Sunday, January 16, 2011

নয় পুলিশের রক্তে পিচঢালা পথ লাল

রসিংদীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ওসিসহ পুলিশের ৯ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত আরেক পুলিশ সদস্য আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুর উপজেলার ঘাসিরদিয়া এলাকায় একটি মালবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতদের সবাই নরসিংদীর বেলাব থানায় কর্মরত ছিলেন। স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে একটি সভায় যোগ দিতে ওই পুলিশ সদস্যরা নরসিংদী পুলিশ লাইনে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ খান (৪৫), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) জিয়াউল খান (৪০), উপপরিদর্শক (এসআই) কংকন কুমার মণ্ডল (৪২), কনস্টেবল কৃষ্ণ কুমার বর্মণ (৫০), রিয়াজ উদ্দিন (৪০), নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ (৪৫), বজলুর রহমান (৫০), মাসুদ পারভেজ (৪২) ও গাড়িচালক রেজাউল হক (৪০)। আহত কনস্টেবলের নাম প্রিয়তোষ (৫০)।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ১৭ জানুয়ারি নরসিংদী ও মনোহরদী পৌরসভার নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে নরসিংদী পুলিশ লাইনে একটি সভা ডাকা হয়েছিল। সভায় যোগ দিতে সকালে বেলাব থানার ওসি ফারুক আহমেদসহ ১০ জনের একটি দল পুলিশ ভ্যানে করে সেখানে যাচ্ছিল। সকাল সোয়া ১১টার দিকে তাদের গাড়িটি শিবপুরের ঘাসিরদিয়া এলাকা অতিক্রম করছিল। ওই সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মাছবোঝাই ট্রাক (যশোর মেট্রো-ট-১১-২৩৫২) পুলিশ ভ্যানের ওপর উঠে পড়ে। এতে পুলিশ ভ্যানের সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে ট্রাকের ভেতর ঢুকে যায়। ঘটনাস্থলেই জিয়াউল খানসহ পুলিশের আট সদস্য নিহত হন। ওসি ফারুক আহমেদ ও কনস্টেবল প্রিয়তোষকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফারুক মারা যান।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক জানান, মারাত্মক আহত প্রিয়তোষকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাত সোয়া ১২টার দিকে যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাসউদ্দিন ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, প্রিয়তোষের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, দুর্ঘটনার পর ১০ জনকেই জেলা হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে আগেই আটজনের মৃত্যু হয়েছিল। হাসপাতালে আনার ১০ মিনিট পর ফারুক আহমেদের মৃত্যু হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত পুলিশের ভ্যান ও ট্রাকটি মহাসড়কে পড়ে রয়েছে। সংঘর্ষের ফলে পুলিশ ভ্যানের সামনের অংশ ট্রাকের ভেতরে চলে যায়। এতে পুলিশের ভ্যানের সামনে থাকা ফারুক, জিয়াউল ও গাড়িচালক রেজাউল ট্রাকের সঙ্গে আটকে পড়েন। খবর পেয়ে শিবপুর থানা পুলিশ, নরসিংদী পুলিশ লাইনের রিজার্ভ পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তাঁরা ক্রেন দিয়ে দুদিক থেকে টেনে গাড়ি দুটি আলাদা করেন। সামনে থাকা ফারুককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জেলা হাসপাতালে পাঠানো গেলেও বাকি দুজন আগেই মারা যান। নিহতদের রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা পথ। দুর্ঘটনার পর ট্রাকটি আটক করা হলেও এর চালক ও তার সহকারী পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় শিবপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মহাসড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নিলে দুপুর ১২টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) হাসান মাহমুদ খন্দকারকে ফোন করে এ দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানান।
দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া স্থানীয় ঘাসিরদিয়া গ্রামের জসিমউদ্দিন বলেন, ‘ট্রাকের ভেতর পুলিশের গাড়ি ঢুকে যাওয়ায় আহতদের উদ্ধার করা যাচ্ছিল না।’
নরসিংদী জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেতে সারি সারি লাশ। একসঙ্গে এত সহকর্মীর চলে যাওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না অন্যরা। শোকে অনেক পুলিশ সদস্য নির্বাক হয়ে পড়েন। কেউ কেউ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
বেলাব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরবীকুল কাঁদতে কাঁদতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকালে থানায় আমার ডিউটি থাকায় স্যারদের গাড়িতে পুলিশ লাইনে আসা হয়নি। আমি গাড়ির পেছনেই মোটরসাইকেল নিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ করে ঘাসিরদিয়ায় আসার পর দেখি আমাদের গাড়িটি ট্রাকের ভেতরে চলে গেছে। আমাদের স্যাররা মারা গেছেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে আবারও তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্না থামিয়ে তিনি আবার বলেন, ‘আমাদের গাড়িটি অনেক পুরনো। থানায় কোনো নতুন গাড়ি না থাকায় ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। ভালো গাড়ি থাকলে একসঙ্গে এত মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হতো না।’
নিহত ফারুকের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলী আহাম্মদ খান। জিয়াউল খানের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার বাগডোবা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ডালিম খান। কংকন কুমার মণ্ডলের বাড়ি খুলনা সদর উপজেলার পাইকগাছা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নিত্যানন্দ। এ ছাড়া কনস্টেবল কৃষ্ণ কুমার বর্মণ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার উত্তর লস্করচালা গ্রামের শ্রীকান্ত বর্মণের ছেলে, রিয়াজ উদ্দিন কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে, নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভেহিবখলা গ্রামের সাধন কুমারের ছেলে, বজলুর রহমান মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের ফয়জুদ্দিনের ছেলে, মাসুদ পারভেজ জামালপুর সদর উপজেলার দমদমা গ্রামের ছোহরাব আলীর ছেলে ও গাড়িচালক রেজাউল হক জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার গোবিন্দনগর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। আহত প্রিয়তোষ নেত্রকোনা সদর উপজেলার সাতপাই গ্রামের নিরঞ্জন চন্দ্র পালের ছেলে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, নজরুল ইসলাম হীরু, জহিরুল হক মোহন, স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার, আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, উপমহাপরিদর্শক (ঢাকা রেঞ্জ) মো. আসাদুজ্জামান, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক অমৃত বাড়ৈ, পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা, নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনায় পড়লে পুলিশের সদস্যরা তাদের বাঁচাতে ছুটে যেতেন। তাঁরা উদ্ধার করতেন। কিন্তু আজ তাঁদেরই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হলো। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘বেলাব থানা থেকে আমার কাছে ফোন যেত একটি গাড়ির জন্য। কিন্তু আমি তাঁদের নতুন গাড়ি দিতে পারিনি। আজ পুরনো গাড়িতে চড়ে দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের এমন দুঃখজনক মৃত্যু হলো। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ দেখে নির্বাক হয়ে যান। কনস্টেবল নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ ও পুলিশের গাড়িচালক রেজাউল হকের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তাঁর চোখও ছলছল করে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুলিশের আধুনিক যানবাহনের অভাব রয়েছে। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি দিয়ে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এভাবেই আত্মত্যাগ করে যাচ্ছেন। এমন আরো অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা দায়িত্ব পালন করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইজি হাসান মাহমুদ বলেন, পৌরসভা নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় কনস্টেবলদের উপস্থিতি দরকার ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ধ্যার পর নিহতদের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে নরসিংদী পুলিশ লাইনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment