Monday, August 22, 2011

মশার ওষুধের নামে ৫০০ ড্রাম পানি! by অমিতোষ পাল

ত ১৬ আগস্টের কথা। নগর ভবনের নিচতলায় ওষুধের মান পরীক্ষার আয়োজন করে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। ১২টি মশারি টানানো হয়। একেকটি মশারির ভেতরে ৫০টি করে মশা ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর মশার ওষুধ ছিটানো হলো ভেতরে। কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন ওষুধে ৮০ শতাংশ মশা কাবু হবে। কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল, ৮০ শতাংশ তো দূরের কথা, দু-একটি মশা ছাড়া সব মশাই বেঁচে আছে। কিছু মশা অজ্ঞান হলেও পরে সেগুলোকে স্বাভাবিকভাবে উড়তে দেখা যায়। আর এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে প্রতারণার একটি ঘটনা। তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকার মশা মারার ওষুধের কথা বলে ডিসিসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫০০ ড্রাম পানি।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ডিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ দ্রুত ঘটনাস্থলে যান এবং তিনি সব ওষুধ জব্দ করার নির্দেশ দেন। ৫০০ ড্রাম থেকে পাঁচটি ড্রাম দৈবচয়ন ভিত্তিতে বাছাই করা হয়েছে। কয়েকটি মশারিরতে দু-চারটি মশা মরার বিষয়কে স্বাভাবিক কারণ হিসেবে মনে করেন মান পরীক্ষকরা। সে ক্ষেত্রে ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই বলেই তাঁরা ধারণা করছেন। অ্যাগ্রো প্রডাক্টস নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এগুলো সরবরাহ করেছিল। ডিসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা এ এস এম শাহেন রেজা ওষুধ কেনার দায়িত্বে ছিলেন। গত মঙ্গলবার প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। দুই দিন পর বৃহস্পতিবার ডিসিসি এই ৫০০ ড্রাম তরল মশার 'ওষুধ' জব্দ করে। ড্রামগুলো ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশে অবস্থিত মশক নিবারণী দপ্তরে আটক রাখা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ডিসিসি।
জানা গেছে, পানির মধ্যে সামান্য ওষুধ মিশিয়ে কিছুটা গন্ধযুক্ত করে তা ভরা হয় ড্রামে। এরপর তা সরবরাহ করা হয় ডিসিসিকে। প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ার পর এ নিয়ে নগর ভবনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যাঁরা ঘটনাটি ধরতে পেরেছেন, তাঁরা ধন্যবাদের দাবিদার। এখন ঘটনার তদন্ত করে দেখা হবে কিভাবে ভেজাল ওষুধ ঢোকার ঘটনা ঘটল।' তিনি জানান, ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ভেজাল ও মানহীন কোনো ওষুধ ডিসিসি নেবে না। প্রয়োজনে নতুন করে ওষুধ কেনা হবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের গোড়ার দিকে ডিসিসি মশার ওষুধ কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। ওষুধ সরবরাহের কাজ পায় লিমিট এগ্রো প্রডাক্টস নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত ৭ আগস্ট তারা ৫০০টি ড্রামে ১০ হাজার লিটার ওষুধ সরবরাহ করে। প্রতিটি ড্রামে ২০০ লিটার করে ওষুধ থাকার কথা।
প্রচলিত নিয়ম অনুসারে একটি মশারির খাঁচার মধ্যে কিছু মশা ছেড়ে দিয়ে তার ভেতরে ওষুধ স্প্রে করা হয়। ৮০ শতাংশ মশা মারা গেলে ওষুধকে মানসম্পন্ন হিসেবে ধরা হয়। এর আগে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ড্রাম থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা হয়।
ডিসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ঠিকাদার যে দিন ওষুধ সরবরাহ করেন, ওই দিন সংরক্ষিত-১৩ আসনের মহিলা কমিশনার মাহমুদা ইসলামের মৃত্যুতে নগর ভবনে ছুটি ছিল। সেই সুযোগেই ঠিকাদার ড্রামে করে ওষুধের নামে পানি গছিয়ে দেন।
জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন যাবৎ মশার ওষুধ কেনার আড়ালে ক্রয়বাণিজ্য করে আসছে। ঠিকাদার ও ভাণ্ডার বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই প্রতারণা চলছে।
ভাণ্ডার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এবারও ডেঙ্গুতে একজন চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আর দোষ পড়ছে মেয়রের ওপর। নগরবাসী মনে করছেন, ডিসিসি মশার ওষুধ ছিটায় না। কিন্তু ওষুধ কেনার দায়িত্ব পালনকারীরাই যদি ভেজাল ওষুধ কেনে, তাহলে শত চেষ্টা করেও ডেঙ্গু ও মশক দমন করতে পারবে না ডিসিসি। তিনি মনে করেন, ওষুধের মান নিশ্চিত করতে না পারলে নগরীকে কোনোভাবেই মশকমুক্ত করা যাবে না।
ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, এই ভেজাল ওষুধের দাম ধরা হয়েছে প্রতি লিটার ৩৪৫ টাকা। অথচ প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান এসিআই বা অন্যান্য কম্পানির কাছ থেকে কিনলে এই 'এডাল্টিসাইড' ওষুধ পাওয়া যেত ১৯৫ টাকা দরে। এই মধ্যবর্তী অংশটা ওষুধ কেনার দায়িত্ব পালনকারী ও ঠিকাদাররা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
ওষুধ কেনার দায়িত্ব পালনকারী ডিসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা এ এস এম শাহেন রেজা কালের কণ্ঠের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তিনি বলেন, 'আমার ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ হবে না। বরং আপনি বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে পারেন এইভাবে যে, এই জালিয়াতি আমরা ধরতে পেরেছি। এখন আমরা প্রয়োজনে ওই ওষুধ ফিরিয়ে দেব।' কিন্তু সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ওষুধ না নিলে এমনিতেই তো তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। তারপর আর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।'
ওষুধ সরবরাহকারী ঠিকাদার মিজানুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডিসিসি ওষুধকে মানহীন বললেও কথাটা ঠিক না। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, ওষুধ পরীক্ষা করার দিন ব্যাপক বৃষ্টি ও বাতাস ছিল। আর মশারির খাঁচাগুলো করা হয়েছিল নগর ভবনের নিচতলার বারান্দায়। এতে মশারির ভেতরে স্প্রে করা ওষুধ সহজেই বাতাসে উড়ে যায়। ফলে ওষুধের আর কার্যকারিতা জোরালো থাকেনি। বাতাসের কারণে মশার গায়ে ধোঁয়াও ঠিকমতো লাগেনি। তারপরও অনেক মশা মরেছে। তিনি দাবি করেন, ওষুধে পানি মেশানো হয়নি। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করলেই সত্যতা প্রমাণিত হবে। তার আগে কেউ খারাপ বললে সেটা হবে আমাকে ক্ষতি করা।'
ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, এভাবে সরবরাহ করা ভেজাল ওষুধ রাজধানীতে ছিটানো হয়। ফলে মশা আর মড়ে না। আর এই সুযোগে লাভবান হয়েছেন কিছু কর্মকর্তা। তাঁরা ইতিমধ্যে ফ্ল্যাট-প্লটসহ বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।

Saturday, August 20, 2011

মন্ত্রীদের ব্যর্থতায় নেতারা বিব্রত by জাহাঙ্গীর আলম

যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিতে চায় না ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক দলগুলো। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-সাংসদেরাও এসব মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে বিব্রত, ক্ষুব্ধ। মহাজোটের শরিকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে এই মন্ত্রীদের নিয়ে মহাজোট আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। এ জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ব্যর্থতা নিয়ে মহাজোটে ব্যাপক আলোচনা আছে। তাঁদের কর্মকাণ্ড, বক্তব্য ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতায় শরিক দলগুলো প্রকাশ্যেই সমালোচনামুখর।
এসব মন্ত্রীর পদত্যাগ চায় দলগুলো। মহাজোটের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কারণেই তাঁদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেন দলগুলোর নেতারা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে দলে অসন্তোষ আছে। বিশেষ করে, মন্ত্রীদের পরস্পরের প্রতি দায় চাপানোর প্রবণতায় নেতারা বিব্রত। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথাও বলছেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী জনগণের অনুভূতির খবর রাখেন। দল মন্ত্রীদের ব্যর্থতার দায় নেবে না। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী সময়মতো পদক্ষেপ নেবেন।
একইভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এই কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা দল বা মহাজোটের ওপর বর্তায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাঁদের নিজে থেকেই চলে যাওয়া উচিত।’ ক্ষমতাসীন দলের আরও কয়েকজন সাংসদ এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চাননি।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত দেশের যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো বাস চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় মানুষ এখন চরম দুর্ভেঅগে রয়েছে। এটি এখন জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও যোগাযোগমন্ত্রীর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদে সাংসদদের তোপের মুখে পড়েন যোগাযোগমন্ত্রী।
একইভাবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান পরীক্ষা ছাড়াই সাড়ে ২৪ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। অদক্ষ চালকদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়লেও নৌমন্ত্রী তাঁর অবস্থানে অনড় রয়েছেন।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের দেশ পরিচালনার মেয়াদ পাঁচ বছর। চলার পথে গতি কখনো শ্লথ হবে, কখনো বাড়বে। একটা ত্রুটি হয়েছে, এটা আমরা কাটিয়ে উঠব।’
মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাজোটে আমরা রাজনৈতিকভাবে আছি। সরকার পরিচালনায় আমাদের ভূমিকা নেই। এসব ব্যর্থ মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দেখেশুনে ব্যবস্থা নেবেন।’
মেনন বলেন, আইনের প্রয়োগ ছাড়া কারও ইচ্ছায় গাড়ি চালানোর পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া যায় না। আর সরকার যতই বলুক, পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।
অপর শরিক জাসদের হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘মন্ত্রীদের দুর্নীতি, অদক্ষতা, ব্যর্থতার দায় আমরা নেব না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেই জবাবদিহি করতে হবে, কৈফিয়ত দিতে হবে। মহাজোটকে বিব্রত না করে এঁদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুত ব্যবস্থা চাই।’
মহাজোটের নেতারা জানান, বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতা ও অদক্ষতায় মজুদদারি ও অতি মুনাফাখোরি চক্রের কাছে সরকার পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। ‘ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও গত আড়াই বছরেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বাজার-ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ও তদারকির অভাব, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা, বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করতে না পারা এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ বলে মনে করে মহাজোট ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়। পাশাপাশি পরিবহনে চাঁদাবাজি, টিসিবিকে শক্তিশালী করতে না পারায় বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাণিজ্যমন্ত্রী জনগণকে কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ায় সব মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পুলিশের উপস্থিতিতে গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও দখলবাজি নিয়ন্ত্রণেও পুলিশ সফলতা পায়নি।
মহাজোটের নেতারা মনে করেন, পুলিশের ওপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি কম থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।
সম্প্রতি পুলিশের উপস্থিতিতে রাজধানীতে ছয় ছাত্র হত্যার ঘটনা সমাজে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। নোয়াখালীতে পুলিশ মিলন নামের এক তরুণকে গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দেয়। গণপিটুনিতে সে নিহত হলে পুলিশ আবার গাড়িতে তুলে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে অপরাধী বানাতে পুলিশ মিথ্যা গল্প সাজিয়েছে। র‌্যাবের গুলিতে লিমনের পঙ্গু হওয়ার ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতারা মনে করেন, এসব ঘটনা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অযোগ্য, ব্যর্থ ও অকর্মণ্য মন্ত্রীদের দায়ভার নেব না। এদের বিদায় দেওয়া না হলে মহাজোট বিপর্যয়ে পড়বে।’
১৪ দলের শরিক কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক অসিত বরণ বিশ্বাস বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী যেদিন কথা বলেন, সেদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। ১৪ দলের ২৩ দফায় আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা ছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। কাজেই অযোগ্য মন্ত্রীদের দায়ভার ১৪ দল নেবে না।
মহাজোটের শরিক ও নিজের দলের নেতাদের দাবির মুখে পদত্যাগ করবেন কি না, জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা করতে হলে আগে আমাকে ভাবতে হবে। যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ কী মনে করেন। পাশাপাশি আমার নিয়োগকর্তা কী বলেন।’
আপনার নিজের বিবেচনায় কী মনে হয়, পদত্যাগ করা উচিত? মন্ত্রী বলেন, ‘আমার ত্রুটির কারণে এ সমস্যা দেখা দেয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বরাদ্দ কম থাকার কারণে রাস্তাঘাটের এ অবস্থা হয়েছে।’
দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কথা শুধু যে এখন বলা হচ্ছে, তা নয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সংসদে এ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। সেদিন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সাংসদ এ প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, গত আড়াই বছরে দেশের কোথাও সড়কের উন্নয়নে কাজ হয়নি। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। এরপর রাশেদ খান মেননও সংসদে এ প্রসঙ্গ নিয়ে বক্তব্য দেন। কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রী বা সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

পুলিশের অভিযোগপত্রে আসামি শুধুই পরিমল

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার দশম শ্রেণীর ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এতে চাকরিচ্যুত শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম এবং বসুন্ধরা শাখার ভারপ্রাপ্ত শাখাপ্রধান লুৎফর রহমানকে অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা পুলিশের অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করে প্রথম আলোকে জানান, পুলিশ প্রভাবিত হয়ে মামলা তদন্ত করে অধ্যক্ষসহ দুই শিক্ষককে অভিযোগ থেকে বাদ দিয়েছে। তাঁরা এ অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেবেন বলেও জানান।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার পরিদর্শক এস এম শাহাদত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১১ আগস্ট মামলার অভিযোগপত্র তৈরি করা হয় এবং তা ১৪ আগস্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম ও বসুন্ধরা শাখার প্রধান লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই তাঁদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ধর্ষণের শিকার ছাত্রীটি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ভাড়া বাসার কোচিং সেন্টারের একটি কক্ষে আটকে রেখে পরিমল জয়ধর তাকে দুই দফা ধর্ষণ করেছেন। গত ১১ জুলাই পরিমল জয়ধর মেয়েটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, আদালতে দেওয়া মেয়েটির জবানবন্দি ও আসামি পরিমলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা এবং সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে আসামি পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সংশোধিত ২০০৩ এর ৯(১) ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম ও শাখাপ্রধান লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে আলামত বিনষ্ট করা, ভয়ভীতি দেখানো ও মেয়েটিকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকির অভিযোগে মামলা করার পর ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এ ঘটনায় ৩৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তদন্তে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ জন্য তাঁদের অব্যাহতির জন্য আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে।
অভিযোগপত্রের ব্যাপারে জানতে চাইলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অধ্যক্ষ মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছিলেন। মেয়েটির স্বজনদের বক্তব্য অভিযোগপত্রে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলেও মেয়েটির স্বজনেরা অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে তিনি এ মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করেছেন।
গত ৭ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিমল জয়ধরকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১১ জুলাই তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ পরিমলকে চাকরিচ্যুত করে। তবে এ ঘটনার পর অধ্যক্ষ হোসনে আরার অপসারণের দাবিতে ভিকারুননিসার ছাত্রী ও অভিভাবকেরা আন্দোলন শুরু করেন। এ অবস্থায় হোসনে আরাকে তিন মাসের ছুটি দিয়ে মঞ্জুআরা বেগমকে অধ্যক্ষের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন: ছাত্রী ধর্ষণ ও পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট ঘটনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, কাল রোববার প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিবেদনে এই ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য অধ্যক্ষ হোসনে আরাসহ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়েছে। কমিটি মনে করে, কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছে। এরপর পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্যের কার্যকলাপ দেখে মনে হয়েছে তাঁরা ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কিছু শিক্ষকও দায়ী। ২৪ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে এত বেশি শাখা না খোলা, এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের কমিটি করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটির প্রধান ছিলেন বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান।

