Friday, January 21, 2011

নারী নির্যাতন :২০১১ সালের প্রত্যাশা by মেরীনা চৌধুরী

"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার?"_ এই ফরিয়াদ আজকের নয়, অনেকদিন ধরেই নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে আসছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যে কেবল পণ্য, এ কথা মেনে নিতে সমাজ সচেতন ভদ্রবেশী শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী কিংবা কর্তাব্যক্তিদের কোনও দ্বিধাবোধ হয় না বা লজ্জায় একবারও মাথা নত হয় না।

এটাই কি আধুনিকতার পরিশীলিত রূপ? আজকে এ বিষয়টা প্রায় সকলেই বুঝে গেছেন নারীরা কেবল পুরুষের বিনোদনের যন্ত্র মাত্র। কিন্তু আজ তো একবিংশ শতাব্দী। বিজ্ঞানের যুগ। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ, মানুষ শিক্ষায়-দীক্ষায় রুচি সংস্কারে অনেক এগিয়ে। আজকে নারী বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজে- পর্বতের শীর্ষে, আর আকাশপথে এরোপেস্নন- সর্বত্রই পুরুষের সঙ্গে নারীর সহজ যাওয়া-আসা। এমনকি অফিস-আদালতে পুরুষের পাশাপাশি বসে একই কাজের দায়িত্ব পালন করছে। নারীরা আজ সমাজের হালও ধরছেন। অথচ চূড়ান্ত শীর্ষে পেঁৗছে এবং সভ্যতার এই চরম উন্নতির মুহূর্তেও পরম প্রাপ্তির ঝুলিতে কিন্তু এখনও নারীর নিশ্চিত নিরাপত্তা আসেনি। পুরুষের পাশাপাশি বসে কাজ করলেও রেহাইয়ের প্রশ্নে? সেখানে তাকে অনেক সচেতন হতে হচ্ছে। তারা নিজেকে অসহায় ভাবতে থাকেন। শরীরটাকে একটা শামুকের মতো খোলায় আবদ্ধ করে রাখেন। ভয় কখন কী ঘটে যায়, কিছুই বলা যায় না। এই রকম একটা সময়ে পুরুষের অত্যাচারকে নারীরা কীভাবে মেনে নিচ্ছেন তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। নারী আজ যৌন নিগ্রহ, পারিবারিক নির্যাতন থেকে শুরু করে এমন কোনও নির্যাতন-নিপীড়ন নেই যা তাকে সহ্য করতে হচ্ছে না। এ যুগে দাঁড়িয়েও তো আজকের নারীরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে, তারা প্রকৃত অর্থেই দুর্বল। প্রতিবাদের কোনও ভাষা তাদের মুখে নেই।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্যস্ত ঢাকা শহরে জান্তব গর্জনের পাশাপাশি মধ্যরাতেও শোনা যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার পৈশাচিক উলস্নাস। দিকে-দিকে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার একই ছবির পুনরাবৃত্তি। পুরনো লোহায় রাংতা মোড়ানোর মতো। ট্রেনে-বাসে, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সুযোগসন্ধানী পুরুষের দল নারীকে নানারকম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে যৌন নিপীড়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যুগ চিত্রটাই এই রকম। নারী নিগ্রহ- চিরদিনের, চিরকালের। তা সত্ত্বেও কয়েক দশক আগেও নারীর কিছুটা নিরাপত্তা ছিল। স্কুল-কলেজ থেকে বান্ধবীদের সাথে একা নিরাপদে বাড়িতে ফিরে এসেছে। কিন্তু আজ! জীবন এখন প্রতি মুহূর্তে বিপদসংকুল। আমরা যেন আফ্রিকার গভীর অরণ্যে শ্বাপদসংকুল পরিবেষ্টিত হয়ে বাস করছি। নতুন নির্যাতন ইভটিজিং। সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়। এই তিন অবক্ষয় মিলে আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে আমাদের চারপাশে বহু কিশোরী, তরুণী ও যুবতীর মুখ। যারা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মাহূতি দিয়েছেন। তারা আর কেউ নয় আমাদেরই এক একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ কিংবা প্রতিমূর্তি বলা চলে।

আসলে কিছু সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি ও তার আংশিক রূপায়ণ সত্ত্বেও নারীকে অবহেলিত, অনুন্নত সম্প্রদায় হিসাবে ভাবার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে সমাজের সর্বস্তরেই। নারীর প্রতি এই মনোভাব এবং পারিপাশ্বর্িকতা তাদের নৈতিক অবক্ষয় বা অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, দিচ্ছে। অন্য মেয়ে তো দূরের কথা, নিজের পরিবারের মেয়েদের সম্মান দিতেও অধিকাংশ পুরুষ নারাজ। স্ত্রীকেও তারা দেয় না মানুষের মর্যাদা বা সম্মান। অবশ্য এর পিছনে অভাব, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা সবই কাজ করে। এতো গেল সমাজের সেই স্তরের মানুষের কথা_ যারা দরিদ্র্য, যাদের জীবন অভাব সংগ্রামের সঙ্গে লিপ্ত। কিন্তু সমাজের মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেও এই চিত্র দেখা যায়। নৈতিক মূল্যবোধের অবনতি ঘটে অনেক বিত্তবান পরিবারেও।

যাই করা হোক না কেন সমাজ সচেতন ব্যক্তির সংখ্যা বাড়াতে না পরলে মেয়েদের নিরাপত্তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে না। যৌনতাকে ভোগবাদের উপকরণে পরিণত কার পশ্চিমি ধারণা আজ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীমের দেশেও নারীদের স্থায়ীত্বের সাম্মানিক নিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। যৌন বিকারের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক ভয়াবহ জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত এই সমাজ। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও সেই নির্মম সত্যটা বার বার উঁকি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, সভ্যতা এগোয়নি একফোঁটাও। না হলে আমাদের মত সভ্য দেশে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। কেন নারী বিচার পায় না? অথচ "ন্যায় বিচার" পাওয়া দেশের প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে না এড়িয়ে অপরাধীকে একজন অপরাধী বলে উপলব্ধিতে আনতে হবে। স্বগোষ্ঠী বলে সে যেন কোনভাবেই বেকসুর খালাস না পায়। নারীর জন্য শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ দেশ তথা সমাজ গড়তে নারী-পুরুষ উভয়কে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সেইসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিজেকে মানবিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করাই হোক ২০১১ সালের প্রত্যাশা।

প্রান্তজনের মানবাধিকার স্থানীয় সরকারের ভূমিকা by পারভীন আফরোজা

বাংলাদেশে বসবাসরত বেশীর ভাগ মানুষের জীবনে স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে বিভিন্নভাবে এই স্থানীয় সরকার ভূমিকা রাখতে পারে। নিজ নিজ এলাকায় মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, কাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এই স্থানীয় সরকারের কাজ করে থাকে।

যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রতি সরকার প্রদত্ত কিছু দায়িত্বভার রয়েছে। তবে সেই সকল দায়িত্ব পালনে স্থানীয় সরকারের দক্ষতা কতটুকু এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। আমি বলতে চাই না যে তারা কোন কাজ জানে না। অবশ্যই তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের সাধ্যমত দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে জনতার কল্যাণে তারা অবশ্যই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে থাকেন। তবে কথা হলো হাল হাতিয়ার ছাড়া একজন মানুষ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনতে পারে সেটা একবার ভেবে দেখুন। এদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ লোক গ্রামে বাস করে যাদের জন্য কাজ করছেন চেয়ারম্যান এবং মেম্বারা, যারা তৃণমূল মানুষের কল্যাণের জন্য দায়বদ্ধ। একই সাথে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বাস শহরে যেখানে জনপ্রতিনিধি হলেন কমিশনারবৃন্দ। একই ভাবে সমগ্র মানুষের কল্যাণের জন্য কয়েকজন প্রতিনিধির পক্ষে কতটুকুই বা কল্যাণ করা সম্ভব। এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগণের সংখ্যাই বেশী এবং এই প্রান্তিক গোষ্ঠী যাদের মধ্যে প্রতিবন্ধী, অসহায়, হতদরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার অগণিত মানুষ রয়েছেন যাদের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে এই স্থানীয় সরকারের কাজ করার কথা। তারা সরকারিভাবে যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে সেটা জনতার কল্যাণের জন্য করলে মনে হয় এ যেন উত্তাল সমুদ্রে একবিন্দু জলসম। বহু ঘটনার সাথে এই জনপ্রতিনিধিদের জড়িত হতে হয়। যেমন নারী ও শিশু নিযর্াতন, জখম, জলাভূমি, ঘরবাড়ি, কৃষি জমি জবর দখল থেকে মুরগী মরা, গরু-ছাগল খোঁয়াড়ে দেয়া পর্যন্ত তাদের শালিস বিচারের আওতায় পড়ে। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, গ্রাম আদালত বা শালিস মীমাংসায় তাদের অনেক বেশী সময় ব্যয় করতে হয়। সেক্ষেত্রে গ্রাম বা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সেই সকল বিচারে অংশগ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাদী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ হলে এবং বিবাদী যদি বিত্তবান হয়ে থাকে তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচার পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ এর জন্য বিত্তশালী ব্যক্তিটি বিভিন্নভাবে নাগরিক পরিসরকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে। এমন কি বিভিন্নভাবে অনেকেই ইলেকশনে অর্থসহ অন্যান্য সহযোগিতা করার টোপ দেখিয়ে বিচার ব্যবস্থায় বৈষম্য ঘটিয়ে থাকে। নিযর্াতিত হবার পরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই বিচার পায় না বরং তারা বঞ্চনার শিকার হয়। সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকরা অনেক ক্ষেত্রেই অসচেতন, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বঞ্চনার স্বীকার হয়ে থাকে। পদে পদে তাদের মানবাধিকার লংঘন হতে থাকে। দেখা যায় বয়স্ক ভাতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবর্তে বিত্তশালীর ঘরে উঠছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সমপ্রতি ইউনিয়ন পরিষদের জন্যে একটা আইন হয়েছে তবে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে অনেকেই দুনর্ীতিবান্ধব বলে থাকেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না। এখনও সময় আছে। জনগণের জন্য ভাল কিছু করার এবং অনেকেই তা করছেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনেক কার্যক্রম রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি যেমন কাবিটা, ভিজিডি, কাবিখা, ভিজিএফ, টিআর চালু আছে। এই সকল কর্মসূচীর মাধ্যমে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বন্টনের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের। এর জন্য রয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও নির্বাহী আদেশ। অথচ এই নীতিমালা ও আদেশকে উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকারের অনেক সদস্যই করছেন স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, দুর্নীতি। প্রকৃত অর্থে সুবিধাসমূহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পেঁৗছাচ্ছে খুবই কম। এতে কেবলমাত্র স্থায়ীয় সরকার প্রতিনিধির দোষ দেয়া যাবে না। এতে জড়িত আছেন অনেক প্রভাবশালী লোক। এর ফলে অসহায়রা চিরজীবন অসহায় রয়েছেন। বিত্তবানের বিত্ত ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। স্থানীয় সম্পদ ও সেবার অধিকার থেকে দরিদ্র জনতা হচ্ছেন বঞ্চিত।

মনের ভেতর থেকে যতদিন পর্যন্ত মানুষকে ভালোবাসার সদিচ্ছা আমাদের মধ্যে জাগ্রত না হবে ততদিন আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না এবং দেশের মানুষের অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের দেশে বাজেট বরাদ্দ, প্রকল্প প্রণয়ন প্রভৃতি কার্যক্রমের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সংশিস্নষ্ট করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সমপ্রতি আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এর পূর্ণ বাস্তবায়ন যেদিন সম্ভব হবে সেদিন সত্যিকারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। স্থানীয় সরকার অনেক ক্ষেত্রেই জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন এবং কেউ কেউ রাখছেনও। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা রোধ, ইভটিজিং রোধ, নারী ও শিশু নিযর্াতন রোধে স্থানীয় সরকারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের দক্ষতা সদিচ্ছা আমাদের দেশে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তাদের তৎপরাতে আমাদের সুবিধাবঞ্চিত জনগণ উন্নয়নের মুখ দেখবেন বলে আশা করি। নিযর্াতিত ও সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার রক্ষার তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। থানা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সাথে গ্রাম আদালত ও সালিশ পরিষদ কার্যকর করত সমন্বয় সাধন করতে হবে। এই সালিশে বা গ্রাম আদালতে যাতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয় এবং কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিবর্গকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কাজের বিস্তারের জন্য পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং জনবল নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের লক্ষ্যে সেবাসমূহের তথ্যকে উন্মুক্ত করে দিলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। বিনা দোষে ভিক্টিমকে চুল কেটে দেয়া, দোররা মারা, হিলস্না বিয়ে, বেত মারা, একঘরে করে দেয়া চলবে না। আসামীকে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় ফেলতে হবে।

সেবাখাতে দুর্ণীতির জরিপ : প্রাসঙ্গিক ভাবনা by আল-আমীন চৌধুরী

দুর্ণীতি ক্যান্সারের মত আমাদের সমাজ দেহকে নি:শব্দে-নীরবে কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে দশকের পর দশক। অসহায় নিরীহদের বেদনার করুণ আর্তি মাঠেঘাটে ও মুখে মুখে শোনা গেলেও এ নিয়ে সমাজে খুব একটা উচ্চবাচ্য নেই। যেন সব গা সওয়া হয়ে গেছে।

