Thursday, February 17, 2011

পোশাক কম্পানিগুলোর নিরাপত্তা প্রসঙ্গ

কটি ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরে ২৬ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর পশ্চিমের ব্র্যান্ড কম্পানিগুলো বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের নিরাপত্তাবিষয়ক অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। হা-মীম গ্রুপের একটি কারখানার নবম তলায় আগুন লাগার ঘটনায় আরো কমপক্ষে ১০০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ গ্রুপের হাজার হাজার শ্রমিক গ্যাপ, জেসিপেনি ও ফিলিপ্স-ভ্যান হাউসেনের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করে থাকে।

বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, চুরি ঠেকানোর জন্য নিচে নামার দরজায় তালা দেওয়া থাকার কারণে আতঙ্কিত শ্রমিকরা ছাদ থেকে দড়ি বেয়ে নামার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণে বাঁচতে ব্যর্থ হন। এ মর্মান্তিক ঘটনার আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সুইডেনের হেনেস অ্যান্ড মরিৎস কম্পানির জন্য সোয়েটার উৎপাদনকারী একটি কারখানা ধসে ২১ শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। এক দশককাল ধরে ব্র্র্যান্ড কম্পানিগুলো উৎপাদনস্থলের পরিবেশ নিয়ে তদারকির যে চেষ্টা করে আসছে, এ আগুনের ঘটনা সে চেষ্টার সীমাবদ্ধতার কথাই প্রমাণ করল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্যাপ বছরের প্রথম দিকে হা-মীম গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করেছে। তারা পরিষ্কারভাবেই অগি্নকাণ্ডে বহির্গমনের পথ সুগম করার কথা উল্লেখ করেছিল। সর্বশেষ অগি্নকাণ্ডের ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে পশ্চিমা ব্র্যান্ড কম্পানিগুলোর প্রতিনিধি,কারখানার মালিক, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শ্রমিক নেতারা পোশাক শিল্পে আগুন লাগার সমস্যা নিরসনে ঢাকায় এক জরুরি আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, পোশাক শিল্প বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ
রপ্তানি করে থাকে।
এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য স্পর্শকাতর একটি সময়ে। সম্প্রতি সরকারের মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা নিয়ে শ্রমিক ও কারখানা মালিকদের মধ্যে একটি চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গত নভেম্বর থেকে নতুন ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কিন্তু শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করছেন, কিছু ফ্যাক্টরি কৌশলে মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা নিম্ন মজুরির শ্রমিকদের শ্রেণীভুক্ত করে বেতন ও বিভিন্ন ভাতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রামে ৭০টি কারখানা বিদেশি ব্র্যান্ড কম্পানির জন্য পোশাক উৎপাদন করে থাকে। গত সপ্তাহে সেখানে পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় তিনজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ২৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
চীনের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যের পোশাক-বাজার বাংলাদেশে চলে আসার পর থেকেই এই শ্রমিক অসন্তোষ লক্ষ করা যাচ্ছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বাংলাদেশ থেকে ৬ দশমিক ৮ ইউএস ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। হা-মীমে এই অগি্নকাণ্ডের পর কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড কম্পানিগুলো এ দুর্ঘটনার একটি স্বাধীন তদন্ত এবং দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিক ও শ্রমিক-পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানিকারক সব ব্র্যান্ড কম্পানি আগামী সপ্তাহে দেশটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সরকার ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের তাগিদ দিয়েছে। পোশাক কম্পানিগুলো অন্যান্য কারখানায় যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে, তা ঠেকাতে এবং কারখানা নিরাপদ করতে কী করণীয়, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপারে অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশের অসংখ্য পোশাক কারখানা এমন সব বহুতল ভবন ব্যবহার করছে, যেগুলো শিল্পের জন্য উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়নি। শিল্প উৎপাদনের জন্য যে ধরনের ভবন প্রয়োজন, তার সঙ্গে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হাজার হাজার মেশিন চলার জন্য যে ভারী বিদ্যুতের সরবরাহ প্রয়োজন, তার সঙ্গে বৈদ্যুতিক সিস্টেম মানানসই নয়; যে কারণে এ বিদ্যুতের অগি্নকাণ্ডের আশঙ্কা দেখা দেয়। শ্রমিকদেরও জরুরি অবস্থায় কী করণীয়, সে বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
ক্লিন ক্লোথ কম্পানি হিসাব করে দেখেছে, গত পাঁচ বছরে ২০০ পোশাক শ্রমিক অগি্নকাণ্ডে নিহত হয়েছেন। ২০০৫ সালে ৬৪ জন শ্রমিক স্পেকট্রাম কম্পানি ধসে পড়ায় প্রাণ দিয়েছেন।
ব্রিটেনভিত্তিক এথিক্যাল ট্রেডিং ইনেশিয়েটিভের পরিচালক পিটার ম্যাকঅলিস্টার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এ ঘটনাকে বিপজ্জনক ত্রুটি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, 'এ রকম প্রতিটি নতুন ঘটনাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সংকট আরো ঘনীভূত করছে।'

