Saturday, September 24, 2011

হাজারীবাগ খালে ক্ষমতার থাবা by আপেল মাহমুদ

পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার তরল বর্জ্য ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয় হাজারীবাগ খাল দিয়ে। অতীতে মূল খালের সঙ্গে ছিল দুটি শাখা খাল। সেগুলো এখন আছে শুধু সরকারি রেকর্ডপত্রে। বাস্তবে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাড়িঘর ও কলকারখানা। অন্তত ২০ বছর ধরে জলাশয়ের জায়গা দখল চলছে। দখল সিন্ডিকেটে এবার যোগ হয়েছে অপরাধজগতের পরিচিত মুখ তনাই মোল্লাসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার নাম। এ নেতাদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁরা বায়না সূত্রে জমির মালিক।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগ মূল খালটি একসময় বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা ছিল। সে শাখার একটি খাল ইসলামবাগ লবণ ফ্যাক্টরি দিয়ে কেল্লার মোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মূল খালটি থাকলেও বর্তমানে এ শাখার কোনো অস্তিত্বই নেই। জেলা প্রশাসকের সার্ভে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, খালের জমিতে কাঁচা, আধা কাঁচা এবং বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ২৫০৫ নম্বর আরএস এবং ২০০১ নম্বর এসএ দাগের অন্তর্ভুক্ত হলো ওই খাল। সরকারের নথিতে তা ১ নম্বর খাস খতিয়ান হিসেবে তালিকাভুক্ত। জমির পরিমাণ ২ দশমিক ২৫২৬ একর।
স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ ব্যক্তি ওই খালের জায়গা দখল শুরু করে ২০ বছর আগে। আর বর্তমানে তনাই মোল্লাসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা অভিনব কৌশলে ইসলামবাগ লবণ ফ্যাক্টরি থেকে কেল্লার মোড় প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত শাখা খালের জায়গায় দখলের কাজ চালাচ্ছেন। দখলকারী হিসেবে যাঁদের নামে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে আছেন মোশারফ হোসেন, তনাই মোল্লা, মো. জাহাঙ্গীর, হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো, সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. বাবুল ঢালী, মতিউর রহমান জামাল, সের ইসলাম, আমির হোসেন, মো. আকিব প্রমুখ। ইতিমধ্যে তাঁরা ক্রয়সূত্রে মালিক এমন সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করে নিয়েছেন হাজারীবাগ শাখা খালের উল্লেখযোগ্য অংশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোশারফ হোসেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তবে তাঁদের সহযোগী তনাই মোল্লা ঢাকার অপরাধজগতের একজন অতিপরিচিত ব্যক্তি।
স্থানীয় ভূমি অফিসের এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ সিন্ডিকেট ইতিমধ্যে খালের প্রায় দুই একর খাসজমি ভরাট করে ফেলেছে। অবশিষ্ট জমি দখলের জন্য ড্রেজার দিয়ে রাত-দিন বালু ফেলা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইসলামবাগ বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে (লবণ ফ্যাক্টরি-সংলগ্ন) পুরনো মজা খালের ওপর একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। স্থানটি এলাকাবাসীর কাছে বাঁশপট্টি হিসেবে পরিচিত। সাইনবোর্ডে লেখা 'ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক মোশারফ হোসেন, তনাই মোল্লা, মো. জাহাঙ্গীর, হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো, সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. বাবুল ঢালী, মতিউর রহমান জামাল, সের ইসলাম, আমির হোসেন ও মো. আকিব।' সেই সাইনবোর্ডে হাজারীবাগ মৌজার সিএস দাগ নম্বর ৪১, এসএ দাগ নম্বর ৬৬৭৬, ৬৬৭৭, আরএস দাগ নম্বর ১৩৫৫২, ১৩৫৫৩, ১৩৫৫৪, ১৩৫৫৫ এবং মহানগর দাগ নম্বর ১২৫০৪, ১২৫০৫। জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩৩ একর বা ১৩৩০০ অযুতাংশ। রেকর্ড সূত্রে উলি্লখিত জমির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা হাজি আবদুল হালিমের বংশধররা।