Wednesday, July 06, 2011

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে শেখ হাসিনার ডিগবাজি, সংঘাতের দিকে বাংলাদেশ by ফিরোজ মাহবুব কামাল

ঘৃণার রাজনীতি কোন দেশেই সুফল বয়ে আনে না। ঘৃণা সমাজে বারুদের কাজ করে,সময় বুঝে তা ভয়ানক বিস্ফোরণও ঘটায়। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অনেক। তবে এ দলটি ক্ষমতায় গেলে যে কাজটি অতি ব্যাপক ভাবে করে সেটি ঘৃণার রাজনীতি। সেটির চর্চা যেমন সত্তরের দশকে শেখ মুজিবের হাতে হয়েছিল। তেমনি শেখ হাসিনার হাতেও হচ্ছে। শেখ মুজিরেব ঘৃণার রাজনীতিতে প্রায় ৪০ হাজার বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বিহারী ঘরবাড়ী হারিয়ে পথে বসেছিল। বহু হাজার সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি চাকুরি হারিয়েছিল। কিন্তু সে ঘৃণার আগুন থেকে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারও বাঁচেনি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় ব্যর্থতা হল,তারা অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না। ফলে একই গর্তে তাদের পা বার বার পড়ে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ঘৃণার সে বিস্ফোরক বারুদকে তিনি দেশময় গভীরভাবে বিছিয়ে চলেছেন। দেশব্যাপী একটি যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব গড়ে তুলেছেন। ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসেন তখন খালেদা জিয়াকে তাঁর ক্যান্টমেন্টের বাসা থেকে উচ্ছেদ করেননি, তার ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা এবং ধরপাকড়ের ব্যবস্থাও করেননি। জামায়াত নেতাদেরও তখন দলে দলে জেলে তুলেননি। ফজলুল হক আমিনীর ছেলেও সে সময় নিখোঁজ হয়নি। শেখ হাসিনার ঘৃণা এখন শুধু বিএনপি,জামায়াত বা ফজলুল হক আমিনীর বিরুদ্ধে নয়,বরং প্রতিবাদী জনগণের বিরুদ্ধেও যারা সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর। ঘৃণা ঘৃণারই জন্ম দেয়। শেখ হাসিনা ঘৃণার রাজনীতি জনগণের মনেও তাঁর প্রতি ভালবাসার জন্ম দেয়নি।
বারুদে আগুন ধরাতে পেট্রোল ঢালতে হয় না। দূর থেকে জ্বলন্ত কাঠি ফেলা মাত্রই বিস্ফোরণ শুরু হয়। দেশব্যাপী আজ তেমনই এক বিস্ফোরণ-উম্মুখ অবস্থা। সে বারুদের উপর ম্যাচের জ্বলন্ত কাঠি ফেলার কাজটি এবা করলো দেশের সুপ্রিম কোর্ট। এবং সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বেআইনী ঘোষণা দিয়ে। ফলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিস্ফোরণও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে এর আগেও বাংলাদেশ হাইকোর্টে দুইবার মামলা উঠিছিল। প্রথম বার ১৯৯৬ সালে এবং দ্বিতীয় বার ২০০৪ সালে। দুইবারই হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে রায় দিয়েছিল। ২০০৪ সালে প্রদত্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এবার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বেঞ্চের ৭ জন বিচারপতি একমত হতে পারেননি। ৪ জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিলোপের পক্ষে রায় দেন,৩ জন মত দিয়েছেন সে রায়ের বিপরীতে। বিষয়টি যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভবত সে চিন্তাটি মাথায় রেখেই সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ৮ জন প্রবীন আইনবিদকে অ্যামিকাস কিউরি রূপে পরামর্শ দিতে ডাকা হয়। তাদের মধ্যে ৭ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন।
সুপ্রিম কোর্টের এ রায় নিয়ে বিস্ময় অনেকেরই। কারণ,৭ জন বিচারপতির মধ্যে ৪ জন বিচারপতি যে রায়টি দিয়েছেন সেটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একবার নয়,দুই বার রায় দিয়েছে। হাইকোর্টের সাথে একমত হয়ে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আরো তিনজন বিচারপতি। হাইকোর্টের উক্ত রায়ের অনুরূপ কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট যে ৮ জন প্রবীন আইন-বিশেষজ্ঞদের পরার্মশ চেয়েছিল তাদের ৭ জন।
