Friday, June 29, 2012

কক্সবাজারে আরো ৯ লাশ উদ্ধার, মৃত্যুর সংখ্যা ৪৮

কক্সবাজারে  টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া আরো নয় জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে কক্সবাজারে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৪৮ জনে।

বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ এখনো কমেনি। এক সপ্তাহ ধরে পানিতে ডুবে থাকা বসত-বাড়িগুলো এখন অধিকাংশই ভেঙে বসবাস অনুপযোগী হয়ে গেছে। তাই ঘরে ফেরা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে মধ্যে রয়েছে এলাকার বন্যাকবলিত মানুষ।
কেউ কেউ বাড়িতে ফিরতে শুরু করলেও তাদের অধিকাংশে’ই দিন কাটছে অনাহারে অর্ধাহারে। তাই কোথাও ত্রাণ বিতরণের খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছে সবাই।

ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কিছু ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে যে বরাদ্দ দুর্গত এলাকার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

এদিকে উঁচু এলাকা থেকে বন্যার পানি সরে গিয়ে জেলার নিচু এলাকায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

এছাড়া গত বুধবার রাত থেকে পাহাড়ি ঢলের পানিতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন বদরখালী, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা,ঢেমুশিয়া, কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডীসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম।

বন্যাকবলিত এলাকার হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে এখনো অবস্থান করছে। বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনো অনেক রাস্তা-ঘাট ডুবে রয়েছে।

এদিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঈদগাঁর কাছে বিধ্বস্ত একটি ব্রিজের দু’পাশে মাটি ও ইট দিয়ে সংস্কার করে যান চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সতর্কতামূলকভাবে এই ব্রিজ দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে পল্টুন দিয়ে ওই স্থানে বেইলি ব্রিজ স্থাপনের কাজ চলছে।

অপরদিকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন বন্যা দুর্গতদের জন্য পাঁচশ’ মেট্টিকটন চাল এবং নগদ ৩০ লাখ টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, এ বরাদ্দ দুর্গত এলাকার প্রয়োজনের তুলনায়  খুবই কম।

কক্সবাজারে পানি কমলেও অন্তহীন দুর্ভোগে মানুষ

কক্সবাজারে বন্যার পানি নেমে গেলেও তার ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে গেছে। ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে বেড়িবাঁধ, রাস্তা, কালভার্টসহ মানুষের ঘর-বাড়ি।

বাঁকখালী নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে শত শত মৃত গবাদিপশু। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে চারদিকে চলছে বনভাসি মানুষের হাহাকার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল, রাজারকুল দক্ষিণ মিঠাছড়ি, কাউয়ারখোপ, রশিদনগর, খুনিয়াপালং, চাকমারকুল, জোয়ারিয়ানালা, গর্জনীয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড় ইউনিয়নের প্রায় পাঁচশতাধিক গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়। তবে পানি নেমে গেলেও রয়ে গেছে অন্তহীন দুর্ভোগ।

রামু উপজেলার রাজারকুল এলাকার হাসমত আলী (৬৩) বাংলানিউজকে জানান, ৪/৫ ফুট পানিতে তলিয়ে ছিল পুরো এলাকা। এর ওপর পানির প্রচণ্ড স্র্রোত। ঘরের চাউনিতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন পরিবারের ৫ সদস্যকে নিয়ে। সে সময় তার মতো এলাকার শত শত পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলেন ঘরের ছাউনি, আশ্রয় কেন্দ্রে ও উঁচু কোনো জায়গায়। একদিন পানিবন্দি থাকার পর যখন পানি নেমে গেলো তখন দেখি চারদিকে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন।

পাহাড়ি ঢলের পানি ও পললে তলিয়ে গেছে রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ থেকে কক্সবাজার সদর উপজেলার চাঁন্দের পাড়া পর্যন্ত বাঁকখালী নদীর দু`তীরের শতাধিক একর বীজতলা ও সবজি ক্ষেত। ফলে ওইসব এলাকায় চলছে কৃষকের হাহাকার। পানিতে মারা পড়েছে শতাধিক পোল্ট্রি ফার্মের কয়েক হাজার মুরগী। নদীতে ভাসছে মৃত গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগী। মাছের ঘের ও পুকুর একাকার হয়ে গেছে পানির সঙ্গে।

রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল, রাজারকুল, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, কাউয়ারখোপ, রশিদনগর, খুনিয়া পালং, চাকমারকুল, জোয়ারিয়ানালা, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ও ঈদগড় ইউনিয়নের ৯৯টি ওয়ার্ডের সহস্রাধিক গ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্রোতের তোড়ে এসব এলাকার শত শত গ্রামীণ সড়ক বিলীন হয়ে গেছে। যার কারণে মানুষকে এখন হেঁটেই পৌঁছতে হচ্ছে গন্তব্যে। এসব সড়কের প্রায় এক ডজন ছোট-বড় কালভার্ট পানির তোড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

বিলীন হওয়া সড়কে উপড়ে পড়েছে গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি। বাঁকখালী নদীর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের ভূতপাড়ায় দু`টি, হাইটুপী, তেমুহনী, অফিসেরচর আতিক্কাবিবির ঘাট, অফিসেরচর ডাকবাংলো এলাকা, রাজারকুল, চাকমারকুল মিস্ত্রিপাড়া, নয়াপাড়া, চরপাড়াসহ অন্তত ১৫টি স্থানে বাঁধ ও সড়ক ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল।

জানা যায়, রাস্তা ও কালভার্ট বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে চলাচল বন্ধ রয়েছে রামু চৌমুহনী-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক, রামু-মরিচ্যা আরাকান সড়ক, রশিদনগর-ধলিরছড়া সড়ক, চেইন্দা-রাজারকুল সড়ক, ঈদগাঁহ-ঈদগড়, তেচ্ছিপুল-লম্বরীপাড়া সড়কসহ রামুর ছোট-বড় শতাধিক সড়কে।

দুর্গত এলাকার মানুষ জানিয়েছে, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেকেই অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি অনেক এলাকায়। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ চিড়া, গুড়, বিস্কিট, মুড়ি দিলেও তা খুবই অপ্রতুল। দুর্গত এলাকায় চলছে মানুষের হাহাকার।

জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোশতাক আহমদ বাংলানিউজকে জানান, এ রকম ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি রামুতে এই প্রথম। বর্তমানে বন্যাকবলিত প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।

রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল বাংলানিউজকে জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল। এখনও বেশিরভাগ মানুষ পানিবন্দি। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের রাস্ত-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, মৎস্য ও পোল্ট্রি খামার, অসংখ্য বসতঘর বন্যায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কিছু এলাকায় পানি নামতে শুরু করলেও বর্তমানে সবখানেই খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।

এদিকে, চকরিয়ায় দু`লক্ষাধিক মানুষ সড়ক ও বেড়িবাঁধের ওপর মানবেতর বসবাস করছে। চকরিয়া-বাঁশখালী আঞ্চলিক সড়কের চকরিয়া অংশে প্রায় ৩০ হাজার বানভাসি মানুষ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, মালামাল নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন।

পেকুয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও প্রায় শতাধিক গ্রামের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজী বাংলানিউজকে জানান, উপজেলার ৭ ইউনিয়নের ৯৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা, ৬৫ হাজার লোক ও ১৫ হাজার পরিবারের বসতবাড়ি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজু বাংলানিউজকে জানান, পেকুয়া উপকূল থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৫৯ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

পাহাড়কে বেআব্রু করায় এই দুর্যোগ

'একসময় সাগর ও নদীর তীর ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, নিরাপদ ছিল পাহাড়। সাগর উন্মত্ত হলে, নদীর তীর ভাঙলে মানুষ আশ্রয় নিত পাহাড়ে।