ঈদে বাড়ি যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় মানুষ by ইফতেখার মাহমুদ ও অনিকা ফারজানা

দূরপাল্লার বাসের অগ্রিম টিকিটের জন্য চলছে হাহাকার। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে কাল রোববার। বেহাল মহাসড়কের কারণে বাস চলাচলও বিপর্যস্ত। তাই এবার প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনের জন্য বাড়ি যাওয়া নিয়ে মানুষ এখনো রয়েছে অনিশ্চয়তায়, শঙ্কায়।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান ও সায়েদাবাদে অধিকাংশ বাস কাউন্টারের কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। বাসমালিক-শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, বিধ্বস্ত সড়কের কারণে প্রতিদিনই মহাসড়কে বাস বিকল বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য বাসের ট্রিপ (যাত্রা) কমিয়ে দিতে হয়েছে। ট্রিপ কমে যাওয়ায় টিকিটও কমেছে।
হানিফ পরিবহনের কাউন্টারের কর্মী জামিল জানান, অন্যান্য বছরের মতো এবার ঈদে অতিরিক্ত বাস নামানোর বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভাঙা রাস্তার কারণে মালিকপক্ষও এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ—দুই দিকেই স্বাভাবিক সময়ে হানিফের প্রায় ৬০টি করে বাস চলে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চলাচল করা এস আলম পরিবহনের ফকিরেরপুল কাউন্টারের মো. মানিক জানান, ২৫ তারিখের পরের কোনো টিকিট নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এই পথে ৩৫-৪০টি বাস চলে। ঈদের সময় চার-পাঁচটি অতিরিক্ত বাস নামানো হয়। কিন্তু এবার অতিরিক্ত বাস নামানো হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কল্যাণপুরে কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গে চলাচলকারী বাসের টিকিট কাউন্টারগুলোর কর্মীরা দাবি করেন, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এশিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপক আবদুর রব জানান, দিনে সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে ২০টি পথে প্রায় এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০ বাস ছেড়ে যেত। এক সপ্তাহ ধরে বাসের সংখ্যা এক হাজারে নেমে এসেছে। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীর চাপ বাড়তে শুরু করলেও বাসের সংখ্যা বাড়ছে না।
সায়েদাবাদ টার্মিনাল বাস মালিক সমিতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা অগ্রিম টিকিট বিক্রি করবে না। কয়েকটি কোম্পানি ২১ আগস্ট থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রির কথা জানিয়েছে। অনেকে গতকাল থেকেই অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে।
অগ্রিম টিকিটের জন্য যাত্রীদের এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। কিন্তু তাদের অনেককেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
সায়েদাবাদে শ্যামলী পরিবহন কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেল, কাউন্টারের ব্যবস্থাপক হেলালউদ্দিন যাত্রীদের অগ্রিম টিকিট নেই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলা শুরু করলে যাত্রীদের কাছে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেন তিনি। তিনি জানান, দিনে বাস ছাড়া যাচ্ছে না। রাতে অল্প কিছু বাস চলায় টিকিট কম।
বাসমালিক ও শ্রমিকেরা জানান, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রাবাড়ী অতিক্রম করতে দুই থেকে চার ঘণ্টা লাগছে। চট্টগ্রাম রুটের বাসগুলোকে কুমিল্লার গৌরীপুর থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পর্যন্ত ভাঙাচোরা রাস্তা অতিক্রম করতে লেগে যায় আরও তিন থেকে চার ঘণ্টা। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে যেতে আগে সময় লাগত ছয় ঘণ্টা, এখন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, এই টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রায় আড়াই হাজার বাসে দৈনিক প্রায় আট হাজার চালক ও শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি ট্রিপে চালক, সুপারভাইজার ও হেলপার মিলে দূরত্ব বুঝে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পান। বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং যানজটের কারণে তাঁরা আগের মতো ট্রিপ পাচ্ছেন না। অর্ধেক শ্রমিক-চালকের কাজ নেই।
কালোবাজারি: কাউন্টার থেকে টিকিট শেষ বলা হলেও গাবতলী ও শ্যামলীতে কালোবাজারে বেশি দামে বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট বিক্রি হতে দেখা গেছে। গাবতলীতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা রাজশাহীর পাঁচটি টিকিটের খোঁজ করছিলেন সুরুজ মিয়া। দালাল নুরুদ্দিন টিকিটপ্রতি ১৫০ টাকা বেশি চান। দর-কষাকষির একপর্যায়ে টিকিটপ্রতি ১০০ টাকা বেশি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত টিকিটগুলো কেনেন তিনি। রংপুর-ভূরুঙ্গামারী পথের বাসের কাউন্টারে কোনো টিকিট নেই। কিন্তু কাউন্টারের সামনে থাকা আবদুস সালামের কাছে ছিল অনেক টিকিট। এই প্রতিবেদক ক্রেতা সেজে দাম জানতে চাইলে টিকিটপ্রতি ৮০ টাকা বাড়তি চান।
শ্যামলীতে হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে জানা গেল, কুষ্টিয়ার কোনো টিকিট নেই। ওই কাউন্টারের ২০-৩০ গজ দূরে একটি চায়ের দোকানে বেশ ভিড় দেখে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২৮ ও ২৯ আগস্টের টিকিট রয়েছে। তবে ৩০০ টাকার টিকিট ৬০০ টাকা। ওই দামেই টিকিট কিনে লটারি জয়ের মতো খুশি হলেন হাসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে কী হবে, টিকিট তো পেলাম। বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে রান্না খেতে পারব, এর চেয়ে বেশি আর কী চাই।’
মহাখালীতে ভিন্ন চিত্র: মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। যাত্রী প্রায় নেই। কাউন্টারের কর্মীরা কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউ খবরের কাগজ পড়ছেন। যাত্রী নেই কেন—জানতে চাইলে ঢাকা-টাঙ্গাইল পথে চলাচল করা গোপালপুর পরিবহনের কাউন্টারের জহির জানান, একে তো রাস্তা খারাপ, তার ওপর কয়েক দিনের সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যাত্রীরাও আসেন না। যোগাযোগমন্ত্রীর ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, ‘তাঁর কারণে ঈদের বাজারে যাত্রী নাই। আমাগো দিন কাটব কেমনে?’
কমেছে বাসের সংখ্যা: রাজধানী থেকে বরিশাল-বাগেরহাট মহাসড়কের প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা ভাঙাচোরা থাকায় এই পথে বাস চলাচলও কমে গেছে। ফলে এই পথের বাসের টিকিটও কমে গেছে। তাই কাউন্টারে এসে অনেকে টিকিট পাচ্ছেন না। কিশোরগঞ্জ পথের অবস্থাও একই রকম। বরিশাল ও বাগেরহাট পথে স্বাভাবিক সময়ে ১৫০টি ও কিশোরগঞ্জ পথে ২০০টি বাস চলত। এই দুই পথে বাসের সংখ্যা ৫০ থেকে ৭০টি কমে গেছে।
ট্রেনে চাপ বেড়েছে: মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে কয়েক দিন ধরে ট্রেনে যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে এই চাপ আরও বাড়বে। গতকালও কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, কাউন্টারের সামনে টিকিটের জন্য আসা মানুষের লম্বা সারি। কেউ কেউ সারিতে আছেন দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু কাউন্টারে পৌঁছে শুনলেন, তাঁর গন্তব্যের টিকিট নেই। স্বাভাবিক সময়ে যাত্রার জন্য টিকিট না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেককে। রোববার থেকে ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলে টিকিটের জন্য হাহাকার আরও বাড়বে বলে জানালেন যাত্রীরা।
কাউন্টার থেকে ‘টিকিট নেই’ বলা হলেও গতকাল কয়েকজন দালালের হাতে টিকিট দেখা গেছে। টিকিটপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশিতে তারা টিকিট বিক্রি করছে। মেরাদিয়া থেকে আসা পোশাককর্মী খলিল টাঙ্গাইলে যাবেন। তিনি জানান, তাঁর মা অসুস্থ। বাড়ি থেকে খবর এসেছে। তাই দালালের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ৮০ টাকা দিয়ে শনিবারের একতার একটি টিকিট কিনেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহসিন জানান, কাউন্টার থেকে ব্রহ্মপুত্রের টিকিট পাননি। কিন্তু দালাল ১০০ টাকা বেশি নিয়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য স্টেশনমাস্টার কামরুজ্জামানকে পাওয়া যায়নি। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তাঁর দেখা মেলেনি।
কবে কোন দিনের টিকিট বিক্রি হবে: রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে রোববার থেকে। সেদিন বিক্রি হবে ২৬ আগস্টের টিকিট। ২২ তারিখ বিক্রি হবে ২৭ আগস্টের টিকিট। ২৩ তারিখ বিক্রি হবে ২৮ আগস্টের টিকিট। ২৪ তারিখ বিক্রি হবে ২৯ আগস্টের টিকিট। ২৫ তারিখ বিক্রি হবে ৩০ আগস্টের টিকিট। একসঙ্গে চারটির বেশি টিকিট কেনা যাবে না।

ভারত দুর্নীতিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেঃ হাজারে

য়াদিল্লির রামলীলা ময়দানে বানানো মঞ্চের পেছনে টাঙানো ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের নায়ক মহাত্মা গান্ধীর বিশাল এক ছবি। মঞ্চে এসে বসলেন সমাজকর্মী আন্না হাজারে। সমবেত জনতা স্লোগান তুলল, ‘ভারত মাতা কী জয়’, ‘ভারত মাতা কী জয়’। আন্না হাজারে ঘোষণা দিলেন, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হলো।’ এর পরই নামে প্রবল বৃষ্টি।
দুর্নীতি প্রতিরোধে শক্তিশালী লোকপালের দাবিতে রামলীলা ময়দানে গতকাল শুক্রবার এভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে সমাজকর্মী আন্না হাজারের ১৫ দিনের অনশন।

এবারের অনশন কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হওয়া দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকে তিনি আখ্যায়িত করছেন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতাসংগ্রাম’ বলে। আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন গত মঙ্গলবার থেকেই। সেদিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনশনের সময়সীমা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে দর-কষাকষির পর সমঝোতা হলে মুক্তি দেওয়া হয় আন্নাকে।
রামলীলা ময়দানে কয়েক হাজার সমর্থকের উদ্দেশে ৭৪ বছর বয়সী আন্না বলেন, ‘গত কয়েক দিনে আমার ওজন তিন কেজি কমেছে। কিন্তু সেটা কিছু নয়, আপনারাই আমার শক্তি। রাজনৈতিক নেতাদের লুটপাট বন্ধ করতেই হবে।’ একটি শক্তিশালী লোকপাল পদ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত রামলীলা ময়দান থেকে নড়বেন না বলে ঘোষণা দেন আন্না হাজারে। অনশনের চার দিন চললেও গতকাল তাঁকে মোটামুটি সুস্থই দেখা গেছে।
গত মঙ্গলবার থেকে জেপি পার্কে আন্না হাজারের অনশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমস্যার কথা বলে এক দিন আগে অনশনের অনুমতি বাতিল করে পুলিশ। এর পরও মঙ্গলবার অনশন করতে গেলে সহস্রাধিক সমর্থকসহ আন্নাকে আটক করা হয়। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় তিহার কারাগারে। রাতে ছেড়ে দেওয়া হলেও তিনি দাবি তোলেন, অনশনের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত কারাগার ছাড়বেন না। গত বৃহস্পতিবার আন্নার সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়। রামলীলা ময়দানে তাঁকে ১৫ দিন অনশনের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ।
গতকাল সকালেই তিহার কারাগার থেকে বের হন আন্না হাজারে। এ সময় দেশের পতাকা আন্দোলিত করে তাঁকে স্বাগত জানান হাজার হাজার সমর্থক। তাঁদের উদ্দেশে আন্না হাজারে বলেন, ‘গত ৬৪ বছরেও আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাইনি। ১৬ আগস্ট থেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়েছে। বিপ্লব শুরু হয়েছে। আমি বেঁচে থাকি আর না থাকি, আন্দোলনের এ অগ্নিশিখা নিভতে দেবেন না। ভারত দুর্নীতিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ আগুন জ্বলবে।’
এরপর রামলীলা ময়দানের উদ্দেশে একটি খোলা ট্রাকে উঠে পড়েন আন্না। তাঁর সঙ্গ নেন দুই-তিন হাজার সমর্থক। তবে রামলীলা ময়দানে যাওয়ার আগে দুই জায়গায় থামেন তিনি। দুর্নীতি প্রতিরোধে লোকপাল নিয়োগের জন্য বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন সেনাবাহিনীর সাবেক ড্রাইভার সমাজসেবক আন্না হাজারে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া।