জোনাথন বির্চাল ও অ্যামি কাজমিন
ফিন্যানশিয়াল টাইমস থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

কমরেড আবদুল হক by শাহিদুল হাসান খোকন

ত শতাব্দীর চলি্লশের দশক। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা দেশজুড়ে। সামন্তবাদী এই সমাজব্যবস্থা ভাঙার দৃঢ় সংকল্পে যে কয়েকজন মানুষ যুদ্ধে নেমেছিলেন, তাঁদের তালিকায় অন্যতম ও উজ্জ্বল বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কমরেড আবদুল হক।

সামন্তবাদী পীর পরিবার থেকে আগত এই সাহসী কমরেড কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই আদর্শ ধারণ করেই মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন আবদুল হক। প্রয়াত এই বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতার পঞ্চদশ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২২ ডিসেম্বর ১৯৯৫ শুক্রবার রাত ১০টা ৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে কমরেড আবদুল হক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কমরেড আবদুল হক যশোর জেলার সদর থানার খড়কিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শাহ মুহম্মদ আবুল খায়ের ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সেই সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স পড়ার সময় তিনি ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীসভ্য পদ লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্রসংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ সময়কালে তিনি অনেক আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে গড়ে তোলেন ও অংশ নেন; যেমন_১৯৩৯ সালের হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার আন্দোলন, ১৯৪২ সালের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন, হাট তোলা আদায় বন্ধ আন্দোলন, ১৯৫০ সালের রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন ইত্যাদি। মতিন-আলাউদ্দিন উপস্থাপিত 'কৃষিতে ধনতন্ত্র' বক্তব্য খণ্ডন করে তিনি ১৯৬৯ সালে রচনা করেন 'পূর্ব বাংলা আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী' পুস্তক। পরবর্তী সময়ে জাসদের আখলাকুর রহমানের জবাবে লেখেন, 'কৃষিব্যবস্থা আধা সামন্ততান্ত্রিক' পুস্তক। ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ সালের অষ্টম কংগ্রেস পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অসুস্থ অবস্থার একটি পর্যায়ে তিনি এই পার্টির কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোর সভ্য ছিলেন। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর বলশেভিক ধরনের পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দীর্ঘ ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে তিনি আজ শুধু একজন ব্যক্তি নন, এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারায় সংশোধনবাদবিরোধী এক মহান প্রতীক হিসেবে এবং এ দেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ধারার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে এসেছেন। আবদুল হক একজন সুবক্তা ছিলেন। তাঁর উদ্দীপক বক্তৃতা প্রতিটি জনসভা উদ্দীপ্ত করত। ১৯৭০ সালের ২০ জানুয়ারি আসাদ দিবসে ভাসানী ন্যাপের আয়োজনে ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় তাঁর বক্তৃতা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রকাশ্য শেষ জনসভা। লেখক হিসেবে কমরেড আবদুল হক ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০।

