Wednesday, February 23, 2011

বিমান থেকে জনতার ওপর বোমা

লিবিয়ায় বিক্ষোভ-সহিংসতা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চল সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী ও বিদ্রোহী সেনাদের দখলে চলে গেছে। বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতেরা বিক্ষোভকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। এদিকে বিক্ষোভ দমনে ট্যাংক-যুদ্ধবিমানসহ সামরিক বহর মোতায়েন করেছেন দেশটির নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি। যুদ্ধবিমান থেকে বোমাও ফেলা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের ওপর।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে গাদ্দাফি বিক্ষোভকারীদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজের সমর্থকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। খবর এএফপি, রয়টার্স, বিবিসির। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা টেলিভিশন জানায়, গত সোমবার রাতে ও গতকাল সকালে রাজধানী ত্রিপোলি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। এ ছাড়া হেলিকপ্টার ও ট্যাংক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে।
ত্রিপোলির বাসিন্দা আবদেল মোহাম্মদ সালেহ একটি বিদেশি টেলিভিশনকে বলেন, যা ঘটছে তা অকল্পনীয়। যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে একের পর এক বোমা ফেলা হচ্ছে। অনেক মানুষ মারা গেছে।
পূর্বাঞ্চলীয় শহর আল-বায়দার এক বাসিন্দা টেলিফোনে রয়টার্সকে জানান, সোমবার রাতে গাদ্দাফি-সমর্থকদের নির্বিচার গুলিতে তাঁর ভাইসহ ২৬ জন নিহত হয়। এ ছাড়া ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।
ওই শহরের আরেক বাসিন্দা মাহরি বলেন, ‘চাই বা না চাই, আমাদের এখন মরতেই হবে। এটা পরিষ্কার যে, আমাদের মরা-বাঁচায় তাদের কিছু যায়-আসে না। এটা গণহত্যা।’ শুধু ত্রিপোলি, বেনগাজি, আল-বায়দা নয়, দেশজুড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলে পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও গাদ্দাফির সমর্থকেরা।
পূর্বাঞ্চলীয় তবরুক শহর থেকে রয়টার্সের এক সাংবাদিক জানান, ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর হ্যানি সাদ মারজা বলেন, ‘পুরো পূর্বাঞ্চল এখন গাদ্দাফির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখানে জনগণ ও সেনাবাহিনী হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।’
ফাসলুম জেলা থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ‘ভাড়াটে খুনিদের’ নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা নির্বিচারে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছুড়ছে। তাজুরা জেলা থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সেখানেও বন্দুকধারীরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।
ভারতে লিবিয়া দূতাবাস থেকে পদত্যাগকারী রাষ্ট্রদূত আল-এসাওয়ি জানান, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা চালাতে সরকার যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য সরকার বিদেশি নাগরিকদের ভাড়া করছে।
এর আগে জাতিসংঘে নিয়োজিত লিবিয়ার উপরাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম দাব্বাসি জানান, গাদ্দাফি নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করেছেন।
তবে গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলামের দাবি, বিক্ষোভকারীদের ওপর নয়, বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করেই যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন গাদ্দাফি। কোনো অবস্থাতেই পদত্যাগ করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমার দেশ। নিজের শেষ রক্তবিন্দু ঝরে পড়া না পর্যন্ত আমি লড়াই করে যাব। পিতৃপুরুষের এই মাটিতে আমি শহীদ হব।’
বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে নিজের সমর্থকদের নির্দেশ দিয়ে গাদ্দাফি বলেন, ‘ওই ইঁদুরগুলোকে ধরে ফেল। রাস্তায় নেমে আস, তাদের যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই গুঁড়িয়ে দাও।’
বিক্ষোভকারীরা ‘শয়তানের স্বার্থসিদ্ধির’ জন্যই কাজ করছে জানিয়ে গাদ্দাফি বলেন, যারা বিক্ষোভ করছে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
ত্রিপোলিসহ গোটা লিবিয়ার অবস্থা গতকাল ছিল থমথমে। ত্রিপোলিতে তেমন কোনো বড় বিক্ষোভ হয়নি। তবে রাজপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টহল দেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী। বেনগাজি পুরোপুরি বিদ্রোহীদের দখলে। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন।
ত্রিপোলির বাসিন্দা লিসা গোল্ডম্যান বলেন, ‘গাদ্দাফি যা খুশি তা-ই করতে পারেন, কোনো কিছুতেই তাঁর বাধে না। আমরা জানি, তিনি উন্মত্ত। তার পরও এটা খুবই দুঃখজনক যে, তিনি নিজের দেশের মানুষ মারছেন। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের কচুকাটা করছেন।’
গাদ্দাফি দাবি করেছেন, বিক্ষোভের মুখে তিনি দেশ ছেড়ে যাননি, রাজধানী ত্রিপোলিতেই আছেন। গাদ্দাফির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তিনি (গাদ্দাফি) দেশ ছাড়বেন না এবং পদত্যাগও করবেন না। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন। গত সোমবার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় লিবিয়া সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তুমুল বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে লিবিয়ার মানুষ। এতে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে সোমবার রাজধানী ত্রিপোলিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিতে মারা যায় ৬০ জনের বেশি।
সোমবার রাত দুইটার দিকে হঠাৎ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা যায় গাদ্দাফিকে। একটি ভাঙাচোরা ভবনের পাশ থেকে তিনি গাড়িতে গিয়ে উঠছেন। এ সময় বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাথার ওপর একটি ছাতা ধরে আছেন। টেলিভিশন জানায়, গাদ্দাফিকে সরাসরি দেখানো হচ্ছে। এর আগে গুজব ছড়িয়ে পড়ে তিনি ভেনেজুয়েলায় পালিয়ে গেছেন।
টেলিভিশনে এক মিনিটের মতো কথা বলেন গাদ্দাফি। তিনি বলেন, ‘আমি গ্রিন স্কয়ারে তরুণদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’ এই স্কয়ারটি ত্রিপোলির উপকণ্ঠেই অবস্থিত। সেখানে ওই দিন বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়।
গাদ্দাফি আরও বলেন, ‘এ কথা প্রমাণ করার জন্যই এসেছি যে আমি ত্রিপোলিতেই আছি, ভেনেজুয়েলায় নয়।’
গাদ্দাফির অন্যতম শীর্ষ সহযোগী নূরি আল-মিসমারি প্যারিসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গাদ্দাফি ক্ষমতা থেকে সরেও দাঁড়াবেন না, দেশও ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন।
এদিকে হাজার হাজার বিদেশি ত্রিপোলি ছাড়ার চেষ্টা করছে। দেশটির বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাজার হাজার চীনা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লিবিয়া সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন।
তুরস্ক তাদের প্রায় তিন হাজার নাগরিককে সরিয়ে নিতে লিবিয়ার বন্দরনগর বেনগাজিতে তিনটি জাহাজ পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যে বিমানে করে তারা প্রায় এক হাজার জনকে দেশে নিয়ে গেছে। গতকাল ফ্রান্স তার নাগরিকদের সরিয়ে নিতে একটি বিমান পাঠায়। কিন্তু সেটি ত্রিপোলিতে নামতে না পারায় মাল্টায় অবতরণ করে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের সরিয়ে আনতে বিমান পাঠাচ্ছে।
লিবিয়ার সাবেক উপনিবেশিক শাসক ইতালি বিমানবাহিনীর তিনটি সি-১৩০ বিমান পাঠাচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার ইতালীয় লিবিয়ায় আছে।
মিসরের সঙ্গে লিবিয়ার সীমান্ত এখন বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। এর আগে ওই সীমান্ত থেকে সীমান্তরক্ষীদের প্রত্যাহার করে নেয় লিবিয়া।
লিবিয়ায় অবস্থানকারী মিসরীয়রা ইতিমধ্যে লিবিয়া ছাড়তে শুরু করেছে। মিসর জানিয়েছে, নাগরিকদের দেশে নিয়ে আসতে তারা কমপক্ষে চারটি বিমান পাঠাচ্ছে।
আল-জাজিরা টেলিভিশন জানায়, বিক্ষোভকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন দেশটির বিচারমন্ত্রী মুস্তাফা আবদুল জলিল। তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ এবং জাতিসংঘ ও আরব লিগে নিযুক্ত লিবিয়ার কূটনীতিকেরা পদত্যাগ করে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিয়েছেন।
গত সোমবার টেলিফোনে গাদ্দাফির সঙ্গে কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। এরপর তিনি জানান, লিবিয়া-পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। মুন বলেন, ‘আমি তাঁকে (গাদ্দাফি) বলেছি, সভা-সমাবেশ, বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারের প্রধান নাভি পিল্লাই বলেছেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে।
লিবিয়া-পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল কায়রোতে জরুরি বৈঠকে বসেন আরব লিগের কূটনীতিকেরা। পরে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, লিবিয়ার সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত লিবিয়াকে সংস্থার বৈঠকে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় লিবিয়া কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘লিবিয়া সরকারের উচিত দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের অধিকারসহ সর্বজনীন অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো। অন্যায় রক্তপাত এখনই বন্ধ করার সময়।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মন্ত্রীরা এক বিবৃতিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

Tuesday, February 22, 2011

রক্তাক্ত লিবিয়ায় আক্রান্ত শতাধিক বাংলাদেশি by মেহেদী হাসান

মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলের অবসানের দাবিতে চলা জনবিক্ষোভে লিবিয়ার পরিস্থিতি এখন অগি্নগর্ভ। গাদ্দাফির অনুগত লোকজন গুলি চালিয়ে সরকারবিরোধীদের হত্যা করছে। চরম অরাজক অবস্থার মধ্যে লিবিয়ায় কর্মরত শতাধিক বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েকটি দেশের তিন শর মতো নাগরিক আক্রান্ত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

