Saturday, September 24, 2011

আ. লীগ-বিএনপির নয়, দ্বন্দ্ব শুধু দুই নেত্রীর

ওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তির মধ্যে। নীতি কিংবা কৌশলগত কোনো পার্থক্য নেই। দুই দলের নীতিগত অবস্থান প্রায় একই রকম। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা দুই দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রায় সব বিষয়েই সাদৃশ্য ছিল।
২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় এ তথ্য জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। গত ৩০ আগস্ট বিকল্প ধারার গণমাধ্যম উইকিলিকসের ফাঁস করা অনেক নথির সঙ্গে এ তারবার্তাটিও রয়েছে।
বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, প্রশাসনের অচলাবস্থা ও জ্বালানি সমস্যার মতো কঠিন বিষয়গুলো রয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছে। তবে যারাই নির্বাচনে ক্ষমতায় যাক না কেন, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ইশতেহারে উলি্লখিত বিষয়গুলো ঠিক ঠিকভাবে পালন করবে কি না, তা নিয়ে এখানকার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি, ঘোষণা ও বিতরণের প্রক্রিয়া বিএনপির তুলনায় ভালো হয়েছে।
বার্তায় মরিয়ার্টি বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। দলের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'দিনবদলের সনদ' স্লোগানে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাচনী স্লোগান 'চেঞ্জ'-এর সঙ্গে এ স্লোগানটির অনেকটা মিল রয়েছে। ইশতেহারে পাঁচটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো ১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, ৩. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ৪. দারিদ্র্য ঘোচাও, বৈষ্যম রুখো এবং ৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
এখানে শেখ হাসিনার অঙ্গীকার, তিনি দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসবেন; দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করবেন; পাঁচ বছরে জ্বালানি খাতে দ্বিগুণ উৎপাদন বাড়াবেন; দরিদ্রের সংখ্যা দুই কোটিতে নামিয়ে আনবেন, বর্তমানে এর সংখ্যা ৬ দশমিক ৫ কোটি; এবং সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের অর্থাৎ জঙ্গিদের দমন করবেন। এ ছাড়া তিনি সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অর্থবহ সংবিধানের আলোকে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ইশতেহারে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সমস্যার জন্য বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করেছেন। হাসিনা জোট সরকারের পাঁচ বছরের উল্লেখ করে বলেন, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জাতীয় অর্থসম্পদ লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি নিচে নামিয়ে এনেছে। ইশতেহারে হাসিনার যে বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব রাখে, তা হলো অসাম্প্রদায়িক ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যুবক ও তরুণ ভোটারদের সহায়তা কামনা। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরে ঘরে অন্তত একজন বেকার যুবকের চাকরি দেওয়া হবে বলে অঙ্গীকার করেছেন শেখ হাসিনা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণার পরদিন ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। 'দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও' স্লোগানে দলের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ইশতেহারটি ঘোষণা করেন। আমরা বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কার কাছ থেকে দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে আহ্বান করছে বিএনপি? তিনি উত্তর দিয়েছেন, দারিদ্র্যের হাত থেকে। বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে যে বিষয়গুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে উল্লেখ করেছে, সেগুলোর প্রায় সবই আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও রয়েছে। বিএনপি তার ইশতেহারে উল্লেখ করেছে, তারা সরকার গঠন করার সুযোগ পেলে সংসদে ডেপুটি স্পিকার নেবেন বিরোধী দল থেকে। দেশকে শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে বিএনপিকে দায়ী করলেও বিএনপি দায়ী করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে।
প্রধান দুই দলের পরের দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। উভয়ের ইশতেহারে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বড় চারটি দলই তাদের ইশতেহারে ইসলাম ধর্মকে সমুন্নত রাখার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এসব ইশতেহার ঘোষণার পর স্থানীয় শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, নির্বাচনের আগে ইশতেহারে অনেক বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর দ্রুত সেগুলো বদলেও যায়। একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে উল্লেখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অন্তত ২০০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের বার্ষিক জিডিপি ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর বিএনপি তার ইশতেহারে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছে, সেগুলো তারা ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার আগেও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু করেনি।
১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা উপলক্ষে বাংলা ও ইংরেজিতে নিমন্ত্রণপত্র তৈরি করেছিল। বাংলা ও ইংরেজিতে মুদ্রিত ইশতেহার ও শেখ হাসিনার বক্তব্যসহ এর ইলেকট্রনিক সংস্করণ বিভিন্নজনকে বিলি করা হয়। শেখ হাসিনা ইশতেহার উপস্থাপনের পর কূটনীতিক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তাঁর সঙ্গে চা পানের নিমন্ত্রণ করেন। কিন্তু বিএনপির ইশতেহার ঘোষণার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ অগোছালো। তারা এ উপলক্ষে কোনো নিমন্ত্রণপত্র দেয়নি। মুখে মুখে ও মিডিয়ার মাধ্যমে খবর জানিয়েছিল তারা। খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও ইশতেহার কোনোটিই ইংরেজিতে পাইনি আমরা। আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণার প্রক্রিয়া বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি গোছালো ছিল।