আন্না হাজারের আন্দোলন নিয়ে বিভক্ত ভারতের সুশীল সমাজ

দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী লোকপাল গঠনের দাবিতে আন্দোলন করছেন ভারতের প্রখ্যাত সমাজকর্মী আন্না হাজারে। এই আন্দোলনের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকলেও সুশীল সমাজ এ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী স্বামী অগ্নিবেশ বলেছেন, আন্না হাজারের আন্দোলনের পেছনে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আছে। আর অন্যদিকে আরেক সমাজকর্মী ও নিবন্ধকার শবনম হাশমি মনে করেন, হাজারে কট্টরপন্থা অবলম্বন করছেন এবং ডানপন্থী গ্রুপগুলো তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে।
গত কয়েক মাসে দেখা গেছে, লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এতে করে আন্দোলন জোরদার হয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত জুনে মৃত্যুর এক মাস আগেও শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন কার্টুন এঁকে আন্না হাজারের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। ফিদা হুসেন বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী এই আন্দোলনকারী আরেকটি নতুন বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভারত থেকে দুর্নীতি নির্মূলের দায়িত্ব নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। এটা দেখে আমি রোমাঞ্চিত এবং আমি তাদের সাফল্য কামনা করি।’
জনপ্রিয় কল্পকাহিনী লেখক চেতন ভগতও হাজারের আন্দোলনের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিবাদ এড়িয়ে চলা একটি রসিকতা ছাড়া কিছু নয়। আমি তাঁর (হাজারে) পক্ষে কথা বলে যাব।’
হাজারের বিপক্ষে সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন ওডিশা রাজ্যের বিখ্যাত বালু ভাস্কর সুদর্শন পট্টনায়েক। গত সোমবার তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে ফেলেছে এবং আমাদের তা ছিন্ন করতেই হবে।’ পুরিতে ভারতের জাতীয় তিন রঙের জমিনে হাজারের মুখমণ্ডলের একটি বালুর ভাস্কর্য তিনি হাজারেকে উৎসর্গ করেন।
তবে হাজারের বিপক্ষেও কথা বলছেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী। প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ‘দুর্নীতির জন্য যে ব্যবস্থা দায়ী তা পরিবর্তনে হাজারের এই আন্দোলনে কোনো সুনির্দিষ্ট আহ্বান নেই। আমার মতে, দুর্নীতি বন্ধের জন্য প্রথমেই সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ বেসরকারীকরণ বন্ধ করতে হবে। এটা হলে দুর্নীতি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। আর তখন লোকপালও কার্যকর হবে।’
প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই একসময় আন্না হাজারের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু হাজারে পল্লি উন্নয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করায় সারাভাই তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন।
হাজারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে শুধু সারাভাই নন, অন্য বুদ্ধিজীবীদেরও সংশয় রয়েছে। শিল্পী-সমাজকর্মী রাম রহমানের মতে, ‘হাজারের আন্দোলন আসলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উদ্যোগ। দুর্নীতি একটি জটিল বিষয়। কিন্তু বিপ্লব ভিন্ন জিনিস। এসব নিয়ে মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই।’

Tuesday, August 16, 2011

সমকালীন অনুরণন by নন্দিনী মুখার্জি

বাংলা বছরের শুরুতে আমাদের লোকশিল্প নিয়ে বিবিধ আয়োজনের সমাগমে সারা দেশ যেন হয়ে ওঠে লোকজ শিল্পের হাট। ঢাকায় দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল ভিন্নধর্মী। একটি সরাচিত্র এবং অপরটি শখের হাঁড়ি নিয়ে। এমন আয়োজন নাগরিক জীবনে এক ব্যতিক্রমী ভাবনাকে সজাগ করে তুলেছে।
ঢাকা আর্ট সেন্টার, ধানমন্ডিতে শেষ হলো শিল্পী সুকুমার পালের ‘ফিরে চল মাটির টানে’ শিরোনামে সরাচিত্র প্রদর্শনী। বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস ছিল এখানে। শুধু প্রদর্শনী নয়, এর পাশাপাশি একটি কর্মশালার আয়োজনও করা হয়েছিল। তরুণ শিল্পীদের অংশগ্রহণে শিল্পী সুকুমার পাল এই কর্মশালায় সরাচিত্র অঙ্কন ও সমকালীন চিত্রকলার সঙ্গে আমাদের লোকশিল্পের যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, দেশজ শিল্পের শক্তি অনুভব না করলে কাজে যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ দেশে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু সরাচিত্র চোখে পড়লেও ঐতিহ্যবাহী সরাচিত্র এখন বিলুপ্তির পথে। তিনি মূলধারার শিল্পকলার সঙ্গে একাত্ম না হয়ে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী অথচ অবহেলিত শিল্প নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন। ‘বিস্তৃত মুখ ঈষৎ গভীর মৃৎপাত্র’কে বাঙালিরা সরা বলে। সাধারণত হাঁড়ি বা কলসি ঢাকার পাত্র হিসেবেই ব্যবহূত হয় সরা। আকৃতি ও ব্যবহারের ভিন্নতায় সরার নানা নামকরণ দেখা যায়; ঢাকনাসরা, এয়োসরা, ফুলসরা, ধূপসরা, আমসরা, লক্ষ্মীসরা প্রভৃতি। সরা বিভিন্ন ধর্মীয় ও পালা-পার্বণে ব্যবহূত হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের বিয়ে এবং মুসলমানদের গাজি বা মহররমের ছবি সরাতে অঙ্কিত হয়।
শিল্পী সুকুমার পাল ঐতিহ্যবাহী সরাচিত্র থেকে রং-রেখা ছাড়াও গোলাকৃতির পটভূমিকেও গ্রহণ করেছেন। তিনি চারুকলা অনুষদ থেকে লেখাপড়া শেষ করে সংস্কৃতির এই শিকড়ে ফিরে গেছেন।
গ্যালারি জলরঙ—এটি একটি অনলাইন গ্যালারি হিসেবে পরিচিত ছিল এত দিন। এখন বনানীতে ছোট পরিসরে অন্যান্য গ্যালারির মতো শুরু হয়েছে তাদের নতুন যাত্রা। সম্প্রতি এই গ্যালারিতে শুরু হয়েছে লোকশিল্পী সুশান্ত পালের একক চিত্র প্রদর্শনী।
সুশান্ত পাল শৈশব থেকেই শখের হাঁড়ির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেন। তাঁর রয়েছে বংশানুক্রমিক দক্ষতা। স্বভাবতই ঐতিহ্যবাহী নকশা ব্যবহার করেন সুশান্ত পাল। শখের হাঁড়ির পাশাপাশি ২০০৯ সাল থেকে তিনি কাগজে পেইন্টিং শুরু করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান জীবনধারায় মাটির পাত্রের ব্যবহার সীমিত। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ক্যানভাস বা কাগজে সুশান্ত পাল আঁকতে শুরু করেছেন। তবে লক্ষ করলে দেখা যায়, রং, রেখা, বিন্যাস, নকশার প্রবণতা মাটির পাত্রের মতোই। এমনকি প্যানেলও শখের হাঁড়ির মতো। তাই বলা যায়, হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির রং, রেখা, নকশার এ এক নতুন পদ্ধতি। তাঁর আঁকা সব পেইন্টিংই ট্র্যাডিশনাল মোটিফের পুনরাবৃত্তি নয়। তাঁর কিছু কিছু পেইন্টিং ট্র্যাডিশনাল পেইন্টিং থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। শুধু তা-ই নয়, তাঁর চিত্রমালা পটুয়া, মালাকার বা আচার্যদের মতো নয়। বাংলাদেশের ভিজুয়াল আর্টে এ এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। সুশান্ত পালের চিত্রকলাকে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বা রূপান্তর-প্রক্রিয়া বলা যায়। এই প্রদর্শনী আমাদের শিল্প-ঐতিহ্যে স্থান করে নিতে পারবে বলে আশাবাদী হওয়া যায়। ২২ এপ্রিল প্রদর্শনী শেষ হবে।

চারুকলা- রূপকথার দেশে by শাশ্বতী মজুমদার

শিশু ও কিশোরদের জীবনের একটি বড় অংশ হলো তার কল্পনার জগৎ। সেখানে মায়ের বকুনি নেই, শিক্ষকের হোমওয়ার্ক নেই। কল্পনার জগতে কখনো তারা আকাশে মেঘের সঙ্গে খেলা করে আবার পানিতে জলকন্যার সঙ্গে গপ্প জুড়ে দেয়। তাদের এই কল্পনার জগৎ আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে যখন তাদের রঙিন ছবি থাকে বইয়ের পাতায়।
বাচ্চাদের ছবিওয়ালা এই ছড়া বা গল্পের বইগুলো হলো দৃশ্যগত এবং টেক্সচুয়াল বয়ান। বাচ্চাদের কল্পনার জগৎকে এই বইগুলো ধারণ করে এবং তাদের সাহিত্যের স্বাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। জার্মানিতে বাচ্চাদের এই বুক ইলাস্ট্রেশন ব্যাপক জনপ্রিয়। সম্প্রতি জার্মানির বিখ্যাত ইলাস্ট্রেটর য়ুলিয়া কার্গেল ঢাকায় এসেছেন। তিনি বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে বুক ইলাস্ট্রেশনের ওপর একটি কর্মশালার আয়োজন করেছেন।
বাচ্চাদের বুক ইলাস্ট্রেশন খুব সহজ নয়। ছবিগুলো সাধারণত গল্প বা ছড়া অনুযায়ী আঁকতে হয়। শিশুদের জন্য ছবিগুলোকে অবশ্যই হতে হবে সরল, সহজবোধ্য—সেই সঙ্গে তাদের মনোযোগ ধরে রাখার মতো আকর্ষণীয়। য়ুলিয়া কার্গেল তাঁর কর্মশালায় সমকালীন বুক ইলাস্ট্রেশনের ধারা ও নতুনত্বের দিকে গুরুত্ব দেন। শিল্পীরা একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা গল্পকে ভিত্তি করে ছবি আঁকেন। এই কর্মশালা আট দিন চলে। পরে ১৩ এপ্রিল এই শিল্পকর্মগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় জার্মান কালচারাল সেন্টারে।
প্রদর্শনীর নাম রাখা হয়েছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ফোর কালারস’। শিল্পীরা তাঁদের বিষয় অনুসারে ছবির মাধ্যমে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য শিল্পীরা এক বা একাধিক ছবি এঁকেছেন। ছবিগুলোতে ঘটনা অনুসারে ১, ২ ও ৩ করে নম্বর দিয়ে সাজানো। তাই ছবিগুলো দেখলেই গল্পগুলো আন্দাজ করা যায়। যেমন, ‘মমস ড্রিম’ ছবিটি শিল্পী সৈয়দা তাহলিমা হকের। ছবিতে ছোট্ট মম ও তার পুষি সকালে ঘুম থেকে উঠতে চায় না, কিন্তু মায়ের ডাকে উঠতে হয়। ঢুলুঢুলু চোখে তারা বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করে। একসময় তারা বাবল তৈরি করে। এরপর এক প্রজাতির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মম ও তার পুষি বিড়াল এসে পৌঁছায় আজব বাগানে। মম আবিষ্কার করে, তারও প্রজাপতির মতো ডানা আছে, সে উড়তে থাকে। মেঘেদের সঙ্গে খেলা করে, সূর্যও তাদের দেখে হাসে। ছাদের ওপর মমর বন্ধুরা তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকে ডাকে। এবার মম তার বাড়িতে ফিরতে চায়। এ সময় মমর ঘুম ভেঙে যায়।
শিল্পী আবদুল্লাহ আল বসিরের ‘চিলড্রেনস ডে আউট’ ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চারা ঘরে বসে ছবি আঁকছে। একসময় তাদের আঁকা পশু-পাখিগুলো ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে আসছে, তাদের সঙ্গে খেলা করছে।
শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষ এঁকেছেন ‘ওয়ানস আপন এ টাইম দেয়ার ওয়াজ এ হেন’। রঙের ব্যবহার ও শক্তিশালী ড্রইংয়ের মাধ্যমে তিনি মুরগির গল্প উপস্থাপন করেছেন।
‘কোয়াক ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ: ব্যাঙের ডাক’ ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী এলিজাবেথ এ ফাহরি মনসুর। শিল্পী ছবিতে কাগজ কেটে কেটে বিভিন্ন পশু-পাখির ফর্ম তৈরি করে ক্যানভাসে কম্পোজ করেছেন।

ছায়ানৃত্য by দ্রাবিড় সৈকত

চিত্রশিল্পের ভাষা বৈশ্বিক হওয়ার পরও থাকে কিছু স্থানীয় বৈশিষ্ট্য, সমসাময়িকতার গন্ধ ও শিল্পীমানসের ব্যক্তিক অনুভূতি। শিল্পী সিলভিয়া নাজনীনের চলমান একক প্রদর্শনী এমনই এক আয়োজন; ধানমন্ডির ক্যাফে ম্যাংগোতে চলছে।

প্রথাগত গ্যালারিতে ছবি দেখা দর্শক প্রথমে কিছুটা হোঁচট খেতে পারেন; পেইন্টিং দেখতে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে, ছবিটির ঠিক নিচে দুজন কফি খাচ্ছেন কিংবা একান্ত আলাপচারিতায় মগ্ন। গ্যালারিতে চিত্রপ্রদর্শনী দেখা থেকে একটু আলাদা প্রস্তুতি নিতে হবে এই প্রদর্শনীতে। ‘ছায়া নৃত্য’ শিরোনামে শিল্পী সিলভিয়া নাজনীনের এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়েছে বিবিধ বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ের পঁচিশটি শিল্পকর্ম। বিষয়বস্তু, বিন্যাস, রং ও উপস্থাপনের ভিন্নতায় এই প্রদর্শনী তারুণ্যের গতিময়তায় উচ্চকিত। ‘ড্যান্সিং উইথ শ্যাডো’ শিরোনামের একটি শিল্পকর্মে দেখা যায় বর্তমান নারীর একাকিত্ব ও মগ্নতার পশ্চাৎপটে একটি বিশাল কাকের অশুভ প্রতিকৃতি। মিশ্র মাধ্যমে সম্পন্ন করা এই শিল্পকর্মটি বর্তমান নারীসমাজের প্রতিকূল বাস্তবতার প্রতীকী উপস্থাপন। এ ছাড়া ‘আই হ্যাড ড্রিম’, ‘ম্যালাঙ্কলি মিউজিক’, ‘মুড’ শিরোনামের পেইন্টিংগুলো দর্শকমানসে ছড়িয়ে দেয় এক অদ্ভুত বিষণ্নতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যেন এক ভিনদেশি পাখি। কখনো তার সৌন্দর্যের বন্দনা, কখনো বৃক্ষ হয়ে যাওয়া, কখনো বা নৌকা হয়ে জল ছেড়ে কল্পিত ডানায় অন্তরিক্ষে উড়ে যাওয়ার চিত্রকল্পে রুক্ষ বাস্তবতাই প্রতিধ্বনিত হয় সিলভিয়ার অধিকাংশ শিল্পকর্মে। সৌন্দর্য উপাসনার ছন্দায়িত রং-রেখায় সময়ের কর্কশ আঁচড় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই সমাজ পুরোপুরি মানবিক নয়, এখানে বৈষম্যের খড়্গ ধারালো হয় প্রতিনিয়ত, সমাজের সুবিধাভোগী অংশ যা মানতে প্রস্তুত নয়।