লিবিয়ায় বেনগাজিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অনেকে 'জিম্মি' হওয়ার কথা গতকাল টেলিফোনে দেশে তাদের স্বজনদের জানায়। অবশ্য ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এর সত্যতা নাকচ করেছে। দূতাবাস সূত্র অবশ্য স্বীকার করেছে, লিবিয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। খোলা তলোয়ার, ছুরি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশিদের উদ্ধার এবং প্রয়োজনে দেশে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা যাচাই করা হচ্ছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, গতকাল সোমবার জঙ্গিবিমান থেকেও বিক্ষোভকারীদের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। গাদ্দাফির সমর্থকরাও ভবনের ছাদ থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। তবে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে গাদ্দাফি সরকারের দেওয়া নির্দেশ অমান্য করে বিমানবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা দুটি জঙ্গিবিমান নিয়ে মালটায় পালিয়ে যান। রাত পৌনে ২টার দিকে জানা যায়, ত্রিপোলিতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
এদিকে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে গাদ্দাফি পালিয়ে ভেনিজুয়েলার পথে রয়েছেন বলেও মনে করছেন
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। তবে ভেনিজুয়েলা কর্তৃপক্ষ খবরটি অস্বীকার করেছে। লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাদ্দাফি দেশেই আছেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের প্রতিবাদে ইতিমধ্যে লিবিয়ার বিচারমন্ত্রীসহ বেশ কিছু ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। জাতিসংঘে নিযুক্ত লিবিয়ার উপরাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম দাব্বাসি পদত্যাগ করে গাদ্দাফিকেও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, লিবিয়ায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ২৩৩ ছাড়িয়ে গেছে। চীন, ভারত ও আরব লিগে লিবিয়ার শীর্ষস্থানীয় তিনজন কূটনীতিক মুয়াম্মার গাদ্দাফির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে পদত্যাগ করে অন্য কূটনীতিকদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের একজন আল জাজিরাকে বলেছেন, গাদ্দাফি হয়তো লিবিয়া ছেড়ে পালিয়েছেন এবং তাঁর ছেলেদের মধ্যে কর্তৃত্ব নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ চলছে। গাদ্দাফিপুত্র সাইফ আল ইসলাম গতকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে সতর্ক করে বলেন, বিক্ষোভকারীদের কারণে তাঁর বাবার শাসনের অবসান হলে গোটা দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে এবং এর মাধ্যমে লিবিয়া ধ্বংস হবে। সরকারের সংস্কার প্রস্তাব না মানলে লিবিয়াজুড়ে রক্তের নদী বয়ে যাবে বলেও হুমকি দেন তিনি।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে নির্বিচার শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়েছেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। অন্যদিকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের জন্য মরিয়া হয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে গাদ্দাফিবিরোধী পক্ষ। সম্প্রতি মিসরে গণবিক্ষোভের পর হোসনি মুবারকের ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণায় লিবিয়ার বিক্ষোভকারীরাও উৎসাহিত হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের একটি অংশ মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জিম্মি করছে বলে বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেছে। গতকাল সোমবার সিএনএন, ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিবিয়ায় পরিচালিত একটি কোরীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১৫ বাংলাদেশি ও তিন কোরীয় শ্রমিকের আহত হওয়ার খবর প্রচার করে। আহত বাংলাদেশিদের মধ্যে দুজন ছুরিকাহত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানায় সংবাদ সংস্থা ইয়োনহাপ।
দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাইক জু হাইয়ুনের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গত রবিবার রাত ১১টার দিকে ত্রিপোলির পশ্চিমে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০০ লিবীয় বিক্ষোভকারী ভাঙচুর করে চলে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর তারা আবার ফিরে এলে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। ওই প্রতিষ্ঠানে এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ও প্রায় ৫০ জন কোরীয় নাগরিক কর্মরত।
বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদ সংস্থা বিডিনিউজ গতকাল রাতে লিবিয়ায় শতাধিক বাংলাদেশিকে জিম্মি করার খবর প্রচার করে। তাদের মধ্যে ১৫ জন আহত হয়েছে বলে জানানো হয়। সংবাদ সংস্থাটি জানায়, লিবিয়ায় দমন-পীড়নের মুখে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা তিন শর বেশি বিদেশিকে জিম্মি করেছে, যার মধ্যে শতাধিক বাংলাদেশি রয়েছে। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজি থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার পূর্বে দারনা সিটিতে কয়েক দিন ধরে তারা আটক রয়েছে বলে একজন বাংলাদেশি জিম্মি জানিয়েছেন। জিম্মিরা ধারণা করছে, নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেই বিদেশিদের আটক করা হয়েছে।
দারনা সিটিতে জিম্মিদের অন্যতম মানিকগঞ্জ জেলার শফিউদ্দিন বিশ্বাস গতকাল দুপুরে টেলিফোনে বিডিনিউজকে বলেন, 'গত শুক্রবার বিকেলে ৩০-৪০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি আমাদের ক্যাম্প অফিস থেকে জিম্মি করে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে একটি মসজিদে নিয়ে যায়। পরের দিন স্থান পরিবর্তন করে পাশের দুটি কমিউনিটি সেন্টারে আমাদের আনা হয়েছে।' আরেক জিম্মি ফরিদপুরের আবদুল আজিজ টেলিফোনে বলেন, 'আমাদের আটকে রাখা হয়েছে। প্রথম কয়েক দিন সারা দিন দুটি করে রুটি খেতে দেওয়া হয়েছে। সামান্য হলেও পানি দিয়েছিল। কিন্তু রবিবার থেকে পানি পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় গতকাল দুপুর ১২টা) কোনো খাবার দেওয়া হয়নি। আমাদের কাছে সামান্য পানি আছে, সেটাই খাচ্ছি।'
আবদুল আজিজ আরো বলেন, 'আমাদের ফোন করতে দিচ্ছে না। তবে ফোন এলে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে। তারা এখনো কিছু দাবি করেনি। শুধু বলছে, গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, এখন আমাদের শাসন চলবে।'
লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের অবস্থা জানতে গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে ৫টার দিকে কালের কণ্ঠ কার্যালয় থেকে টেলিফোনে ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ জানায়, লিবিয়ায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিন দিন আগে তারা নিয়ন্ত্রণকক্ষ খুলেছে। ওই নিয়ন্ত্রণকক্ষে দায়িত্বরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, দিনরাত সব সময়ই বাংলাদেশিদের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগ হচ্ছে। জিম্মি করা বলতে যা বোঝায় সে ধরনের কোনো ঘটনার তথ্য দূতাবাসের জানা নেই। তবে কয়েকজন শ্রমিক অসুবিধার মধ্যে আছে। লিবিয়ায় আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী লুটপাট চালাচ্ছে।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা কী ধরনের অসুবিধার মধ্যে আছেন, জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশিরা কাজ করেন_এমন একটি প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পালিয়েছে। তবে বিক্ষোভকারীদের হামলায় কোনো বাংলাদেশির মারাত্মক আহত হওয়ার খবর দূতাবাসের জানা নেই।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, শুধু বাংলাদেশি নয়, সেখানে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও কোরিয়ার নাগরিকরাও হামলার শিকার হয়েছে। পরিস্থিতি এখন কারো নিয়ন্ত্রণে নেই। রাস্তায় খোলা তলোয়ার ও ছুরি নিয়ে নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। সর্বত্র থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে। দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টেলিফোন যোগাযোগও সীমিত করা হয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ দূতাবাস জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলে বাংলাদেশিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দূতাবাস সূত্র আরো জানায়, বিক্ষোভে উত্তাল বেনগাজিতে প্রায় ছয় হাজার এবং পুরো লিবিয়ায় প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোয় বাংলাদেশিদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানায়, পরিস্থিতি অনুযায়ী সব সম্ভাবনা যাচাই করা হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ এখানে একা কিছু করবে না। লিবিয়ায় অন্য দেশগুলোর দূতাবাসগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে দেশটির অভিবাসনবিষয়ক আইনও। প্রয়োজনে সবাইকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধারের চিন্তাভাবনাও করা হবে।
বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে লিবিয়ায় তুলনামূলক নিরাপদ কোনো স্থানে রাখা হবে নাকি দেশে ফেরত পাঠানো হবে_এ প্রশ্ন করলে দূতাবাস সূত্র জানায়, বিষয়টি পরিস্থিতি এবং ওই বাংলাদেশিদের প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করবে। লিবিয়ায় চলমান পরিস্থিতির কোনো প্রভাব বাংলাদেশ দূতাবাসের ওপর পড়েছে কি না_এ প্রশ্নে সূত্রটি জানায়, লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস এলাকার পরিস্থিতি এখনো বেনগাজি বা অন্য এলাকাগুলোর মতো হয়নি। তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
গণবিক্ষোভের মুখে গত ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর পলায়ন এবং গত ১১ ফেব্রুয়ারি মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ৩০ বছরের শাসনামলের অবসানের পর লিবিয়াসহ বিভিন্ন আরব দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ চলছে। বর্তমানে বিক্ষোভে উত্তাল লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি চার দশক ধরে ক্ষমতাসীন। ১৯৬৯ সালে তরুণ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেন গাদ্দাফি। তখন থেকেই দেশটি তাঁর শাসনে চলছে। করুণ পরিণতির আশঙ্কায় গাদ্দাফি দৃশ্যত মরণ কামড় দিয়ে এখন ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন। অন্যদিকে তাঁকে উৎখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিক্ষোভকারীরা। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ও টুইটারে সংগঠিত হয়ে গত বৃহস্পতিবারকে 'ক্ষোভের দিন' নাম দিয়ে সরকার পতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে কয়েক হাজার মানুষ। বিক্ষোভকারীদের ওপর গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর হামলা ও গুলিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ত্রিপোলির বাসিন্দারা এএফপিকে জানিয়েছে, রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় গতকাল সকালে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এরই মধ্যে চলছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মাত্র চার দিনে (১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি) লিবিয়ায় অন্তত ২৩৩ জন নিহত হয়েছে। সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের পরিচালক সারাহ লিহ হুইটসন বলেছেন, লিবিয়ায় মানবিক বিপর্যয় ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেশটি (লিবিয়া) তথ্য আড়াল করার চেষ্টা করলেও বর্বর হত্যাকাণ্ড আড়াল করতে পারবে না।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, চীন ও ভারতে নিযুক্ত লিবিয়ার জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এবং আরব লিগে নিযুক্ত লিবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি গাদ্দাফি প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন। বেইজিংয়ে লিবিয়া দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব হোসেইন সাদিক আল মুস্তারি পদত্যাগের পর গতকাল কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্য কূটনীতিকদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'গাদ্দাফি হয়তো ইতিমধ্যে লিবিয়া ছেড়েছেন এবং তাঁর ছেলেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ চলছে।' আরব লিগে নিযুক্ত লিবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি আবদেল মোনেম আল-হোনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বিদ্রোহে যোগ দিতেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গতকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেন, বিক্ষোভের পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে। সরকারের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাব আগ্রাহ্য করা হলে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। এ পর্যন্ত মাত্র ৮৪ জন নিহত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'সরকারের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবে রাজি না হলে আমরা কেবল ৮৪ জনের জন্য শোক পালন করব না। এ সংখ্যা হাজার ছাড়াবে। লিবিয়াজুড়ে রক্তের নদী বইবে।'
সংঘাত বন্ধের আহ্বান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের : ফ্রান্স, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফিলিপাইন অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের জন্য লিবিয়ার সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে শক্তিপ্রয়োগ বন্ধ ও জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানান।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় ঝুঁকিতে অর্থনীতি

পুঁজিবাজারে ধস, আবাসন শিল্পে স্থবিরতা ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে। গুটিকয়েক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী কার্যক্রম পুরো আর্থিক খাতকেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের প্রারম্ভিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
তাঁদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার, আবাসন খাত ও অনুৎপাদনশীল খাতে অতিমাত্রায় ঋণ সম্প্রসারণের কারণে এশিয়ার অনেক দেশই ওই সময় চরম সংকটে পড়েছিল। জিডিপির প্রয়োজনের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি : ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ব্যাপক বেড়েছে, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি। এ বিষয়ে খোদ মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, 'অর্থবছরের প্রথমার্ধজুড়েই (২০১০ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর) অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ব্যাপক। বিদায়ী ২০১০ সালের জুন থেকে নভেম্বর_এই পাঁচ মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এই ঋণের প্রবাহ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল।' অপরদিকে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২১ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের এই বিপুল ঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য
সরকারের সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেছেন একাধিক ব্যাংক বিশ্লেষক। বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে জানান, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে সহায়ক ছিল কিছু খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩ শতাংশ
নির্ধারণ করে দেওয়া। যেখানে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারছে না, সেখানে শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার বেঁধে দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
তিনি বলেন, এতে সমস্যা হয়েছে ত্রিমুখী। প্রথমত, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে আমানতের বিপরীতে ঋণের সুদহার কমাতে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলো মুনাফা ধরে রাখতে কনজ্যুমার ক্রেডিটে বেশি অর্থায়ন করেছে। তৃতীয়ত, চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদহারে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য লাভজনক খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। লাভজনক খাত ছিল সঞ্চয়পত্র। সেখানেও সুদহার কমানো এবং এর আয়ের ওপর করারোপ করায় সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকেছে অসংখ্য বিনিয়োগকারী।
সরকারি ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ও করারোপ সরকারের অন্যতম একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ এতে বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ধাবিত হয়েছেন। যদি সঞ্চয়পত্রে সরকারের ভর্তুকি দিতেই হতো তাহলে এর পরিমাণ আর কত হতো! নিশ্চয়ই বর্তমানে পুঁজিবাজারে ধসের চেয়ে ভয়াবহ হতো না। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক ঘরোয়া বৈঠকেও সিদ্ধান্তটির সমালোচনা করেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স বিনিয়োগের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় প্রান্তিক মানুষ তা ব্যয় করেছে জমি কেনাসহ নানা অনুৎপাদনশীল খাতে, যা মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং তা প্রবৃদ্ধিকে গিলে ফেলে। সুতরাং সরকারের উচিত ছিল, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর পরিবর্তে কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া। তাতে রেমিট্যান্সের বিপুল পরিমাণ অর্থ হয়তো ব্যাংক খাতেই থেকে যেত। পরবর্তী সময়ে কোনো উৎপাদনশীল খাতে তা বিনিয়োগ করা যেত বলে মনে করেন ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী।
পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়াও ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অর্থায়নে ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়নে প্রায় ২৮, এসএমই ও কৃষিতে প্রায় ১০ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় এ খাতগুলোতে মোট নতুন ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ গেছে। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ (প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা) গেছে সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নয় এমন খাতগুলোতে। এ ছাড়াও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ভোক্তাপণ্য কেনার জন্য দেওয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় যেসব খাত অনুৎপাদনশীল তার মধ্যে গত বছর পুঁজিবাজার ছিল শীর্ষে। অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণের সিংহভাগই পুঁজিবাজারে গেছে বলে ধারণা করছেন তাঁরা। এরই মধ্যে কিছু ব্যাংকের আর্থিক সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কেউ কেউ আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করেও তাদের মার্চেন্ট ব্যাংক শাখায় দিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রমাণ পেয়েছে। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে এসব ব্যাংকের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আটকে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে বিনিয়োগ উঠে না আসায় ব্যাংকগুলোর দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে কলমানি থেকে প্রতিদিন এসব ব্যাংক বেশ বড় অঙ্কের টাকা ধার করে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুঁজিবাজারে ধস অব্যাহত থাকলে কয়েকটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হতে পারে, যা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাই আমরা ব্যাংকগুলোকে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।'
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় চলে এসেছে।'
অপরদিকে তুলনামূলক অরক্ষিত খাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটির মুনাফার অধিকাংশই আসে পুঁজিবাজার থেকে। এদের অনেকেরই পুঁজিবাজারে বড় ধরনের মূলধন আটকে গেছে। বাজারে মন্দাবস্থা এবং ক্রেতা না থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান ট্রিগার সেলেও যেতে পারছে না। এ ছাড়া এ বিষয়ে এসইসির কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল কম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়াম্যান ও লঙ্কা বাংলা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজউদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইং রয়েছে। এদের পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে দেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে আনুমানিক বিনিয়োগ প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে গ্রাহকদের দেওয়া এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশ আগামী প্রান্তিকে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মার্কেটের এ অবস্থায় আমরা ট্রিগার সেলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
সার্বিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী দুই প্রান্তিক অর্থাৎ মার্চ ও জুন প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিবরণীতে এর প্রতিফলন ঘটতে পারে।
আবাসন শিল্পে মন্দাবস্থা ও বিপুল অর্থ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা : গত কয়েক বছর ধরে জমির মূল্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর সহজ শর্তে অর্থায়নই ছিল দায়ী। সহজে অর্থ পাওয়ার সুবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে হাউজিং ব্যবসার প্রসার বেড়েছে। জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অবস্থায় তৈরি হয়েছে বিপুল উদ্যোক্তা। বিনিয়োগও হয়েছে প্রচুর। ফলে ব্যাংকের অর্থায়নও রয়েছে অনেক।
রিয়্যাল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)_এর তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে আবাসন শিল্পমালিকদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং ফ্ল্যাট ক্রেতাদের প্রায় ১২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়েছে। রিহ্যাবের সদস্য নয় এমন উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের সমপরিমাণ অর্থ বিবেচনা করলে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ডেভেলপার চরম আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে পারছেন না অনেকে। আবার অনেকে সম্পূর্ণ করেও প্রকল্প হস্তান্তর করতে পারছেন না গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকার কারণে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক ডেভেলপারই দেউলিয়া হয়ে যাবেন বলে রিহ্যাব সূত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এশীয় মন্দার সময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার এবং আবাসন খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছিল। তবে আমরা এখনো সে পর্যায়ে যাইনি। কিছু ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা অন্যান্য খাত থেকে ডিভিডেন্ট দিচ্ছে। পুঁজিবাজারে খেলাপি হলে তারা সেখান থেকে প্রভিশন করবে।'
তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশের আর্থিক খাত মন্দাকবলিত হতে পারে বলে এখনো আমি মনে করি না। পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে এটাও বলা ঠিক হবে না। কারণ এটাকে আবার কার্যকর করার প্রচেষ্টা চলছে।'
তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকে। তারা পুঁজিবাজারে স্বল্প মেয়াদি বিনিয়োগের দিকে যেন অতিমাত্রায় ধাবিত না হয় সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তবে মন্দাবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সরকারকে ম্যাক্রো-ইকোনমির দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি জোর দিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এশিয়ান মন্দার কারণ পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন লেখেন ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইউএন-ডেসার সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার ড. আনিছ চৌধুরী। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়, যা তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলো আবাসন খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ করে। এক পর্যায়ে ব্যাংকের মুনাফা কমতে শুরু করে এবং কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারেও অধিক হারে বিনিয়োগ করে। ফলে পুঁজিবাজারে অতিমূল্যায়নের ঘটনা ঘটে। একসময় পুঁজিবাজারে ধস নামে এবং ব্যাংকগুলো বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতেও এসব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন এ বিশ্লেষক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর। আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক বাব্ল বা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির পর্যালোচনায় ড. আনিছ চৌধুরী লিখেছেন, অতিমূল্যায়িত পুঁজিবাজারে ধস সবার জন্যই বেদনাদায়ক। প্রাইস কারেকশন আরো বিলম্বিত হওয়ার কারণে যে ধস নামবে তা আরো বেদনাদায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, পুুঁজিবাজারের মতো অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থায়িত্ব ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেট সেক্টর সঠিকভাবে মূল্যায়িত হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আর্থিক খাতে মন্দা হতে পারে দুটি কারণে। এগুলো হচ্ছে_জ্বালানি সংকট এবং জমির অতিমূল্য। জমির দাম সাংঘাতিক বেড়েছে, এখানে কারেকশন হতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে মাসে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ অবস্থায় এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আর বাড়বে না। এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হওয়ার ফলে চলতি ঋণগুলো খেলাপি হতে পারে। তবে বড় ধরনের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ তাদের অন্যান্য খাতের লভ্যাংশ থেকে এ ঋণ ফেরত আসবে। সমস্যা হবে ছোট উদ্যোক্তাদের নিয়ে।
মন্দা ঠেকাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ানোর পক্ষে মত দেন মাহমুদ সাত্তার। অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে সরকার বিদ্যুতের জোগান বাড়াতে সক্ষম হলেও গ্যাসের জোগান বাড়ানো নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