কিন্তু পঙ্কিলতায় এ দুনর্ীতির ব্যাপ্তির খবর বা প্রতিবেদন যখন প্রকাশ্যে পেশ করা হয় তখনই কেবল সরকারের ও সমাজের উঁচু মহলে সরগোল ও হৈ-চৈ পড়ে যায়। দশ বছর আগ থেকে যখন ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে পাঁচবার দুনর্ীতিতে সারাবিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল তখনও দেখেছি একই অবস্থা। সরকারপক্ষের নেতারা প্রতিবারই সরোষে রিপোর্টটি ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছিল। একবার (যতদূর মনে পড়ে ২০০৫ সালে) তো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর কর্মকর্তাদের ধমকিয়ে যখন সরকার জানতে পারল টিআইবি শুধুমাত্র তাদের জার্মানীস্থ সদর দপ্তর কর্তৃক প্রণীত প্রতিবেদনটিই প্রকাশ করেছে তখন সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী সুদূর জার্মানীতে পাড়ি জমিয়েছিলেন এহেন প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে। অন্যদিকে বিরোধীদল প্রতিবারই একশ' ভাগ সমর্থন দিয়ে প্রতিবেদনকে প্রশংসা করেছে। পত্রিকান্তরে এ সম্পর্কে একাধিকবার লিখেছিও। তবে বিগত ২৩ ডিসেম্বর টিআইবি সেবাখাতে দুনর্ীতির যে প্রতিবেদন পেশ করেছে তা পূর্বোক্ত প্রতিবেদন প্রেক্ষিত ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে যেমন ভিন্ন তেমনি এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়ার ধরন, বরণ এবং মাত্রাও আলাদা।

১৩টি সেবাখাতে দেশের ছয় হাজার খানা বা পরিবারের উপর জরিপ চালিয়ে দুনর্ীতির এ রিপোর্ট তৈরি হয়েছে টিআইবি'র নিজস্ব উদ্যোগে; ২০০৭ সালের অবস্থার সাথে ২০০৯-১০ সালের তুলনামূলক একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এতে; বিচার ব্যবস্থা ও সরকারি বিভাগের সাথে সাথে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের কার্যক্রমও অন্তভর্ুক্ত হয়েছে জরিপে। প্রতিক্রিয়ার দিক দিয়ে এবার সরকার ও বিরোধীদল প্রায় অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে প্রতিবেদনে দুনর্ীতির শীর্ষে বিচার বিভাগ চলে আসায় সরকারপক্ষ ও বিরোধী আইনজীবীরা একে তথ্যনির্ভর নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু তাই নয়, কুমিলস্না ও চট্টগ্রামে টিআইবি'র তিন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং চট্টগ্রামে তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। সর্বশেষ সুপ্রীম কোর্ট টিআইবি'র প্রতিবেদনের তথ্য উপাত্ত চেয়েছেন। এদিকে জরিপ প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন এবং এটা বিচার বিভাগকে ধ্বংস করার কোন ষড়যন্ত্র কিনা তা তদন্ত করার দাবীও জানিয়েছে তারা। মোট কথা এবারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত প্রবল এবং নির্দ্বিধায় বলা যায় টিআইবি তোপের মুখে পড়েছে।

দুনর্ীতিতে আমরা এখন বিশ্বসেরা না হলেও যে প্রথম কাতারে আছি তা অনস্বীকার্য। সেবাখাতগুলোর পরতে পরতে দুনর্ীতির যে বসতি গড়ে উঠেছে তাও কারো অবিদিত নয়। এ পটভূমিতে সেবাখাতে দুনর্ীতির বিষয়ে সারাদেশের শহর-গ্রামে ছয় হাজার পরিবারের উপর পরিচালিত জরিপের নানান তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রণীত টিআইবি'র প্রতিবেদনটি প্রকৃতপক্ষে সরকারের সর্বোচ্চ মহল, সংশিস্নষ্ট বিভাগসমূহ সরকারের আওতা বহির্ভূত বিভাগ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সকল সচেতন নাগরিকের বিচার-বিশেস্নষণ ও বিবেচনার দাবী রাখে। পরিসংখ্যান পদার্থ বা রসায়নিক তত্ত্বের ন্যায় সম্পূর্ণ নির্ভুল না হতে পারে বা তার পদ্ধতিতে কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে" তবে এ প্রতিবেদনটি আলোচ্য বিষয়টির বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দিয়েছে নি:সন্দেহে। তাই উষ্মা ও ক্ষোভের বশবতর্ী হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সেটিকে প্রত্যাখ্যান না করে সেখানে প্রদত্ত ধারণা সূচক দেখে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংস্কারের মাধ্যমে বিদ্যমান অবস্থার উন্নতি সাধন করাই হবে সকল পক্ষের জন্য সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজ।

বর্ণিত পরিপ্রেক্ষিতেই টিআইবি রিপোর্টটির কয়েকটি খাতে ২০০৭ সালের চেয়ে ২০১০ সালে তুলনা মূলক বা আপেক্ষিকভাবে কি পরিবর্তন তথা উন্নতি-অবনতি হয়েছে তা পর্যালোচনা করা দরকার। ১৩টি সেবাখাতের মধ্যে ২০০৯-১০ সালে বিচার বিভাগে গিয়ে হয়রানি, অনিয়ম, ঘুষ তথা দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৮৮ শতাংশ মানুষ অথচ ২০০৭ সালে হয়েছিল ৪৭ শতাংশ বিচারার্থী অর্থাৎ এখাতে তিন বছর আগের তুলনায় দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণের প্রায় কাছাকাছি। আয়কর ও শুল্ক বিভাগে বেড়েছে দ্বিগুণ। বিদু্যৎখাতে প্রায় ৫০ শতাংশ ও ভূমি প্রশাসনে শতকরা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে একই সময় শিক্ষাখাতে দুর্নীতি কমেছে ৬০ শতাংশেরও বেশি তেমনি কমেছে স্বাস্থ্যখাতে ২৫ শতাংশ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় প্রায় ২০ শতাংশ। তাহলে উপরোক্ত আটটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের মধ্যে তিন বছরের ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে ৪টি তে দুর্নীতির পরিমাণ উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে আবার অন্য ৪টিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণে কমেছে। তাই সংশিস্নষ্ট বিভাগসমূহের ও সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের প্রয়োজন এসব তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশেস্নষণ করে দুনর্ীতির এ হ্রাস-বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা। মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রধান নির্বাহী থেকে সর্বনিম্ন মাঠকর্মীর সততা, দক্ষতার জন্য, ভাল কাজের জন্য পুরস্কার আর খারাপ কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা প্রয়োগ করার কারণে অথবা কর্মপদ্ধতি সহজীকরণের এবং আইন-কানুন ও প্রশাসন ব্যবস্থার ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করে দুর্নীতির সুযোগ কমিয়ে আনার কারণে সংশিস্নষ্ট বিভাগসমূহে দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে, না কি উলেস্নখিত সবক'টি বা কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ উন্নতি অর্জিত হয়েছে তা জানা দরকার। যাতে করে অন্যাখাতেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করে উন্নয়ন সাধন করা যায়। অন্যদিকে দেখতে হবে উপরোক্ত গুণাবলী বা উপযুক্ত ব্যবস্থা বা পদ্ধতির অভাবে বা অনুপস্থিতির কারণে অবস্থার অবনতি হয়েছে কি না। কারণ জানা গেলে সেক্ষেত্রেও দুনর্ীতি হ্রাসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে। এসব কথা বলার অর্থ এ নয় যে, যেসব খাতে দুনর্ীতি কমেছে তা যথেষ্ট। মোটেই তা নয়, ঐসব খাতেও দুনর্ীতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে অনেক দেরি, তবে হ্রাসের প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে বলতে হবে। যাক সে কথা। আগে এ সংজ্ঞা ব্যবহার করে একটি দেশের দুনর্ীতির পরিমাপ করা হতো যে" সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভ করাই হলো দুনর্ীতি। অন্য কথায় দুনর্ীতি শুধু যেন সরকারি খাতেই হয়ে থাকে, বেসরকারি খাতে সংঘটিত হয় না। টিআইবির আলোচ্য রিপোর্ট থেকে দেখা যায় বেসরকারি অর্থ লগ্নীকারী ও এনজিওখাতে জনসাধারণ দুনর্ীতির শিকার হয়ে (অপেক্ষাকৃত কম হারে হলেও) থাকে। তবে বেসরকারি খাতে দুনর্ীতির সবচেয়ে মারাত্মক শিকার হয়ে থাকে বিদেশে চাকরি লাভের জন্য বিদেশগামী সাধারণ মানুষ। নির্ধারিত পরিমাণ থেকে তাদের প্রত্যেককে গড়ে লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করতে হয়।

এবার টিআইবি রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতে হয়। প্রথমেই আসে বিচার ব্যবস্থা বা বিভাগের দুনর্ীতির কথা। এটি ভিত্তিহীন ও গ্রহণযোগ্য নয় বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। স্মর্তব্য যে আইনসভা, প্রশাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ হলো রাষ্ট্রের তিন মৌল ভিত্তি। এর তিনটিই হলো পৃথক ও স্বাধীন। বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শুধুমাত্র প্রশাসন বিভাগই সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই টিআইবির প্রতিবেদনের বিচার বিভাগ সম্পকর্ীয় অংশে সরকারের পক্ষ থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলাকে অনেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর সরকারের প্রছন্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করতে পারে। সরকারি, বেসরকারি আইনজীবীগণ বা জুডিশিয়াল এসোসিয়েশন বিচার বিভাগের সংশিস্নষ্ট বলে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রাসঙ্গিক ও বোধগম্য। অবশ্য জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের যে প্রতিবাদলিপি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের বিচারকরা এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা বিচার বিভাগের অন্তভর্ুক্ত হবেন। সংবিধান অনুযায়ী আদালতের আইনজীবী, মোহরার ও কর্মচারীরা বিচার বিভাগের অন্তভর্ুক্ত নন, অথচ টিআইবির প্রতিবেদনে তাদের অন্তভর্ুক্ত দেখিয়ে দুনর্ীতির সূচক তৈরি করা হয়েছে। একথার সারবার্তা বুঝি ও মানি। কিন্তু সাধারণ জনগণ যখন বিচারের জন্য আদালতে যায় তখন বিচার বিভাগ সংশিস্নষ্ট ও সহযোগী পুরো বিচার প্রশাসনের মুখোমুখি হয়। তাই বিচার প্রাথর্ী হয়ে সার্বিকভাবে তাকে যে দুনর্ীতির শিকার হতে হয়, আমার বিশ্বাস, তারই ধারণা সূচক প্রণয়ন করা হয়েছে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে। তাছাড়া কর শুল্কসহ অন্যান্য প্রশাসনিক বিভাগ ও তাদের স্ব স্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে সহকারী, পেশকার, ইন্সপেক্টর বা অন্য কর্মচারীদের থেকে পৃথক করে প্রায় অনুরূপ বিবৃতি দিতে পারে কিন্তু তাতে সেবাপ্রাথর্ী জনগণ সেবা পেতে সার্বিকভাবে সেসব বিভাগের যে দুনর্ীতির শিকার হয় তা কোনক্রমেই লাঘব হবে না বা তার পূর্ণাঙ্গ চিত্রও পাওয়া যাবে না। তদুপরি যে কোন সেবা খাতের কর্মচারী, সহযোগী বা সংশিস্নষ্টদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও সাধারণত উক্ত খাতের কর্মকর্তাদের উপর বর্তায়। বলা নিষ্প্রয়োজন যে টিআইবি বা কারো সাফাই গাইতে নয়, শুধু যুক্তির খাতিরেই উপরোক্ত কথাগুলো বলা হল। তবে এখানে একটি বিষয় উলেস্নখ করতে হয় যে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর সুষ্ঠু বিচার প্রশাসনের স্বার্থে সুপ্রীম কোর্টের অধিনে যে একটি শক্তিশালী সুপ্রীমকোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল বা সে মর্মে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যে প্রস্তাব ছিল তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। সে কারণেও নানা ধরনের অনিয়ম বা হয়রানি সংঘটিত হয়ে থাকে বলে অনেকের ধারণা। কাজেই বিচার বিভাগে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত সংস্কার এবং শক্তিশালী ও কার্যকর একটি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা যত শীঘ্রই করা যাবে ততই মঙ্গল। শেষ কথা হল একটি দুনর্ীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে চাই দুনর্ীতি দমন কমিশনের মত একটি প্রতিষ্ঠানের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাসমূহসহ সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা। কেননা দুনর্ীতি দমন কমিশন যত স্বাধীন ও কার্যকরই হোক না কেন দুনর্ীতি প্রতিরোধে তার চেয়ে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল সেবাখাতসহ সকল সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজেদের। কমিশন মূলত ইতিমধ্যে সংঘটিত এবং তাদের নজরে আনীত দুনর্ীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে এবং তাতে দুনর্ীতি কিয়দাংশে নিরুৎসাহিত হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি বিভাগে ও সংস্থায় প্রতিনিয়ত যে অসংখ্য অনিয়ম ও দুনর্ীতি হয় তা প্রতিহত করতে হলে প্রধানত প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানসমূহের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা, ভাল কাজের জন্য পুরস্কারের এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তর কমানোসহ কার্যপদ্ধতি সহজীকরণ, একচেটিয়া ব্যবসা বা ক্ষমতার অবসায়ন, দুনর্ীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সর্বোপরি সরকারসহ রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গসমূহের সদিচ্ছা ও ঐকান্তিকতা।