বইপত্র- রোকেয়ার আলো by সুদীপ্ত শাহীন

প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশের নারী ও রোকেয়ার দর্শন—সম্পাদনা করেছেন নাজমা চৌধুরী \ ২০১০ \
পাঠক সমাবেশ \ পৃষ্ঠা ৮৭ \ ২৯৫ টাকা
উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। পাশাপাশি মহীয়সী একজন নারী, একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও নন্দিত। সংগঠক, সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। নারীমুক্তির পথিকৃৎ ও নারীবাদের প্রবক্তা হিসেবেও তাঁর অবদান চিহ্নিত।

এ রকম বহুবিধ অভিধায় তিনি সম্মানিত। তাঁর সকল কর্ম ও সৃষ্টির বহুধা হলেও সবকিছুর মূলে রয়েছে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমতা নিশ্চিত করা। এ কারণে তাঁর যাপিত জীবন, কর্ম ও সৃষ্টির আলোকে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা বর্তমানের বিদ্যোৎসাহী, আলোকপিয়াসী, মুক্তমনা নারীরা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা। নতুন শতাব্দীতে নারীর জন্য এই প্রাপ্তি মহার্ঘ্য এক সম্পদতুল্য, যার শুরুটা হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে। ২০০০ সালে উইমেন্স স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬-এ পরিবর্তিত নাম দাঁড়ায় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, যারা প্রতিবছর আয়োজন করে রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালার। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে উপস্থাপিত বক্তৃতার সংকলন বই প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশের নারী ও রোকেয়ার দর্শন। সম্পাদনা করেছেন নাজমা চৌধুরী। লেখকেরা হলেন মাহমুদা ইসলাম, মালেকা বেগম, হাসনা বেগম ও সুলতানা কামাল। উপর্যুক্ত লেখকক্রম অনুযায়ী বিষয়গুলো হলো—রোল অব ওমেন ইন পলিটিক্স অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন, রোকেয়ার নারী ও ধর্মভাবনা: জাতীয় নারীনীতি, রোকেয়ার দৃষ্টিতে পারিবারিক আইন ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিত। এ ছাড়া রয়েছে লেখক পরিচিতি এবং সম্পাদকের লেখা ভূমিকা—রোকেয়ার দর্শন: রাজনীতিতে নারী, নারী আন্দোলনের স্বরূপ ও ধর্মের রাজনীতি।
বক্তৃতার শিরোনাম দেখে সহজেই অনুমিত হয় বিষয়বিন্যাসের স্বরূপ, যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লড়াই-সংগ্রামের সারকথা। মানুষের সারস্বত জীবনের মৌল প্রসঙ্গগুলোই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। রাজনীতি, নারী আন্দোলন, ধর্মভাবনা, নারীনীতি, পারিবারিক আইনের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শিরোনামে রেখে তার ভেতরেও দৃষ্টি প্রোথিত করা হয়েছে, যাতে শুধু তথ্য সন্নিবেশন নয়, গভীর পর্যবেক্ষণ, তীক্ষ বিশ্লেষণ, নিরপেক্ষ মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে অতীতের প্রতি যেমন দৃষ্টিপাত করা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎ রূপরেখা ও প্রত্যাশার কথাও ব্যক্ত হয়েছে। ভূমিকাংশেও এমনটিই বলা হয়েছে: রোকেয়ার অবদান এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে বর্তমানে নারীসমাজের অবস্থান বিশ্লেষণ রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালার পরিধির বিস্তার ঘটবে। বর্তমান সংকলনে অন্তর্ভুক্ত বক্তৃতামালা এভাবেই বাংলাদেশে নারীর সমস্যাসংকুল অবস্থানের কয়েকটি দিক তুলে ধরেছে। রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালা রোকেয়া স্মরণে নিবেদিত হলেও এর একটি বৃহৎ প্রায়োগিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে, যা বিভাগের রোকেয়াচর্চাকে গুরুত্ববহ ও সম্ভাবনাময় করেছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সমুন্নত করার প্রশ্নে রোকেয়া চর্চার কোনো বিকল্প নেই। যে অবস্থায়, যে পরিধিতে এ রকম কর্ম সম্পাদন হোক না কেন, তার জন্য সাধুবাদ জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে যখন এ রকম কর্ম সম্পাদন হয়, তখন সেটি আমাদের সবাইকে আশান্বিত করে। নতুন সম্ভাবনায় বুক বাঁধতে শেখায়। এ রকম আয়োজন এবং শেষাবধি তার গ্রন্থভুক্তকরণ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কেননা, রোকেয়াচর্চার মধ্য দিয়েই যাওয়া যাবে আলোকপানে, যার জন্য প্রয়োজনে আলোকের এই স্রোতধারাকে বেগবান করা। লেখক-সম্পাদকের যৌথ প্রয়াসে আলোচ্য বই শত ফুল ফোটার সুযোগ করেছে। এখন মঞ্জুরিত হওয়ার পালা। যা হলে রোকেয়ার ঋণ শোধরানোর কিঞ্চিৎ সুযোগ মিলবে আর শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো সম্ভব হবে সম্পাদক-লেখককে। সেই প্রত্যয় ও প্রতীতিতে জয়তু জানাই রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালাসংশ্লিষ্ট সবাইকে।

সাদা ফুল সাদা আগুন by ওমর আলী

প্রভুর বাগানে সারা রাত সাদা ফুল ফুটে থাকে
জ্যোৎস্নায় ধবল কিরণ দেয় মিটিমিটি কিংবা নিজেরাই আলোকিত
দু-একটা সাদা ফুল পৃথিবীতে ছিটকে পড়ে
উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে সাদা চুন

সেনা চেরিব হামুরাব্বি তুতান খামেন কিংবা তারও আগে থেকে
পিরামিডগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে
তাদের গায়ে সঞ্চরমান সাদা ফুল
স্যাফোর কবিতার মতো জীবন্ত সাদা আগুন যেন
ইউসুফ জুলেখার কিংবা রাধা কৃষ্ণের কিংবা
রোমিও জুলিয়েটের উদগ্র প্রেমের মতো
চণ্ডীদাস ও রজকিনী রামতারা ওরফে রামীর প্রেম
নিকষিত হেম
প্রভুর বাগানে সারা রাত সাদা ফুল ফুটে থাকে
কিছু সাদা ফুল মর্ত্যে ছিটকে পড়ে
ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত ফসফরাসের আলোতে
আলোকিত হয় যেমন সমুদ্রে রাতে কতকগুলো মাছের আলো থাকে
কী সুন্দর সাদা আগুন উড়তে থাকে সারা রাত
সাদা মাছির মতো...

সাধারণের ভালোবাসায় সিক্ত দুই অনন্য প্রতিভা

মেঘ কেটে যাওয়া সকালের রোদে প্রকৃতি ছিল উষ্ণ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে গগনশিরীষ গাছগুলোর নিচে কালো ব্যানার টানানো মঞ্চের সামনে কফিনে শায়িত দুই বন্ধুর জোড়া লাশ। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। কফিন বন্ধ। নিমেষের আকস্মিকতায় প্রাণবন্ত মানুষ থেকে তাঁরা ক্ষতবিক্ষত শবদেহে পরিণত। সেই বেদনা ক্ষোভ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা অগণিত জনের কথায়। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, কবি, ছাত্র—সবাই বলেছেন, এ তো দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়, বলতে হয় রাজপথে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না।
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ যখন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের শববাহী গাড়ি শহীদ মিনারে আসে, এর আগে থেকেই মানুষে ভরে উঠেছিল চত্বর। নেপথ্যের করুণ সুর বিমর্ষতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল পরিবেশে। দল-মত, বয়স-ধর্মনির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এসেছিলেন অকালপ্রয়াত এই দুই বন্ধু, দেশের দুই প্রতিভাবান কৃতী সন্তানের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা নিবেদন করতে। প্রিয়জন হারানোর বেদনার সঙ্গে সমবেত মানুষের মনে তীব্র হয়ে উঠেছিল ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ নামের প্রতিকারহীন মৃত্যুর ক্ষোভ ও যন্ত্রণা।
আক্ষেপ করছিলেন সবাই, মাটির ময়না আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনেছিল। তারেক-মিশুক জুটির নতুন উদ্যোগ ছিল কাগজের ফুল। আগামী দিনে আরও নতুন নতুন কাজ হয়তো আরও বড় অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেত দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে। কিন্তু হায়, না ফুটতেই ঝরে গেল সেই ফুল!
শোকের মিছিল: ব্যানার নিয়ে, পুষ্পস্তবক সঙ্গে করে বা একাকী ফুলের গুচ্ছ নিয়ে মিছিলের মতো জনস্রোত নেমেছিল শহীদ মিনারে। উত্তর দিকের প্রবেশপথ থেকে যাত্রা করে পায়ে পায়ে তাঁরা শহীদ মিনারের মূল বেদির পাশ দিয়ে ঘুরে এগিয়ে আসছিলেন পুব পাশের প্রবেশপথের ধারে শোকমঞ্চের কাছে।
এর আগে সকালে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের শবদেহ আনা হয়েছিল এটিএন নিউজের কার্যালয়ে। সেখানে জানাজার পর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হয়।
এখানে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শোক জ্ঞাপন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাংসদ হাসানুল হক ইনু, আসাদুজ্জামান নূর, সারাহ বেগম কবরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমজীবী-পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠন এবং ব্যক্তিগতভাবে অগণিত মানুষ হূদয়ের নিখাদ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেন।
সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, গণফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, ছায়ানট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, গণসংগীত শিল্পী সমন্বয় পরিষদ, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, বাউল একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, এফডিসি, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, সমকাল, ভোরের কাগজ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল, টিএসসি, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতি, ’৭১-এর পরিবার, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় জাদুঘর, লোকশিল্প জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মুক্তির গানের শিল্পীবৃন্দ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী প্রগতি সংঘ, নিজেরা করি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, প্রশিকা, নায়েম, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, খেলাঘর আসর, প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ, যুব ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, স্বভূমি লেখক পরিষদ প্রভৃতি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে এই শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হয়েছিল। জোটের সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ সংগঠনগুলোর পরিচিতি এবং প্রয়াত জনের নানা তথ্য ও তাৎপর্য তুলে ধরেন। জোহরের নামাজের পর হয় জানাজা। কিন্তু এত লোকসমাগম হয়েছিল যে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এলেও অনেকেই দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছিলেন ফুল নিয়ে।
শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের দিকে শবযাত্রার আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর তাঁদের শিল্পপ্রয়াস চালিয়ে গেছেন। বহির্বিশ্বে আমাদের গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের যে নেতিবাচক পরিচিতি রয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের সৃজনশীলতার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন তারেক মাসুদ। জাতি তাঁদের কখনো ভুলবে না।’ এরপর সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করেন প্রয়াত দুই কৃতীর স্মরণে। শহীদ মিনার চত্বরে নেমে আসে এক প্রগাঢ় স্তব্ধতা।
শোক থেকে ক্ষোভ: সাংসদ হাসানুল হক ইনু বললেন, ‘সড়ক-মহাসড়কে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তাতে সরকার ও প্রশাসন যে আছে জনগণ তা টের পাচ্ছে না। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক বন্ধ হয়ে আছে। এক দিনে মহাসড়কে এমন ভয়াবহ অবনতি ঘটেনি। বোঝাই যায়, কোনো তদারকি নেই। গাড়ির চালকদের কীভাবে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, কেন এত দুর্ঘটনা ঘটছে—কোনো বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। এসব মৃত্যু হত্যাকাণ্ডেরই শামিল। দেশবাসী আর কোনো অজুহাত শুনতে চায় না। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আজ, এই মুহূর্ত থেকেই কাজ দেখতে চায় জনগণ। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ নিতে হবে। ব্যর্থ হলে এর দায়িত্ব কেউ এড়াতে পারবেন না।’
একই রকম প্রতিক্রিয়া ছিল প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর। বললেন, ‘যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। যাঁদের উদাসীনতায় রোজ অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও প্রতিভাবান প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, তাঁরা কী করে পদ আঁকড়ে থাকেন? কী দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা?’
প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এ ধরনের অপমৃত্যুকে আমি হত্যাকাণ্ড হিসেবেই গণ্য করি। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী আমাদের রাষ্ট্র। রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কাজেই এমন দুর্ঘটনায় আরও কত প্রাণ ঝরে যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই।’ তিনি বলেন, সরকার যদি এই মৃত্যু থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে জাতিকে আরও চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘দুর্ঘটনা তো ঘটছেই। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেও সরকারের টনক নড়ে না। সড়ক অচল মানে দেশ অচল। কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয়। যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত তাঁর অকর্মণ্য কর্মকর্তাদের সচেতন করার লক্ষ্যে। আমার মনে হয়, যোগাযোগমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা।’
প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, ‘জাতীয় সংকটের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন সড়কপথের বিশৃঙ্খলা। এই দুই তরুণ প্রতিভার কাছে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। কিন্তু তাঁরা অকালে চলে গেলেন এই বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে।’
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বললেন, ‘মানুষকে তো চলাচল করতে হবে। কাজেই পথের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তারেক ও মিশুক বাংলা একাডেমীর হয়ে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। এ বছরই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই কাজ আর আমরা দেখতে পারব না। জাতির জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখের ঘটনা।’
এভাবেই দুঃখ ও ক্ষোভ, শোক আর আক্ষেপ মিলে মানুষের মনে এক অসহ্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠছিল এই দুই প্রতিভার অকালপ্রয়াণ।
জানাজা: শহীদ মিনার থেকে শববাহী গাড়ি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হয়।
তারপর আবার শবযাত্রা। শবানুগামী নানা বয়সী মানুষের ঢলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, মানুষের প্রতি যাঁরা আস্থা রাখেন, মানুষকে ভালোবেসে যাঁরা কাজ করে যান, তাঁদের প্রতিও ভালোবাসা জানানোর মানুষের অভাব হয় না কখনো।
দাফন: জানাজার পর মিশুক মুনীরের মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হিমাগারে রাখা হয়। তারেক মাসুদের মরদেহ নেওয়া হয় এফডিসিতে। সেখানে তাঁর জানাজা শেষে মরদেহ বিএসএমএমইউর হিমাগারে রাখা হয়।
মিশুক মুনীরের ছোট ভাই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার কর্মকর্তা আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে জানান, সিয়েরালিয়নে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তা তাঁদের বড় ভাই আহমেদ মুনীর (ভাষণ মুনীর) মঙ্গলবার দেশে ফিরবেন। সেদিনই বাদ জোহর বনানী গোরস্থানে মিশুক মুনীরকে দাফন করা হবে।
তারেক মাসুদকে কোথায় দাফন করা হবে তা রোববার রাতেও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ফরিদপুর থেকে তারেকের মা এসেছেন। দাফনের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
দোয়া মাহফিল: তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল হবে মিশুক মুনীরের পরিবারের উদ্যোগে। কাল মঙ্গলবার বাদ আসর ১৩৯ রামকৃষ্ণ মিশন রোডের চিওরা হাউসে এই দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শোক: বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীরের অকালমৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, এই দুজন তাঁদের সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে যে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন, তা জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এই মৃত্যুতে দেশ দুই অমূল্য প্রতিভা হারালো।