কবে হবে চার লেন by হকিকত জাহান হকি ও তৌফিকুল ইসলাম বাবর

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ কবে শেষ হবে? বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ১৯৬৭ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এর মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সালে। গত ৪৪ বছরেও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি 'ইকোনমিক লাইফ লাইন' হিসেবে ব্যবহৃত এ সড়কটি। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সার্বিক অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এ সড়কটি। সব ধরনের আমদানি-রফতানি পণ্য আনা-নেওয়া হয় এ সড়ক দিয়েই। এ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পর শুরু হবে 'ঢাকা-চট্টগ্রাম অ্যাক্সেস কন্ট্রোল হাইওয়ে'। এ সড়কটি হবে বিশেষায়িত।

২০১৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু গত দেড় বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। হাতে সময় রয়েছে মাত্র ৯ মাস। এ সময়ে প্রকল্পের বাকি ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ করা প্রায় অসম্ভব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় বছরে প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ হলেই কেবল নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বাকি কাজ শেষ হতে বাড়তি আরও এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জুনের আগে চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
বর্ষার কারণে সাড়ে তিন থেকে চার মাস ধরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ
থাকার পর ক'দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে ঠিকাদারদের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান দেব কনসালট্যান্ট লিমিটেডকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় ৭-৮ মাস সময়ক্ষেপণ, নতুন লেন নির্মাণে মাটি সংকট, মন্ত্রণালয় থেকে যথাসময়ে অর্থ ছাড় না করা, সর্বোপরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা না গেলেও যত
দ্রুত সম্ভব শেষ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন, প্রকল্প পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও প্রকল্পের দেশি-বিদেশি তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী ও প্রধান বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য চার লেনের সড়কের দাবি আজ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থায়নে।
সরকারের এক হিসাব থেকে জানা গেছে, জিডিপিতে এ মহাসড়কের অবদান ৩০ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। এর মধ্যে পণ্যবাহী ৬০ ভাগ যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়েই।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, নির্মাণ ব্যয় মেটানোর জন্য যথাসময়ে পর্যাপ্ত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ চার লেনের সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা চলতি ও আগামী অর্থবছরের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্মাণকাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ পুরোদমে চলছে বলে মন্ত্রী জানান।
যোগাযোগমন্ত্রী আরও বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য নির্মাণকাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে আগামী ২ বছরের মধ্যে প্রাক্কলিত ব্যায়ের পুরো টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে যথাসময়েই এ সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সড়কের বেশিরভাগ ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে বেশি সময় লাগবে না। এরপর পুরোদমে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। সামনে কাজের চাপ আরও বাড়বে। সে সময় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। অর্থের সরবরাহ থাকলে যথাসময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পুরো কাজ সম্পন্ন করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৬-৭ মাস সময় বেশি লাগতে পারে।
অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হলে চার লেনে উন্নীত করার কাজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১০ মিটার প্রস্তের ১৯২ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণে চলতি অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলে দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা। মাটি ভরাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে এ টাকা শেষ হয়ে যাবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে ঠিকাদারদের। তখন অর্থ বরাদ্দের জন্য আবারও ছোটাছুটি শুরু করতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। চার লেনের এ নতুন সড়ক নির্মাণে এ পর্যন্ত গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বিদ্যমান সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ডান পাশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ১০ মিটার প্রস্থের নতুন সড়কটি। ১০ মিটার প্রস্থের বিদ্যমান সড়কটি দুই লেনবিশিষ্ট। প্রস্থের দিক থেকে একই মাপের দুই লেনের নতুন সড়কটিসহ প্রায় তিনশ' কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়টি হবে চার লেনের। চার লেনের সড়কের মাঝখানে থাকবে ৬ মিটারের ডিভাইডার। এর মধ্যে ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করা হয়েছে বেশ আগে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি যেভাবে উন্নীত করার কথা ছিল গত ৪০ বছরেও তা হয়নি। এতে রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন পণ্যবাহী একটি গাড়ি ঢাকা থেকে ছাড়লে তা কখন চট্টগ্রামে পেঁৗছবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। চার লেনে উন্নীত হলে এ সংকট থাকবে না। কোনো কারণে নির্মাণকাজ যেন পিছিয়ে না যায় সে জন্য সরকারের সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