অপূরণীয় ক্ষতি

বার বিমান দুর্ঘটনা। এবার বরিশালে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ল। নিহত হলেন বিমানের দুই বৈমানিক। এ নিয়ে গত ৩৮ বছরে দেশে বিমান দুর্ঘটনায় ২২ বৈমানিকসহ ৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিমানবাহিনীর এই প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় দুই পাইলটের মৃত্যু দুঃখজনক।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঠিক কোনো কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বড় কোনো সমস্যার কারণেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিমানবাহিনীর প্রধানও তেমনটি বলেছেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে বিশদ জানা যাবে।
প্রাপ্ত খবরে দেখা যাচ্ছে, বিমানবাহিনীর যে প্রশিক্ষণ বিমানটি গত সোমবার বরিশালে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি ২০ বছর আগে কেনা। এ ধরনের বিমান বিমানবাহিনীতে আরো আছে। বাংলাদেশে পিটি-৬ মডেলের বিমানের এটাই প্রথম দুর্ঘটনা। নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিমানটি নিয়ে বিমানবাহিনীর দুই স্কোয়াড্রন লিডার আকাশে উড়েছিলেন। তাঁদের বরিশাল বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী যশোর বিমানঘাঁটি থেকে বরিশাল বিমানবন্দরকে জানানোও হয়েছিল। বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণের কোনো সংকেত দেয়নি। রানওয়েতে না নেমে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিমানটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়। এভাবে রানওয়ে স্পর্শ না করে উঠে যাওয়াকে প্রশিক্ষণের ভাষায় বলে 'কাট অ্যান্ড গো'। ধারণা করা যেতে পারে, এটা বৈমানিকদের, বিশেষ করে যুদ্ধবিমানের বৈমানিকদের বিশেষ ধরনের দক্ষতা। প্রশিক্ষণ বিমানে উড়তে গিয়ে সে দক্ষতার পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন দুই বৈমানিক। সে সময় কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে। সেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হতে পারে। দুর্ঘটনার আগে ও পরে চারটি বিমান বরিশাল থেকে ঘুরে গেছে। সেই বিমানগুলো দুর্ঘটনায় পড়েনি। দুর্ঘটনায় পড়েছে এই বিমানটি।
আগেই বলা হয়েছে, সামরিক বা বেসামরিক বিমানের দুর্ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিশেষ করে সামরিক প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। বিমানবাহিনীর যে দুই কর্মকর্তা এই বিমানের বৈমানিক হিসেবে ছিলেন, তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভেতর দিয়ে বিমানবাহিনীতে এসেছিলেন। তাঁদের স্বপ্ন ছিল অনেকটা পথ যাওয়ার। তাঁদের পরিবারও তাঁদেরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একই সঙ্গে হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি। যেকোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেয়। এর আগেও অনেক সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যশোর এরিয়ার জিওসি ও একজন লে. কর্নেল নিহত হন। গত সেপ্টেম্বরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত হয়। দেখা যাচ্ছে, বিমান দুর্ঘটনা ঘটছেই; বিশেষ করে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে।
বিষয়টির দিকে সবারই দৃষ্টি দেওয়া দরকার। একের পর এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় দেশ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। যেসব প্রশিক্ষণ বিমান আছে, সেগুলো ঠিকমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই উড্ডয়নের অনুমতি দিতে হবে। দুর্ঘটনা হঠাৎ করেই ঘটে, কিন্তু একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে তা রোধ করা যায়। প্রশিক্ষণ বিমানের ক্ষেত্রে এই সাবধানতা আরো জরুরি। বিমানের কারিগরি দিকগুলো বিশেষভাবে পরীক্ষা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবারই এ ব্যাপারে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করুন