সড়ক নিরাপত্তা উপেক্ষিত by আনোয়ার হোসেন

দেশে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল রয়েছে। আছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধবিষয়ক সেলও। এগুলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারও নির্বিকার।

সরকারি হিসাবে বছরে গড়ে তিন হাজারের বেশি লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ১২ থেকে ২০ হাজার। বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ভাঙাচোরা ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক এবং জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করছেন।
সারা দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ১৮ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়কের দশা বেহাল ও ত্রুটিপূর্ণ। তা ছাড়া পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে মন্ত্রীর সুপারিশে ও পরীক্ষা ছাড়াই। আর সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রমও চোখে পড়ে না।
সড়ক দুর্ঘটনাকে নরহত্যা হিসেবে গণ্য করে দায়ী চালকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার আইন করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে সরকার পরে আইন সংশোধন করে। এখন চালকের ভুলে দুর্ঘটনা হলে এক থেকে তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। আইনটি যুগোপযোগী করতে ২০০৭ সালে একটি কমিটি করেছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। কমিটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে। খসড়াটি চার বছর ধরে এ-টেবিল ও-টেবিল ঘুরছে, আইনে পরিণত হয়নি। ফলে একটি দুর্ঘটনার পর কয়েক দিন হইচই হলেও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
সরকারি হিসাবে ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এক যুগে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩৮ হাজার লোক। আহত হয়েছে ৩৫ হাজার। এ সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫০ হাজার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) মনে করে, পুলিশ দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে হিসাব দেয়, প্রকৃত সংখ্যা এর তিন গুণ। অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৭ সালের হিসাবে বলা হয়েছে, এ বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ হাজার ৩৪ জন মারা যায়। বাংলাদেশের প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় বলে ডব্লিউএইচও উল্লেখ করে।
যুক্তরাজ্য সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থার (ডিএফআইডি) ২০০৪ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়। তবে এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক মাজহারুল ইসলাম বলেন, এখন সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি।
নিষ্ক্রিয় কাউন্সিল: সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের তিন মাস পর পর বৈঠক করার কথা। কিন্তু এই সরকারের পৌনে তিন বছরে বৈঠক হয়েছে মাত্র তিনটি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই তিনটি বৈঠকের একটি করা হয়েছে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের অনুরোধে। গত ২৭ জুলাই বৈঠকটি হয়। এখানে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। উল্টো সাড়ে ২৪ হাজার পেশাদার চালককে পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দেওয়া এবং পরিবহন খাতে চাঁদা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়।
নৌমন্ত্রীর চাপে ২০০৯ সালে ১০ হাজার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষা ছাড়া। এবার তাঁর শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশন সাড়ে ২৪ হাজার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে।
সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি আছেন। একাধিক সদস্য জানান, সর্বশেষ বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ডাকাই হয়নি। কাউন্সিলের সদস্য ও নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে মানুষ মরছে, কিন্তু সরকারিভাবে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেও কোনো সমন্বয় নেই।’
একইভাবে সওজ ও বিআরটিএর একটি সেল আছে। বিআরটিএর সেলটি শুধু পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে একটি বই প্রকাশ ও চালকদের জন্য কয়েকটি সেমিনার করে। আর সওজের সেলটির কাজ কী, তা কেউ বলতে পারে না।
জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, ভাঙাচোরা সড়ক ও সড়কের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে সওজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও বসবেন তিনি। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, খুব শিগগির সবাইকে নিয়ে বৈঠক হবে। পরীক্ষা ছাড়া পেশাদার লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘একেবারে পরীক্ষা ছাড়া নয়। ন্যূনতম পরীক্ষা নিয়ে যারা যানবাহন চালাতে পারে, তাদের লাইসেন্স দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।’
দুর্ঘটনা হলেই সরকার একটু তৎপর হয়, তারপর ভুলে যায়, কেন? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এবার আমরা খুব সিরিয়াস। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতেই হবে।’
কাজ হয় না: যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বুয়েটের এআরআই গত বছর জুনে সারা দেশের ২১৬টি স্থানকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ (ব্ল্যাক স্পট) হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সওজের কাছে পাঠায়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু এক বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এআরআই সূত্র বলছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বছরে তিনবার বা তারও বেশি দুর্ঘটনা ঘটলে এটাকে ব্ল্যাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্ল্যাক স্পটগুলোতে সড়কের অস্বাভাবিক বাঁক থাকে, সড়কের পাশে হাটবাজার গড়ে ওঠে এবং সড়ক সংকেত থাকে না। শনিবার মানিকগঞ্জের যে স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ মারা গেছেন, সেটিও একটি ব্ল্যাক স্পট।
গতকাল দুর্ঘটনাস্থলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এআরআইয়ের পরিচালক ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে সড়ক সংকেত (ওভারটেক করা যাবে, যাবে না; গতিসীমা কত) নেই। অত্যধিক বাঁক ও সড়কের পাশের গাছপালাও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
এআরআই পরিচালক বলেন, সরকার কলেরা ও পোলিওকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে সফল হয়েছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা একটি মহামারি হলেও এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই। আগামী এক বছরে কী পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা কমবে, সে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কর্মসূচি ঠিক করে এগোতে হবে।
এআরআই পরিচালক বলেন, এবার দুর্ঘটনার হার বেশি এবং হতাহতের সংখ্যাও বেড়েছে। এর কারণ সম্পর্কে তিনি সড়কের দুরবস্থা, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, বেপরোয়া যান চলাচলের কথা উল্লেখ করেন।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, কোনো রকম অর্থ খরচ না করে শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি, চালকের প্রশিক্ষণ, মোটরযান আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। আর পরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন নিশ্চিত করা এবং এই খাতে গবেষণা-পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা একেবারে কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনোটাই হচ্ছে না।
ঢাকা-আরিচা মরণফাঁদ: আরিচা হয়ে ঢাকা-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের দূরত্ব ৫০৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-আরিচা অংশের দূরত্ব ৮৮ কিলোমিটার। এই ৮৮ কিলোমিটার পথে প্রতিবছর গড়ে ১৪৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। আরিচা পার হয়ে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত এত মানুষের প্রাণহানি হয় না বলে বিআরটিএ ও এআরআই সূত্র জানায়। ঢাকা-আরিচা পথে প্রতিবছর গড়ে ১৩১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই অংশটুকুতে ২২টি স্থান রয়েছে, যেখানে প্রতিবছরে গড়ে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে।
আরও ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক: সওজ ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের হিসাবে, সারা দেশে অন্তত ১০০ কিলোমিটার মহাসড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২১৬টি স্থান আছে (ব্ল্যাক স্পট), যেখানে বছরে অন্তত তিনটি করে দুর্ঘটনা ঘটে।
দেশে নয়টি জাতীয় মহাসড়ক আছে। দূরত্ব সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। এই মহাসড়কের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্ত, গজারিয়া, দাউদকান্দি, সোনারগাঁ ও মধ্যবাউশিয়া। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপারা বাসস্ট্যান্ড, জয়পাড়া বাসস্ট্যান্ড, পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ড, সাভার বাজার ও বাথুলী উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মধ্যে কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্তে ৬০০ মিটার জায়গার মধ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৪৯ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
দেশের সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিআরটিএ জানায়, ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে জাতীয় মহাসড়কে, ১২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১৫ শতাংশ শাখা সড়কে (ফিডার রোড)।
বাংলাদেশে দুর্ঘটনা বেশি: ২০০৯ সালে এআরআই এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ১৫টি দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, ১৫টি দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এ তালিকায় নেপাল প্রথম।

ঝুঁকিতে আরও দুই মহাসড়ক

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পাঁচ দিন ধরে যাত্রীবাহী বেসরকারি বাস চলছে না। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাস বন্ধ তিন দিন। ফরিদপুর-আলফাডাঙ্গা সড়কেও একই অবস্থা। এখন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের হাটিকুমরুল-বনপাড়া এবং বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর পথেও যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে ইটের খোয়া ও বালু দিয়ে সাময়িক মেরামতের চেষ্টা করছে। বৃষ্টি না হলে দু-এক দিনের মধ্যে জোড়াতালি দিয়ে যানবাহন চালানো যাবে বলে মনে করছে সওজ। তবে অন্য সড়কগুলোর কী হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
সওজের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করছি, যাতে আর বৃষ্টি না হয়। বৃষ্টি হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’
এরই মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যাতায়াতকারী প্রায় ১২টি জেলার বাস চলাচল বন্ধ আছে। গতকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) কয়েকটি বাস চালু করা হয়েছে। তবে সরকারি ছুটি থাকায় এর কোনো প্রভাব বোঝা যায়নি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিআরটিসির বাসে ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি ঢাকার যাত্রী ছাড়া অন্য কোনো গন্তব্যে যাত্রী তোলা হয়নি। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান এম এম ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে ৩০টি বাস চলেছে। কোনো সমস্যা হয়নি। অক্ষত ফিরে এসেছে বাসগুলো।’ বাড়তি ভাড়া ও মাঝপথে যাত্রী তোলার অভিযোগ নাকচ করে দেন তিনি।
মহাসড়ক মেরামত সম্পর্কে জানতে চাইলে গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলে রব্বে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এখনো অধিকাংশ স্থানে মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা দোকান-কারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি আছে। এর ওপর বালু ফেলা হচ্ছে। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। সাময়িক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এটা করা হচ্ছে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি গতকাল রাত আটটায় প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের অনেক স্থান এখনো বাস চলাচলের অনুপযোগী। তিনি জানান, আজ যোগাযোগমন্ত্রী মহাসড়ক পরিদর্শনে যাবেন। সীমিত আকারে হলেও বাস চালানো যায় কি না, আজ সিদ্ধান্ত হবে। তবে এক দিন বৃষ্টি হলেই সব শেষ হয়ে যাবে।
পথে পথে দুঃখ: ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের বনপাড়া-হাটিকুমরুল অংশে বড় গর্তে পড়ে গত রোববার একটি ট্রাক উল্টে যায়। এতে দিনভর ওই পথে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। জানা গেছে, মহাসড়কের এই অংশটুকু ৫২ কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত নয় কিলোমিটার এলাকায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভারী বৃষ্টি হলে যেকোনো সময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওই পথে কুষ্টিয়া, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ—এ পাঁচটি জেলার মানুষ যাতায়াত করে। বাসমালিক, চালক এবং সওজ সূত্র জানায়, ঈদে এই পথে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে এবং এর মধ্যে বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। মহাসড়কটি অচল হয়ে যেতে পারে।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কটির বেহাল দশা আট বছরেও কাটেনি। তৈরির কয়েক দিন পরই ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথটির বিভিন্ন অংশ দেবে যায়। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর কয়েক দফা সড়কটি মেরামত করা হয়। কিন্তু এখনো বড় বড় গর্তে ভরা এবং অনেক স্থান দেবে আছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে এর অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়েছে।
২০০৪ সালে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
গত রোববার সরেজমিনে সড়কের মান্নাননগর এলাকায় তিনটি ট্রাক, ৯ ও ১০ নম্বর সেতুর পাশে দুটি ট্রাক এবং খালকুলায় একটি ট্যাংকলরি নষ্ট হয়ে সড়কের গর্তের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি ট্রাক উল্টে পড়ে আছে।
এই মহাসড়কের খালকুলা বাজার, ৬ ও ৭ নম্বর ব্রিজের মধ্যখানের দুটি স্থানে, মহিষলুটি ও মান্নাননগর এলাকার পাঁচটি স্থানে ৫০ মিটার এলাকাজুড়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ৯ ও ১০ নম্বর সেতুর দুই পাশে ২০০ মিটার এলাকা চলাচলের অনুপযোগী।
সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল খালেক বলেন, ইট-বালু দিয়ে গর্ত ভরাট করার কাজ চলছে। বৃষ্টির জন্য কাজ এগোচ্ছে না।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুন নবী বলেন, গর্তের কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। দ্রুত মেরামতের জন্য ১০ আগস্ট সওজকে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা।
সওজের সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর-ই-আলম বলেন, স্থায়ী মেরামতের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বরাদ্দ ঠিকমতো না পাওয়ায় ঠিকাদার কাজে উ ৎ সাহী হননি।
ফরিদপুর থেকে আলফাডাঙ্গা: এই ৩৪ কিলোমিটার সড়কেও বড় বড় গর্ত। এই সড়কে শনিবার থেকে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সওজ সূত্র জানায়, পুরো সড়কে পিচের চিহ্ন নেই। হাঁটুসমান গর্তে প্রতিদিনই যানবাহন বিকল হয়ে যাচ্ছিল। এই পথে প্রতিদিন ১০০ বাস চলত।
বরিশাল-ভোলা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভোলা অংশের সাড়ে আট কিলোমিটারজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। রোববার ভোরে পূর্ব ইলিশার গুপ্তমুন্সী এলাকায় সড়কের বড় গর্তে মালবাহী ট্রাক আটকে গেলে আট ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। এই পথে এক হাজারের বেশি যান চলে। এ সড়কটি দিয়ে লক্ষ্মীপুর হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যানবাহন চলে।
গাজীপুর থেকেও বাস চলাচল বন্ধ: গাজীপুর থেকে রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন উপজেলায় গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে গতকাল থেকে। ফলে যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে গাদাগাদি করে যাতায়াত করছেন। এ ছাড়া হিউম্যান হলার, টেম্পো, লেগুনা, অটোরিকশায় করে স্বল্প দূরত্বে লোকজন চলাচল করছে। বাস বন্ধ হওয়ার সুযোগে এসব যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
গাজীপুরের শ্রমিক নেতা দেওয়ান ফিরোজ জানান, গাজীপুর থেকে বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাওয়া ঢাকা পরিবহন, গাজীপুর পরিবহন, কালিয়াকৈর পরিবহন, পলাশ পরিবহন, বলাকা পরিবহন ও নিরাপদ পরিবহন সোমবার থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। চালক বাবুল মিয়া জানান, ভাঙা ও খানাখন্দে ভরা সড়কে গাড়ি চালালে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। পানি ঢুকে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এ ছাড়া গাজীপুর থেকে যাওয়া-আসায় যেখানে আগে তিন ঘণ্টা সময় লাগত, এখন সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। আগে তেল লাগত সাড়ে চার হাজার টাকার। এখন লাগে ছয় হাজার টাকার। এ অবস্থায় গাড়ি চালানো সম্ভব নয়।