কথকতা : তথ্য এবং সত্য by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

খনো যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন ইত্তেফাক পড়ি কতদিন ধরে, আমি উত্তর দিই জন্মের পর থেকে। কারণ হল একটু বড় হবার পর পাঠাভ্যাস শুরুর সময় থেকেই তো ইত্তেফাক পড়ি। তাছাড়া আমার দুরন্ত কৈশোর এবং সংগ্রামী যৌবনের শুরুর দিনগুলোতে ইত্তেফাক ছিল অন্যতম রাজনৈতিক গুরু।

সারাদিনের মিটিং-মিছিল শেষে মফস্বল শহরের চায়ের স্টলে গিয়ে কাড়াকাড়ি করে ইত্তেফাক পড়ার স্মৃতি আজো আমাকে রোমাঞ্চিত করে। প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের স্বাধীকার আদায়ের প্রশ্নে অনড় এবং আপোষহীন অবস্থান, সেই সাথে মানিক মিয়ার সময়োপযোগী ধারালো ও বলিষ্ঠ উপ-সম্পাদকীয় দুইয়ের সংমিশ্রণে ইত্তেফাক সেই সময়ে এক প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল বাঙালি জাতিকে। বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির দ্রোহের ইতিহাস লিখতে গেলে ইত্তেফাকের নাম অপরিহার্যভাবে লেখা হবে। তাছাড়া জাতির ক্রান্তিলগ্নে ইত্তেফাকের রিপোর্টিংও অসাধারণ। ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন, সত্তুরের জলোচ্ছ্বাস এবং জাতীয় নির্বাচন, পূর্ববাংলার সরলপ্রাণ বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বৈরী আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে ইত্তেফাকের রিপোর্টিং এবং ছবির স্মৃতি আজো আমার কাছে জ্বলজ্বলে হীরকতুল্য। তারও আগে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অথবা রবীন্দ্র শতবার্ষিকী নিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইত্তেফাকের বলিষ্ঠ ও গণমুখী ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম, পূর্ববাংলা ও বাঙালির জাগরণে ইত্তেফাক অনিবার্য হয়ে আছে।

সেই কোনকাল থেকে জেনে এসেছি টিকাটুলীর মোড়ে ইত্তেফাকের অফিস। পরে ঐ মোড়টার নামই হয়ে গেছে ইত্তেফাকের মোড়। সম্প্রতি ইত্তেফাকের অফিস ঐ মোড় থেকে দূরে চলে গেছে। ইত্তেফাকের মোড় কিন্তু ঠিকই আছে। যেমন আছে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেকদিন পরেও দৈনিক বাংলার মোড়। সম্প্রতি ইত্তেফাক প্রকাশনার মালিকানা চলে এসেছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দায়িত্বে। গণমুখী চরিত্রের আড্ডাপ্রিয় মঞ্জু সাহেবকে আমার ভালো লাগে। তর্কবাজ কিন্তু অপরের যুক্তি শোনার মত ঔদার্য, ভদ্রতা এবং ধৈর্যশীল মানুষ তিনি। গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ততা এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই বোধহয় তিনি স্থবির ইত্তেফাক ভবনের বিনিময়ে বেছে নিয়েছেন চলমান ইত্তেফাক প্রকাশনা। এ জন্য অবশ্যই তাঁকে সাধুবাদ জানাই। কাজটা কঠিন। আবার নতুন করে সংগ্রামের শুরু। তবু তিনি কঠিনকে বেছে নিয়েছেন পরস্পরকে গতিশীল রাখবার জন্য। পুরনো পাঠকদের কাছে এটা কম পাওনা নয়।

পূর্বে ইত্তেফাকের একটা বিশেষ চরিত্র ছিল এই যে উলেস্নখিত দৈনিকে বাসি-তাজা সব খবরই পাওয়া যেতো। ইত্তেফাক তথ্য ছাপার ব্যাপারে কার্পণ্য করত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়তে গিয়ে প্রথমেই লিখেছলাম 'কে কী দেন কবে কোথায় এর তত্ব।' ইত্তেফাকের তথ্যে এই তত্বের সব উত্তরই মিলতো। কিন্তু বর্তমানে অবাধ তথ্যপ্রবাহের পৃথিবীতে চিত্র অনেক পাল্টেছে। দেশ-বিদেশ জুড়ে চলছে রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতার নিত্যচর্চা। স্বল্প শিক্ষিতের দেশে তথ্য পাঠকের জ্ঞান বাড়ায় সত্য, কিন্তু জ্ঞান যদি বোধে না পেঁৗছায় তবে তো প্রকৃত সত্য আবিষ্কৃত হবে না। পাঠকের জানাটা যদি বিক্ষিপ্ত থেকে যায়, থেকে যায় শুধু তথ্য সমাহার এবং বোধের জগৎ যদি পড়ে থাকে অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্ত অবস্থায় তবেতো সেই সত্যের চেহারা কখনোই স্পষ্ট হবে না যাতে দেশ, জাতি, সমাজ এগুবে। আতিশয্যের আস্বাদন গুরুপাক হয়ে বদহজমে রূপ নেবে। এসব কথা ভাবতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা মনে পড়ছে। মানুষের ধর্মে তিনি লিখেছিলেন, 'প্রত্যক্ষ তথ্যকে উপেক্ষা করলে মানুষের চলে না, আবার সত্যকেও নইলে নয়। অন্যান্য বস্তুর মতোই তথ্য মানুষের সম্বল, কিন্তু সত্য তার ঐশ্বর্য।' বর্তমানকালে গণমাধ্যমের হিসেবটা বেশ জটিল। তাই বলছিলাম মঞ্জু সাহেবের নবযাত্রা একটু কঠিন বৈকি। তবু সত্যের লক্ষ্যে পেঁৗছাতে তিনি কঠিনকেই ভালবেসেছেন।

কাজ-কর্মে বাইরে গেলে ইত্তেফাক আগ্রহ নিয়েই পড়ি। আর যেদিন আমার কোনো লেখা ছাপা হয় সেদিন নানা জায়গা থেকে টেলিফোন পাই। তখন বুঝি ইত্তেফাক দেশজুড়ে আছে। থাকবেই বা না কেন! ইত্তেফাকতো বাঙালির দৈনিক। বাংলাদেশেরও।

মঙ্গলে লেকের চিহ্ন

ঙ্গল গ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের সীমা নেই। গত এক দশকে এ গ্রহটি সম্পর্কে অকল্পনীয় সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন তারা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহটিকে পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকে। মনুষ্য বসবাসের উপযোগী কিনা সে বিষয়ে চালাচ্ছেন নানা গবেষণা তারা।

এর আগে সমুদ্র সৈকতের চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। পানি থেকে উদ্ভূত ফ্যানারাশি জমে থাকার প্রমাণ মিলেছে মাত্র কিছুদিন আগে। সর্বশেষ একদল বিজ্ঞানী আরো কিছু উলেস্নখযোগ্য তথ্য আবিষ্কার করেছেন। তাদের মতে, মঙ্গল গ্রহের নতুন ছবি থেকে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে, তিনশ' কোটি বছর আগেও গ্রহটিতে বিশাল আকারের লেক ছিল তা ছিল টলটলে জলরাশিতে পূর্ণ। দফায় দফায় কক্ষপথ পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির সচল এবং উল্কাপাতের ফলে গ্রহটি উত্তপ্ত হয়। সে কারণেই বিশাল জলরাশি ক্রমে বাষ্পে পরিণত হয়ে মরুময় লাল গ্রহের রূপ লাভ করে।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার মার্স রিকোনাইস্যান্স অরবিটার (এমআরও) মনে করে, সে কারণেই মঙ্গল গ্রহে পানি শুকানোর দাগ সম্বলিত বিশাল আকারের লেক এবং কোথাও কোথাও ড্রেনের সন্ধান মিলেছে। অবশ্য আগে ইমপেরিয়াল এন্ড ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকদল মঙ্গল গ্রহের ছবি পর্যালোচনা শেষে জানিয়েছেন, গ্রহটিতে ২ হাজার কিলোমিটারব্যাপী গিরিসঙ্কটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। যাতে ২০ কিলোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট গর্ত রয়েছে। তাদের ধারণা, এক সময় মঙ্গলগ্রহ ছিল একটি বরফ চাঁই। কালক্রমে এটি উত্তপ্ত হতে হতে পানিতে পরিণত এবং মাত্র চলিস্নশ লাখ বছর আগে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মরুময় বিরাণ প্রান্তরে পরিণত হয়। অবশ্য কোন কোন বিজ্ঞানী নির্দিষ্ট এ সময়সীমার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, মঙ্গল গ্রহে পানি ছিল। হয়তো সাগর এমনকি লেকও ছিল। কিন্তু আজ থেকে কত বছর আগে, সে পরিবেশ ছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয়ের সময় এখনো আসেনি। এ পর্যন্ত যে তথ্য মিলেছে তা পরিপূর্ণ নয়। এজন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন।

২০১১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা

০১১ সালের মাঝামাঝি বিশ্বের জনসংখ্যা হইবে ৭০০ কোটি। বিশ্ব জনসংখ্যা ফাউন্ডেশন এই হিসাবটি প্রকাশ করিয়াছে। জার্মান ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড পপুলেশন অথবা ডিএসডবিস্নউ তাহাদের ওয়েবসাইটে "পপুলেশন মিটার" নামে একটি ক্যালকুলেটর পরিচালনা করিয়াছে।

যাহা বার্ষিক বিভিন্ন তথ্যের সূত্র ধরিয়া হিসাব করিয়াছে। শুক্রবার রাত অবধি বিশ্বের জনসংখ্যা হিসাব দেখান হইয়াছে ৬৯৩ কোটি ৪১ লক্ষ ৯৬ হাজার জন। এক বৎসর আগের চাইতে এই সংখ্যা ৮০ মিলিয়ন বেশি। ঐ পরিসংখ্যানটি এই তথ্যই প্রদান করিতেছে যে, বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ২৬ জন নূতন মানুষ যোগ হইতেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ১৯৫০ সালে একেকজনের ছয়টি করিয়া সন্তান জন্ম নিত। সেই সংখ্যা এখন নামিয়া আসিয়াছে ২.৫-এ। ব্রাজিল, চিলি, কিউবা, ইরান, থাইল্যান্ড এবং তুরস্কে প্রতিজন মা দুইটি করিয়া সন্তান জন্ম দিতেছেন। অথবা উহার চাইতেও কম।

পক্ষান্তরে শতাব্দীর মধ্যভাগে আফ্রিকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ বাড়িয়া দুইশত দশ কোটি হইবে। উহার সঙ্গে যুক্ত হইবে এশিয়ার বর্ধিত একশত ত্রিশ কোটি। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লক্ষ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪ এবং প্রজনন হার ২ দশমিক ২৫। বাংলাদেশের মত নাতিশীতোষ্ণ এবং উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের পর্যায়ে নামাইয়া আনা সহসা সম্ভব হইবে না।

জনসংখ্যা সীমিত করিয়া আনার পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করিবার ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য না আসায় বিষয়টি নানাভাবে দেশের উন্নয়নের অন্তরায় হইয়া উঠিয়াছে। কাজেই জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরিত করিতে পারিলে দেশের দারিদ্র্য সহনশীল মাত্রায় নামিয়া আসিবে। জীবনযাত্রার মান উন্নীত হইলে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রিত হইলে আশানুরূপ সাফল্য আসিতে পারে। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করিয়া এই ক্ষেত্রে সরকারের চলমান কর্মসূচিগুলির সফল বাস্তবায়ন করা অতি প্রয়োজন ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিশ্চিত করাও অতি জরুরী। আমরা মনে করি, উন্নয়ন নিশ্চিত করিতে হইলে পরিকল্পিত পরিবার গঠন করিতে হইবে। দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করিবার কোন বিকল্প নাই। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশে মানবসম্পদই হইতে পারে সবচাইতে বড় জাতীয় সম্পদ। ইহার জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি করিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করিতে হইবে সংশিস্নষ্ট সকলকেই।

চায়ের রফতানি ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখিতে উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নাই

ভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়িয়া যাওয়ায় এবং উৎপাদন হ্রাস পাইবার কারণে বাংলাদেশ বাদ পড়িয়াছে চা রফতানিকারক দেশের তালিকা হইতে। উপরন্তু কিছু চা আমদানি করা হইয়া থাকে। বিশ্বের চা রফতানিকারক দেশগুলির তুলনায় বাংলাদেশের চায়ের দাম অনেক বেশি, ফলে কিছু প্রাইভেট কোম্পানি চা আমদানি করিয়া বাজারজাত করিতেছে।
জানা যায়, বাংলাদেশের চা বাগানগুলিতে বৎসরে ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়, যাহা দেশীয় বাজারের চাহিদার সমান। গত ২০ বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়াছে ৯.৯৪ ভাগ, আর উৎপাদন বাড়িয়াছে মাত্র ২.১৪ ভাগ। চায়ের উৎপাদন বাড়াইতে যথাযথ উদ্যোগ-পরিকল্পনার অভাবেই দেশের ঐতিহ্যবাহী চা-বাগান ও চা শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হইতেছে।

