Wednesday, September 28, 2011

গৃহশ্রমিক সমস্যায় কর্মজীবী নারী by তানজিনা হোসেন

রোজেনার স্বপ্ন ছিল দেশের একজন সেরা আইনজীবী হওয়ার। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার। সে জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেছে নিয়েছিলেন আইন বিষয়টি। পরীক্ষায় চমৎকার ফল করে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন দেশের একজন খ্যাতনামা আইনজীবীর ফার্মে। জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন নিজেরই সহপাঠী বন্ধুকে, যিনি বেছে নিয়েছিলেন বিচারকের পেশা। দুজনের ক্যারিয়ারই এগোচ্ছিল ভালো, বছর দেড়েকের মাথায় ঘরজুড়ে এল শিশু।

সরকারি চাকরিজীবী স্বামী বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাইরে থাকেন, ওদিকে ঢাকা শহরে নেই রোজেনার কোনো আত্মীয়স্বজনও। সন্ধ্যা অবধি স্যারের চেম্বারে বসে মামলামোকদ্দমা নিয়ে পড়াশোনা বা মক্কেল সামলানোর সময় তাঁর মন পড়ে থাকে বাড়িতে, শিশুটিকে যে রেখে এসেছেন মাত্র ১৩ বছরের আরেক শিশুর কাছে—শিশু অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে তাঁরই বাড়িতে, আর তিনি কিনা মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় বুলি কপচাচ্ছেন! দিনমান মনে অশান্তি, কী হচ্ছে বাড়িতে, মুহূর্তে মুহূর্তে টেলিফোন, অমনোযোগের কারণে স্যারের বকুনি, গুরুত্বপূর্ণ নোট নিতেও ভুল হয়ে যায়। দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে এভাবে যুদ্ধ করতে করতে একসময় রোজেনা হার মানলেন। ছেড়ে দিলেন নিজের ক্যারিয়ার। সে আজ সাত বছর হতে চলল। সাত বছর আগের সিদ্ধান্তটার কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। এই সাত বছরে তাঁর স্বামী ও অন্য পুরুষ সহকর্মীরা নির্বিঘ্নে তরতরিয়ে উঠে গেছেন ক্যারিয়ারের শিখরে আর তিনি বাড়িতে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন শুধু। এর মধ্যে সন্তান হয়েছে আরেকটি। শুরু হয়েছে ওদের লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়া—আরও বেড়েছে দায়িত্ব। সেই সব দায়িত্ব পালন করতে করতে রোজেনা মাঝেমধ্যে এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন—শুধু যদি একজন কেউ পাশে থাকত! এমন কেউ, যার কাছে সন্তান দুটি রেখে আসা যেত নিশ্চিন্তে।
রোজেনার মতো মালিহার ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে যায় সেদিন, যেদিন তাঁর মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। এত দিন মা-ই তাঁর সন্তানকে দেখাশোনা করতেন, স্কুলে নিয়ে যেতেন ও আনতেন। কেননা, যে বিদেশি সংস্থায় তাঁর চাকরি, তাতে প্রতি সপ্তাহেই দু-একবার ঢাকার বাইরে যেতে হয়, থাকতে হয়। সন্তানের মুখ চেয়ে স্বামীকে অনেক বলে-কয়ে, অনেক অনুরোধে রাজি করিয়ে তবেই না মায়ের বাড়িতে একসঙ্গে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় দ্বিমুখী এক সংকটে পড়ে গেলেন মালিহা—সন্তানের প্রতি মা হিসেবে তাঁর কর্তব্য এবং সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতি তাঁর নিজের কর্তব্য বিষয়ে। বেশ কয়েকবার গৃহকর্মী, আয়া ইত্যাদি পাল্টেও মনমতো পাওয়া গেল না কাউকে। চরম অযত্ন আর অবহেলায় ক্রমাগত আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন মা, সন্তানের অবস্থাও ছাড়া বাছুরের মতো। এই সংকটে আর কী করার ছিল মালিহার—এত দিনের পুরোনো চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া! কদিন বাদেই একটা জুতসই পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও। মালিহাও তাই ভাবেন, যৌথ পরিবারের বিকল্প কিছু গড়ে না উঠলে তাঁর মতো নারীরা কীভাবে সব দিক সামলাবেন?