এখানে আরো চিন্তার বিষয়,তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি কোন একটি বিশেষ দলের ছিল না। ছিল সকল রাজনৈতিক দলের। বিএনপি প্রথমে বিরোধীতা করলেও তারাও তাতে সম্মতি দিয়েছিল। রাজনৈতিক দল-বহির্ভূত কোন আইনবিদও সে সময় এমন একটি পদ্ধতির বিরোধীতা করেননি। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে ইতিমধ্যে ৩টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেসব নির্বাচনে বহু হাজার ব্যক্তি অংশ নিয়েছেন। বহু শত ব্যক্তি নির্বাচিতও হয়েছেন,তারা সংসদেও বসেছেন এবং আজও বসছেন। প্রশ্ন হল, সুপ্রিম কোর্ট আজ যেটিকে শাসনতন্ত্র বিরোধী বলে ঘোষণা দিল সেটি বিগত ১৫ বছরে ধরা পড়লো না কেন? বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে যে বহুশত ব্যক্তি নির্বাচিত হলেন এবং সংসদে আইন প্রণয়নে অংশ নিলেন তাদের সম্মিলিত মেধা কি সুপ্রিম কোর্টের মাত্র ৪ জন বিচারপতির মেধার তুলনায় তুচ্ছ? আরো প্রশ্ন হল, তারা যদি শাসনতন্ত্র বিরোধী এমন একটি মস্তবড় বেআইনী বিধানকে সনাক্ত করতে না পারেন,তবে তার চেয়ে মারাত্মক অযোগ্যতা আর কি হতে পারে? এত বড় অযোগ্যতা নিয়ে কি তারা দেশের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার অধিকার রাখেন? সংসদে বসারও কি যোগ্যতা রাখেন? তাদের তো সত্ত্বর রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়া উচিত। সেটি হওয়া উচিত শুধু বিএনপি,জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের নেতাদের ক্ষেত্রে নয়,আওয়ামী লীগের নেতাদের বেলায়ও। ফলে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আইনবিদ ও সংসদ সদস্যদের মেধা ও যোগ্যতাকেই গুরুতর ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রশ্নবিদ্ধ সুপ্রিম কোর্ট
তবে সুপ্রিম কোর্টের এ রায়টি খোদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের যোগ্যতাকেও কম প্রশ্নবিদ্ধ করেনি। সুপ্রিম কোর্ট আজ যেমন বহাল তবিয়তে আছে,১৫ বছর আগেও ছিল। অথচ সুপ্রিম কোর্ট আজ বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা দেশের শাসনতন্ত্র-পরিপন্থি। এটি তো ভয়ানক কথা! সুপ্রিম কোর্টের বড় দায়িত্ব হল,সংবিধানের সুরক্ষা। অথচ এ সুপ্রিম কোর্টের কয়েক ডজন বিচারপতির চোখের সামনে এতবড় একটি সংবিধান বিরোধী প্রথা বেঁচে আছে বিগত ১৫ বছর ধরে! আরো গুরুতর বিষয়,এমন একটি সংবিধান বিরোধী প্রথার অধীনে সরকার প্রধান হয়েছেন খোদ সুপ্রিম কোর্টেরই বিচারপতিরাই। তাহলে কি দীর্ঘ ১৫ বছর পর বিচারপতিদের সদ্য ঘুম ভাঙ্গলো? এটি মেনে নিতেই হবে,দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরাও মানুষ। তারা ফেরেশতা নন, অতি মানবও নন। সলিমুদ্দিন,কলিমদ্দিনের ন্যায় তাদের ঘুম আসে, ঘুমও ভাঙ্গে। সলিমুদ্দিন,কলিমদ্দিনের ন্যায় তাদের জীবনেও দারিদ্রতা আসে। তাদেরও খয়রাত নিতে হয়। ফলে প্রধান বিচারপতির মত ব্যক্তিরও ত্রাণ তহবিল থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ত্রাণ নেয়ার প্রয়োজন হয়। যেমনটি প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লক্ষ টাকা নিয়েছেন। (সূত্র- দৈনিক আমার দেশ,৩০/৫/১১)।
সমস্যা বাধে তখন যখন তারা দেশের জটিল রাজনৈতিক বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া শুরু করেন। আরো বিস্ময়ের বিষয়, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে সংবিধান বিরোধী বলা হলেও আগামী দুইটি নির্বাচন তার অধীনে করা যেতে পারে বলে রায় দেয়া হয়েছে। এটিই বা কেমন কথা? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যদি শাসনতন্ত্রের পরিপন্থিই হয় তবে সেটি তো সাথে সাথেই বিলুপ্ত হওয়া উচিত। আগামী দু'টি নির্বাচনের জন্য আবার বাঁচিয়ে রাখা কেন?