শীর্ষ পদে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজেরা!

দুর্নীতি করার কথা স্বীকার করে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে (ট্রুথ কমিশন) অর্থদণ্ড দেওয়া কর্মকর্তাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পদসহ শীর্ষস্থানীয় অন্তত পাঁচটি পদে বসানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এক-এগারোর পর ঘুষের টাকা লেনদেনের সময় হাতেনাতে আটক কর্মকর্তাকে।

রেলওয়ের মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমন একজনকে, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলা চলছে এবং আরও দুটি দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত এসব কর্মকর্তাকে বসানোর কারণে প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মকর্তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ কারণে সেখানে কাজের গতি কমে গেছে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়েরই অনেক কর্মকর্তা। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে এই পরিস্থিতি অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রধান প্রকৌশলী: ট্রুথ কমিশনে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির দায় স্বীকার করা মো. শাহাবুদ্দিনকে গত ২৭ জানুয়ারি সওজের প্রধান প্রকৌশলী করা হয়। তাঁকে গত ২৪ জানুয়ারি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের করা তদন্তে শাহাবুদ্দিনসহ ৪১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু এখন তাঁরা শাস্তির বদলে সুবিধাজনক উচ্চ পদে বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে পুরো বিভাগে জেঁকে বসেছেন।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে চারটি বিভাগীয় মামলা হলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু তিরস্কার করে তাঁকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিধিমালা (পিপিআর) অনুসরণ না করা এবং মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজার অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধভাবে বিদেশ সফরের অভিযোগে বিভাগীয় মামলাগুলো করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, শাহাবুদ্দিন ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (এলপিআর) যান। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ালে তিনি পুনরায় যোগ দেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তবে তাঁর মুক্তিযোদ্ধার সনদ অবৈধ দাবি করে হাইকোর্টে রিট করেন বাহারউদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা। ওই মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় শাহাবুদ্দিনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বিষয়ে তিনি খবর রাখেন না। সংসদীয় কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে ভুল বুঝে কথা বলেছে। ট্রুথ কমিশনে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যটা আমি জানি। কী বলেছি আর করেছি, আমি ভালো করেই জানি।’
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ফিরে আসেন তাঁর ব্যাচমেট মোস্তাক হোসেন, আরিফুর রহমান ও আবদুল অদুদ। এই তিনজনের মধ্যে মোস্তাক হোসেন ও আরিফুর রহমান ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করেছিলেন। এঁরা এখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে আছেন। এই পদে নিয়মিত হওয়ার জন্য তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের পরিচালক: আরিফুর রহমানকে সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে গত বছরের জানুয়ারি মাসে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পরও প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়নি। সূত্র জানায়, দরপত্রের শর্তানুযায়ী চার লেন প্রকল্প অনুমোদনের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খানাখন্দ নির্বাচিত ঠিকাদারদেরই করার কথা। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, ঠিকাদারেরা তা করবেন না। এ জন্য মহাসড়কের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মিরসরাই থেকে চট্টগ্রাম গেট পর্যন্ত অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে সরকারের বাড়তি ব্যয় হবে। সারা দেশে সড়ক মেরামতের জন্য এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প শিগগিরই একনেকে অনুমোদন হবে বলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানিয়েছেন। এই প্রকল্পে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামতও রয়েছে।
এ বিষয়ে আরিফুর রহমান বলেন, সে সময় সওজের ঢাকায় কর্মরত সব কর্মকর্তাকে জোর করে ট্রুথ কমিশনে নেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে যারা আছেন, সে সময় তাঁরা ঢাকায় থাকলে কেউ বাদ যেতেন না। তিনি দাবি করেন, তাঁর পদোন্নতিতে সওজে কোনো অস্বস্তি নেই।
পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান: ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা আরেক প্রকৌশলী মোস্তাক হোসেনকে করা হয়েছে সওজের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান। সওজের কোন প্রকল্প নেওয়া হবে, কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, কোনটিতে কত অর্থায়ন হবে, তা নির্ধারণ করা পরিকল্পনা বিভাগের কাজ।
মোস্তাক হোসেন দাবি করেন, তাঁদের ট্রুথ কমিশনে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কিছু লোক খারাপ প্রচার চালাচ্ছে। তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ায় সওজের কাজ দ্রুতগতিতে হচ্ছে। অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো অস্বস্তি নেই।
প্রশাসন ও সংস্থাপন বিভাগের প্রধান: স্বেচ্ছায় দুর্নীতির কথা স্বীকার করা আবদুল আজিম জোয়ার্দারকে বর্তমান সরকার পদোন্নতি দিয়ে সওজের প্রশাসন ও সংস্থাপন বিভাগের প্রধান করেছে। গত বছরের আগস্ট মাসে ঈদুল ফিতরের আগে একসঙ্গে সওজের ৪৪ জনকে বদলি করা হয়। সে সময় ‘বদলি বাণিজ্য’ আলোচনায় আসে। সম্প্রতি সওজের প্রকৌশলীদের সমিতির নির্বাচনে পরাজিত হন জোয়ার্দার। এই পরাজয়ের পেছনে সেই বদলি বাণিজ্যের একটা প্রভাব আছে বলে মন্তব্য করেন কয়েকজন প্রকৌশলী।
এসব বিষয়ে আবদুল আজিম জোয়ার্দারকে বক্তব্য জানার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। শুধু বললেন, ‘আমি অফিসের কাজে বাইরে আছি।’ তিনি পরে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করার পরামর্শ দেন।
আরও যাঁরা বড় দায়িত্ব পেয়েছেন: আরেক কর্মকর্তা সোহরাব উদ্দিন মিয়াকেও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদমর্যাদায় বেশ কয়েকটি সড়ক নির্মাণ ও মেরামতসংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে।
সোহরাব উদ্দিন মিয়া জানান, তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে আছেন। ট্রুথ কমিশনে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এভাবে গত দুই বছরে সওজের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসিয়েছে মন্ত্রণালয়।
সেতু বিভাগ: যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আরেক বিভাগ সেতু বিভাগ। সরকারের সর্বাধিক অগ্রাধিকার ও বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে সেতু বিভাগ। এই প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে সওজের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে। তিনি এক দিনের জন্য সওজের প্রধান প্রকৌশলীও হয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ধানমন্ডির এক রেস্তোরাঁয় ঠিকাদারদের কাছ থেকে নেওয়া কমিশনের টাকা ভাগাভাগির সময় তাঁকেসহ আরও সাত প্রকৌশলীকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হাতেনাতে ধরে ফেলেন। পদ্মা সেতুর নকশার কাজ চূড়ান্ত না হওয়ার আগেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির পুরো প্রায় ১১৬ কোটি টাকা দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক: এই পদে নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক আছে। বর্তমান মহাপরিচালক টি এ চৌধুরীর বিরুদ্ধে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। তাঁকে মহাপরিচালক এবং শাহাবুদ্দিনকে সওজের প্রধান প্রকৌশলী না করার জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছিল কমিটি। এর পরও টি এ চৌধুরীকে মহাপরিচালক করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে, তিনি রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে ইঞ্জিন ও কোচের যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ৫৩ লাখ টাকায় ক্রয় এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। দুদক তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য গত ১২ জানুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণলয়ে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
টি এ চৌধুরীসহ রেলওয়ের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রেলওয়ের চট্টগ্রামের সরঞ্জাম শাখার কেনাকাটায় দুর্নীতির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়েছিল দুদক। গত বছরের ৩০ মার্চ শাহবাগ থানায় এ বিষয়ে একটি মামলাও করে দুদক।
জানেত চাইলে টি এ চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘এগুলো সব পুরোনো অভিযোগ। আমাকে এসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
বিআরটিএ: যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গুরুত্বপূর্ণ পদেও আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজেরা আসীন। ২০০৭ সালে মোটরযানের কর ও ফি বাবদ গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের দায়ে বরখাস্ত হওয়া সহকারী পরিচালক কাজী মাহবুবুর রহমান বর্তমান সরকারের সময়ে দিনাজপুর কার্যালয়ের প্রধান হন। এখন তিনি বিআরটিএর টাঙ্গাইল কার্যালয়ের প্রধান।
২০০৭ সালে বিআরটিএর এক তদন্ত কমিটি কাজী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় এবং সেই টাকা তাঁর কাছ থেকে উদ্ধারেরও সুপারিশ করে। সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাও হয় তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন।
এ ছাড়া ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা সহকারী পরিচালক আমিনুল হক সরকারকে ঢাকার পরই গুরুত্বপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ রকম ৪১ জন কর্মকর্তা ট্রুথ কমিশনে হাজির হয়ে দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেও এখন সরকারি চাকরি করছেন। তাঁদের অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন, অনেকে সুবিধাজনক স্থানে বদলিও হয়েছেন।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি উল্টো।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে ট্রুথ কমিশন গঠন করা হলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ৪৫২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বেচ্ছায় গিয়ে নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন এবং অনেকে অর্থদণ্ড দেন।
যোগাযোগ খাতে অব্যবস্থার মূলে: মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে কাউকেই পাত্তা দেন না। তাঁদের কোনো কাজে তাগিদ দেওয়ারও সাহস পান না মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কারণ তাঁরা প্রকাশ্যে বলে বেড়ান, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ। কেউ তাঁদের কিছু করতে পারবে না।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, দেশের রাস্তাঘাট উন্নয়ন করবে কে? সওজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পদোন্নতির বিষয়টি সুপেরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) দেখে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি হয়। দুর্নীতিবাজদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘নিয়মের বাইরে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয় না।’
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রেলওয়ের মহাপরিচালক এবং সওজের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর ব্যাপারে তদন্ত করতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে প্রতিবেদন নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি।
প্রথম আলোয় ২০১০ সালের ৬ মার্চ প্রকাশিত এক কলামে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনের সদস্য মনজুর রশীদ খান লিখেছিলেন, ‘...আমরা সর্বমোট ৪৫২ জনের শুনানি করেছিলাম। এর বেশির ভাগই এসেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা, ডেসা, দুটি গ্যাস কোম্পানি, সাব-রেজিস্ট্রার, ডাক বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিআরটিএ থেকে। কয়েকটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, তাঁদের দপ্তরগুলোতে পিসি (পার্সেনটেজ) নামের ছদ্মাবরণে ঘুষ নেওয়ার প্রথাকে কেউ দুর্নীতি মনে করেন না।...অনেক সংস্থায় বিশেষ করে প্রকৌশল সংস্থাগুলোতে পিসি নেওয়াটা একটা সাধারণ ব্যাপার। অর্থাৎ তাঁরা একে দুর্নীতি মনে করেন না। যিনি নেন না, তিনি চাকরির সিঁড়ির ধাপে বেশি দূর এগোতে পারেন না।’
বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা ট্রুথ কমিশনে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই অর্থদণ্ড দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন কয়েক কোটি টাকা করে জরিমানা দিয়েছেন। নির্দিষ্ট প্রকল্পে বা কাজে দুর্নীতির কারণে তাঁরা এই দণ্ড দিয়েছিলেন বলে সূত্র জানায়।

Thursday, February 17, 2011

পোশাক কম্পানিগুলোর নিরাপত্তা প্রসঙ্গ

কটি ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরে ২৬ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর পশ্চিমের ব্র্যান্ড কম্পানিগুলো বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের নিরাপত্তাবিষয়ক অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। হা-মীম গ্রুপের একটি কারখানার নবম তলায় আগুন লাগার ঘটনায় আরো কমপক্ষে ১০০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ গ্রুপের হাজার হাজার শ্রমিক গ্যাপ, জেসিপেনি ও ফিলিপ্স-ভ্যান হাউসেনের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করে থাকে।

বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, চুরি ঠেকানোর জন্য নিচে নামার দরজায় তালা দেওয়া থাকার কারণে আতঙ্কিত শ্রমিকরা ছাদ থেকে দড়ি বেয়ে নামার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণে বাঁচতে ব্যর্থ হন। এ মর্মান্তিক ঘটনার আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সুইডেনের হেনেস অ্যান্ড মরিৎস কম্পানির জন্য সোয়েটার উৎপাদনকারী একটি কারখানা ধসে ২১ শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। এক দশককাল ধরে ব্র্র্যান্ড কম্পানিগুলো উৎপাদনস্থলের পরিবেশ নিয়ে তদারকির যে চেষ্টা করে আসছে, এ আগুনের ঘটনা সে চেষ্টার সীমাবদ্ধতার কথাই প্রমাণ করল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্যাপ বছরের প্রথম দিকে হা-মীম গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করেছে। তারা পরিষ্কারভাবেই অগি্নকাণ্ডে বহির্গমনের পথ সুগম করার কথা উল্লেখ করেছিল। সর্বশেষ অগি্নকাণ্ডের ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে পশ্চিমা ব্র্যান্ড কম্পানিগুলোর প্রতিনিধি,কারখানার মালিক, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শ্রমিক নেতারা পোশাক শিল্পে আগুন লাগার সমস্যা নিরসনে ঢাকায় এক জরুরি আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, পোশাক শিল্প বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ
রপ্তানি করে থাকে।
এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য স্পর্শকাতর একটি সময়ে। সম্প্রতি সরকারের মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা নিয়ে শ্রমিক ও কারখানা মালিকদের মধ্যে একটি চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গত নভেম্বর থেকে নতুন ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কিন্তু শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করছেন, কিছু ফ্যাক্টরি কৌশলে মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা নিম্ন মজুরির শ্রমিকদের শ্রেণীভুক্ত করে বেতন ও বিভিন্ন ভাতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রামে ৭০টি কারখানা বিদেশি ব্র্যান্ড কম্পানির জন্য পোশাক উৎপাদন করে থাকে। গত সপ্তাহে সেখানে পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় তিনজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ২৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
চীনের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যের পোশাক-বাজার বাংলাদেশে চলে আসার পর থেকেই এই শ্রমিক অসন্তোষ লক্ষ করা যাচ্ছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বাংলাদেশ থেকে ৬ দশমিক ৮ ইউএস ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। হা-মীমে এই অগি্নকাণ্ডের পর কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড কম্পানিগুলো এ দুর্ঘটনার একটি স্বাধীন তদন্ত এবং দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিক ও শ্রমিক-পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানিকারক সব ব্র্যান্ড কম্পানি আগামী সপ্তাহে দেশটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সরকার ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের তাগিদ দিয়েছে। পোশাক কম্পানিগুলো অন্যান্য কারখানায় যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে, তা ঠেকাতে এবং কারখানা নিরাপদ করতে কী করণীয়, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপারে অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশের অসংখ্য পোশাক কারখানা এমন সব বহুতল ভবন ব্যবহার করছে, যেগুলো শিল্পের জন্য উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়নি। শিল্প উৎপাদনের জন্য যে ধরনের ভবন প্রয়োজন, তার সঙ্গে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হাজার হাজার মেশিন চলার জন্য যে ভারী বিদ্যুতের সরবরাহ প্রয়োজন, তার সঙ্গে বৈদ্যুতিক সিস্টেম মানানসই নয়; যে কারণে এ বিদ্যুতের অগি্নকাণ্ডের আশঙ্কা দেখা দেয়। শ্রমিকদেরও জরুরি অবস্থায় কী করণীয়, সে বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
ক্লিন ক্লোথ কম্পানি হিসাব করে দেখেছে, গত পাঁচ বছরে ২০০ পোশাক শ্রমিক অগি্নকাণ্ডে নিহত হয়েছেন। ২০০৫ সালে ৬৪ জন শ্রমিক স্পেকট্রাম কম্পানি ধসে পড়ায় প্রাণ দিয়েছেন।
ব্রিটেনভিত্তিক এথিক্যাল ট্রেডিং ইনেশিয়েটিভের পরিচালক পিটার ম্যাকঅলিস্টার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এ ঘটনাকে বিপজ্জনক ত্রুটি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, 'এ রকম প্রতিটি নতুন ঘটনাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সংকট আরো ঘনীভূত করছে।'

জোনাথন বির্চাল ও অ্যামি কাজমিন
ফিন্যানশিয়াল টাইমস থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

কমরেড আবদুল হক by শাহিদুল হাসান খোকন

ত শতাব্দীর চলি্লশের দশক। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা দেশজুড়ে। সামন্তবাদী এই সমাজব্যবস্থা ভাঙার দৃঢ় সংকল্পে যে কয়েকজন মানুষ যুদ্ধে নেমেছিলেন, তাঁদের তালিকায় অন্যতম ও উজ্জ্বল বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কমরেড আবদুল হক।

সামন্তবাদী পীর পরিবার থেকে আগত এই সাহসী কমরেড কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই আদর্শ ধারণ করেই মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন আবদুল হক। প্রয়াত এই বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতার পঞ্চদশ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২২ ডিসেম্বর ১৯৯৫ শুক্রবার রাত ১০টা ৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে কমরেড আবদুল হক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কমরেড আবদুল হক যশোর জেলার সদর থানার খড়কিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শাহ মুহম্মদ আবুল খায়ের ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সেই সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স পড়ার সময় তিনি ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীসভ্য পদ লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্রসংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ সময়কালে তিনি অনেক আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে গড়ে তোলেন ও অংশ নেন; যেমন_১৯৩৯ সালের হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার আন্দোলন, ১৯৪২ সালের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন, হাট তোলা আদায় বন্ধ আন্দোলন, ১৯৫০ সালের রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন ইত্যাদি। মতিন-আলাউদ্দিন উপস্থাপিত 'কৃষিতে ধনতন্ত্র' বক্তব্য খণ্ডন করে তিনি ১৯৬৯ সালে রচনা করেন 'পূর্ব বাংলা আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী' পুস্তক। পরবর্তী সময়ে জাসদের আখলাকুর রহমানের জবাবে লেখেন, 'কৃষিব্যবস্থা আধা সামন্ততান্ত্রিক' পুস্তক। ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ সালের অষ্টম কংগ্রেস পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অসুস্থ অবস্থার একটি পর্যায়ে তিনি এই পার্টির কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোর সভ্য ছিলেন। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর বলশেভিক ধরনের পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দীর্ঘ ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে তিনি আজ শুধু একজন ব্যক্তি নন, এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারায় সংশোধনবাদবিরোধী এক মহান প্রতীক হিসেবে এবং এ দেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ধারার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে এসেছেন। আবদুল হক একজন সুবক্তা ছিলেন। তাঁর উদ্দীপক বক্তৃতা প্রতিটি জনসভা উদ্দীপ্ত করত। ১৯৭০ সালের ২০ জানুয়ারি আসাদ দিবসে ভাসানী ন্যাপের আয়োজনে ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় তাঁর বক্তৃতা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রকাশ্য শেষ জনসভা। লেখক হিসেবে কমরেড আবদুল হক ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০।

অপূরণীয় ক্ষতি

বার বিমান দুর্ঘটনা। এবার বরিশালে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ল। নিহত হলেন বিমানের দুই বৈমানিক। এ নিয়ে গত ৩৮ বছরে দেশে বিমান দুর্ঘটনায় ২২ বৈমানিকসহ ৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিমানবাহিনীর এই প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় দুই পাইলটের মৃত্যু দুঃখজনক।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঠিক কোনো কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বড় কোনো সমস্যার কারণেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিমানবাহিনীর প্রধানও তেমনটি বলেছেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে বিশদ জানা যাবে।
প্রাপ্ত খবরে দেখা যাচ্ছে, বিমানবাহিনীর যে প্রশিক্ষণ বিমানটি গত সোমবার বরিশালে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি ২০ বছর আগে কেনা। এ ধরনের বিমান বিমানবাহিনীতে আরো আছে। বাংলাদেশে পিটি-৬ মডেলের বিমানের এটাই প্রথম দুর্ঘটনা। নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিমানটি নিয়ে বিমানবাহিনীর দুই স্কোয়াড্রন লিডার আকাশে উড়েছিলেন। তাঁদের বরিশাল বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী যশোর বিমানঘাঁটি থেকে বরিশাল বিমানবন্দরকে জানানোও হয়েছিল। বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণের কোনো সংকেত দেয়নি। রানওয়েতে না নেমে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিমানটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়। এভাবে রানওয়ে স্পর্শ না করে উঠে যাওয়াকে প্রশিক্ষণের ভাষায় বলে 'কাট অ্যান্ড গো'। ধারণা করা যেতে পারে, এটা বৈমানিকদের, বিশেষ করে যুদ্ধবিমানের বৈমানিকদের বিশেষ ধরনের দক্ষতা। প্রশিক্ষণ বিমানে উড়তে গিয়ে সে দক্ষতার পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন দুই বৈমানিক। সে সময় কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে। সেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হতে পারে। দুর্ঘটনার আগে ও পরে চারটি বিমান বরিশাল থেকে ঘুরে গেছে। সেই বিমানগুলো দুর্ঘটনায় পড়েনি। দুর্ঘটনায় পড়েছে এই বিমানটি।
আগেই বলা হয়েছে, সামরিক বা বেসামরিক বিমানের দুর্ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিশেষ করে সামরিক প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। বিমানবাহিনীর যে দুই কর্মকর্তা এই বিমানের বৈমানিক হিসেবে ছিলেন, তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভেতর দিয়ে বিমানবাহিনীতে এসেছিলেন। তাঁদের স্বপ্ন ছিল অনেকটা পথ যাওয়ার। তাঁদের পরিবারও তাঁদেরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একই সঙ্গে হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি। যেকোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেয়। এর আগেও অনেক সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যশোর এরিয়ার জিওসি ও একজন লে. কর্নেল নিহত হন। গত সেপ্টেম্বরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত হয়। দেখা যাচ্ছে, বিমান দুর্ঘটনা ঘটছেই; বিশেষ করে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে।
বিষয়টির দিকে সবারই দৃষ্টি দেওয়া দরকার। একের পর এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় দেশ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। যেসব প্রশিক্ষণ বিমান আছে, সেগুলো ঠিকমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই উড্ডয়নের অনুমতি দিতে হবে। দুর্ঘটনা হঠাৎ করেই ঘটে, কিন্তু একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে তা রোধ করা যায়। প্রশিক্ষণ বিমানের ক্ষেত্রে এই সাবধানতা আরো জরুরি। বিমানের কারিগরি দিকগুলো বিশেষভাবে পরীক্ষা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবারই এ ব্যাপারে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করুন

ত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি জাহান মনি সিঙ্গাপুর থেকে সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপের উদ্দেশে যাওয়ার পথে আরব সাগরে প্রবেশ করলে লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জের কাছে সোমালি জলদস্যুরা একে ধাওয়া করে। জাহাজটি দখল করে তারা সোমালি উপকূলে নিয়ে যায় এবং ৬২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

পণ্যবোঝাই জাহাজটিতে ২৫ জন নাবিক এবং জাহাজের প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীও রয়েছেন। কিন্তু বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেলেও এখনো সরকার বা জাহাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ এ সমস্যার কোনো সমাধানে পেঁৗছতে পারেনি। পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ নয় দেখে নাবিকদের নিকটাত্মীয়রা রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন যেকোনো মূল্যে নাবিকদের জীবিত ফিরিয়ে আনার। এখন শুধু নাবিকদের আত্মীয়স্বজনই নয়, গোটা দেশ তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রী কী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ কথা ঠিক, এমন তীব্র ও বিব্রতকর অবস্থায় বাংলাদেশকে কখনো পড়তে হয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের সংকটে কী করণীয়, তাও বোধ করি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভালো করে জানা ছিল না। ব্রিটেন, ভারত, রাশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশগুলোকে প্রতিনিয়তই সোমালি জলদস্যুদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিগত দিনে সোমালি জলদস্যুদের দমন করতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী সোমালি উপকূলে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই জলদস্যুদের দমন করা যাচ্ছে না। বরং জার্মানির মতো বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ মুক্তিপণ দিয়ে জানমাল রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন? বাংলাদেশকে তার নিজের মতো করেই জলদস্যুদের হাত থেকে জানমাল রক্ষার চেষ্টা চালাতে হবে। প্রথমেই সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মুক্তিপণ দিয়ে নাবিকদের রক্ষা করা হবে কি না। যদি সরকার মুক্তিপণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দ্রুত সেটা সোমালি জলদস্যুদের অবহিত করতে হবে। আর যদি মুক্তিপণ না দিয়ে সোমালিয়া সরকার ও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করতে হবে। সর্বোপরি কী ধরনের সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করছে, তা সাধারণ মানুষকে তাৎক্ষণিক জানাতে হবে। সরকারের মনে রাখা দরকার, বিষয়টি শুধু নাবিকদের আত্মীয়স্বজন নয়, সারা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে দেশের ২৬ জন নাগরিককে উদ্ধারের চেষ্টার ওপর সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাবমূর্তি অনেকটা নির্ভর করছে। এমভি জাহান মনিতে জিম্মি নাগরিকরা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে সরকারকে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মোট কথা, যে করেই হোক, দেশবাসী দেখতে চায়, তাদের নাগরিকরা অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে। মানবিক বিবেচনাকেই জিম্মি সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে। উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, জার্মানির মতো দেশগুলো বিগত দিনে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের নাগরিকদের ছাড়িয়ে নিয়েছে। সুতরাং এ সম্ভাবনার কথাও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।