যত সব পিছুটান
একই মেধা, একই প্রতিভা, একই রকম উজ্জ্বল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে নারীকে কদিন পরেই পিছু হটে আসতে হয় প্রধানত যেসব বাধার মুখে, সেই সব বাধাবিপত্তি আজকের নারীরা অনেকাংশেই সামলে নিয়েছেন। পরিবারে তাঁদের ক্যারিয়ার বিষয়ে অসহযোগিতামূলক মনোভাব অনেকটাই এখন আর নেই, স্বামীরাও স্ত্রীর কর্মজীবন নিয়ে যথেষ্টই সহানুভূতিশীল। কর্মক্ষেত্রে নারীর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিও এখন ইতিবাচক। এতগুলো ইতিবাচকতার ভিড়ে এখনো প্রকটভাবে নেতিবাচক হলো কর্মজীবী নারীর গৃহের নিরাপত্তার জায়গাটি। একুশ শতকের নগরায়ণে যৌথ পরিবার ভেঙে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট ইউনিট। এই পরিবারে শিশুরাই আজ সবচেয়ে অসহায় ও একা। অনিরাপদও বটে। আর শিশুর এই নিরাপত্তাহীনতা বা অসহায়ত্বের ঝুঁকি নারীকে বাধ্য করে পিছু হটে আসতে। নারীর ক্ষমতায়ন তত দিন অসম্ভব, যত দিন না তাঁর অনুপস্থিতিতে গৃহ ও সন্তানের নিরাপত্তা বা সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত হয়। বাড়িতে রেখে আসা সন্তানের অবস্থা প্রতিনিয়ত তাঁকে পিছু টানতে থাকলে তাঁর পক্ষে আর এগোনো অসম্ভব হয়ে পড়ে। মেয়েরা অফিসে এসেও কেবল বাড়ি বাড়ি করে—এই অপরাধে কত যে কথা শুনতে হয় কর্মদাতাদের কাছে, তা কর্মজীবী নারী মাত্রই জানেন। এতই যখন সংসার আর বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা, তবে আর চাকরি করা কেন!

তবু তো তুমি আছো
ঠিক এই জায়গাতে শহরে কর্মজীবী নারীর জীবনে অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে যুক্ত হয় গৃহকর্মীরা, যাদের কাছে সংসার ও সন্তান রেখে বেরোতে বাধ্য হন তাঁরা। এই গৃহকর্মী কারা? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখাপড়া না জানা, বাড়ির দারোয়ান বা পাশের বাড়ির গৃহকর্মী কর্তৃক গ্রামের বাড়ি থেকে আনীত, কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণবিহীন, সাধারণ মাইনে আর ভাত-কাপড়ের বিনিময়ে আগত অসহায় কোনো কিশোরী বা নারী। তার কাছে গৃহিণীর চাহিদা আকাশ সমান—মেয়েটি বা নারীটি পূরণ করবে মায়ের শূন্যস্থান, নিখুঁতভাবে পালন করবে মায়ের দায়িত্ব, নিশ্চিন্ত রাখবে তাঁকে তাঁর কাজের সময়টিতে। আর গৃহকর্মীর অভিযোগগুলোও কম নয়—এই দুরন্ত বাচ্চাগুলোর জন্য এত করেও তো বেগম সাহেবার মন পাওয়া যায় না, প্রতি পদে ভুল আর ভুল। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার ডিউটিতে কোনো বিশ্রাম নেই, বিনোদন নেই, ছুটি নেই; তবু পাওনাটা কি যথাযথ হয়? শেষে উভয় পক্ষই দাঁড়িয়ে যায় পরস্পরের বিপরীতে। যে দুজন নারী শিশুকে ঘিরে এক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে যুক্ত, সেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অনাস্থার ওপর ভর করে। ফল যা হওয়ার তাই হয়। মানসিক টানাপোড়েন বাড়ে, অশান্তি বাড়ে, কখনো এক পক্ষ নির্যাতিত হয়। কখনো অপর পক্ষ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়। গৃহিণীর আর কোনো উপায় নেই। কেননা, তবু তো মেয়েটা আছে আর তার জন্য অফিসে যেতে পারছেন; ও না থাকলে অফিস কামাই দিতে হয়। আর গৃহকর্মীরও কোনো উপায় নেই। কেননা, এই চাকরিটা ছাড়লেও তো আরেক বাসায় চাকরি নিতে হবে। সবাই কমবেশি এক রকম। এরই মধ্যে বিপদ কখনো ঘটে বটে। সেই সব আমরা খবরের কাগজে পড়ি এবং শিউরে উঠি।