পাহাড়ই ছিল এখানকার সাইক্লোন শেল্টার। কিন্তু এখন সবই যেন উল্টাপাল্টা। পাহাড় এখন সবচেয়ে অনিরাপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথায় যাবে মানুষ?' সাগরপারের বাসিন্দা কঙ্বাজারের প্রবীণ শিক্ষাবিদ মোসতাক আহমদ গত কয়েক দিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালের কণ্ঠকে বলেন এ কথা।
মোসতাক আহমদ বলেন, "সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝা এ জীবনে কম দেখিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষ সব সময় আশ্রয় নিয়েছে পাহাড়ে। কিন্তু এমন কী যে হলো_এই পাহাড়েই কিনা এখন নেমে এসেছে দুর্যোগ। 'পাহাড়ে বন্যা'_এ কথা বলতেও লজ্জা করছে। পাহাড়ের আব্রু বলতে যা বোঝায় সেই গাছগাছালি মানুষই ধ্বংস করেছে। উলঙ্গ হয়ে গেছে পাহাড়গুলো। এ কারণে দুর্যোগ নেমে এসেছে।"
কঙ্বাজার-বান্দরবানের সীমানাসংলগ্ন এলাকা কঙ্বাজারের রামু, উখিয়া, চকরিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদম উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা গত দুই দিন পাহাড়ি ঢলে লণ্ডভণ্ড হয়েছে। অনেক পাহাড় ধসে গেছে। ঢলের পানিতে এসব এলাকার শত শত মাটির ঘর মিশে গেছে মাটির সঙ্গে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী গ্রামের একই পরিবারের সাতজন মঙ্গলবার প্রাণ হারিয়েছে এ রকম একটি মাটির ঘর ধসে পড়ায়। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের পাশাপাশি আদিবাসীরাও এখন আতঙ্ক ও চিন্তায় পড়েছে আকস্মিক এই পাহাড়ি দুর্যোগ নিয়ে। বাইশারী মধ্যম চাকপাড়ার বাসিন্দা উসালা চাক (৫০) বলেন, 'পাহাড়ে বর্ষণ হয় বটে, সেই বর্ষণের পানি তৎক্ষণাৎ নেমে যায়। কিন্তু এবার পানিতে ডুবে গেছে পাহাড়ি এলাকা। এ এলাকায় শতাধিক চাক ও মুরুং উপজাতির ঘর মঙ্গলবারের বর্ষণজনিত দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।' লামার ফাইতং এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম জানান, একদম নীরবেই পাহাড়ে এই দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এ রকম সাধারণত হয় না। এই দুর্যোগে পাহাড়ের রাবার বাগান থেকে শুরু করে উপজাতিদের জুম চাষেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কঙ্বাজারের রামু উপজেলার ঈদগড়ের হাসনাকাটা গ্রামের ৯৫ বছর বয়সী ফরিদুল আলম বলেন, 'বন্যা হয় নিচু এলাকায়, এখন সেই বন্যা পাহাড়ে আঘাত করায় হতবাক হয়েছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছি পরিবেশ নষ্ট করে।'
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোকতার আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একটি দেশে ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের তা নেই। তদুপরি আমাদের পাহাড়গুলোতে বন না থাকায় সামান্য বর্ষণেই মাটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে।'

কক্সবাজারে আরও ৪ লাশ উদ্ধারঃ মৃতের সংখ্যা ৪৮

কক্সবাজার জেলায় আরও ৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় চলমান দুর্যোগে ৪৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদিকে রামুতে নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ ১২ জনের সন্ধান এখনও মিলেনি।

শুক্রবার দুপুর ২টায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার সদর উপজেলার খুটাখালীতে পানিতে ভেসে যাওয়া ২ শিশুর লাশ পাওয়া যায়।
শুক্রবার চকরিয়া উপজেলায় এক নারীর ও রামু উপজেলার মিঠাছড়িতে এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়। ফলে কক্সবাজারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮ জনে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, এ পর্যন্ত কক্সবাজারে পাহাড় ধসে মারা গেছেন ২৯ জন, বজ্রপাতে ৬ জন, দেয়াল চাপায় ৩ জন ও পানিতে ডুবে মারা গেছেন ১০ জন।

এর মধ্যে পাহাড় ধসে রামু উপজেলায় ৪ জন, চকরিয়ায় ১০ জন, পেকুয়ায় ২ জন, মহেশখালীতে ৩ জন ও উখিয়া উপজেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বজ্রপাতে চকরিয়া উপজেলায় ৩ জন, পেকুয়ায় ২ জন ও মহেশখালীতে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দেয়াল চাপায় কক্সবাজার সদরে ২ জন ও মহেশখালীতে ১ জনের এবং পানিতে ডুবে কক্সবাজার সদরে ৩ জন, চকরিয়ায় ১ জন, রামুতে ৪ জন ও কুতুবদিয়ায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী বাংলানিউজকে মোট ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন।

কক্সবাজারে বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে দুর্ভোগ

কক্সবাজার জেলায় সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনের দুর্ভোগ  কমছে না। বিশুদ্ধ পানিসহ পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে প্লাবিত মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে।

এছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। যদিও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৯ মেট্রিক টন চাল, ২১ লাখ টাকা, ৪২ বস্তা চিড়া ও ৫০০ কেজি গুড় ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ইতোমধ্যে কক্সবাজার থেকে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন কোনো সংকেত দেওয়া হয়নি।

