেবে_এটা নিশ্চিত।'
লবণচাষি শরীফ বাদশা বলেন, 'পার্শ্ববর্র্তী রাষ্ট্র ভারতের মতো লবণ শিল্প রক্ষায় প্রকৃত লবণ চাষিদের চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র দেওয়া এবং লবণ চাষের উন্নয়নে উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।' সংবাদ সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন কোস্ট ট্রাস্টের মোস্তফা কামাল আখন্দ। এ ছাড়া লবণচাষি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী, লবণচাষি ঐক্য পরিষদের সভাপতি শরীফ বাদশা, একই সংগঠনের সদস্য রহুল কাদের বাবুল, নাজেম উদ্দিন ও হারুনুর রশিদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

সীমান্তে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করবে বিএসএফ! by মেহেদী হাসান

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। কূটনৈতিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তবে আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ফেব্র“য়ারি মাসের মধ্যে ত্রিপুরা সীমান্তে বিএসএফ পরীক্ষামূলক রাবার বুলেটের ব্যবহার শুরু করবে।

ভারতে অনুপ্রবেশ রোধে এ ব্যবস্থা সফল হলে আগামী দিনগুলোতে মারণাস্ত্রর ব্যবহারের বদলে বিকল্প অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে শুধু কাশ্মীর সীমান্তে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী প্রাণঘাতী নয় (নন-লিথাল) এমন অস্ত্র ব্যবহার করে। এদিকে ঢাকায় স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার ভারতের এ উদ্যোগের কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানার কথা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ অনেক আগেই ভারতের কাছে এ দাবি জানিয়েছিল। ভারত এ ধরনের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ অবশ্যই একে সাধুবাদ জানাবে।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত ৫১ দফা যৌথ ইশতেহারের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এর পরও বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে বাংলাদেশিদের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ৭৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। তাদের মধ্যে ২৪ জনকে নির্যাতন ও ৫০ জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া গত বছর ৪৩ বাংলাদেশিকে বিএসএফ অপহরণ করেছে বলে সংগঠনটির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন সীমান্তে বিএসএফের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও দৃশ্যত দায়মুক্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গত ডিসেম্বর মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত ‘ট্রিগার হ্যাপি : অ্যাক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্র–পস অ্যাট দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তে বিএসএফ
জওয়ানদের দ্বারা নির্বিচার হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের অসংখ্য প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সংগঠনটির পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, বিএসএফকে বেপরোয়া মনে হয়েছে। সন্দেহভাজন মনে হলেই যে কাউকে গুলি করার নির্দেশ তাদের দেওয়া আছে। সীমান্ত এলাকায় মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অধিকাংশই অনুপস্থিত। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বৈঠক শেষে বিএসএফের মহাপরিচালক (ডিজি) শ্রী রমন শ্রীবাস্তব সীমান্তে গুলি বন্ধের আশ্বাস না দিয়ে বলেছিলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্তের ভারতীয় অংশে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) চলছে। এই কারফিউ ভেঙে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের অপরাধী বলেও তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন। সম্প্রতি বিএসএফের গুলিতে ফেলানির নির্মম মৃত্যুতে আবারও সীমান্ত পরিস্থিতির ভয়াবহতা উন্মোচিত হয়েছে।
গত শুক্রবার নয়াদিল্লির একটি সূত্র জানায়, ভারতের সেনাবাহিনীতে যখন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন চলছে, তখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার বন্ধের কথা ভাবছে বিএসএফ। ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন সীমান্তে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসএফ। এ প্রচেষ্টা সফল হলে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হবে। জানা গেছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আগামী মাস থেকেই ত্রিপুরা সীমান্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হবে। এতে অনুপ্রবেশকারীরা আহত হলেও নিহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
সূত্রে জানা যায়, সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বিএসএফ। শিগগিরই বিএসএফের ত্রিপুরা ডিভিশন সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারে হেলিকপ্টার পাবে। এই হেলিকপ্টার প্রায় ৮৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার ও রসদ সরবরাহ কাজে বিএসএফকে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে নাইট ভিশন চশমা ও আগাম সতর্ক ব্যবস্থা চালু হবে।
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ আগামী বছরের মার্চ মাসের দিকে শেষ হওয়ার কথা। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা বেড়া নেই এমন স্থানগুলো ব্যবহার করছে বলে বিএসএফ মনে করে। তাই সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওই স্থানগুলোর দিকে বেশি নজরদারি করবে।
বিএসএফের মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার গতকাল দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনিও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন সূত্রে এ বিষয়ে জেনেছেন। সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারী নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে বিএসএফের গুলিতে যাতে কেউ মারা না যায় সে জন্য বাংলাদেশ বেশ আগেই প্রাণঘাতী গুলির বিকল্প ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত এখনো এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। ভারত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ অবশ্যই একে স্বাগত জানাবে।
স্বরাষ্ট্রসচিব আরো বলেন, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। নিহতদের সবাই চোরাকারবারি নয়।
ফেলানির মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়ে স্বরাষ্ট্রসচিব বলেছেন, ওই মৃত্যুর ব্যাপারে ভারত এখনো কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এ সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি তোলা হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির (সাবেক বিডিআর) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যম সূত্রে সীমান্তে বিএসএফের মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘গত এক বছরে সীমান্তে সব হত্যাকাণ্ড গুলির কারণে হয়নি। বাংলাদেশিদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করেও হত্যা করা হয়েছে। বিএসএফ পাকিস্তান সীমান্তে দায়িত্ব পালন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের হত্যার হার অনেক বেশি। বিডিআর-বিএসএফ পর্যায়ের বৈঠকেও আমরা তাদের মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটানের থিম্পু সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যা বন্ধের আশ্বাস দিয়েও ভারত তা রক্ষা করেনি। তা ছাড়া অনেক স্থানে পিলারগুলো দৃশ্যমান না থাকায় সীমান্ত চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। এর পরও আমাদের জেলেদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার পর বলা হয় আÍরক্ষার্থে বিএসএফ গুলি ছুড়েছে। অসমর্থিত সূত্রে আমি মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার কথা জেনেছি। আমি এ ব্যাপারে খুব একটা আশ্বস্ত নই।’
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, এ মাসেই বিএসএফের গুলিতে চার বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তার নিজ দেশের জনগণ ও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে। আগে বিএসএফ মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করুক, এরপর তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ফেলানি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অধিকার আজ একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে তিনি জানান।

পাকিস্তানে ন্যাটোর ১৬টি তেল ট্যাংকারে বন্দুকধারীদের আগুন

তকাল শনিবার ভোরে পাকিস্তানে বন্দুকধারীরা আফগানিস্তানে অবস্থানরত ন্যাটোর সেনাদের জন্য জ্বালানি সরবরাহকারী ১৬টি তেলের ট্যাংকারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটার ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে দেরা মুরাদ জামিলি শহরের বাইরে গতকাল ভোরে বন্দুকধারীরা ওই ট্যাংকারগুলোর ওপর হামলা চালায়।

