Sunday, February 13, 2011

বিজয়ে উন্মাতাল মিসর তবুও শঙ্কার ছায়া

সূর্য প্রতিদিনই ওঠে। কিন্তু কোনো কোনো সূর্যোদয় মানুষকে আলোড়িত করে দারুণভাবে। যেমন, গতকালের দিনটায় আলোড়িত হয়েছে মিসরের কোটি কোটি মানুষ। গতকাল শনিবার ছিল মিসরের গত ৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথম আলোকিত অনাবিল এক দিন।

তবে মুবারকবিহীন এই দিন পুরো দ্বিধাহীন নয়। কারণ গণতন্ত্র স্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনো। ক্ষমতা আপাতত সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত হওয়ায় পুরনো শঙ্কাও কাজ করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে। কেননা মুবারকরা এভাবেই মিসরে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আবারও যে কেউ হবেন না, এর নিশ্চয়তা কী? ফলে এখনো বাকি রয়েছে অপেক্ষার প্রহর।
টানা ১৮ দিন দেশজুড়ে তীব্র গণবিক্ষোভের পর হোসনি মুবারককে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারায় মিসরবাসীর মনে এখন বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার। গত শুক্রবার রাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমান পলাতক হোসনি মুবারকের পদত্যাগের বার্তাটি পাঠ করার পর থেকেই কায়রো যেন নির্ঘুম নগরী। লাখ লাখ মিসরীয় শুক্রবার রাত থেকেই আনন্দে উদ্বেল। গতকালও তারা মনের আনন্দে গেয়েছে বিজয়ের গান, উড়িয়েছে দেশের পতাকা।
এদিকে মিসরের বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী আহমেদ নাফিজের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন প্রধান কেঁৗসুলি। এ ছাড়া আত্মগোপন করে থাকা দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদলির ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব আল-আদলিসহ ক্ষমতাচ্যুত হোসনি মুবারক সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। মিসরের বার্তা সংস্থা মেনার উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল শনিবার রাতে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
মেনার খবরে বলা হয়, রাষ্ট্রের প্রধান কেঁৗসুলির দপ্তর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মুবারকের ঘনিষ্ঠ ও এনডিপির একজন শীর্ষ নেতা ইস্পাত ব্যবসায়ী আহমেদ ইজের অর্থসম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। মেনা জানায়, সাবেক গৃহায়ণমন্ত্রী আহমেদ আল-মাগরাবি এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী রশিদ মোহাম্মদ রশিদের অর্থসম্পদ নিয়েও তদন্ত চলছে। কায়রো শহরে গতকালও হয়েছে বিজয় মিছিল। যুবকরা হাতে হাত মিলিয়ে পরস্পর
অনুভূতি বিনিময় করেছে। মিসরীয়দের এ যেন পুনর্জন্মের দিন।
দুই রাত আগেও যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তাহরির স্কয়ারে ফেলা অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর উদ্বেগ ও শঙ্কায় রাত পার করেছিল, গতকাল তারাই ছিল বিজয় মিছিলগুলোর সম্মুখভাগে। তাদেরই একজন ৪০ বছর বয়সী কৃষি প্রকৌশলী ওসামা সাদাল্লাহ গতকাল মিছিল থেকে বলেন, 'আজ শুধুই উৎসবের দিন। আমাদের জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে। আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি_আমরা পারি। আজ পৃথিবীজুড়ে শুধুই আমাদের বিজয়ের সংবাদ। এ জন্য আমরা গর্বিত। এটা ভীষণ সুখের মুহূর্ত।'
অবশ্য মুবারকের পতনের পর মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাওয়ায় এ সুখ তাদের কপালে সইবে কি না, সেটা নিয়েও উৎসবের মধ্যেই চলছে নানা আলোচনা। মুবারকের পতনের আনন্দে আত্মহারা হলেও এখন মিসরীয়দের মুখে মুখে এটাও ঘুরছে_সেনাবাহিনী কি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে?
সেনা নিয়ন্ত্রণের কারণে এত দিন ধরে গণমানুষের সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো হঠাৎ করেই যেন চলে গেছে দৃশ্যপটের আড়ালে। তবে মিসরের সেনাবাহিনী গতকালও এক ঘোষণায় দেশবাসীকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দেওয়া ভাষণে খুব শিগগিরই নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন ঘটবে এবং দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে ওই বিবৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর বিষয়ে সেনা সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা জানিয়েছে, এর আগে মুবারকের শাসনামলে ইসরায়েলসহ সারা পৃথিবীর সঙ্গে মিসরের যেসব চুক্তি ছিল, সেগুলো মেনে চলা হবে। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় পাশের দেশটিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছে। বিবৃতিতে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দেশটির বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
