Sunday, July 31, 2011

তাহের পুত্র বিপ্লবের প্রাণদণ্ড মওকুফঃ নতুন করে দেয়া হচ্ছে ‘লাইসেন্স টু কিল’? by জামশেদ মেহ্দী

য়ান ফেমিংয়ের অসাধারণ জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার ‘জেমস বন্ড’। ৬০ এর দশকের প্রথমার্ধে জেমস বন্ডের চরিত্র রূপায়ণ করে সমগ্র পৃথিবীতে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন সিনকোনারি সিনকোনারিকে মার্কিন সরকার দিয়েছিল দুটি অবিশ্বাস্য মতা। একটি হলো : দুঃসাহাসিক অভিযানে শরীর-মনকে ঝরঝরে ও প্রফুল্ল রাখার জন্য অবাধ নারী সম্ভোগ। আয়ান ফেমিংয়ের জেমস বন্ড সিরিজে এই যদৃচ্ছ দেহ মিলনের রগরগে বর্ণনা পাওয়া যায় এবং বন্ড সিনেমাসমূহে এসব আদিম ক্রিয়াকলাপের উত্তেজক দৃশ্য দেখা যায়। মার্কিন সরকার তাদেরও এই দুর্ধর্ষ স্পাইকে আরেকটি যে অসাধারণ মতা দিয়েছিল সেটা হলো ‘লাইসেন্স টু কিল’। অর্থাৎ নরহত্যার লাইসেন্স।

‘ডক্টর নো’, ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’সহ একাধিক বন্ড সিরিজে জেমস বন্ড রূপী সিনকোনারি বা রজার মুরকে বেপরোয়া মানুষ খুন করতে দেখা গেছে। সরকারি ছত্রছায়ায় নির্বিচার নরহত্যার অধিকার দেয়া হয়েছিল ‘প্যানিক ইন ব্যাংকক’ ছবিতে সরকারি গোয়েন্দা হিউবার্ট বার্টনকে অথবা ফ্যান্টোমাসকে। এবার গত ২১ এপ্রিল শুক্রবার বাংলাদেশে আওয়ামী লাঠিয়াল বাহিনীকে নরহত্যার আনুষ্ঠানিক সরকারি অধিকার দিলেন আওয়ামী শাহীর প্রধান শেখ হাসিনা। কিন্তু কাদেরকে এই মানুষ খুনের অধিকার দেয়া হলো? নরহত্যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও সিনকোনারি, রজার মুর বা হিউবার্ট বার্টনকে সেই লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রুশ সাবভার্সন থেকে রার জন্য। কিন্তু এখানে শেখ হাসিনা ওই ভয়ংকর অধিকার দিচ্ছেন কোনো কর্মটি করার জন্য? উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকগণকে লাঠিপেটা করার জন্য? আর কাদেরকে দেয়া হচ্ছে সেই অধিকার? ওইসব আওয়ামী মাস্তান এবং রংবাজ, যাদের কাজ হলো হাইকমান্ডের অর্ডারে আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী হিসেবে কাজ করা। আর আওয়ামী লাঠিয়াল হওয়ার এনাম হিসেবে অন্য সময় ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণ করা। বাংলাদেশের মানুষ বিপন্ন বিস্ময়ে ল্য করছেন যে সরকার চেঙ্গিস খান এবং হালাকু খানের মতো রক্তপিপাসু হতে যাচ্ছেন। তারা বাংলাদেশকে লুটেরা এবং বর্গীর দেশ বানাতে চলেছেন।
এসব কথা এসে যাচ্ছে আজ প্রমাণিত খুনীদের স্বয়ং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুকম্পা প্রদর্শনের ফলে। এর সর্বশেষ ঘটনা হলো স্বনামধন্য গডফাদার লক্ষ্মীপুরের তাহের পুত্র বিপ্লবকে মাফ করার পর। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে, গত ১৪ জুলাই লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র ও এই এলাকার গডফাদার বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের পুত্র এ এইচ এম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করেছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। লক্ষ্মীপুর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আইনজীবী এডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যা মামলায় দ্রুত বিচার আদালত তাহের পুত্র বিপ্লবের ফাঁসির আদেশ দেয়। আবু তাহেরের অপর পুত্র সালাউদ্দিন টিপু অপর একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন যে, শুধুমাত্র এডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যা মামলা নয়, ছাত্র লীগ কর্মী কামাল হত্যা মামলায় প্রদত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকেও বিপ্লবকে মাফ করেছেন প্রেসিডেন্ট। টিপুর বক্তব্য মতে, শিবির নেতা মহসিন হত্যা মামলায় প্রদত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও মওকুফ হওয়ার কথা ছিল। তবে নথিতে সামান্য ‘ত্রুটি’ থাকায় এই মওকুফ প্রক্রিয়া কিছুটা পিছিয়ে গেছে। দৈনিক ‘কালের কণ্ঠে’ ২১ জুলাই প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রধান সংবাদে সালাউদ্দিন টিপু বলেন, “সাজা মওকুফের নথি আমরা আটকে রেখেছি। ধীরে ধীরে সব নথি পাঠানো হবে। মহসিন হত্যা মামলার নথিতে যে সামান্য ভুল হয়েছিল সেটি সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।” ইচ্ছা করলেই প্রেসিডেন্ট মাফ করতে পারেন না। বলা হয় যে সংবিধানে প্রাণদণ্ড মওকুফের মতা প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে। তিনি সেই মতা প্রয়োগ করেছেন। তাহলে ভুল হলো কোথায়? আসলে প্রেসিডেন্ট নিজের খেয়াল খুশি মাফিক যাকে ইচ্ছা তার প্রাণদণ্ড রহিত করতে পারেন না। তাকেও কতগুলো নৈতিক ও অকথিত বিধি বিধান মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা জানি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনে অপরাধীকে মা করে দেয়ার বিশেষ অধিকার দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। এই অধিকার পৃথিবীর প্রায় সব সংবিধানে দেয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডে সেই ১৩৭২ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলে ঢালাও মা করে দেয়া হয়েছিল বহু অপরাধীকে। কিন্তু সেই যুগ এখন আর নেই। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন সংবিধানে (যেমন আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, দণি অফ্রিকা) রাষ্ট্রপতির মা করার অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে বা শর্তারোপ করে। যেখানে সংবিধান এটি করতে পারেনি, সেখানে বিচার বিভাগ (যেমন ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত) এই মতা প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করতে বিভিন্ন রায় দিয়েছে। ভারতের সংবিধানে প্রায় অবিকল বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেখানে ১৯৮০ সালে ‘মারু রাম বনাম ইন্ডিয়া’ মামলায় বলা হয়, কোনো বিবেচনা বা কাজ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক, স্বেচ্ছাচার প্রসূত বা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে না। এসব েেত্র আদালত রাষ্ট্রপতির মা প্রদান মতার প্রয়োগের ন্যায্যতা পরীা করে দেখতে পারে। ১৯৮৯ সালে ‘কেহার সিং’ মামলায় ভারতের সুপ্রীমকোর্ট বলেছিলেন, কেবল অসঙ্গত হয়রানি ও প্রতীয়মান ভুলের েেত্র মার্জনা করার মতা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভারতের সংবিধানে এই মতা রাজ্যগুলোতে প্রয়োগের অধিকার রয়েছে গভর্নরের। ২০০০ সালে ‘সাতপাল বনাম হরিয়ানা’ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট বলেন, আদালত মার্জনার আদেশ রদ করতে পারেন, যদি গভর্নর রেকর্ডে থাকা তথ্যাবলির দিকে নজর না দিয়ে যান্ত্রিকভাবে আদেশটি প্রদান করে থাকেন।
বারবার প্রেসিডেন্ট কেন
গুরুদণ্ড মওকুফ করছেন?
কথায় বলে কেউ যদি একটি মিথ্যা কথা বলে তাহলে সেই একটি মিথ্যা ঢাকার জন্য তাকে আরো ১০টি মিথ্যা বলতে হয়। আওয়ামী প্রেসিডেন্টেরও হয়েছে সেই একই দশা। নাটোরের বড়াইবাড়ির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০ জন আসামির ফাঁসির আদেশ মওকুফ করে প্রেসিডেন্ট ফেঁসে গেছেন। এখন একটির পর একটি গুরুদণ্ড তাকে মওকুফ করতে হচ্ছে। গত বছর জুন মাসে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর পুত্র লাবুকে কারাদণ্ড দেয় আদালত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, জ্ঞাত আয়ের চেয়ে তার সম্পদ অনেক বেশি। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। দণ্ড মওকুফের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন জানানো হলে প্রেসিডেন্ট লাবুর কারাদণ্ড মওকুফ করেন। দাগী ও প্রমাণিত অপরাধীদের অপরাধ মওকুফের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটে গত সেপ্টেম্বর মাসে। তখন সাবেক উপমন্ত্রী নাটোরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহমদ গামা হত্যা মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ হয় প্রেসিডেন্সিয়াল আদেশে। অথচ বিষয়টি তখনও হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল। উচ্চ আদালতকে পাশ কাটিয়ে এক সাথে ২০ জন ফাঁসির আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করার বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রচণ্ড সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর কিছুদিন পরেই নাটোরে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিপরে একজন নেতাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ফাঁসির দণ্ড অনুকম্পাপ্রাপ্তরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইতিহাস
আওয়ামী লীগের ইতিহাস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস শ্বেত সন্ত্রাসের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস প্রাইভেট বাহিনী পোষার ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস রক্ত হিম করা ভয়াল সন্ত্রাসের ইতিহাস। নাটোরে ওরা সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর আত্মীয় গামাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল। এই খুনের অভিযোগে দেশের আইন আদালতে তাদের বিচার হয় এবং ২০ ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ হয়। এই ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যখন তাদের আপীলের বিচার চলছিল সেই বিচারাধীন মামলাটিকে প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ঐ ২০ জনেরই মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেন। ফাঁসির রজ্জু থেকে মুক্তি পেয়ে ওরা আবার শুরু করে হত্যাকাণ্ড। গত বছর হরতালের দিন বিএনপি একটি মিছিল বের করেছিল। মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ছানা উল্লাহ বাবু। এই খুনীরা ১০০ সন্ত্রাসী নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ঐ মিছিলে হামলা করে এবং শত শত মানুষের সামনে সদর রাস্তায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার তো দূরের কথা, কোনো সিরিয়াস তদন্তও অনুষ্ঠিত হয় নাই। লক্ষ্মীপুরে তাহের পুত্র বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের কয়েকদিন পরেই ওরা নিহত এডভোকেট নূরুল ইসলামের স্মৃতিসৌধ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। নূরুল ইসলামকে হত্যা করে তার লাশ কেটে ১১ টুকরা করে মেঘনা বে ছুড়ে ফেলে দেয়ার অভিযোগে বিপ্লবের ফাঁসির আদেশ হয়। বিপ্লবের মুক্তির পর আতঙ্কে এখন সকলেই তটস্থ। কবে কার ওপর না জানি তাহের ও বিপ্লবের গজব নাজিল হয়।
গভীর উৎকণ্ঠায় দেশ
এই সরকার দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে অনেক দেশপ্রেমিক মানুষ উদ্বিগ্ন হচ্ছেন । এসব দণ্ডাদেশ মওকুফ করা ছাড়াও শেখ হাসিনার সরকার গত আড়াই বছরে ৭ হাজারেরও বেশি মামলা প্রত্যাহার করেছেন। রাজনৈতিক বিবেচেনায় এসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর একটি মামলাও তুলে নেয়া হয়নি। এটি সরকারের চরম বৈষম্যমূলক আচরণ। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে ৭ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে তার মধ্যে হাজার হাজার ক্রিমিনাল কেস রয়েছে। এদের অনেকে হত্যা, খুন ও সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে বিএনপি ও জামায়াত যখন রাজপথে জোরেশোরে নামবে তখন মামলা উঠে যাওয়া খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিএনপি ও জামায়াত তথা বিরোধী দলের কর্মীদের সাইজ করবে। এভাবে তারা দেশকে সহিংসতার পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বিরোধী দলও ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। তখন দেশের পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা ভেবে রাজনৈতিক পর্যবেক মহল টেনশনে অস্থির হয়ে আছেন।