স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান আবদুল ফাতাহ খাজ্জাক এ কথা জানান। খাজ্জাক বলেন, হামলার সময় জ্বালানি বহনকারী এই তেলের ট্যাংকারগুলো একটি পেট্রলপাম্পে পার্ক করা ছিল। বন্দুকধারীরা একটি গাড়িতে এসে ওই তেলের ট্যাংকারগুলোর ওপর সরাসরি গুলি চালায়। এ সময় ১৬টি ট্যাংকারে আগুন ধরে যায়। তবে বন্দুকধারীদের গুলিতে তেলের ট্যাংকারের একজন স্টাফ আহত হয়েছেন।
গত বছরের অক্টোবরেও বন্দুকধারীরা ২৯টি তেলের ট্যাংকারে আগুন দিয়েছিল। আফগানিস্তানে অবস্থানরত বিদেশি সেনাদের জন্য অধিকাংশ মালামাল ও সরঞ্জাম পাকিস্তানের ভেতরে দিয়ে সেখানে পাঠানো হয়। যদিও মার্কিন সেনারা অন্য পথ হিসেবে এশিয়ার মধ্য অঞ্চলকে ব্যবহার করছে।
পাকিস্তান গত ৩০ সেপ্টেম্বর ন্যাটো সেনাদের জন্য রসদ সরবরাহের প্রধান পথ বন্ধ করে দেয়। ন্যাটোর হেলিকপ্টার হামলায় পাকিস্তানের দুজন সেনা মারা যাওয়ার পর তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ১১ দিন পর তা আবার স্বাভাবিক হয়।
করাচিতে মৃত ২৭: করাচিতে গত দুই দিনে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। সে দেশের বহুল প্রচারিত ডন নিউজের খবরে এ কথা বলা হয়। এমকিউএমের নেতা সৈয়দ বাদশা খান বলেন, সরকার এই শহরের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পিএমএল-কিউ বলছে, করাচিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেনা অভিযান প্রয়োজন। এএফপি, ডন।

সংস্কৃতির বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

থাটা ফ্রেড জেমিসনের: ইতিহাস তা-ই যা ব্যথা দেয়। ইতিহাস পপুলার মাইণ্ড থেকে গরহাজির, এই বিলাপ উচ্চতর একাডেমিগুলিতে, এই বিলাপ বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের এবং তাদের নির্মিত রাষ্ট্রে। ডান রাজনীতিতে এই বিলাপের শেষ নেই, বাম রাজনীতিতে আছে এই বিলাপের ধ্বনি।

এই অর্থে কি ইতিহাস ব্যথা দেয়? না বোধ হয়। বাংলাদেশে পপুলার সংস্কৃতি একদিকে ডান প্রভাবিত এবং বাম প্রভাবিত সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করছে, অন্যদিকে প্রান্তিক সংস্কৃতিগুলো আত্মস্থ করে শক্তিশালী হচ্ছে। ডান সংস্কৃতি মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে মতাদর্শিক সাহায্য পাচ্ছে এবং ধর্মজ বোধের মাধ্যমে এই সংস্কৃতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। রক্ষণশীলতা কিংবা নব্য রক্ষণশীলতা ধর্মজ আখ্যান দিয়ে দেশের অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতিগুলির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। দেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে রাষ্ট্র হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতিগুলি হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের স্মৃতি : তেভাগা থেকে হাজং, নানকার থেকে জিরাটিয়াসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একই সঙ্গে রাষ্ট্র হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং কৃষক আন্দোলনের লড়াইয়ের ডকুমেন্টেশন। এ সকল অভিজ্ঞতাকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করেছে ধর্মজ বোধের মাধ্যমে ধর্মজ আখ্যান দিয়ে নব্য রক্ষণশীলতা। মুক্তিযুদ্ধ কি ধর্মজ আখ্যান? মুক্তিযুদ্ধ কি সেকু্যলার সমাজতান্ত্রিক আখ্যান? মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দুই বিরোধী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের যে-লড়াই হয়েছে (সোভিয়েত মতাদর্শ বনাম চিনা মতাদর্শ), তার স্থান কি যুদ্ধের মধ্যে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পড়েনি? যেসব কৃষক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা ডানপক্ষভুক্ত নন কিংবা বামপক্ষভুক্ত নন, কিংবা বাম প্রভাবিত সোভিয়েতপন্থী অথবা চিনাপন্থী নন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়েছেন, তাঁরা বর্িিভন্ন ধরনের পপুলার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সমাজ পরিব্রাজন করেছেন, তাঁরা কিন্তু ফর্মাল পলিটেক্সে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের অংশগ্রহণ এক ধরনের টেক্স যুদ্ধ নামক অ-বিদ্যায়নিক টেক্সটের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের প্রকাশ করেছেন পূর্বপুরুষের লড়াইয়ের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে। এসব স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা একদিকে পাকিস্তান কলোনিয়াল রাষ্ট্র অবদমিত করেছে, এবং অন্যদিকে যুদ্ধ নামক ফর্মাল পলিটিক্স ব্যক্তিগত এবং পাবলিক জীবনাচরণ সামনে আসতে দেয়নি। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে শ্রেণী এবং সংস্কৃতি উদ্ভাসিত হয়েছে, গণসংস্কৃতি সম্পাদিত হয়েছে ফর্মাল পলিটিক্স একপাশে ঠেলে, এভাবেই ডানের সংস্কৃতি কোণঠাসা হয়েছে। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন যোদ্ধার নিজস্ব জীবনচালিত, ফর্মাল পলিটিক্সের বাইরে প্রতিরোধের জটিল উৎস।

পপুলার সংস্কৃতির মধ্যে একটা ইউটোপিয়ান ডিমেনশন আছে। এই ডিমেনশন আছে বলেই পপুলার সংস্কৃতির পক্ষে সমকালীন ক্ষমতা সম্পর্কের ক্রিটিক করা সম্ভব। পপুলার সংস্কৃতি, এদিক থেকে, সমকালীন ক্ষমতা সম্পর্ক ছিঁড়েখুঁড়ে খায়, কংক্রিট আকার দেয় পলিটিক্সকে (যেমন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা এই কাজটা করে চলেছেন সাহসের সঙ্গে)। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক আখ্যান, ফর্মাল পলিটিক্সের বাইরে তারা ভবিষ্যতের ইতিহাস এবং রাজনীতি সফল করে চলেছেন।

একে কি অর্জিত ইউটোপিয়া বলা যাবে? অর্জিত বিপস্নব? আমার তো মনে হয় এভাবে আমরা ইউটোপিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, এক পা দুই পা করে বিপস্নবের ভূমি দখল করে নিচ্ছি। এখানেই বামের অন্তদর্ৃষ্টি লুকানো, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া। যে দেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে (যেমন, রাশিয়া সমাজতন্ত্র বিট্রে করছে কিংবা চিন ধনতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে), সে দেশ সমাজতন্ত্রের মনোপলি তৈরি করে সমাজতন্ত্র থেকে সরে আছে। পপুলার সংস্কৃতি এদিকটা সম্বন্ধে সজাগ।

পপুলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, এভাবে প্রান্তিক সেনসিবিলিটি কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস এবং সংস্কৃতিক সাহস পরীক্ষার ভূমি। বিভিন্ন কণ্ঠ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা মানুষকে সহনশীল করে তুলেছে, যারা গতকাল প্রান্তিক ছিলেন, তারা আগামীকাল কেন্দ্রে এসে যাচ্ছেন। মার্জিনাল সংস্কৃতি এই প্রক্রিয়ায় পপুলার সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে, স্টাবলিশমেন্টের রাজনীতি (বাম এবং ডান) ভয় পাচ্ছে। এই ভয় পাওয়া বৈধতা দিচ্ছে প্রান্তিক সেনসিবিলিটিকে, শক্তিশালী করে তুলছে প্রান্তিক মানুষগুলোর ক্ষমতাকে, (পোশাক শিল্পের কর্মীদের, ফুটপাতের ফেরিওয়ালাদের, নিঃস্ব কৃষকদের কিছুতেই হটানো যাচ্ছে না), তারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন, তারা ইতিহাসের দিক থেকে কমিউনিটির বীর। তাদের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কবর দেয়া, গ্রুপ আইডেন্টিটির আখ্যান প্রতিরোধের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। ধানের লড়াই, ভাতের লড়াই, বাসস্থানের লড়াই, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখার লড়াই_এ সবই পপুলার সংস্কৃতির ইতিহাস, বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস। সাধারণ মানুষ এভাবেই নিজেদের মবিলাইজ করছে বিপস্নবের জন্য।

বিশ্বজুড়ে খাদ্যমন্দা, দেশে দ্রুত আমদানির পরামর্শ

বিশ্ববাজারে আবারও খাদ্যমন্দার পদধ্বনি। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি ‘খাদ্য পূর্বাভাস’ নামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার ৬ শতাংশ কম খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজারে আসবে। আর সরবরাহ কমায় এরই মধ্যে খাদ্যের দাম ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।

এফএও প্রতিবেদনে আরও বলেছে, খাদ্যমূল্য বাড়ায় বাংলাদেশসহ ৭৭টি খাদ্য ভর্তুকির দেশকে অতিরিক্ত ১২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা গুনতে হবে। বাংলাদেশের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এবার খাদ্য ভর্তুকিতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আরও এক হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারকে খাদ্য মজুদ দ্রুত বাড়াতে হবে। নয়তো তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৩০ ডলার বৃদ্ধির প্রভাবে পর্যায়ক্রমে সার ও খাদ্যের দাম আরও বাড়বে। তখন আমদানি করা আরও কঠিন হয়ে যাবে।
খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাগতেও শুরু করেছে। আলজেরিয়া, মোজাম্বিক, হাইতি, তিউনিসিয়াসহ বিশ্বের আটটি দেশে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলী জনবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক এক বিবৃতিতে হঠাৎ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এ পরিস্থিতি বিশ্বের স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি।
এফএওর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে চাল-গম উৎপাদন প্রায় ৪ শতাংশ বাড়বে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, উৎপাদন বাড়লেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত ৭০টি দেশকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষ তাদের আয়ের ৭০ শতাংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় করে। দাম বাড়ায় এই গরিব মানুষগুলোই সবচেয়ে সমস্যার মধ্যে পড়বে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ দেখা দেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম সামনের দিনে আরও বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত মজুদ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৭-০৮-এর খাদ্যসংকট পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি আমদানিকারকেরা খাদ্য আমদানি করতে রাজি হবেন না মন্তব্য করে মাহবুব হোসেন বলেন, সে ক্ষেত্রে সরকারকে আমদানি বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে খাদ্য আনতে হবে।
সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিটের (এফপিএমইউ) হিসাবে আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে তিন কোটি ৪০ লাখ টন চাল ও ১০ লাখ টন গম উৎপাদিত হবে। এপ্রিল পর্যন্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ৬০ লাখ মানুষের জন্য কম দামে খাদ্য সরবরাহ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
খাদ্য আমদানি পরিস্থিতি: চলতি বছরের বাজেটে মোট ২৮ লাখ টন খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১২ লাখ টন চাল সংগ্রহ ও ১৬ লাখ টন আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ পরবর্তী দফায় আমদানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২০ লাখ টন করা হয়। সম্প্রতি তা আরও বাড়িয়ে ২২ লাখ টন করা হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১২ লাখ ৭০ হাজার টন চাল-গম আমদানির চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন লাখ টন চাল ও দুই লাখ টন গম সরকারি গুদামে এসেছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে বর্তমানে আরও আড়াই লাখ টন চাল-গম খালাস হচ্ছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তার প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশে চলে এসেছে।
গত নভেম্বর মাসে খাদ্যসচিব বরুন দেব মিত্রের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভারত সরকারের সঙ্গে পাঁচ লাখ টন চাল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কেনার জন্য সমঝোতা চুক্তি করে। এই চাল গত ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশে আসার কথা ছিল। খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভারত প্রতি টন চালের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৩২ হাজার টাকা চাইছে। কিন্তু শর্ত দিচ্ছে, সেখানকার গুদাম থেকে চাল নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশে আনতে হবে। অনেক দেনদরবারের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারত যদি সেখানকার বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, তাতে বাংলাদেশ রাজি আছে। এই শর্তেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় এখনো আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে কেনার পাশাপাশি বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চাল আমদানির ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। সময়মতো চাল আসার ব্যাপারে নিশ্চয়তাও পাওয়া গেছে।
এদিকে, লন্ডনভিত্তিক সংস্থা জ্যাকসন সন অ্যান্ড কোং এবং থাই ডিপার্টমেন্ট অব ফরেইন ট্রেডের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ থাইল্যান্ডে চালের দাম তিন মাস ধরে স্থিতিশীল আছে। আগামী চার মাসের মধ্যে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই বলেও সংস্থা দুটি মনে করছে।
গত চার মাসে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চালের দাম প্রতি টন ৪২৫ থেকে ৪৭৫ ডলারে ওঠানামা করছে। পরিবহন খরচ যোগ হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা। চলতি জানুয়ারি মাসে তা প্রায় ২০ থেকে ৪০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। এখন আমদানি করলে চালের কেজি ৪০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দেশে মোটা চালের দাম এখনো ৪০ টাকার নিচে থাকায় আমদানি কমে গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে চালের দাম ৪৫০ ডলার থেকে বেড়ে ৯০০ ডলার হয়েছে। তবে এই চালের বেশির ভাগ ক্রেতা ইউরোপের দেশগুলো।
বেসরকারি আমদানি কমেছে: এফপিএমইউ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে আমদানি কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন এবং দুর্যোগের বছর ২০ থেকে ৩০ লাখ টন আমদানি হয়ে থাকে। গত ডিসেম্বরে দেশে পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে, যার ৬৫ শতাংশ সরকার আমদানি করেছে। গম আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ৪৮ হাজার টন। বেসরকারি খাত থেকে এসেছে এর ৮৪ শতাংশ। রাশিয়ায় খরার কারণে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ ও দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার বুলগেরিয়া ও ইরান থেকে গম আমদানি শুরু করেছে।
জানা গেছে, পূবালী, দেশবন্ধু, সানফ্লাওয়ার, হানিবি, এস আলম, এল এম জে ও মাহবুব ব্রাদার্স নামের ১০টি প্রতিষ্ঠান সরকারকে নয় লাখ টন গম সরবরাহ করবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে গমের দাম ৬০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে গম দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে খাদ্য বিভাগ ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের ৫৩ কোটি টাকার পিজি ও বিডবন্ড বাজেয়াপ্ত করেছে।
তেলের প্রভাব খাদ্যে: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের ৫৫টি খাদ্যপণ্যের দাম পর্যবেক্ষণ করে গত ৬ জানুয়ারি পূর্বাভাস দিয়ে বলছে, গত জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বে খাদ্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। চীনের খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও রাশিয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহতম দাবানলের কারণে খাদ্যের দাম বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পণ্যমূল্য পর্যবেক্ষণ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সারের দাম আবারও বাড়তে শুরু করেছে। গত এক বছরের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬১ ডলার থেকে বেড়ে ৯০ ডলার হয়েছে। এর প্রভাবে সারের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যেমন, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের দাম গত এক বছরের মধ্যে ৩১৬ ডলার থেকে বেড়ে ৫৯৩ ডলার, ট্রিপল সুপার ফসফেট ২৩৫ ডলার থেকে বেড়ে ৪৭২ ডলার ও ইউরিয়া ২৪৮ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭৫ ডলার হয়েছে।
৭০ শতাংশ উৎপাদন বাড়াতে হবে: এফএওর প্রতিবেদনে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আবদলরেজা আব্বাসিয়ান বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, সংকট বাড়ায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ, মিসর ও হাইতির মতো বিশ্বের ৩০টি দেশ হুমকির মুখে পড়েছিল। খাদ্যপণ্যের বাজার আগের মতো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
খাদ্যপণ্যের সংকট মোকাবিলায় এফএও বলেছে, বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৬৮০ কোটি ২০৫০ সাল নাগাদ ৯১০ কোটিতে পরিণত হবে। বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে খাদ্য উৎপাদন বর্তমান সময়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে সরকার ও জনপ্রশাসন by হাসনাত আবদুল হাই