বুধবার সকাল থেকে কক্সবাজারের বৃষ্টিপাত কমে গেছে। বুধবার পুরোদিন বিরতি দিয়ে হালকা বৃষ্টি হলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃষ্টিপাত হয়নি। ফলে, কক্সবাজার জেলার ৮ উপজেলার প্লাবিত এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, টানা ৫ দিনের বৃষ্টিতে জেলার ৫২টি ইউনিয়ন পানিতে প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি জানান, এর মধ্যে ২১টি ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এসব ইউনিয়নে জরুরি ভিত্তিতে ৩৯ মেট্রিক টন চাল, ২১ লাখ টাকা, ৪২ বস্তা চিড়া ও ৫০০ কেজি গুড় ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।

টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার সদর, পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, রামু, মহেশখালী, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার প্লাবিত হয়। প্লাবিত এলাকার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন। প্লাবিত এলাকার সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলার প্রধান নদী বাঁকখালী, মাতাহুরীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও ফরিদ কলেজ সংলগ্ন সেতুতে ফাটলের কারণে এখনো কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া অন্য কয়েকটি সড়কেও যানচলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, বন্যায় রামু উপজেলার ৯৯টি ওয়ার্ড পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো.জয়নুল বারী, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. জসীম উদ্দিন, রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবী চন্দসহ বিভিন্ন কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার রামুর বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন । বন্যাকবলিত এলাকায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু খাদ্য ও পানি সংকটে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

এবিষয়ে কাউয়াখোপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক বাংলানিউজকে জানান, কাউয়াখোপ এলাকায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। বেশিরভাগ মানুষ ঘরের চালে (ছাদে) আশ্রয় নেন। সরকারিভাবে ব্যবস্থা না থাকায় তারা নিজ উদ্যোগে স্পিডবোট ভাড়া করে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন।
বর্তমানে এ ইউনিয়নের প্রতিটি ঘরে ঘরে খাদ্য ও পানি সংকট চলছে। সরকারিভাবে ৮ বস্তা চাল-ডাল ও ৩ বস্তা চিড়া বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার সংকট খুব প্রকট। এ সংকট মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

উখিয়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে ওই এলাকায় ২৫টির বেশি চিংড়ি ঘের তলিয়ে গিয়ে লাখ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাহমুদুল হক চৌধুরী, ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মিন্টু বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষকে সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় দিয়ে খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য তালিকা তৈরি করতে ইউপি চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলায় বন্যায় প্রায় ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চকরিয় পৌর শহরের ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে পৌর বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও পৌর শহর ৭/৮ ফুট পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের কয়েক শ ঘরবাড়ি, সহস্রাধিক গরু, ছাগল ও অসংখ্য হাসমুরগি পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে গেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, চকরিয়া, মহেশখালী সড়ক, চিরিংগা-পেকুয়া সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে ঢলের পানি উপচে পড়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

চকরিয়া পৌরসভা ও উপজেলার কয়েকটি এলাকায় পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য জাফর আলমের উদ্যোগে লঙ্গরখানা খুলে মানুষকে খাবার দেওয়া হচ্ছে।

চকরিয়ার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক বাংলানিউজকে জানান, চকরিয়ায় প্রায় ৪০ হাজার একর চিংড়ি ঘেরের ৫ শতাধিক চিংড়ি ঘের ও সহস্রাধিক পুকুর পাড় উপচে শতকোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। চকরিয়া বিমানবন্দরে সেনাক্যাম্পে ঢলের পানি ঢুকে তাদের স্থাপনাগুলো ৩ ফুট পানির নিচে রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও পরিষদ থেকে ৫ হাজার কেজি চিড়া, ২ হাজার কেজি গুড় ও ৮ টন চাল বানভাসীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন।

পেকুয়ায় শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

পেকুয়ার মগনামার চেয়ারম্যান শহিদুল মোস্তফা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, প্রায় ৫ চেইন বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে পুরো মগনামা ইউনিয়নে জোয়ার-ভাটা চলছে।

উজানটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এটিএম শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ করিয়ারদিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ওই এলাকায় এখন বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর-ই খাজা আলামীন বাংলানিউজকে জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে ৭ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধস, বজ্রপাতে কক্সবাজারের ৪৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছে, অসংখ্য গবাদিপশু।