এদিকে সেনা সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মেদ হোসেইন তানতাভি খুব শিগগিরই তাঁর সরকারের অবস্থান ও নীতি ঘোষণা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে ৭৫ বছর বয়সী তানতাভি গত শুক্রবার জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে মুবারকের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর ভাষণে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আশা করছেন মিসরের রাজনীতিবিদরা।
মিসরের রাস্তাগুলো থেকে সেনাবাহিনীর ট্যাংকসহ ভারী সাঁজোয়া যানগুলোকে গতকাল সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৮ দিনের গণবিদ্রোহের সময় সরকারি নির্দেশে সম্ভাব্য সহিংসতা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে এসব সাঁজোয়া যান কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ভেতরেও দেশটির সেনাবাহিনী আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত থাকায় এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। অন্যদিকে সেনাবাহিনী গণমানুষের বিক্ষোভ চলাকালে সরাসরি কোনো অবস্থান না নেওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতায় আসার পরও তাদের প্রতি দেশটির সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রেখেছে। এটা মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে সেনাবাহিনী অঙ্গীকার পাল্টে নিজেরাই ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিকল্পনা করলে সাধারণ মানুষ আবারও মাঠে নামবে বলেই তাঁদের ধারণা।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করায় মিসরের বিরোধী দলগুলো এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, 'মিসরবাসী পরিবর্তনের জন্য আকুল হয়ে ছিল। ক্ষমতা ছেড়ে মুবারক সে ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। মিসরবাসী প্রমাণ করেছে, বর্তমান সময়ে আদর্শ গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।'
মিসরের বৃহত্তম বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড মুবারক ক্ষমতা ছাড়ায় আনন্দিত হলেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখবে এটাই তাদের প্রত্যাশা।'
এদিকে গতকাল সুয়েজ খালের নিকটবর্তী ইসমাইলিয়া শহরে শত শত পুলিশ ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশও এ বিক্ষোভে যোগ দেয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে তারা অভিযোগ করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী তারা কেবল এ নির্দেশ পালন করেছে। তবে কাজটা ছিল জঘন্য অন্যায়। এ সময় তারা 'পুলিশ ও জনতা ভাই ভাই'-জাতীয় স্লোগান দিয়েও রাস্তা প্রকম্পিত করে। এই নির্দেশের জন্য তারা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদরিকেও দায়ী করে। উল্লেখ্য, গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের হামলায় ৩০০ মিশরীয় আন্দোলনকারী নিহত ও কায়েক হাজার আহত হয়।
এদিকে গতকাল শনিবারও কায়রোর একটি জেল থেকে ৬০০ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, জেলের ভেতরে বন্দিরা প্রথমে বিক্ষোভ করে। এরপর দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করলে জেলখানার বাইরে থেকে একদল সশস্ত্র বন্দুকধারী পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ার সময় বন্দিদের একটি অংশ পুলিশের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ সময় সৃষ্ট সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হলেও প্রায় ৬০০ বন্দি পালিয়ে যায়। আহত-নিহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ জানাতে পারেনি। তবে অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, পুলিশের একটি অংশ বিচারাধীন এসব আসামিকে জেল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
এদিকে মিসরের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দৈনিক 'আল-আহরাম' মুবারকের পতনের পর তাদের শিরোনামে লিখেছে 'দেশের তরুণ প্রজন্ম মুবারককে গদি ছাড়তে বাধ্য করল'। এ শিরোনামের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি তাদের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অন্যান্য প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে।
সূত্র : এএফপি, এপি, বিবিসি, রয়টার্স।