রাষ্ট্রের যে তিনটি স্তম্ভ সকল দেশের সংবিধানে দেখা যায় বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নেই। যদিও এই তিনটি স্তম্ভ (ক) সংসদ, (খ) বিচার বিভাগ এবং (গ) নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকার যোগ করা উচিত, কেননা স্থানীয় সরকার নির্বাহী বিভাগের মতোই প্রশাসনিক এবং উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে।

কোনো দেশে স্থানীয় সরকারকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বলেই বাংলাদেশের সংবিধানে এর ব্যতিক্রম করা হয়নি, এমন ভাবা যায়। এখন দেখা যাক গত ঊনচলিস্নশ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ কিভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখা দিয়েছে কি না, পরিবর্তন হয়ে থাকলে তা কাদের স্বার্থে বা কিসের জন্য হয়েছে এবং তার পরিণতিতে কী পাওয়া গেছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং প্রয়োজনের নিরিখে বলা যাবে ভবিষ্যতে আগামী দশ কি বিশ বছরে সরকার পরিচালনায় কেমন হবে এবং আদর্শগতভাবে কী হওয়া উচিত।

দুই.


বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান আমলে যেসব কেন্দ্রীয় সার্ভিসের আমলা ছিলেন তারা দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এদের তুলনায় প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা এই সুযোগ কমই পেয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সার্ভিস ক্যাডারের মধ্যে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) শীর্ষে থাকায় বাংলাদেশ সরকারে বাঙালি সিএসপি অফিসাররাই প্রায় একচেটিয়া উচ্চতম পদগুলোতে নিয়োজিত হন। তবে এখানে প্রথম দিকে সিএসপিদের মধ্যেও বয়োজ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি। যেসব সিএসপি (এবং অন্যান্য ক্যাডারের সদস্য) মুজিবনগর সরকারে কাজ করেছিলেন তারা সবাই বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে নিয়োজিত হন। এতে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা ক্ষুব্ধ হলেও কিছু বলতে পারেননি। ১৯৭৫-এর আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুজিবনগরের সচিবদের বদলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব এবং অন্যান্য উচ্চতর প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেয়া শুরু হলো। ১৯৭৫ সালের আগে ও পরে রাজনৈতিক ও সামরিক সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু আমলা (আমলাতন্ত্রের বাইরের ব্যক্তিও) সরকারের উচ্চতর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা এসব সুযোগ না পাওয়ার ফলে ক্ষুব্ধ হলেন এবং শক্ত লবিং (তদবির) করে তাদের কেউ কেউ উচ্চতর পদে নিয়োগ পেয়ে যান। এ উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক জুনিয়র ও সিনিয়র সিভিল সার্ভিস একীভূত করা হয়।

পাকিস্তান আমলেই সিএসপি ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে প্রশাসনে উচ্চতর পদে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। অন্য সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যরা সিএসপিদের দ্রুত পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিরোধিতা করে আসছিল। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পালাবদলের পর সামরিক কতর্ৃপক্ষের সমর্থন পেয়ে যায় এই নন-সিএসপি ক্যাডারের সদস্যরা। তারা সংখ্যায় বেশি ছিল, সামরিক কতর্ৃপক্ষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। সামরিক কতর্ৃপক্ষও সিএসপিদের একাধিপত্য ও প্রাধান্যকে সুনজরে দেখেনি। এই কারণে অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদেরও সরকারের উচ্চতর পদে, বিশেষ করে সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম সচিব পর্যায়ে নিয়োগের সুযোগ করে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনা হয়। প্রথমে যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্যান্য সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যরা এই সব পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োজিত হন। পরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) নামে একটি অভিন্ন ক্যাডার সৃষ্টি করে এর অধীনে ২৯টি সাব-ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে এইসব সাব-ক্যাডারে অন্তভর্ুক্তির বিধান রাখা হয়। এই পদক্ষেপ প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বেশ স্বচ্ছতা নিয়ে আসে। সাবেক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্যরা এইসব সাব-ক্যাডারের অন্তভর্ুক্ত হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং পদোন্নতি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা সমতা এসে যায়। এ সত্ত্বেও কোনো সাব-ক্যাডারের কত জন সদস্য সচিব, অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব হবেন, এই বিষয় নিয়ে কলহ এবং মতদ্বৈততা অব্যাহত থাকে।

তিন.

রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে অবশ্যই সংসদ ওপরে; কেননা সেখানে জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সরকারের জবাবদিহিতা এই সংসদের কাছেই। আর আইনের শাসন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখে বিচার বিভাগ। যেহেতু সংসদে জনপ্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হয়ে আসন গ্রহণ এবং সরকার গঠন করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যরা সেই জন্য রাষ্ট্রের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের ওপরই বর্তায়। তারাই আইন প্রণয়ন করেন এবং দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়সহ উন্নয়নের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই কাজে তাদের সহায়তা করে আমলারা। রাজনীতিবিদরা যত অভিজ্ঞ হবেন, সরকার পরিচালনার বিষয়ে যত বেশি সময় দিতে পারবেন আমলাদের ওপর কতর্ৃত্ব সেই পরিমাণে বেশি হবে। নীতিনির্ধারণে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকাই হবে প্রধান। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রকারান্তরে তারাই সরকার পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা নিয়ে নেবে। পাকিস্তানে এমন হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন হয়েছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, দেশ স্বাধীন হবার পরপর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য রাজনীতিবিদদের এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে, তারা দৈনন্দিন ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার বিষয়ে বেশি সময় দিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতায় বহু বছর না থাকায় এবং সরকার পরিচালনায় কৌশল ও দক্ষতা না থাকার জন্য তাদেরকে আমলাদের ওপরই নির্ভরশীল হতে হয়েছে। তৃতীয়ত, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের আগেই রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাচু্যত করেছে সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে কিছু আমলাও ক্ষমতাচু্যতির ক্ষেত্রে জড়িত ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সামরিক শাসন একবার নয়, দুইবার এসেছে বাংলাদেশে_১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বাধীনতার ঊনচলিস্নশ বছরের মধ্যে ষোল বছরই বাংলাদেশ রাষ্ট্র ছিল সামরিক শাসনের অধীন। এই সময় শুধু সামরিক কর্মকর্তারা নয়, আমলারাও সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা তাদের করার কথা ছিল না। যেহেতু সামরিক কর্মকর্তারাও একশ্রেণীর আমলা সেই জন্য সিভিলিয়ান আমলারা তাদের সঙ্গে অথবা অধীনে কাজ করে স্বস্তি পেয়েছে এমন মনে করা যায়।

প্রশ্ন হলো, সরকার যদি জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দক্ষতার সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচালিত হতো, তাহলে কি সামরিক হস্তক্ষেপ ও তাদের ক্ষমতা গ্রহণ সম্ভব হতো? এর সোজাসুজি উত্তর দেয়া কঠিন। রাজনীতিবিদদের অধীনে সরকার পরিচালনায় অস্থিরতা ছিল, বিভিন্ন স্বার্থবিশিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে তারা আপোসের ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি বরং কোনো কোনো শ্রেণীর বিরাগভাজন হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূচনা করেছে। এই সব জটিলতা ও দুনর্ীতির অভিযোগ এনে সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হয়েছে। বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েও পদত্যাগ করে ক্ষমতা তুলে দেন সামরিক কতর্ৃপক্ষের কাছে। যদি আমলারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক সরকারকে সমর্থন করার জন্য সঠিক পরামর্শ দিত এবং রাজনীতিবিদদের সময়মতো অবহিত করতো তাহলে রাজনীতিবিদদের যত দুর্বলতা আর ত্রুটিই থাক না, তারা এভাবে ক্ষমতাচু্যত হতেন না। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যার কথাটি ধরা যাক। এত বড় একটা ষড়যন্ত্র হলো, এতজন সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্য এবং কিছু বেসামরিক ব্যক্তি (রাজনীতিবিদসহ) এত দীর্ঘ সময় ধরে এই হত্যার পরিকল্পনা করল সে সম্বন্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের (এনএসআই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সংস্থা) কেউই কিছু বলতে পারল না। এটা তাদের অদক্ষতা ছাড়া আর কিছু না। অন্যদিকে বিদেশ থেকে যে কোটি কোটি ডলারের ত্রাণসামগ্রী এল সেসব যে যোগ্য লোকের কাছে পেঁৗছাল না, তার দায়ভারও অনেকটা আমলাদের ওপরে পড়ে। আসলে সেই প্রথম কয়েক বছর যা হয়েছে তা হলো_স্বাধীন দেশে উন্নতির সুযোগ খুলে যাওয়ায় আমলারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি ভেবেছেন এবং দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কে কোন মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন, কে রাষ্ট্রদূত হবেন, কে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাবেন, কে পদোন্নতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হবেন, এসব চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন অধিকাংশ আমলা। তারা রাজনীতিবিদদের পেছনে ও আশপাশে ঘুরেছেন নিজেদের স্বার্থে, রাষ্ট্রের বা সে সময়ের সরকারের স্বার্থে অতটা নয়, এই উপসংহারে এলে ভুল হবে না।

সরকারের পক্ষ থেকে একটা দক্ষ, অনুগত (দেশের প্রতি নয়, রাষ্ট্রের প্রতি) এবং ঐক্যবদ্ধ সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলা হলে সরকার পরিচালনায় (রাষ্ট্র পরিচালনায়ও বটে) এমন বিপর্যয় ঘটত না।

চার.

১৯৭৫ সালের আগে সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি তা নয়। তবে সেসব খুব ফলপ্রসূ হয়নি। নিচে সেইসব উদ্যোগের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে (২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১) সিভিল প্রশাসন পুনর্গঠন কমিটি গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল মাঠপর্যায়ে ভেঙে-পড়া প্রশাসন পুনর্গঠনের সুপারিশ দেয়া, পাকিস্তান সরকারের অধীনে কর্মরত সিভিল অফিসারদের বাংলাদেশ সরকারের কাঠামোতে আত্মীকৃত করা, প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। এই কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে ২০টি মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনে ডিভিশন সৃষ্টি করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি গঠিত হয় এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে, কেননা তখন সংবিধান প্রণীত হয়নি।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যকে সভাপতি করে গঠন করা হয় চার সদস্যের প্রশাসনিক ও সার্ভিস পুনর্গঠন কমিটি। এই কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিদ্যমান সিভিল পরীক্ষা করে সুপারিশ রাখা, সকল সিভিল সার্ভিসকে একটি অভিন্ন সার্ভিসে একীভূত করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা এবং বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা, বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভাগে সরকার কর্মকর্তা রিক্রুটের নীতিমালা ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এই সব বিষয়ে কমিটি যথাসময়ে সুপারিশ দিলেও সেসবের মধ্যে অনেকই বাস্তবায়িত হয়নি। সার্ভিস ক্যাডারগুলোর মধ্যে কলহ ও বিরোধিতার জন্যই এমন হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। তা ছাড়া ১৯৭৪ সালের পর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে ঠাণ্ডা মাথায় প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না।

১৯৭৫ সালের আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক শাসক হয়ে পে অ্যান্ড সার্ভিসের কমিশন গঠন করেন ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কমিশনকে সিভিল প্রশাসনের কাঠামো এবং সেখানে যে বেতন-ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখে সুপারিশ রাখতে বলা হয়। সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের এবং প্রাদেশিক সরকারের আমলাদের একীভূত করা এবং নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য পদ্ধতি নির্ধারণের দায়িত্বও দেয়া হয় এই কমিশনকে। কমিশন এই সব বিষয়ে যে সুপারিশ রাখে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলো বাস্তবায়ন করতে দুই বছরের বেশি সময় নেয়। পাঁচটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়, যা ছিল সময়সাপেক্ষ। সুপারিশের ভিত্তিতে ১৪টি মূল ক্যাডারের অধীনে ২৮টি সার্ভিস ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। বেতন-ভাতা সম্পর্কে সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ২১টি পে-স্কেল অনুমোদন করে। এই সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ আমলারাই মনোপূত হয়নি এবং তারা নানাভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কমিশন সিনিয়র সার্ভিস পুল সৃষ্টির যে সুপারিশ করে, সরকার তা গ্রহণ করে। কিন্তু এর বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দেয় এবং সিদ্ধান্তটি প্রায় অবাস্তবায়িত থেকে যায়।

উপরে যেসব প্রশাসনিক সংস্কারের উলেস্নখ করা হলো, তাদের প্রধান উদ্দেশ্যেই ছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য একটি উপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং আমলাদের মধ্যে রেষারেষি ও কলহ বন্ধ করে সংহতি সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্য আংশিক সফল হয়েছিল_এ কথা বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সার্ভিস কাঠামো, বেতন-ভাতা, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা নির্ধারণ_এইসব বিষয়ের বাইরে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জনসাধারণের কল্যাণ বৃদ্ধির সার্ভিস ডেলিভারি উন্নত করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা, সেদিকে তেমন মনোযোগ দেয়া হয়নি। ফলে গতানুগতিকভাবেই সরকার পরিচালিত হয়েছে। দ্বিতীয়, সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে সরকারের কার্যক্রম বিকেন্দ্রীভূত করে উপজেলা পদ্ধতির প্রচলন করলেন, যা সরকার পরিচালনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। সরকারের অনেক দফতরের অনেক কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের উপকারে এসেছিল। দুঃখের বিষয় জেনারেল এরশাদ নিজেই রাজনৈতিক স্বার্থে উপজেলা পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আনেন, যা একে দুর্বল করে দেয়। জেনারেল এরশাদের সময় প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল সরকারকে সংকুচিত করে আনা এবং পাবলিক সেক্টরে অপ্রয়োজনীয় জনবল হ্রাস করা। এটিও প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল।