মহাসড়কের বর্তমান অবস্থা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন রীতিমতো মহাদুর্ভোগের মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই সড়কটির নাজুক অবস্থা। তার ওপর ভারী বৃষ্টিতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সড়কটির স্থানে স্থানে শুধু দেবেই যায়নি অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় খানাখন্দ। সড়কের বিভিন্ন জায়গা উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। গাড়িতে স্বাভাবিক গতি তোলা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রামে চলাচলের কথা থাকলেও এখন সময় লেগে যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। সম্প্রতি সড়কটি যানবাহন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়লে সরকার চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কের কিছুটা সংস্কার-মেরামত করলেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি; কিন্তু দায়সারা গোছের কাজের কারণে তা খুব বেশি টেকসই হয়নি।
মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়িচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসড়কের কমপক্ষে ৩০টি পয়েন্ট এখনও ছোট-বড় খানাখন্দে ভরা। এর মধ্যে সড়কের মিরসরাইয়ের ১০টি, সীতাকুণ্ডের ৫টি, কুমিল্লার ১০টি এবং ফেনীর ৪টি পয়েন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। সড়কের মিরসরাইয়ের বড় দারোগাহাট, নিজামপুর কলেজ, হাদিফকির হাট, বড়তাকিয়া, মিরসরাই সদর, মিঠাছড়া, জোড়ারগঞ্জ, বারৈয়ারহাট পৌর সদর, ইসমাইল কার্পেট মিল এলাকা, ছোটকমলদহ বাইপাস মোড় ও মিরসরাই সদর, সীতাকুণ্ডের উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বাইপাস সড়ক, মছইদ্দা স্কুলের সামনের মোড়, ফৌজদারহাট পোর্ট কানেকটিং সড়কের সংযোগস্থল, এসকেএন জুট মিল এলাকা, ফকিরহাট ফায়ার সার্ভিস মোড়ে সড়ক সংস্কার হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে। এ ছাড়া কুমিল্লার রায়পুর, চৌদ্দগ্রামের বাতিসাবৈদ্যের বাজার এলাকা, দক্ষিণ উপজেলার ধনাইতরী, দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজা মোড়, হাসনপুর, বিতপুর, ইলিয়টগঞ্জের আমিরাবাদ রাস্তার মাথা, চৌদ্দগ্রামের চিওড়া এলাকা, বুড়িচংয়ের নিমসার এবং ফেনী জেলার মুহুরীগঞ্জ, লেমুয়াব্রিজ, মহীপাল ও মোহাম্মদ আলী বাজার এলাকায় এখনও আছে ছোট-বড় গর্ত। এসব স্থানে গাড়ি চলাচল করতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে।
ঠিকাদারদের স্বেচ্ছাচারিতা : চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্প কাজের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ তিনটি ঠিকাদার কোম্পানির করার কথা থাকলেও তারা এ কাজ সঠিকভাবে করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোদ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এ বিষয়ে আপত্তির কথা জানা গেছে। তারা বলেছেন, অনেকটা তাদের অবহেলার কারণেই বিদ্যমান সড়কটির ছোট ছোট গর্ত আজ খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের। নতুন সড়ক নির্মাণের জন্য নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য পণ্য আনা-নেওয়া করতে হয় বিদ্যমান সড়ক দিয়ে। এ ছাড়া জনগণের চলাচল ও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড বেশি অবহেলা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড নামমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে বলে জানা গেছে।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন বলেন, নতুন সড়কের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের স্বাভাবিক কাজের দায়িত্ব ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত থাকে। বিশেষ কারণে ব্যাপক সংস্কারের কাজ করে ঠিকাদাররা পোষাতে পারবেন না। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের বেহাল দশা সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কার কাজ না হওয়ায় এখন সড়কটির অবস্থা বেশ নাজুক। সড়কটি সংস্কারের জন্য আলাদাভাবে টেন্ডার ডাকা হবে। নতুন সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররাই এ টেন্ডারে অংশ নিয়ে সংস্কারকাজ করবেন।
মহাজোট সরকারের আমলে নির্মাণ কাজ শেষ হবে কি : বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে বাস্তবায়ন কাজে তদারক বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যথাসময়ে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এ বছর বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। শিগগির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া না হলে নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দে গড়িমসি করা হলে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ক্ষমতায় আসার পর এ সরকার ১৫২টি সড়ক প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার মন্ত্রী, এমপিদের চাপে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বেশি। এ কারণে দেশের মূল সড়ক নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো, কার্যক্রম ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ যাচাই করে সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ওভার পাস, বাস বে : নতুন ১৯২ কিলোমিটার সড়কে ২৮টি ব্রিজ নির্মিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বড় ব্রিজ। কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ১৯৫টি। দুর্ঘটনা রোধে তিনটি রেলওয়ে ওভারপাস, দুটি আন্ডারপাস, ৩৩টি ফুটওভার ব্রিজ ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে দীর্ঘ সড়কের পাশে ৬১ স্থানে বাস বে নির্মাণ করা হবে।
প্রাক্কলিত ব্যয় ও বরাদ্দ : প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। গত তিন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ৭০০ কোটি টাকা চাওয়া হলে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা।