বৈঠক শেষে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশাবাদ, সীমান্তের সব সমস্যার সুরাহা হবে অচিরেই

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আগামী ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরের আগেই অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময়সহ সীমান্তের সব সমস্যার সমাধান হবে। গতকাল শনিবার ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকে ফলপ্রসূ করতে ভারতীয় মন্ত্রীদের ঢাকায় সিরিজ সফরের অংশ হিসেবে প্রায় ২৪ ঘণ্টার সফরে গত শুক্রবার রাতে পি চিদাম্বরম ঢাকায় আসেন। গত ১৪ বছরের মধ্যে ভারতের কোনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতকাল বৈঠক শেষে দুই দেশের যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।


বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) প্রধান নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মারকে সই করেন। নারী ও শিশুপাচার, মাদক চোরাচালানসহ আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনে এ পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে উভয় দেশ আশা করছে।
প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পি চিদাম্বরম বলেন, 'আমরা অত্যন্ত গঠনমূলক আলোচনা করেছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর (মনমোহন) সফরের আগে সব ইস্যু নিষ্পত্তি হবে।' তিনি বলেন, ছিটমহলগুলোতে জনগণনা সবেমাত্র শেষ হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে মোট ৫১ হাজার বাসিন্দা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ভারতীয় ও ১৭ হাজার বাংলাদেশি।
ছিটমহলের বাসিন্দারা কোন দেশে থাকবেন, সে বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকবে কি না-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে চিদাম্বরম বলেন, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. মনমোহন সিংয়ের বৈঠকেই ছিটমহলবাসীদের ভাগ্য ঠিক হবে।
অপদখলীয় ভূমি বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ইস্যুটি প্রায় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। মাত্র দু-একটি পয়েন্ট নিয়ে এখনো কিছুটা মতভেদ আছে, যা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। অন্যদিকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত ইস্যুটি যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ সমাধান করবে।
বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত হওয়াবিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে পি চিদাম্বরম বলেন, সীমান্ত পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে যাতে কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া না হয় সেজন্য বিএসএফ জওয়ানদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ওই নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকে এ বছর সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ৭-এ নেমে এসেছে। বিএসএফ জওয়ানরা হামলার শিকার হয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। তখন সাংবাদিকরা সম্প্রতি বিএসএফের ছোড়া পাথরের আঘাতে এক বাংলাদেশি নিহত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে পি চিদাম্বরম দাবি করেন, বিএসএফ এর সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি এ ধরনের হত্যার খবর খতিয়ে দেখার জন্য সাহারা খাতুনকে অনুরোধ জানান। সই হওয়া সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার মান জোরদার হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন ভারতের কোথাও আত্মগোপন করে আছে কি না, তা খুঁজে দেখার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি।' এ প্রসঙ্গে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'বলা হচ্ছে, তারা (দুই খুনি) ভারতে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশের কাছে আরো তথ্য চেয়েছে। তথ্য পেলে ভারত দণ্ডপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে কোনো চেষ্টা বাকি রাখবে না।'
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে বলে বিভিন্ন সময় ভারতের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পি চিদাম্বরম বলেন, 'আমি আড়াই বছর মন্ত্রী হিসেবে এ পদে আছি এবং একবারের জন্যও এ ধরনের অভিযোগ করিনি। বরং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করায় আমি প্রকাশ্যে বহুবার বাংলাদেশের প্রশংসা করেছি।' বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ ভারতবিদ্বেষী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দ্বারা প্রভাবিত_ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের এমন বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে চিদাম্বরম বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী এমন বক্তব্য দেননি'।
বাংলাদেশে ভারতের ভিসা কার্যক্রম প্রসঙ্গে পি চিদাম্বরম বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অনলাইন ভিসা সুবিধা পাচ্ছে এবং গত এক বছরে পাঁচ লাখ লোককে ভিসা দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে বিদ্যমান সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে বৈঠকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে কি না_জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সীমান্তে যখনই কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, বাংলাদেশ তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এ বিষয়ে আমার আর বলার কিছু নেই।' মাদক পাচারসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত তার সীমান্তবর্তী এলাকায় ফেনসিডিল কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম, স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান সিকদার, ভূমিসচিব মোখলেছুর রহমান, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রজিত মিত্র, সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বিএসএফের মহাপরিচালক রমন শ্রীবাস্তব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (সীমান্ত ব্যবস্থাপনা) কে কে মিত্তাল, যুগ্ম-সচিব শম্ভু সিং প্রমুখ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ : পি চিদাম্বরম গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময় প্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এর মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। তিনি সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান পূণর্ব্যক্ত করে এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান।
সফরসূচির অংশ হিসেবে পি চিদাম্বরম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং গতকালই তিনি বিশেষ বিমানে নয়াদিলি্ল ফিরে যান।