ত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি জাহান মনি সিঙ্গাপুর থেকে সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপের উদ্দেশে যাওয়ার পথে আরব সাগরে প্রবেশ করলে লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জের কাছে সোমালি জলদস্যুরা একে ধাওয়া করে। জাহাজটি দখল করে তারা সোমালি উপকূলে নিয়ে যায় এবং ৬২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

পণ্যবোঝাই জাহাজটিতে ২৫ জন নাবিক এবং জাহাজের প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীও রয়েছেন। কিন্তু বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেলেও এখনো সরকার বা জাহাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ এ সমস্যার কোনো সমাধানে পেঁৗছতে পারেনি। পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ নয় দেখে নাবিকদের নিকটাত্মীয়রা রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন যেকোনো মূল্যে নাবিকদের জীবিত ফিরিয়ে আনার। এখন শুধু নাবিকদের আত্মীয়স্বজনই নয়, গোটা দেশ তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রী কী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ কথা ঠিক, এমন তীব্র ও বিব্রতকর অবস্থায় বাংলাদেশকে কখনো পড়তে হয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের সংকটে কী করণীয়, তাও বোধ করি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভালো করে জানা ছিল না। ব্রিটেন, ভারত, রাশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশগুলোকে প্রতিনিয়তই সোমালি জলদস্যুদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিগত দিনে সোমালি জলদস্যুদের দমন করতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী সোমালি উপকূলে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই জলদস্যুদের দমন করা যাচ্ছে না। বরং জার্মানির মতো বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ মুক্তিপণ দিয়ে জানমাল রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন? বাংলাদেশকে তার নিজের মতো করেই জলদস্যুদের হাত থেকে জানমাল রক্ষার চেষ্টা চালাতে হবে। প্রথমেই সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মুক্তিপণ দিয়ে নাবিকদের রক্ষা করা হবে কি না। যদি সরকার মুক্তিপণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দ্রুত সেটা সোমালি জলদস্যুদের অবহিত করতে হবে। আর যদি মুক্তিপণ না দিয়ে সোমালিয়া সরকার ও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করতে হবে। সর্বোপরি কী ধরনের সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করছে, তা সাধারণ মানুষকে তাৎক্ষণিক জানাতে হবে। সরকারের মনে রাখা দরকার, বিষয়টি শুধু নাবিকদের আত্মীয়স্বজন নয়, সারা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে দেশের ২৬ জন নাগরিককে উদ্ধারের চেষ্টার ওপর সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাবমূর্তি অনেকটা নির্ভর করছে। এমভি জাহান মনিতে জিম্মি নাগরিকরা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে সরকারকে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মোট কথা, যে করেই হোক, দেশবাসী দেখতে চায়, তাদের নাগরিকরা অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে। মানবিক বিবেচনাকেই জিম্মি সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে। উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, জার্মানির মতো দেশগুলো বিগত দিনে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের নাগরিকদের ছাড়িয়ে নিয়েছে। সুতরাং এ সম্ভাবনার কথাও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।