আদালতের বিতর্কিত রায় ও তার বিরূপ পরিণতি
আদালতের রায়ও যে দেশের জন্য অতি ক্ষতিকর ভূমিকা রাখতে পারে সে নজির ইতিহাসে অনেক। পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মারাত্মক মরণ ছোবলটি হেনেছিল সেদেশের সুপ্রিম কোর্ট। সেটিও এসেছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে। তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল তথা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন জনাব গোলাম মহম্মদ। তিনি তার কর্ম জীবনে ছিলেন একজন সরকারি আমলা। তিনি পাকিস্তানের গণপরিষদকেই ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জনাব মোহম্মদ আলী বোগরা। আর গণপরিষদ তথা জাতীয় সংসদের স্পীকার ছিলেন ফরিদপুরের জনাব মৌলবী তমিজ উদ্দিন খান। গণপরিষদ তখন পার্লামেন্টারী ধাঁচের শাসনতন্ত্র নির্মাণের কাজ প্রায় সমাধা করে ফেলেছিল। গণপরিষদের অপরাধ,শাসনতন্ত্রে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস করেছিল,কেঁড়ে নিয়েছিল তাঁর গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষমতা। এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণোয়নের উদ্যোগ বানচাল করতেই গোলাম মহম্মদ গণপরিষদকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। সে সময় জনাব মহম্মদ আলী বোগরা সরকারের প্রতি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থণও ছিল। কিন্তু গোলাম মহম্মদ তাঁকে সেটি প্রমাণেরও সুযোগ দেননি। জনাব মহম্মদ আলী বোগরা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরে ছিলেন।ফল দাঁড়ালো,বিপাকে পড়লো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার কাজটি। স্মরণীয় বিষয় হল,গোলাম মহম্মদের সে স্বৈরাচারি কর্মকে আওয়ামী লীগ সেদিন সমর্থণ করেছিল। গোলাম মহম্মদের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মৌলবী তমিজ উদ্দিন খান মামলা করেছিলেন। সিন্ধু হাইকোর্টে তিনি সে মামলায় জিতেছিলেনও। কিন্তু হেরে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। তখন দেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন জাস্টিস মুনির। তাঁর সে রায়টি পাকিস্তানের ইতিহাসে আজও প্রশ্নবৃদ্ধই রয়ে গেছে। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের বুকে প্রথম চাকুটি তিনিই ঢুকিয়েছিলেন,কোন রাজনৈতিক দলের নেতা বা সামরিক বাহিনীর কোন জেনারেল নয়। গণতন্ত্রের দেহে তখন যে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়েছিল,তা থেকে আর কখনই সুস্থতা ফিরে আসেনি। সে মামলায় অপর বিচারপতি ছিলেন জাস্টিস কর্নেলিয়াস। তিনি প্রধান বিচারপতির বিপরীত রায় দিয়েছিলেন;সিন্ধু হাইকোর্টের রায়কে তিনি সঠিক বলেছিলেন।

শেখ হাসিনার পরাজয় এড়ানোর কৌশল
আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে,আগামী নির্বাচনে তাদের বিজয় অসম্ভব। সেটি টের পেয়েছে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন, পৌর সভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল দেখে। ফলে আওয়ামী সরকারের প্রধান এজেন্ডা দেশে চাল-ডালের দাম কমানো বা বিদ্যুৎ বা পানির সরবরাহ বাড়ানো নয়। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নও নয়। বরং সেটি হল, যেভাবেই হোক আগামী নির্বাচনে পরাজয় ঠেকানো। নইলে রাষ্ট্রীয় তহবিলের উপর তাদের দখলদারি শেষ হয়ে যাবে। দখলদারি শেষ হবে প্রশাসন ও পুলিশের উপর দখলদারিও। পরাজয় ঠেকাতে তাদের মূল কৌশলটি হল, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বটি নিজ হাতে নেয়া। সেটি করতে হলে প্রয়োজন হল,তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি আস্তাকুঁড়ে ফেলা। আদালতের দরজায় ধর্ণা দেয়ার মূল হেতু তো এখানেই।