প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ হাট, এমপি-সাবেক এমপিরাও গ্রীন বাংলার ফাঁদে by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

রাজধানীর বনশ্রীতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিকিকিনির জন্য আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে একটি 'স্টক মার্কেট'। গ্রীন বাংলা গ্রুপ পরিচালিত এ কার্ব মার্কেটে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনাবেচা হয়। বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য চলে এখানে। এই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। সংসদ সদস্য, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীসহ অনেকের মোটা অঙ্কের টাকা আটকে আছে গ্রীন বাংলা গ্রুপের কাছে। তাঁদের মধ্যে মাহী বি চৌধুরী আড়াই কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করে পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা উদ্ধার করেন। কুমিল্লার এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরীও গ্রীন বাংলার মাধ্যমে আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন বলে জানা যায়। তবে নাসিমুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি টাকা তুলে নিয়েছেন।

প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এক বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নবী উল্যাহ নবীকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। এসইসির তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল। মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো চলছে। তবে অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না গ্রীন বাংলার।
গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে। নবী উল্যাহ নবী এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আটটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে চালানো হচ্ছে অবৈধ প্লেসমেন্ট ব্যবসাসহ পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানামুখী প্রতারণা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসতে পারে_এর প্রায় সব কটির শেয়ার এখনই নবী উল্যাহ নবীর কাছে রয়েছে বলে তাঁর সহযোগীরা প্রচার করছে। এই চক্র ইতিমধ্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে ৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন এমন দেড় শতাধিক ব্যক্তির তালিকা রয়েছে কালের কণ্ঠের কাছে।
ফাঁদে আটক যাঁরা : ১৫০ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করা 'বিনিয়োগ চুক্তি' দলিলের মাধ্যমে জহিরুল ইসলাম নামে একজন বিনিয়োগকারী নবী উল্যাহর কাছ থেকে দেশবন্ধু পলিমারের দুই লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন। শেয়ারপ্রতি ৩৫ টাকা হিসাবে জহিরুল ইসলাম ৭০ লাখ টাকা দেন নবী উল্যাহকে। চুক্তিনামায় নবী উল্যাহর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মিনু এবং কে এম নাজমুল হাসান নামে এক ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। জহিরুল ইসলামের বিনিয়োগকৃত অর্থের জামানত হিসেবে নবী উল্যাহর পক্ষ থেকে সমপরিমাণ অর্থের নিরাপত্তামূলক চেক দেওয়া হয়েছে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। চুক্তিপত্রে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রির পর বিক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগের লভ্যাংশ নির্ধারিত হবে। আর শেয়ার বিক্রি করে লোকসান হলে বিনিয়োগকারীর ৭০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ারও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ক্রেতাদের বলছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদের ১১ জন সদস্য, বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, উঠতি শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য গত ১৩ জুলাই বনশ্রীর গ্রীন বাংলা কার্যালয়ে গিয়েছিলেন কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাসিমুল আলম চৌধুরী। এ সময় এই প্রতিবেদকও প্রতিষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন। গ্রীন বাংলার এক কর্মকর্তার সঙ্গে সেদিন কথা বলে জানা যায়, নাসিমুল আলম গ্রীন বাংলায় আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ওই দিন তাঁকে আরো সাত কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
কয়েক দিন আগে যোগাযোগ করা হলে নাসিমুল আলম চৌধুরী এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবীর কাছে আমার কিছু বিনিয়োগ ছিল। সেটা আমি কিছুদিন আগে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। তবে আমার এলাকার অনেকের টাকা আটকে গেছে বলে শুনেছি।' প্লেসমেন্ট শেয়ার এভাবে কেনা বৈধ কি না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সেটা জানি না।' তিনি আরো বলেন, 'এখন শেয়ারবাজার ভালো, ফলে মূল মার্কেটের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগের দরকার পড়ে না।'
ডিএসইর কয়েকজন সদস্যও গ্রীন বাংলায় বিনিয়োগ করেছেন বলে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা দাবি করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, বনশ্রীর ওই অফিসে একাধিক এমপির যাতায়াত রয়েছে। তাঁরা সবাই প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন।
বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে সম্প্রতি বড় ধরনের বিপাকে পড়েন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারার নেতা মাহি বি চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবী উল্যাহ সিন্ডিকেটের সদস্য আলাউদ্দীনের মাধ্যমে তিনি বীকন ফার্মার দুই কোটি ৬১ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছিলেন। গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে তাঁদের নামে চেক লিখে দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও তিনি রাজি হননি। কথা ছিল, মাহির নিজস্ব বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা হবে এবং সেখানে নির্ধারিতসংখ্যক শেয়ার জমা হওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করা হবে। সে অনুযায়ী মতিঝিলে সাদ সিকিউরিটিজের একটি শাখায় পরিচালিত বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার জমা হয়নি। এ কারণে ব্রোকারেজ হাউস থেকে সব টাকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়নি।
মাহি বি চৌধুরী জানান, তিনি তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও শাশুড়ির নামে নবী উল্যাহর কাছ থেকে বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনেন। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের সহায়তায় তিনি ওই টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। বিষয়টি তিনি ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী ও সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটুকে মৌখিকভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন। গ্রীন বাংলার বনশ্রী অফিসে একাধিক বৈঠক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পান মাহি।
মাহি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা বেআইনি, তা প্রথমে বুঝিনি। পরে যখন বুঝতে পারি, তখন টাকাটা তুলে আনার চেষ্টা করি।' তাঁর মতে, টাকার রসিদই প্রমাণ দেয়, সাদ সিকিউরিটিজ জড়িত।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার হাউসে মাহি বি চৌধুরীর বিও হিসাব থাকলেও সেখানে ওই টাকা জমা হয়নি। আলাউদ্দীনের মাধ্যমে গ্রীন বাংলার নবী উল্যাহ নবী ওই টাকা নিয়েছেন। ইতিমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে।' প্রতারক চক্র তাঁর হাউসের জাল রসিদ বই ছাপিয়ে নিয়েছে বলেও তিনি জানান।
গ্রীন বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার এই ব্যবসা বৈধ। আইনগত কোনো বাধা নেই।' তিনি আরো বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে এসইসি ৫৪ ধারায় একটা মামলা করেছে। আশা করি, শিগগিরই মামলাটির মীমাংসা হয়ে যাবে।' প্রতারণার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সাত-আট বছর ধরে এ ব্যবসা করছি। কেউ বলতে পারবেন না, আমি কারো টাকা মেরে দিয়েছি।'
প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে গড়ে ওঠা আলাদা কার্ব মার্কেট প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একজন আইনজীবীসহ কিছুদিন আগে মাহি বি চৌধুরী ডিএসইর অফিসে আসেন। তাঁর অভিযোগের সূত্র ধরে জানতে পারি, মূল শেয়ার মার্কেটের বাইরে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির জন্য বনশ্রীর লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে আলাদা কার্ব মার্কেট। যেন শেয়ার মার্কেটের বাইরে আলাদা স্টক মার্কেট। এটা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা মূল শেয়ার মার্কেটের জন্য মারাত্মক হুমকি। এখনই তা বন্ধ করা উচিত।'
অবৈধ ব্রোকারেজ হাউস : ২০০০ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানকে এসইসির কাছ থেকে স্টক ব্রোকার বা স্টক ডিলারের নিবন্ধন সনদ পেতে হলে অবশ্যই কোনো স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্য হতে হবে। কিন্তু দেশের দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের কোনোটির সদস্য না হয়েও ব্রোকারেজ হাউস প্রতিষ্ঠা করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ_নাম গ্রীন বাংলা সিকিউরিটিজ। ডিএসইর আওতাধীন সাদ সিকিউরিটিজের সদস্যপদ কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলেও দাবি করেছেন গ্রীন বাংলার কর্মকর্তারা। তবে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, এসব একেবারেই ভুয়া প্রচারণা, তবে তাঁর (দেলোয়ার) ছোট ভাইয়ের ব্রোকারেজ হাউস আরাফাত সিকিউরিটিজ কেনার বিষয়ে একবার কথা হয়েছিল।
