Monday, August 22, 2011

মশার ওষুধের নামে ৫০০ ড্রাম পানি! by অমিতোষ পাল

ত ১৬ আগস্টের কথা। নগর ভবনের নিচতলায় ওষুধের মান পরীক্ষার আয়োজন করে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। ১২টি মশারি টানানো হয়। একেকটি মশারির ভেতরে ৫০টি করে মশা ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর মশার ওষুধ ছিটানো হলো ভেতরে। কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন ওষুধে ৮০ শতাংশ মশা কাবু হবে। কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল, ৮০ শতাংশ তো দূরের কথা, দু-একটি মশা ছাড়া সব মশাই বেঁচে আছে। কিছু মশা অজ্ঞান হলেও পরে সেগুলোকে স্বাভাবিকভাবে উড়তে দেখা যায়। আর এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে প্রতারণার একটি ঘটনা। তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকার মশা মারার ওষুধের কথা বলে ডিসিসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫০০ ড্রাম পানি।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ডিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ দ্রুত ঘটনাস্থলে যান এবং তিনি সব ওষুধ জব্দ করার নির্দেশ দেন। ৫০০ ড্রাম থেকে পাঁচটি ড্রাম দৈবচয়ন ভিত্তিতে বাছাই করা হয়েছে। কয়েকটি মশারিরতে দু-চারটি মশা মরার বিষয়কে স্বাভাবিক কারণ হিসেবে মনে করেন মান পরীক্ষকরা। সে ক্ষেত্রে ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই বলেই তাঁরা ধারণা করছেন। অ্যাগ্রো প্রডাক্টস নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এগুলো সরবরাহ করেছিল। ডিসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা এ এস এম শাহেন রেজা ওষুধ কেনার দায়িত্বে ছিলেন। গত মঙ্গলবার প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। দুই দিন পর বৃহস্পতিবার ডিসিসি এই ৫০০ ড্রাম তরল মশার 'ওষুধ' জব্দ করে। ড্রামগুলো ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশে অবস্থিত মশক নিবারণী দপ্তরে আটক রাখা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ডিসিসি।
জানা গেছে, পানির মধ্যে সামান্য ওষুধ মিশিয়ে কিছুটা গন্ধযুক্ত করে তা ভরা হয় ড্রামে। এরপর তা সরবরাহ করা হয় ডিসিসিকে। প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ার পর এ নিয়ে নগর ভবনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যাঁরা ঘটনাটি ধরতে পেরেছেন, তাঁরা ধন্যবাদের দাবিদার। এখন ঘটনার তদন্ত করে দেখা হবে কিভাবে ভেজাল ওষুধ ঢোকার ঘটনা ঘটল।' তিনি জানান, ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ভেজাল ও মানহীন কোনো ওষুধ ডিসিসি নেবে না। প্রয়োজনে নতুন করে ওষুধ কেনা হবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের গোড়ার দিকে ডিসিসি মশার ওষুধ কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। ওষুধ সরবরাহের কাজ পায় লিমিট এগ্রো প্রডাক্টস নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত ৭ আগস্ট তারা ৫০০টি ড্রামে ১০ হাজার লিটার ওষুধ সরবরাহ করে। প্রতিটি ড্রামে ২০০ লিটার করে ওষুধ থাকার কথা।
প্রচলিত নিয়ম অনুসারে একটি মশারির খাঁচার মধ্যে কিছু মশা ছেড়ে দিয়ে তার ভেতরে ওষুধ স্প্রে করা হয়। ৮০ শতাংশ মশা মারা গেলে ওষুধকে মানসম্পন্ন হিসেবে ধরা হয়। এর আগে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ড্রাম থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা হয়।
ডিসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ঠিকাদার যে দিন ওষুধ সরবরাহ করেন, ওই দিন সংরক্ষিত-১৩ আসনের মহিলা কমিশনার মাহমুদা ইসলামের মৃত্যুতে নগর ভবনে ছুটি ছিল। সেই সুযোগেই ঠিকাদার ড্রামে করে ওষুধের নামে পানি গছিয়ে দেন।
জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন যাবৎ মশার ওষুধ কেনার আড়ালে ক্রয়বাণিজ্য করে আসছে। ঠিকাদার ও ভাণ্ডার বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই প্রতারণা চলছে।
ভাণ্ডার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এবারও ডেঙ্গুতে একজন চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আর দোষ পড়ছে মেয়রের ওপর। নগরবাসী মনে করছেন, ডিসিসি মশার ওষুধ ছিটায় না। কিন্তু ওষুধ কেনার দায়িত্ব পালনকারীরাই যদি ভেজাল ওষুধ কেনে, তাহলে শত চেষ্টা করেও ডেঙ্গু ও মশক দমন করতে পারবে না ডিসিসি। তিনি মনে করেন, ওষুধের মান নিশ্চিত করতে না পারলে নগরীকে কোনোভাবেই মশকমুক্ত করা যাবে না।
ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, এই ভেজাল ওষুধের দাম ধরা হয়েছে প্রতি লিটার ৩৪৫ টাকা। অথচ প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান এসিআই বা অন্যান্য কম্পানির কাছ থেকে কিনলে এই 'এডাল্টিসাইড' ওষুধ পাওয়া যেত ১৯৫ টাকা দরে। এই মধ্যবর্তী অংশটা ওষুধ কেনার দায়িত্ব পালনকারী ও ঠিকাদাররা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
ওষুধ কেনার দায়িত্ব পালনকারী ডিসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা এ এস এম শাহেন রেজা কালের কণ্ঠের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তিনি বলেন, 'আমার ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ হবে না। বরং আপনি বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে পারেন এইভাবে যে, এই জালিয়াতি আমরা ধরতে পেরেছি। এখন আমরা প্রয়োজনে ওই ওষুধ ফিরিয়ে দেব।' কিন্তু সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ওষুধ না নিলে এমনিতেই তো তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। তারপর আর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।'
ওষুধ সরবরাহকারী ঠিকাদার মিজানুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডিসিসি ওষুধকে মানহীন বললেও কথাটা ঠিক না। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, ওষুধ পরীক্ষা করার দিন ব্যাপক বৃষ্টি ও বাতাস ছিল। আর মশারির খাঁচাগুলো করা হয়েছিল নগর ভবনের নিচতলার বারান্দায়। এতে মশারির ভেতরে স্প্রে করা ওষুধ সহজেই বাতাসে উড়ে যায়। ফলে ওষুধের আর কার্যকারিতা জোরালো থাকেনি। বাতাসের কারণে মশার গায়ে ধোঁয়াও ঠিকমতো লাগেনি। তারপরও অনেক মশা মরেছে। তিনি দাবি করেন, ওষুধে পানি মেশানো হয়নি। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করলেই সত্যতা প্রমাণিত হবে। তার আগে কেউ খারাপ বললে সেটা হবে আমাকে ক্ষতি করা।'
ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, এভাবে সরবরাহ করা ভেজাল ওষুধ রাজধানীতে ছিটানো হয়। ফলে মশা আর মড়ে না। আর এই সুযোগে লাভবান হয়েছেন কিছু কর্মকর্তা। তাঁরা ইতিমধ্যে ফ্ল্যাট-প্লটসহ বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।

No comments:

Post a Comment