গোলাগুলি শুরু হয় আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুড়ি

রাজনৈতিক পরিবারে আমার জন্ম। আমার নানা মরহুম উকিল সেকান্দার মিয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মামা শাহাব উদ্দিন ইস্কান্দার কচি এমসিএ ছিলেন। মামীও এমপি হয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে আমাকে।
১৯৬৫ সালে মেট্রিক পাস করার পর নোয়াখালী কলেজে ভর্তি হই। তখন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। '৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হই। '৬৯-এর আন্দোলনের সময় প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে আমাদের উপস্থিতি ছিল। প্রতি মিটিংয়েই আমাদের বলা হতো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে। তখন থেকেই যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই। '৭০-এর নির্বাচনে সক্রিয় ছিলাম।
১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আমাদের ট্রেনিং করানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে। দুজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য রোকেয়া হল থেকে দল বেঁধে রেসকোর্সে ছুটে যাই। সে ভাষণ শুনে প্রতিটি মানুষের মতো আমরাও উজ্জীবিত হই।
আমরা রোকেয়া হলে থাকতাম। মমতাজ আপা এবং আমার ওপর নির্দেশ ছিল যেন রোকেয়া হল না ছাড়ি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা যখন হল আক্রমণ করল, আমরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম হাউস টিউটরের বাসায়। ওই বাসার একটা স্টোররুমে সাত-আটজন মেয়ে সারা রাত ছিলাম। ২৬ মার্চ মেহেরুন্নেসা আপা আমাকে আর মমতাজ আপাকে শায়রা আপার বাসায় পেঁৗছে দেন। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে খালেদ মোহাম্মদ আলী, একরামুল হকসহ অন্য নেতারা রোকেয়া হলে যান। তাঁদের ধারণা ছিল, আমরা আর বেঁচে নেই। কিন্তু পথেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা আমাকে ওয়ারীতে ফুপা খান বাহাদুর নুরুল আমিনের বাসায় পেঁৗছে দেন। পরে রাজশাহী থেকে বাবাও আসেন।
১ এপ্রিল বাবার সঙ্গে নোয়াখালী রওনা হই। অনেক কষ্টে দুদিন পর মাইজদীতে নানাবাড়ি পেঁৗছাই। সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে সংগঠনের কাজ শুরু করি। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর কাজ করতাম। তাঁদের জন্য টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ ও তাঁদের উৎসাহ দিতাম। তখনো পাকিস্তানি বাহিনী মাইজদী ঢোকেনি। এপ্রিলের শেষে ওরা মাইজদী আসে। প্রথমেই আমার নানাবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সেখানে থাকতে না পেরে নানার গ্রামের বাড়ি কাদিরপুরে চলে যাই। ওই বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। আমার কাজ ছিল খবরাখবর আদান-প্রদান করা। পাকিস্তানি আর্মিরা মামাকে মেরে ফেলে। এরপর রাজাকারদের অত্যাচারে আর সেখানে থাকতে পারিনি। চলে যাই মামির বাবার বাড়ি মনিনগরে।
সেখানে থাকার সময়ই শেখ ফজলুল হক মনি, আ স ম রব ভাইয়ের চিঠি পাই_আমি যেন ভারতে চলে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ছোট বোন শিরিন জাহান দিলরুবা, ছোট ভাই তাহের জামিলকে নিয়ে রওনা হই। তাহের তখন ক্লাস এইটে পড়ত। ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলা পেঁৗছাই। সেখানে আমাদের আটজন মেয়েকে আলাদা করে একটা বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেখাশোনা করতেন অ্যাডভোকেট আমিনুল হক। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে লেম্বুছড়া ক্যাম্পে আমাদের সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর কে বি সিং এবং মেজর শর্মা আমাদের ট্রেনিং দিতেন। দেড় মাস ট্রেনিং নিই। অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ছোড়া, গোয়েন্দাগিরিসহ সব ধরনের ট্রেনিং আমাদের দেওয়া হয়েছিল।
ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা কোনো অপারেশনে গেলে আমাদের তাঁদের সঙ্গে পাঠানো হতো। আমাদের কাজ ছিল রেকি করা। রেকি করে খবর নিতাম। এসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিতাম।
এর পর সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিই আগস্টের শেষের দিকে। আমরা সেনবাগের দিতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সন্ধ্যায় সেনবাগের কাছাকাছি আসার পর আমরা পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাই। তারাই আমাদের ওপর প্রথম গুলি ছোড়ে। আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ি। গোলাগুলি শুরু হয়। আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুড়ে ছুড়ে মারি। ওই যুদ্ধে সাতজন পাকিস্তানি আর্মি ও চারজন রাজাকার মারা পড়েছিল। বাকিরা পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো আমরা নিয়েছি। এরপর আমাকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল মিত্রবাহিনী ঢুকবে।
মনে আছে, ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংলাদেশে ঢুকতেন, তখন রাস্তার আশপাশের বাড়ির নারীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন। চোখের জল মুছতেন অনেকে। প্রায় সবার হাতেই থাকত একটা পোঁটলা। তাতে কিছু না কিছু থাকতই। এগুলো তাঁরা গুঁজে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এ দৃশ্য এখনো মনে পড়ে।
৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হলে আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। আমার ভাই যুদ্ধ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস পর সে দেশে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, সে হয়তো মারা গেছে।
আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, সে লক্ষ্য আংশিক পূরণ হয়েছে। পুরোপুরি হয়নি। যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম, সে বাংলাদেশ গড়তে পারিনি। কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দেশের সঙ্গে, স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানি করেছে। আর এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে তেমনভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কখনোই। এখনো পুরোপুরি দেওয়া হচ্ছে না।
পরিচিতি : ফরিদা খানম সাকীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বরগুনায়। মা লুৎফুন নাহার বেগম, বাবা আবদুল আলীম। বর্তমানে তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা পরিষদের ও মহিলা সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। এ ছাড়া নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। এ সংসদের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার কথা তেমন ভাবেননি। সম্প্রতি নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড তাঁদের তিন ভাইবোনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ তুলে দেন। ফরিদা খানম সাকীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১২৭৬৯১।
অনুলিখন: ওবায়দুর রহমান মাসুম।

