Thursday, February 17, 2011

গোলাগুলি শুরু হয় আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুড়ি

রাজনৈতিক পরিবারে আমার জন্ম। আমার নানা মরহুম উকিল সেকান্দার মিয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মামা শাহাব উদ্দিন ইস্কান্দার কচি এমসিএ ছিলেন। মামীও এমপি হয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে আমাকে।
১৯৬৫ সালে মেট্রিক পাস করার পর নোয়াখালী কলেজে ভর্তি হই। তখন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। '৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হই। '৬৯-এর আন্দোলনের সময় প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে আমাদের উপস্থিতি ছিল। প্রতি মিটিংয়েই আমাদের বলা হতো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে। তখন থেকেই যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই। '৭০-এর নির্বাচনে সক্রিয় ছিলাম।
১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমাদের ট্রেনিং করানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে। দুজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য রোকেয়া হল থেকে দল বেঁধে রেসকোর্সে ছুটে যাই। সে ভাষণ শুনে প্রতিটি মানুষের মতো আমরাও উজ্জীবিত হই।
আমরা রোকেয়া হলে থাকতাম। মমতাজ আপা এবং আমার ওপর নির্দেশ ছিল যেন রোকেয়া হল না ছাড়ি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা যখন হল আক্রমণ করল, আমরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম হাউস টিউটরের বাসায়। ওই বাসার একটা স্টোররুমে সাত-আটজন মেয়ে সারা রাত ছিলাম। ২৬ মার্চ মেহেরুন্নেসা আপা আমাকে আর মমতাজ আপাকে শায়রা আপার বাসায় পেঁৗছে দেন। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে খালেদ মোহাম্মদ আলী, একরামুল হকসহ অন্য নেতারা রোকেয়া হলে যান। তাঁদের ধারণা ছিল, আমরা আর বেঁচে নেই। কিন্তু পথেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা আমাকে ওয়ারীতে ফুপা খান বাহাদুর নুরুল আমিনের বাসায় পেঁৗছে দেন। পরে রাজশাহী থেকে বাবাও আসেন।
১ এপ্রিল বাবার সঙ্গে নোয়াখালী রওনা হই। অনেক কষ্টে দুদিন পর মাইজদীতে নানাবাড়ি পেঁৗছাই। সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে সংগঠনের কাজ শুরু করি। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর কাজ করতাম। তাঁদের জন্য টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ ও তাঁদের উৎসাহ দিতাম। তখনো পাকিস্তানি বাহিনী মাইজদী ঢোকেনি। এপ্রিলের শেষে ওরা মাইজদী আসে। প্রথমেই আমার নানাবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সেখানে থাকতে না পেরে নানার গ্রামের বাড়ি কাদিরপুরে চলে যাই। ওই বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। আমার কাজ ছিল খবরাখবর আদান-প্রদান করা। পাকিস্তানি আর্মিরা মামাকে মেরে ফেলে। এরপর রাজাকারদের অত্যাচারে আর সেখানে থাকতে পারিনি। চলে যাই মামির বাবার বাড়ি মনিনগরে।
সেখানে থাকার সময়ই শেখ ফজলুল হক মনি, আ স ম রব ভাইয়ের চিঠি পাই_আমি যেন ভারতে চলে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ছোট বোন শিরিন জাহান দিলরুবা, ছোট ভাই তাহের জামিলকে নিয়ে রওনা হই। তাহের তখন ক্লাস এইটে পড়ত। ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলা পেঁৗছাই। সেখানে আমাদের আটজন মেয়েকে আলাদা করে একটা বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেখাশোনা করতেন অ্যাডভোকেট আমিনুল হক। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে লেম্বুছড়া ক্যাম্পে আমাদের সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর কে বি সিং এবং মেজর শর্মা আমাদের ট্রেনিং দিতেন। দেড় মাস ট্রেনিং নিই। অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ছোড়া, গোয়েন্দাগিরিসহ সব ধরনের ট্রেনিং আমাদের দেওয়া হয়েছিল।
ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো অপারেশনে গেলে আমাদের তাঁদের সঙ্গে পাঠানো হতো। আমাদের কাজ ছিল রেকি করা। রেকি করে খবর নিতাম। এসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিতাম।
এর পর সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিই আগস্টের শেষের দিকে। আমরা সেনবাগের দিতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সন্ধ্যায় সেনবাগের কাছাকাছি আসার পর আমরা পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাই। তারাই আমাদের ওপর প্রথম গুলি ছোড়ে। আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ি। গোলাগুলি শুরু হয়। আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুড়ে ছুড়ে মারি। ওই যুদ্ধে সাতজন পাকিস্তানি আর্মি ও চারজন রাজাকার মারা পড়েছিল। বাকিরা পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো আমরা নিয়েছি। এরপর আমাকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল মিত্রবাহিনী ঢুকবে।
মনে আছে, ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংলাদেশে ঢুকতেন, তখন রাস্তার আশপাশের বাড়ির নারীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন। চোখের জল মুছতেন অনেকে। প্রায় সবার হাতেই থাকত একটা পোঁটলা। তাতে কিছু না কিছু থাকতই। এগুলো তাঁরা গুঁজে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এ দৃশ্য এখনো মনে পড়ে।
৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হলে আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। আমার ভাই যুদ্ধ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস পর সে দেশে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, সে হয়তো মারা গেছে।
আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, সে লক্ষ্য আংশিক পূরণ হয়েছে। পুরোপুরি হয়নি। যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম, সে বাংলাদেশ গড়তে পারিনি। কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দেশের সঙ্গে, স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানি করেছে। আর এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে তেমনভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কখনোই। এখনো পুরোপুরি দেওয়া হচ্ছে না।
পরিচিতি : ফরিদা খানম সাকীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বরগুনায়। মা লুৎফুন নাহার বেগম, বাবা আবদুল আলীম। বর্তমানে তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা পরিষদের ও মহিলা সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। এ ছাড়া নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। এ সংসদের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার কথা তেমন ভাবেননি। সম্প্রতি নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড তাঁদের তিন ভাইবোনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ তুলে দেন। ফরিদা খানম সাকীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১২৭৬৯১।
অনুলিখন: ওবায়দুর রহমান মাসুম।

No comments:

Post a Comment