১৯৮৪ সালে একজন ভাইস চ্যান্সেলরের সভাপতিত্বে একটি পে কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন তাদের সুপারিশে আমলাদের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বেতন উলেস্নখ করে ২০টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করে। সরকার কিছুটা সংশোধন করে কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। ১৯৮৯ সালে আবার আর একটি পে কমিশন গঠন করে সকল পর্যায়ে এবং পাবলিক সেক্টরের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বাস্তবানুগ বেতন কাঠামো সুপারিশ করতে বলা হয়। এবারো কমিশন ২০টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করে সুপারিশ করে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ছিল সেক্রেটারি কমিটি, স্পেশাল কমিটি, কেবিনেট সাব কমিটি, কাউন্সিল কমিটি ইত্যাদি। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্য জাতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার)। সামরিক শাসক হলেও প্রেসিডেন্ট এরশাদই প্রশাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কার আনার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন ও কমিটি গঠন করেন। এদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়নি।

বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৩ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কমিটি গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রণালয় পর্যায়ে প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনবল নিয়োগ নির্ধারণ এবং প্রশাসনের ওপর সেসব নতুন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠন বিষয়ে সুপারিশ রাখা। এই কমিটি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস গঠন করে ২৯টি সাব ক্যাডার গঠনের সুপারিশ করে এবং বিদ্যমান কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিধিবিধান নির্ধারণ করে। কমিটির সুপারিশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে জনবল কমিয়ে আনার প্রস্তাবও ছিল। একজন গবেষকের মতে, খালেদা জিয়া প্রশাসনিক সংস্কারে আগ্রহী ছিলেন না। তার সময়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় যেসব পদোন্নতি দেয় তার অনেকগুলিই বিতর্কিত ছিল। জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক আনুগত্য প্রাধান্য পেতে শুরু করে (মোহাম্মদ মোহাব্বত খান : বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কার, ১৯৯৮)।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার জাতীয় পে কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন আগের ২০ গ্রেডের বেতন-ভাতা অক্ষুণ্ন রাখে তবে বেতনে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে জীবনধারণের মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগের শাসনকালেও (১৯৯৫-২০০১) একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিশনকে পরবতর্ী সকল কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে সমন্বিত সুপারিশ রাখতে বলা হয়। এই কমিশন প্রথাগতভাবে প্রশাসনিক কাঠামো ও সার্ভিস ক্যাডার নির্ধারণ করে নিয়োগ পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ রাখা ছাড়াও জনসেবার মান উন্নত করার জন্য সুপারিশ রাখে। এইসব সুপারিশ খুব বেশি বাস্তবায়িত হয়নি। এই সময়ে প্রশাসনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ আরো স্পষ্ট হয়। জনতার মঞ্চে অংশগ্রহণকারী আমলারা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হন। তবে এই সময় বিরোধীদলীয় মনোভাবাপন্ন বলে কোনো আমলাকে অবসরে পাঠানো অথবা ওএসডি করার ঘটনা তেমন ঘটেনি। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসার পর (২০০১-২০০৬) প্রায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই প্রশাসনে আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্নদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং নিজেদের অনুগত আমলাদের দ্রুত পদোন্নতি দেয়া থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে। এই সময় পাবলিক সার্ভিস কমিশনও তার স্বাধীনতা হারায় এবং দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা দলের সমর্থক প্রাথর্ীদের বেশি করে নিয়োগদান করে। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রশাসনে রাজনীতিকরণ আরো ব্যাপক ও তীব্র করে। তারাও পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিজেদের সমর্থকদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দলীয় প্রাথর্ীদের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়।



ভবিষ্যতে কী হবে?

ভবিষ্যতে প্রশাসনের রাজনীতিকরণ অব্যাহত থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। এর ফলে যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে তাদের সমর্থক আমলারা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবে এবং তাদের দ্রুত পদোন্নতি হবে। ফলে যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সাধুতা খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হবে না। এর ফলে সরকারের দক্ষতা হ্রাস পাবে। আমলারা দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করবে। এই কারণে দুর্নীতি ও অনিয়ম আরো তীব্র হবার সম্ভাবনা থাকবে। কেননা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্তরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা, নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। জনসেবার সিংহভাগ যাবে দলীয় সমর্থক এবং কর্মী-নেতাদের ভোগে। আইনের শাসন আরো দুর্বল হয়ে আসবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় আমলাদের দোষ-ত্রুটি হবে। এক কথায় ভবিষ্যতে প্রশাসনে নিরপেক্ষ এবং আগত উৎকর্ষ ক্ষুণ্ন হবে এবং প্রশাসনের মাধ্যমে জনসেবা প্রদানের মানে অবনতি দেখা যাবে। স্থানীয় সরকার আরো দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সংসদে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

প্রশাসন সরকার পরিচালনার চালিকাশক্তি। রাজনীতিকরণ হয়ে গেলে প্রশাসন শুধু দুর্বল হয়ে পড়বে না, জনস্বার্থও বিঘি্নত হবে। জনস্বার্থের কথা ভেবে যদি সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পেঁৗছায় এবং প্রশাসনকে রাজনীতির ঊধের্্ব রাখে তাহলে ভবিষ্যতের যে অন্ধকার চিত্র দেয়া হলো তার পরিবর্তন হতে পারে। যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় তাহলে প্রশাসনে যোগ্য ও দক্ষ আমলারা যোগ দেবে এবং তাদের মাধ্যমে জনস্বার্থ শুধু রক্ষা না, এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে। এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণই নির্ভর করছে রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা by আকবর আলি খান

৯৬০-এর দশকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয় তখন পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অর্থনীতির দিক থেকে আত্মঘাতী হবে। তারা এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই অর্থনীতি টিকে থাকতে পারবে না।

তার সাথে সাথে আরো দুটি ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হবে না। ফলে জনসংখ্যার চাপে ক্ষুদ্র ভূ-খণ্ডে বাংলাদেশের অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়বে। সবশেষে পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদরা ও তাদের পশ্চিমা দোসররা প্রচার করেন, বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আদৌ টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চলিস্নশ বছর পূর্ণ হতে চলছে। এই চার দশকের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আমরা তখনকার পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ও তাদের দোসরদের বক্তব্যের যথার্থতা বিচার করতে পারি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সে সময়কার পূর্ব-পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই সময়ে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সময়কালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদের হিসাব রয়েছে। প্রায়ত স্বদেশ বোসের হিসাব অনুসারে ১৯৮৯-৫০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদ ছিল ৩১০ রুপি। ১৯৫৪-৫৫ সালে এই মাথাপিছু আয় কমে ৩০০ রুপিতে দাঁড়ায়। ১৯৫৪-৫৫ সময়কাল হতে ১৯৫৯-৬০ সময়কালে মাথাপিছু উৎপাদ আরো কমে ২৬৯ রুপিতে দাঁড়ায়। ১৯৬০ সাল থেকে অর্থাৎ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদ পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ সংখ্যা ১৯৬৪-৬৫ সালে ২৮৩ রুপিতে উন্নীত হয়। ১৯৬৯-৭০ সালে এই সংখ্যা ৩১৪ রুপিতে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর সময়কালে বাংলাদেশে মাথাপিছু উৎপাদ ৩২০ রুপি হতে ৩১৪ রুপিতে উন্নীত হয়। অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বের ভাষায় এই ২০ বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় স্থির ছিল। পক্ষান্তরে বর্তমান পাকিস্তানে (যা তখন পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল) ১৯৪৯-৫০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৩২৪ রুপি। ২০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৯-৭০ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০৪ রুপি। অর্থাৎ পাকিস্তানে গড়ে তিন শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল। অথচ বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের অগ্রগতি ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে কোনোক্রমে ১৯৪৯-৫০-এ মাথাপিছু আয় সমান হওয়া সম্ভব হয়।