রোড ফান্ড : সূত্র জানায়, সারাদেশের সড়ক উন্নয়নে সরকারের আলাদা কোনো তহবিল নেই। এ খাতের জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা থাকলে জনগুরুত্বসম্পন্ন সড়ক নির্মাণে অর্থ সংকটের কথা ভাবতে হতো না সরকারকে। সরকারের মধ্যে এ তহবিল গঠনের কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে 'রোড ফান্ড' নামে একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। দেশটির ফুয়েল স্টেশন থেকে প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে ক্রেতার কাছ থেকে ২ রুপি করে নেওয়া হয় ওই তহবিলের জন্য। এ ছাড়া সড়কের বিশেষ স্থান থেকে টোল আদায়ের টাকা জমা করা হয় ওই তহবিলে। এ তহবিলের অর্থে ভারত সরকার সর্বশেষ জয়পুর থেকে আজমীর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সড়ক ৬ লেনে উন্নীত করছে। এর সঙ্গে রাখা হচ্ছে সার্ভিস লেন। জম্মু থেকে অমৃতসর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়কও উন্নয়ন করা হচ্ছে একই তহবিলের অর্থ খরচ করে।
ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি : মহাসড়কটি ১০ ভাগ করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন ৭টি প্যাকেজ, রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড দুটি প্যাকেজ এবং তাহের ব্রাদার্স ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে একটি প্যাকেজে কাজ পেয়েছে।
রেজা কনস্ট্রাকশন : এ কোম্পানি দুটি প্যাকেজে ৩৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে। এর মধ্যে ১নং প্যাকেজে দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে কুটুম্বপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার ও ৭নং প্যাকেজে ধুমঘাট ব্রিজ থেকে মিরসরাই বাজার পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। দুটি প্যাকেজে ৩৩৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্ষার কারণে মাটি ভরাটের কাজ তেমন এগোচ্ছে না। আগামী নভেম্বর থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হবে।
১নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ২২ কিলোমিটারে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ মাটি ভরাট হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এতটুকু সড়কে একটি ছোট আকারের ব্রিজ ও সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এর মধ্যে তিনটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। চুক্তির বাইরে আরও ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে বলে জানিয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে।
৭নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ১৫ কিলোমিটারে মাটি ভরাট হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আগামী মার্চের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। ৩০টি কালভার্টের মধ্যে সাতটি নির্মিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ১৫ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদার।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন সমকালকে বলেন, এ সড়কটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। যথাসময়ে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে টাকার সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। সামনের শীত মৌসুমে কাজের চাপ বেড়ে যাবে। তখন সে অনুপাতে টাকা সরবরাহ করতে হবে। টাকার অভাবে কাজ বন্ধ থাকলে ২০১৩ সালের মধ্যে পুরো সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
তাহের-আল আমীন : কুমিরা বাইপাস থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ১০নং প্যাকেজের আওতায় এ দুটি কোম্পানি পেয়েছে ১৭২ কোটি টাকার কাজ। তাহের ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার সমকালকে বলেন, তারা এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেছেন। ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় মাঝারি আকারের ছয়টি ব্রিজ ও নয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এরই মধ্যে সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি না হলে ২০১৩ সালের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
সাইনোহাইড্রো করপোরেশন : কুটুম্বপুর থেকে ধুমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত পাঁচটি প্যাকেজ ও মিরসরাই বাজার থেকে কুমিরা বাইপাস পর্যন্ত দুটি প্যাকেজসহ মোট সাতটি প্যাকেজে ১৩৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। মাটি ভরাট, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। জানা গেছে, দরকষাকষিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সাতটি প্যাকেজের আওতায় কাজ পেয়েছে এ কোম্পানি।

ঝুঁকিতে মেঘনা সেতু by আনোয়ার হোসেন

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নির্মিত মেঘনা সেতু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সেতুর মাঝ বরাবর ছয়টি পিলারের (ভারবাহী স্তম্ভ) আশপাশে ৫২ থেকে ৬৫ ফুট পর্যন্ত জায়গার মাটি সরে গেছে। এ ছাড়া সেতুর অনেকগুলো সম্প্রসারণশীল সংযোগ ও বিয়ারিং অকেজো হয়ে পড়েছে।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের নিয়োগ করা বিশেষজ্ঞরা সরেজমিন জরিপ করে এ তথ্য দিয়েছেন। জরিপ করার জন্য গত বছর সওজ জেপিজেড-মালয়েশিয়া-এইচসিইএল নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পিলারের কাছের মাটি সরে যাওয়ায় এবং বিয়ারিং-সম্প্রসারণশীল সংযোগ (এক্সপানশন জয়েন্ট) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সেতুটির ভারবহন ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় পুরো সেতু কেঁপে ওঠে। এ জন্য যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পিলারের কাছের মাটি সরে গেলে সেতুর শক্তি কমে যায়। সে ক্ষেত্রে ভূমিকম্প হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করলেও সেতুটির স্থায়িত্ব কমে যাবে। এটা মেরামতযোগ্য সমস্যা এবং দ্রুত মেরামত করাই একমাত্র সমাধান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মেঘনা সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগগুলোর অধিকাংশের ওপরের অংশে নাট-বল্টু খুলে পড়ে গেছে। ওপরে রাবার ও স্টিলের আবরণ উঠে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় বিকট শব্দ হচ্ছে, সেতু কাঁপছে।
