Sunday, July 31, 2011

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যত ক্ষমা by এমএ নোমান ও নাছির উদ্দিন শোয়েব

ত আড়াই বছরে বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় আদালতের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২২ খুনিকে ক্ষমা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। এদের মাফ করা ছাড়াও দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আরও এক ভিআইপি আসামির দণ্ড মওকুফ করেছেন তিনি। তাদের এ দণ্ড মওকুফে জেল কোডের বিধানও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি আসামিদের পক্ষ থেকে দণ্ড মওকুফের প্রার্থনা জানিয়ে যেসব আবেদন করা হয়েছে তাও যথাযতভাবে পূরণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতও নেয়া হয়নি। এছাড়াও সাংবিধানিক এখতিয়ারের কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আরও ৮৯৭ জন কয়েদির দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। এদের মুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন আলোচিত হত্যা মামলার আসামি। আবেদন ছাড়া সাজা মওকুফের বিধান না থাকলেও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলের সাজা মওকুফ করা হয়েছে জেলকোডের বিধান লঙ্ঘন করেই। রাজনৈতিকভাবে এসব কয়েদির দণ্ড মওকুফের পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমার আওতায় আরও এক হাজার কয়েদির দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢালাওভাবে এ ধরনের দণ্ড মওকুফের ঘটনা রাষ্ট্রপতিকে এবং তার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে বিতর্কিত এবং কলুষিত করেছে। এতে করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং সমাজ দিন দিন অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হবে।
মহাজোট সরকারের গত আড়াই বছরে রাজনৈতিক মামলার তালিকায় আলোচিত খুনের মামলাসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে দায়ের করা প্রায় ৭ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে এর আসামিদের মুক্তি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক এখতিয়ারকে ব্যবহার করে নাটোরের চাঞ্চল্যকর গামা হত্যা মামলায় ২০ ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। আগে ক্ষমা করা হয়েছে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা ও খ্যাতিমান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের হত্যাকারী এক ফাঁসির আসামিকে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা
চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ওরফে লাবুর ১৮ বছরের দণ্ড রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে ক্ষমা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতাবলে লাবুর কারাদণ্ডসহ তার আর্থিক জরিমানা পুরোটাই মওকুফ করে দেন। কোনো আসামি কারাগারে না গিয়ে কারাগারকে ব্যবহার করে দণ্ড মওকুফের প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা মঞ্জুর করার ঘটনা এটিই প্রথম। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের জনপ্রিয় আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে হত্যাকারী বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফের ঘটনা গোটা দেশে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে।
দণ্ড মওকুফ ও জেলকোডের বিধান : আইন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দণ্ড মওকুফের বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, কারাগারে বন্দি কোনো কয়েদির যে কোনো মেয়াদের দণ্ড মওকুফের বিষয়ে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এ এখতিয়ার দিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের জন্য কে আবেদন করতে পারবেন, সেটা জেল কোডের বিধান অনুসরণ করে জেল কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবেন। যে কোনো কয়েদি ইচ্ছা করলেই রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করার সুযোগ নেই। মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ তার নিজস্ব পর্যবেক্ষকদের দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন। এদের মধ্যে যারা কারাগারে ভালো আচরণ করেছে, যাদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং বার্ধক্য কিংবা অন্য কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ শক্তিতে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছেন কারা কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের দণ্ড মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার সুযোগ করে দিতে পারেন। নির্ধারিত ফরমে এ আবেদন করতে হয়। এতে কয়েদির বয়স, কারাভোগের মেয়াদ ও বিবরণ, আচরণগত দিক, কারাগারে প্রবেশের তারিখে ওজন এবং আবেদন করার তারিখের ওজনসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো উল্লেখ করবে আবেদনকারী। আবেদনকারীর এ আবেদন যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এতে সুপারিশসহ কারা কর্তৃপক্ষ তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সর্বমোট ৮টি ধাপে এ আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে এর আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। একইভাবে আইন মন্ত্রণালয়েও ৮টি ধাপে তা যাচাই-বাছাই করা হয়। এসব ধাপ অতিক্রম করে একটি সুপারিশসহ একটি আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে কম করে হলেও এক মাস সময় লাগার কথা। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে যে, গামা হত্যা মামলা, অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামিসহ অন্য আসামিদের দণ্ড মওকুফের আবেদন পর্যালোচনায় এসব রীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন আসামির দণ্ড মওকুফকে রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার এবং জেল কোডের বিধান উল্লেখ করে বলেন, কোনো আসামিকে দেয়া নিম্ন আদালতের সাজা সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকলে সেক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ডিত ওই আসামি উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে দণ্ড মওকুফের প্রার্থনা জানাতে পারেন। জেলকোডের বিধান অনুযায়ী এটাকে ‘ক্ষমা ভিক্ষা’ বলে। জেল কর্তৃপক্ষ তার কেসস্টাডি, তার কারাভোগের বিবরণ, ব্যক্তিগত আচার আচরণ এবং বয়স সবকিছু উল্লেখপূর্বক দণ্ডিত ব্যক্তি ক্ষমার যোগ্য না-কি অযোগ্য তা উল্লেখ করে সুপারিশসহ প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা শেষে আইনগত দিক ক্ষতিয়ে দেখার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। আইনি মতামতসহ আইন মন্ত্রণালয় সেটা পুনরায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে।
