Friday, January 21, 2011

প্রান্তজনের মানবাধিকার স্থানীয় সরকারের ভূমিকা by পারভীন আফরোজা

বাংলাদেশে বসবাসরত বেশীর ভাগ মানুষের জীবনে স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সাধারণ মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে বিভিন্নভাবে এই স্থানীয় সরকার ভূমিকা রাখতে পারে। নিজ নিজ এলাকায় মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, কাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এই স্থানীয় সরকারের কাজ করে থাকে।

যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রতি সরকার প্রদত্ত কিছু দায়িত্বভার রয়েছে। তবে সেই সকল দায়িত্ব পালনে স্থানীয় সরকারের দক্ষতা কতটুকু এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। আমি বলতে চাই না যে তারা কোন কাজ জানে না। অবশ্যই তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের সাধ্যমত দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে জনতার কল্যাণে তারা অবশ্যই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে থাকেন। তবে কথা হলো হাল হাতিয়ার ছাড়া একজন মানুষ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনতে পারে সেটা একবার ভেবে দেখুন। এদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ লোক গ্রামে বাস করে যাদের জন্য কাজ করছেন চেয়ারম্যান এবং মেম্বারা, যারা তৃণমূল মানুষের কল্যাণের জন্য দায়বদ্ধ। একই সাথে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বাস শহরে যেখানে জনপ্রতিনিধি হলেন কমিশনারবৃন্দ। একই ভাবে সমগ্র মানুষের কল্যাণের জন্য কয়েকজন প্রতিনিধির পক্ষে কতটুকুই বা কল্যাণ করা সম্ভব। এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগণের সংখ্যাই বেশী এবং এই প্রান্তিক গোষ্ঠী যাদের মধ্যে প্রতিবন্ধী, অসহায়, হতদরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার অগণিত মানুষ রয়েছেন যাদের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে এই স্থানীয় সরকারের কাজ করার কথা। তারা সরকারিভাবে যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে সেটা জনতার কল্যাণের জন্য করলে মনে হয় এ যেন উত্তাল সমুদ্রে একবিন্দু জলসম। বহু ঘটনার সাথে এই জনপ্রতিনিধিদের জড়িত হতে হয়। যেমন নারী ও শিশু নিযর্াতন, জখম, জলাভূমি, ঘরবাড়ি, কৃষি জমি জবর দখল থেকে মুরগী মরা, গরু-ছাগল খোঁয়াড়ে দেয়া পর্যন্ত তাদের শালিস বিচারের আওতায় পড়ে। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, গ্রাম আদালত বা শালিস মীমাংসায় তাদের অনেক বেশী সময় ব্যয় করতে হয়। সেক্ষেত্রে গ্রাম বা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সেই সকল বিচারে অংশগ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাদী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ হলে এবং বিবাদী যদি বিত্তবান হয়ে থাকে তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচার পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ এর জন্য বিত্তশালী ব্যক্তিটি বিভিন্নভাবে নাগরিক পরিসরকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে। এমন কি বিভিন্নভাবে অনেকেই ইলেকশনে অর্থসহ অন্যান্য সহযোগিতা করার টোপ দেখিয়ে বিচার ব্যবস্থায় বৈষম্য ঘটিয়ে থাকে। নিযর্াতিত হবার পরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই বিচার পায় না বরং তারা বঞ্চনার শিকার হয়। সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকরা অনেক ক্ষেত্রেই অসচেতন, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বঞ্চনার স্বীকার হয়ে থাকে। পদে পদে তাদের মানবাধিকার লংঘন হতে থাকে। দেখা যায় বয়স্ক ভাতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবর্তে বিত্তশালীর ঘরে উঠছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সমপ্রতি ইউনিয়ন পরিষদের জন্যে একটা আইন হয়েছে তবে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে অনেকেই দুনর্ীতিবান্ধব বলে থাকেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না। এখনও সময় আছে। জনগণের জন্য ভাল কিছু করার এবং অনেকেই তা করছেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনেক কার্যক্রম রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি যেমন কাবিটা, ভিজিডি, কাবিখা, ভিজিএফ, টিআর চালু আছে। এই সকল কর্মসূচীর মাধ্যমে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বন্টনের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের। এর জন্য রয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও নির্বাহী আদেশ। অথচ এই নীতিমালা ও আদেশকে উপেক্ষা করে স্থানীয় সরকারের অনেক সদস্যই করছেন স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, দুর্নীতি। প্রকৃত অর্থে সুবিধাসমূহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পেঁৗছাচ্ছে খুবই কম। এতে কেবলমাত্র স্থায়ীয় সরকার প্রতিনিধির দোষ দেয়া যাবে না। এতে জড়িত আছেন অনেক প্রভাবশালী লোক। এর ফলে অসহায়রা চিরজীবন অসহায় রয়েছেন। বিত্তবানের বিত্ত ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। স্থানীয় সম্পদ ও সেবার অধিকার থেকে দরিদ্র জনতা হচ্ছেন বঞ্চিত।

মনের ভেতর থেকে যতদিন পর্যন্ত মানুষকে ভালোবাসার সদিচ্ছা আমাদের মধ্যে জাগ্রত না হবে ততদিন আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না এবং দেশের মানুষের অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের দেশে বাজেট বরাদ্দ, প্রকল্প প্রণয়ন প্রভৃতি কার্যক্রমের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সংশিস্নষ্ট করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সমপ্রতি আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এর পূর্ণ বাস্তবায়ন যেদিন সম্ভব হবে সেদিন সত্যিকারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। স্থানীয় সরকার অনেক ক্ষেত্রেই জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন এবং কেউ কেউ রাখছেনও। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা রোধ, ইভটিজিং রোধ, নারী ও শিশু নিযর্াতন রোধে স্থানীয় সরকারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের দক্ষতা সদিচ্ছা আমাদের দেশে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তাদের তৎপরাতে আমাদের সুবিধাবঞ্চিত জনগণ উন্নয়নের মুখ দেখবেন বলে আশা করি। নিযর্াতিত ও সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার রক্ষার তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। থানা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সাথে গ্রাম আদালত ও সালিশ পরিষদ কার্যকর করত সমন্বয় সাধন করতে হবে। এই সালিশে বা গ্রাম আদালতে যাতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয় এবং কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিবর্গকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কাজের বিস্তারের জন্য পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং জনবল নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের লক্ষ্যে সেবাসমূহের তথ্যকে উন্মুক্ত করে দিলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। বিনা দোষে ভিক্টিমকে চুল কেটে দেয়া, দোররা মারা, হিলস্না বিয়ে, বেত মারা, একঘরে করে দেয়া চলবে না। আসামীকে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় ফেলতে হবে।

No comments:

Post a Comment