স্বাধীনতা পূর্ববতর্ী ২০ বছরের সাথে যদি আমরা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তুলনা করি তাহলে নিম্নলিখিত প্রবণতাগুলো দেখতে পাই :

ক) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৫ সময়কালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতা পূর্বকালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে ২০ বছরে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রতি বছরেই হয়েছে। ত্রিশ বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হওয়া নেহাৎ অকিঞ্চিতকর নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, শিল্প-বিপস্নবের সময় যুক্তরাজ্যে প্রথমবার মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হতে ৫৭ বছর সময় লেগেছিল।

খ) গড় আয়ুর প্রত্যাশা বৃদ্ধি : বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ৪২ বছর। সেই সময়ে পাকিস্তানে গড় আয়ু ছিল ৪৪ বছর। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৫ বছর। আর বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ৬৪ বছর। (২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের দেয়া হিসাব অনুযায়ী)।

গ) জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি : গড় আয়ুর প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। অথচ সত্তরের দশকে অনুমান করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনুন্নত দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমানো সম্ভব হবে না। ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যা ছিল ছয় কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ আর পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি আটাশি লক্ষ। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ষোল কোটি বিশ লক্ষ। অন্যদিকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল পনের কোটি নব্বই লক্ষ। অর্থাৎ যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তাহলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু প্রদেশে পরিণত হতো। শুধু জনসংখ্যার দিক দিয়েই নয়, খাদ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ১৯৬৪-৬৫ সালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি চার লক্ষ টন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই সময়ের পরে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ হলো ২.৬৫ কোটি টন। একই সময়ে পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ২.৬৪ কোটি টন।

বাংলাদেশ সম্বন্ধে সবচেয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা প্রসঙ্গে। এ কথা সত্য, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে যখন পাকিস্তান সকল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কুক্ষিগত করে নেয় তখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশকে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আজকে এই পরিস্থিতি নেই। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য ছিল নয় ডলার। এই সময়ে পাকিস্তানে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি ছিল চৌদ্দ ডলার। একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল একত্রিশ ডলার।

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর শতকরা আশিভাগ দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য পেয়ে থাকে।

উপরের আলোচনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতার পূর্বকারে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক ব্যাপক ও আশাব্যঞ্জক। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক কাঠামোতে এ ধরনের প্রবৃদ্ধি আদৌ সম্ভব হতো না। যদিও সম্পদের সুষম বণ্টনের সমস্যা বাংলাদেশে রয়েছে তবুও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, প্রবৃদ্ধির সোনার ফসল সাধারণ মানুষের কাছেও পেঁৗছেছে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো। এখন এই হার ৪০ শতাংশে নেমে এসেেছ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এসব অর্জন অবশ্যই ঈর্ষণীয়।

গত চার দশকের এসব লক্ষণীয় অর্জন সত্ত্বেও এখনো অনেকগুলো সমস্যা রয়ে গিয়েছে। বিশ্বের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ এখনো অনেক কম। বাংলাদেশে ভূমিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল। এখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ আদৌ উন্নত দেশের কাতারে উঠে আসতে পারবে কি না? আমি অবশ্য এ বিষয়ে আশাবাদী। আমার আশাবাদের কারণ দুটি_একটি হলো, তাত্তি্বক, আরেকটি হলো ঐতিহাসিক।

তাত্তি্বক ব্যাখ্যাটি উপস্থাপন করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক আলেকজান্ডার গ্রাসচেনক্রনে, তার বক্তব্য হলো যে, শিল্প-বিপস্নবের প্রথম পর্যায়ে যেসব রাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছেন তাদের প্রবৃদ্ধি ছিল শস্নথ। উন্নয়নের অগ্রপথিক হিসাবে তাদেরকে ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে অগ্রগতির পথে এগোতে হয়েছে। কিন্তু যেসব দেশ পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাদের পক্ষে নতুন করে নিজেদের ভুল থেকে শিখতে হবে না। তারা অন্যদের ভুলের ইতিহাস মনে রেখে এবং সর্বশেষ কারিগরি জ্ঞান প্রয়োগ করে উন্নতি করতে পারবেন।

ষাটের দশকে যখন এই তথ্য উপস্থাপন করা হয় তখন অনেকেই এর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বিগত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে এই অনুমানই সঠিক। অন্যথায় ভারত ও চীনের পক্ষে এত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হতো না। আমরা ইতিহাসে যাকে প্রথম শিল্প-বিপস্নব বলি সেটি ঘটেছিল যুক্তরাজ্যে। সেই সময়ে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। এই জনসংখ্যার মাথাপিছু আয় ৫৭ বছর সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ করা হয়। এতেই সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়। অথচ আমাদের চোখের সামনে প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে প্রায় ১২০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে ভারতেও আমরা একই ধরনের পরিস্থিতি দেখেছি। ভারত ও চীন যা করতে পারে বাংলাদেশের পক্ষেও সেটা করতে পারা উচিত। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সুষ্ঠু অর্থনৈতিক নীতিমালা। এই দুটির সমন্বয় করতে পারলে বাংলাদেশের সৃজনশীল মানুষ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারবে।

নিশ্চিত প্রাথমিক শিক্ষা by হাসান আজিজুল হক

বাংলাদেশের বয়স চলিস্নশ বছর হতে যাচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে আরো দশ বছর পরের চেহারা দেখতে হলে একটু পেছনে ফিরে দেখা দরকার। দেশ ভাগের পর বাংলাদেশ হওয়ার আগে পর্যন্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বয়স হয়েছিল ২৩ বছর। আমরা তাকে শিশুরাষ্ট্র বলতাম।

পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ গড়ব সেটা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল কথা। যদিও '৪৭ সাল থেকে '৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের প্রেক্ষাপট আমাদের ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি। এ কারণে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি করেছিলাম দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, তা শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশে পরিণত করে। এরই ফলে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হলো 'স্বাধীন' ও 'সার্বভৌম' রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এসব কথা ও শব্দগুলো তাবিজের মতো আমরা জীবন-যাপনে স্থান করে নিয়েছি। কিন্তু স্বাধীন এই রাষ্ট্রটির বয়সও পাকিস্তান রাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হতে চলেছে। তাই আমি এই রাষ্ট্রকে শিশুরাষ্ট্র বলতে রাজি নই।

চলিস্নশ বছর হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ঠিক কী ধরনের রাষ্ট্র হবে, তার মোটামুটি একটা রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই জায়গা থেকে দাঁড়িয়েই তো পঞ্চাশ বছরের হিসাব_বাংলাদেশ কেমন দাঁড়াবে তার হিসাব-নিকাশ করা আমাদের জন্য আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ বছরে পেঁৗছাতে আর মাত্র দশ বছর বাকি আছে। চলিস্নশ বছর তো হয়েই গেছে প্রায়। তাহলে পঞ্চাশ বছরে কী দাঁড়াবে তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ইতোমধ্যেই দাঁড়িয়েই গেছে। কী দাঁড়িয়েছে? কী দেখছি এখন? এই খান থেকেই তো আন্দাজ করতে হবে এক-চতুর্থাংশ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ কোথায় পেঁৗছাবে?

১৯৭১ সালে তৈরি হওয়া রূপরেখাটি সামনে রেখে ২০১১ সালে এসব বিষয়ে কথা বলার সময় এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রের গতিমুখ পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কারণে সাগরে পেঁৗছতে পারেনি বাংলার জনগণ_আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে যা বলুক, প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা। আমি সবাইকে বলি, আপনারা সবাই একবার সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসুন না, কেমন করে টিকে আছে এই শিক্ষাব্যবস্থাটি। ব্যক্তিগতভাবে, এনজিও বা অন্যান্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগ নেয়ার আগে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব। শুধু দায়িত্ব নিলে হবে না, কার্যকরও করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য থেকে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে অক্ষরজ্ঞান দেবেন বা অক্ষর চেনানো শিক্ষাব্যবস্থার কাজ নয়। আবার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, ফ্রি করে দেয়া, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য দেয়া খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সামাজিক কাঠামোটি যদি ওই রকম করতে না পারা যায়, তাহলে গোড়াতেই ওই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। আর দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই নিরক্ষর বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরক্ষরতা দূর করার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার আগেই প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী ঝরে যায়। কারণ, বর্তমান বাংলাদেশে যে বাস্তব সমাজ কাঠামো রয়েছে, তা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের অনুকূলে নয়। আর অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার কথা না-ই বললাম। এ রকম সামাজিক কাঠামোর মধ্যে কিভাবে সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করা যায়, সে ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন না করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের ভেতর এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর যে বিন্যাস রয়েছে, তা পুনঃবিন্যাস করতে হবে। নতুবা সব ধরনের উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। এই ধারাবাহিকতা উচ্চশিক্ষার কাঠামোতে একইভাবে বিন্যাস করতে হবে।

আমি সাধারণত যেভাবে কথা বলি, তাতে সাধারণ মানুষ আমাকে নিরাশাবাদী বলতে চাইবে। আমি নিরাশাবাদী নই, ছিদ্রান্বেষী সমালোচকও নই। তবে আমি বাস্তবকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে চাই এবং অন্যদেরকেও দেখতে বলি। এই কথায় যেন কোনো পক্ষপাত না ঘটে, সত্যকে যেন ঠিক সত্য বলে দেখাই এই আমি কামনা করি। নিজেকে বা অপরকে স্তোক বাক্য শোনালে তাতে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। আশাবাদের ঢাক বাজালেও নির্মম কঠিন রাস্তাগুলোও তো উঠে যাবে না। এই চলিস্নশ বছরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন, রাষ্ট্র চালিয়েছেন তাদের কথা একরকম হবে। আর আমরা যারা সেই রাষ্ট্রে বসবাস করছি_১৫ কোটি মানুষ_অনেক শ্রেণীতে ভাগ হয়ে, অনেক রকম স্বার্থের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জীবন যাপন করেছি আর করছি, এখানে তাদের কথা অন্যরকম হবেই। নানা রকম হবেই। যারা ক্ষমতা শাসনে অধিষ্ঠিত আছেন, তারা তাদের সাফল্যের কথাই বড় করে তুলে ধরতে চাইবেন। আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনো সেই পর্যায়ে ওঠেনি যে, জনগণ জবাবদিহিতে শাসকদের বাধ্য করতে পারে। সে জন্য ব্যর্থতা ঢাকা দিয়ে সাফল্যের পালস্নাটা ভারী করে দেখলে সেটা কি অাঁটকানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এই রাষ্ট্রে যেসব শ্রেণী উচ্চে অবস্থিত তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধা, আইনের সুবিধা, নানাবিধ স্বার্থের সুবিধা আদায় করে নিতে পারছেন, তাদের কথাও তো আরেক রকম হবে। আমরা যারা উচ্চবিত্তভুক্ত নই, সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তও নই; অথচ বাধ্যতামূলকভাবে দৈহিক ও মানসিক শ্রম দেয়া থেকে মোটামুটি অব্যাহতি পেয়েছি, কোনো রকমে টিকে আছি, মাঝারি জায়গায় আছি, কোনো রকমে কিছু কাজ, কিছু চাকরি, কিছু ব্যবসা, সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া ইত্যাদি ব্যবস্থা করে নিতে পেরেছি তাদের কথাও আরেক রকম দাঁড়াবে। তাহলে রাষ্ট্রের ১৫ কোটি মানুষের জায়গা থেকে কোন কষ্টিপাথরে ঘষলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কথা, সার্থকতার কথা ঠিকমতো ধরা পড়বে? সেটা তো আগে ঠিক করতে হবে। কাজেই আর দশ বছর পরে এটা কেমন দেশ দাঁড়াবে তার বিবরণ তো হাজার রকমই হয়ে যাবে। প্রশ্নটা হচ্ছে, এই প্রশ্নটা কাকে করা হচ্ছে এবং কে জবাব দিচ্ছে? আমার নিজের ধারণা সংখ্যাগরিষ্ঠের জায়গা থেকেই সম্ভবত একটি রাষ্ট্রের সার্থকতা বা ব্যর্থতার বিচার হওয়া উচিত। যদিও তা আমরা করতে পারি কি না বা পারলে সেটা আলাদা কথা। সাধারণত আমরা সবাই নিরপেক্ষতার ভান করি। দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত মানুষরাও অবশ্যই তা করি। তবু কঠিন বাস্তব ঠিক এক জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে-কেউ তার কাছে যাবার চেষ্টা করলেই যেতে পারে। এই জায়গা থেকে গত চলিস্নশ বছরের উন্নয়ন হিসাব করা যেতে পারে। তার সর্বোচ্চ বেনিফিসিয়ারি কারা তার হিসাব করা যেতে পারে। মোটামুটি সুবিধা পেয়েছে এমন শ্রেণীগুলোরও হিসাব করা যেতে পারে। এমনকি প্রান্তিক সুবিধা যারা পেয়েছে, তাদেরও হিসাব করা সম্ভব। তাহলে উন্নতি বলতে আমাদের যাবতীয় অবকাঠামোর কথা বলা হোক, বিস্তার এবং প্রসারের কথা বলা হোক, আধুনিকতা এবং আধুনিকতার সুবিধার কথা বলা হোক, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির ব্যবহারে লাভালাভের কথা বলা হোক, অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-শিক্ষার নানা অনুপাতের বিষয় অনুসন্ধান করা হোক, সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানগুলো খতিয়ে দেখা হোক_আর তার মুখোমুখি বাংলাদেশের ১৫কোটি মানুষকে উপস্থাপন করা হোক; তাহলে গত চলিস্নশ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কতটা এগোল, কতটা অর্জন করল; এবং পঞ্চাশ বছরে কতটা এগোবে, আর কতটা অর্জন করবে তার ভালো আন্দাজ পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে এর বেশি গভীর ও বিস্তারিত আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।