বিপ্লবসহ বিভিন্ন আসামির দণ্ড মওকুফ সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ের বিতর্কিত বিষয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি যতটুকু জানি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক খালাসপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামির মামলা এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। আপিল বিভাগে তাদের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করায় মূলত উচ্চ আদালতের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে দণ্ডিতরা প্রকৃত অর্থেই অপরাধী। এ কারণেই তারা সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ড বহাল থাকবে এটা মনে করেই আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষা না করে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করিয়ে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে দণ্ড মওকুফ করিয়েছে। তিনি বলেন, এতে করে উচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাবে। ভয়ঙ্কর আসামিরা সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ক্ষমা নেয়ার চেষ্টা করতে থাকবে। খন্দকার মাহবুব বলেন, যে আসামির দণ্ড মওকুফ করা হলো ওই ব্যক্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি সুবিচার ও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে। রাষ্ট্রপতির এ দণ্ড মওকুফের মাধ্যমে তার সে আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অনেক সময় অপরাধীরা দণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে বেপরোয়া হয়ে যায়। এর প্রমাণ নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ছানাউল্লাহ নুর বাবুকে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। খন্দকার মাহবুব বলেন, কাজেই রাষ্ট্রপতির দণ্ড মওকুফের ব্যাপারে তার সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রয়োগের বিষয়টি আগে ভেবে দেখা উচিত।
প্রথিতযশা ফৌজদারি আইন বিশারদ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলায় নিম্ন আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতা কোনো সুস্থ সমাজের মানদণ্ড হতে পারে না। সামাজিক ও নৈতিকতা বলে একটা কথা রয়েছে, যেসব আসামির দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে দেশে সামাজিক নৈতিকার রেষ থাকলে তাদের ক্ষমা করা সম্ভব হতো না। আমি ভাবছি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নিয়ে। তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। তাদের সে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। এ ধরনের দণ্ড মওকুফের ঘটনা সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম রেজাউল করিম বলেন, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। দণ্ড মওকুফ বা সাজা হ্রাস করার অধিকার সংবিধান তাকে দিয়েছে। কিন্তু সেই দণ্ড মওকুফ কতটা যুক্তিযুক্ত তা নির্ণয় করে দেয়ারও কর্তব্য স্বরাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয়ের। আমি মনে করি রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো আসামির দণ্ড মওকুফ বাঞ্ছনীয় নয়। এতে রাষ্ট্রপতি পদ ও সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত হয়ে পড়ে। কেননা যে লোক খুন হলেন তার পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ন্যায়বিচারের আশা নিয়ে তারাও অপেক্ষায় থাকেন। বাদী বা বিচার প্রার্থীদের অনুভূতির বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত। বিপ্লবসহ সাম্প্রতিক সময়ে দণ্ড মওকুফের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাষ্ট্রপতির ওই প্রতিষ্ঠানকে যাতে বিতর্কিত না হয় সেটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক ডিআইজি মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবেই দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ বা কোনো বিবেকবান জনগণ আশা করে রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে করবেন। যেহেতু এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে তাই আমরা আশা করব সেটা সমাজে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তিনি তা না করুক। মানুষ তা কামনা করে না। শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, যদি এ ক্ষমার ক্ষেত্রে বিবেচনা না করা হয়, তা হলে অন্যান্য খুনি বা বড়মাপের আসামিরা ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের অপরাধীরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে এভাবে ক্ষমা পাওয়ার পথ অনুসরণ করবে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন এই প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকলে তার পরিণাম কখনও শুভ হবে না। তিনি বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞ এবং সচেতন একজন মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তার এ ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি জনমনে কিছুটা হলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক কারা কর্মকর্তা শামসুল হায়দার সিদ্দিকী প্রশ্ন তুলে বলেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমান হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ভবিষ্যতে কোনো রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেন তখন ওনার কি বলার থাকবে?