অবৈধ প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের বিষয়টি জানানো হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন সম্পূর্ণ বেআইনি। আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি বলেন, 'এ ধরনের তৎপরতা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। যে বা যারাই অবৈধ পন্থায় শেয়ার লেনদেনে জড়িত থাকুক না কেন_প্রমাণ পেলে কমিশনের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
সরেজমিন প্লেসমেন্ট হাটে : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি দেশবন্ধু পলিমারের প্রতিটি শেয়ার গত বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ৮১.৫০ টাকা দরে। অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের শেয়ারের দাম ছিল ৮৮.৫০ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে এই দরে বিক্রি হলেও বনশ্রীর ওই স্টক মার্কেটে এ দুটি কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা করে। আগামী অক্টোবরে দেশবন্ধু ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের 'লক-ইন' উঠে যাবে বলে গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে ক্রেতাদের জানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তখন যদি এসব শেয়ারের বাজারদর বর্তমান স্তরেও থাকে, তাহলেও প্লেসমেন্ট শেয়ারের ক্রেতারা লাভ পাবেন শেয়ারপ্রতি যথাক্রমে ৪৬ ও ৫৩ টাকারও বেশি।
একই কায়দায় বিক্রি হচ্ছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ও রংপুর ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের প্লেসমেন্ট শেয়ার। পিপলস লিজিংয়ের ১২৫ টাকার শেয়ার ৫০ টাকায় আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে রংপুর ডেইরির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার।
জানা যায়, এর আগে গ্রামীণফোন, আরএকে সিরামিকস, ফিনিঙ্ ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ বেশ কয়েকটি কম্পানির প্লেসমেন্টে শেয়ার নিয়েও বাণিজ্য করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত যেকোনো কম্পানি পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এর শেয়ারের একটা অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পূর্বানুমতি প্রয়োজন। এ ধরনের শেয়ারই প্লেসমেন্ট শেয়ার, যা কম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বা লক-ইন উঠে না যাওয়া পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া এসব প্লেসমেন্ট শেয়ারই অবাধে কেনাবেচা হচ্ছে গ্রীন বাংলা পরিচালিত 'কার্ব মার্কেটে'। এসইসি আইন ১৯৯৩ অনুযায়ী এসইসির নিবন্ধন ছাড়া স্টক ব্রোকার, সাব ব্রোকার, শেয়ার হস্তান্তরকারী প্রতিনিধিসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট যেকোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা বেআইনি। এ ছাড়া ২০০০ সালের এসইসি (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালায়ও এসইসির নিবন্ধন সনদ ছাড়া কোনো সিকিউরিটি (শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট ইত্যাদি) ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে পাঁচ বছরের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অথচ এসইসির কোনো নিবন্ধন সনদ ছাড়াই গ্রীন বাংলা গ্রুপ চার বছর ধরে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বাণিজ্য চালিয়ে আসছে।
রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য : বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসইসির অনুমোদনের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এরই মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের রাইট শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন নবী উল্যাহ নবী ও তাঁর সহযোগীরা। গত বৃহস্পতিবার পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ১২৫.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। গ্রীন বাংলা শেয়ারটি বিক্রি করছে ৫০ টাকায়।
২০০৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রীন বাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের কাছে পিপলস লিজিংয়ের ৮০ লাখ শেয়ার আছে। এসইসিতে রাইট শেয়ার পাস হলে সেখান থেকে আরো ৪০ লাখ শেয়ার পাওয়া যাবে। এ কারণেই তাঁরা ছয় মাসের লক-ইন হিসাব করে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার বিক্রি করছেন। অথচ এই কম্পানির রাইট শেয়ার ইস্যুর আবেদন এসইসির অনুমোদন পাবে কি না, সে বিষয়টি এখন নিশ্চিত নয়।
কোনো একটি কম্পানি শেয়ারবাজারে আসার প্রক্রিয়া শুরু করা মাত্রই ওই কম্পানির শেয়ার বাগিয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন নবী উল্যাহ নবী। কম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক কিংবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে প্লেসমেন্ট শেয়ার প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্লেসমেন্ট শেয়ার পাওয়া না গেলে উদ্যোক্তা শেয়ারের একাংশ কিনে নেন। এসইসির বিধি অনুযায়ী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্লেসমেন্ট ও উদ্যোক্তা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা (লক ইন) বলবৎ থাকে।
গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নবী উল্যাহ : ২০১০ সালের ১৫ জুলাই গ্রীন বাংলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী ওরফে শফিউল আলম নবী এবং তাঁর সহযোগী সাত্তারুজ্জামান শামীমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নবী উল্যাহ বিভিন্ন কম্পানির প্লেসমেন্টের শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার কথা স্বীকার করেন। বিষয়টি নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তের ভিত্তিতে কমিশনের পক্ষে উপপরিচালক (আইন) এ এস এম মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে নবী উল্যাহ নবী, সাত্তারুজ্জামান শামীম এবং গ্রীন বাংলা কমিউনিকেশনস লিমিটেডের নামে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলার আরজিতে ১০টি কম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আট কোটি টাকার প্লেসমেন্ট ব্যবসার হিসাব দেখিয়ে নবী উল্যাহ নবীর লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, 'তার মোট ক্লায়েন্ট সংখ্যা ১০০ জন এবং ৩-৪ বছর যাবত তিনি অবৈধ শেয়ার প্লেসমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রীন বাংলার নিয়োজিত এজেন্টদের নামে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে অনেক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টকে প্লেসমেন্ট শেয়ার থাকার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয় বিনিয়োগকারীদের সামনে। বিষয়টি আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের প্রত্যয়নপত্রও দেখানো হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই ভুয়া পোর্টফোলিও তৈরি করে তাতে ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর বসিয়ে দেওয়া বা একই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্ট দেখিয়ে একই শেয়ার একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। কখনোই আইপিও বা প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোনো শেয়ার ইস্যু করেনি_এমন কম্পানির শেয়ারও রয়েছে গ্রীন বাংলার পোর্টফোলিওতে।
নথিপত্রে দেখা যায়, গ্রীন বাংলা গ্রুপের নামে আইআইডিএফসি মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের একটি সিডিআই হিসাবের পোর্টফোলিওতে (হিসাব নম্বর ০৩১৩) ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ৩০ লাখ এবং বাংলালিংকের ৫০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। পোর্টফোলিওতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন বাংলা গ্রুপ ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা দরে মোট ৩০ কোটি টাকায় এবং বাংলালিংকের প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা দরে পাঁচ কোটি টাকায় কিনেছে। একই হিসাবে গ্রামীণফোনের ৫০ লাখ, গোল্ডেনসনের ১০ লাখ, ক্রাউন সিমেন্টের ১০ লাখ এবং আরএকে সিরামিকের ৭০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। অথচ ইনসেপ্টা ফার্মা ও বাংলালিংক এখনো কোনো প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুই করেনি।
পোর্টফোলিওটির সত্যতা জানতে আইআইডিএফসিতে যোগাযোগ করা হলে গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রতারণার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টে প্রত্যয়নকারী হিসেবে আইআইডিএফসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) রাসেল আহমেদের নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে এই নামে কোনো ডিএমডি নেই এবং কোনোকালে ছিলও না। রাসেল শাহরিয়ার নামে একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের এসএমই ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাসেল শাহরিয়ারের কাছে গ্রীন বাংলার ওই পোর্টফোলিও বিবরণী দেখানো হলে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, প্রদর্শিত স্বাক্ষরটি তাঁর নয়। রাসেল আহমেদ নামের কোনো কর্মকর্তা আইআইডিএফসিতে নেই। প্রকৃতপক্ষে আইআইডিএফসিতে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব চালু নেই। তা ছাড়া 'সিডিআই' কোডের কোনো হিসাব তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নয়।