রাজধানীতে ৫০০ কিশোর চালক by হায়দার আলী

রাজধানীর ব্যস্ততম প্রতিটি সড়কেই গাড়ি চালাতে দেখা যাচ্ছে কিশোর চালকদের। এসব কিশোরের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তাদের বেশির ভাগেরই বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। কিশোর চালকদের কেউ কেউ বিআরটিএর লোকজনদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে ভুয়া লাইসেন্স তৈরি করে নিচ্ছে।

এসব লাইসেন্স দিয়ে তারা অনায়াসে গাড়ি চালাচ্ছে। কিছু কিশোর চালক বয়স বাড়িয়ে বিআরটিএ থেকে আসল লাইসেন্সও জোগাড় করে নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া লাইসেন্সধারীরা ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্টদের ম্যানেজ করে নিয়মিত গাড়ি চালাচ্ছে। এসব কিশোর চালক রাজধানীতে সাধারণত লেগুনা, টেম্পো, হিউম্যান হলার চালায়। এ ছাড়া কখনো কখনো পিকআপ ভ্যান, মিনিবাসসহ অন্যান্য যানবাহনও চালায় তারা। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই অপ্রাপ্তবয়স্করা গাড়ি চালাচ্ছে। মফস্বল এলাকায় নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাচ্ছে। এসব যানবাহন এবং চালক উভয়েরই নেই বৈধ লাইসেন্স। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে।
হেলপার থেকে চালক : লেগুনা গাড়ির চালক মনির। এখনো মুখে গোঁফের রেখা দেখা দেয়নি। চার মাস হতে চলেছে গাবতলী থেকে মহাখালী পর্যন্ত লেগুনা চালায়। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একাধিক ট্রিপ মারে। মনির কালের কণ্ঠকে বলে, 'তিন বছর গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করছি।
হেলপারি করতে করতে এখন নিজেই গাড়ি চালাই।' লাইসেন্স আছে কি না জানতে চাইলে মনির বলে, 'লাইসেন্স না থাকলে তো ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় গাড়ি চলতে দেবে না, তবে বয়স কম বলে আসল লাইসেন্স দিতে চায় না। কিছু টাকা দিয়া নকল লাইসেন্স বানাইতে হইছে।'
একই গাড়ির হেলপার আনিস (১৫) বলে, 'আমিও গাড়ি চালানো শিখে ফেলেছি। লাইসেন্স করতে দিছি। লাইসেন্স পাইলেই গাড়ি নিজেই চালামু।'
আদাবর বেড়িবাঁধ থেকে শ্যামলী রুটে এক বছর ধরে লেগুনা চালায় খোরশেদ হোসেন। বয়স সবে ১৫ পেরিয়েছে। খোরশেদ বলে, 'গাড়ি চালাইতে হলে বয়স লাগে নাকি? আমাগো চেয়ে অনেক বেশি বয়সের লোকও তো গাড়ি চালাইতে পারে না। মহল্লায় গাড়ি চালাইলে পুলিশ বেশি ধরে না। মালিকের লগে এলাকার নেতাগো খাতির আছে।' দুর্ঘটনার কথা তুললে খোরশেদের জবাব, 'গাড়ি চালাইলে তো কিছু না কিছু এঙ্েিডন্ট হইব।'
মনির আর খোরশেদের মতোই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ১৪ থেকে ২০ বছরের পাঁচ শতাধিক কিশোর গাড়ি চালাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালায়। গাবতলী কিংবা মিরপুর থেকে ছেড়ে আসা অনেক মিনিবাসের চালকও কিশোর। মূল চালক না এলে মালিকরা হেলপারদের দিয়েই বাস রাস্তায় নামিয়ে দেন। কখনো ট্রাফিক পুলিশ ধরলে কিছু টাকা দিলেই ছেড়ে দেয় বলে কিশোর চালকদের অনেকেই এ প্রতিবেদককে জানায়।
বেপরোয়া গাড়ি চালানো : কিশোর চালকরা রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই সড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ঘটাচ্ছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অদক্ষ কিশোর চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে বেশির ভাগ সময় দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত গাড়ির চালকরাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
মহাখালী থেকে টাঙ্গাইলগামী নিরালা পরিবহনের চালক আনিসুর রহমান বলেন, '২০ বছর ধরে রাস্তায় গাড়ি চালাই, কিন্তু এখন কয়েক মাস হেলপারি করেই রাস্তায় অল্প বয়সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অল্প বয়সের চালকের উল্টাপাল্টা চালানোর কারণে আমরা অনেক সময় বিপদে পড়ে যাই। তাদের কারণেই রাস্তায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।' একই কথা বলেছেন এস এ খালেক পরিবহনের চালক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, 'কিশোর চালকরা গাড়ি চালানোর সময় নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করে না। তারা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো গাড়ি চালানোর কারণে রাস্তায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। তাদের কারণে আমাদের মতো দক্ষ চালকরা বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছি।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর চালকদের অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালায়। রাতভর মাদক গ্রহণ করে দিনের বেলায় গাড়ি চালাতে গিয়ে শারীরিক ভারসাম্য হারিয়েও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষিত চালকের অভাব, পথচারীদের অসতর্কতা, ফিটনেসহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, গাড়ির অতিরিক্ত গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, অতিরিক্ত গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সেতু এবং অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
লাশের মিছিল : জানা যায়, সারা দেশে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার। আর লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের মধ্যেও রয়েছে অদক্ষ চালকের ছড়াছড়ি। ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় অসংখ্য কিশোর চালক রয়েছে। মফস্বলের প্রতিটি রাস্তায় দারিদ্র্যের কারণে ১২ থেকে ২০ বছর বয়সের হাজার হাজার কিশোর চালক নির্বিঘ্নে গাড়ি চালাচ্ছে। যানবাহন আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই তাদের। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বাকি সাড়ে পাঁচ লাখ গাড়ি চালাচ্ছে ভুয়া লাইসেন্সধারীরা। বেসরকারি পরিসংখ্যানে ঢাকাসহ সারা দেশে ৬১ শতাংশ চালক বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছে। দেশে ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছে এক লাখ তিন হাজার জন। এর মধ্যে মারা যায় ৫০ হাজার ৫৪৪ জন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে দুই হাজার ৮২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট হতাহত হয়েছে চার হাজার ৪৪৯ জন। অন্যদিকে সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চের (এমআরটি) বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে চার হাজার ৪৮১ জন। মৃত্যুর হার গড়ে প্রতিদিন ১২ জনেরও বেশি। এসব ঘটনায় ১৫ হাজার ৫৬৯ জন অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪২ জনেরও বেশি মানুষ আহত হচ্ছে বলে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিআরটিএ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এঙ্েিডন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ড. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সড়ক দুর্ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দুর্ঘটনার খবর পাই। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশেই অদক্ষ এবং কিশোর চালক রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ হাজার হাজার গাড়ির বেশির ভাগ চালক কিশোর।'
তাঁর মতে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রতিটি সড়কে রোড ডিভাইডার স্থাপন করার পাশাপাশি চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। বছরে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার দুর্ঘটনার হিসাব রাখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে ওস্তাদের কাছ থেকে গাড়ি চালানো শেখার সংস্কৃতির কারণে চালক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় দেশের ছয়টি বিভাগে ছয়টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আমাদের রয়েছে।'

দুর্ভোগের শেষ কবে by রাশেদ মেহেদী ও আলতাব হোসেন

সারাদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। আসছে ঈদ। অথচ একের পর এক মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার ও মেরামতের অভাবে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জনদুর্ভোগও বেড়েছে। সড়ক-মহাসড়কে গুরুতর দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। হাইকোর্টও মহাসড়ক মেরামতের বিষয়ে রুল জারি করেছেন। তারপরও সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার। একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। সময়মতো অর্থ ছাড় না হওয়ায় রাস্তা সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন খোদ যোগাযোগমন্ত্রী। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে তাদের?