দেশে চায়ের উৎপাদন হ্রাসের অন্যতম কারণ চা বাগানগুলিতে কয়েক দশকের পুরাতন গাছের জায়গায় উচ্চ ফলনশীল জাতের চা-গাছ রোপণ করা সম্ভব হয় নাই। এই প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত ৬০ বৎসর পর চা গাছে পাতার উৎপাদন কমিয়া যায়। পুরাতন বাগানসমূহে বেশিরভাগ চা গাছের বয়স ৬০ বৎসরের বেশি। উপরন্তু চাহিদানুযায়ী সার ব্যবহার না করার কারণেও চায়ের উৎপাদন ১০ হইতে ১২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাইতেছে বলিয়া চা-বিজ্ঞানীরা মনে করেন। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের জন্য বিভিন্ন ধরনের সারের চাহিদা বৎসরে প্রায় ৫৩ হাজার টন। সারের প্রাপ্যতা অনুযায়ী সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সার চা বোর্ড ও চা সংসদের মাধ্যমে বাগানগুলিতে সরবরাহ করা হইয়া থাকে। কিন্তু বিগত কয়েক বৎসর যাবৎ এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিতেছে। চাহিদা অনুযায়ী সার না পাওয়ার অভিযোগ রহিয়াছে অনেক বাগানের। অন্যদিকে অনেক বাগানের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতাও উৎপাদন হ্রাসের কারণ। ইহাছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও সিলেট অঞ্চলে চায়ের উৎপাদন কমিবার আশঙ্কা করিতেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। দেশে বর্তমানে ১৬৩টি চা বাগান রহিয়াছে। ইহার মধ্যে ৭৪টি চা বাগানই রুগ্ন। ২০০৩ সালে তিনটি পার্বত্য জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পঞ্চগড়েও বেসরকারি উদ্যোগেও চা-চাষ শুরু হইয়াছে। কিন্তু চা-খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও প্রণোদনা শুল্ক কার্যক্রম যথেষ্ট না হওয়ায় চায়ের উৎপাদন বাড়িবার বদলে কমিয়া গিয়াছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণেও চা-শিল্প হুমকির মধ্যে পড়িয়াছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চা চাষ হইতেছে। এই পরিমাণ জমিতে প্রতি বৎসর ৩০ কোটি কেজি চা উৎপাদন করা সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে উৎপাদন হইতেছে ৬ কোটি কেজি।

বাংলাদেশে একদা কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে পাটের পরই চা প্রধান রফতানি পণ্য হিসাবে গণ্য হইত। সোনালী আঁশের সুদিন গত হইবার পরেও চা রফতানির তালিকায় টিকিয়াছিল। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় চা-শিল্পের ক্রমবর্ধমান সংকট এবং দেশের চা-আমদানি নির্ভর দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়টি ভাবনা উদ্রেককারী নিঃসন্দেহে। চা-শিল্পের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১০ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ১২ বৎসর মেয়াদি কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা 'ভিশন ২০২১' নামে একটি পরিকল্পনা গ্রহণের কথা জানা যায়। কিন্তু বিগত এক বৎসরেও এই পরিকল্পনার কোনো অগ্রগতি হয় নাই। আমরা মনে করি, চায়ের উৎপাদন বাড়াইতে সার্বিক উদ্যোগ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। পুরাতন বাগানগুলিতে উচ্চ ফলনশীল চায়ের উৎপাদন নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলের সম্ভাবনাময় এলাকাতেও চায়ের চাষ সমপ্রসারণ করার কথা ভাবা প্রয়োজন। চায়ের উৎপাদন বাড়াইতে প্রয়োজনীয় সার ও অন্যান্য সহযোগিতা নিশ্চিত করিতে হইবে অবশ্যই। পুরাতন বাগানসমূহে নূতন চারা লাগাইতে হইবে ক্রমান্বয়ে। তবে দেশের চাহিদা মিটাইয়াও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী চা অন্যতম রফতানি পণ্য হিসাবে ধরিয়া রাখিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না চাল

খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রিতে ( ওএমএস) চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না চাল। ফলে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে অনেক ক্রেতাকে।

রাজধানীতে ওএমএম-এর চাল বিক্রির বিভিন্ন স্পটে সোমবার গিয়ে দেখা যায়, কম মূল্যে চাল পাওয়ার আশায় অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক ঘন্টা আগে স্পটে হাজির হয়েছেন। মুহূর্তেই তা দীর্ঘ লাইনে পরিণত হয়। চাল দেয়া শুরু হয়, কিন্তু লাইন ছোট হয় না। ক্রমেই তা আরো দীর্ঘ হয়।

ডিলাররা বলছেন, চাহিদার তুলনায় চালের বরাদ্দ কম। কিন্তু ক্রেতা অনেক বেশি। চাল বিক্রি শুরুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের খালি হাতে ফিরতে হয়।

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় আব্দুলস্নাহপুর স্পটে গিয়ে দেখা যায়, তখনো চাল বিক্রির ট্রাক আসেনি। কিন্তু চাল কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে।

৮০ বছরের বৃদ্ধ সোনামিয়া আগেরদিন লাইনে দাঁড়িয়ে চাল না পাওয়ায় সোমবার সকাল ৭টার ভিতরেই চাল কিনতে চলে আসেন। আগেভাগে এসেও ১৫/১৬ জনের পেছনে পড়ে গেছেন। বারবার তাকাচ্ছিলেন ট্রাকের উপরে চালের বস্তার দিকে। সোনামিয়া বলেন, 'বাড়িতে খাইনাওয়ালা মেলা। তাই চাইল নিতে লাইনে দাঁড়াইছি।' বয়স বেশি হলেও কেউ তাকে আগে চাল নিতে দেয় না বলে আক্ষেপ করেন তিনি। 'গতকাল পাই নাই , আইজ চাল নিতেই হইব' জোরের সাথে বললেন ষাটোধর্্ব আব্দুল গফুর। রোদের মধ্যে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট হইলে কি হইব, জানতো বাঁচাতে হইব। সরকার কম দামে চাল না দিলে যে কি হইতো।'

চাল বিক্রির আরেক স্পট এফডিসি গেইট রেলক্রসিং এলাকায় গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে অনেকেই যখন ২টার দিকে চাল নিতে আসেন তখন চাল শেষের পথে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয় তাদের।

শুধু এই দুই স্পটেই নয়, রাজধানীর পান্থপথ, পলাশী, আজিমপুর, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শ্যামলী, কামরাঙ্গারীরচরসহ অন্যান্য স্পটেও দেখা গেছে একই চিত্র। ১ জানুয়ারি থেকে চাল বিক্রির আরো ১৫টি স্পট বাড়িয়ে বর্তমানে ৮০টি স্পটে খোলা ট্রাকে চাল বিক্রি করছে খাদ্য বিভাগ। প্রতি স্পটে ৩ টন করে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু এই বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

আব্দুলস্নাহপুর স্পটের ডিলার হোসেন বলেন, সরকার যে চাল দেয় তা দুপুর ২টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। চালের বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত।

সরকারের সংস্থা টিসিবির হিসাবে বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়। কিন্তু সরকার ওএমএস'র চাল বিক্রি করছে ২৪ টাকা কেজিতে। প্রতি কেজিতে দামের পার্থক্য ১১ থেকে ১২ টাকা। যে কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও এখন ওএমএস'র চাল কিনতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।

আমনের ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের সুবিধার্থে রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে ন্যায্যমূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু করেছে খাদ্য বিভাগ। সারাদেশে প্রতিটি উপজেলা সদরে প্রতিদিন ৫টি স্পটে ১ টন করে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ওএমএস'র পাশাপাশি ১ জানুয়ারি থেকে ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমেও প্রতি মাসে ন্যায্যমূল্যে ১০ কেজি করে চাল ও গম দেয়ার কর্মসূচি শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

খাদ্য বিভাগসূত্র জানিয়েছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেভাবে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে, তাতে চালের বাজারের উপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু সরকারের মজুদ যথেষ্ট পরিমাণে না থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে ওএমএস-এ নানা অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।

খাদ্য বিভাগসূত্র আরো জানিয়েছে, ট্রাকের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় রাজধানীর সব স্থানে চাল বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। চাল বিক্রির কার্যক্রম তদারকির জন্য যে লোকবল প্রয়োজন তাও নেই। তবে চাল বিক্রির স্পটের সংখ্যা শিগ্গির আরো বাড়ানো হবে।

খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ইত্তেফাককে বলেছেন, স্বল্প আয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির কেন্দ্র ও পরিমাণ আরো বাড়ানো হচ্ছে। যাতে মানুষকে চাল না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে না হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম যেভাবে বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। তবে সরকারের ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

চট্টগ্রামে ফেয়ার প্রাইস কার্ডে চাল বিক্রি শুরু

এদিকে আমাদের চট্টগ্রাম অফিসের রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রামে চালের মূল্য সহনীয় রাখতে ওএমএস'র সাথে শুরু হয়েছে ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে চাল ও গম বিক্রি। মহানগরীর ২৫টি স্পটে ট্রাকে খোলা বাজারে চাল বিক্রি চলছে। একজন ডিলার প্রতিদিন তিন টন করে চাল বিক্রি করছেন।

ফেয়ার প্রাইস কার্ডের আওতায় ৪৭ জন ডিলারের মাধ্যমে চাল ও গম বিক্রি শুরু হয়েছে। নগরীর ষোলটি ওয়ার্ডের প্রায় ৪৭ হাজার দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে মাসে দশ কেজি করে চাল ও গম বিক্রি করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের সবকটিতে এই ফেয়ার প্রাইস কার্ডধারীদের মাঝে চাল ও গম বিক্রি করা হবে। আর তখন দুই লাখ ৫ হাজার স্বল্প আয়ের পরিবার এই প্রকল্পের আওতায় আসবে।

খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন, সরকারের দরিদ্র বান্ধব এই উদ্যোগের ফলে এই অঞ্চলে চালের দামের ঊধর্্বগতি কিছুটা হলেও নিম্নমুখী হবে। দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত এসব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও তারা জানান।

শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত

দেশে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্য প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডায় জীবনযাত্রা এখন প্রায় বিপর্যস্ত। চুয়াডাঙ্গা থেকে শুরু করে পাবনা-ঈশ্বরদী-রাজশাহী-সৈয়দপুর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে মাঝারি শৈত্য প্রবাহ।

আর মাদারীপুর, শ্রীমঙ্গল, সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশাল অঞ্চলে রয়েছে মৃদু শৈত্য প্রবাহ। ঘন কুয়াশায় নৌ-চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তবে ফ্লাইট অনুসন্ধান থেকে জানানো হয়েছে, বিমান সংস্থাগুলো ফ্লাইট আসা-যাওয়ার সময় পরিবর্তন করায় বিমান চলাচলে তেমন কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি।

আবহাওয়া দপ্তর জানায়, আরও অন্তত দুইদিন এ অবস্থা বিরাজ করতে পারে। সাইবেরিয়ার হিমেল হাওয়া হিমালয় ও ভারতীয় ভূ-ভাগ অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বদিক দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ায় এই শৈত্যপ্রবাহ। তবে সাধারণত জানুয়ারি মাসে দেশে যে তাপমাত্রা থাকে এখন পর্যন্ত তার কোন হেরফের হয়নি; বরং বলা যেতে পারে এটা এই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রা। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তা মাঝারি শৈত্য প্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে সেটি হয় মৃদু শৈত্য প্রবাহ। গতকাল সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা সম্পর্কে আবহাওয়া বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, শৈত্য প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে আরো দুইটি ঘটনা ঘটছে। এর একটি হালকা বায়ু প্রবাহ। আর দ্বিতীয়টি হলো ঘনকুয়াশা। কুয়াশার কারণে সূর্যরশ্মি মাটির কাছাকাছি পেঁৗছাতে পারছে না। ফলে মাটি গরম হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। শৈত্য প্রবাহের সঙ্গে এই দুইটি বিষয় মিলেমিশে শীত তীব্রতর অনুভূত হচ্ছে।

রাজধানীর অবস্থা ঃ রাজধানীতে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকভাবে এই তাপমাত্রায় খুব বেশি শীত অনুভূত হওয়ার কথা নয়; কিন্তু হালকা বায়ু প্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে গতকাল শীত ছিল তীব্র। তাই ভর দুপুরেও সূর্যকে তেমন তেজস্বী মনে হয়নি। মানুষকে শীত নিবারণী কাপড় গায়ে চলাফেরা করতে দেখা যায়। ঠাণ্ডায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করছে বস্তিবাসী।

এদিকে রবিবার রাতে ঘন কুয়াশার কারণে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌ-রুটে ফেরি চলাচল ১০ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। এ সময় নদীপথে আটকা পড়ে ৫টি ফেরি। মাওয়া ও কাওড়াকান্দি ঘাটের দুই পাড়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট।

আমাদের পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান, ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ১১টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল গোটা জেলা। একই কারণে যানবাহন চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। শীতের কারণে বেশি বিপাকে পড়েছে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের লোকজন। এছাড়া জেলার নদ-নদী থেকে পাথর উত্তোলনকারী শ্রমিকরা তীব্র শীতের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। একইসাথে শিশুদের শীতজনিত সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে।

দিনাজপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন,হিমালয়ের সনি্নকটে হওয়ায় এই জেলায় শীতের তীব্রতা বেশি। গত কয়েকদিন ধরেই চলছে শৈত্যপ্রবাহ। কুয়াশা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বাড়িয়ে দিয়েছে শীতের তীব্রতা। তাই বিপর্যস্ত জনজীবন। সবচেয়ে কষ্টে আছে হতদরিদ্ররা। এদিকে তীব্র শীতে নষ্ট হচ্ছে শীতকালীন ফসল ও ইরি/বোরোর বীজতলা।

আমাদের বগুড়া অফিস জানায়, কনকনে শীতে জেলার জনজীবন বিপর্যস্ত। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে প্রকৃতি। দুপুরের আগে সূর্যের মুখ দেখা মেলে না। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল কমে গেছে। যাত্রী না পেয়ে অধিকাংশ দূরপালস্নার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ছে শীতজনিত নানা রোগ। নিউমোনিয়া ও কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে শিশুরাই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশী।

