Monday, June 13, 2011

অতঃপর দেশে দুটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দল সৃষ্টি হবে by মুনীরুজ্জামান

'এ স্বাধীনতা শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা। শাসনতন্ত্র ছাড়া, মৌলিক অধিকার ছাড়া দেশের অবস্থা হয় মাঝিবিহীন নৌকার মতো। ৪টা স্তম্ভের ওপর এ শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে। এ যে ৪টা স্তম্ভের ওপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হলো, এর মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকার হচ্ছে_ একটা মূলবিধি। মূল ৪টা স্তম্ভ জনগণ ভোটের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ নাহলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমি বাঙালি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

দ্বিতীয় কথা, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে। তৃতীয়ত, সমাজতন্ত্র। তারপরে আসছে ধর্মনিরপেক্ষতা। স্পিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে ঘুষ, ধর্মের নামে ব্যভিচার_ এ বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে।
ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। আমরা ৪টি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। শাসনতন্ত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদের গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। এটা জনতার শাসনতন্ত্র। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।'
_বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশ গণপরিষদ,
ঢাকা, শনিবার
৪ অক্টোবর ১৯৭২
সূত্র : শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ
সম্পাদিত 'বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।'
আগামী প্রকাশনী (পৃ. ২১৬-২২৩)
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের যে সংবিধানটি গণপরিষদে গৃহীত হয় সেটি '৭২-এর সংবিধান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধানটি উত্থাপন করেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংবিধান উত্থাপনকল্পে বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ঐতিহাসিক এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে শুধু সংবিধানের রূপরেখাই বর্ণনা করেননি। তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন, ঐতিহাসিক পটভূমি, সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, কেন এ রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতি তার পটভূমি ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন এবং ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, রক্তদানই যে ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধানকে ঐতিহাসিকভাবে কোন বিকল্প ছাড়াই অপরিহার্য করেছে তারও ব্যাখ্যা তিনি তার ঐতিহাসিক এ ভাষণটিতে প্রদান করেছেন। সে জন্যই তিনি বিনা দ্বিধায় অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এ শাসনতন্ত্র শহীদের রক্তে লেখা। ধর্ম কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।
বস্তুত গোটা পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ যে রাজনৈতিক লড়াই করেছে তার মূল বই হচ্ছে_ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরোধিতা। আমাদের মনে রাখতে হবে স্বৈরাচারী শাসন, রাজনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব এবং ইসলামী জঙ্গিবাদের কারণে পাকিস্তান আজ যে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে তার মূলেই রয়েছে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বা রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার। এবং পাকিস্তানি রাজনীতির এ মৌল ভিত্তির বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই কারণেই '৭২-এর সংবিধানে সনি্নবেশিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, নিষিদ্ধ হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। আর এ কারণেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক-জিয়া গং প্রথম যে কাজটি করেছিল তা হচ্ছে_ সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসিয়েছিল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি রাজনীতির বা পাকিস্তানি চেতনাকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আরেক সামরিক-স্বৈরাচার এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ঢুকিয়েছিল। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল এ কারণে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি শক্তির দেশীয় প্রতিনিধি মোশতাক-জিয়া যেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্ত করে পাকিস্তানি চেতনা পুনঃস্থাপিত করতে পারে। যার সূচনা তারা করেছিল সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' বসিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বলেছিলেন 'এই সংবিধান শহীদের রক্তে লেখা।' বস্তুত শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান মোশতাক-জিয়া-এরশাদ '৭৫ পরবর্তী সময়ে ঁহফড় করেছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তে।
আদালতের আদেশে অর্থাৎ ৫ম সংশোধনী বাতিল করায় আবার সুযোগ এসেছে সংবিধান থেকে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সাম্প্রদায়িক ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতির ধারা মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার। সুযোগ এসেছে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার। সুযোগ এসেছে সংবিধান থেকে অপ্রয়োজনীয় বিসমিল্লাহ অবলোপন করার।
কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটি যে রিপোর্ট ৯ম জাতীয় সংসদে পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে_ সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকছে, রাষ্ট্রধর্ম থাকছে আবার প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা হলেও, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি যেটা করা হয়েছিল '৭২-এর সংবিধানে।
দেখা যাচ্ছে_ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আরও পরিষ্কারভাবে বললে বলতে হয় আওয়ামী লীগ ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রশ্নে সংবিধানে মোশতাক-জিয়া-এরশাদের নীতিই গ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ (বাংলাদেশ + পাকিস্তানি রাজনীতির চেতনা) গ্রহণ করছে। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটিকে সংবিধান সংশোধন করে পাকাপোক্তভাবে বহফড়ৎংব করতে যাচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে আবার একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে 'সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা' বিলোপ করার কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবে।