সামাজিক অবক্ষয়, নাকি প্রশাসনিক দুর্বলতা by পবিত্র হালদার

মাজের মানুষ কি এতই অন্ধ বা বিবেক-বর্জিত যে, 'ডাকাত ডাকাত' শুনেই না বুঝে পেটাতে পেটাতে ছয়জনকে মেরে ফেলল? এ সামাজিক অবক্ষয় কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া_ এ পদ্ধতি গণতন্ত্রের জন্য এক অশনিসংকেত; যা যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় ও প্রশাসনিক দুর্বলতা দুটিই শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। বর্তমানে মানুষ মানুষকে কুকুরের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলছে, একটুও বিবেকে বাধছে না কিংবা মানুষের আকুতি এখন আর অন্য মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে না। বাঁচার জন্য মরণ চিৎকার আর অন্যের কানে পৌঁছে না, তাহলে কি সামাজিক অবক্ষয় মানুষকে দিন দিন অমানুষ বানিয়ে দিচ্ছে? আবার আমরা যে গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করি, যে দেশকে আমাদের পূর্বপুরুষরা স্বাধীন করেছেন, সে দেশের নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাহলে সে দেশে প্রশাসনিক দুর্বলতার দায়ভার কে নেবে?

গত ১৭ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে যে ঘটনা ঘটেছে তার দায়ভার কে নেবে? সরকার, নাকি পরিবার? এখানে দু'পক্ষকেই দায়ভার নিতে হবে। কারণ তারা ছয়জনই ছাত্র। আর ছাত্রই যদি হয় তাহলে ওখানে অত রাতে তারা যাবে কেন? কী কাজ ছিল তাদের? যে চরে দিনের বেলায়ই মানুষ যেতে চায় না কিংবা যেখানে কয়েকদিন আগে পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই হয়েছিল, সেখানে গভীর রাতে ছাত্ররা গিয়েছিল কেন? আমরা ছাত্রদের কিংবা সন্তানদের সেভাবে মানুষ করতে পারিনি, যাতে তারা ভালো সঙ্গ বিচার করতে পারে কিংবা কোথায়-কখন যেতে হবে বা যাওয়া যাবে না, সে শিক্ষা দিতে পারিনি_ এ ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষক জাতির আর পরিবারের। তাই আংশিকভাবে হলেও আমরা এ দুঃখজনক ঘটনার জন্য দায়ী। আবার যদি অন্যদিক দিয়ে দেখি তাহলে ছাত্ররা না হয় না বুঝে কিংবা কৌতূহলবশে সেখানে গিয়েছিল; কিন্তু তারা যে ডাকাতি করতেই গিয়েছিল তার কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। ডাকাতি করতে নূ্যনতম যে হাতিয়ার প্রয়োজন সেটিও তাদের ছিল না, তাহলে জনগণ কীভাবে ধরে নিয়েছিল যে তারা ডাকাত? আর সমাজের মানুষ কি এতই অন্ধ বা বিবেক-বর্জিত যে, 'ডাকাত ডাকাত' শুনেই না বুঝে পেটাতে পেটাতে ছয়জনকে মেরে ফেলল? এ সামাজিক অবক্ষয় কিংবা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া_ এ পদ্ধতি গণতন্ত্রের জন্য এক অশনিসংকেত; যা যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সরকারের প্রশাসনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটে, যেখানে মাইকে ডাকাত বলে প্রচার করা হয়েছে সেখানে জনগণকে সাহায্য করতে পুলিশের পেঁৗছা উচিত সবার আগে। আর এ ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছয়জনকে মেরে ফেলার পর পুলিশ সেখানে পেঁৗছে। তাহলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা দিনে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করি কিংবা রাতে ঘুমাই তারা কি-না আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আর যখনই তারা ব্যর্থ তখনই জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। শিগগির এর অবসান হওয়া দরকার। সব বিবেকবান মানুষের আজ জেগে ওঠা উচিত। এত ছাত্র কেন নিহত হলো? তারা যে অন্যায় করেছে তার একমাত্র শাস্তি কি শুধু মৃত্যুই ছিল? না, বাঁচিয়ে রেখেও অন্য শাস্তি দেওয়া যেত। তা আমাদের জানতে হবে। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।

চাই দ্রুততম ও নিরাপদ ব্যবস্থা

বাই একবাক্যে স্বীকার করেন, একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান মানদণ্ডগুলোর একটি এর যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুধু সড়ক পথই নয়, রেল, নৌ ও আকাশ পথে কত দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষ ও মালপত্র পরিবহন করা যায় তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচক। বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেলপথে যাতায়াতের সুযোগ সীমিত।

নৌপথ একদা এ দেশে মূল যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হলেও নাব্যতা হারিয়ে অনেক নৌপথই পরিত্যক্ত হতে বসেছে। আকাশ পথে যোগাযোগের সুযোগ এখানে আর্থসামাজিক কারণেই অনেক সীমিত। সবেধন নীলমণি সড়ক ব্যবস্থাই আমাদের যোগাযোগের মেরুদণ্ড। সাম্প্রতিককালে কানেকটিভিটি বলে যে ধারণার কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা আমাদের প্রেক্ষাপটে সড়ক অবকাঠামোরই। এখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে খুব শীঘ্র আমাদের রাস্তাঘাট, বন্দর আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের জন্যও উন্মুক্ত হবে। এ পরিস্থিতিতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল-হকিকত বিচার করা খুবই প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, অবাধ পণ্য পরিবহন, দ্রুততম ও নিরাপদ যোগাযোগ ও স্থানান্তরের স্বার্থেও সড়ক ব্যবস্থার তত্ত্বতালাশ প্রয়োজন। ফলে খুবই সঙ্গত প্রশ্ন হলো, আমাদের সড়ক ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি কী? শনিবারের সমকালে দেশের মহাসড়ক নিয়ে যে প্রতিবেদন ও বিশেষ আয়োজন প্রকাশিত হয়েছে তা পড়ে যে কেউ বলবেন, সড়ক অবকাঠামোর এখন বেহাল দশা। প্রায় সব বিভাগীয় ও জেলা শহরের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ সড়কগুলোর অবস্থা শোচনীয়। এমনকি বন্দর ও বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ সড়কটির অবস্থাও ভীষণ হতাশাজনক। অধিকাংশ সড়ক খানাখন্দে পরিপূর্ণ। ভাঙাচোরা কিছু সড়ক দ্রুত যান চলাচলের অনুপযুক্ত শুধু নয়, এগুলো ব্যবহার করাও কষ্টকর। সড়কের অনেক স্থানে নির্মাণ ত্রুটি আছে, আছে অপরিকল্পিত স্থাপনাও। মহাসড়ক দখল করে অবৈধভাবে বাজার বসানোর উদাহরণও এন্তার। যানজট না থাকলেও এসব সড়ক পেরোতে গড়ে দুই থেকে চার ঘণ্টা সময় বেশি লাগে। আর কয়েক কিলোমিটারব্যাপী যানজট থাকলে তো কথাই নেই। দ্রুত পেঁৗছানোর স্বপ্ন সুদূরপরাহত, গন্তব্যে পেঁৗছাতে অনেক শ্রমঘণ্টা অপচয় হবে এটাই এখন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো লেগে আছে দুর্ঘটনার উপদ্রব। যে দিন দেশে কোনো দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে না সেদিনটিকে সৌভাগ্যজনক ও ব্যতিক্রম বলেই অভিহিত করা হয়। চালকদের অসতর্কতা, লাইসেন্সবিহীন চালক, ওভারটেকিং, বেপরোয়া গাড়ি চালনার পাশাপাশি এর জন্য দায়ী বেহাল সড়কও। দেশে রাস্তার দৈর্ঘ্য বড়, কিন্তু রাস্তায় সুষ্ঠু তদারকির জন্য পর্যাপ্ত হাইওয়ে পুলিশিংয়ের ব্যবস্থা নেই। যেটুকু ব্যবস্থা আছে তাও কতটা ক্রিয়াশীল সে প্রশ্ন বারবার ওঠে। ফলে দুর্ঘটনা এখন নিত্যসঙ্গী। একটি মালবাহী ট্রাক বা যাত্রীবাহী বাস রাজধানীর উপকণ্ঠে পেঁৗছানোর পর বা রাজধানী থেকে বেরুবার পথে প্রায় প্রতিটি রাস্তায় দীর্ঘ সময়ের যানজটে পড়তে বাধ্য। আর রাজধানীর ভেতরের যানজটের কথা তো বলাই বাহুল্য। পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট যে, আমাদের সড়ক ব্যবস্থা একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নকামী একটি দেশের সড়ক ব্যবস্থা নয়। এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চাৎগতি ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সড়ক সংস্কারে দ্রুত মনোযোগ দরকার। দ্রুত বড় আকারের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে দেশের সড়কপথের সংস্কার ও নির্মাণ কাজ শেষ করা দরকার। দেশের উন্নয়নের জন্য নতুন পথ ও নতুন সেতু আমাদের আরও দরকার। কিন্তু বিদ্যমান পথগুলো ব্যবহারের অনুপযুক্ত হলে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? ফলে আমরা মনে করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো দ্রুত নিরাপদ, সাবলীল ও দ্রুততম সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হবে।