গোলাগুলি শুরু হয় আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুড়ি

রাজনৈতিক পরিবারে আমার জন্ম। আমার নানা মরহুম উকিল সেকান্দার মিয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মামা শাহাব উদ্দিন ইস্কান্দার কচি এমসিএ ছিলেন। মামীও এমপি হয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে আমাকে।
১৯৬৫ সালে মেট্রিক পাস করার পর নোয়াখালী কলেজে ভর্তি হই। তখন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। '৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হই। '৬৯-এর আন্দোলনের সময় প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে আমাদের উপস্থিতি ছিল। প্রতি মিটিংয়েই আমাদের বলা হতো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে। তখন থেকেই যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই। '৭০-এর নির্বাচনে সক্রিয় ছিলাম।
১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমাদের ট্রেনিং করানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে। দুজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য রোকেয়া হল থেকে দল বেঁধে রেসকোর্সে ছুটে যাই। সে ভাষণ শুনে প্রতিটি মানুষের মতো আমরাও উজ্জীবিত হই।
আমরা রোকেয়া হলে থাকতাম। মমতাজ আপা এবং আমার ওপর নির্দেশ ছিল যেন রোকেয়া হল না ছাড়ি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা যখন হল আক্রমণ করল, আমরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম হাউস টিউটরের বাসায়। ওই বাসার একটা স্টোররুমে সাত-আটজন মেয়ে সারা রাত ছিলাম। ২৬ মার্চ মেহেরুন্নেসা আপা আমাকে আর মমতাজ আপাকে শায়রা আপার বাসায় পেঁৗছে দেন। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে খালেদ মোহাম্মদ আলী, একরামুল হকসহ অন্য নেতারা রোকেয়া হলে যান। তাঁদের ধারণা ছিল, আমরা আর বেঁচে নেই। কিন্তু পথেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা আমাকে ওয়ারীতে ফুপা খান বাহাদুর নুরুল আমিনের বাসায় পেঁৗছে দেন। পরে রাজশাহী থেকে বাবাও আসেন।
১ এপ্রিল বাবার সঙ্গে নোয়াখালী রওনা হই। অনেক কষ্টে দুদিন পর মাইজদীতে নানাবাড়ি পেঁৗছাই। সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে সংগঠনের কাজ শুরু করি। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর কাজ করতাম। তাঁদের জন্য টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ ও তাঁদের উৎসাহ দিতাম। তখনো পাকিস্তানি বাহিনী মাইজদী ঢোকেনি। এপ্রিলের শেষে ওরা মাইজদী আসে। প্রথমেই আমার নানাবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সেখানে থাকতে না পেরে নানার গ্রামের বাড়ি কাদিরপুরে চলে যাই। ওই বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। আমার কাজ ছিল খবরাখবর আদান-প্রদান করা। পাকিস্তানি আর্মিরা মামাকে মেরে ফেলে। এরপর রাজাকারদের অত্যাচারে আর সেখানে থাকতে পারিনি। চলে যাই মামির বাবার বাড়ি মনিনগরে।
সেখানে থাকার সময়ই শেখ ফজলুল হক মনি, আ স ম রব ভাইয়ের চিঠি পাই_আমি যেন ভারতে চলে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ছোট বোন শিরিন জাহান দিলরুবা, ছোট ভাই তাহের জামিলকে নিয়ে রওনা হই। তাহের তখন ক্লাস এইটে পড়ত। ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলা পেঁৗছাই। সেখানে আমাদের আটজন মেয়েকে আলাদা করে একটা বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেখাশোনা করতেন অ্যাডভোকেট আমিনুল হক। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে লেম্বুছড়া ক্যাম্পে আমাদের সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর কে বি সিং এবং মেজর শর্মা আমাদের ট্রেনিং দিতেন। দেড় মাস ট্রেনিং নিই। অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ছোড়া, গোয়েন্দাগিরিসহ সব ধরনের ট্রেনিং আমাদের দেওয়া হয়েছিল।
ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো অপারেশনে গেলে আমাদের তাঁদের সঙ্গে পাঠানো হতো। আমাদের কাজ ছিল রেকি করা। রেকি করে খবর নিতাম। এসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিতাম।
এর পর সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিই আগস্টের শেষের দিকে। আমরা সেনবাগের দিতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সন্ধ্যায় সেনবাগের কাছাকাছি আসার পর আমরা পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাই। তারাই আমাদের ওপর প্রথম গুলি ছোড়ে। আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ি। গোলাগুলি শুরু হয়। আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুড়ে ছুড়ে মারি। ওই যুদ্ধে সাতজন পাকিস্তানি আর্মি ও চারজন রাজাকার মারা পড়েছিল। বাকিরা পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো আমরা নিয়েছি। এরপর আমাকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল মিত্রবাহিনী ঢুকবে।
মনে আছে, ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংলাদেশে ঢুকতেন, তখন রাস্তার আশপাশের বাড়ির নারীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন। চোখের জল মুছতেন অনেকে। প্রায় সবার হাতেই থাকত একটা পোঁটলা। তাতে কিছু না কিছু থাকতই। এগুলো তাঁরা গুঁজে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এ দৃশ্য এখনো মনে পড়ে।
৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হলে আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। আমার ভাই যুদ্ধ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস পর সে দেশে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, সে হয়তো মারা গেছে।
আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, সে লক্ষ্য আংশিক পূরণ হয়েছে। পুরোপুরি হয়নি। যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম, সে বাংলাদেশ গড়তে পারিনি। কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দেশের সঙ্গে, স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানি করেছে। আর এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে তেমনভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কখনোই। এখনো পুরোপুরি দেওয়া হচ্ছে না।
পরিচিতি : ফরিদা খানম সাকীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বরগুনায়। মা লুৎফুন নাহার বেগম, বাবা আবদুল আলীম। বর্তমানে তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা পরিষদের ও মহিলা সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। এ ছাড়া নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। এ সংসদের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার কথা তেমন ভাবেননি। সম্প্রতি নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড তাঁদের তিন ভাইবোনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ তুলে দেন। ফরিদা খানম সাকীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১২৭৬৯১।
অনুলিখন: ওবায়দুর রহমান মাসুম।

যুদ্ধাপরাধের বিচার, অবস্থান পাল্টাচ্ছে বিএনপি!

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান। এই বিচারের পক্ষে দলটি কখনো সোচ্চার না থাকলেও সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। কিন্তু ইদানীং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

এ নিয়ে দলের ভেতরেও দেখা দিচ্ছে ব্যাপক মতবিরোধ। বিশেষ করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই বিরোধ জোরদার হয়েছে। বিএনপির মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, সরকার বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ফাঁদ পেতেছে। আর সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। সরকারের এই উদ্যোগে প্রথমেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে বিএনপি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করবে না। তবে দল থেকে দাবি তোলা হয়, এই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ দলের প্রায় সব নেতাই এ ধরনের অভিমত দিয়ে বক্তব্য দেন। এমনকি চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ সিনিয়র পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পরও বিএনপি নীরব ছিল। কিন্তু গত ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপি মহাসচিবসহ দলের কোনো কোনো নেতার বক্তব্যের ধরন পাল্টে গেছে। খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন, '৪০ বছর পর কেন এ বিচার? এর আগেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখন বিচার করেনি। তারাই ১৯৫ জন মূল যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়েছিল। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিরোধী দলকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা। বিরোধী দলের নেতাদের মেরে ফেলার জন্য এই কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।' তাঁর এই বক্তব্য বিএনপির অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
খোন্দকার দেলোয়ারের ওই বক্তব্যের পর গত শুক্রবার দুপুরে তাঁরই সভাপতিত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি যৌথ সভা করা হয়। সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সেই সভা থেকে চট্টগ্রামে ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে পূর্ণদিবসে রূপ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে দুদিনের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে মনে করেন কি না। জবাবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবশ্যই তিনি মনে করেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে। না হলে আইনের শাসন কায়েম হবে না। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি রাজাকার। তিনি আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। বিএনপি যদি তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, হরতাল-বিক্ষোভ করে, তাহলে তো তাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি।'
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাকা চৌধুরীর মতো একজন আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নিয়ে বিএনপি প্রমাণ করেছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি বিচারের আগেই ট্রাইব্যুনাল ও বিচারকদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতেও স্পষ্ট হয়, তারা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে মানতে চাইছে না।' তিনি আরো বলেন, 'গোলাম আযম অনেক বড় রাজাকার। কিন্তু সেই সময় সাকা চৌধুরী ও তাঁর বাবা ফকা চৌধুরী গং অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। তারাই শান্তি কমিটি গঠন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি এসব অস্বীকার করে তার পক্ষ নিয়ে নিজেরাই বিচারক সাজছে।'
জানা গেছে, সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির একাংশের তৎপরতা নিয়ে দলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সমালোচক অংশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে না যায়, তাহলে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করার পর এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে কেন? জবাবে সাকা চৌধুরীর পক্ষের অংশটি বলছে, তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বিএনপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, মহাসচিবসহ একদল নেতা অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ঢাকায়ও হরতাল ডাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু দলের বড় একটি অংশ এর বিরোধিতা করায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। এমনকি ওই নেতাদের চাপে পড়ে যাতে হরতাল ডাকতে না হয়, সে জন্য দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও চীন সফরে যাওয়ার আগে দুদিন গুলশানে তাঁর অফিসে যাননি। এ ক্ষেত্রেও সাকাবিরোধী গ্রুপের চেষ্টা ছিল।
এদিকে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গত রবিবার ঢাকার মুক্তাঙ্গনে যে সমাবেশ করা হয়েছে, সেখানে অনেক নেতা অংশ নেননি। অনেকে সমাবেশে এসে হাজিরা অথবা বক্তব্য দিয়েই চলে যান। বিএনপির এটা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলেও স্থায়ী কমিটির ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ প্রভাবশালী নেতারা অনুপস্থিত থাকেন। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ মহানগর নেতাদের অধিকাংশও ওই সমাবেশে ছিলেন না।
সূত্র জানায়, সাকা চৌধুরীকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা নিয়েও প্রশ্ন আছে দলের ভেতরে। তাঁকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করার আগে অনেকে আপত্তি করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে কথা আসবে। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। তখন দলের চেয়ারপারসন বলেছিলেন, তাঁকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হবে না। কিন্তু রহস্যজনক কারণে হঠাৎ করেই তাঁকে সদস্য করা হয়। এর আগে তিনি দলের কোনো পদে ছিলেন না। দলের অনেকে মনে করেন, অদৃশ্য চাপে তাঁকে স্থায়ী কমিটির সদস্য বানানো হয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপির গঠনতন্ত্রেও উল্লেখ আছে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিরোধী কোনো ব্যক্তিকে' সদস্যপদ দেওয়া হবে না।
বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বলে ব্যাখ্যা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে বিএনপি মহাসচিব যে কথা বলেছেন, তাতে প্রমাণিত হয় তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করতে তারা ষড়যন্ত্র করছে।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের আলোচনা সভায় বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে প্রতিষ্ঠা করাই বিরোধী দল বিএনপির প্রধান কাজ। তিনি বলেন, জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করছেন। তাদের দিয়ে খালেদা জিয়া হরতাল ডাকাচ্ছেন এবং তাতে সমর্থন দিচ্ছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'স্পর্শকাতর এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কী ঘটছে তা সবাই দেখছেন।' তবে একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সৌদি আরব ভ্রমণের পর থেকে তাঁর কাছে পরিস্থিতি ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। এই বিচার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে তাঁর সংশয় দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা উচিত। কারণ এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে মানুষের মনোভাব খুব দ্রুত বদলায়।'
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, 'বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে তাঁরাই বলবেন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সব দলেরই মেনে নেওয়া এবং সরকারকে সহায়তা করা উচিত।'
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কি না বা সরকারের পাতা ফাঁদে বিএনপি পা দিচ্ছে কি না, জানতে চাওয়া হলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর গঠিত দল বিএনপি। এ দল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নয়। এর পরও আওয়ামী লীগের নেতারা বলে যাচ্ছেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। তাঁদের এ ধরনের কথা থেকেই বোঝা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। বিরোধী দলকে ধ্বংস করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের কথা, এ বিচার যাতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়।'

Tuesday, February 15, 2011

নিঃস্ব লাখো বিনিয়োগকারী

দিন যত গড়াচ্ছে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমাণ তত বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তাঁদের ক্ষোভের মাত্রা। প্রায় দুই মাস ধরে চলা অব্যাহত দরপতনে এরই মধ্যে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে।

এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার দেশের শেয়ারবাজারে আবারও বড় ধরনের দরপতন ঘটে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা বাজার নিয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও নীতিনির্ধারকসহ বিভিন্ন মহলের সমন্বয়হীন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। একপর্যায়ে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় লিপ্ত হন। এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনে থেকে পুলিশ কমপক্ষে ৬১ জন বিনিয়োগকারীকে আটক করে।
এদিকে সরকার ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার ঘোষণা আপতত কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গতকাল সকালেই সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে দুপুরে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর নিজ কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুঁজিবাজারে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ শেয়ারের দাম কমাচ্ছে, তার প্রমাণও আছে আমাদের কাছে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এখনই বাজারে ছাড়া হবে না। এ ব্যাপারে ২০ ফেব্রুয়ারির পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ সময় অর্থমন্ত্রী আবারও চলতি সপ্তাহের মধ্যে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার ইঙ্গিত দেন।
সরকার গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়ার দিনক্ষণ বেঁধে দেয়। এরপর প্রথম লেনদেন দিবসে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে। বিশেষ করে সরকারি কোম্পানিগুলো একেবারে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। বাজারে যখন চাহিদা বাড়ানো দরকার, তখন জোগান বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগ সময়োচিত হয়নি বলে সমালোচনা করেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
আগের দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল ডিএসইতে সাধারণ মূল্যসূচক ৪৭৩ পয়েন্ট বা ৭ দশমিক ৮১ পয়েন্ট কমে পাঁচ হাজার ৫৭৯ পয়েন্টে নেমে আসে। এ নিয়ে গত তিন মাসেরও কম সময়ে সূচক কমেছে তিন হাজার ৩৩০ পয়েন্টের বেশি। সূচক কমার এ হার প্রায় ৪০ শতাংশের মতো। আর এতে বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, গ্রামীণফোনের তালিকাভুক্তির সময় কৃত্রিমভাবে বাড়ানো সূচকের অংশটুকু বাদ দিলে বাজারের প্রকৃত সূচক আরও কম হবে।
যোগাযোগ করা হলে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিনিয়োগকারীদের আরও যৌক্তিক আচরণ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই বাজার তার মৌলভিত্তির চেয়ে নিচে নেমে এসেছে। তালিকাভুক্ত অন্তত ৮০ থেকে ১০০টি কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই ১০ থেকে ২০-এর নিচে নেমে গেছে। এ ধরনের শেয়ার যাঁদের হাতে রয়েছে, তাঁদের সেগুলো বিক্রি করা উচিত নয়। এতে সরবরাহ কমে গিয়ে বাজার এমনিতেই ঘুরে দাঁড়াবে।
একই সঙ্গে তিনি বাজারে চাহিদা সৃষ্টির জন্য মিউচুয়াল ফান্ড ও মার্চেন্ট ব্যাংককে আরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ডিএসই সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বাজারের গড় পিই ১৩ দশমিক ৭৭।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, বাজার এমনিতেই আস্থার সংকটে ভুগছিল। তার ওপর নানা মহলের বক্তব্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। এ অবস্থায় কেবল প্রণোদনা দিয়ে বাজারে আস্থা ফেরানো যাবে না, এ জন্য উদ্ধার বা বেইল-আউট কর্মসূচি নিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অংগ্রণী ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), সাধারণ বিমা ও জীবন বিমার সমন্বয়ে একটি মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে শেয়ার কেনার কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ব্যাপক দরপতনের মধ্য দিয়ে গতকাল ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয়। আধঘণ্টার মধ্যে সাধারণ মূল্যসূচক ৪৩৬ পয়েন্ট কমে যায়। এ সময় পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ডিএসইর সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বেরিয়ে এসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অংশ নেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ডিএসইর বিপরীত পাশে অবস্থিত মধুমিতা ভবনের ভেতর থেকে কিছু বিনিয়োগকারী ভবনের কাচ ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় ওই ভবনের সামনের সড়কে ভাঙা কাচের টুকরো পড়তে থাকে। একই সঙ্গে মধুমিতা ভবনসহ বিভিন্ন ভবন থেকে ইট, পানির বোতল ও বড় পানির জার নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর মূল ভবন ও সমবায় ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ বিনিয়োগকারীদের ধাওয়া দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অপর দিকে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগকারীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। এতে ওই এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দুপুর ১২টায় বিনিয়োগকারীরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করেন এবং গাড়ির চালক জয়নাল আবেদিনকে মারধর করেন। এ ছাড়া দৈনিক বাংলা মোড়ে আরও অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে।
এ সময় বিনিয়োগকারীরা সেখানে কর্তব্যরত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন। তাঁদের আঘাতে আরটিভির ক্যামেরাম্যান মাসুদ, চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরাম্যান আবদুর রব এবং মোহনা টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান আবুল কালাম আজাদ আহত হন।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিনিয়োগকারীরা মধুমিতা ভবনের ছয় তলায় আগুন লাগিয়ে দেন। প্রায় ২০ মিনিট পর নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণব্যবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। একই সময় ডিএসইর সামনে ঝুলন্ত তারে আগুন লাগিয়ে দেন বিনিয়োগকারীরা। তবে ডিএসইর নিরাপত্তাকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ সময় ডিএসইর কর্মচারীদের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
একপর্যায়ে বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বেলা পৌনে একটার দিকে পুলিশ সড়কের দুই পাশে অবস্থানরত বিনিয়োগকারীদের সরাতে বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে। একই সঙ্গে শুরু করে গণআটক। পুলিশ ডিএসই ভবনের (৯/ই) নিচতলাসহ বিভিন্ন ভবনে অবস্থিত ব্রোকারেজ হাউসে ঢুকে বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে এবং সেখান থেকে সাইদুর রহমান, সুমন, মাসুম ও নিপুনা সার্ভিস স্টেশনের সামনে থেকে রাসেল, মোজাম্মেলসহ অন্তত ৩০ জনকে আটক করে। সংঘর্ষ চলাকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অন্তত আটটি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।
পরে বেলা আড়াইটার দিকে মধুমিতা ভবনে অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ২৭ জন আটককে করে পুলিশ। এর আগে ডিএসইর সামনে থেকে আরও চারজনকে আটক করা হয়। এ নিয়ে আটকের সংখ্যা ৬১ জনে দাঁড়ায়। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে ৪৫ জনকে আটক করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে বিনিয়োগকারী ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত যান-চলাচল বন্ধ থাকে। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে পুলিশ বিনিয়োগকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে যান-চলাচল স্বাভাবিক হয়।
আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সেখানে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছে। অব্যাহত দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা জুতা মিছিল নিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টাকালে নগরের ডাকবাংলা মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেছেন। এ সময় তাঁরা অর্থমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আ হ ম মুস্তফা কামালের পদত্যাগ দাবি করেন। কুমিল্লায় বিনিয়োগকারীরা ঝাড়ু ও জুতা মিছিল করেছেন। এ সময় বিনিয়োগকারীরা শহরের কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে আগুন লাগাতে চেষ্টা করলে পুলিশের বাধায় পিছু হটতে বাধ্য হন। সিলেটের বিনিয়োগকারীরাও দরপতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। তাঁরা নগরে মিছিল ও রাস্তায় গাড়ির টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দরপতনের প্রতিবাদে বন্দরনগর চট্টগ্রামের বিনিয়োগকারীরা আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) কার্যালয়ের সামনের সড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
সিএসইতে গতকাল সাধারণ মূল্যসূচক এক হাজার ৩০০ পয়েন্ট বা ৭ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট কমে ১৬ হাজার ১১২-তে নেমে এসেছে। আর লেনদেন হয়েছে ৮১ কোটি টাকার শেয়ার।
অর্থমন্ত্রীর সংবাদ ব্রিফিং: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি তো বলেছিলাম এ সপ্তাহের মধ্যে বাজার স্থিতিশীল হবে। সপ্তাহ তো এখনো শেষ হয়নি।’
রোববার এক সেমিনারে দেশের পুঁজিবাজারকে ক্যাসিনোর (জুয়া খেলা) সঙ্গে তুলনা করেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রেহমান সোবহান এটা প্রতীকী অর্থে বলেছেন। আর আমি তো আগেই বলেছি, শেয়ারবাজার কোনো জুয়া খেলার জায়গা নয়। তবে এখানে কেউ কেউ আজ ১০০ টাকা এনে কালই ২০০ টাকা বানাতে চাইছেন। এমন প্রবণতা জুয়া খেলার মতোই মনে হয় তাঁর কাছে।
অর্থমন্ত্রী উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘পতনোন্মুখ অবস্থার মধ্যেও বাজারে এক লাখ নতুন বিনিয়োগকারী এসেছেন। তার মানে কী?’
ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করা) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিএসইর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। প্রথমে আপত্তি করলেও এখন তারা রাজি। ডিমিউচুয়ালাইজেশন সম্ভব না হলে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের চিন্তার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য একটি বাজারই যথেষ্ট।’
ট্রিগার সেলের আতঙ্ক: যেসব বিনিয়োগকারী মার্চেন্ট ব্যাংক ও বা ব্রোকারেজ হাউস থেকে তাঁর মূলধনের বিপরীতে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই মূলধন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এতে ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তা বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে। বাজারে এ ধরনের ঋণ সমন্বয়ের জন্য শেয়ার বিক্রির বিষয়টি বাজারে ট্রিগার সেল নামে পরিচিত। বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে বলেছেন, গতকালের দরপতনের পেছনে অন্যতম কারণ এই ট্রিগার সেল। তাঁরা বলেন, সূচক আরও কমলে ট্রিগার সেলের পরিমাণও বাড়বে। তখন বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ট্রিগার সেল বন্ধে তাঁরা সরকারি উদ্যোগের আহ্বান জানান।
বিশেষ ফান্ড অনুমোদন: এসইসি গতকাল ৫০০ কোটি টাকার ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড নামের একটি বিশেষ মিউচুয়াল ফান্ড গঠনের জন্য ট্রাস্ট চুক্তি ও নিবন্ধনের অনুমোদন দিয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ফান্ডটির মূল উদ্যোক্তা। এই চারটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ২০০ কোটি টাকার জোগান দেবে। এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের অংশ এখনই বিনিয়োগের শর্তে ফান্ডটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ফান্ডটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকছে বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ইমাম জানান, আজ মঙ্গলবার ট্রাস্ট চুক্তি ও নিবন্ধন সম্পন্ন হবে। এরপরই তাঁরা উদ্যোক্তাদের অংশ বাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন।

মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে

তিহাসিক স্থান বগুড়ার মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে! মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন বিভিন্ন স্থাপনা থেকে দিনে-দুপুরে ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সেই ইট আবার বিক্রি হচ্ছে প্রতি ভ্যান ৩০-৩৫ টাকায়।

মহাস্থানগড় এলাকার দুর্লভ প্রত্নসম্পদ থেকে লুণ্ঠিত আকারে বড় ও কারুকাজসম্পন্ন এসব ইট দিয়ে তৈরি হয়েছে অর্ধশতাধিক বাড়ি। কয়েক বছর ধরে এসব অপকর্ম চললেও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
এদিকে মহাস্থানগড়ের প্রত্নসম্পদ
ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় জমি দখলের অপরাধে মামলা দায়ের করার জন্য বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এই নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কেউ পুরাকীর্তি নষ্ট করতে এলে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত সোমবার মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতান বলখি (রহ.) মাজার শরিফের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়িই তৈরি হয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্ন ইট দিয়ে। যে যার ইচ্ছেমতো মাটি খুঁড়ে বের করেছে ঐতিহাসিক সব নিদর্শন। এরপর তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাড়িঘর। অনেক বাড়িতে প্লাস্টার (আস্তর) করা হয়নি, যাতে প্রত্ন ইটের গায়ের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দৃশ্যমান। বিশাল আকৃতির একেকটি বাড়িতে সেই প্রাচীন আমলের হাজার হাজার ইট ব্যবহার করা হয়েছে। পুণ্ড্রনগরের মহামূল্য পোড়া ইটের কোনো মূল্যই নেই তাদের কাছে। কিনে নেওয়া ছাড়াও কিছু ইট জমিতে কাজ করতে গিয়ে লাঙ্গলের ফলায় উঠে এসেছে। কিছু চুরি করে আনা হয়েছে খনন করা ঢিপি এবং পুণ্ড্রনগরীর প্রাচীর থেকে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর স্থানীয় অধিবাসীদের অজ্ঞতায় প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে এই অমূল্য সম্পদ।
স্থানীয় দোকানদার নুরুল ইসলাম জানান, এলাকায় রফিকুল নামের এক যুবক পুরনো এসব ইট বিক্রি করে। প্রতি ভ্যান ইটের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এক ভ্যানে সর্বোচ্চ ২০০টি ইট বহন করা যায়। এ ছাড়া এই ইট বিক্রির সঙ্গে আরো সংশ্লিষ্ট রয়েছে সফিকুল, মিরাজুল ও আকবর। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে প্রত্নসম্পদ রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে প্রকাশ্যে ইট বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তার পরও লুকিয়ে এসব ইট বিক্রি করা হচ্ছে। গফুর নামের আরেকজন মুদি দোকানি জানান, মাটি খুঁড়ে শুধু ইট নয়, আরো পাওয়া যায় দুর্লভ মূর্তি, সোনার পাত্রের ভাঙা অংশ। এগুলো কখনো পাওয়া গেলে তার ভাগ্য ফিরে যায়। কখনোই এসব ব্যাপার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হয় না। রাতের আঁধারে চলে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ।
মহাস্থানের পাশে মথুরা এলাকায় প্রত্নতত্ত্ব ইট দিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন আবদুল ওয়াহাব নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ভ্যানে করে এসব ইট এনেছেন। কিনেছেন ৪০ টাকা ভ্যান হিসেবে। প্রায় ১০ হাজার ইট লেগেছে তাঁর তিন কক্ষের বাড়িটি বানাতে। কেন এই ইট ব্যবহার করেছেন, এগুলোর প্রত্নতাত্তি্বক মূল্য কী সেটা জানেন_এমন প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহাব জানান, 'এই ইটাই কিনা লাভ। বেশি দাম দিয়্যা ইটা কিনবার যামু ক্যা। হামাক্যেরোক কেউ কুনুদিন ম্যানা করেনি যে, এই ইটা দিয়্যা বাড়ি করার যাবি না। তালে হামাকেরে কী দোষ।' তিনি জানান, মাত্র ১৫ দিন হলো তাঁর বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এই বাড়ি ভাড়া দেবেন।
এলাকা ঘুরে আরো দেখা গেছে, মাজারসংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা কাসেম উদ্দিন, রনজু মিয়া, আবদুল মান্নান, কাসেম আলী, মীর আলম ও সবুর মিয়ার বাড়িও প্রত্নসম্পদের ইট দিয়ে তৈরি। গড়ের আশপাশে এ ধরনের আরো অর্ধশতাধিক বাড়ি রয়েছে। তবে কোনো বাড়িতে গিয়ে বাড়ির মালিককে পাওয়া যায়নি। এসব বাড়ি ভাড়া দিয়ে মালিকরা অন্যত্র থাকেন।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, সংরক্ষিত এই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রত্নসম্পদের ইট ব্যবহারে বাধা দিতে গেলে তাঁদের পাল্টা হুমকি দেওয়া হয়। তিনি জানান, মহাস্থান এলাকায় কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেও তিনি সেটা খনন করে এসব প্রত্ন নিদর্শন বিক্রি বা ব্যবহার করার অধিকার রাখেন না। এসব ঐতিহাসিক স্থানের সব নিদর্শনের মালিক সরকার। তিনি জানান, বর্তমানে মহাস্থানের যে সম্পত্তি রয়েছে তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সম্পত্তির মালিক বনে গেছে এলাকার কিছু মানুষ। সম্প্রতি সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এসব সম্পদ অধিগ্রহণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনার। সেই মতো কাজ চলছে। অনেককে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে জমি ফেরত নেওয়া হয়েছে। তবে আফজাল হোসেন স্বীকার করেন, প্রত্নসম্পদ নষ্ট করে যেভাবে ঘরবাড়ি করা হচ্ছে তা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষার জন্য রীতিমতো হুমকি।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) নাহিদ সুলতানা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের অবস্থা হয়েছে 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার'-এর মতো। বিশাল এলাকার নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁর রয়েছে মাত্র ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে আনসার রয়েছে মাত্র সাতজন, যা দিয়ে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়।
অঙ্কন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন জানান, মহাস্থানগড়ের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দখলে রয়েছে। বাকি ৮০০ একরেরও বেশি এলাকা এখনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তহবিলের অভাবে সরকার এত দিন সেগুলো অধিগ্রহণ করেনি। পুরো এলাকাটি সে কারণে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই সেখানে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত স্থাপনা, বাড়িঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপের ওপরই মাটিতে চাষাবাদ চলছে। নানা জাতের শীতকালীন সবজি ফলানো হয়েছে। আর জমি তৈরি করতে গিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির নিচ থেকে পুরো অথবা ভাঙা ইট তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আলের পাশে। এলাকার বাসিন্দা মকবুল হোসেন জানান, স্থানীয় লোকজন গড়ের ইটের গাঁথুনি দিয়ে বাড়ি তৈরি করছে। প্রশাসনের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কখনোই কোনো বাধা তাঁরা পাননি।
আওয়ামী লীগ নেতাকে হাইকোর্টের তিরস্কার
হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বলেছেন, মহাস্থানগড়ের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধী ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। যে শ্রমিকরা এটা নষ্ট করেছে, খোঁড়াখুঁড়ি করেছে, তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাদের নিয়োগদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে।
আদালতের আদেশে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর এবং মহাস্থানগড় মাজার কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মমতাজ উদ্দিন গতকাল সকালে হাইকোর্টে হাজির হন। আদালত ডিসি ও এসপিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকে আজ মঙ্গলবার আবার আদালতে হাজির থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন রক্ষা এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ধ্বংসকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে ডিসি ও এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত এ সময় আওয়ামী লীগ নেতাকে তিরস্কার করেন।
আদালত বগুড়ার জেলা প্রশাসককে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, 'পত্রিকায় এ রকম সংবাদ যেন আর লেখা না হয় সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। শুধু বিচারক হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবেও এ দেশের প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।'
কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে মাজারসংলগ্ন মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায় কি না, জানতে চান আদালত। জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এ মসজিদটিও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং প্রত্নতত্ত্বের অংশ।
মহাস্থানগড়ের নিদর্শন রক্ষার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচপিআরবি) গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রিট আবেদন দাখিল করে। এরপর মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক স্থাপনার আশপাশের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