যুদ্ধাপরাধের বিচার, অবস্থান পাল্টাচ্ছে বিএনপি!

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান। এই বিচারের পক্ষে দলটি কখনো সোচ্চার না থাকলেও সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। কিন্তু ইদানীং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বক্তব্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

এ নিয়ে দলের ভেতরেও দেখা দিচ্ছে ব্যাপক মতবিরোধ। বিশেষ করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই বিরোধ জোরদার হয়েছে। বিএনপির মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, সরকার বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ফাঁদ পেতেছে। আর সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। সরকারের এই উদ্যোগে প্রথমেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে বিএনপি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করবে না। তবে দল থেকে দাবি তোলা হয়, এই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ দলের প্রায় সব নেতাই এ ধরনের অভিমত দিয়ে বক্তব্য দেন। এমনকি চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ সিনিয়র পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পরও বিএনপি নীরব ছিল। কিন্তু গত ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপি মহাসচিবসহ দলের কোনো কোনো নেতার বক্তব্যের ধরন পাল্টে গেছে। খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন, '৪০ বছর পর কেন এ বিচার? এর আগেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখন বিচার করেনি। তারাই ১৯৫ জন মূল যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়েছিল। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিরোধী দলকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা। বিরোধী দলের নেতাদের মেরে ফেলার জন্য এই কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।' তাঁর এই বক্তব্য বিএনপির অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
খোন্দকার দেলোয়ারের ওই বক্তব্যের পর গত শুক্রবার দুপুরে তাঁরই সভাপতিত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি যৌথ সভা করা হয়। সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সেই সভা থেকে চট্টগ্রামে ডাকা অর্ধদিবস হরতালকে পূর্ণদিবসে রূপ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে দুদিনের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে মনে করেন কি না। জবাবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবশ্যই তিনি মনে করেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে। না হলে আইনের শাসন কায়েম হবে না। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি রাজাকার। তিনি আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। বিএনপি যদি তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, হরতাল-বিক্ষোভ করে, তাহলে তো তাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি।'
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাকা চৌধুরীর মতো একজন আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নিয়ে বিএনপি প্রমাণ করেছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি বিচারের আগেই ট্রাইব্যুনাল ও বিচারকদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতেও স্পষ্ট হয়, তারা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে মানতে চাইছে না।' তিনি আরো বলেন, 'গোলাম আযম অনেক বড় রাজাকার। কিন্তু সেই সময় সাকা চৌধুরী ও তাঁর বাবা ফকা চৌধুরী গং অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। তারাই শান্তি কমিটি গঠন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি এসব অস্বীকার করে তার পক্ষ নিয়ে নিজেরাই বিচারক সাজছে।'
