Sunday, February 06, 2011

মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' by হালিমা খাতুন

মার জন্ম ১৯৩৩ সালে তৎকালীন খুলনা জেলার বাগেরহাটের বাদেকাড়া পাড়ায়। বাবা মৌলভি আবদুর রহিম ছিলেন কূপমণ্ডূকতা-বিরোধী মানুষ। এ জন্য তাঁকে একঘরে করে রাখা হয়েছিল। এমন সব বৈরিতার ভেতরেই গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলজীবন থেকেই আমার মনে এক ধরনের স্বাধিকার বোধ কাজ করত।
কলেজে গিয়ে শিক্ষকদের আদর্শে আরো অনুপ্রাণিত হই। খুলনার বাগেরহাট কলেজে পড়াকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানতে পারি। সিদ্ধান্ত নিই ভাষা আন্দোলনে একাÍ হওয়ার। এরপর ১৯৫১ সালে ২১ বছর বয়েসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই।
তখন ‘উইম্যান স্টুডেন্ট রেসিডেন্টস’ (ডাব্লিওএসআর) হলে থাকতাম। বর্তমান রোকেয়া হল। পুরো হলে আমরা মাত্র ৩০ জন ছাত্রী। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই মেয়ের সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫০ জন। ভাষা আন্দোলনে প্রথম সুফিয়া খান, রোকেয়া খাতুন এবং বন্ধু আবদুর রাজ্জাকের হাত ধরে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হই। আমি ক্লাস করে বেরুচ্ছিলাম। রাজ্জাক জানাল, আমাদের এখন ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেইন’ করা দরকার। অর্থাৎ কানে কানে সবাইকে জানাতে হবে, ‘ভাষা আন্দোলনে শামিল হও’। রাজ্জাক পরে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত হয়েছিল।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কালা-কানুন। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কথা বলা মানা। আমরা মেয়েরা কমনরুমে বসে থাকতাম। টিচাররা এসে আমাদের ক্লাসে নিয়ে যেতেন। আমরা সামনের বেঞ্চে বসতাম। ক্লাস শেষে আবার পৌঁছে দিতেন। হলে কিংবা ডিপার্টমেন্টে কারো সঙ্গে কথা বলতে হলে প্রক্টরের অনুমতি নিতে হতো। তা সত্ত্বেও আমরা রাজনীতি করতাম। স্থানীয় অভিভাবকের চিঠি নিয়ে রাতে কমিউনিস্ট পার্টির ক্লাস করতাম। মেয়ে হিসেবে এসব কাজ করতাম বলে স্থানীয় লোকজন টিটকারি করত। অসহিষ্ণুতা দেখাত। এসব বিষয়কে পাত্তা দিতাম না। পরে তীব্র আন্দোলনের পর ওই লোকগুলোই উল্টো আপ্যায়ন করিয়েছ। অনেকে আন্দোলনেও যোগ দিয়েছে।
২১ ফেব্রুয়ারির দিনের কথা বলি। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ১৯৫২ সাল। আমরা সবাই আমতলায় সমবেত হই। আমার ওপর ভার ছিল বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ও মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে আসার। ওই দুই স্কুলের বেশকিছু ছাত্রীকে আমি সংগঠিত করে সভায় নিয়ে আসি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের পক্ষ থেকে এসেছিল মিটফোর্ড কলেজের ছাত্রীরা। সভা শুরু হলো। গাজী ভাই (অ্যাডভোকেট গাজীউল হক) সভাপতি। প্রথমে কেউ কেউ ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বক্তব্য দেন। এর পরপরই প্রচণ্ড প্রতিবাদ হয়। স্লোগান ওঠে, ১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে। স্লোগানে স্লোগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। চূড়ান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভাঙার। সিদ্ধান্ত হয় মেয়েরা আগে বের হবে। চারজনের প্রথম দলটিতে ছিলাম আমি, জুলেখা (পুতুল), নূরী ও সেতারা। পরে আরো চারজনের একটি দল। তৃতীয় দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ড. শাফিয়া খাতুন। আমরা প্রথমেই বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে বের হয়ে এগোতে থাকি। পুলিশ সম্ভবত ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে তারা। নির্দেশ পেয়ে আমাদের পরের দুটি দলকেই আটক করে। পরে অবশ্য ছেড়ে দেয়। তারপর শুরু হয় স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তারবরণের পালা। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ছেলেমেয়েদের দল গেট থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। এদিকে শুরু হয় পুলিশের অবিরাম লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস। চারদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা সব এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল অ্যাসেম্বলিতে যাওয়া। বর্তমান জগন্নাথ হল ছিল তখন অ্যাসেম্বলি ভবন। তখন পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হলে আমরা মেডিক্যাল কলেজের ভেতর ঢুকে পড়ি। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। স্ট্রেচারে করে আহতদের নিয়ে আসা হচ্ছে মেডিক্যালে। সে কী গগণবিদারি আর্তনাদ! পরে শুনেছি অনেক লাশ পুলিশ নিয়ে গেছে। গোলাগুলি বন্ধ হলে আমরা বাইরে বের হই।