যুদ্ধাপরাধ : দালাল আইনে বন্দির তালিকা মন্ত্রণালয়ে

৯৭২ সালে দালাল আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়ে যারা কারাগারে ছিল, তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ রকম ৭৭৫ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। সেগুলো কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েও দিয়েছে।

সূত্র জানায়, ওই সময় দেশে মোট ২৩টি কারাগার ছিল। এর মধ্যে চারটি ছিল কেন্দ্রীয় কারাগার, বাকি ১৯টি জেলা করাগার। মূলত এই ২৩টি কারাগারেই সে সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে বন্দি করা হয়েছিল। তবে এদের অধিকাংশই ছিল জেলা (বৃহত্তর জেলা) কারাগারগুলোতে। এখন পর্যন্ত আটটি কারাগারে বন্দি করে রাখাদের মধ্য থেকে ওই ৭৭৫ জনের নাম-ঠিকানা জোগাড় করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। যথেষ্ট কাগজপত্রের অভাবে বাকি কারাগারগুলোর তালিকা এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাকি কারাগারগুলোতে থাকা যুদ্ধাপরাধের আসামিদের নামও খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কারা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কারা সদর দপ্তর থেকে ২০১০ সালের জুন মাসে তাঁরা নির্দেশ পান ১৯৭২ সালে দালাল আইনে আটক বন্দিদের তালিকা খুঁজে বের করার। এ নির্দেশের পর তাঁরা সর্বোচ্চ গুরুত
্ব দিয়ে ওই তালিকা খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু এই কারাগারে সে রকম কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই বিষয়টি তাঁরা সদর দপ্তরে লিখে জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এখনো নানাভাবে খোঁজার চেষ্টা চলছে। পাওয়া গেলে সদর দপ্তরে তালিকা পাঠানো হবে।
কারা সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বাহাত্তরের দালাল আইনে বন্দি যে ৭৭৫ জনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ৩০৯ জন, নওগাঁ কারাগারের ২৮৬ জন, পাবনা কারাগারের ১০, কুমিল্লা কারাগারের ৮৩, পটুয়াখালী কারাগারের ৮, ময়মনসিংহ কারাগারের ২৪, জামালপুর কারাগারের ৩২ ও মুন্সীগঞ্জ কারাগারের ২৩ জন। এসব নাম পাওয়ার পর গত বছর জুলাই মাসে কারা সদর দপ্তর থেকে ওই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৩৭ হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭২ সালে দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ২৬ হাজার কারাবন্দি মুক্তি পায়। আর হত্যা, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টা, অগি্নসংযোগ, নির্যাতনসহ ১৮টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত বাকি ১১ হাজার বন্দি ওই সাধারণ ক্ষমার আওতায় না আসায় তারা সে সময় মুক্তি পায়নি। পরে তাদের বিচারের জন্য ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ওইসব ট্রাইব্যুনালে কিছু আসামির বিচার সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল। বাকিদের বিচার চলছিল। পরে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দিলে বিচার হওয়া ও বিচারাধীন সব আসামিই মুক্তি পেয়ে যায়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পুস্তিকা 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচালের ষড়যন্ত্র : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়' থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে দালাল আইন বাতিল হলেও ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি বহাল আছে। এই আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া সম্ভব।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বছর ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরে দালাল আইনে বন্দিদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কারা অধিদপ্তর থেকে সেই নির্দেশনা পাঠানো হয় দেশের সব কটি কারাগারে। বর্তমানে দেশে ৬৮টি কারাগার থাকলেও ওই সময় বৃহত্তর জেলাগুলোতে একটি করে কারাগার ছিল।
একটি কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ পাওয়ার পরই আমরা কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু কাগজপত্র পাওয়া বেশ কষ্টকর। অনেক খুঁজে যাদের নাম পেয়েছি তা পাঠিয়ে দিয়েছি সদর দপ্তরে।'
কারা মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুল ইসলাম খান বলেন, 'মন্ত্রণালয় দালাল আইনে বন্দিদের নাম-ঠিকানা চাওয়ার পর আমরা যদ্দূর পারি কালেক্ট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আরো পাওয়া যায় কি না তার চেষ্টা চলছে।'
যাদের তালিকা পাওয়া গেছে তাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, 'বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ঢাকা সিটি আমির ও একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নেতা খালেক মজুমদারকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। দালাল আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়নি। আমি মনে করি, এখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হওয়া দরকার।'
একজন সাবেক কারা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর হাজার হাজার রাজাকারকে ফৌজদারি আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল। পরে তাদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই আইনে বিচারও হয় অনেকের। অনেকে সাজাও পায়। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে একটি অর্ডার হয়_যেসব রাজাকার সাজার অর্ধেক ভোগ করেছে, তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হোক। এভাবে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে অনেকে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যায়।
কারা সূত্র জানায়, ওই সময় দেশে যে ২৩টি কারাগার ছিল, তার মধ্যে ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোরে চারটি কেন্দ্রীয় ও বাকি ১৯টি ছিল জেলা কারাগার। মহকুমাগুলোতেও কিছু সাব-জেল ছিল। তবে যুদ্ধাপরাধীদের জেলা কারাগারগুলোতেই বেশি রাখা হয়েছিল।

Monday, February 14, 2011

বদলে যেতে পারে আরবের চেহারা

মিসরে যে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটল তার একমাত্র তুলনা চলে ১৯৫২ সালে সংঘটিত মিসর বিপ্লব ও রাজতন্ত্রের অবসানের দিনটির সঙ্গে। মিসরের আধুনিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবেই ওই দিনটি বিবেচিত। শুক্রবার আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা দেখল আরব বিশ্ব।

প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পতনের মধ্যদিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের সূচনা হয়েছে আরব বিশ্বে। এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এর মাধ্যমে মিসরের সম্ভাবনার দ্বার যেমন খুলে গেছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে সংকটের আবর্তে পড়ার আশঙ্কা। মুবারক চলে গেছেন, রেখে গেছেন একটা ভাঙা দেশ। আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হয়তো কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। অন্তত বিশ্লেষকদের তাই ধারণা।
মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোসহ সারা দেশ উত্তাল ছিল টানা ১৮ দিন। তাদের এ আন্দোলন শুধু মুবারকের পদত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সেটা ভাবা ঠিক হবে না। দীর্ঘ ৩০ বছর যে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে জনতা_তার অবসান, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন, অর্থনৈতিক মুক্তি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ, বেকারত্বের অবসান ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য দূর_এসবই ছিল জনতার দাবি।
১৯৮১ সালে আততায়ীর হাতে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত খুন হওয়ার পর মুবারক তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন। মিসরীয়রা তাঁকে বিশাল এক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে সময়। কিন্তু জনগণের সেই আশা ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে তিনি দেশটিকে পরিণত করলেন এক পুলিশি রাষ্ট্রে। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ১৫ লাখ সদস্যের ভয়ে জনগণ রীতিমতো আতঙ্কিত থেকেছে দীর্ঘ ৩০ বছর। প্রায় আট কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে মুষ্টিমেয় এই লোকগুলোই এত দিন ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল। আজ মুবারক নেই। কী ঘটবে এখন তাদের ভাগ্যে?
বিশ্বের কোনো দেশেই সেনাশাসনের ইতিহাস সুখের নয়। অথচ সেই সেনা পরিষদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছেন মুবারক। মুবারকের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক তো একদিনের নয়, বহু বছরের। তার ওপর তিনি ছিলেন বিমানবাহিনীরও প্রধান। বহু সেনা কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা এখনো মুবারকের শাসনব্যবস্থাই চালু রাখতে চাইবেন। দেশটির মাত্র ১০ ভাগ লোকের প্রতিনিধিত্বকারী সম্ভ্রান্ত শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেও তাঁদের রয়েছে মিত্রতা। এটাই মিসরের ট্রাজেডি। এমন অবস্থায় সেনাশাসকরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কতটা দেখাতে পারবেন তা নিয়ে সংশয়ে আছেন বিশ্লেষকরা। সেনা পরিষদ ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, তারা ৩০ বছরের জরুরি অবস্থা তুলে নেবে, সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে। বর্তমান সরকারের প্রধান মোহাম্মদ হুসেইন তান্তাবি মুবারকের একজন ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বলেই এত সব ঘোষণা সত্ত্বেও তাঁর সদিচ্ছা নিয়ে উৎকণ্ঠিত অনেকেই। বর্তমান আন্দোলনের ফসল হিসেবে হয়তো মিসরীয়রা একটি সংশোধিত সংবিধান পাবে, যে সংবিধান এত দিন মুবারকের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু তান্তাবির ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না অনেকেই। তাদের যুক্তি_যে তান্তাবিকে ২০ বছর ধরে সেনা কুজকাওয়াজে মুবারকের ঠিক পাশের আসনে দেখা গেছে, তিনি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি কতটা সন্মান দেখাবেন? জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে কতটা প্রস্তুত তিনি? তবে এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য মিসরবাসীকে আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মিসর এখনো আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু, সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে যাই ঘটুক, তার প্রভাব আরব বিশ্বে পড়বেই। তাই মুবারকের পতন শুধু মিসরের চেহারাই বদলে দেবে না, দেবে আরব বিশ্বের চেহারাও। আরব নেতারা তাই এখন চিন্তায় পড়েছেন, কিভাবে তাঁদের তরীটি ডোবার হাত থেকে রক্ষা করবেন। কী হয় দেখার জন্য অবশ্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। সূত্র : মিরর, রয়টার্স।

Sunday, February 13, 2011

বিজয়ে উন্মাতাল মিসর তবুও শঙ্কার ছায়া

সূর্য প্রতিদিনই ওঠে। কিন্তু কোনো কোনো সূর্যোদয় মানুষকে আলোড়িত করে দারুণভাবে। যেমন, গতকালের দিনটায় আলোড়িত হয়েছে মিসরের কোটি কোটি মানুষ। গতকাল শনিবার ছিল মিসরের গত ৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথম আলোকিত অনাবিল এক দিন।