নির্বাচন অনষ্ঠানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নিজ হাতে নিলে সেটি যে কেমন রূপ নেয় তার প্রমাণ তারা এবার ভোলার উপনির্বাচনে প্রমাণ রেখেছে। নব্বইয়ের দশকে সেটির নজীর রেখেছিল পাবনার উপ-নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ সরকার এ পর্যন্ত একটি বারও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের রেকর্ড রাখতে পারিনি। তাদের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র একবার, এবং সেটি ১৯৭৩ সালে খোদ শেখ মুজিবের শাসনামলে। কিন্তু তিনিও কোন উন্নত দৃষ্টান্ত রাখতে পারেন। সে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ইতিহাসে বড়ই বেদনাদায়ক। সে সময় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নিজামী ইসলাম পার্টির ন্যায় প্রধান দলগুলোকে মুজিব সরকার নিষিদ্ধ করেছিল এবং কারারুদ্ধ করা হয়েছিল তার নেতাদের। মেজর আব্দুল জলীল নেতৃত্বাধীন জাসদ এবং ভাসানী ন্যাপ ময়দানে থাকলেও তাদের উপর রক্ষিবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। নির্বাচন কি করবে,প্রাণে বাঁচাই তাদের দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন এক দেশ ও এক নেতার শ্লোগান দিয়ে বিরোধী দলের রাজনীতিকেই অসম্ভব করে তোলা হয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারণা দূরে থাক, বহু বিরোধী প্রাথীকে নমিনেশনের কাগজ পর্যন্ত দাখিল করতে দেয়নি। সে নির্বাচনে শেখ মুজিবসহ বহু আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী ঘোষণা দেয়া হয়।

আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদের রাজনীতি
আওয়ামী লীগের রাজনীতিততে সুবিধাবাদ যে কতটা প্রকট সেটিরও পুণরায় বিস্ফোরণ ঘটলো। এবং সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাটি কোন দলের নয়,সমগ্র দেশের। এটি কোন আইনগত সমস্যাও নয়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। তাই এ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে হওয়া উচিত ছিল। শেখ হাসিনার উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে সংসদে যাওয়া। কিন্তু সংসদে না গিয়ে শেখ হাসিনা তিনি এটির বিলুপ্তি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন আদালতকে দিয়ে। শেখ হাসিনার বুঝা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ ইস্যুতে অতীতে দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে। বহু হরতাল, বহু ভাংচুর, বহু নাশকতা ও বহু প্রাণহানি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনকিছুরই সহজে সমাধা হয় না। অতি দূরুহ ব্যাপার হল,সব দল মিলে কোন বিষয়ে এক মত হওয়া। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি এমন একটি ইস্যু যা নিয়ে সকল দল একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিল। একটি রাজনৈতিক সমাধানও হয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। ছিল এক বিশাল অর্জন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটির আর কোন প্রয়োজন নাই।তারা চায়,এটিকে আস্তাকুঁরে ফেলতে। আস্তাকুঁড়ে ফেলার সে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারা দেশের সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশে সমস্যা অনেক,কোন একটি সমস্যাকে নিয়ে রাজনীতিতে প্রচণ্ড ঝড় তোলাও অসম্ভব কিছু নয়। দেশের এরূপ নাজুক অবস্থায় সবাই শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। এ অবস্থায় একটি settled ইস্যুকে unsettled করার কোন হেতু আছে কি? এতে কি দেশের কোন কল্যাণ হয়? কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাই করলো।