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

চাল নিয়ে চালবাজি তো চলছেই, এখন শুরু হয়েছে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডকারখানা। বাজার থেকে ভোজ্যতেল সয়াবিন প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার পর তা ১২ টাকা বাড়তি দাম নিয়ে ফিরে এসেছে। গত কয়েক দিন বাজারে সয়াবিনের সরবরাহ ছিল না বললেই চলে।

অথচ গতকাল শনিবার বাজার সয়াবিনে সয়লাব। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর জন্যই কয়েক দিন ধরে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল। আর লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর মাধ্যমে সেই সংকট কেটে গেল গতকাল।
সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য এবার আর তেমন কোনো কথা বলছে না। অথচ আড়াই মাস আগে এক দিনে লিটারে ১৩ টাকা বাড়ার ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৯ নভেম্বর এক দিনে ১৩ টাকা বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর চটেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান। সচিবালয়ে ডেকে তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এটা মগের মুল্লুক না। ইচ্ছেমতো ভোজ্যতেলের দর বাড়ানো চলবে না। এক দিনের ব্যবধানে ১৩ টাকা বাড়ানো কোনো ব্যবসার লক্ষণ নয়।’
তবে ব্যবসায়ীদের মুখে সেই পুরোনো কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বলেই তাঁরাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সরকারই দাম বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে, তাই তাঁরা বাড়িয়েছেন। আর সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বক্তব্য হচ্ছে, যত টাকা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি হারে বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) রাখা হয়েছে লিটার ১১৪ টাকা। আবার নজিরবিহীনভাবে খোলা সয়াবিন তেলের দরও বোতলজাতের সমানই। আর পামতেল বিক্রি হচ্ছে বাজারে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা লিটার।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন দোকান সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ৯ ফেব্রুয়ারি উৎপাদিত রূপচাঁদা পাঁচ লিটারের বোতলের খুচরা মূল্য ৫৭০ টাকা। আগে ছিল তা ৫১০ টাকা। রূপচাঁদার সঙ্গে আগে কয়েক টাকা পার্থক্য থাকলেও পুষ্টি, তীর, ফ্রেশ, দাদা, রুবাইয়া, মোস্তফা ইত্যাদি ব্র্যান্ডের সয়াবিনেরও বর্তমানে একই দর। দোকানদারেরা জানান, এখন সব সমান। গত শুক্রবার থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়েছে।
গত ৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব ১৫ দিন পরপর দাম পুনর্নির্ধারণের কথা জানিয়েছিলেন। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বৈঠক ঠিকই অনুষ্ঠিত হয় ২২ ডিসেম্বর। দুবারই ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপর থেকেই মন্ত্রণালয় নীরব।
তবে সরকার নির্ধারণ করে দিলেও কোনোবারই নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়নি ভোজ্যতেল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ বৈঠক করেও কোনো লাভ হয় না। কারণ, নির্ধারিত দরের কোনো প্রভাব থাকে না বাজারে। ব্যবসায়ীরা যা করার তা-ই করেন।’
বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট: ভোজ্যতেলের বাজারে মেঘনা গ্রুপ একটি সুপরিচিত নাম। ফ্রেশ ব্র্যান্ডের সয়াবিন এ কোম্পানির পণ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোম্পানিটি দিন দিন বাজারে তেল পরিবেশন কমিয়ে এনেছে। অর্থাৎ বিক্রি করা হয়নি। ঢাকা চেম্বারের এক সেমিনারে বাণিজ্যমন্ত্রী এ ধরনের বিষয়কেই কৃত্রিম সংকট বলে অভিহিত করেছেন।
মেঘনা গ্রুপের চার মাসের বিক্রয়চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অক্টোবরে কোম্পানিটি দুই হাজার ৯০০ টন সয়াবিন বিক্রি করে। নভেম্বরে দুই হাজার ৭৬৯ টন, ডিসেম্বরে এক হাজার ৯৩ টন এবং জানুয়ারিতে বিক্রি নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ২০২ টনে।
এলসি কম খোলা হয়েছে: ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ টনের ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। মাসিক চাহিদা এক থেকে সোয়া লাখ টন। এই চাহিদা পূরণ হয় আমদানি করা সয়াবিন ও পামতেলের মাধ্যমে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়া সরিষার মাধ্যমেও কিছুটা চাহিদা পূরণ হয়। আমদানি হয় মূলত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম মিলিয়ে বর্তমানে এক লাখ ৩০ হাজার টন ভোজ্যতেলের মজুদ রয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি সময়ে ২৪ হাজার ৫০০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন এবং ৩১ হাজার ১৭৬ টন পামতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীরা এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উদাহরণ দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, ভোক্তাদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ পামতেল, ৩৪ শতাংশ সয়াবিন তেল এবং ৮ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা ও অন্যান্য তেল ব্যবহার করে।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দর নির্ধারণ: জানা গেছে, ভোজ্যতেলের দর নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যারিফ কমিশন কয়েক দফা বৈঠক করেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা চান বেশি বাড়াতে আর কমিশন চায় যথাসম্ভব কম রাখা যায়।
গত বুধবারও এ নিয়ে নিষ্ফল বৈঠক হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ট্যারিফ কমিশনে আবার জরুরি বৈঠকে ডাকা হয় ব্যবসায়ীদের। ওই বৈঠকে নতুন দর নির্ধারিত হয়। এবার জাহাজভাড়া, কর, পরিশোধন ব্যয়, ব্যাংকের সুদ, পরিশোধনজনিত ঘাটতি এবং মুনাফাসহ মিল গেটে খোলা সয়াবিনের নতুন দর নির্ধারণ করা হয় ১০০ টাকা। খুচরা বাজারে চার টাকা করে যোগ হবে। আর বোতলজাত সয়াবিনের ক্ষেত্রে এ মূল্যের সঙ্গে বোতলের দাম যোগ হবে।
যোগাযোগ করলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সয়াবিনের নতুন দর লিটার ১০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বোতলের দাম যোগ হলেও কোনো অবস্থাতেই তা ১১৪ টাকা লিটার হতে পারে না। কাল রোববারই (আজ) বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ বাজারে চালু সব ব্র্যান্ডেরই পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের এমআরপি ৫৭০ টাকা লেখা রয়েছে জানানো হলে বিস্মিত মজিবুর রহমান বলেন, ‘এটি কীভাবে সম্ভব! একটি পেট বোতলের দাম কি তাহলে ৭০ টাকা!’
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বোতলের গায়ে নতুন মূল্য ০৯.০২.১১ তারিখ উল্লেখ রয়েছে। শুভ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম জানান, পরিবেশকদের কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তেল বিক্রি করেন না। আগের কেনা তেলও নতুন দামে বিক্রি করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান শোয়েব মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। সরকারই দেশীয় বাজারে বাড়তে দিচ্ছিল না। নতুন দর ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না।
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ হাশেম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও তাঁদের কোনো লাভ হয় না। কারণ, তাঁরা কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ পয়সা করে মুনাফা করেন। আসল মুনাফা করেন পরিশোধনকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।