বর্তমান শহীদ মিনারের স্থানটি তখন রক্তে ভাসছিল। একসঙ্গে এত রক্ত কখনো দেখিনি। ছড়িয়ে রয়েছে রক্তে ভেজা জামাকাপড়। একজনের মাথার খুলি উড়ে যায়। থোকা থোকা মাথার মগজ সমস্ত রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। ছাত্ররা ব্লকে ওই মাথার খুলির ছবি ধারণ করে। ছবিটি রাখা হয় এসএম হলে শাহ এম এস কিবরিয়ার রুমে (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী)। কিবরিয়া ছিল আমার ক্লাসফ্রেন্ড। এ ঘটনায় আর্মিরা হল ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়। প্রভোস্টের ঘরের সঙ্গেই ছিল কিবরিয়ার রুম। পেছন দিকে বের হওয়া যেত। কিবরিয়ারা পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় ভেতর দিয়ে দরজা আটকে রাখে। আমার দায়িত্ব ছিল তার ঘর থেকে ওই ব্লকের ছবিটা নিয়ে আসার। প্রভোস্টের সঙ্গে আমার জানাশোনা থাকায় প্রভোস্টের বাড়ির ভেতর দিয়ে পেছন থেকে গোপনে আমি এবং রাবেয়া বেগম কিবরিয়ার রুম থেকে ওই ছবিটা বুকের ভেতর করে নিয়ে আসি মিলিটারির সামনে দিয়ে। সেদিন ধরা পড়লে হয়তো ইতিহাস অন্য রকম হতো। সেদিনের সেই ছবিটা এখনো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখা যায়।
একুশের যে অর্জন, তা খাতা-কলমে হয়েছে। বাংলা ভাষার উন্নয়ন, ভাষার সত্যিকারের লালন হচ্ছে না। শিক্ষার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, প্রতিশ্রুতি ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ সত্যিকারের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেজন্য ভাষা শিক্ষা এবং মানবিক শিক্ষা কোনোটিই হচ্ছে না। এসব ব্যাহত হচ্ছে বলে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত পেয়েছেÑএটা আমাদের পরম গৌরবের কথা। কিন্তু যে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এ গৌরব কত দিন ধরে রাখতে পারব তা নিয়ে শঙ্কা হয়। সেজন্য সবার কাছে অনুরোধÑভাষা, শিক্ষা, মানবতাকে বাঁচানোর জন্য আসুন সংগ্রাম করে যাই। একুশের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের এখনো সংগ্রাম করে যেতে হবে। নিজের ভাষাকে শিখতে হবে। সম্মান করতে হবে। পরিচর্যা করতে হবে। ইদানীং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দোকানপাটের নামও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। কেন? বাংলা শব্দের কি আকাল পড়েছে? অন্য ভাষা জাতি শিখবে। কিন্তু তা হবে নিজের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে। ভাষা তো অস্তিত্বেরই অংশ।
সে সময়ের বেশ কিছু মজার স্মৃতিকথাও মনে পড়ছে। আমি সব সময় সাদা শাড়ি পরতাম এবং সিম্পল থাকতাম। তখন আমার নাম হয়ে যায় ‘হিন্দু বিধবা’। হলে একটিমাত্র মেয়ে বোরকা পরত। আমরা তার নাম দিয়েছি ‘বোরকা শামসুন’ নাহার। তার বাবা স্পিকার ছিলেন। সে সময় আমরা বেশ চাঁদা তুলতাম। বেইলী রোড এলাকা থেকে শুরু করে সব বাড়িতে যেতাম। আমাদের নেত্রী ছিলেন মুনীর চৌধুরীর বোন নাদেরা বেগম। সে সময় আজকের মতো এত বড় রাস্তাঘাট ছিল না, এত কোলাহল ছিল না। গাছপালা ছিল প্রচুর। নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির উল্টোদিকে ধানক্ষেত দেখেছি। ওই সব স্মৃতি বেশ মনে পড়ে।
স্বাধীনতার এত দিন পরে এসে একটি বিষয়ে বেশ কষ্ট পাই। আমাদের মূল্যায়ন হয়নি। ১৯৬১ সাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। যদিও মূল্যায়নের জন্য সংগ্রাম করিনি। আমি শিক্ষক পদাতিক সৈনিক। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি বলেই কথাটা বলা। এখন খাদ্যবস্তুর চেয়ে ওষুধ খেতে হয় বেশি। এ দায়িত্বটি অন্তত সরকারের নেওয়া উচিত।
অনুলিখন: শরীফা বুলবুল