২০০৪ সাল থেকে পিলারের মাটি সরে যাওয়া শুরু হলেও মেরামতের উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু শাখা) সাইদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুই-তিন বছর ধরে মাটি সরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা এটি মেরামতের পদ্ধতি জানিয়ে দিয়ে গেছেন। শিগগিরই মেরামত শুরু হবে। এভাবে মাটি সরে যাওয়া সেতুটির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সম্প্রসারণশীল সংযোগের নাট-বল্টু খুলে যাওয়ায় স্টিল ও রাবারের পাতগুলো কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেক স্থানে পাত নেই। যানবাহনের চাকার ঘর্ষণে কিছু কিছু পাত লাফিয়ে কয়েক ইঞ্চি ওপরে ওঠানামা করছে।
এই সেতু দিয়ে ট্রাক চালান আবুল বাশার। তিনি বলেন, সেতুর ওপরে খুব ধীরে ট্রাক চালাতে হয়। বিকট শব্দ হলে ভয় হয়। কখন না ভেঙে পড়ে। ঢাকা-কুমিল্লা পথে চলাচলকারী তিশা পরিবহনের চালক মহিউদ্দিন বলেন, এই সেতুতে দীর্ঘদিন ধরেই নাট-বল্টু খোলা দেখা গেছে।
মেঘনা সেতুর দুই প্রান্তেই সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখে দিয়েছে, ‘মেরামতকাজ চলছে। যানবাহন চলাচলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ২০ কিলোমিটার।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন কোনো মেরামতকাজ চলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ বলেই গতি কমানোর নির্দেশনা টাঙানো হয়েছে।
১৯৯১ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে সেতুটি নির্মিত হয়। সেতুর আয়ুষ্কাল ধরা হয় ১০০ বছর। কিন্তু ২০ বছর না যেতেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এতে ১২টি পিলার এবং ১৩টি সম্প্রসারণশীল সংযোগ রয়েছে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, সেতুটি মেরামতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। অনুমোদনও পাওয়া গেছে। অর্থ পেলেই মেরামত শুরু হবে।
মূল সমস্যা: সেতুর পিলারের পাশে মাটি সরে যাওয়া শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকেই। কিন্তু এ পর্যন্ত তা মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জরিপে বলা হয়েছে, ১২টি পিলারের মধ্যে নদীর মাঝখানের তিনটি পিলারের পাশের মাটি সরে গিয়ে ৬৫ ফুট গভীর গর্ত হয়ে পড়েছে। মাঝামাঝি অন্য আরও তিনটি পিলারের পাশে মাটি সরে ৫২ ফুট গর্ত হয়েছে। মেঘনা সেতুর পিলার ১৩৩ থেকে ১৪৬ ফুট পর্যন্ত গভীর। অন্তত তিনটি পিলার যে গভীরে পাইল করা হয়েছে, তার গোড়ার অর্ধেক মাটি সরে গিয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি সওজের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় থেকে প্রধান দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে মেঘনা সেতুর দুরবস্থার কথা জানানো হয়। মাটি সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, সেতুর নিচ দিয়ে গড়ে তিন হাজার টন পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে। কিন্তু ৫০০ টন পণ্যবাহী নৌযান চলবে—সে হিসাব করেই নকশা করা হয়েছিল। এ ছাড়া অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। ফলে নদীর স্রোত, নৌযানের গতি ও কম্পনের ফলে পিলারের পাশের মাটি সরে যাচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগ ও কল-কবজাগুলো দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি পর্যন্ত ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেক কল-কবজা স্থানচ্যুত হয়ে পড়ায় যান চলার সময় সেতুটি অস্বাভাবিকভাবে নড়ে। এখনই মেরামত করা না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সওজ সূত্র জানায়, গোমতী সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেঘনা সেতুর তিন বছর পর গোমতী সেতু চালু হয়। এই দুটি সেতু খুব কাছাকাছি। দুটি সেতুর জন্য একসঙ্গেই টোল আদায় করা হয়। ২০০৮ সালে মেঘনা ও গোমতী সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগ মেরামত করা হয় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু তিন বছরও টেকেনি সেই মেরামত।
সওজ সূত্র জানায়, মেঘনা সেতু এখন মেরামত করতে গেলে ভূমিকম্পের সহনীয় মাত্রাও বাড়াতে হবে। কারণ ১৯৯১ সালে সেতুটি ত ৎকালীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী ভূমিকম্পের জন্য মান ধরা ছিল দশমিক শূন্য ৫ জি। বর্তমানে বিএনবিসি কোড অনুযায়ী ভূমিকম্পের মান ধরা হয়েছে দশমিক ১৫ জি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ: সেতুটি মেরামতে ১৫০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে। এতে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটি পরিপূর্ণ মেরামত করতে হলে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নতুন করে নকশা প্রণয়ন করতে হবে। এতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। কিন্তু মেঘনা সেতুর বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে দুই বছর অপেক্ষা করা বাস্তবসম্মত হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, মেঘনা সেতু কোনো কারণে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে বন্দরনগর চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হুমকির সম্মুখীন হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র অকেজো: বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মেঘনা ও গোমতী সেতুর দুই প্রান্তে দুটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে এই কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও কখনোই তা ব্যবহার করা হয়নি। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহনও সেতুর জন্য ক্ষতিকর।
মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজা সূত্রে জানা গেছে, এই সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৬ হাজার যানবাহন চলে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই বাণিজ্যিক অর্থা ৎ মালবাহী যান।