রাষ্ট্রপতির আলোচিত ক্ষমা : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডপাপ্ত ২২ আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। নাটোরো গামা হত্যা মামলায় ২০ জন, জামালপুরে অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলায় ১ জন ও লক্ষ্মীপুরে অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় এক জনকে মুক্তি দেয়া হয়। এর মধ্যে গামা হত্যা মামলার ২০ আসামির মধ্যে ১০ জনকে ঢাকা কেন্দ্র্রীয় কারাগার এবং অন্যদের সংশ্লিষ্ট কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার পর জামিননামা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই কারাগারের তত্ত্বাবধায়কের পৌঁছার পর যাচাই-বাছাই করে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
গামার ২০ খুনি : ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নাটোরের নলডাঙ্গা রামশার কাজিপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলি ও চাপাতিতে খুন হন সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহমদ গামা। এ সময় কাজিপুর গ্রামে ৫০টি বাড়িঘরে লুটপাট, ভাংচুর, নারী নির্যাতনসহ অগ্নিসংযোগ করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় গামার বাবা রফিকুল ইসলাম তালুকদার বাদী হয়ে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজসহ ১৬ জনের নামসহ অজ্ঞাত আরও ১৫-১৬ জনের নামে নলডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে ২১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পরে উচ্চ পর্যায়ে তদন্তের পর মামলাটি ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফিরোজ আলম গামা হত্যা মামলার রায়ে ২১ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। আসামিদের আপিলের শুনানির আগেই ২০ আসামি গত বছর ১৫ এপ্রিল কারাগার থেকে আপিল প্রত্যাহার ও প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আবেদন করে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছর ২ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ২০ আসামির দণ্ড মওকুফ সংক্রান্ত আদেশে স্বাক্ষর করেন। গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি পায় আসামিরা। ২০ জনের মধ্যে তিন সহোদর এসএম ফিরোজ, ফজলুল হক শাহ্ ও ফারুক, আনিসুর রহমান আনসার ও তার দুই ছেলে ফয়সাল ও সেন্টু, শাজাহান, জাহেদুল, বাদল, আ. জলিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং জহুরুল শাহ্, সাজ্জাদ, সোহাগ, বাবলু, আবুল, আতাউর, আশরাফ, ফরমাজুল, ফকরউদ্দিন, ওহিদুর রহমান রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিল। এক আসামি শুরু থেকেই পলাতক ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ আইন মন্ত্রণালয় ঘুরে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্টের কাছে। নিয়ম রয়েছে, এ ধরনের কোনো সারসংক্ষেপ প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো হলে তা নোটিংয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর গামা হত্যা মামলায় ২০ আসামির সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সারসংক্ষেপটি কীভাবে প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তাই জানেন না। প্রেসিডেন্ট সাজা মওকুফ করলে তার একটি আদেশের কপি রাষ্ট্রপতির দফতরে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু গামা হত্যার আসামিদের সাজা মওকুফ সংক্রান্ত কোনো আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট অফিসে সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে ধারণা করা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রক্রিয়া করে ফাইল সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট তাতেই স্বাক্ষর করে দেন। এক্ষেত্রে নিয়মমাফিক প্রক্রিয়াগুলো যথাযথভাবে অনুসরণই করা হয়নি।
নুরুুল ইসলামের ঘাতক : লক্ষ্মীপুরে ১১ বছর আগে স্থানীয় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে এএইচএম বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করায় তীব্র সমালোচনা উঠেছে বিভিন্ন মহলে। আতঙ্কিত এ জনপদের সাধারণ মানুষ। নিহত নুরুল ইসলামের পরিবার এ মৃত্যুদণ্ড মওকুফের বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিপ্লবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ২০০০ সালে নুরুল ইসলামকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে হত্যা করে। ঘটনার পর একটি মামলা হলেও তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মামলার পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও পৌর মেয়র আবু তাহের, তার স্ত্রী ও তিন ছেলেসহ ৩১ জনকে আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। এরপর দ্রুত বিচার আদালতে তাহেরের তিন ছেলেসহ ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। পরে হাইকোর্টেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অন্যতম তাহেরের ছেলে বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ সংক্রান্ত একটি চিঠি গত ১২ জুলাই নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার বিচারিক আদালত চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। এতে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দির বাবা কর্তৃক ছেলের প্রাণভিক্ষার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ‘মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হলো’ লিখে স্বাক্ষর করেছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা শেষে গত ১০ জুলাই আইন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানো হয়। কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অন্ধকারে রেখেই ফাইলটি আইনমন্ত্রীকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। আইনমন্ত্রী এ ফাইলের মতামত নিজে পড়ে দেখারও সুযোগ পাননি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
আইনজীবী খুনের আসামি : জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলার প্রধান আসামি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসান হাবীব ওরফে টিটু। নয় বছর আগে এক রায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সে সময় টিটু ছিল পলাতক। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর টিটু উচ্চ আদালতে আত্মসমর্পণ ও আপিল করলে উচ্চ আদালত তার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে সাধারণ ক্ষমার আবেদন জানালে তা মঞ্জুর হয়। গত ৯ মার্চ তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
আবেদন ছাড়াই দণ্ড মওকুফ : সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ওরফে লাবুর সাজা মওকুফ করা হয়েছে আবেদন ছাড়াই। জরুরি অবস্থার সরকারের সময় চারটি দুর্নীতির মামলায় ১৮ বছর সাজাপ্রাপ্ত শাহাদাব আকবরের সাজা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পলাতক অবস্থায়ই মওকুফ করে দেয়া হয়। পলাতক থাকা অবস্থায় আবেদন ছাড়াই দণ্ড মওকুফের ঘটনা এটাই প্রথম বলে দাবি করেছেন আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ২০০৯ সালে শাহাদাব আকবরের সাজা মওকুফ করেন।

No comments:

Post a Comment