বদরগঞ্জ (রংপুর) সংবাদদাতা জানান, ঘন কুয়াশা ও শৈতপ্রবাহে এলাকার বোরো বীজতলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কৃষক হতাশ হয়ে পড়েছেন।

ভারতে ২৪ জনের মৃতু্য ঃ টানা শৈত্যপ্রবাহে ভারতের উত্তরাঞ্চল জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে শীতজনিত কারণে মারা গেছে ২৪ জন। তীব্র শৈত্যপ্রবাহে রাজধানী নয়াদিলিস্নসহ কাশ্মীর, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশের জনজীবন থমকে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে কাশ্মীরের তাপমাত্রা নেমে গেছে হিমাংকের ২৩ ডিগ্রি নিচে। ঘন কুয়াশার কারণে দিলিস্নর বিমান ব্যবস্থা হচ্ছে বিঘি্নত। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, চলমান শৈত্যপ্রবাহ আরো তীব্র হতে পারে।

চলছে মেলা জমজমাট

থ্যপ্রযুক্তির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, প্রযুক্তির মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড় দেখে বিষয়টি একেবারেই পরিস্কার হয়ে যায়। ১৩ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিসিএস কম্পিউটার সিটির বার্ষিক মেলা ‘সিটি আইটি ২০১১’ ঘুরেও তা বোঝা যায়।

প্রযুক্তির এই বাজারে সবগুলোই স্থায়ী দোকান।তার পরও মেলার সময় টিকিট কেটে ঢুকছেন দর্শকেরা। দর্শক-ক্রেতার এখন ভিড় পুরো কম্পিউটার সিটি জুড়ে। ‘ডিজিটাল লাইফ, বেটার লাইফ’ স্লোগানকে সামনে রেখে ১০ দিনের এই মেলা চলবে আগামীকালশনিবার পর্যন্ত।
প্রথম দিন থেকেই মেলায় দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়, কিছুক্ষণ পরপরই মূল প্রবেশপথের টিকিট কাউন্টারগুলোর সামনে দর্শনার্থীদের লম্বা সারি। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে বা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে অনেকেই আসছেন এই মেলায়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন স্কুল থেকেও দলগতভাবে মেলা দেখতে এসেছে অনেক শিক্ষার্থী। সাধারণ মানুষ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নতুন প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার সেবা পৌঁছে দেওয়ার কিছু নমুনাও তুলে ধরা হয়েছে এ মেলায়। ফলে মেলায় প্রযুক্তিপণ্য দেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ পাচ্ছেন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে এ মেলা। মেলা চলাকালে কম্পিউটার সিটির কোথায় কোন অনুষ্ঠান চলছে তা ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরপরই কম ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সবার আগ্রহ নতুন প্রযুক্তিতে
মেলায় দর্শনার্থীদের মধ্যে ল্যাপটপ কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ বেশি। অনেকেই এসেছেন ডেস্কটপ কম্পিউটার বা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনতে। কেউ কেউ এসেছেন প্রযুক্তি বাজারের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে। কোন পণ্যে কী কী সুবিধা বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে এবং নতুন আসা পণ্যগুলো পরিবেশবান্ধব ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কি না সে বিষয়গুলোও দর্শনার্থীরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন।
মেলার প্লাটিনাম পৃষ্ঠপোষক বাংলালায়ন। তারা দর্শকদের জন্য ওয়াইম্যাক্সের মাধ্যমে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ রেখেছে। মেলায় প্রতিদিনই গুণীজন সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গেমস প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা ও রক্তদান কর্মসূচি। প্রতিদিনই প্রবেশ টিকিটের ওপর রয়েছে র‌্যাফল ড্র।

নতুন পণ্য, উপহার, ছাড়
এবারের মেলায় বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাভেলিয়ন দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে ইন্টেল, মাইক্রোসফট, আসুস, বেলকিন, এইচপির ওএমই পার্টনার—এসব ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন করছে। ইন্টেল মেলায় তাদের নতুন দুটি প্রসেসর দেখাচ্ছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের কোর সিরিজের এই প্রসেসরে গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট উন্নততর করা হয়েছে, ফলে অতিরিক্ত গ্রাফিকস কার্ড ছাড়াই হাই ডেফিনেশন গ্রাফিকসের কাজ করা যাবে। ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে প্রিন্ট করার সুবিধাসহ অল-ইন-ওয়ান প্রিন্টার এনেছে এইচপি।
তারহীনওয়াই-ফাই দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রিন্টারের জন্য নির্ধারিত ঠিকানায় ই-মেইল করেও তা প্রিন্ট করা যাবে। আসুস তাদের সাম্প্রতিকতম ল্যাপটপ প্রদর্শন করছে।অপরদিকে মাইক্রোসফটের ওএমই পার্টনার বাইনারি লজিক লাইসেন্স করা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের সুবিধা দেখাচ্ছে ও ব্যবহারকারীদের এ বিষয়ে সচেতন করছে। এ ছাড়া মেলায় আরও নতুন যে পণ্যগুলো এসেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এভারমিডিয়ার নতুন একটি ডকুমেন্ট ক্যামেরা, ইমাশনের তারহীন প্রেজেন্টার। মেলা উপলক্ষে ক্যানন ইওএস ৬০ডি নামের একটি পেশাদার মানের ডিজিটাল ক্যামেরা এনেছে এবং অন্যান্য মডেলের ক্যামেরার সঙ্গে বিভিন্ন উপহার দিচ্ছে।
মেলায় প্রায় প্রতিটি দোকানেই বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে বিশেষ ছাড় বা উপহার দেওয়া হচ্ছে। তোশিবা, ডেল, ফুজিৎসু এবং এইচপির কিছু মডেলের সঙ্গে উপহার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ওয়াইম্যাক্স মডেম, পেনড্রাইভ, টি-শার্ট ইত্যাদি। সাধারণ সময়ের থেকে মেলায় বিক্রি বেশি হচ্ছে। মেলায় দর্শনার্থীরা বিভিন্ন প্রযুক্তির পণ্য সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। এতে ল্যাপটপ কেনার প্রতি আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন কম্পিউটার সিটির রায়ানস কম্পিউটার্সের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম।

আয়োজকদের কথা
প্রতিবছরই বিসিএস সিটিতে আইটি মেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এ বছর আয়োজকেরা মেলা শুরুর আগে থেকেই চালিয়েছেন ব্যাপক প্রচারণা। মেলার আহ্বায়ক এ এল মাজহার ইমাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সব সময় চেষ্টা করছি যেন দেশের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা ও প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপনের সুযোগ পান। ছোট থেকেই যেন তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে সে জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের মেলায় বিনা মূল্যে প্রবেশের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের জন্যও বিনা মূল্যে প্রবেশ এবং তাদের বিশেষভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এবারের মেলায় প্রথমবারের মতো নলেজ ম্যানেজমেন্ট জোন তৈরি করা হয়েছে। এ দেশে প্রথম কম্পিউটার কবে এসেছে, কম্পিউটারে বাংলা লেখা শুরু হলো কবে, দেশের তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে এমন বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
এর ফলে দর্শনার্থীরা দেশের তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ধারা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারছেন।’
প্রতিদিন সকাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিনোদনমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে দর্শনার্থীদের জন্য। আরও থাকছে জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর আয়োজন। র‌্যাফেল ড্রর একজন বিজয়ী রফিকুল ইসলাম সনি ৩২ ইঞ্চি এলসিডি টিভি পেয়েছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি বলেন, তাঁর এত দিন ধারণা ছিল, এ ধরনের ড্রতে পুরস্কার দেওয়ার কথা বলা হলেও আসলে তা দেওয়া না। তবে বিসিএস কম্পিউটার সিটির এই আয়োজনে তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছেন।
মেলার অন্য পৃষ্ঠপোষক হলো স্যামসাং, তোশিবা, ক্যাসপারস্কি ও লাইট-অন। মিডিয়া অংশীদার রেডিও এবিসি, এটিএন বাংলা ও ইত্তেফাক। ম্যাগাজিন পার্টনার কমপিউটার বিচিত্রা।

ক্যারিয়ার বাজি রাখতেও রাজি

'আগে থেকে যদি জানতাম, তাহলে আপনাদের সামনে কাঁদতাম না'-দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত মাশরাফি বিন মুর্তজা বলছিলেন কাল বিকেলে। সবাই এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সন্ধ্যায় বাসায় এসে সহমর্মিতা জানালেন। টেলিফোনে একই ভাষায় সান্ত্বনা দিয়েছেন বিসিবি সভাপতি।

দল ঘোষণার একটু আগে নাকি প্রধান নির্বাচকও ফোন করেছিলেন। তবে না পেয়ে এসএমএস করেন রফিকুল আলম। আর তাঁর নিজের শহর নড়াইলে তো রীতিমতো হরতাল পালিত হয়ে গেল! যে ভালোবাসা জড়িয়ে ধরে আরো বড় স্বপ্ন দেখছেন মাশরাফি। বিলীন হওয়া বিশ্বকাপ-স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ক্ষণ গণনা করছেন তিনি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২২ জানুয়ারি কলম্বো যাচ্ছেন মাশরাফি। যে শহরে উড়ে আসা শৈল্যবিদ ডেভিড ইয়াংয়ের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি। জানবেন স্বপ্নের গন্তব্য ২০১১ বিশ্বকাপ, নাকি আবারও অস্ত্রোপচারের টেবিল!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর একটা লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন মাশরাফি-তিন শ টেস্ট উইকেট। ২০০৩ বিশ্বকাপ তাঁর মনে এঁকে দিয়েছিল তিনটি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। 'ইনজুরির কারণে টেস্টেরটা হবে না, তা আমি আগেই জেনে গেছি। কিন্তু ভাবিনি যে তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে পারব না!' দল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না মাশরাফি। এ স্বপ্ন পূরণের জন্য এখনো তিনি মরিয়া, 'এই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে যদি আর কোনোদিন ক্রিকেট না-ও খেলতে পারি, তাতেও আমার কোনো দুঃখ হবে না।' দিন গুনছেন ডেভিড ইয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতেরও, ‘২২ তারিখ কলম্বো যাব। পরদিন ওর (ইয়াং) সঙ্গে দেখা হবে। দেখি কী বলে।’
ডেভিড ইয়াংয়ের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছেন নির্বাচক থেকে শুরু করে বোর্ড পরিচালকও। যদি অস্ট্রেলীয় এ সার্জন সবুজ সংকেত দেন, যদি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক গতিতে ছুটতে শুরু করে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’...। প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলম কালও বলেছেন, ‘ফিট হয়ে গেলে মাশরাফির বিশ্বকাপে খেলার জোর সম্ভাবনা আছে।’ সেই সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়ে বসে আছে আইসিসির টেকনিক্যাল কমিটির নির্দেশনা। এ নির্দেশনায় ইনজুরির কারণে দলে পরিবর্তনের সুযোগ আছে। তাহলে কি মাশরাফি ফিট হলেই ধরে-বেঁধে কাউকে ইনজ্যুরড দেখিয়ে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে?
বাংলাদেশের ঘোষিত বিশ্বকাপ দলের সর্বশেষ মেডিক্যাল রিপোর্টেও টুকটাক ইনজুরির খবর আছে। গোড়ালির চোটের কারণে প্রিমিয়ার লিগের শেষ দিকের দুটি ম্যাচ খেলতে পারেননি শফিউল ইসলাম। ইনজুরির কারণে শেষ লিগ ম্যাচটাই খেলেননি রুবেল হোসেন। নাজমুল হোসেনের ইনজুরির ট্র্যাক রেকর্ড আছে। তার ওপর বিশ্বকাপের মূল প্রস্তুতি ম্যাচের আগেও কয়েকটা ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ দল। যেমন ১ ফেব্র“য়ারি তিন দিনের চট্টগ্রাম সফরেও প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবেন সাকিব আল হাসানরা। এসবের ধাক্কায় যে কেউই ইনজুরিতে পড়তে পারেন। রফিকুল আলম তাই বলছেন, ‘বিশ্বকাপের এখনো প্রায় এক মাস বাকি। এ সময়ে কত কিছুই তো হতে পারে!’
নিজের পথ খুঁজতে অন্য কারো ইনজুরি কামনা করছেন না মাশরাফি। তাঁর চিন্তাজুড়ে নিজের ফিটনেস। ডেভিড ইয়াং যদি বলেন যে তাঁর পক্ষে বিশ্বকাপে বল করা সম্ভব, তাহলে আপাতত অস্ত্রোপচারে না গিয়ে তিনি ফিরে আসবেন আর অপেক্ষা করবেন স্বপ্ন পূরণের সুযোগের। দরজা যে পুরো বন্ধ হয়ে যায়নি, সেটা তো প্রধান নির্বাচক ইতিমধ্যেই জানিয়ে রেখেছেন। আর যদি ডেভিড ইয়াং অন্য কিছু বলেন, তাহলে চলে যাবেন অস্ত্রোপচারের টেবিলে, বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে যে অস্ত্রোপচারটা তিনি পিছিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ইয়াং যদি অপারেশনের কথা বলে, তাহলে শ্রীলঙ্কায়ই করিয়ে ফেলতে পারি। অযথা আর সময় নষ্ট করে লাভ কি!’
সময়। সময়কে পেছনে ফেলেই ছুটতে চেয়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। জাতীয় দলের ফিজিও মাইকেল হেনরির প্রাথমিক মূল্যায়ন ছিল ৫ ফেব্র“য়ারি দুই পা দৌড়ে বল করতে পারবেন মাশরাফি। কিন্তু ক্যারিয়ারকে বাজি রেখে সে সময়ের ১৮ দিন আগে নেটে বল করেছেন তিনি। মাশরাফির নিজের বিশ্বাস, ‘বিশ্বকাপের আগে আমি পুরো ফিট হয়ে যাব ইনশাল্লাহ।’ অবশ্য তার জন্য দরকার ডেভিড ইয়াংয়ের অনুমোদন। এরই মধ্যে বার দুয়েক টেলিফোনে কথা হয়েছে দুজনের। তবে সামনাসামনি দেখে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করতে চান ডেভিড ইয়াং। সেই সাক্ষাতে মাশরাফির সঙ্গে থাকবেন ফিজিও মাইকেল হেনরিও।
ঙ্গীর তুরাগ নদের পারে আজ শুক্রবার প্রথমবারের মতো শুরু হচ্ছে দুই পর্বে তাবলিগ জামাতের ছয় দিনের বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম পর্বে অংশ নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের ৩৩টি জেলার মুসল্লি।