তামাশা আর কাকে বলে? এ যেন দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি ঠিক করা। এক পাল্লায় ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িকতা বিলোপ করার কথা, আরেক পাল্লায় বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং পরোক্ষভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ এক পাল্লায় বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ আরেক পাল্লায় পাকিস্তানি রাজনীতি। এরপর কি আর মুক্তিযুদ্ধ থাকে যা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নীতি ও আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছু থাকে? বিএনপির জাতীয় পার্টির সঙ্গে নীতি ও আদর্শে আওয়ামী লীগের কোন পার্থক্য থাকে?
প্রশ্ন হলো কেন এভাবে মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিসর্জন? সেই দলের যে দলটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই দলের এ আপসকামিতা যেন যে দল ১৯৭২ সালে শহীদের রক্তে শাসনতন্ত্র লিখেছিল। প্রশ্নটি অনেকের কাছে করেছি কেউই সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে কয়েকটি মত পাওয়া গেছে। একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি চেতনায় আওয়ামী লীগ বিএনপি-জাতীয় পার্টির বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করছে কেন? মুক্তিযুদ্ধ ছেড়ে পাকিস্তান ধরছে কেন? জবাবে তিনি বললেন চড়ষরঃরপং ড়ভ পড়হাবহরবহপব, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হলে একদিকে ধর্মের প্রশ্নে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঢাল হয় আরেকদিকে বিএনপির একটি প্রধান অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। আরেকজন বললেন, এখানে আমেরিকার একটা পলিসি আছে। আমেরিকা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নয়, মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে দেখতে চায়। এতে আমেরিকার ভারি সুবিধা, বিশেষ করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে বাংলাদেশের মডারেট মুসলিম দেশের ইমেজ বিক্রি করতে তাদের সুবিধা হয়। অন্যদিকে আমেরিকা বোধহয় হিসেব করছে যে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জামায়াতে ইসলামের মতো দলগুলোকে মেইন স্ট্রিম রাজনীতিতে ধরে না রাখলে দলুগুলো ইসলামী জঙ্গিবাদের সঙ্গে হাত মেলাবে অথবা ইসলামী জঙ্গিবাদের উৎস হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং গ্লোবস স্ট্র্যাজেডি থেকে আমেরিকা চাইছে বাংলাদেশ একটি মডারেট ইসলামিক দেশই থাকুক এবং ক্ষমতার বিবেচনায় আওয়ামী লীগ তার অতীতকে বিসর্জন দিয়ে এ লাইনেই অগ্রসর হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দিয়ে এ ঈড়সঢ়ৎড়সরংব কি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ক্ষমতার প্রশ্নে, ক্ষমতার প্লেয়ারদের ম্যানেজ করার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে ফরারফবহফ দেবে কি? অর্থাৎ ধর্ম এবং অন্য প্রশ্নে যারা আওয়ামী লীগ বিরোধী তারা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের বাংলাদেশি অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থি আদর্শ গ্রহণ করলে আওয়ামী লীগ সমর্থন করবে। বা আওয়ামী লীগের গেম-মেকার হবে? কোনদিন হবে না। এটা শেখার জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও কোন প্রয়োজন নেই তেমনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হওয়ারও দরকার নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দেয়া যে ক্ষমতার রাজনীতির একটি চাল এটা না বোঝার মতো কেউই নেই। সুতরাং যা মৌলিকভাবে বাংলাদেশই জাতীয়তাবাদের পক্ষে তারা কোন দুঃখে দুই নম্বরী 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে' সমর্থন করতে যাবে বা নির্বাচনের সময় ভোট দিতে যাবে। বরং আওয়ামী লীগের এ পদক্ষেপটি অর্থাৎ 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' ছেড়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ গ্রহণের রাজনীতিকে মোনাফেকী হিসেবেই চিহ্নিত হবে। বস্তুত আওয়ামী লীগ যদি একেবারে মওদুদী মার্কা ইসলাম ও তাদের নীতি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেও তবুও মোল্লাতন্ত্রে বিশ্বাসীরা কখনোই তাদের রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাস করবে না, তাদের ওপর আস্থা রাখবে না। নীতি-আদর্শের অবস্থানটি ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষের আদর্শ ধারণ করে ভেক হয়তো ধরা যেতে পারে কিন্তু তাতে কারও বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। এটা আমাদের দেশেই আরেক রাজনীতিতে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কিন্তু নীতি ও আদর্শের জায়গায় আপস করেননি। আপস করলে তিনি পাকিস্তানেরই প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রয়োজন হতো না আর সংবিধানও রক্তে লিখতে হতো না। এবং আপস করেননি বলেই তিনি বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব থেকে। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের যা কিছু অর্জন সেটা জনগণকে নিয়ে লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের আদর্শ ও নীতির একটি অবস্থান তৈরি করার ফলেই হয়েছে। কারও দয়ায় হয়নি, নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দেয়ার জন্যও হয়নি।
আমি বলছি না আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বেইমানি করছে। তবে আওয়ামী লীগ যে বিএনপি'র রাজনীতি গ্রহণ করল, বিএনপির রাজনীতির কাছে হেরে গেল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধস-পরাজয়ে পরাজিত হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১১-তে এসে রাজনীতিতে বিজয়ী হয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের কাছে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার বিএনপি-জামায়াতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের বড় বাধাটি আওয়ামী লীগ নিজ দায়িত্বে অপসারণ করছে।
আওয়ামী লীগ কী করবে সেটা আওয়ামী লীগের ব্যাপার। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চৎবসরংব থেকে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সে সম্পর্কে আর সন্দেহের অবকাশ থাকল না। এরপর রাজনৈতিক আশ্বাসের প্রশ্নে বিএনপি-জাপা'র সঙ্গে আওয়ামী লীগের মৌলিক কোন তফাৎ থাকবে না সেটাও বলা যায়। অতঃপর ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকেরা সহজেই বলতে পারবেন একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচনে দুুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়েও মহাজোট সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগ তাদের প্রধান রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আওয়ামী লীগ নামে দেশে দুটো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দলের অস্তিত্ব দেখা যায়।

No comments:

Post a Comment