নিম্নমানের নির্মাণ কাজের দায় কার?

রিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা খোলা আকাশের নিচে পাঠগ্রহণ করছে, এমন সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে শনিবার সমকালে 'খোলা আকাশের নিচে ক্লাস' শিরোনামে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে খোলা আকাশের নিচে পাঠদান করা হয় এবং এ শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্বে আদর্শ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীও এ আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন এবং তারাও একে অনুকরণীয় বলে অভিহিত করে থাকেন। তবে শান্তিনিকেতনে পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীরা ঠিক খোলা আকাশের নিচে নয়, বসে পড়ে গাছতলায়। ভাঙ্গার ধর্মদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের মিল ঠিক এখানেই। এখানেও শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর গাছের পাতার ছায়া রয়েছে। তবে এ মিলের কারণ প্রকৃতির সানি্নধ্যে থেকে পড়াশোনা কিংবা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণে আগ্রহ নয়। ১৯৯৪ সালে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়ের জন্য একটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। দেড় দশক অতিক্রম করতে করতেই ভবনটি প্রায় অকেজো হতে বসেছে। বছর তিনেক আগে দেয়াল ও ছাদে নানা ধরনের নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়ে এবং অবস্থা এমনই যে, এটি আর ব্যবহার করা যাবে বলে মনে হয় না। সময়মতো মেরামত কাজ সম্পন্ন হলে হয়তো কিছুদিন ব্যবহার করা যেত। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে ভবন-ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীরা গাছের নিচে ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা কখনও কখনও রোদে ঘর্মাক্ত হয়, বৃষ্টিতে ভিজে যায়। এতে তাদের পাঠগ্রহণের প্রতি অসীম আগ্রহ প্রমাণিত হয়। শিক্ষকদের ধৈর্যও প্রশংসা পেতে পারে। কিন্তু তাতে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অপরাধ স্খলন হয় না। সরকারের সংশ্লিষ্ট যে বিভাগটি কাজ শেষে যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে ভবনটি বুঝে নিয়েছে তাদের দায়ও কম নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশের নানা স্থানে এ ধরনের নিম্নমানের কাজের অভিযোগ রয়েছে। সব এলাকার খবর সংবাদপত্রে আসে না। যখন কোথাও দুর্ঘটনা ঘটে তখনই কেবল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ অনিয়ম বন্ধ করার কোনো উপায়ই কি সরকারের জানা নেই?

ব্রিটেনের 'ভিসা কলেজ' by আসিফ আহমদ

ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী এখন বিপদে। তারা একেক জন কেবল কলেজে ভর্তির সময় জমা দিয়েছেন ৫ হাজার পাউন্ড। বাংলাদেশের মুদ্রায় যা ৬ লাখ টাকারও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে যাওয়ার খরচসহ আরও বিপুল অর্থ ব্যয়। এখন তাদের মাথায় হাত। এসব ছাত্রছাত্রী যদি দুই মাসের মধ্যে নতুন কোনো কলেজে ভর্তি হতে না পারেন, তাহলে সে দেশ ছাড়তে হবে। কেউ কেউ কি লুকিয়ে সেখানে থেকে যাবেন? এর অর্থ হচ্ছে চিরজীবনের জন্য অবৈধ হয়ে পড়ার শঙ্কা।

বিভিন্ন হিসাবে বলা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে পড়তে গেছেন। তাদের প্রত্যেকে যদি ৬ লাখ টাকা করে কলেজে ফিস হিসেবে জমা দিয়ে থাকেন তাহলে ২৫ হাজারের জন্য জমা পড়েছে অন্তত ১৫০ কোটি টাকা। প্রায় সমপরিমাণ অর্থ তাদের ব্যয় করতে হয়েছে ভিসা ফি, টিকিট ও দালালদের পেছনে।
ব্রিটিশ সরকার তাদের যাওয়ার জন্য ভিসা দিয়েছে এবং এ কারণে তারা সেখানে বৈধভাবেই গেছেন। এখন নিয়মে যথেষ্ট কড়াকড়ি আনা হয়েছে এবং এ কারণেই যত বিপত্তি। ব্রিটেনে পড়াশোনার জন্য যাওয়া বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ ছিল। এ কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী সেখানে চলে যাওয়ায় আগ্রহবোধ করত। তারা আয় করে নিজের পড়াশোনা চালাতেন এবং একই সঙ্গে পরিবারেও কিছু অর্থ পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সরকার নতুন নিয়ম করেছে_ বেসরকারি কলেজগুলোতে ছাত্র ভিসায় যারা আসবেন, তারা কাজ করতে পারবেন না। এর পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা প্রদর্শনের নিয়মকানুনও কঠোর করা হয়েছে। আরও একটি পরীক্ষায় তাদের পড়তে হচ্ছে_ ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা। অনেকেই হয়তো এতে উৎরে যেতে পারবেন, কিন্তু আটকা পড়ে যেতে পারেন অন্যান্য পরীক্ষায়।
বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পড়তে পেরেছেন ব্রিটিশ সরকারের নিয়মের কারণেই। এ সুযোগে বেশকিছু কলেজও গড়ে উঠেছিল। এর কয়েকটিতে রীতিমতো বাংলাদেশের কলেজের মতোই পরিবেশ। ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের একটি চক্র এ ধরনের ভর্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখানে প্রচুর ছাত্রছাত্রীকে নিয়েছে। এমন অনেক কলেজের কথাও শোনা যায়, যেখানে শিক্ষার অবকাঠামো দুর্বল। লাইব্রেরি, ক্লাসরুম সুবিধার বালাই নেই। এমনকি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকও নেই। বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত দেখি। তাই বলে ব্রিটেনেও? যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই, সেগুলো কী ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারল? এখন দুর্দিনে তাদের পাশে কে দাঁড়াবে?
কেউ কেউ এসব কলেজের নাম দিয়েছে 'ভিসা কলেজ'। এর সঙ্গে জড়িত চক্র পড়াশোনার নামে কিছু লোককে ব্রিটেনে নিয়ে আসার ব্যবসায়ে জড়িত হয়ে পড়েছে। আগে ছাত্ররা এক কলেজ ছেড়ে অন্য কলেজে ভর্তি হতে পারত। এখন নিয়ম করা হয়েছে, নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন দফতরের অনুমতি নিতে হবে। আর এ কাজ খুব কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এভাবে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর শুধু শিক্ষা জীবন নয়, ভবিষ্যৎও অন্ধকারময়। তারা নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি পেলেও নতুন করে অর্থ জমা দিতে হবে। কারণ যেসব কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। এর দায় কে নেবে?
বাংলাদেশের অনেক তরুণ উন্নত দেশগুলোতে কাজের স্বপ্নে বিভোর থাকে। এজন্য বিপুল অর্থ খরচেও দ্বিধা করে না। তারা মনে করে, আয় করতে পারলে সব খরচ উসুল করা যাবে। কিন্তু ব্রিটেনে এখন যে অবস্থা তাতে এটি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ সরকার কি এ সমস্যা অবগত ছিল না? এখন কি তাদের কিছুই করার নেই?