ইজতেমা মাঠে মুসল্লিদের জায়গার অপর্যাপ্ততা ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মুসল্লিদের চরম দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তাবলিগ জামাত কর্তৃপক্ষ এ বছর থেকে দুই পর্বে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছর বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের পর তাবলিগের মুরব্বিরা এ সিদ্ধান্ত নেয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর আমবয়ানের (সাধারণ আলোচনা) মধ্য দিয়ে ইজতেমার কর্মসূচি শুরু হয়। ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ শওকত আলী বয়ান করেন। আগামী রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দুই পর্বে অনুষ্ঠেয় ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হবে। বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে ৩০ জানুয়ারি। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
ইজতেমার আন্তর্জাতিক নিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাওলানা আবদুল মতিন কালের কণ্ঠকে জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ প্রায় ১০ হাজার বিদেশি মুসল্লি মাঠে এসে পৌঁছেছে। প্রথম পর্বে অংশ নেওয়া মুসল্লিরা আগামী রবিবার নিজ নিজ জেলা ও নতুন জামাতে চলে যাবে। তবে বিদেশি মেহমান ও তাবলিগের মুরব্বিরা মাঠে থাকবে।
মুসল্লিদের সেবা ও নিরাপত্তার জন্য আয়োজক ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পুরো টঙ্গীকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে। দুই পর্বের ইজতেমায় পালাক্রমে একাধিক আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার প্রায় ২৫ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগেই চটের বিশাল শামিয়ানায় প্রায় ছেয়ে গেছে ইজতেমা ময়দান। আয়োজকরা আশা করছে, এবার জামাতবন্দি হয়ে আসা মুসল্লিদের মাঠে নির্ধারিত খেত্তায় জায়গা হবে। কাউকে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে না।
প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচিতে আছে সাধারণ (আম) ও বিশেষ আলোচনা (খাসবয়ান)। উভয় পর্বের দ্বিতীয় দিনে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন হবে। আগ্রহীদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমবয়ানের জন্য আন্তর্জাতিক নিবাসের পাশেই লোহার পাইপ ও কাঠ দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এ মঞ্চ থেকে তাবলিগের দেশ-বিদেশের মুরব্বিরা আলোচনা করবে। বয়ানের সুবিধার জন্য মঞ্চে লম্বা পায়ার একটি কাঠের চেয়ার পাতা হয়েছে। বিদেশি মেহমানদের জন্য মঞ্চের আশপাশে হোগলার পাটি বিছানো হয়েছে। তালিম ও খাসবয়ানের জন্য তাশকিল, কাবুওয়ালি জামাত ও জুড়নেওয়ালি জামাতকক্ষ তৈরি করা হয়েছে। বয়ান শোনার জন্য মাঠের বিভিন্ন স্থানে দেড় শ ছাতা মাইক ও পাঁচ শতাধিক লম্বা মাইক টাঙানো হয়েছে। ইজতেমার প্রথম পর্বের মুসল্লিদের জন্য ৪২টি খেত্তা নির্ধারণ করে প্রায় ১০ হাজার খুঁটি বসানো হয়েছে।
ইজতেমার সব কয়টি প্রবেশপথে র‌্যাবের সদস্যরা সন্দেহভাজন মুসল্লিদের শরীর তল্লাশি করে মাঠে প্রবশে করতে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিবাসে কেবল বিদেশি মুসল্লি বহনকারী বিশেষ স্টিকারযুক্ত গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। লাল, নীল, সবুজ ও খয়েরি রঙের নিরাপত্তা পাস দিয়ে ‘খেদমত জামাত’কে আন্তর্জাতিক নিবাসে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। মাঠের আশপাশে স্থাপিত পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও টহলের মাধ্যমে ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে।
ইজতেমায় যোগ দিতে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ নানা বাহনে করে মুসল্লিদের ঢল নামে। টঙ্গীর আবাসিক এলাকার আÍীয়স্বজনদের বাসা-বাড়িতে মুসল্লিরা ওঠে। এলাকার অলিগলি ও খোলা জায়গায় অস্থায়ী দোকানপাট এবং হোটেল তৈরি করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের জন্য বেশকিছু দোকানিকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।
র‌্যাবের নিরাপত্তা বেষ্টনী
ইজতেমার মাঠ ঘিরে তিন স্তরে র‌্যাবের ৮০০ সদস্য নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকবে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, হেলিকপ্টার টহল, ডগ স্কোয়াড ও ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘ইজতেমা ময়দানকে পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে র‌্যাবের বোম্ব স্কোয়াড, স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ডগ স্কোয়াড।
ইজতেমা ময়দান ও সংলগ্ন এলাকার নিরাপত্তা এবং নজরদারির সুবিধার জন্য ইজতেমা ময়দান ঘিরে র‌্যাবের অবজারভেশন পোস্ট থাকবে। মাঠে ছদ্মবেশে ও বিশেষ পোশাকে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল কালের কণ্ঠকে জানান, বিশ্ব ইজতেমায় র‌্যাবের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে নিñিদ্র করার লক্ষ্যে পুরো ইজতেমা সময়কালকে চার ভাগ করা হয়েছে। র‌্যাবের কমান্ড পোস্ট থেকে ইজতেমার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা হবে। নৌটহলের মাধ্যমে নদীপথেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে র‌্যাব।
ফ্রি ক্লিনিক উদ্বোধন
ইজতেমায় অংশ নেওয়া মুসল্লিদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে প্রায় ৬০টি প্রতিষ্ঠান ফ্রি ক্লিনিক বুথ স্থাপন করেছে। গতকাল হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ, জনকল্যাণ ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস সেবা কার্যক্রম শুরু করেছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজহান মিয়া এসব কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সে সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল ও টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমতউল্লা খান উপস্থিত ছিলেন।

নারীদের উচ্চশিক্ষায় আশার প্রদীপ জ্বলল বাংলাদেশে

শিয়ার নারীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়েছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রীকে এই অঞ্চলের ‘আশার প্রদীপ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত আচার্য (চ্যান্সেলর) ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেরি ব্লেয়ারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। এ সময় অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষক, অতিথি ও পৃষ্ঠপোষকেরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ২০০৮ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরতে ঢাকায় শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী সিম্পোজিয়াম। ‘এশিয়ার আরেক ভবিষ্যতের স্বপ্ন: পরিবর্তনের পথ ও চিন্তা’ শীর্ষক এই সিম্পোজিয়ামে বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিরা অংশ নিচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান ও স্বনামধন্য ব্যক্তিরা অর্থসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে উচ্চশিক্ষার মাইলফলক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা করেন, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন শুধু বাংলাদেশেই নয়, এশিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলা ভাষায় দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার আহ্বান জানান।
শেরি ব্লেয়ার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে এশিয়ার উত্থান হয়েছে। উন্নতির শিখরে উঠতে চাওয়া এশিয়ার ভিন্ন চেহারা রয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। দক্ষিণ এশিয়ায় মাতৃমৃত্যুর হার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও তারা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত।’
দরিদ্র নারীদের বাইরে রেখে এশিয়া সামনের দিকে এগোতে পারবে না—এমন মন্তব্য করে শেরি ব্লেয়ার আশা প্রকাশ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় নারীদের মধ্য থেকে ভবিষ্যৎ এশিয়ার নেতৃত্ব গড়ে তুলবে।
‘উচ্চশিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের একটি উপায়’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মালয়েশিয়ার বর্তমান ফার্স্ট লেডি দাতিন পাদুকা সেরি রোসমাহ মনসুর। হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে ও আলাপের ঢংয়ে তিনি এশিয়ার অঞ্চলের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষা নারীদের বৈশ্বিক সমস্যা গভীরভাবে বুঝতে ও এসব সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে সহায়তা করে।
জাপানের সাবেক ফার্স্ট লেডি আকিও আবে বলেন, প্রতিবছর সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে। তবে নারীর উন্নতি না হলে কখনো একে পরিপূর্ণ সাফল্য বলা যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, জাপানের মতো উন্নত দেশেও এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতের শীর্ষ পদে নারীদের অংশগ্রহণ কম।
দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন জাপানের সাবেক এই ফার্স্ট লেডি। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নারীদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে।
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সরকার শিক্ষাকে ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানের বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য সরকার আগে ১০৪ একর জমি দিয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৭০ কোটি টাকা মূল্যে অধিগ্রহণ করা ৪৭ একর জমি কিনে দিয়েছে। ভবিষ্যতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন শিক্ষামন্ত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব অ্যাডভাইজারের সভাপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে এই বিশ্ববিদ্যালয় আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এশিয়ার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এখান থেকেই গড়ে উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য কামাল আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সম্মিলিতভাবে কাজ করলে যে বড় কিছু করা যায়, তার বড় উদাহরণ এই বিশ্ববিদ্যালয়।’
উঁচুমানের উচ্চশিক্ষা ও সুনাগরিক গড়ে তুলতে এই বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে চলেছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জ্যাক মেয়ার বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাত যে সম্মিলিতভাবে কাজ করে সফলতা আনতে পারে, তার উদাহরণ সৃষ্টি করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীরা একটি ভিডিও তথ্যচিত্র ও নাটক পরিবেশন করেন। সিংহলি, তামিল ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের অবসানে তরুণ শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভূমিকা রাখছে, তা একটি নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাগত যে বৈষম্য এবং দ্বন্দ্ব আছে, তা নিরসনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখবেন বলে ঘোষণা দেন তাঁরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে কুয়েতের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মহাসচিব লুলওয়া আল-মুল্লাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য ইউনিভার্সিটি ২০১১’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
তৃতীয় পর্বে ‘সুশাসন, দারিদ্র্য, নিরাপত্তা ও পরিবেশে এশিয়ার আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কানাডার ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অমিত চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক সুগত বোস, ভারতভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিইসি) পরিচালক সুনীতা নারায়ণ ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান।
আজ শুক্রবার ও কাল শনিবার সিম্পোজিয়ামের বিভিন্ন পর্বে জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন কৃষি ও শিল্প বিপ্লব এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসা গবেষক ও শিক্ষকেরা এতে বক্তব্য দেবেন।
উদ্যোক্তারা জানান, একটি পৃথক আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশের ৪৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁদের ৯৯ শতাংশই শতভাগ বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। সংশ্লিষ্ট আইনটিতে এখানে বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করা বাধ্যতামূলক। তবে এখন স্থানীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। আগামী তিন বছরের মধ্যে এক হাজার ও সাত বছরের মধ্যে তিন হাজার ছাত্রীকে ভর্তি করানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর অর্ধেককে পুরোপুরি বৃত্তি দেওয়া হবে।

বখাটের মোটরসাইকেল চাপা দিল ছাত্রীকে: বাঁ পায়ের দুই হাড় ভেঙে গেছে

ঝোরে কাঁদছে আমেনা। এ কান্না পা ভাঙার অসহ্য ব্যথার জন্য নয়। হতদরিদ্র পরিবারের সংগ্রামী এ মেয়েটির এমন কান্না তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। আমেনার মর্মন্তুদ এ কান্নায় চোখ ভিজছে সহপাঠীসহ হাসপাতালে কর্তব্যরতদেরও।