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, যেখানে খাসজমি ভরাট করা হচ্ছে, এর পাশে কিছুু ব্যক্তিগত সম্পত্তি রয়েছে। মূলত দখলদার সিন্ডিকেট ওই জমিকে পুঁজি করেই সরকারি খাসজমি দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। স্থানটি হাজারীবাগ ও লালবাগ সীমান্তবর্তী হওয়ায় তারা সে সুযোগটা সহজেই কাজে লাগিয়ে মাটি ভরাটের কাজ করতে পারছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বলছে, দখলদার সিন্ডিকেট এক দাগের জমি বায়নাসূত্রে কিনে অন্য দাগের জমি ভরাট করছে। মৌজার মানচিত্র দিয়ে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারের মাধ্যমে মাপজোখ করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে জানান স্থানীয় ইসলামবাগের বাসিন্দা কুদরত উল্লাহ।
ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেলের সার্ভেয়ার জহির হোসেন জানান, যে জমিতে মাটি ভরাট করা হচ্ছে, এর মালিকানা এখনো নির্ণয় করা হয়নি। কারণ সেখানে সরকারি খাসজমি ছাড়াও সরকারি অধিগ্রহণ করা জমি রয়েছে। সব কিছু বিশ্লেষণ করে কোনটা খাসজমি, কোনটা ব্যক্তিগত জমি, তা চিহ্নিত করা হবে।
খালের নকশা ও রেকর্ড-পর্চা থেকে জানা গেছে, বায়নাসূত্রে যে জমিতে বালু ফেলা হচ্ছে, এর পাশেই হাজারীবাগ খালের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে, যা লালবাগ মৌজার অন্তর্ভুক্ত। ২০০১ নম্বর এসএ দাগেই রয়েছে কয়েক একর সরকারি খাসজমি। এর কিয়দংশ ভরাট করার কাজ ইতিমধ্যে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকি ভরাটের কাজ দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, মাটি ভরাটের কাজ শেষ হলে ওই সিন্ডিকেট পুরো জমি কাউকে সাবকবলা দলিলমূলে বিক্রি করে দেবে। তবে ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার আবুল হাসনাত মঈনউদ্দিন বলেন, শিগগিরই ভরাট করা জমি সার্ভেয়ার দিয়ে মেপে দখলকৃত সরকারি জমি উদ্ধার করা হবে। কেউ মাটি ভরাট করলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও তিনি জানান।
লালবাগ তহশিল অফিস সূত্রে জানা গেছে, হাজারীবাগ খালের পাশে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হলে তারা বিষয়টি জানিয়ে ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেল অফিসে চিঠি দিয়েছে। গত ২৪ জুলাই লেখা সেই চিঠিতে বলা হয়, মাটি ভরাটের জায়গায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির পাশাপাশি অনেক সরকারি জমি রয়েছে। বিশেষ করে লালবাগ মৌজার ১/১ খতিয়ানে ২০০১ নম্বর এসএ দাগে বিপুল পরিমাণ খাসজমি বিদ্যমান। কিন্তু ওই দাগের জমির সীমানা চিহ্নিত করা নেই। ফলে বায়নাসূত্রে মালিকদের ভরাট করা অংশ খাসজমি কি না, তা চিহ্নিত করার জন্য চিঠির মাধ্যমে তহশিলদার আলমাস হোসেন খান ভূমি সহকারী কমিশনারের অফিসকে জানান। এরপর ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেল অফিসের সার্ভেয়ার দিয়ে খাসজমি নির্ণয়ের জন্য মাপজোখ শুরু করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বায়নাসূত্রে ওই জমির মালিক এবং লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, ওই জমির প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে সঠিক কাগজপত্র দেখেই বায়না করা হয়েছে। এখানে সরকারি খাস কিংবা অধিগ্রহণ করা কোনো জমি ভরাট করা হয়নি। তনাই মোল্লার নাম সাইনবোর্ডে সংযুক্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে বায়না দলিলে তনাই মোল্লার স্ত্রীর নাম রয়েছে। তিনি মহিলা হওয়ায় স্ত্রীর পরিবর্তে স্বামী তনাই মোল্লার নাম দেওয়া হয়েছে। অপর বায়না দলিলগ্রহীতা হাজি সিরাজুল ইসলাম ওরফে রাডো সিরাজ বলেন, ওই জমি বায়না করার ব্যাপারে সব কিছু করেছেন তনাই মোল্লা। তাই জমির সব কিছু তিনিই বলতে পারবেন।