জানা গেছে, সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির একাংশের তৎপরতা নিয়ে দলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সমালোচক অংশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে না যায়, তাহলে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করার পর এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে কেন? জবাবে সাকা চৌধুরীর পক্ষের অংশটি বলছে, তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বিএনপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, মহাসচিবসহ একদল নেতা অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ঢাকায়ও হরতাল ডাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু দলের বড় একটি অংশ এর বিরোধিতা করায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। এমনকি ওই নেতাদের চাপে পড়ে যাতে হরতাল ডাকতে না হয়, সে জন্য দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও চীন সফরে যাওয়ার আগে দুদিন গুলশানে তাঁর অফিসে যাননি। এ ক্ষেত্রেও সাকাবিরোধী গ্রুপের চেষ্টা ছিল।
এদিকে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গত রবিবার ঢাকার মুক্তাঙ্গনে যে সমাবেশ করা হয়েছে, সেখানে অনেক নেতা অংশ নেননি। অনেকে সমাবেশে এসে হাজিরা অথবা বক্তব্য দিয়েই চলে যান। বিএনপির এটা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলেও স্থায়ী কমিটির ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ প্রভাবশালী নেতারা অনুপস্থিত থাকেন। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ মহানগর নেতাদের অধিকাংশও ওই সমাবেশে ছিলেন না।
সূত্র জানায়, সাকা চৌধুরীকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা নিয়েও প্রশ্ন আছে দলের ভেতরে। তাঁকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করার আগে অনেকে আপত্তি করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে কথা আসবে। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। তখন দলের চেয়ারপারসন বলেছিলেন, তাঁকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হবে না। কিন্তু রহস্যজনক কারণে হঠাৎ করেই তাঁকে সদস্য করা হয়। এর আগে তিনি দলের কোনো পদে ছিলেন না। দলের অনেকে মনে করেন, অদৃশ্য চাপে তাঁকে স্থায়ী কমিটির সদস্য বানানো হয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপির গঠনতন্ত্রেও উল্লেখ আছে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিরোধী কোনো ব্যক্তিকে' সদস্যপদ দেওয়া হবে না।
বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বলে ব্যাখ্যা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে বিএনপি মহাসচিব যে কথা বলেছেন, তাতে প্রমাণিত হয় তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করতে তারা ষড়যন্ত্র করছে।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের আলোচনা সভায় বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে প্রতিষ্ঠা করাই বিরোধী দল বিএনপির প্রধান কাজ। তিনি বলেন, জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করছেন। তাদের দিয়ে খালেদা জিয়া হরতাল ডাকাচ্ছেন এবং তাতে সমর্থন দিচ্ছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'স্পর্শকাতর এ বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কী ঘটছে তা সবাই দেখছেন।' তবে একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সৌদি আরব ভ্রমণের পর থেকে তাঁর কাছে পরিস্থিতি ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। এই বিচার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে তাঁর সংশয় দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা উচিত। কারণ এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে মানুষের মনোভাব খুব দ্রুত বদলায়।'
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, 'বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে তাঁরাই বলবেন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সব দলেরই মেনে নেওয়া এবং সরকারকে সহায়তা করা উচিত।'
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কি না বা সরকারের পাতা ফাঁদে বিএনপি পা দিচ্ছে কি না, জানতে চাওয়া হলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর গঠিত দল বিএনপি। এ দল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নয়। এর পরও আওয়ামী লীগের নেতারা বলে যাচ্ছেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। তাঁদের এ ধরনের কথা থেকেই বোঝা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। বিরোধী দলকে ধ্বংস করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের কথা, এ বিচার যাতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়।'