এদিকে গতকাল সোমবার টানা ষষ্ঠ দিনের মতো ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গগামী বাস ছাড়েনি। ফলে সাধারণ যাত্রীদের উঠেছে নাভিশ্বাস। অন্যদিকে শঙ্কা বাড়ছে ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে। ঈদের আগে দেশে মহাসড়কের এ ধরনের বেহাল অবস্থা নজিরবিহীন। বন্ধ হয়ে যাওয়া সড়কে বাস চলাচলে সরকার ও পরিবহন নেতাদের চোখে পড়ার মতো সমঝোতার উদ্যোগ নেই। কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই চলছে পরিবহন ধর্মঘট। ঈদের আগে ও পরে তিন-চার দিন ঘরে ফেরা এবং ঘর থেকে ফিরে
আসা নিয়ে বড় সংকটের
আশঙ্কা করছেন খোদ পরিবহন মালিকরাই।
দেশের সর্বত্রই ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। দিন যত যাচ্ছে সড়ক যোগাযোগ পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। তারপরও বড় বড় গর্তসহ খানাখন্দে ভরা বেশিরভাগ মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। এক গর্ত থেকে উঠে আরেক গর্তে পড়ার সময় টাল সামলাতে পারছেন না চালকরা। এদিকে যোগাযোগ সেক্টরের সার্বিক অবস্থা জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে আজ সকালে তার দফতরে বৈঠক ডেকেছেন।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ১২টি জেলায় বাস চলাচল বন্ধ থাকার কারণে ওইসব জেলার সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গতকাল সমকালের ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধিরা জানান, এসব জেলার সঙ্গে ঢাকার বাস ও ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর এবং জামালপুর জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব এলাকার বাজারে তেল, চিনি, ময়দা লবণ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে কিছু বিআরটিসি বাস চলাচল করলেও দুর্ভোগ কমেনি। এসব বাসও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় বেশি নিচ্ছে গন্তব্যে পেঁৗছতে। কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব হয়ে সায়েদাবাদ টার্মিনালে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে কিছু বাস চলছে গাজীপুর পর্যন্ত। বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম থেকে মহাখালী টার্মিনালে চলাচলকারী কোনো বাস গতকালও ছাড়েনি। তবে গাবতলী টার্মিনাল থেকে যাতায়াতকারী বাস চলাচল করছে। বগুড়া ও রংপুর জেলা পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা জানান, ঢাকা-বগুড়া এবং বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তাই আগে যেখানে ঢাকা থেকে বগুড়া যেতে চার-সাড়ে চার ঘণ্টা লাগত, এখন সেখানে ছয়-সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগছে।
'দেশে কি দেখার কেউ নেই' : সোমবার দুপুর ২টায় মহাখালী টার্মিনালের সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন অনেক যাত্রী। অনেকে ব্যাগ নিয়ে বসেছিলেন। টার্মিনাল থেকে কয়েক গজ দূরে চলনবিল ট্রান্সপোর্টের একটি বাস এলে হেলপার হাঁক দিচ্ছিলেন_ 'গাজীপুর, মাওনা'। মাঝবয়সী এক যাত্রী আট-দশ বছরের একটি বাচ্চা নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। 'ভাই ময়মনসিংহ যাওয়া যাবে না?' হেলপার উত্তর দিলেন, 'এই গাড়ি ময়মনসিংহ যায় না। মাওনা থেকে লোকাল গাড়ি পাবেন।' লোকটি ফিরে এলেন। কথা হলো তার সঙ্গে। নাম বশীরউদ্দিন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন এক সপ্তাহ আগে। দু'দিন থেকেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে বুধবার থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাস চলাচল বন্ধ। আজ চালু হবে কাল চালু হবে করে পাঁচ দিনেও চালু হয় না। তিনি বলেন, 'ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের দীঘিরচালা থেকে গাজীপুরের মালেকের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা খুবই খারাপ। এ খারাপ অবস্থা বছরজুড়েই। এখন গাড়ি চলে গর্তের মধ্য দিয়ে, ডানে-বাঁয়ে কাত হয়ে যায়। বুঝলাম না, দেশে কি পাবলিকের সমস্যা দেখার কেউ নেই? সরকারের কারও কি এই রাস্তাটার ওপর চোখ পড়ে না? ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ছয় দিন ধরে বন্ধ, এটা কি সহজ কথা?' টার্মিনালে বাস কর্মচারীরা জানান, দু'চারটি গাড়ি লোকাল হিসেবে গাজীপুর পর্যন্ত চলছে। ড্রাইভার, হেলপারের দিনের খোরাকির জন্য ফাও ট্রিপ। সমিতির সিদ্ধান্ত ছাড়া পুরোদমে গাড়ি চালু হবে না।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে বাস চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, 'যোগাযোগমন্ত্রী আমাদের নেতাদের নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অবস্থা দেখতে যাবেন। আমরা খবর নিয়েছি, রাস্তা মেরামতের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। মঙ্গলবার পরিদর্শনে যদি অবস্থা কিছুটা ভালো দেখা যায় আমরা বাস চালু করব।' ঈদের আগে পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'প্রতি বছর ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকেই যাত্রীর চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এ কারণে মালিকরা ট্রিপের সংখ্যাও বেশি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে এখন স্বাভাবিক ট্রিপ চালু রাখাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঈদের আগে সমস্যার আশঙ্কা থাকছেই।'
আদালতের রুল : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক মেরামতের বিষয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থ সচিব, সড়ক ও জনপথের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে মহাসড়কের বেহালদশার জন্য ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্টদের কারও কোনো অবহেলা রয়েছে কি-না তা খুঁজে বের করে আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাস চলাচল বন্ধের নেপথ্যে চাঁদাবাজি : একটি পরিবহন সূত্র জানায়, রাস্তা ভাঙাচোরা ছাড়াও ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির নামে চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাকার মালিক সমিতির বিরোধ বাস চলাচল বন্ধের আরও একটি বড় কারণ। গত ছয় মাস ধরে ময়মনসিংহ মালিক সমিতির নামে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মধ্যে চলাচলকারী বাস থেকে ৩০০ টাকা হারে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের গাড়ি থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হারে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। ক'দিন আগে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির নামে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতান সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের পর ময়মনসিংহ জেলা পরিবহন মালিক সমিতির আর কোনো নির্বাচন হয়নি। এ কারণে সমিতির দু'গ্রুপের মধ্যে বিরোধও তীব্র হয়েছে। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনছে। এ চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাকার মালিক সমিতির সঙ্গেও ময়মনসিংহ মালিক সমিতির বর্তমান কমিটির টানাপড়েন চলে আসছিল। ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামতের দাবি বর্তমানে বাস্তব সমস্যা থেকে এলেও চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধও একটি বড় কারণ।
এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, যোগাযোগমন্ত্রীকে চাপে ফেলে লাইসেন্স আদায় করতে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উত্তরাঞ্চলে বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। শ্রমিক ফেডারেশন ২৭ হাজার ৩৮০ নেতাকর্মীর নামে পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর তালিকা পাঠিয়েছে বিআরটিএতে। এটি এখন যোগাযোগমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
৭০ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা : সারাদেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ১৮ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা আর খানাখন্দে ভরা। সওজ ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, সারাদেশে অন্তত ১০০ কিলোমিটার মহাসড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২১৬টি স্থান আছে যেখানে বছরে অন্তত তিনটি করে দুর্ঘটনা ঘটে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে নয়টি জাতীয় মহাসড়ক আছে। দূরত্ব সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার। এ মহাসড়কের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো হলো_ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্ত, গজারিয়া, দাউদকান্দি, সোনারগাঁ ও মধ্যবাউশিয়া। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপারা বাসস্ট্যান্ড, জয়পাড়া বাসস্ট্যান্ড, পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ড, সাভার বাজার ও বাথুলী উল্লেখযোগ্য।
দরকার ৩ হাজার কোটি টাকা :যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে মেরামত না করায় রাস্তার যে অবস্থা হয়েছে, তাতে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ করে আর সামাল দেওয়া যাবে না। অনেক রাস্তা নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সে জন্য আরও দেড় হাজার কোটি টাকা দরকার। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর দ্রুত সংস্কার করতে একনেকে একটি প্রকল্প পাস হয়। সরকারদলীয় সাংসদ তোফায়েল আহমেদ সারাদেশের সড়ক ব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলার পর ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই বছর মেয়াদি (২০১০-১১ এবং ২০১১-১২) প্রকল্পটি আগামী জুন মাসে শেষ হবে। দেড় বছরে প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই দফায় মাত্র ১০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রথম বছরে ৫০ কোটি টাকা এবং প্রকল্পের শেষ বছরে দিয়েছে ৫৭ কোটি টাকা। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এ সামান্য অর্থ দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর সারাদেশে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অনেক জায়গায় কার্যাদেশ দেওয়া হয়। টাকা ছাড় না হওয়ায় বহু ঠিকাদার কাজ শুরু করেননি। তিনি বলেন, গত তিন বছরে যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল। যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে তার বেশির ভাগই বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্যের মাধ্যমে। এসব প্রকল্পে স্থানীয় বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রকল্পের বকেয়া ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকাসহ নতুন করে আরও ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা দ্রুত মেরামতের জন্য জরুরিভাবে টাকার প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আজ : যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, ঈদের আগে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ভাঙা অংশগুলোতে ইট ফেলে মেরামত করে দেব। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও সারাদেশের রাস্তা সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জরুরিভাবে তিন হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে টাকা ছাড় না করায় রাস্তার ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাই ১৪শ' কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করতে এখন ব্যয় করতে হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, দুই বছরের জন্য মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রমের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৪১০ কোটি টাকা। ব্যয় অনুমোদনও করা হয়েছিল। প্রথম বছর ৫০ কোটি এবং পরের বছর ৫৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। জরাজীর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো দ্রুত সংস্কার করতে তার মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই বলে তিনি জানান। তবে সব রাস্তা ঈদের আগে কার্পেটিং করা সম্ভব হবে না। ঈদের পরে সে কাজ এবং নতুন করে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হবে। পুরো রাস্তা সংস্কার হতে কমপক্ষে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস লাগতে পারে।
নির্মাণের ছয় মাসেই বেহাল হচ্ছে রাস্তা : অনেকে অভিযোগ করেন, কোরীয় ও চীনা ঠিকাদাররা যেসব সড়ক বা অবকাঠামো নির্মাণ করেন সেগুলো দীর্ঘদিন টিকে থাকে। অথচ দু'এক বছর পর পর স্থানীয় ঠিকাদার দিয়ে রাস্তা তৈরি বা মেরামত করা হলেও তা কাজ শেষের ছয় মাস যাওয়ার আগেই চলার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম রহমত উল্লাহ বলেন, একটি রাস্তায় কী পরিমাণ ও ওজনের কতো গাড়ি চলবে তার ওপর গবেষণা করে রাস্তা নির্মাণ না হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটছে। অনেকে বলছেন, বিদেশিরা ২০ ভাগ লাভ নিয়ে বাকি টাকার কাজ করে। স্থানীয় ঠিকাদাররা ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে মাত্র ২০ ভাগ অর্থের কাজ করে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া ট্রাক চলাচল, অভারলোডেড, রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কারণেও রাস্তা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা সম্পর্কে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, 'গত সাত থেকে আট বছর এসব রাস্তা ড্রেসআপ (নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ) করা হয়নি। আমি যতদূর জানি বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে সড়ক সংস্কারের একাধিক প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার খুবই কম অংশ ছাড় করা হচ্ছে। এ কারণে প্রকল্প থাকলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। ফলে সমস্যাটা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটসহ কয়েকটি রুটে প্রকট হয়েছে।'
সমঝোতার উদ্যোগ কম : মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, 'যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আগামীকাল বুধবার থেকে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছি। সরকারেরর তরফ থেকে বড় বড় গর্তে ইট সুরকি আর বালি দিয়ে ভরাট করলে বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হতো না।' সরকারের পক্ষ থেকে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা জোরালো হয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিআরটিসির চেয়ারম্যান এম এম ইকবাল সমকালকে বলেন, বাস মালিকদের হাতে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাদের বাস চলাচল করতে না পারলেও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বিআরটিসির ২০টি এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ১০টি চলাচল করছে। মালিকরা যাতে ভবিষ্যতে যাত্রীদের জিম্মি না করতে পারে সেজন্য বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।
পরিবহন নেতাদের সঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রীর বৈঠক : সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় ঠিক করতে গতকাল সোমবার সংসদ ভবনে পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি জানান, বাসচালকদের দুর্ঘটনার ব্যাপারে সচেতন করতে প্রতিটি জেলার টার্মিনালে পৃথক সমাবেশ করা হবে। ২১ আগস্ট গাবতলী টার্মিনালে প্রথম সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, নৌপরিবহনমন্ত্রী মালিকদের বলেন সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তিনি বেপরোয়া বাস চালানোর বিষয়ে খুবই ক্ষুব্ধ। বৈঠকে মহাখালী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণকারী পরিবহন নেতারা গাবতলী টার্মিনালের নেতাদের তাদের বাস ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাব দেন। গাবতলী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণকারী বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা তাতে রাজি হননি।
খারাপ রাস্তা কত? :সারাদেশে পাকা সড়ক আছে ৯০ হাজার ২১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে আছে ২১ হাজার ২১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কের আওতায় ৬ হাজার ৪৪৫ কিলোমিটার, অঞ্চলিক মহাসড়কের আওতায় ৪ হাজার ১০৫ কিলোমিটার ও জেলা সড়কের আওতায় ১০ হাজার ৬৬০ কিলোমিটার। প্রতি বছর কী পরিমাণ সড়ক খারাপ হচ্ছে, তা মেরামত করতে কত টাকা লাগবে_ এসব চাহিদা প্রতিবেদন প্রণয়ন করে সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ। চলতি বছর বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ১২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার রাস্তা খারাপ বলে তারা প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৫০ কিলোমিটার রাস্তা একেবারেই খারাপ, যা যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আরও দেড় হাজার কিলোমিটার রাস্তা খারাপ হলেও মোটামুটিভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারে। বর্ষা শুরু হওয়ার পর বর্তমানে কী পরিমাণ রাস্তা খারাপ হয়েছে সে হিসাব তারা এখনও করেননি। রাজধানীর অবস্থাও খারাপ। এক হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র ২০-২৫ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা মোটামুটি ভালো। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ওই রাস্তাগুলোর সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। ভাঙাচোরা, কাটাকাটি ও গর্তের কারণে বাকি রাস্তা ক্রমেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

Friday, August 12, 2011

অনিরুদ্ধ হুমায়ুন আজাদ by নওশাদ জামিল

স্পেনের অন্তরতম সন্তান বিশ্বখ্যাত কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা। দেশকে তিনি ভালোবেসেছিলেন আর দেশের জন্য শহীদ হয়েছিলেন দেশেরই হিংস্র শাসক ও সহযোগীদের হাতে। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুও অনেকটা লোরকার মতোই। ঘাতকরা তাঁকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, তবে বিস্ময়করভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরও কিছুদিন বেঁচেছিলেন তিনি। পরে মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করে। বহুমাত্রিক লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার। ২০০৪ সালের এই দিনে জার্মানিতে মারা যান প্রথাবিরোধী এ লেখক। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীতে বইমেলা শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে মৌলবাদীদের হামলার শিকার হন তিনি।
লোরকার স্মৃতি স্মরণে স্পেনে রয়েছে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার। কিন্তু আমাদের দেশে বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিদেশে লেখক-কবিদের বাড়ি সংরক্ষণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে। আমাদের এখানেও নেতা-নেত্রীদের নামে কত কিছু করা হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, দলীয় লোকের নামে সড়ক ও স্থাপনা করা হয়। তবে দেশের বরেণ্য লেখক হুমায়ুন আজাদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা'। তিনিও ছিলেন অনেকটা নিঃসঙ্গ। জীবিতকালে তিনি একাই লড়াই করে গেছেন কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। মৃত্যুর পরও তিনি যেন নিঃসঙ্গ।
হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা কোহিনূর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তাঁর স্মৃতি রক্ষার জন্য কেউ কিছু করছেন না। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে। তাদের কথা শুনে আমরা ভাবি, হুমায়ুন আজাদের হত্যার বিচারটা তাদের দ্বারা হবে এবং তাঁর অবদান স্বীকৃত হবে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষিত হবে। তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হবে যথাযোগ্যভাবে। এই যে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক দেওয়া হয়, হুমায়ুন আজাদ কি তা পাওয়ার যোগ্য নন? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি তো বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন, এমনকি ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও তাঁর যে অবদান সে জন্যও তো তিনি একটি পুরস্কার পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিছুই পাননি। তাঁর নামে একটি সংগ্রহশালা গড়ার উদ্যোগও নিচ্ছেন না কেউ। এমনকি তাঁর কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এটা আমাদের খুব পীড়া দেয়।'
বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সম্মানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে গেছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি অমলিন হয়ে আছেন বাঙালির কাছে, বিশ্বমানবের কাছে। বাঙালির সমাজজীবন, প্রকৃতি ও ঐহিত্যগতভাবে অর্জিত সংস্কৃতি, সাহিত্য আর শিল্পের মাধুর্যকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-সমালোচনাসহ শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট আলোক কণা আমাদের অন্ধকারে পথ দেখায়, প্রাণিত করে। তবে বরেণ্য এ লেখকের নামে ঢাকায় কোনো সড়কের নামকরণ হয়নি কিংবা তাঁর নামে কোনো স্থাপনা নেই। এটাকে অন্যায় হিসেবে দেখছেন তাঁর ভক্ত-সুহৃদরা।
হুমায়ুন আজাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে দেশি-বিদেশি সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার। দেশ-বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পদক পেয়েছেন। অনেক খ্যাতনামা লেখক তাঁকে স্বাক্ষরসহ বই উপহার দিয়েছেন। এসব পদক ও বই সংরক্ষণ করার জন্য যে আর্থিক সামর্থ্য থাকা দরকার, তা তাঁর পরিবারের নেই। এ বিষয়ে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে তাঁরা মত দেন।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কবির হার্দিক সম্পর্ক ছিল। তিনি কবির চিকিৎসার জন্য অনেক কিছু করেছিলেন। এখন কবি নেই। তাঁর স্মৃতিরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে এলে সেটি বাংলা ভাষার একজন বরেণ্য লেখকের প্রতি সমগ্র জাতির সম্মান ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হয়ে থাকবে।
হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদ বলেন, প্রথাবিরোধী এ লেখকের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি আশা করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ সরকার লেখকের স্মৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন, 'সরকার চাইলে আমরা বসে ঠিক করতে পারি। সবার পরামর্শ নিয়ে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে কিছু করা দরকার।'
হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মৌলি আজাদ। তবে হুমায়ুন আজাদের জন্মভূমি মুন্সীগঞ্জের রাঢ়িখালে তাঁর সাহিত্য ও কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
হুমায়ুন আজাদ মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাগ্যকুল ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাঢ়িখাল গ্রামে। তিনি তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাঢ়িখালের জ্যোতির্ময় আঙিনায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
হুমায়ুন আজাদ রাঢ়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। মেধাবী ছাত্র হুমায়ুন আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন।
'অলৌকিক ইস্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ১৯৯৪ সালে তিনি 'ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল' দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত 'সবকিছু ভেঙে পড়ে' বইয়ের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। এ ছাড়া তাঁর প্রবন্ধ, গবেষণা, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, শিশুসাহিত্যসহ প্রায় ৬০টি পাঠকনন্দিত বই রয়েছে।