হাজারীবাগ খালের আরেকটি শাখা কোম্পানীগঞ্জঘাট থেকে এনায়েতগঞ্জের ভেতর দিয়ে হাজারীবাগের সাত্তারের ট্যানারি ফ্যাক্টরি পর্যন্ত এসেছে বলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। কিন্তু ওই খালের কোনো অস্তিত্ব স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা সম্ভব হয়নি। তবে অনেক অনুসন্ধানের পর ওই খালের চিহ্ন পাওয়া গেল, যাকে নালা বলাই ভালো। খালের দুই পাশে বড় বড় বহুতল ভবন উঠেছে। স্থায়ী বাসিন্দা হাজি একলাছ উদ্দিন বলেন, পাকিস্তান আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে এনায়েতগঞ্জের খাল দিয়ে ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা ও উত্তরবঙ্গ থেকে নৌকা বোঝাই করে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া আসত। বর্তমানে সেই খালের জায়গায় পাকা রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে।
জেলা প্রশাসন কিংবা স্থানীয় ভূমি অফিস থেকেও ওই খালের বিবরণ জানা সম্ভব হয়নি। ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ঢাকায় যে ৩৬টি খাল তারা ব্যবস্থাপনা করছে, এর মধ্যে হাজারীবাগ কিংবা এনায়েতগঞ্জ খালের কথা নেই। তবে লালবাগ তহশিল অফিসের ২৮ নম্বর আরএস রেকর্ড নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে ১ দশমিক ৫৩৮৪ একর জমি রয়েছে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। ওই জমিতেই একসময় খাল ছিল বলে স্থানীয় বর্ষীয়ান ব্যক্তি হোসেন আলী মাতবর জানান।
হোসেন আলী আরো বলেন, খালের আরো অনেক জমি থাকলেও পর্যায়ক্রমে তা ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। এর পরই খাল দখল করে সেখানে বাড়িঘর এবং কলকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে এলাকায় জমে থাকা বিষাক্ত তরল বর্জ্যে অনেকে নানা অসুখে ভুগছে। হাজারীবাগের স্থানীয় চিকিৎসক ডা. আবদুল কাদের বলেন, এসব বর্জ্য ঠিকমতো অপসারণ হয় না বলে এলাকার অনেকে শ্বাসকষ্ট, শরীর চুলকানি, নাসিকা প্রদাহ, চোখের রোগসহ আরো অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী জঙ্গলবাড়ী মৌজার ২৯৮৭ ও ২৯৮৬ নম্বর আরএস দাগে সরকারের আরো প্রায় ৩০ একর খাসজমি থাকলেও তা বিভিন্ন লোকের দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ ঘাটের পাশে খাল ভরাট করে প্রায় দুই একর জমিতে ম্যাটাডোর কলম এবং ভলভো ব্যাটারি ফ্যাক্টরির স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে হাজারীবাগ খালের সংযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ ঘাটের ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, এলাকার প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশেই এসব দখলের ঘটনা ঘটছে। তবে ফ্যাক্টরির কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে খালের জমি লিজ নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
সরকারি খাল এবং খাসজমি দখল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, হাজারীবাগ খালের সরকারি খাসজমি দখলের বিষয়টি অনেক পুরনো। ধীরে ধীরে খাসজমি দখল করে নিয়েছে কিছু প্রভাবশালী মহল। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন খালের সার্ভে করে বেদখল হয়ে যাওয়া জমি কিভাবে উদ্ধার করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। খালের জায়গা চিহ্নিত হলেই তা উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হবে।

No comments:

Post a Comment