হাজারীবাগ খালে ক্ষমতার থাবা by আপেল মাহমুদ

পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার তরল বর্জ্য ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয় হাজারীবাগ খাল দিয়ে। অতীতে মূল খালের সঙ্গে ছিল দুটি শাখা খাল। সেগুলো এখন আছে শুধু সরকারি রেকর্ডপত্রে। বাস্তবে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাড়িঘর ও কলকারখানা। অন্তত ২০ বছর ধরে জলাশয়ের জায়গা দখল চলছে। দখল সিন্ডিকেটে এবার যোগ হয়েছে অপরাধজগতের পরিচিত মুখ তনাই মোল্লাসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার নাম। এ নেতাদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁরা বায়না সূত্রে জমির মালিক।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগ মূল খালটি একসময় বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা ছিল। সে শাখার একটি খাল ইসলামবাগ লবণ ফ্যাক্টরি দিয়ে কেল্লার মোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মূল খালটি থাকলেও বর্তমানে এ শাখার কোনো অস্তিত্বই নেই। জেলা প্রশাসকের সার্ভে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, খালের জমিতে কাঁচা, আধা কাঁচা এবং বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ২৫০৫ নম্বর আরএস এবং ২০০১ নম্বর এসএ দাগের অন্তর্ভুক্ত হলো ওই খাল। সরকারের নথিতে তা ১ নম্বর খাস খতিয়ান হিসেবে তালিকাভুক্ত। জমির পরিমাণ ২ দশমিক ২৫২৬ একর।
স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ ব্যক্তি ওই খালের জায়গা দখল শুরু করে ২০ বছর আগে। আর বর্তমানে তনাই মোল্লাসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা অভিনব কৌশলে ইসলামবাগ লবণ ফ্যাক্টরি থেকে কেল্লার মোড় প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত শাখা খালের জায়গায় দখলের কাজ চালাচ্ছেন। দখলকারী হিসেবে যাঁদের নামে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে আছেন মোশারফ হোসেন, তনাই মোল্লা, মো. জাহাঙ্গীর, হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো, সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. বাবুল ঢালী, মতিউর রহমান জামাল, সের ইসলাম, আমির হোসেন, মো. আকিব প্রমুখ। ইতিমধ্যে তাঁরা ক্রয়সূত্রে মালিক এমন সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করে নিয়েছেন হাজারীবাগ শাখা খালের উল্লেখযোগ্য অংশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোশারফ হোসেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তবে তাঁদের সহযোগী তনাই মোল্লা ঢাকার অপরাধজগতের একজন অতিপরিচিত ব্যক্তি।
স্থানীয় ভূমি অফিসের এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ সিন্ডিকেট ইতিমধ্যে খালের প্রায় দুই একর খাসজমি ভরাট করে ফেলেছে। অবশিষ্ট জমি দখলের জন্য ড্রেজার দিয়ে রাত-দিন বালু ফেলা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইসলামবাগ বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে (লবণ ফ্যাক্টরি-সংলগ্ন) পুরনো মজা খালের ওপর একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। স্থানটি এলাকাবাসীর কাছে বাঁশপট্টি হিসেবে পরিচিত। সাইনবোর্ডে লেখা 'ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক মোশারফ হোসেন, তনাই মোল্লা, মো. জাহাঙ্গীর, হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো, সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. বাবুল ঢালী, মতিউর রহমান জামাল, সের ইসলাম, আমির হোসেন ও মো. আকিব।' সেই সাইনবোর্ডে হাজারীবাগ মৌজার সিএস দাগ নম্বর ৪১, এসএ দাগ নম্বর ৬৬৭৬, ৬৬৭৭, আরএস দাগ নম্বর ১৩৫৫২, ১৩৫৫৩, ১৩৫৫৪, ১৩৫৫৫ এবং মহানগর দাগ নম্বর ১২৫০৪, ১২৫০৫। জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩৩ একর বা ১৩৩০০ অযুতাংশ। রেকর্ড সূত্রে উলি্লখিত জমির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা হাজি আবদুল হালিমের বংশধররা।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, যেখানে খাসজমি ভরাট করা হচ্ছে, এর পাশে কিছুু ব্যক্তিগত সম্পত্তি রয়েছে। মূলত দখলদার সিন্ডিকেট ওই জমিকে পুঁজি করেই সরকারি খাসজমি দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। স্থানটি হাজারীবাগ ও লালবাগ সীমান্তবর্তী হওয়ায় তারা সে সুযোগটা সহজেই কাজে লাগিয়ে মাটি ভরাটের কাজ করতে পারছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বলছে, দখলদার সিন্ডিকেট এক দাগের জমি বায়নাসূত্রে কিনে অন্য দাগের জমি ভরাট করছে। মৌজার মানচিত্র দিয়ে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারের মাধ্যমে মাপজোখ করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে জানান স্থানীয় ইসলামবাগের বাসিন্দা কুদরত উল্লাহ।
ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেলের সার্ভেয়ার জহির হোসেন জানান, যে জমিতে মাটি ভরাট করা হচ্ছে, এর মালিকানা এখনো নির্ণয় করা হয়নি। কারণ সেখানে সরকারি খাসজমি ছাড়াও সরকারি অধিগ্রহণ করা জমি রয়েছে। সব কিছু বিশ্লেষণ করে কোনটা খাসজমি, কোনটা ব্যক্তিগত জমি, তা চিহ্নিত করা হবে।
খালের নকশা ও রেকর্ড-পর্চা থেকে জানা গেছে, বায়নাসূত্রে যে জমিতে বালু ফেলা হচ্ছে, এর পাশেই হাজারীবাগ খালের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে, যা লালবাগ মৌজার অন্তর্ভুক্ত। ২০০১ নম্বর এসএ দাগেই রয়েছে কয়েক একর সরকারি খাসজমি। এর কিয়দংশ ভরাট করার কাজ ইতিমধ্যে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকি ভরাটের কাজ দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, মাটি ভরাটের কাজ শেষ হলে ওই সিন্ডিকেট পুরো জমি কাউকে সাবকবলা দলিলমূলে বিক্রি করে দেবে। তবে ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার আবুল হাসনাত মঈনউদ্দিন বলেন, শিগগিরই ভরাট করা জমি সার্ভেয়ার দিয়ে মেপে দখলকৃত সরকারি জমি উদ্ধার করা হবে। কেউ মাটি ভরাট করলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও তিনি জানান।