প্রশ্ন হল, আওয়ামী লীগ কি ভেবে নিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির এ সিদ্ধান্তকে বিরোধী দলগুলো মেনে নিবে? আদালতের রায়ের নামে সেটির উপর সুগারকোট লাগালেই কি সেটি গ্রহণযোগ্য হয়? সেটি মেনে নিলে কি বিরোধী দলের রাজনীতি থাকে? তাদের অস্তিত্বও কি তাতে বাঁচবে? সরকারি দলন নীতির ফলে বিরোধী দলগুলোর পিঠ ইতিমধ্যেই দেয়ালে ঠেকেছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তু তাদেরকে বরং আরো ক্ষিপ্ত করবে। সরকারি দলের ন্যায় বিরোধী দলেরও তো রাজনীতিতে বিশেষ এজেন্ডা আছে। সেটি কি সরকারের কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ? শেখ হাসিনা যদি সেটিই মনে করে থাকেন তবে বুঝতে হবে তিনি বোকার স্বর্গে আছেন। বিরোধী দল ইতিমধ্যেই হরতালের মধ্য দিয়ে তাদের অভিমতটি জানিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে বিরোধী দলে থাকলে তিনি কি এমন বিচার মেনে নিতেন? আজ যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি চাইছেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন কেন সেটি বললেন না। আদালতে গিয়ে সে জন্য কেন বিচার চাইলেন না? নব্বইয়ের দশকে তাঁর দল আদালতকে লাঠি দেখিয়েছিল। আদালতকে শায়েস্তা করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তিও পাঠিয়েছিল। আদালতের প্রতি শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের এমন শ্রদ্ধাবোধের (?)কাহিনী কি জনগণ ভূলতে পারে?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও শেখ হাসিনার অনড় অবস্থান
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানকে বাংলাদেশের জন্য যারা অপরিহার্য গণ্য করেছিলেন তারই একজন হলেন শেখ হাসিনা। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে বিএনপির শাসনামলে তিনিই অন্যান্য বিরোধী দলকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তখন বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে অংশ নেবে না এবং সে নির্বাচনের রায়ও মানবে না। সে দাবী নিয়েই বর্জন করেছিলেন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচন। সে নির্বাচনের আগে ১৬ নভেম্বর ১৯৯৫-এ গাইবান্ধায় একটি জনসমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে তার দল আন্দোলনে নেমেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে জনগণ আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। অন্য কোনো ফর্মুলা গ্রহণযোগ্য হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয় ১৯৯৬য়ে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে শপথ নেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তাঁর সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জনগণের অপরিসীম ত্যাগ ও তিন দলের আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি বিএনপিকে মানতে বাধ্য করা হয়েছে। অথচ আজ তিনি নিজে বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ আর নেই। কথা হল, ১৯৯৬ সালে যে পদ্ধতিটি এত অপরিহার্য হয়ে পড়লো সেটি আজ অপ্রয়োজনীয় হয় কি করে?
শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের ডিগবাজি হরতালের প্রশ্নেও হাস্যকর। হরতালের নিন্দা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন,বিরোধী দল গণতন্ত্রের বিনাশে হরতালের রাজনীতি শুরু করেছে। প্রশ্ন হল, হরতালে যে গণত্ন্ত্র ধ্বংস হয় সেটি কি হাসিনার নতুন উপলব্ধি? সেটি বিশ্বাস করলে তিনি যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন কেন এত হরতাল করলেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে ১৯৯৪, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচি পালন করেছিল। এর মধ্যে ৭০ দিন ছিল হরতাল-অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, দু'টি ৭২ ঘণ্টা এবং পাঁচটি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়েছিল।

অনিবার্য হচ্ছে সংঘাত
যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশ-শাসনের পথ হল গণতন্ত্র। কিন্তু সে শান্তিপূর্ণ পথকে বিপন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় গিয়ে দলটির নেতা শেখ মুজিব অন্যদলগুলোকেই নিষিদ্ধ করেছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথকেই রুদ্ধ করেছিল। বিরোধী দলগুলোর নেতাদের উপর রক্ষীবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন। আর শেখ হাসিনা চাপিয়ে দিয়েছেন র‌্যাব। ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাঁর রাজনীতি হয়, ভাংচুর, বোমাবাজি, ককটেল ছোড়া, আগুন লাগানো ও গোলাগুলি। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামে নতুন নির্মিত রেলওয়ে স্টেশনটি তাঁর দলীয় ক্যাডারগণ ধ্বংস করে দেয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এ দৈনিক সংবাদ-এর রিপোর্টে বলা হয়, শুধু ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর নির্বাচনের দিনে হরতাল ও গণকারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং ছয় শতাধিক আহত হয়।
তখন আওয়ামী লীগের এ আন্দোলনে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৯৬ সালের ৩ ও ৪ জানুয়ারির ৪৮ ঘণ্টার হরতাল সফল করার ডাক দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন,"দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না। সবাই মাঠে নেমে পড়ুন। যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন। ... বিরোধী দলের (আওয়ামী লীগের) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কেউ যদি মোনাফেকি করে, সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে যায় তাহলে তার সম্পর্কে আপনারা যা খুশি তাই ব্যবস্থা নেবেন।" এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর কর্মী ও সমর্থকদের নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আজ আওয়ামী লীগ বলছে, হরতাল হল গণতন্ত্র ধ্বংস করার রাজনীতি। অথচ আওয়ামী লীগ যে সহিংস হরতালের রাজনীতি করল সেটি কিসের রাজনীতি ছিল?

শেখ হাসিনা ঠিক একইভাবে ২০০৭-এ এসে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্য কামনা করেছিলেন। তিনি জানতেন যে, ১১ জানুয়ারি বা ওয়ান-ইলেভেনে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের বন্দুকের জোরে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল,জনগণের দাবিতে নয়। কিন্তু তারপরও সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তার সমর্থন ছিল অতি গভীর। ২০০৭-য়ের ১৫ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় ঢাকা এয়ারপোর্টে শেখ হাসিনা বলেছিলেন,আমাদের আন্দোলনের ফসল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা ফেল করলে আমাদের লজ্জা পেতে হবে। ... আমরা ক্ষমতায় গেলে তাদের এসব কার্যক্রম র‌্যাটিফাই করে দেবো।" তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি এ ছিল শেখ হাসিনার সমর্থনের মাত্রা। অথচ আজ সেটিই তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে! শেখ হাসিনা আজ যে ভাবে উল্টোপথ ধরলেন সেটি কি জনগণ বুঝে না? তবে তিনি এ উল্টোপথ ধরেছেন নিছক ক্ষমতায় টিকে স্বার্থে। ভেবেছেন, নির্বাচনের ফলাফল তাঁকে নিজ হাতেই তৈরী করতে হবে। দেশের নিরাপত্তা, শান্তি ও জনকল্যাণের প্রতি সামান্য দরদ থাকলে তিনি এভাবে দেশকে আবার এ সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির পথে ঠেলে দিতেন না। টের পেয়েছেন,ক্ষমতার টিকে থাকার জন্য তাঁর সামনে বিকল্প পথ নেই। সমস্যা হল, ক্ষমতায় থাকা ছাড়া আর কোন অবস্থানের কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। কিন্তু এরূপ অবস্থায় বিরোধী দলের সামনেও তো আন্দোলন ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। এ বিষয়টিও কি দুর্বোধ্য? কথা হল, জেনে বুঝে দেশকে এভাবে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিলে সেদেশের কি আর কোন শত্রুর প্রয়োজন আছে?