লাগামছাড়া অপরাধ গাছাড়া প্রশাসন

বেশ কিছুদিন হলো দেশজুড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। অপরাধীদের বেপরোয়া বিচরণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনমনে। কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চবাচ্য ও মরিয়া চেষ্টা-সবই বিফলে যাচ্ছে। উপরন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে গাছাড়া ভাব দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও প্রকট।

অপরাধ-আতঙ্ককে সম্প্রতি আরো ভয়াবহ করে তুলেছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থীদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধে হানাহানির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়েও অস্ত্রধারীরা চালিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। এরই মধ্যে সংঘটিত লোমহর্ষক কয়েকটি হত্যা, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর পাশাপাশি পারিবারিক খুন-খারাবি যোগ করেছে আতঙ্কের আরেক মাত্রা। শুধু রাজধানীতেই গত এক মাসে ঘটেছে এক ডজন চাঞ্চল্যকর অপরাধ। পুলিশের গোয়েন্দা শাখাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলমান বাস্তবতা আর গোয়েন্দাদের গোপনীয় প্রতিবেদনে যা-ই বলা হোক না কেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরাধ নির্মূলে সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাঁদের এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষকে খুব বেশি আশ্বস্ত করতে পারছে না। অনেকেরই ভাষ্য, অপরাধের মাত্রা আর ধরন কোন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে, সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে। সরকারের প্রথম বছরে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রের মহড়া, অপরাধীদের প্রকাশ্য তৎপরতা, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা চাঞ্চল্যকর অপরাধ প্রশ্নবিদ্ধ করছে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়, র‌্যাব-পুলিশের বিরোধ ও সমন্বয়হীনতায় কর্মকাণ্ডে শিথিলতা, চাঞ্চল্যকর অপরাধ ও মামলার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবসহ নানা ঘটনা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়ক হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গতকাল শনিবারও সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, বেশির ভাগ অপরাধ হচ্ছে ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে। এর বাইরে যা কিছু ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা সুন্দরভাবে সামাল দিচ্ছে। সম্প্রতি সংঘটিত নানা অপরাধের আসামিদের দ্রুত সময়ে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুরেই কালের কণ্ঠকে গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, খুন, ডাকাতির কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। যা ঘটছে এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত বিরোধের সূত্র ধরে। তাই সামাজিকভাবে এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে অপরাধ কমার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও কাজের চাপ কমে আসবে।
পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেছেন, ক্রসফায়ার ও গুপ্তহত্যা নিয়ে ধারাবাহিক সমালোচনার মুখে র‌্যাব এখন অনেকটাই সতর্কভাবে এবং ধীরে কাজ করছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যাশিত পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা না বাড়ায় পুলিশ বিভাগের অনেকের মধ্যেই এখন কর্ম-অনীহা স্পষ্ট। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে যথেষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিংয়ে বিশেষ এলাকার প্রাধান্য কোণঠাসা করে রেখেছে অনেক কর্মকর্তাকে। আবার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সাহস দেওয়া হলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবে পড়ে অনেক সময় অপরাধমূলক ঘটনায় সমঝোতার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো মনিটরিং করার কথা থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়ায় তদন্তকারীরাও দায়সারা জবাব নিয়ে হাজির হচ্ছেন ঊর্ধ্বতনদের কাছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় বড় মামলা থেকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত আসামিদের ছাড় দেওয়ার ঘটনাও পুলিশকে তাদের কাজ থেকে পিছপা করছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই এক ধরনের শৈথিল্যভাব অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলছে বলে অনেকের মত।
কিন্তু র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল সমন্বয়হীনতা ও কর্মশিথিলতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, নিয়মিত টহল ছাড়াও র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা প্রতিরোধেও কাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই তারা কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় র‌্যাব কার্যকর ভূমিকা রাখছে। জঙ্গি দমন ও চরমপন্থীবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি র‌্যাব অন্যান্য অপরাধী গ্রেপ্তারেও সফলতা পেয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন এবং একুশের বইমেলা নিয়ে রাজধানীতে পুলিশ বাহিনী ব্যতিব্যস্ত। এরই মধ্যে ঘটে চলেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অপরাধ। গত এক মাসে রাজধানীতেই খুন হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে তিনটি জোড়া খুন; যদিও ১৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ব্যক্তিগত কারণ বা বিরোধের জের ধরে, রাজনৈতিক কারণেও ঘটেছে দুটি। ডাকাতির ঘটনায় নিহত হয়েছে দুজন এবং ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মারা গেছে একজন। অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণ এবং অপরাধী শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
অনেকেই মনে করছে, অপরাধমূলক নানা ঘটনাকে পুলিশ ব্যক্তিপর্যায়ের বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধেও পুলিশের দায়সারা মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থির হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধন অনেক দুর্বল হয়ে পড়ছে বলেই খুনসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। মানসিক অস্থিরতা থেকে সামন্য কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এটি অপরাধের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়কেও প্রকাশ করে। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘পারিবারিক ও সামাজিক কারণে অনেকে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। চরম মানসিক অস্থিরতা থেকে এ ধরনের অপরাধের সৃষ্টি। ঘটনার সময় হত্যাকারীর চেতনাবোধ লোপ পায়। মানুষের জন্য তাদের মনে ভালোবাসা থাকে না।’
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান সাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধের কাজে জড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ বা ভালো মনে করলে অপরাধী ওই অপরাধ বারবার করে। অপরাধ-সহায়ক পরিবেশে মানসিক বিকাশ অল্প বয়সেই অপরাধপ্রবণতা তৈরি করতে পারে। বর্তমানে যুবসমাজের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা বেশি। অস্থিরতার কারণে হত্যাকে কেউ বড় অপরাধ বলে ভাবতে পারে না। তাই সামান্য কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে অপরাধের কৌশল পাল্টায়। তবে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করা সম্ভব।’