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যত ক্ষমা by এমএ নোমান ও নাছির উদ্দিন শোয়েব

ত আড়াই বছরে বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় আদালতের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২২ খুনিকে ক্ষমা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। এদের মাফ করা ছাড়াও দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আরও এক ভিআইপি আসামির দণ্ড মওকুফ করেছেন তিনি। তাদের এ দণ্ড মওকুফে জেল কোডের বিধানও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি আসামিদের পক্ষ থেকে দণ্ড মওকুফের প্রার্থনা জানিয়ে যেসব আবেদন করা হয়েছে তাও যথাযতভাবে পূরণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতও নেয়া হয়নি। এছাড়াও সাংবিধানিক এখতিয়ারের কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আরও ৮৯৭ জন কয়েদির দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। এদের মুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন আলোচিত হত্যা মামলার আসামি। আবেদন ছাড়া সাজা মওকুফের বিধান না থাকলেও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলের সাজা মওকুফ করা হয়েছে জেলকোডের বিধান লঙ্ঘন করেই। রাজনৈতিকভাবে এসব কয়েদির দণ্ড মওকুফের পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমার আওতায় আরও এক হাজার কয়েদির দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢালাওভাবে এ ধরনের দণ্ড মওকুফের ঘটনা রাষ্ট্রপতিকে এবং তার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে বিতর্কিত এবং কলুষিত করেছে। এতে করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং সমাজ দিন দিন অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হবে।
মহাজোট সরকারের গত আড়াই বছরে রাজনৈতিক মামলার তালিকায় আলোচিত খুনের মামলাসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে দায়ের করা প্রায় ৭ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে এর আসামিদের মুক্তি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক এখতিয়ারকে ব্যবহার করে নাটোরের চাঞ্চল্যকর গামা হত্যা মামলায় ২০ ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। আগে ক্ষমা করা হয়েছে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা ও খ্যাতিমান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের হত্যাকারী এক ফাঁসির আসামিকে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা
চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ওরফে লাবুর ১৮ বছরের দণ্ড রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে ক্ষমা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতাবলে লাবুর কারাদণ্ডসহ তার আর্থিক জরিমানা পুরোটাই মওকুফ করে দেন। কোনো আসামি কারাগারে না গিয়ে কারাগারকে ব্যবহার করে দণ্ড মওকুফের প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা মঞ্জুর করার ঘটনা এটিই প্রথম। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের জনপ্রিয় আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে হত্যাকারী বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফের ঘটনা গোটা দেশে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে।
দণ্ড মওকুফ ও জেলকোডের বিধান : আইন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দণ্ড মওকুফের বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, কারাগারে বন্দি কোনো কয়েদির যে কোনো মেয়াদের দণ্ড মওকুফের বিষয়ে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এ এখতিয়ার দিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের জন্য কে আবেদন করতে পারবেন, সেটা জেল কোডের বিধান অনুসরণ করে জেল কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবেন। যে কোনো কয়েদি ইচ্ছা করলেই রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করার সুযোগ নেই। মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ তার নিজস্ব পর্যবেক্ষকদের দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন। এদের মধ্যে যারা কারাগারে ভালো আচরণ করেছে, যাদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং বার্ধক্য কিংবা অন্য কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ শক্তিতে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছেন কারা কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের দণ্ড মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার সুযোগ করে দিতে পারেন। নির্ধারিত ফরমে এ আবেদন করতে হয়। এতে কয়েদির বয়স, কারাভোগের মেয়াদ ও বিবরণ, আচরণগত দিক, কারাগারে প্রবেশের তারিখে ওজন এবং আবেদন করার তারিখের ওজনসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো উল্লেখ করবে আবেদনকারী। আবেদনকারীর এ আবেদন যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এতে সুপারিশসহ কারা কর্তৃপক্ষ তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সর্বমোট ৮টি ধাপে এ আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে এর আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। একইভাবে আইন মন্ত্রণালয়েও ৮টি ধাপে তা যাচাই-বাছাই করা হয়। এসব ধাপ অতিক্রম করে একটি সুপারিশসহ একটি আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে কম করে হলেও এক মাস সময় লাগার কথা। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে যে, গামা হত্যা মামলা, অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামিসহ অন্য আসামিদের দণ্ড মওকুফের আবেদন পর্যালোচনায় এসব রীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন আসামির দণ্ড মওকুফকে রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার এবং জেল কোডের বিধান উল্লেখ করে বলেন, কোনো আসামিকে দেয়া নিম্ন আদালতের সাজা সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকলে সেক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ডিত ওই আসামি উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে দণ্ড মওকুফের প্রার্থনা জানাতে পারেন। জেলকোডের বিধান অনুযায়ী এটাকে ‘ক্ষমা ভিক্ষা’ বলে। জেল কর্তৃপক্ষ তার কেসস্টাডি, তার কারাভোগের বিবরণ, ব্যক্তিগত আচার আচরণ এবং বয়স সবকিছু উল্লেখপূর্বক দণ্ডিত ব্যক্তি ক্ষমার যোগ্য না-কি অযোগ্য তা উল্লেখ করে সুপারিশসহ প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা শেষে আইনগত দিক ক্ষতিয়ে দেখার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। আইনি মতামতসহ আইন মন্ত্রণালয় সেটা পুনরায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে।
বিপ্লবসহ বিভিন্ন আসামির দণ্ড মওকুফ সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ের বিতর্কিত বিষয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি যতটুকু জানি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক খালাসপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামির মামলা এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। আপিল বিভাগে তাদের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করায় মূলত উচ্চ আদালতের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে দণ্ডিতরা প্রকৃত অর্থেই অপরাধী। এ কারণেই তারা সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ড বহাল থাকবে এটা মনে করেই আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষা না করে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করিয়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে দণ্ড মওকুফ করিয়েছে। তিনি বলেন, এতে করে উচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাবে। ভয়ঙ্কর আসামিরা সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ক্ষমা নেয়ার চেষ্টা করতে থাকবে। খন্দকার মাহবুব বলেন, যে আসামির দণ্ড মওকুফ করা হলো ওই ব্যক্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি সুবিচার ও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে। রাষ্ট্রপতির এ দণ্ড মওকুফের মাধ্যমে তার সে আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অনেক সময় অপরাধীরা দণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে বেপরোয়া হয়ে যায়। এর প্রমাণ নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ছানাউল্লাহ নুর বাবুকে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। খন্দকার মাহবুব বলেন, কাজেই রাষ্ট্রপতির দণ্ড মওকুফের ব্যাপারে তার সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রয়োগের বিষয়টি আগে ভেবে দেখা উচিত।