লালবাগ তহশিল অফিস সূত্রে জানা গেছে, হাজারীবাগ খালের পাশে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হলে তারা বিষয়টি জানিয়ে ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেল অফিসে চিঠি দিয়েছে। গত ২৪ জুলাই লেখা সেই চিঠিতে বলা হয়, মাটি ভরাটের জায়গায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির পাশাপাশি অনেক সরকারি জমি রয়েছে। বিশেষ করে লালবাগ মৌজার ১/১ খতিয়ানে ২০০১ নম্বর এসএ দাগে বিপুল পরিমাণ খাসজমি বিদ্যমান। কিন্তু ওই দাগের জমির সীমানা চিহ্নিত করা নেই। ফলে বায়নাসূত্রে মালিকদের ভরাট করা অংশ খাসজমি কি না, তা চিহ্নিত করার জন্য চিঠির মাধ্যমে তহশিলদার আলমাস হোসেন খান ভূমি সহকারী কমিশনারের অফিসকে জানান। এরপর ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেল অফিসের সার্ভেয়ার দিয়ে খাসজমি নির্ণয়ের জন্য মাপজোখ শুরু করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বায়নাসূত্রে ওই জমির মালিক এবং লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, ওই জমির প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে সঠিক কাগজপত্র দেখেই বায়না করা হয়েছে। এখানে সরকারি খাস কিংবা অধিগ্রহণ করা কোনো জমি ভরাট করা হয়নি। তনাই মোল্লার নাম সাইনবোর্ডে সংযুক্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে বায়না দলিলে তনাই মোল্লার স্ত্রীর নাম রয়েছে। তিনি মহিলা হওয়ায় স্ত্রীর পরিবর্তে স্বামী তনাই মোল্লার নাম দেওয়া হয়েছে। অপর বায়না দলিলগ্রহীতা হাজি সিরাজুল ইসলাম ওরফে রাডো সিরাজ বলেন, ওই জমি বায়না করার ব্যাপারে সব কিছু করেছেন তনাই মোল্লা। তাই জমির সব কিছু তিনিই বলতে পারবেন।
হাজারীবাগ খালের আরেকটি শাখা কোম্পানীগঞ্জঘাট থেকে এনায়েতগঞ্জের ভেতর দিয়ে হাজারীবাগের সাত্তারের ট্যানারি ফ্যাক্টরি পর্যন্ত এসেছে বলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। কিন্তু ওই খালের কোনো অস্তিত্ব স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা সম্ভব হয়নি। তবে অনেক অনুসন্ধানের পর ওই খালের চিহ্ন পাওয়া গেল, যাকে নালা বলাই ভালো। খালের দুই পাশে বড় বড় বহুতল ভবন উঠেছে। স্থায়ী বাসিন্দা হাজি একলাছ উদ্দিন বলেন, পাকিস্তান আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে এনায়েতগঞ্জের খাল দিয়ে ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা ও উত্তরবঙ্গ থেকে নৌকা বোঝাই করে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া আসত। বর্তমানে সেই খালের জায়গায় পাকা রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে।
জেলা প্রশাসন কিংবা স্থানীয় ভূমি অফিস থেকেও ওই খালের বিবরণ জানা সম্ভব হয়নি। ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ঢাকায় যে ৩৬টি খাল তারা ব্যবস্থাপনা করছে, এর মধ্যে হাজারীবাগ কিংবা এনায়েতগঞ্জ খালের কথা নেই। তবে লালবাগ তহশিল অফিসের ২৮ নম্বর আরএস রেকর্ড নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে ১ দশমিক ৫৩৮৪ একর জমি রয়েছে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। ওই জমিতেই একসময় খাল ছিল বলে স্থানীয় বর্ষীয়ান ব্যক্তি হোসেন আলী মাতবর জানান।
হোসেন আলী আরো বলেন, খালের আরো অনেক জমি থাকলেও পর্যায়ক্রমে তা ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। এর পরই খাল দখল করে সেখানে বাড়িঘর এবং কলকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে এলাকায় জমে থাকা বিষাক্ত তরল বর্জ্যে অনেকে নানা অসুখে ভুগছে। হাজারীবাগের স্থানীয় চিকিৎসক ডা. আবদুল কাদের বলেন, এসব বর্জ্য ঠিকমতো অপসারণ হয় না বলে এলাকার অনেকে শ্বাসকষ্ট, শরীর চুলকানি, নাসিকা প্রদাহ, চোখের রোগসহ আরো অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী জঙ্গলবাড়ী মৌজার ২৯৮৭ ও ২৯৮৬ নম্বর আরএস দাগে সরকারের আরো প্রায় ৩০ একর খাসজমি থাকলেও তা বিভিন্ন লোকের দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ ঘাটের পাশে খাল ভরাট করে প্রায় দুই একর জমিতে ম্যাটাডোর কলম এবং ভলভো ব্যাটারি ফ্যাক্টরির স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে হাজারীবাগ খালের সংযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ ঘাটের ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, এলাকার প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশেই এসব দখলের ঘটনা ঘটছে। তবে ফ্যাক্টরির কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে খালের জমি লিজ নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
সরকারি খাল এবং খাসজমি দখল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, হাজারীবাগ খালের সরকারি খাসজমি দখলের বিষয়টি অনেক পুরনো। ধীরে ধীরে খাসজমি দখল করে নিয়েছে কিছু প্রভাবশালী মহল। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন খালের সার্ভে করে বেদখল হয়ে যাওয়া জমি কিভাবে উদ্ধার করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। খালের জায়গা চিহ্নিত হলেই তা উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হবে।

বীরকন্যা প্রীতিলতা by শরীফা বুলবুল ও আবদুল হাকিম

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনন্য অধ্যায় বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মোৎসর্গ। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনেক নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হন। অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লবী দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন অনেক নারী। অগি্নযুগের প্রথম পর্বে স্বর্ণ কুমারী দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনী নাইডু, ননী বালা, দুকড়ি বালা; পরবর্তীকালে ইন্দুমতি দেবী (অনন্ত সিংহের দিদি), লীলা রায়, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী প্রমুখ নারী ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শামিল হন।