সমাধান কোথায়
ছয় বছর আগে যখন সাজিয়া উচ্চশিক্ষার্থে ইউরোপে ছিলেন, তখন ছুটিছাঁটায় বাড়তি উপার্জনের জন্য বেবি সিটিং বা বাচ্চা রাখার কাজ করতেন। এর জন্য তাঁকে একটি বিশেষ ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। এখন দেশে ফিরে যখন তিনি নিজের সন্তানকে গৃহকর্মীর কাছে রেখে অফিসে যাচ্ছেন, তখন এই পেশার প্রয়োজনীয়তাটা খুব বেশি করে অনুভব করছেন। তাঁর মতে, বিদেশে যেখানে শিক্ষিত নারীরাও স্বচ্ছন্দে এই কাজ করেন এবং ভালোই আয় করে থাকেন, তবে এ দেশে নয় কেন? আমাদের দেশে এখন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা অনেক, আর সন্তানের নিরাপত্তার জন্য বেতনের বড় একটা অংশ খরচ করতে আপত্তি নেই বেশির ভাগের। তাহলে আমাদের এখানে প্রশিক্ষিত বেবি সিটার বা গৃহকর্মী গড়ে উঠছে না কেন? প্রতিবছর এত যে এসএসসি বা জেএসসি পাস করে বোরোচ্ছে অনেক মেয়ে, বেকার বসে থেকে বিয়ের দিন গুনছে, তাদের অনেকেই তো ট্রেনিং নিয়ে এই কাজ করতে পারে। দুস্থ নারীদের সেলাই বা পারলারের কাজ শেখানোর পাশাপাশি শিশু পালনের ট্রেনিং দিয়ে পুনর্বাসিত করা যায়!
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই গৃহকর্মকে একটি শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে, কিন্তু হচ্ছে না। কেননা, সমস্যাটা দৃষ্টিভঙ্গিতে। গৃহকর্মীর কাজের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো দরকার। কাজের মেয়ে হিসেবে আচরণ না করে তার প্রতি পরিবারের সদস্যের মতো আচরণ করা, তাদের সম্বোধনে সহানুভূতিশীল হওয়া, বিপদে-অসুখে সাহায্য করা—মোটকথা তাদের সামাজিক অবস্থানটাকে স্বীকৃতি না দিলে আমরা শিক্ষিত বা প্রশিক্ষিত গৃহকর্মী পাব না। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান, এজেন্সি বা এনজিও এগিয়ে আসতে পারে, যারা দুই পক্ষের অধিকার সংরক্ষণ করবে, নিয়মনীতি চালু করবে, চাকরির ন্যায্য-অন্যায্য নির্ধারণ করবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আইন-কানুনের বাইরে কিছু করলে উভয় পক্ষেরই বিচার চাওয়ার জায়গা থাকবে এবং জবাবদিহি থাকবে। অর্থাৎ গোটা শ্রমটার একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি থাকলে এর ভেতরকার নিরাপত্তাহীনতা ও অনাস্থা অনেকটাই কমে আসবে।’ মাহবুবা আরও মনে করেন, যত বেশি মেয়ে নানা ধরনের কাজে এগিয়ে যাবেন, শিক্ষিত হয়ে উঠবেন, ততই তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনেই গৃহকর্মীদের প্রতি সহূদয় ও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে থাকবেন, তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে আগ্রহী হবেন।

চাই নির্ভাবনা ও নিশ্চিন্তি
একেবারে প্রাথমিকভাবে হলেও বাংলাদেশে ইদানীং গৃহকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান জেএস মিডিয়া লিমিটেডের আলীমুজ্জামান বলেন, ‘আমরা গৃহকর্মী ও ক্লায়েন্টের মধ্যে একটা চুক্তিপত্র সম্পাদন করি। এতে কাজের ধরন, বেতন-ভাতা, ছুটিছাটা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। ছবি, পূর্ণ ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংরক্ষণ করি। দুই পক্ষ সম্পর্কেই ভালো করে খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু এগুলোর আসলে তেমন কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কেননা, সত্যিকারের নিয়ম-কানুন ও আইনবিধি তৈরি করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। গৃহশ্রমের বাজার একটি বৃহৎ বাজার এবং এর চাহিদা ব্যাপক। আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত এগিয়ে আসা উচিত।’
আমরা রোজেনা, মালিহা বা সাজিয়ার মতো মেধাবী কর্মজীবী নারীকে আর হারাতে চাই না। এ দেশে তাঁদের মেধা ও দক্ষতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার আগে চাই এমন ব্যবস্থা ও পরিবেশ, যাতে তাঁরা নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় নিজেদের কাজে নিয়োজিত হতে পারেন। তাই সময় এসেছে প্রশিক্ষিত ও আইনানুগ গৃহশ্রমিক নিয়োগ নিশ্চিত করার।