কখনো নানিকে আবার কখনো প্রিয় বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আমেনা আর বারবার চিৎকার করে বলে উঠছে-‘আমার পা ব্যান্ডেজ করে দেন, আমার সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি ঢাকায় যাব না...।’
কিন্তু আশঙ্কাজনক শারীরিক অবস্থার কারণে চিকিৎসকদের কাছে হার মানল মেয়েটির নিদারুণ এ আকুতি। তাকে পাঠানো হলো ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। পড়ালেখা করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমেনার। কিন্তু বখাটের মোটরসাইকেলে আমেনার সঙ্গে চাপা পড়ল তার সেই স্বপ্নও।
দারিদ্র্যের কারণে ঘর ছেড়ে নানা-নানির কাছে আশ্রয় নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল আমেনা আক্তার। কিন্তু তার এ সংগ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়াল বখাটের উৎপাত। গতকাল বুধবার বখাটের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আমেনার বাম পায়ের দুটি হাড় ভেঙে ও লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। বড় ধরনের ও ব্যয়বহুল একটি অস্ত্রোপচারের জন্য আমেনাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু হতদরিদ্র আমেনার চিকিৎসার খরচ কিভাবে জোগাড় হবে, এ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক থাকায় আমেনা ছোটবেলা থেকেই নানা-নানির কাছে থাকে। দরিদ্র নানা-নানির সংসারে থেকেই গত বছর আমেনা এসএসসিতে ৪.৭০ পেয়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, গতকাল বুধবার দুপুরে উপজেলার নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একাদশ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী আমেনা আক্তার (১৭) সহপাঠীদের সঙ্গে পাশের ভদ্রাসন জিসি একাডেমির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল। তারা গুহবাড়ি এলাকায় পৌঁছলে মিজান আকনসহ তিন বখাটে ইচ্ছাকৃতভাবে আমেনাদের ওপর তাদের মোটরসাইকেল তুলে দেয়। এতে আমেনাসহ তিন ছাত্রী সড়কের পাশে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত আমেনাকে উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে কলেজের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক মিজানকে আটক করে। খবর পেয়ে বখাটেদের পরিচিত লোকজন এসে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে মিজানকে মোটরসাইকেলসহ জোর করে নিয়ে যায়। এ সময় বখাটেদের আক্রমণে আমেনার সহপাঠী হাবিবুর, শাওন, নাসির, জসিমসহ ১০ ছাত্র আহত হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে গাছ ফেলে শিবচর-শরীয়তপুর সড়ক অবরোধ করে। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তরিকুল ইসলাম ও শিবচর থানা পুলিশ এসে এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বখাটে মিজান পাশের জাজিরা উপজেলার সেনেরচরের ডেঙ্গর আকনের ছেলে। আমেনার বাবা হারুন মোল্লা ঢাকায় বাসের হেলপার ও মা পারভীন গার্মেন্টকর্মী।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমেনা বলে, ‘বন্ধু-বান্ধব মিলে পাশের একটি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ওর (মিজান) গাড়ি চালানো দেখে আমরা সড়কটির এক পাশে চলে যাই। এরপরও ও হেলেদুলে চালাতে চালাতে হাসতে হাসতে আমাদের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেয়। সামনে আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি মনে হয় আর পড়তে পারব না। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্বপ্নের শিক্ষক হওয়া আর হলো না আমার।’ আমেনার নানি জয়গুন্নেছা বলেন, ‘আমেনার ছোড সময় থিকাই পড়াশোনার ওপর ঝোঁক। তাই অনেক কষ্টের মধ্যেও আমার কাছেই রাইখা পড়াশোনা করাইতাছি। কী দিয়া ওর চিকিৎসা করামু?’
প্রত্যক্ষদর্শী আমেনার সহপাঠী রোকসানা, সাথী, রোকন, জাহিদ বলেন, ‘কলেজে যাওয়া-আসার সময় সব সময়ই বাইরের ছেলেরা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাত্রীদের বিরক্ত করে। আজ মিজানসহ তিন বখাটে খালি সড়কে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে ছাত্রীদের ওপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিয়েছে। এরপর মিজানকে মোটরসাইকেলসহ আটক করলে প্রায় ২০-২৫ বখাটে আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে ওকে ছিনিয়ে নেয়। হামলায় আমাদের ১০ ছাত্র আহত হয়েছে। অবরোধকারী ছাত্ররা অভিযোগ করে, একদিকে ইভ টিজিং করল, এরপর প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর হামলা করল। আমেনা সম্পূর্ণ সুস্থ ও উপযুক্ত বিচার না হলে আমরা সামনে কঠোর আন্দোলনে নামব।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. অশোক কুমার ভৌমিক বলেন, ‘মেয়েটির বাম পায়ের দুটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে ও হাড় ভেঙে গেছে। দ্রুত উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারলে মেয়েটি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।’ নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘এত বড় একটি ঘটনা ঘটার পর আবার ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে ওরা। শিক্ষার্থীদের আপাতত আশ্বাস দিয়ে অবরোধ তুলেছি। কিন্তু এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও আমেনার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না হলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে পারে।’ তদন্তকারী কর্মকর্তা শিবচর থানার এসআই মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি ইভ টিজিংয়ের চেয়েও ভয়াবহ। মিজানসহ বখাটেরা সম্পূর্ণ ইচ্ছা করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি।’

উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ ৩ কোটি মানুষ রক্ষায় সক্রিয় একাধিক এনজিও

লবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষায় কাজ শুরু করেছে একাধিক বেসরকারি সংস্থা। কিন্তু এসব সংস্থার কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য উপকূলীয় অঞ্চলের জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে মতামতের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা করা উচিত ছিল।

কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির মুখে পড়া এলাকার মানুষদের সাথে কথা না বলেই যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে তাতে শেষ পর্যন্ত উপকূলকে রক্ষা করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বেসরকারি সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা। দক্ষিণ উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে কোস্টট্রাস্ট, হিউম্যানিটিওয়াচ, সিএসআরএল, আভাসসহ একাধিক বেসরকারি সংস্থা।

কোস্টট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী ইত্তেফাককে জানান, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গরিব দেশগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। অথচ এজন্য এসব হতদরিদ্র দেশগুলো কোনভাবেই দায়ী নয়। গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য অধিকতর দায়ী ধনী দেশগুলো এখনো কোন দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় উপকূলের বাসিন্দারা হতাশ। তার চেয়েও হতাশার খবর জলবায়ু পরিবর্তনের কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা সরকারিভাবে ইংরেজীতে প্রকাশ করা হয়েছে। যা ভুক্তভোগী অঞ্চলের মানুষ বুঝতে পারছে না। ইকু্যইটি অ্যান্ড জাস্টিস ওয়াকিং গ্রুপ এই কৌশলপত্র বাংলায় ভাষান্তর করে বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মশালার উদ্যোগ নিয়েছে। গত সপ্তাহে বরিশালে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় সরকারি ঐ কৌশলপত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ আমিনুল হকসহ একাধিক বক্তা। ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করতে গিয়ে সংসদ সদস্য তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতিত যে কোন কর্মপরিকল্পনা ও কৌশলপত্র কাজে আসবে না। তিনি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মতামত নিয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের পরামর্শ দেন।

তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২ দশমিক থেকে ৪ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য এবং পুষ্টিহীনতায় অতিরিক্ত ৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ আদায়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাবী উত্থাপন করতে হবে। ইউনিসেফ'র বরিশাল বিভাগীয় প্রধান এএইচ তৌফিক আহমেদ আন্তর্জাতিকভাবে কৌশল নির্ধারণের দাবী জানিয়ে বলেন, সবচেয়ে বেশি আশংকায় পড়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা। উপকূলীয় এলাকার ১৯টি জেলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের মত নেপাল, মালদ্বীপসহ দরিদ্র দেশগুলোর এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক এনজিও ব্যক্তিত্ব।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর দাবী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলের লাখ লাখ মানুষের জীবন-যাপন হয়ে উঠবে আরো দুর্বিষহ,কঠিন। বাংলাদেশের উপকূল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে যে হারে বরফ গলছে তাতে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরো পাঁচ ফুট বাড়বে। নতুন এই পরিসংখ্যান বিগত দিনের পরিসংখ্যানগুলোর প্রায় দ্বিগুণ। আর এই পরিসংখ্যান সত্যি হলে উপকূলের অবস্থা হবে সবচেয়ে শোচনীয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে ৫ ফুট পানি বাড়লে বাংলাদেশের একপঞ্চমাংশ অর্থাৎ উপকূলের ১৯টি জেলা তলিয়ে যাবে। ফলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ হবে গৃহহীন, একই সঙ্গে কমে যাবে ফসল উৎপাদন, বাড়বে রোগ-বালাই। ফলে উপকূলের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কোটি কোটি মানুষ এখন তাকিয়ে আছে উন্নত বিশ্বের দিকে। তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় ও উপকূল রক্ষায় সঠিক কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে না পারলে উপকূলকে কোনভাবেই রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

সেভ দ্যা চিলড্রেন জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এবং একই সঙ্গে শিশুশ্রম বাড়বে। ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে শিশু পাচার এবং বাল্যবিবাহ বাড়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। গ্রামীণ জনউন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মহিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র প্রণীত হলেও ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও নির্বাচনী ইশতিহারের আলোকে রাষ্ট্রীয় দলিলের পরিমার্জন করা হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নে এ ধরনের পরিকল্পনা অপরিহার্য। কিন্তু উপকূলের মানুষ রক্ষায় খাদ্য নিরাপত্তা সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে কৌশল নির্ধারণ প্রয়োজন। তিনি উপকূলীয় জেলার মানুষের সাথে কথা বলে নতুন কৌশল নির্ধারণের দাবী জানান।

বছরজুড়ে বেরসিক বাজারদরে জনগণ ছিল দিশেহারা by রেজাউল করীম

ভাতহীন সংসারের শেষ বাসন ভাঙ্গার মত বছর জুড়ে বেরসিক অপ্রেমে জনগণের হূদয় ভেঙেছে বাজার দর। সব পণ্যের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চালের দাম। আটা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, আলু, গুঁড়ো দুধ, ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে সমানে পালস্না দিয়ে।

আর দামের এই পাগলা মাতমে জনগণ ছিল দিশেহারা। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম শুনেই দিশেহারা হয়ে ওঠেছেন। বছরের শেষদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ার ফলে স্থানীয় বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সরকারের নেয়া উদ্যোগ বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের নিন্ম আয়ের লোকদের আয় বাড়ছে না। তাদের আয়-উপার্জন প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়ছে।

অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে না। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিন্মবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষকে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছে। গত এক বছরে সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হলেও সরকার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে তা নামিয়ে আনতে পারেনি। কাগজে-কলমে মুল্যস্ফীতি কমে এলেও বাজারে তার চিত্র ছিল উল্টো। বাজারে প্রতিদিনই বেড়েছে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, ১২ মাসের গড় ভিত্তিতে গেল অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১২ শতাংশে।

গত বছরের অক্টোবরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১০ জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা গতবছর (২০০৯) জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ২০১০ ফেব্রুয়ারিতে ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০০৯ এই সময়ে তা ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, ২০১০ মার্চ ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা ২০০৯ মার্চে ছিল ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, ২০১০ এপ্রিলে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০০৯ এপ্রিলে ছিল ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২০১০ মে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা গত বছরের মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। বছরের পাঁচ মাস মুল্যস্ফীতি কমে আসার পর তা পরের মাসগুলোতে বাড়তে থাকে। জুন-জুলাইয়ে তা বেড়ে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ গিয়ে দাঁড়ায়, ২০০৯ সালে ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আগস্টে ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা গত বছররে আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৮ দশমিক শতাংশ যা ২০০৯ সেপ্টেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।

ডিসেম্বরে কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি হারে। সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার যে প্রত্যাশা করেছিল তা পূরণ হয়নি, বরং মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে খাদ্যদ্রব্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের ওপর থাকার কারণেই মূল্যস্ফীতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে কয়েক মাস ধরে শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হারে বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির এ প্রবণতা গ্রামের নিন্মআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলেছে।

২০১০ সালের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা by অর্কপ্রভ দেব

সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না।

বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিগুলোতে মন্দা চলছে। এ অবস্থা থেকে বিশ্ব অর্থনীতি কবে মুক্তি পাবে - এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসও এখন বাস্তবতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। বেকার সমস্যা প্রকটভাবে বিরাজ করায় গত নভেম্বরে বিশ্ব অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। ইউরোপে ইউরোজোনের পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, ইতালী, ফিনল্যান্ডসহ ১৬টি দেশের অর্থনীতিতেই এখন টালমাটাল অবস্থা। জার্মানী একটু ভাল অবস্থায় থাকলেও অন্যদের মন্দা মোকাবেলায় ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংককে চাঁদা দিতে দিতে তারাও ক্লান্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরোজোনের বাইরে থাকা ব্রিটেনসহ ১১টি দেশের অর্থনীতিও ভাল অবস্থায় নেই। সবাই ব্যয় সংকোচন করছে। ব্রিটেনে বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভাঙচুর, অগি্নসংযোগকেও হার মানিয়েছে। মন্দাকবলিত প্রায় সবগুলো দেশেই পেনশন ভাতা কমানো হয়েছে। জাপান শত চেষ্টা করেও তাদের অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে পারছে না। এখন সরকার প্রায় শত কোটি ডলার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে গেলে তা কীভাবে সামাল দেবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন একটু ভাল অবস্থায় আাছে। তবে ইতোমধ্যেই চীনের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ স্পর্শ করেছে। ধনী-গরিব বৈষম্য আরো বেড়েছে। উচ্চ বেতনের চাকরির আশায় লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শিল্পসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বমন্দার অভিঘাত সহ্য করেও সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি আশাপূর্ণ অগ্রগতি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বিশ্বে যে বিশটি দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গত নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন_২০১০ অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে। উন্নয়ন ধারার দিক থেকে ৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। কয়েকদিন আগে অর্থনীতিবিষয়ক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী 'দ্যা ইকোনোমিস্ট'-এর মর্যাদাপূর্ণ 'ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট ইনডেস্ক ২০১০' প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বগণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ৮৩ তম। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম।