পুলিশের ঈদ চাঁদাবাজি by আবু হেনা রাসেল ও এস এম আজাদ

ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরের শপিং কমপ্লেক্সে সামনে ফুটপাতের কাছে গত শনিবার মোটরসাইকেলে করে এসে দাঁড়ালেন শাহ আলী থানার এসআই তরিকুল ইসলাম। ফুটপাতের এক দোকানদারকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, 'তাড়াতাড়ি সরা। দুই দিন তো মালপানি দিস না।' দোকানি বললেন, 'স্যার, যে বৃষ্টি, দোকানই তো সাজাইতে পারি না! আপনাগো কী দিমু?' পরে নিজের দোকান গুটানোর সময় সিদ্দিক মিয়া নামের ওই হকার বললেন, "ভাই, পুলিশকে প্রতিদিন ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। একে বলে 'পুলিশের কাবজাব'। টাকা না দিলে ওরা আমগো ধইরা মাজারের পাশে নিয়া আটকাইয়া রাইখা টাকা আদায় করে।"
নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের বিপরীত দিকের গ্লোব শপিং কমপ্লেক্সে সামনে ফুটপাতের গেঞ্জি বিক্রেতা সেলিম বললেন, 'ঈদের সময় বেচাকেনা না অইলেও ট্যাকা বাড়াইয়া দিতে অইতাছে। ওগো ঠিকমতো ট্যাকা না দিলেই বিপদ। কিছুই কওয়ার নাই। কিছু কইলেই রোজার দিনে ইফতারির বদলে লাথি আর লাঠি জুটব কপালে। ঘাড় ধইরা উঠাইয়া দিব।'
সরকারি রাস্তার ওপর ৪০ ইঞ্চি ও ৫২ ইঞ্চি প্রশস্ত দুটি চৌকি-দোকানের জন্য সেলিমকে এখন প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। পুলিশের হয়ে এই টাকা তুলছে 'লাইনম্যান' রফিক ও আকবর।
রমজানের আগে চাঁদা ছিল ২০০ টাকা, ঈদ উপলক্ষে ৩০০ টাকা বেড়েছে।
গত সোমবার বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য সংগ্রহের সময় কালের কণ্ঠকে সেলিম বললেন, 'ভাই, আমি সামান্য হকার। উল্টা-পাল্টা কিছু লেইখেন না। আমি কারো বিরুদ্ধে বলতে চাই না।'
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, পেশাদার চাঁদাবাজদের পাশাপাশি পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন রাজধানীর ফুটপাত ব্যবসায়ীরা। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, ঈদকে সামনে রেখে নিউমার্কেটের এসব ফুটপাতও ব্যবসায়ীদের কাছে রীতিমতো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। হকার-ব্যবসায়ীদের কাছে এটার নাম 'পজিশন বাণিজ্য'। ৪০ ইঞ্চি ফুটপাতের পজিশন শুধু চলতি মাসের জন্য বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। ঈদের কারণে দৈনিক চাঁদার হারও তারা বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ফুটপাতে ব্যবসা করতে গেলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, ছাত্রনেতা, পেশাদার সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজসহ অনেককেই টাকা দিতে হয়। আর পুলিশকে টাকা না দিয়ে দোকান বসানোর তো প্রশ্নই ওঠে না।
নিউমার্কেটের আটটি ফুটপাত-মার্কেটসহ রাজধানীর প্রধান প্রধান ফুটপাত-বাজারগুলো ঘুরে পুলিশের চাঁদাবাজির ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। জানা গেল, মিরপুর রোডের নেওয়াজ পাম্পের সামনে থেকে নিউমার্কেট ফুট ওভারব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে পুলিশের হয়ে টাকা ওঠায় লাইনম্যান রফিক ও আকবর। রফিক নিজেকে হকার্স লীগের নেতা বলেও পরিচয় দেয়।
বাংলাদেশ জাতীয় হকার্স ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক কামাল সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হকাররা এখন চলে গেছে পুলিশের লাইনম্যানের নিয়ন্ত্রণে। এরা মূলত পুলিশের দালাল। ওদের ভয়ে হকাররা প্রতিবাদও করতে পারে না।'
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি হকার বসে নিউমার্কেট ও গুলিস্তান এলাকায়। ছিন্নমূল হকার্স সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গুলিস্তান এলাকায় হকারের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। নিউমার্কেট এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার। এর পরই হকারের সংখ্যাধিক্য সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী, তারপর ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার এলাকায়।
পুরানা পল্টনের ৬২/২ নম্বর ভবনের সামনের ফুটপাতের টুপি বিক্রেতা আবুল বাশার বললেন, 'এত দিন ৩০ ট্যাকা কইরা দিয়া আসতাছি। হুনলাম আজ থাইক্যা ২০ ট্যাকা বাড়াইয়া ৫০ করছে। অহনো দেই নাই। তয় দিতে অইব।' তিনি আরো জানান, দৈনিক বাংলা মোড় থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত পুরো ফুটপাতে পুলিশের হয়ে চাঁদা আদায় করে লাইনম্যান নূর মিয়া ওরফে কাইল্যা নূর, শাহজালাল, কামরুল ও গোলাপ।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বায়তুল মোকাররমের মোড় থেকে গুলিস্তানের সব ফুটপাতেই দোকানপ্রতি এখন প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে। কিছুদিন আগেও এ হার ছিল ৩০ টাকা। গুলিস্তানের ২২টি ফুটপাতই নিয়ন্ত্রণ করছে আবদুস সালাম নামে পুলিশের এক লাইনম্যান। সালাম নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে থাকে। তবে জানা গেছে, গত সরকারের আমলেও সালাম ওই এলাকায় লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেছে।
বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পাশ হয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ফুটপাতে পুলিশের হয়ে চাঁদা তোলে লাইনম্যান কোটন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আশপাশে আকতার হোসেন এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতে দোকানপ্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা নেয় লাইনম্যান আবুল হোসেন। ভাষানী হকি স্টেডিয়ামের সামনে ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গেটে দীর্ঘদিন ধরেই পুরনো এবং চোরাই ইলেকট্রনিঙ্ পণ্যের ফুটপাত-বাজার চলছে। এই এলাকায় টাকা তুলছে পল্টন থানার লাইনম্যান আলী। সে নিজেকে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দেয়। তার সহযোগীরা হচ্ছে জুনিয়র লাইনম্যান সোহেল, পায়েল, আনোয়ার ও কবির। বায়তুল মোকাররম মসজিদের ২ নম্বর গেট এলাকার লাইনম্যানগিরি করে পটল আর মসজিদের সামনে কাদির। রমনা ভবনের পাশে ফুটপাত থেকে দোকানপ্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান রানা। পাশের রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে ফল বাজার। দোকানদাররা জানান, থানার জন্য চাঁদার টাকা ওঠায় লাইনম্যানরা। আর প্রতিদিন টহল পুলিশ নিজেরাই এসে নিয়ে যায় দোকানপ্রতি ২০ টাকা করে। পুলিশের ভাষায় এটা চাঁদা না, 'চা খরচা'।
বঙ্গবন্ধু হকার্স মার্কেটের পাশে ফুটপাতের দোকানগুলোতে চাঁদা আদায় করছে লাইনম্যান দুলাল ও মনির, গোলাপশাহ মাজার থেকে ঢাকা ট্রেড সেন্টার পর্যন্ত দেড় শ টাকা করে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান বিমল বাবু। জাতীয় গ্রন্থাগারের পাশে বাবুল ও শহীদ, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের আশপাশে জজ মিয়া, জিপিওর সামনে কবির, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পেছন দিকে সালাম, হিন্দু বাবুল ও বিমল বাবু, গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনে স্বেচ্ছাবেক লীগ নেতা পরিচয়ধারী বাবুল এবং জুতাপট্টিতে মঙ্গল নামে আরেক যুবলীগ নেতা পুলিশের হয়ে টাকা তোলে। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের পাশে আহাদ, পুলিশ বঙ্ জুতাপট্টিতে ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সেক্রেটারি রাহাত এবং ট্রেড সেন্টারের পাশ থেকে নিউ রাজধানী পর্যন্ত ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাছির পুলিশের লাইনম্যান। তাদেরকে চৌকিপ্রতি প্রতিদিন ১০০ ও সপ্তাহে আলাদাভাবে ২০০ টাকা করে দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে থেকে গুলিস্তান আন্ডারপাস পর্যন্ত টাকা তোলে লাইনম্যান হারুন, গুলিস্তান গার্ডেনের সামনে আল মুনসুর থেকে হল মার্কেট পর্যন্ত বড় মিয়া এবং উল্টো পাশের ফুটপাত দেখে হাসান ও সুলতান। কাজী বসিরউদ্দিন নাট্যমঞ্চের পেছনে টাকা ওঠায় রিপন।
এদিকে ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে থেকে গ্লোব শপিং সেন্টার পর্যন্ত হকার্স লীগ নেতা রফিক, ৫২ নং ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা ইসমাইল, হোসেন ও আকবর দোকানপ্রতি ৫০ থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা তুলছে। প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের সামনে থেকে সানমুন টেইলার্সের কোনা পর্যন্ত ৫২ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সভাপতি ফরিদ ও সাধারণ সম্পাদক মিজানের নামে লাইনম্যান বাচ্চু; গাউছিয়া মার্কেট এলাকায় বাংলাদেশ হকার্স সমিতির সভাপতি হোসেন মোল্লা ও ধানমণ্ডি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আমির হোসেন এবং নিউমার্কেট ৪ নম্বর গেট থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত চাঁদা তোলে নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাত্তার মোল্লা। জানা গেছে, নিউমার্কেটের দুটি ফুটপাত ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নেন ৫২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুখলেছুর রহমান ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মামলাও করেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এ দুটি ফুটপাতে তাঁরা দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন ২৮০টি। এখন দুই ফুটপাতে পজিশন বিক্রি করে ও টাকা তোলে লাইনম্যান সাত্তার মোল্লা। রাফিন প্লাজার সামনে স্থানীয় যুবলীগের মাইনুল ইসলাম, আনন্দ বেকারির পাশ থেকে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার পর্যন্ত আবদুল জলিল, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে মনির, ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাতে বিভিন্ন দোকান থেকে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে চাঁদা আদায় করে কয়েকজন। পুলিশও নিয়মিত ১০ টাকা করে নিয়ে যায়।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহীদ ফারুক সড়কসহ আশপাশে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান মান্নান, মনির, সোনা মিয়া, অনু ও তোরাব আলী। প্রতিদিন লাইম্যানরা এই টাকা বুঝিয়ে দেয় যাত্রাবাড়ী থানার এসআই হোসেনের হাতে।
এ ছাড়া মতিঝিলের জনতা ব্যাংক ভবনসংলগ্ন ফুটপাতে বড় হারুন, লিটন ও চুইলা বাবু, ফার্মগেট এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে যুবলীগ নেতা শাহআলম ও বিএনপি নেতা দুলাল আর ফুটপাতে টাকা তোলে লাইনম্যান হায়দার, বরিশাইল্লা হারুন, চুন্নু, আলমগীর, ঘড়ি সাইদ, সাইদ, মোবারক, শামসু, তোয়ালে কামাল, তৌহিদ, কাজল ও মোফাজ্জল। কারওয়ান বাজার এফডিসিসংলগ্ন রেলক্রসিং এলাকায় কমিউনিটি পুলিশ নেতা সিরাজ ও জিআরপির কনস্টেবল নুরু টাকা তোলে। পুলিশের হয়ে পুরো কারওয়ান বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আনোয়ার হোসেন, এল রহমান এবং সাহেব আলী নামের তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি। চেয়ারম্যানবাড়ী থেকে কাকলী ব্রিজ পর্যন্ত আবদুল ও মাসুম, মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে বাদল, খলিল ও আকরাম আর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় জিআরপির এসআই নজরুল নিজেই হকারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।
বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই চাঁদাবাজরা আসলে পুলিশের লাইনম্যান ও দালাল। পুলিশ নিজেরা চাঁদা তুলতে পারে না বলে এদের ব্যবহার করছে। এসব বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়েও প্রতিকার মিলছে না। কারণ, এই চক্রে সব সময়ই সরকারি দলের নেতারা জড়িত থাকেন।'
ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে গুলিস্তানের সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের দায়িত্বরত টিএসআই শাহাবুদ্দিন বলেন, 'এখানে ফুটপাতে দোকান বসতে দেওয়া হয় না। চাঁদা কারা নেয় তা ভালো করে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। বক্স পুলিশ এসবের সঙ্গে জড়িত না।'
চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে আবদুস সালামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ভাই পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বলেন, 'এই এলাকায় সালাম একা চাঁদা নেয় না। মূলত সে প্রশাসনের দিকটা দেখে।'
পল্টন থানার ওসি শহীদুল হক ফুটপাত থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, 'থানা পুলিশের মাঠপর্যায়ের কেউ কেউ এ কাজ করতে পারে, তবে তিনি বা তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানেন না। আসলে পুলিশ নয়, রাজনৈতিক দলের নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করে ফুটপাত। বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা তোলা হয়। ফুটপাত হকারমুক্ত করতে গিয়ে গত বছর পুলিশের ওপর হামলা হয়েছিল। মানবিক কারণে হকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।'
অথচ মিরপুর এক নম্বরের ফুটপাতের কয়েকজন হকার জানান, এই এলাকায় পুলিশ নিজেরাই সরাসরি মাঠে নেমেছে। শাহআলী থানার সিভিল টিমের এসআই বাবু কৃষ্ণ সাহা ও লতিফ কাঁচাবাজার, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটসহ আশপাশের প্রতিটি দোকান থেকে মাসে চার হাজার টাকা ওঠান। সঙ্গে থাকে সাঈদ নামে তাঁদের লাইনম্যান। কো-অপারেটিভ মার্কেটে তৈরি পোশাক বিক্রেতা শামছু ও মিজান জানান, প্রতিদিন দোকানপ্রতি থানা পুলিশকে দিতে হয় ১৫০ টাকা। কালু মিয়া নামে শাহআলী থানার ওসির এক লাইনম্যান কাঁচাবাজার থেকে প্রতি মাসের জন্য ছয় হাজার করে টাকা তোলে। গাবতলী টার্মিনাল ও দারুস সালামে পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই) তৈয়বুর রহমান নিজেই টাকা তোলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দিয়াবাড়ী এলাকায় পুলিশের লাইনম্যান কালাম টাকা ওঠায় দারুস সালাম থানার ওসি আবদুল মালেক ও অপারেশন অফিসার আবদুস সালামের নামে। ব্যবসায়ীরা এই অভিযোগ করলেও কালের কণ্ঠের কাছে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে হকাররা গড়ে তুলেছে ফুটপাত মার্কেট। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি লেডিস মার্কেট নামে পরিচিত। এখানকার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শাহজাহানপুর পুলিশ ফাঁড়ি ও মতিঝিল থানা তাঁদের কাছ থেকে লাইনম্যানদের মাধ্যমে প্রতিদিনই টাকা নেয়। সাইফুল ও ফল বেপারি নামে পরিচিত এক লাইনম্যান এসব চাঁদা তুলে থাকে।
এই অভিযোগের ব্যাপারে মতিঝিল থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, 'শুক্রবারে রাস্তায় বসে হকাররা। আর অন্য দিন ফুটপাতে। পুলিশের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ বহু আগে থেকেই শুনে আসছি। এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করি না।'