প্রথিতযশা ফৌজদারি আইন বিশারদ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলায় নিম্ন আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতা কোনো সুস্থ সমাজের মানদণ্ড হতে পারে না। সামাজিক ও নৈতিকতা বলে একটা কথা রয়েছে, যেসব আসামির দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে দেশে সামাজিক নৈতিকার রেষ থাকলে তাদের ক্ষমা করা সম্ভব হতো না। আমি ভাবছি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নিয়ে। তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। তাদের সে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। এ ধরনের দণ্ড মওকুফের ঘটনা সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম রেজাউল করিম বলেন, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। দণ্ড মওকুফ বা সাজা হ্রাস করার অধিকার সংবিধান তাকে দিয়েছে। কিন্তু সেই দণ্ড মওকুফ কতটা যুক্তিযুক্ত তা নির্ণয় করে দেয়ারও কর্তব্য স্বরাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয়ের। আমি মনে করি রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো আসামির দণ্ড মওকুফ বাঞ্ছনীয় নয়। এতে রাষ্ট্রপতি পদ ও সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত হয়ে পড়ে। কেননা যে লোক খুন হলেন তার পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ন্যায়বিচারের আশা নিয়ে তারাও অপেক্ষায় থাকেন। বাদী বা বিচার প্রার্থীদের অনুভূতির বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত। বিপ্লবসহ সাম্প্রতিক সময়ে দণ্ড মওকুফের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাষ্ট্রপতির ওই প্রতিষ্ঠানকে যাতে বিতর্কিত না হয় সেটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক ডিআইজি মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবেই দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ বা কোনো বিবেকবান জনগণ আশা করে রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে করবেন। যেহেতু এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে তাই আমরা আশা করব সেটা সমাজে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তিনি তা না করুক। মানুষ তা কামনা করে না। শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, যদি এ ক্ষমার ক্ষেত্রে বিবেচনা না করা হয়, তা হলে অন্যান্য খুনি বা বড়মাপের আসামিরা ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের অপরাধীরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে এভাবে ক্ষমা পাওয়ার পথ অনুসরণ করবে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন এই প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকলে তার পরিণাম কখনও শুভ হবে না। তিনি বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞ এবং সচেতন একজন মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তার এ ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি জনমনে কিছুটা হলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক কারা কর্মকর্তা শামসুল হায়দার সিদ্দিকী প্রশ্ন তুলে বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমান হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ভবিষ্যতে কোনো রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেন তখন ওনার কি বলার থাকবে?
রাষ্ট্রপতির আলোচিত ক্ষমা : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডপাপ্ত ২২ আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। নাটোরো গামা হত্যা মামলায় ২০ জন, জামালপুরে অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলায় ১ জন ও লক্ষ্মীপুরে অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় এক জনকে মুক্তি দেয়া হয়। এর মধ্যে গামা হত্যা মামলার ২০ আসামির মধ্যে ১০ জনকে ঢাকা কেন্দ্র্রীয় কারাগার এবং অন্যদের সংশ্লিষ্ট কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার পর জামিননামা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই কারাগারের তত্ত্বাবধায়কের পৌঁছার পর যাচাই-বাছাই করে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
গামার ২০ খুনি : ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নাটোরের নলডাঙ্গা রামশার কাজিপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলি ও চাপাতিতে খুন হন সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহমদ গামা। এ সময় কাজিপুর গ্রামে ৫০টি বাড়িঘরে লুটপাট, ভাংচুর, নারী নির্যাতনসহ অগ্নিসংযোগ করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় গামার বাবা রফিকুল ইসলাম তালুকদার বাদী হয়ে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজসহ ১৬ জনের নামসহ অজ্ঞাত আরও ১৫-১৬ জনের নামে নলডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে ২১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পরে উচ্চ পর্যায়ে তদন্তের পর মামলাটি ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফিরোজ আলম গামা হত্যা মামলার রায়ে ২১ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। আসামিদের আপিলের শুনানির আগেই ২০ আসামি গত বছর ১৫ এপ্রিল কারাগার থেকে আপিল প্রত্যাহার ও প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আবেদন করে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছর ২ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ২০ আসামির দণ্ড মওকুফ সংক্রান্ত আদেশে স্বাক্ষর করেন। গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি পায় আসামিরা। ২০ জনের মধ্যে তিন সহোদর এসএম ফিরোজ, ফজলুল হক শাহ্ ও ফারুক, আনিসুর রহমান আনসার ও তার দুই ছেলে ফয়সাল ও সেন্টু, শাজাহান, জাহেদুল, বাদল, আ. জলিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং জহুরুল শাহ্, সাজ্জাদ, সোহাগ, বাবলু, আবুল, আতাউর, আশরাফ, ফরমাজুল, ফকরউদ্দিন, ওহিদুর রহমান রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিল। এক আসামি শুরু থেকেই পলাতক ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ আইন মন্ত্রণালয় ঘুরে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্টের কাছে। নিয়ম রয়েছে, এ ধরনের কোনো সারসংক্ষেপ প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো হলে তা নোটিংয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর গামা হত্যা মামলায় ২০ আসামির সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সারসংক্ষেপটি কীভাবে প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তাই জানেন না। প্রেসিডেন্ট সাজা মওকুফ করলে তার একটি আদেশের কপি রাষ্ট্রপতির দফতরে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু গামা হত্যার আসামিদের সাজা মওকুফ সংক্রান্ত কোনো আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট অফিসে সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে ধারণা করা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রক্রিয়া করে ফাইল সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট তাতেই স্বাক্ষর করে দেন। এক্ষেত্রে নিয়মমাফিক প্রক্রিয়াগুলো যথাযথভাবে অনুসরণই করা হয়নি।
নুরুুল ইসলামের ঘাতক : লক্ষ্মীপুরে ১১ বছর আগে স্থানীয় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে এএইচএম বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করায় তীব্র সমালোচনা উঠেছে বিভিন্ন মহলে। আতঙ্কিত এ জনপদের সাধারণ মানুষ। নিহত নুরুল ইসলামের পরিবার এ মৃত্যুদণ্ড মওকুফের বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিপ্লবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ২০০০ সালে নুরুল ইসলামকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে হত্যা করে। ঘটনার পর একটি মামলা হলেও তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মামলার পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও পৌর মেয়র আবু তাহের, তার স্ত্রী ও তিন ছেলেসহ ৩১ জনকে আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। এরপর দ্রুত বিচার আদালতে তাহেরের তিন ছেলেসহ ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। পরে হাইকোর্টেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অন্যতম তাহেরের ছেলে বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ সংক্রান্ত একটি চিঠি গত ১২ জুলাই নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার বিচারিক আদালত চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। এতে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দির বাবা কর্তৃক ছেলের প্রাণভিক্ষার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ‘মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হলো’ লিখে স্বাক্ষর করেছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা শেষে গত ১০ জুলাই আইন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানো হয়। কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অন্ধকারে রেখেই ফাইলটি আইনমন্ত্রীকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। আইনমন্ত্রী এ ফাইলের মতামত নিজে পড়ে দেখারও সুযোগ পাননি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
আইনজীবী খুনের আসামি : জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলার প্রধান আসামি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসান হাবীব ওরফে টিটু। নয় বছর আগে এক রায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সে সময় টিটু ছিল পলাতক। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর টিটু উচ্চ আদালতে আত্মসমর্পণ ও আপিল করলে উচ্চ আদালত তার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে সাধারণ ক্ষমার আবেদন জানালে তা মঞ্জুর হয়। গত ৯ মার্চ তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
আবেদন ছাড়াই দণ্ড মওকুফ : সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ওরফে লাবুর সাজা মওকুফ করা হয়েছে আবেদন ছাড়াই। জরুরি অবস্থার সরকারের সময় চারটি দুর্নীতির মামলায় ১৮ বছর সাজাপ্রাপ্ত শাহাদাব আকবরের সাজা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পলাতক অবস্থায়ই মওকুফ করে দেয়া হয়। পলাতক থাকা অবস্থায় আবেদন ছাড়াই দণ্ড মওকুফের ঘটনা এটাই প্রথম বলে দাবি করেছেন আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ২০০৯ সালে শাহাদাব আকবরের সাজা মওকুফ করেন।