বাংলাদেশের অর্থনীতির এ ভাল অবস্থায় বড় অবদান রেখেছে রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। গত বছর বিশ্বের আমদানি-রফতানি তার আগের বছরের তুলনায় ১২.২ শতাংশ কমেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় পতন। বিশ্বের রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ। মাত্র ১২টি দেশ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১,৬২০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। ২০০৮-০৯-এ হয়েছিল ১,৫৫৬ কোটি ডলার। ৪.১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমান ২০১০-১১ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৮২৮ কোটি ডলার। যা বিগত অর্থবছরের এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। আগামী জুন পর্যন্ত এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে চলতি অর্থবছরে রফতানি আয় ২,২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভাল অবস্থায় আছে। মন্দার কারণে ২০০৯ সালে বিশ্ব আমদানি ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের আমদানি ৫.৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ কোটি ডলার। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। এ ব্যয়ের একটা বড় অংশই হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। এটি আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাংলাদেশের রফতানিপণ্যের সংখ্যা বেশি নয়। প্রায় আড়াই দশক ধরে রফতানি ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। প্রতি বছরই রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাতের অবদান বাড়ছে। গত বছর ১,৬২১ কোটি ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে ১,২৫০ কোটি ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যান্য পণ্য থেকে এসেছে মাত্র ২৩ শতাংশ আয়। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্কের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। আমদানিকারক দেশগুলোতে ব্যাপক মন্দা সত্ত্বেও সরকার ও তৈরি পোশাক উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কারণে দেশ এ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সরকার বিশ্বমন্দার প্রভাব মোকাবেলা করে রফতানিমুখী খাতগুলো যাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে সে লক্ষ্যে প্রথম প্যাকেজে নীতি প্রণোদনাসহ ৩,৪২৪ কোটি টাকা দিয়েছে। দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ২,০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ঔষধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ ম্যানুফেকচার্ড পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, কৃষিপণ্য, জাহাজ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টিতে সরকার তৎপর রয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে অর্থনৈতিক কূটনীতিমুখী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য রফতানি বাজারে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বিনিয়োগবান্ধব শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিল্পনীতিতে ৩২টি খাতকে থার্স্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোতে বিনিয়োগ করলে কর মওকুফসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তবে গার্মেন্টস খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান শক্তি এ খাতে নিয়োজিত প্রায় ৩৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। যার অধিকাংশই নারী। সাম্প্রতিককালে নতুন বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশকিছু গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের নামে কিছু অনভিপ্রেত উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা গেছে। যদিও সরকার অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গার্মেন্টস খাতে নূ্যনতম মজুরি ২০০৬ সালের ১,৬৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছে। এসবের পিছনে কার কী দূরভীসন্ধি কাজ করছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের মনিটরিং জোরদার করা দরকার। শিল্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে আগামী দিনগুলোতে উৎপাদন ও রফতানি প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। নতুন বিনিয়োগও হবে। বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের অর্থনীতি দৃঢ় হবে।

দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বমন্দা অবস্থায়ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্পঋণ সহজলভ্য করা হয়েছে। ফলে ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিল্পঋণ বিতরণে আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে। ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১,০৯৫ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি প্রধান খাত জনশক্তি রফতানি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসীরা ৯৬৯ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিটেন্স আয়ে ১৩.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ১,০৯৯ কোটি ডলার অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর রেমিটেন্স এসেছিল মাত্র ৪৪৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৫৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। প্রবাসীরা যাতে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে উদ্বুদ্ধ হয় সে লক্ষ্যে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাচ্ছেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ পদ্ধতি সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের পথ এখন অনেক সুগম হয়েছে। তাদের এবং দেশে তাদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। প্রবাসে গমনেচ্ছুরা এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন। এতে তাদের পাসপোর্ট, ওয়ার্ক-পারমিট ইত্যাদি যথাযথ আছে কি না তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রতারিত হওয়ার পথ বন্ধ হবে। এর ফলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হয়েছেন। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মন্দার কারণে কোনো কোনো দেশে জনশক্তির চাহিদা কমে গেছে। জনশক্তি রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকারকে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সরকারের সাথে নিরন্তর আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিক রফতানি সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে হবে।

রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও বেশ সন্তোষজনক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট ৭৮,০৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় ১৬.৭ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে ৯২,৮৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে আয় হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এ আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২.৬ শতাংশ বেশি। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেট বরাদ্দের শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার এবং জবাবদিহিমূলক ব্যব্স্থা নেয়া হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন গত বছরের চেয়েও এ বছর দ্রুততর হচ্ছে। নতুন মজুরি কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে।

নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আছে এবং এটা স্বাভাবিক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩ শতাংশ। এখন তা ৭.৮ শতাংশ এবংয় ঊধর্্বমুখী। এখন বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতি চলছে। কোনো কোনো দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এর প্রধান কারণ, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ছয় মাসে বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার দাম ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। চালের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। সয়াবিনের দাম গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত অক্টোবরে ভারতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে এসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.১৩ শতাংশে। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ। নেপালে ১৩.২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১১ শতাংশ। সার্কভুক্ত দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মূলে আছে কৃষি উৎপাদনে আমাদের ব্যাপক সাফল্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর আগের বছর হয়েছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন। গত মৌসুমে আমন ধানের ফলনও খুব ভাল হয়েছে। উৎপাদন এক কোটি ৩১ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। শাক-সবজি, আলু, পিঁয়াজ, ডাল, ফল, পাট, রবিশস্য সব ফসলের উৎপাদনই গত দুই বছরে অনেক বেড়েছে। এর মূল কারণ সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি। সরকার ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে ইউরিয়া সার আমদানি করে কৃষককে দিচ্ছে কেজি ১২ টাকায়। অন্যান্য সারের দাম এ দুই বছরে তিনবার কমিয়েছে। ২০০৮ সালে যে টিএসপি ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হতো কেজি ৬৫ টাকায় এখন ডিলাররা তা পাচ্ছে ২০ টাকায়। ডিএপি'র দাম ছিল ৮৫ টাকা কেজি। এখন ডিলাররা পাচ্ছে ২৫ টাকা কেজি। ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। কৃষি উপকরণ দেয়ার জন্য এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি কার্ড দেয়া হয়েছে। এখন কৃষক ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারছে। সরকার কৃষকদেরকে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। গত অর্থবছরে সরকার কৃষকদের মধ্যে ১১,১১৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ৩,৬০৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত জমি, অতি খরা, হঠাৎ বন্যা , সহনীয় বীজ উদ্ভাবনে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে পতিত জমি আবাদী জমিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব উদ্যোগ কৃষকের মধ্যে উৎপাদন বাড়ানোর প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না। সে লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে

স্পেনে বেকারত্ব বাড়ছে by শফিকুর রহমান রয়েল

স্প্যানিশ এমপস্নয়মেন্ট অফিসগুলোর সামনে এতোটা লম্বা লাইন আর কখনোই দেখা যায়নি। ২০০১ সালে বিভিন্ন বাহিনীতে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের পর থেকে এই প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যাও পরিপূর্ণ। বন্দুক বেছে নিয়ে আফগানিস্তানে বোমার মুখে পড়াটাকেই বেকারত্ব নিরসনের সবচে কার্যকরী উপায় বলে মনে করা হচ্ছে স্পেনে।

কারণ, সেখানে ৪০ লক্ষ লোক এখন বেকার। গত অক্টোবরে বেকারত্বের হার আরেক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ এ সময়টায় বেকারত্ব কমার কথা। শুধু এ মাসেই যুক্ত হয়েছে ৩৬ হাজার নতুন বেকার। ধারণা করা হচ্ছে, স্পেনে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশে পেঁৗছুতে পারে।

২৪ মাস আগে বেকারত্ব যখন বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করলো, তখন সমাজতন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী জোসে লুইস রডরিগুয়েজ জাপাটেরো ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন, ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু ২০১০ সাল শেষ হয়ে যেতে থাকলেও তার কোন লক্ষণ নেই। ব্যাংক অব স্পেন বলছে, ২০১১ সালের দ্বিতীয়ার্ধের আগে বেকারত্ব কমার কোন সম্ভাবনা নেই। আর সে নাগাদ এর হার ২০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। এসব শুনে স্প্যানিয়ার্ডরা আতংকিত।

বর্তমানে কাজ না থাকায় সুবিধা গ্রহণ করে ৩০ লাখ ২০ হাজার লোক। ৪ লাখেরও বেশি দীর্ঘকালীন বেকার প্রতিমাসে গ্রহণ করে মাত্র ৪২৬ ইউরো। অভিবাসী ও তরুণদের অবস্থা বেশি খারাপ। স্পেনে পঁচিশ অনূধর্্বদের চলিস্নশ শতাংশেরই কোন কাজ নেই। যা কিনা মহামন্দা আক্রান্ত ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ। রোমান ক্যাথলিক চ্যারিটি 'কারিতাস' -এর মহাসচিব সেবাস্তিয়ান মোরা জানিয়েছেন, স্পেনে তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া লোকের সংখ্যাটা গত দুই বছরে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০০৮ সালের শেষে বেকারের সংখ্যাটা প্রথমবারের মতো যখন তিন মিলিয়নে পেঁৗছুলো, তখন ট্রেড ইউনিয়নের এক সিনিয়র কর্মী বলেছিলেন, ৪ মিলিয়নে পেঁৗছুলে স্পেনে সামাজিক বিপস্নব ঘটে যাবে। রক্ষণশীল অনেক পন্ডিতই মন্তব্য করতে দ্বিধান্বিত হননি যে, এতে করে স্পেনের রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে যেতে পারে। বেকারদের সংখ্যা ৪ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে ঠিকই, কিন্তু সামাজিক বিপস্নব দাঙ্গা-হাঙ্গামার কোন চিহ্ন নেই। এর অবশ্য একটি কারণ রয়েছে। স্পেনের লোকেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পুলিশের চাকরিটাকে তারা বেশ সম্মানজনক মনে করে। পুলিশের প্রতিটি চাকরির জন্য আবেদনপত্র জমা পড়ে গড়ে ত্রিশটি।

ঐতিহাসিকভাবেই স্পেনের লোকজন বেকারত্ব সম্পর্কে সহনশীল। দৃঢ় পারিবারিক নেটওয়ার্ক বেকারদের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আবার সব বেকারেরই যে কাজ নেই, একথা ঠিক নয়। স্পেনের তেজস্বী ও বর্ধিষ্ণু গুপ্ত (কালো) অর্থনীতির কথা সবাই জানে। ট্যাক্স, ইন্সপেকটরস ইউনিয়ন গেসথা'র তথ্যানুযায়ী, জিডিপিতে গুপ্ত অর্থনীতির অবদান ২৩%। গত বছরও তা বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৭ শতাংশ। অনেক বেকারই প্রাতিষ্ঠানিক কাজে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয়। বছরের পর বছর গ্রহণ করছে বেকর ভাতা। স্থায়ী কাজ গ্রহণেও অনেকের রয়েছে অনীহা। কাজেই বেকারত্বের হার সত্যিই কতো, তা বলা খুব মুস্কিল। অন্তত এটুকু বলা যায় যে, সমস্যাটাকে যতোটা তীব্র ভাবা হচ্ছে, আসলে ততোটা নয়।

ইউরোপের মধ্যে স্পেনে শ্রমবাজার সবচে অস্থির। মহামন্দা শুরুর পর থেকে এখানে মানুষ চাকরি হারিয়েছে খুব দ্রুত। কিন্তু তার আগের পরিস্থিতিটা ছিলো যেনো উল্টো; সৃষ্টি হচ্ছিলো অসংখ্য চাকরি, বিশেষত নির্মাণ ক্ষেত্রে। কিন্তু অগণিত বাড়ি অবিক্রীত থাকাতে নির্মাণ শিল্পের অবস্থা এখন করুন। সেজন্যেই স্পেনে বেকারত্বের হার বাড়ছে আমেরিকা ও আয়ারল্যান্ডের চেয়েও দ্রুতগতিতে। স্পেনে ছাঁটাই করাটা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ।

স্পেনের একটি ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, দ্বি-স্তর বিশিষ্ট শ্রমবাজারের কারণেই চাকরি হারানোর ব্যাপারটা অহরহ ঘটছে। স্পেনে চাকরি প্রাথর্ীদের এক-তৃতীয়াংশই গ্রহণ করে অস্থায়ী চাকরি। বাকিরা আবদ্ধ হয় স্থায়ী চুক্তিতে। অস্থায়ী শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়া যায় জরুরি নোটিসের ভিত্তিতে। ঠিকমতো ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না এসব দেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মিগুয়েল এ্যাঞ্জেল ফার্নান্দেজ অর্দোনেজ দাবি জানিয়েছেন শ্রম আইন সংশোধনের।

স্পেনের কার্লোস থ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমিলিয়ানো কালর্ুসিয়ানো বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে বের করেছেন ভিন্ন তথ্য। স্পেনে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট শ্রম বাজারের পেছনে কাজ করছে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট শিক্ষা। ইউরোপের অন্যান্য বড় দেশগুলোর মতোই এখানে উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে,কিন্তু ৩০ শতাংশ স্প্যানিয়ার্ডই স্কুল ছাড়ে কোন যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই। যা কিনা ইউরোপের অন্যঅন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। স্কুল ছাড়া তরুণরা চাকরির বাজারে গিয়ে দারুণ সমস্যার মুখে পড়ে। চাকরি খুঁজে পাওয়াই তাদের জন্য মুস্কিল হয়ে দাঁড়ায়। কোনোমতে একটি পেলেই তাতে লেগে পড়ে। সেই চাকরিটি স্থায়ী না অস্থায়ী সেই চিন্তা করে না। আর সে কারণেই স্পেনের লোকজন সেনাবাহিনীতে ঢোকার জন্য এতোটা উদগ্রীব। কারণ সেখানে তো আর মাস্টার্স ডিগ্রীর প্রয়োজন পড়ে না। অন্যান্য বাহিনীর বেলাতেও ঠিক একই অবস্থা। যা সাধারণত দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। সেনা সদস্য হওয়ার জন্য লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে।