Saturday, March 12, 2011

সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তিনি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ইতিহাসে প্রথম নারী বিচারপতি হলেন। হাইকোর্টেও অবশ্য তিনিই প্রথম নারী। আজকের এই অবস্থানে আসতে তাঁকে পার করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি। তবে সবকিছু জয় করে তিনি এখন দেশের ও বিচার বিভাগের ইতিহাসের অংশ।
মেয়েরা আবার ‘উকিল’ হয় নাকি!
নাজমুন আরা সুলতানার কর্মজীবনের শুরু আইনজীবী হিসেবে। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ময়মনসিংহ জেলা আদালতে। তখন লোকে বলত, মেয়েরা আবার ‘উকিল’ হয় নাকি! এই মেয়ে কী ওকালতি করবে? লোকের এসব ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর তাচ্ছিল্য পাশ কাটিয়ে তিনি সামনে এগিয়েছেন।
বেড়ে ওঠার গল্প
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারের আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন ও রশীদা সুলতানা দম্পতির ঘরে জন্ম নেন নাজমুন আরা সুলতানা। তাঁরা তিন বোন ও দুই ভাই। বাকি চার ভাইবোনের সঙ্গে শৈশব-কৈশোরের সময়টা কেটেছে ময়মনসিংহে। এই শহরের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন; ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
মায়ের উৎসাহে বাবার স্বপ্নপূরণ
মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবাকে হারান নাজমুন আরা সুলতানা। তবে তিনি তাঁর বাবার স্বপ্নকে হারাতে চাননি। বাবার ইচ্ছা ছিল, তাঁর সন্তানদের কেউ একজন আইনজীবী হবে। বাবার স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসেন তিনি। বিএসসি পাসের পর তিনি মোমেনশাহী ল কলেজে ভর্তি হন। তবে ওই সময় ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। আইন কলেজে রাতে ক্লাস করতে হতো। রাতের বেলা একজন অবিবাহিত মেয়ে ক্লাস করতে যাবে—এটা আশপাশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এ সময় পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর মা রশীদা সুলতানা। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের রাধাসুন্দরী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা। প্রতিকূলতা জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে মেয়েকে উৎসাহ আর সমর্থন দেন তিনি। বাবার স্বপ্ন আর সেই স্বপ্ন পূরণে মায়ের সমর্থন পেয়ে ১৯৭২ সালে তিনি এলএলবি পাস করেন।
বিচারক হতে বাধা
আইনজীবী হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ তো হলো! এবার নিজের স্বপ্নের পাখাটা মেলে ধরার ইচ্ছে জাগল মনে। স্বপ্ন—এবার তিনি বিচারক হবেন। কিন্তু আবার বাধা। আর এই বাধাটা তৈরি করে রেখেছিল রাষ্ট্র নিজেই। রাষ্ট্রের কাছে মনে হয়েছে, নারী বিচারক হওয়ার যোগ্য নয়। এই পদটা নারীর জন্য নয়। তবে ১৯৭৪ সালে এই অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। স্বপ্নপূরণের পথটা সুগম হয় নাজমুন আরা সুলতানার জন্য। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরের বছর ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি মুনসেফ হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন।
ভিড় ঠেকাতে পুলিশ ফোর্স
বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারক হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানা যখন খুলনায় দায়িত্ব পালন করতে যান, তখন মুখোমুখি হন এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার। আশপাশের লোকজন দল বেঁধে তাঁকে দেখত আসত। সেই ভিড় সামাল দিতে প্রথম দিকে মাঝেমধ্যে পুলিশ ফোর্সও রাখা হতো।
নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে
মুনসেফ হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানা খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে সাবজজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরে পাঁচ বছর কাজ করেন। কয়েক দফা পদোন্নতির পর ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজ হিসেবে যোগ দেন। কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম। ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন তিনি। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন।
ফতোয়া অবৈধ
হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানা অনেক রায় দিয়েছেন। তবে ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় অনেক বেশি আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিল। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে রায় দেন।
এ ছাড়া গত বছরের ১৩ অক্টোবর বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি নিয়ে রায়, জোট আমলে বাদ পড়া ১০ জন বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই দেওয়া রায় আছে তাঁর দেওয়া উল্লেখযোগ্য রায়ের তালিকায়।
কাজের স্বীকৃতি, নারীর ক্ষমতায়ন
আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনুভূতি অনেক ভালো। আমি আমার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছি। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম। হাইকোর্টেও প্রথম বিচারপতি হিসেবে এসেছিলাম। এবারও আপিল বিভাগে প্রথম বিচারপতি হিসেবে এলাম।’ তিনি মনে করেন, তাঁর এই নিয়োগ দেশে নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখবে।
স্বামী-সন্তানের অকুণ্ঠ সমর্থন
বিয়ের আগে মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণা। বিয়ের পরে সেই দলে নাম লেখান নাজমুন আরা সুলতানার স্বামী কাজী নুরুল হক। স্ত্রীর বদলির চাকরি। এক বছর এই জেলায় তো পরের বছর অন্য জেলায়। কিন্তু এতে বিরক্ত হননি কাজী নুরুল হক, স্ত্রীকে ফেলেননি চাকরি বনাম সংসারের দ্বন্দ্বে, বরং স্ত্রীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। একসময় এই দম্পতির ঘর আলো করে আসে দুই ছেলে উপল ও সূর্য। তাদের পড়াশোনা, দেখভাল করা—এর বেশির ভাগটাই সামাল দিয়েছেন কাজী নুরুল হক। ছেলেরাও বড় হতে হতে বুঝেছেন তাঁদের মায়ের কাজের ধরন আর সম্মানের বিষয়টি। তারাও কখনো এটা-সেটা নিয়ে অন্যায় আবদার করেননি। স্ত্রীর এই অর্জনে স্বভাবতই অনেক খুশি ও গর্বিত কাজী নুরুল হক। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের সচিব পদ থেকে অবসরে গেছেন। দুই ছেলেই প্রকৌশলী হয়েছেন। বড় ছেলে কাজী সানাউল হক উপল অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ছোট ছেলে কাজী এহসানুল হক সূর্য দেশেই কাজ করছেন।
প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা আর সাহসিকতা
‘অল্প কথায় বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সম্পর্কে বলা মুশকিল। তিনি অসম্ভব প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী ও সাহসী। তাঁর এই গুণগুলোই তাঁকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।’ বলছিলেন বাংলাদেশ মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শারমিন নিগার। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ছিলেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সংগঠনটি গড়ে তোলার সময়কার কথা স্মরণ করে শারমিন নিগার বলেন, ওই সময় নারী বিচারকদের নিয়ে আলাদা একটি সংগঠন গড়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। পদে পদে বাধা এসেছে। কিন্তু অসম্ভব দৃঢ়তা, সাহস ও ধৈর্য নিয়ে সেসব বাধা পার করেছেন তিনি। এ ছাড়া বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা আন্তর্জাতিক মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম ডাইরেক্টর।