Monday, June 13, 2011

জাতীয় ঐকমত্য জরুরি by তারেক শামসুর রেহমান

সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে গত ৮ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য ৫১ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি এ সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে।

ওই সুপারিশমালায় কী আছে, তা পাঠক ইতিমধ্যে জেনেও গেছেন। বিশেষ কমিটি গত ১০ মাসে ২৭টি বৈঠক করেছে। তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্যও নিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিদের কেউ কেউ বিশেষ কমিটির আমন্ত্রণে বক্তব্যও রেখেছেন; কিন্তু যেটা অবাক করার বিষয় তা হচ্ছে_ বিশেষ কমিটি কারও সুপারিশই আমলে নেয়নি। সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা ইত্যাদি যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের শাসনামলে এটি পাস হয়েছিল। এরশাদ এখনও চাচ্ছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি সংবিধানে থাকুক। রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে মহাজোটের শরিক বাম দলগুলোর প্রবল আপত্তি রয়েছে। এমনকি সেক্টর কমান্ডার্স ফেরামের সুপারিশও গ্রহণ করা হয়নি। ইতিমধ্যে অষ্টম সংশোধনীকে (১৯৮৭) চ্যালেঞ্জ করা একটি রিট পিটিশন (২৩ বছর আগে করা) পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্ট সরকারের ওপর একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট গত ৫ জুন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে।
উত্থাপিত সুপারিশমালা, বিরোধী দলের তাতে অংশগ্রহণ না থাকা, সর্বোপরি ২৩ বছর আগে করা একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্টের কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান_ সব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশটি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধান সংশোধনের মতো একটি জাতীয় ইস্যুতে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না। এখন সরকার যদি এককভাবে সুপারিশগুলো পাস করিয়ে নেয় তাহলে এর পরিণতির জন্য সরকারই এক সময় অভিযুক্ত হবে। বিশেষ কমিটি অনেক বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তার ধরন রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল; কিন্তু যে বিভক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তারই প্রতিফলন ঘটল সংবিধান সংশোধনীতে। সংবিধান সংশোধনীকে কেন্দ্র করে বেশকিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার জবাব খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তি হচ্ছে, উচ্চ আদালতের একটি রায়। কিন্তু রায়ে একথাটিও বলা হয়েছিল যে, আরও দুটি টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সুপারিশে এটি নেই। তাই সঙ্গত কারণেই সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়_ এ অভিযেগে কাটিয়ে ওঠা এখন কঠিন হবে। সংবিধানে মাত্র দুই টার্মের জন্য এ ব্যবস্থা থাকবে, এ ধরনের বিধান রাখা যায় না। এমনকি মূল সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেভাবে আছে, সেটাও রাখা যাবে না। কেননা তাতে করে সংবিধানে ৫৮গ(৩) ধারা মতে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা, যাতে বিএনপির রয়েছে প্রবল আপত্তি। তাই সংবিধানে নয়, বরং সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এই 'দলনিরপেক্ষ'-এর ব্যাখ্যাও সংসদকে দিতে হবে। সংসদ একটি 'এলডার্স কাউন্সিলের' প্রস্তাব করতে পারে, যেখানে চারজনের একটি টিম (দু'জন আওয়ামী লীগের, দু'জন বিএনপির মনোনীত নিরপেক্ষ ব্যক্তি) নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এখানে কেউ এককভাবে 'প্রধান উপদেষ্টার' দায়িত্ব পালন করবেন না। বিকল্প হিসেবে তিনজন 'সিনিয়র সিটিজেন (একজন প্রবীণ প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন সুশীল অথবা ব্যবসায়িক সমাজের প্রতিনিধি) নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। সংসদ যদি এ ধরনের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ধরে রাখার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগে থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে বলার কিছু থাকবে না। দুই. প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। এটাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা আগামী মাসেই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ পদে নতুনদের নিয়োগ দিতে হবে। এখন সরকার যাদেরই নিয়োগ দিক, তাদের নিয়ে বিতর্ক উঠবে। তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হবে। আর এটা তো ঠিক সামরিক-বেসামরিক আমলারা তাদের অবসরের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার দল ক্ষমতায় গেলেই তারা সরকারের একটা 'পদ' বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে, এখানে 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তি এখন খুঁজে পাওয়া ভার। 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী' হিসেবে যে তত্ত্বই হাজির করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সচিবালয়ের আমলারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেছেন। কেউ এখন বিএনপির আমলা, কেউ আওয়ামী লীগের। সুতরাং সরকার এখন যাদেরই এ পদে নিয়োগ দেবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি। সুতরাং এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিযুক্তি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায়। প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কর্মপরিধির মধ্যেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তিন. বিশেষ কমিটি যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছে ঠিক তখনই অষ্টম সংশোধনী, অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কেন সংবিধান পরিচালিত নয়, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। এখন হাইকোর্ট যদি একটি রায় দেন তাহলে তা সংসদ সদস্যদের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাতে করে হাইকোর্ট অবমাননার প্রশ্ন উঠতে পারে। উপরন্তু সুপারিশমালায় রয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়া, যেখানে বলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। এ ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরস্পরবিরোধী। এমনকি সংবিধানের ২৫(২) ধারায় যেখানে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন'_ সংবিধানের এ অংশটুকু নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে এটি সংযোজন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এ অংশটুকু ছিল না। বিশেষ কমিটি অবিশ্যিই এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করেনি। পঞ্চম সংশোধনী এখন উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ায় যে কেউ এখন সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। চার. সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে 'বাঙালি' এবং নাগরিক হিসেবে 'বাংলাদেশী' হিসেবে পরিচিত হবেন। এটা কি নতুন করে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করবে না? তবে একটি ভালো দিক হচ্ছে, প্রস্তাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কোনো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে কোনো আদিবাস নেই। পাঁচ. খসড়ায় অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মতো কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি নিয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, কেন অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত হয়, সে ব্যাপারে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে তাদের দায় এড়াতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অসহযোগিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা, সংসদ একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া ইত্যাদি কারণেই অসাংবিধানিক শক্তিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ছয়. নির্বাচন কমিশনে চারজন কমিশনার (দু'জনের পরিবর্তে) নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবের কোনো গুরুত্ব নেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোকদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার তার 'পছন্দের' লোকদের নিয়োগ দেয়। ফলে বিতর্ক বাড়ে। সুপ্রিম জডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হবে। এটি একটি ভালো প্রস্তাব। সাত. সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। বরং নারীদের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে এবং সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিতে হবে। সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে এক-পঞ্চমাংশ কিংবা এক-ষষ্ঠাংশ আসনে মহিলাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিএনপির মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা বিএনপি তথা চার দল প্রায় ৩৭ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। স্পিকার নিজে উদ্যোগী হয়ে বিএনপির মতামত নিতে পারেন এবং তা সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধান সংশোধন নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।

No comments:

Post a Comment