দল গোছাচ্ছে আ. লীগ, গুরুত্ব পাচ্ছে তৃণমূল

সারা দেশে অনুষ্ঠিত পৌর ও দুই উপনির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় দল গোছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। অভ্যন্তরীণ দলাদলি, কোন্দল, মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে দূরত্ব, সুবিধাবাদীদের আধিপত্যসহ বিশৃঙ্খল অবস্থা দূর করতে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সুপারিশ করবেন দলের সাত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক।

দলগত ব্যর্থতা উত্তরণে দলের তৃণমূলের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তা নিরসনের উপায়সংবলিত সুপারিশমালা দলীয় প্রধানের হাতে তুলে দেবেন তাঁরা। গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন এসব কথা জানান। দলীয় অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশ ঘুরে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা তৃণমূলের চরম বিশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ করে তা পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রতিবেদনে বিরাজমান সাংগঠনিক অগোছালো অবস্থা কিভাবে নিরসন করা যায় এবং সারা দেশে অনুষ্ঠেয় পৌর ও দুই উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা কাক্সিক্ষত ফল অর্জনে কেন ব্যর্থ হয়েছেন তা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা আগামী ১২ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠেয় দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তুলে ধরা হবে।
প্রতিবেদনে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের সৃষ্ট দূরত্ব, শিগগিরই সম্মেলন অনুষ্ঠান ও নতুন নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব দেওয়া, নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত করে রাখা, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার প্রবণতা এবং সুবিধাবাদীদের আধিপত্য রোধ করতে কেন্দ্র থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ থাকছে। সাংগঠনিক সম্পাদকদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলেই তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আর সাংগঠনিক অবস্থা এমন নাজুক থাকলে ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরো বেশি ভয়াবহতা আসতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা মনে করেন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের দূরত্ব, দলাদলি, দীর্ঘদিন জেলাগুলোতে সম্মেলন না হওয়া, রাজনীতিকে পুঁজি করে একটি অংশের বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টা, নব্য ও সুবিধাবাদীদের আধিপত্য আর এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তদারকি না থাকার কারণে তৃণমূলের রাজনীতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার ওপর সম্মেলন না হওয়ায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। তাই সাংগঠনিক কাজের গতি মন্থর হয়ে গেছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে এবারের নির্বাচনগুলোতে।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সংগঠন ভালোভাবে গোছানো গেলে যেকোনো নির্বাচন আমরা মোকাবিলা করতে পারব। তৃণমূলে আমাদের সমর্থনের অভাব নেই। তা সক্রিয় করতে নেতৃত্ব সংকট রয়েছে।’
স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিদের দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব আছে জানিয়ে জাফর উল্যাহ বলেন, তা কমাতে হবে। সম্মেলন করে সঠিক নেতৃত্বের হাতে দলীয় কর্মকাণ্ডের ভার ছেড়ে দিতে হবে। তৃণমূল সফরে গিয়ে দেখা গেছে, তারা ‘ইয়াং লিডারশিপ’ চায়। সাত সাংগঠনিক সম্পাদকের যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, সবাই কাজ করছে। তবে কারো কারো যোগ্যতার অভাব রয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘তৃণমূলে কিছু বিশৃঙ্খলা আছে। তা দ্রুত নিরসনে আগামী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রস্তাব করা হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে পর্যালোচনামূলক একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এর আলোকে সব ধরনের বিশৃঙ্খলা নিরসনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহমদ হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল, নেতা-কর্মী বেশি। পদ নিয়ে বিভিন্ন রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তা ছাড়া দীর্ঘদিন সম্মেলন হয় না। তিনি বলেন, ‘কিছু সমস্যা থাকলেও আমরা তা মিটিয়ে ফেলতে পারব।’
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের ৭৩ সাংগঠনিক জেলার ১১টিতে সম্মেলন হয় না ১৮ বছর। বাকি ৬২ জেলার কোনো কোনোটির মেয়াদ পেরিয়ে চার-পাঁচ বছর হয়েছে। তাই কোনো জেলাতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালসহ ছয়টি মহানগর কমিটিরও মেয়াদ পেরিয়ে চার-পাঁচ বছর হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা, বরিশাল ও সিলেট মহানগর কমিটি চলছে ভারপ্রাপ্তদের নেতৃত্বে। মহানগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোথাও সভাপতি, কোথাও সাধারণ সম্পাদক আবার কোথাও আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। তাদের কেউ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তেমন সক্রিয় নেই বলে জানান কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা। এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর নিয়ে চলছে নতুন করে বিশৃঙ্খলা। পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার।
কার্যনির্বাহী সংসদের সভা : আগামী ১২ ফেব্র“য়ারি শনিবার বিকেল ৪টায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হবে। তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠেয় জরুরি এ সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কমিটির সব সদস্যকে উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সূত্র মতে, সম্প্রতি শেষ হওয়া পৌরসভা ও দুই উপনির্বাচনে দলের সাফল্য-ব্যর্থতা প্রসঙ্গে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। সরকারের কর্মকাণ্ডের এবং তৃণমূলের রাজনীতিকে চাঙ্গা করার বিষয়ে পর্যালোচনা ও কৌশল নির্ধারণ করা হবে।

গামাল মুবারকসহ ক্ষমতাসীন দলের পলিটব্যুরোর পদত্যাগ

মিসরে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেছেন। দেশটিতে টানা ১২ দিন ধরে মুবারকবিরোধী অব্যাহত গণবিক্ষোভ এবং প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের প্রেক্ষাপটে গতকাল রাতে তাঁদের বেশির ভাগই একযোগে সরে দাঁড়ান।

মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, পদত্যাগীদের মধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ছেলে গামাল মুবারকও রয়েছেন। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত হোসাম বিকে দলের জেনারেল সেক্রেটারি ও রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান করা হয়েছে। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত ফ্রাংক উহসনার বলেছেন, রাজনৈতিক পালাবদলের এই সময়ে মুবারকের ক্ষমতায় থাকা উচিত।
এদিকে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে গতকালও রাজধানী কায়রোর কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ারে সমাবেশ হয়েছে। গত শুক্রবারের সমাবেশে কয়েক লাখ মিসরীয় অংশ নিলেও মুবারক নিজ মুখে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেওয়ায় বিক্ষোভকারীদের অনেকে গতকাল বাড়ি ফিরে গেছে। তবে তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীরা সারা দিন শান্ত থাকলেও রাতে ক্ষমতাসীন দলটির পলিটব্যুরোর বেশির ভাগ নেতা পদত্যাগ করায় তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। গত রাতে তারা মুবারকের পতনের দাবিতে আবারও সোচ্চার হয়।
এদিকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অব্যাহত রয়েছে। নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান ও শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা হোসনি মুবারকের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণের জন্য বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তাঁরা হোসনি মুবারককে কিভাবে সম্মানজনক উপায়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে বিদায় দেওয়া যায়, এর সম্ভাব্য উপায়ের খোঁজ করছেন। অন্যদিকে একটি অসমর্থিত খবরে জানা গেছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানকে গতকাল হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি।
মিসরের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম মেনা জানিয়েছে, গতকাল প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক তাঁর নবনিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তবে সেখানে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে গত কয়েক দিনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিসরের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে প্রেসিডেন্ট মুবারক গতকাল আবার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে ইঙ্গিত করে গতকাল বলেছেন, 'দেশপ্রেমিক' নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, তাঁর দেশের জনগণ কী চায়। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন, আশা করি। তবে ওবামা যা-ই বলুন, তাঁর প্রশাসনের বাতলে দেওয়া 'অর্ডারলি ট্রানজিশন'-এর ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন মিসরের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক। মিসর এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে ফিরে যাচ্ছে উল্লেখ করে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট মুবারক ইতিমধ্যে আগামী সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আমাদের উচিত প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য তাঁকে আগামী ৯ মাস সময় দেওয়া।' পরে তিনি আল আরাবিয়া টিভিকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন। আবার ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে মুবারককে চলেও যেতে বলছেন তিনি। যদি বিষয়টি নিয়মতান্ত্রিকভাবে করতে হয়, তাহলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সংবিধানের দিকে এবং সেখানে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থেই মুবারককে আরো কিছুদিন সময় দিতে হবে, যাতে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করতে পারেন। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।' বিষয়টিকে মিসরের নতুন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সুস্পষ্ট দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত বলেই মনে হচ্ছে।
মিসরের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানকে গতকাল হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। সুলাইমান অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও তাঁর দুই দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন। ফঙ্ নিউজের বরাত দিয়ে এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
গতকাল রাজধানী কায়রোর কেন্দ্রস্থলে বিক্ষোভকারীরা মুবারকবিরোধী সমাবেশ অব্যাহত রাখলেও গত শুক্রবারের তুলনায় তাদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। এখনো সেনাবাহিনী তাহরির স্কয়ারের সামনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে। তবে গতকাল কোনো গোলযোগ হয়নি। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও পাহারা দিচ্ছে।
সম্মিলিত বিরোধী মোর্চার ডাকে গত শুক্রবার মুবারক পতন দিবসের কর্মসূচিতে লাখ লাখ লোক অংশ নেয়।
এদিকে গত এক সপ্তাহে মিসরের গণ-অভ্যুত্থানের সংবাদ কাভার করতে আসা ১০১ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে 'কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট' (সিপিজে)।
হোয়াইট হাউস মিসরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ইরানকে সতর্ক করে দিয়েছে। হোয়াইট হাউস বলেছে, যে দেশটি ২০০৯ সালের জুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পড়েছিল, তাদের এ বিষয়ে বড় গলায় কোনো কথা বলা বা পরামর্শ দেওয়ার নৈতিক ভিত্তি নেই। গত শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবা পড়ার সময় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মিসরের গণ-অভ্যুত্থানকে ইসলামপন্থী নাগরিকদের নবজাগরণ ঘোষণা দিয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের 'চাকর' অভিহিত করেছিলেন।
মিসরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের উত্তরসূরি যিনি-ই হোন না কেন, তাঁকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে অতীতের শান্তিচুক্তি পালন করে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিসরে নতুন সরকার গঠন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ইসরায়েল। তাদের আশঙ্কা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ডানপন্থী কোনো দল ক্ষমতায় এলে ১৯৭৯ সালে সম্পাদিত ইসরায়েল-মিসর শান্তিচুক্তি ভেঙে দেশ দুটি আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে।
সূত্র : বিবিসি, এএফপি, দ্য হিন্দু।