এরই ধারাবাহিকতায় বিপ্লবী আন্দোলনে শামিল হন বীরকন্যা প্রীতিলতা। ব্রিটিশ নাগপাশ থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপাশি অসংখ্য বিপ্লবীকে প্রশিক্ষিত, অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে গেছেন তিনি। আজ তাঁর আত্মাহুতি দিবস।
অগি্নযুগের এই বিপ্লবী ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার নেতৃত্ব দেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার এড়াতে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
প্রীতিলতার জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে ১৯১১ সালের ৫ মে। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি ও মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার একজন গৃহিণী ছিলেন। এক ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ডাক নাম ছিল রানী।
প্রীতিলতার পড়াশোনার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করান। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পান প্রীতিলতা। ওই স্কুল থেকে তিনি ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। থাকতেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে। এ সময় প্রীতিলতা বিপ্লবী
লীলা নাগের সংস্পর্শে আসেন। লীলা নাগ ওই সময় দীপালী সংঘের নেতৃত্বে ছিলেন। দীপালী সংঘ ছিল ঢাকার বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের নারী শাখা। ১৯৩০ সালে তিনি আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম হন। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালের ডিসটিঙ্কশনসহ তিনি বিএ পাস করেন।
সংগ্রামী জীবন : ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুট, রেললাইন উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল করে দেওয়াসহ ব্যাপক আক্রমণ হয়। এটি চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। এই আন্দোলন সারা দেশের ছাত্র সমাজকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯ এপ্রিল প্রীতিলতা ঢাকা থেকে ফিরে আগের রাতে বীর যোদ্ধাদের এই মহান কর্মকাণ্ডের খবর পান। প্রীতিলতার ভাষায়, 'ওই সব বীরের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হলো। কিন্তু ওই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অংশ নিতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাস্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি, তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম।'
কলকাতা বেথুন কলেজে পড়ার সময় একটু একটু করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে যান প্রীতিলতা। চাঁদপুরে হামলার ঘটনায় বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয়। তিনি আলীপুর জেলে বন্দি ছিলেন। প্রীতিলতা বোন পরিচয়ে অনেকবার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর প্রেরণায় প্রীতিলতা বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি গোপনে বিপ্লবীদের জন্য অর্থ, গোলাবারুদ সংগ্রহ করে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম আনাসহ বিভিন্ন তৎপরতায় যুক্ত হন। ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণের ফাঁসি কার্যকর হয়। প্রীতিলতা লিখেছেন, 'রামকৃষ্ণ দার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।'
বিএ পরীক্ষা শেষে প্রীতিলতা স্থায়ীভাবে চলে আসেন চট্টগ্রামে। এখানে তিনি নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমান অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
ওই সময় আরেক বীরকন্যা কল্পনা দত্তের মাধ্যমে মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন প্রীতিলতা। এর মধ্যে যোগাযোগ ঘটে বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে। ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টারদার সঙ্গে প্রীতিলতার প্রতীক্ষিত সাক্ষাৎ ঘটে এবং দুই ঘণ্টা ধরে কথা হয়। এরপর তিন দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ লাভ করেন তিনি।
জুন মাসে বিপ্লবীদের শক্ত আস্তানা প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করার সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁদের ঘিরে ফেলেন। বিপ্লবীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধে প্রাণ দেন বিপ্লবী নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নিহত হন। এ ঘটনার পর পুলিশ সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বাড়ি ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে পুলিশের নজরদারি বাড়ায় জুলাই মাসের দিকে তাঁকে আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দেন মাস্টারদা।
দুই বছর আগে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল যুব বিদ্রোহের সময় অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু ওইদিন গুড ফ্রাইডে থাকায় সে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। ১৯৩২ সালে আবারও এই ক্লাবে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করেন বিপ্লবীরা। ওই বছরের ১০ আগস্ট আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। পরিকল্পনা হয়, সেপ্টেম্বর মাসে নারী বিপ্লবীদের নেতৃত্বে আক্রমণ হবে। এর আগেই কল্পনা দত্ত পুলিশের হাতে ধরার পড়ার পর আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়া হয় প্রীতিলতাকে। আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কাট্টলীর সাগরতীরে প্রীতিলতা ও তাঁর সাথীদের অস্ত্র শিক্ষা শুরু হয়। ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে সফল হন বিপ্লবীরা। পুরুষের ছদ্মবেশে আক্রমণে নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। পরে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন এই বীরকন্যা।
বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি প্রীতিলতা নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন।
কর্মসূচি : প্রীতিলতার মহান আত্মত্যাগ স্মরণে আজ ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ট্রাস্টের উদ্যোগে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে প্রীতিলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার সোমনাথ ঘোষ।