তবে মুবারকবিহীন এই দিন পুরো দ্বিধাহীন নয়। কারণ গণতন্ত্র স্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনো। ক্ষমতা আপাতত সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত হওয়ায় পুরনো শঙ্কাও কাজ করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে। কেননা মুবারকরা এভাবেই মিসরে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আবারও যে কেউ হবেন না, এর নিশ্চয়তা কী? ফলে এখনো বাকি রয়েছে অপেক্ষার প্রহর।
টানা ১৮ দিন দেশজুড়ে তীব্র গণবিক্ষোভের পর হোসনি মুবারককে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারায় মিসরবাসীর মনে এখন বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার। গত শুক্রবার রাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমান পলাতক হোসনি মুবারকের পদত্যাগের বার্তাটি পাঠ করার পর থেকেই কায়রো যেন নির্ঘুম নগরী। লাখ লাখ মিসরীয় শুক্রবার রাত থেকেই আনন্দে উদ্বেল। গতকালও তারা মনের আনন্দে গেয়েছে বিজয়ের গান, উড়িয়েছে দেশের পতাকা।
এদিকে মিসরের বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী আহমেদ নাফিজের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন প্রধান কেঁৗসুলি। এ ছাড়া আত্মগোপন করে থাকা দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদলির ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব আল-আদলিসহ ক্ষমতাচ্যুত হোসনি মুবারক সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। মিসরের বার্তা সংস্থা মেনার উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল শনিবার রাতে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
মেনার খবরে বলা হয়, রাষ্ট্রের প্রধান কেঁৗসুলির দপ্তর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মুবারকের ঘনিষ্ঠ ও এনডিপির একজন শীর্ষ নেতা ইস্পাত ব্যবসায়ী আহমেদ ইজের অর্থসম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। মেনা জানায়, সাবেক গৃহায়ণমন্ত্রী আহমেদ আল-মাগরাবি এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী রশিদ মোহাম্মদ রশিদের অর্থসম্পদ নিয়েও তদন্ত চলছে। কায়রো শহরে গতকালও হয়েছে বিজয় মিছিল। যুবকরা হাতে হাত মিলিয়ে পরস্পর
অনুভূতি বিনিময় করেছে। মিসরীয়দের এ যেন পুনর্জন্মের দিন।
দুই রাত আগেও যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তাহরির স্কয়ারে ফেলা অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর উদ্বেগ ও শঙ্কায় রাত পার করেছিল, গতকাল তারাই ছিল বিজয় মিছিলগুলোর সম্মুখভাগে। তাদেরই একজন ৪০ বছর বয়সী কৃষি প্রকৌশলী ওসামা সাদাল্লাহ গতকাল মিছিল থেকে বলেন, 'আজ শুধুই উৎসবের দিন। আমাদের জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে। আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি_আমরা পারি। আজ পৃথিবীজুড়ে শুধুই আমাদের বিজয়ের সংবাদ। এ জন্য আমরা গর্বিত। এটা ভীষণ সুখের মুহূর্ত।'
অবশ্য মুবারকের পতনের পর মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাওয়ায় এ সুখ তাদের কপালে সইবে কি না, সেটা নিয়েও উৎসবের মধ্যেই চলছে নানা আলোচনা। মুবারকের পতনের আনন্দে আত্মহারা হলেও এখন মিসরীয়দের মুখে মুখে এটাও ঘুরছে_সেনাবাহিনী কি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে?
সেনা নিয়ন্ত্রণের কারণে এত দিন ধরে গণমানুষের সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো হঠাৎ করেই যেন চলে গেছে দৃশ্যপটের আড়ালে। তবে মিসরের সেনাবাহিনী গতকালও এক ঘোষণায় দেশবাসীকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দেওয়া ভাষণে খুব শিগগিরই নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন ঘটবে এবং দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে ওই বিবৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর বিষয়ে সেনা সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা জানিয়েছে, এর আগে মুবারকের শাসনামলে ইসরায়েলসহ সারা পৃথিবীর সঙ্গে মিসরের যেসব চুক্তি ছিল, সেগুলো মেনে চলা হবে। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় পাশের দেশটিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছে। বিবৃতিতে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দেশটির বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
এদিকে সেনা সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মেদ হোসেইন তানতাভি খুব শিগগিরই তাঁর সরকারের অবস্থান ও নীতি ঘোষণা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে ৭৫ বছর বয়সী তানতাভি গত শুক্রবার জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে মুবারকের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর ভাষণে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আশা করছেন মিসরের রাজনীতিবিদরা।
মিসরের রাস্তাগুলো থেকে সেনাবাহিনীর ট্যাংকসহ ভারী সাঁজোয়া যানগুলোকে গতকাল সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৮ দিনের গণবিদ্রোহের সময় সরকারি নির্দেশে সম্ভাব্য সহিংসতা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে এসব সাঁজোয়া যান কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ভেতরেও দেশটির সেনাবাহিনী আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত থাকায় এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। অন্যদিকে সেনাবাহিনী গণমানুষের বিক্ষোভ চলাকালে সরাসরি কোনো অবস্থান না নেওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতায় আসার পরও তাদের প্রতি দেশটির সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রেখেছে। এটা মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে সেনাবাহিনী অঙ্গীকার পাল্টে নিজেরাই ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিকল্পনা করলে সাধারণ মানুষ আবারও মাঠে নামবে বলেই তাঁদের ধারণা।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করায় মিসরের বিরোধী দলগুলো এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, 'মিসরবাসী পরিবর্তনের জন্য আকুল হয়ে ছিল। ক্ষমতা ছেড়ে মুবারক সে ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। মিসরবাসী প্রমাণ করেছে, বর্তমান সময়ে আদর্শ গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।'
মিসরের বৃহত্তম বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড মুবারক ক্ষমতা ছাড়ায় আনন্দিত হলেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখবে এটাই তাদের প্রত্যাশা।'
এদিকে গতকাল সুয়েজ খালের নিকটবর্তী ইসমাইলিয়া শহরে শত শত পুলিশ ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশও এ বিক্ষোভে যোগ দেয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে তারা অভিযোগ করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী তারা কেবল এ নির্দেশ পালন করেছে। তবে কাজটা ছিল জঘন্য অন্যায়। এ সময় তারা 'পুলিশ ও জনতা ভাই ভাই'-জাতীয় স্লোগান দিয়েও রাস্তা প্রকম্পিত করে। এই নির্দেশের জন্য তারা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদরিকেও দায়ী করে। উল্লেখ্য, গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের হামলায় ৩০০ মিশরীয় আন্দোলনকারী নিহত ও কায়েক হাজার আহত হয়।
এদিকে গতকাল শনিবারও কায়রোর একটি জেল থেকে ৬০০ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, জেলের ভেতরে বন্দিরা প্রথমে বিক্ষোভ করে। এরপর দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করলে জেলখানার বাইরে থেকে একদল সশস্ত্র বন্দুকধারী পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ার সময় বন্দিদের একটি অংশ পুলিশের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ সময় সৃষ্ট সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হলেও প্রায় ৬০০ বন্দি পালিয়ে যায়। আহত-নিহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ জানাতে পারেনি। তবে অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, পুলিশের একটি অংশ বিচারাধীন এসব আসামিকে জেল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
এদিকে মিসরের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দৈনিক 'আল-আহরাম' মুবারকের পতনের পর তাদের শিরোনামে লিখেছে 'দেশের তরুণ প্রজন্ম মুবারককে গদি ছাড়তে বাধ্য করল'। এ শিরোনামের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি তাদের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অন্যান্য প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে।
সূত্র : এএফপি, এপি, বিবিসি, রয়টার্স।

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

চাল নিয়ে চালবাজি তো চলছেই, এখন শুরু হয়েছে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডকারখানা। বাজার থেকে ভোজ্যতেল সয়াবিন প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার পর তা ১২ টাকা বাড়তি দাম নিয়ে ফিরে এসেছে। গত কয়েক দিন বাজারে সয়াবিনের সরবরাহ ছিল না বললেই চলে।

অথচ গতকাল শনিবার বাজার সয়াবিনে সয়লাব। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর জন্যই কয়েক দিন ধরে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল। আর লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর মাধ্যমে সেই সংকট কেটে গেল গতকাল।
সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য এবার আর তেমন কোনো কথা বলছে না। অথচ আড়াই মাস আগে এক দিনে লিটারে ১৩ টাকা বাড়ার ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৯ নভেম্বর এক দিনে ১৩ টাকা বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর চটেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান। সচিবালয়ে ডেকে তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এটা মগের মুল্লুক না। ইচ্ছেমতো ভোজ্যতেলের দর বাড়ানো চলবে না। এক দিনের ব্যবধানে ১৩ টাকা বাড়ানো কোনো ব্যবসার লক্ষণ নয়।’
তবে ব্যবসায়ীদের মুখে সেই পুরোনো কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বলেই তাঁরাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সরকারই দাম বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে, তাই তাঁরা বাড়িয়েছেন। আর সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বক্তব্য হচ্ছে, যত টাকা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি হারে বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) রাখা হয়েছে লিটার ১১৪ টাকা। আবার নজিরবিহীনভাবে খোলা সয়াবিন তেলের দরও বোতলজাতের সমানই। আর পামতেল বিক্রি হচ্ছে বাজারে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা লিটার।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন দোকান সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ৯ ফেব্রুয়ারি উৎপাদিত রূপচাঁদা পাঁচ লিটারের বোতলের খুচরা মূল্য ৫৭০ টাকা। আগে ছিল তা ৫১০ টাকা। রূপচাঁদার সঙ্গে আগে কয়েক টাকা পার্থক্য থাকলেও পুষ্টি, তীর, ফ্রেশ, দাদা, রুবাইয়া, মোস্তফা ইত্যাদি ব্র্যান্ডের সয়াবিনেরও বর্তমানে একই দর। দোকানদারেরা জানান, এখন সব সমান। গত শুক্রবার থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়েছে।
গত ৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব ১৫ দিন পরপর দাম পুনর্নির্ধারণের কথা জানিয়েছিলেন। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বৈঠক ঠিকই অনুষ্ঠিত হয় ২২ ডিসেম্বর। দুবারই ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপর থেকেই মন্ত্রণালয় নীরব।
তবে সরকার নির্ধারণ করে দিলেও কোনোবারই নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়নি ভোজ্যতেল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ বৈঠক করেও কোনো লাভ হয় না। কারণ, নির্ধারিত দরের কোনো প্রভাব থাকে না বাজারে। ব্যবসায়ীরা যা করার তা-ই করেন।’
বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট: ভোজ্যতেলের বাজারে মেঘনা গ্রুপ একটি সুপরিচিত নাম। ফ্রেশ ব্র্যান্ডের সয়াবিন এ কোম্পানির পণ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোম্পানিটি দিন দিন বাজারে তেল পরিবেশন কমিয়ে এনেছে। অর্থাৎ বিক্রি করা হয়নি। ঢাকা চেম্বারের এক সেমিনারে বাণিজ্যমন্ত্রী এ ধরনের বিষয়কেই কৃত্রিম সংকট বলে অভিহিত করেছেন।
মেঘনা গ্রুপের চার মাসের বিক্রয়চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অক্টোবরে কোম্পানিটি দুই হাজার ৯০০ টন সয়াবিন বিক্রি করে। নভেম্বরে দুই হাজার ৭৬৯ টন, ডিসেম্বরে এক হাজার ৯৩ টন এবং জানুয়ারিতে বিক্রি নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ২০২ টনে।
এলসি কম খোলা হয়েছে: ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ টনের ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। মাসিক চাহিদা এক থেকে সোয়া লাখ টন। এই চাহিদা পূরণ হয় আমদানি করা সয়াবিন ও পামতেলের মাধ্যমে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়া সরিষার মাধ্যমেও কিছুটা চাহিদা পূরণ হয়। আমদানি হয় মূলত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম মিলিয়ে বর্তমানে এক লাখ ৩০ হাজার টন ভোজ্যতেলের মজুদ রয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি সময়ে ২৪ হাজার ৫০০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন এবং ৩১ হাজার ১৭৬ টন পামতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীরা এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উদাহরণ দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, ভোক্তাদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ পামতেল, ৩৪ শতাংশ সয়াবিন তেল এবং ৮ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা ও অন্যান্য তেল ব্যবহার করে।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দর নির্ধারণ: জানা গেছে, ভোজ্যতেলের দর নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যারিফ কমিশন কয়েক দফা বৈঠক করেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা চান বেশি বাড়াতে আর কমিশন চায় যথাসম্ভব কম রাখা যায়।
গত বুধবারও এ নিয়ে নিষ্ফল বৈঠক হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ট্যারিফ কমিশনে আবার জরুরি বৈঠকে ডাকা হয় ব্যবসায়ীদের। ওই বৈঠকে নতুন দর নির্ধারিত হয়। এবার জাহাজভাড়া, কর, পরিশোধন ব্যয়, ব্যাংকের সুদ, পরিশোধনজনিত ঘাটতি এবং মুনাফাসহ মিল গেটে খোলা সয়াবিনের নতুন দর নির্ধারণ করা হয় ১০০ টাকা। খুচরা বাজারে চার টাকা করে যোগ হবে। আর বোতলজাত সয়াবিনের ক্ষেত্রে এ মূল্যের সঙ্গে বোতলের দাম যোগ হবে।
যোগাযোগ করলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সয়াবিনের নতুন দর লিটার ১০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বোতলের দাম যোগ হলেও কোনো অবস্থাতেই তা ১১৪ টাকা লিটার হতে পারে না। কাল রোববারই (আজ) বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ বাজারে চালু সব ব্র্যান্ডেরই পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের এমআরপি ৫৭০ টাকা লেখা রয়েছে জানানো হলে বিস্মিত মজিবুর রহমান বলেন, ‘এটি কীভাবে সম্ভব! একটি পেট বোতলের দাম কি তাহলে ৭০ টাকা!’
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বোতলের গায়ে নতুন মূল্য ০৯.০২.১১ তারিখ উল্লেখ রয়েছে। শুভ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম জানান, পরিবেশকদের কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তেল বিক্রি করেন না। আগের কেনা তেলও নতুন দামে বিক্রি করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান শোয়েব মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। সরকারই দেশীয় বাজারে বাড়তে দিচ্ছিল না। নতুন দর ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না।
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ হাশেম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও তাঁদের কোনো লাভ হয় না। কারণ, তাঁরা কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ পয়সা করে মুনাফা করেন। আসল মুনাফা করেন পরিশোধনকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।