Tuesday, September 13, 2011

বন্দি পাখি ও মানুষের মন by তৌফিক মারুফ

কিশোরী তানিয়া তাকিয়ে আছে পাখিগুলোর দিকে। চোখে পলক নেই, আছে পানি_গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। যেন অশ্রুর বর্ষণ। তার মা মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে আছেন। তিনিও দেখছেন পাখিগুলো। অনেক ঘুঘু। হঠাৎ করেই তানিয়া মায়ের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করল। কামড় দিয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। মা জাপটে ধরে মেয়েকে মেঝেতে বসিয়ে দিলেন।

তানিয়ার কান্না আরো বেড়ে যায়। এরপর পা ছড়িয়ে মাথা ঠুকে চলে অঝোরে কান্না। 'ওই যে খাঁচার মইধ্যে পাখিগুলান আটকায়া থাকতাছে, এইডা অয় দেখতে পারতাছে না। আমার মাইয়াডার মাথায় গণ্ডগোল লাগতাছে, সেই জন্যে এইখানতে লইয়া আইছিলাম, এহনতে তো আরো খারাপ অইতাছে দেখলাম।' কী হয়েছে জানতে চাইলে তানিয়ার মা শেফালী বেগম বলেন এই প্রতিবেদককে। রাজধানীর সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের দোতলার করিডরের দৃশ্য এটি।

কেবল তানিয়া একা নয়, ওই হাসপাতালে আসা আরো অনেকেই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওই পাখির খাঁচার দিকে। এই দৃশ্য কাউকে কাউকে করে তোলে আরো আবেগপ্রবণ। কেউ কেউ আনমনে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে। পাখির ওড়াউড়ির মধ্যে নিজেকে হয়তো আরো বেশি করে হারিয়ে ফেলে। হাসপাতাল ভবন ঘুরে দেখা যায়, চতুর্ভুজ আকৃতির ভবনের মাঝখানের ফাঁকা এক চিলতে জমির ওপর গাছগাছালির বাগান। আছে ছোট চৌবাচ্চায় মাছের খামার। নিচ থেকে ভবনের চারতলার ছাদ পর্যন্ত পুরো ফাঁকা জায়গাটি ঘিরে দেওয়া হয়েছে লোহার জাল দিয়ে। ভেতরে অনেক প্রজাতির পাখির ওড়াউড়ি। বেশির ভাগই দেশি ঘুঘু। এ ছাড়া চড়ুই, বাবুই, টিয়া, শালিকসহ অন্য পাখিও রয়েছে। এসব পাখি উড়ে উড়ে বারবার জালের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সে দৃশ্য কোনো কোনো রোগীকে হয়তো মুগ্ধও করে।

অবশ্য হাসপাতালের ভেতর এমন পাখির খামার নিয়ে এ হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের ভেতর অনেক দিন ধরেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জালবন্দি পাখি দেখে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রোগী কান্নাকাটি করে। কেউ কেউ পাখিগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্যও চেঁচামেচি করে থাকে। খামারের কারণে হাসপাতালজুড়েই পাখির বিষ্ঠার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে আছে। রোগী-দর্শনার্থী অনেকেই নাকে কাপড় চেপে থাকেন এ হাসপাতালে। হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা বলেন, একটি হাসপাতালের মধ্যে এই নজিরবিহীন পাখির খামারটির কোনো বৈধতা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো রকম অনুমোদনও নেই। সরকারি এ হাসপাতালে এ খামারটি কোনো গবেষণা বা চিকিৎসা কার্যক্রমভুক্ত নয়। সাবেক এক পরিচালক তাঁর শখ পূরণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ খামার বানিয়েছিলেন। তিনি অবসরে যাওয়ার পর এ খামারটি এখানে থেকে যায়। এখন এ হাসপাতালের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের একজন চিকিৎসক এই পাখির খামারের তদারকি করেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটাল নামের এ প্রতিষ্ঠানটি এখন অনেকটাই লোকোচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। রাজধানীর শেরে বাংলানগর এলাকায় এ হাসপাতালটিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের কোর্স রয়েছে। যেখানে চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা ও গবেষণা করে থাকেন। পাশাপাশি চলে আবাসিক-অনাবাসিক চিকিৎসা কার্যক্রম। এখন রোগী রয়েছে প্রায় ২০০ জন। এর মধ্যে ১৫০ জন মানসিক রোগী এবং বাকি ৫০ জন্য মাদকাসক্ত। মোট রোগীর মধ্যে ৩০ জনের মতো শিশু। এখানে শিশু ও বড় রোগীদের আলাদা রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। জায়গার অভাবে সব রোগীকে একসঙ্গে রাখা হয়। মোট বিভাগ রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে সাতটি সরাসরি চিকিৎসার জন্য এবং বাকি তিনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারিগরি বিভাগ।

হাসপাতালের ভেতর পাখির খামার করা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম রাব্বানী বলেন, 'এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো কিছু নয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনোরূপ সিদ্ধান্তে ও পরিচালনায় এটি স্থাপিত বা পরিচালিত হয় না। জীববৈচিত্র্যপ্রেমী সাবেক এক পরিচালক এ হাসপাতালের দায়িত্বে থাকার সময় তাঁর ব্যক্তিগত শখ থেকে এটি তৈরি করেছিলেন। এখনো সেটি রয়ে গেছে। এখন এখানকার অন্য একজন চিকিৎসক এটি ব্যক্তিগতভাবে দেখভাল করেন।' রোগীদের মাঝে এ খামারে বন্দি পাখিদের নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পরিচালক বলেন, এটি অস্বাভাবিক নয়। বন্দি পাখি দেখে যে কারো যে কোনো সময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। এতে অনেক সময় রোগীদের মনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে পরিচালক এর সঙ্গে আরো যোগ করে বলেন, বিষয়টি একেকজনের মনের তাৎক্ষণিক অবস্থা ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। অনেক সময় এ পাখির খামার দেখে অনেকের মনে প্রশান্তি আসতে পারে বা ভালোও লাগে। পরিচালক বলেন, এ খামারের বিষয়ে এর আগে খুব একটা ভাবা হয়নি। এখন বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। এটি ক্ষতিকর হলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ খামার পরিচালনায় অর্থ ও জনবল জোগানের ব্যাপারে পরিচালক জানান, হাসপাতালের কোনো তহবিল থেকে এর জোগান হয় না। যে চিকিৎসক এটি দেখভাল করেন, তিনিই তাঁর ব্যক্তিগত অর্থে সব করে থাকেন। হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী এ খামার পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, একটি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে এমন একটি ব্যক্তিগত খামার থাকার ঘটনা নজিরবিহীন। তাও একটি মানসিক হাসপাতালে! এখানকার রোগীও যেমন এক ধরনের বন্দি জীবনযাপন করে, পাখিগুলোও তেমনি বন্দি থাকে_এটা হতে পারে না। এক রোগীর অভিভাবক আলতাফ হোসেন বলেন, 'দেখেন এখানে চিকিৎসার স্বার্থে যেমন রোগীদেরও বন্দি করে রাখা হয়, তেমনি পাখিগুলোকেও বন্দি করে রাখা হয়েছে। পুরো পরিবেশটাই কেমন অমানবিক মনে হয়।' আরেক চিকিৎসক বলেন, এর আগে এ খামারটি অপসারণে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালী একটি মহলের চাপে তা সম্ভব হয়নি। আগের পরিচালক নিজের বাড়িতে পাখির খামার না করে কেন এ সরকারি হাসপাতালের জায়গায় করলেন, তা নিয়ে এখনো অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে।