Wednesday, June 08, 2011

আশা হতাশার বয়ন by সিলভিয়া নাজনীন

শিল্পীর সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে শিল্প। শিল্পের গঠন, গড়ন ও গভীরতার স্তরে স্তরে বীজের মতো ছড়িয়ে থাকে নানাবিধ সুপ্ত কথকতা। পরিশুদ্ধ আত্মার অনুনাদ ধ্বনিত হয় মহৎ শিল্পের পরম্পরায়। শিল্পীকুলের অভিলক্ষ সেই মহাসারণি। ‘কনটেমপ্লেশন’ শিরোনামে মুর্শিদা আরজু আল্পনার একক প্রদর্শনী। চলছে ধানমন্ডির ঢাকা আর্ট সেন্টারে। বার্লিন প্রবাসী শিল্পী আল্পনা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, নানা বিচ্ছিন্ন অনুভূতিকে একত্র করেছেন তাঁর চিত্রকর্মে।

শিল্প বিশ্লেষিত হয় শিল্পের সৌন্দর্য, রং, ব্যঞ্জনা, ইতিহাস, ভাষা এবং উপস্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আল্পনার চিত্রকর্মে সৌন্দর্যবোধ উজিয়ে জীবনদর্শন প্রকট হয়ে উঠেছে। ঢাকায় বেড়ে ওঠা এবং জার্মানিতে দীর্ঘ সময়ের জীবনযাপন—এই সময়কে তিনি নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর প্রতিটি ক্যানভাসে। তাঁর চিত্রপটে টেক্সটের ব্যবহার দর্শককে আরও একাত্ম হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পকর্মই শিল্পীর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ।
মাধ্যম নিয়ে শিল্পীর বিশেষ কোনো ভাবনা নেই বলেই মনে হয়। ভাবের স্ফুরণই মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাসে। অ্যাক্রেলিক, পেনসিল, কালি, চারকোল, জলরঙের ব্যবহারে বক্তব্য ফুটিয়ে তোলাই তাঁর মোক্ষ। ব্যক্তিগত গণ্ডির বাইরে তাঁর ভাবনার বলয়কে ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি গল্পের মতো বর্ণনা করেন তাঁর চাওয়া-পাওয়া, নারীসত্তার সংকট, প্রেম-বিরহ, স্মৃতি-বিস্মৃতির বহুস্তরিক আখ্যান। তাতে শিল্পগুণ পুরোপুরি রক্ষিত হয়, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
শিল্পী আল্পনার কাজ নারীবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। নারীর দৈনন্দিন সংকট, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিবিধ বর্ণনায় চিত্রতলে মূর্ত হয়ে ওঠে বর্তমান সময়ের বৈরী বিশ্বব্যবস্থা। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে তাঁর কাজ প্রতিবাদের অভিব্যক্তিতে উচ্চকিত। সারফেসকে নানা ধরনের অসংগতিপূর্ণ বিভাজনের মাধ্যমে এবং বর্ণ প্রয়োগের অমার্জিত পদ্ধতিতে তাঁর কাজে তৈরি হয় অসামঞ্জস্য এবং ভাসমানতার অনুভূতি, যা দর্শকের অস্বস্তিকে প্রকট করে তোলে।
শিল্পী তাঁর আত্মজৈবনিক অভিঘাতে উন্মুল। তৃতীয় বিশ্ব, নারী প্রশ্ন, বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ এখনো ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত। দেশ-কাল-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পের ভূমিকা কতটুকু তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিল্পীর ব্যক্তি অনুভূতির একান্ত প্রকাশের চেয়ে শিল্পে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক উপস্থিতিই বিবেচনার বিষয়। শিল্পী বলেন, তাঁর চিত্রপটে পাশ্চাত্যের বড় শহরে বসবাস ছাপ রেখেছে। প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নের উদ্রেক, রহস্যময়তা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, মর্মপীড়া, উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ফ্যান্টাসি, ট্যাবু প্রভৃতির সমাবেশ ঘটেছে।
অভিব্যক্তিবাদী শিল্পধারার সঙ্গে তাঁর কাজের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ইমেজের আপাত বিচ্ছিন্ন উপস্থিতি, রঙের পাতলা পর্দা গলিয়ে বেরিয়ে আসা ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব শিল্পী আল্পনার শিল্পকর্ম বস্তুত সময়ের অস্থির পাণ্ডুলিপি।

প্রচ্ছদের প্রবাদপুরুষ by শাশ্বতী মজুমদার

কাইয়ুম চৌধুরী যখন ঢাকা আর্ট কলেজে পড়ছেন তখন পূর্ববঙ্গে ইসলামি ভাবধারার ছবির খুব রমরমা। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি করছেন, নন অবজেক্টিভ ফর্মে ছবি আঁকছেন।

কাইয়ুম চৌধুরী এই পথের ধার দিয়েও গেলেন না। তিনি গ্রামবাংলার ছেলে। চিত্রা নদীর পাড়ে তাঁর শৈশব কেটেছে। নদী, নৌকা, জেলে আর গ্রামীণ জীবন তাঁর সত্তায় মিশে আছে। এদিকে তাঁর শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে চিত্রে তুলে ধরতেই আগ্রহী। তাঁর লোকশিল্পের সংগ্রহশালা কাইয়ুম চৌধুরীকে দেখাল নতুন পথ।
এসব কারণে কাইয়ুম চৌধুরী লোকশিল্পের কর্মকে অবলম্বন করে গ্রামবাংলার ছবি আঁকতে শুরু করলেন। সৃষ্টি করলেন তাঁর চিত্রের নিজস্ব ধারা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের ফর্মকে আধুনিক রূপদান করে শিল্প সৃষ্টি করেছেন এই শিল্পী। কাইয়ুম চৌধুরী ছবির ক্যানভাসের ক্ষেত্রেও ব্যতীক্রমী পথ গ্রহণ করেন। পেইন্টিং খুব বেশি না করে তিনি ঝুঁকলেন প্রচ্ছদের দিকে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল প্রচ্ছদের দিকে। তাঁর ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা এসেছে বইয়ের ছবি দেখে। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে ভারতবর্ষ, প্রবাসী এসব পত্রিকা আসত। এসব পত্রিকায় ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারীদের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি। এসব ছবি তাঁকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ওই ছবিগুলো দেখতাম, খুব সুন্দর ছবি। কিন্তু মনে খুব দাগ কাটত না। দাগ কাটত গল্পের বই কাঞ্চনজঙ্গা সিরিজের প্রচ্ছদ ও ভেতরে আঁকা ছবিগুলো। কাঞ্চনজঙ্গা সিরিজের সব ছবি প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা। আর ভালো লাগত সমর দের করা প্রচ্ছদের ছবি। জসীমউদ্দীনের এক পয়সার বাঁশি বইয়ের প্রচ্ছদ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
ছোটবেলায় কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদশিল্পের প্রতি যে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছিল তা-ই তাঁকে পরবর্তীকালে প্রচ্ছদশিল্পের কিংবদন্তিতে পরিণত করে।
প্রথমদিকে তাঁর চিত্রে কিছুটা কিউবিস্ট ধারার প্রভাব দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে তাঁর কাজের ধারা পরিবর্তিত হয়। তাঁর ফিগারগুলো আরও বেশি বিমূর্ত ও লিরিক্যাল হয়ে ওঠে। আমাদের লোকশিল্পের সাবলীলতা ফুটে ওঠে তাঁর শিল্পে, লোকশিল্পের ফর্মগুলোকে আত্মস্থ করেছেন নিবিড়ভাবে। লোকশিল্পীরা টেপা পুতুল বানায় বিক্রির জন্য। একটা পুতুলের পেছনে বেশি সময় তো দেওয়া যাবে না। ওরা তাই পুতুলের ফর্মটাই মিনিমাইজ করে ফেলেছে। এভাবেই গড়ে উঠেছে লোকশিল্পের নিজস্ব ধারা। কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি শিল্পচর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের চারুশিল্পের জগৎকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। এ দেশের প্রচ্ছদশিল্প ও গ্রাফিক ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনি অবিসংবাদিত একজন ব্যক্তিত্ব।

বইপত্র- প্রামাণ্য বাংলাদেশ

বাংলাদেশ: সিক্স ডিকেডস—সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান, মুহাম্মদ জমির, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম \ এপ্রিল ২০১০ নিমফিয়া পাবলিকেশন \ প্রচ্ছদচিত্র: শিশির ভট্টাচার্য্য \ দাম: ২০০০ টাকা

১৯৪৭ থেকে ২০০৭—দীর্ঘ ছয় দশকে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বহু আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে দুই বার পতাকা বদল হয়েছে। ১৯৪৭ সালে বিদেশি শাসকেরা চলে যাওয়ার সময় এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের মধ্যে যে মুক্তি খুঁজেছিল, তা তিরোহিত হতে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় এসে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পরবর্তীকালে শিক্ষা আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমেই পাকিস্তানি শাসকদের চরম জবাব দেয় বাঙালি জনগোষ্ঠী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করে সামরিক জান্তা। যার পরিণতি ২৫ মার্চের গণহত্যা। এরপর দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে, যা কেবল একটি পতাকা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতায় সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি। গণতন্ত্র ও সাম্যই ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা পেয়েছি? পেলে কতটুকু পেয়েছি, না পেলে কেন পাইনি, কাদের কারণে পাইনি—সেসব আজ ইতিহাসের বিষয়।
ছয় দশকে সাতটি প্রতিপাদ্য বিষয় বাছাই করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এর মধ্যে ‘টারবুলেন্ট ফার্স্ট ইয়ারস, ১৯৪৭-৫২’: অধ্যাপক-শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, ‘কোয়েস্ট ফর রিজিওনাল অটোনমি’: দিলারা চৌধুরী, ‘আন্ডার মিলিটারি রুল, ১৯৫৪-৭০’: আবুল মাল আবদুল মুহিত, ‘দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ১৯৭১’: মোহাম্মদ জমির, ‘দি মুজিব এরা: ১৯৭২-৭৫’: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ‘আন্ডার জিয়া অ্যান্ড এরশাদ’: মেঘনা গুহঠাকুরতা, ‘টু ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেটিক পলিসি: ১৯৯১-২০০৬’: আতাউস সামাদ।
একটি বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিশাল ক্যানভাস ধারণা সহজ নয়। আর এ ধরনের লেখায় বিশ্লেষণের সুযোগও কম। তার পরও আনিসুজ্জামানের ভাষাভঙ্গিটি বেশ সরস, এবং ধারাবর্ণনার মধ্যেও আছে নিখুত বিশ্লেষণ। অন্যান্য লেখকও অনেক পরিশ্রম করে তথ্য-উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, যাতে পাঠক চোখ বোলালে সব ঘটনার সারাংশ জানতে পারেন।
তবে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আলোকচিত্র। দীর্ঘ ৬০ বছরের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনার সচিত্র স্মারক হয়ে উঠেছে এটি। এতে দেশ বিভাগের সময়ের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে দাঙ্গাকবলিত জনপদের। আছে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল, আছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ছবি। আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাতটি শাসনামলের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রও।
সেদিক দিয়ে বলা যায়, এই বই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সম্পাদনের দায়ভার যাঁরা নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন তাঁরা হলেন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ জমির; এঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ঔজ্বল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি আবু জাফর শামসুদ্দীন

লেখক-চিন্তাবিদ আবু জাফর শামসুদ্দিন তৎকালীন ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানার দক্ষিণবাগ গ্রামে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু ১৯৩২ সালে। তিনি অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, মননশীল প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই হলো: পদ্মা মেঘনা যমুনা, প্রপঞ্চ, দেয়াল, রাজন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, শেষ রাত্রির তারা প্রভৃতি। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক পান।

১৯৪৭-এর আগস্টে দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন জাফর ভাই— আবু জাফর শামসুদ্দীন। মুসলিম লীগ নয়, বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন যৌবনের শুরুতেই। তার আগে ঢাকায় থাকাকালে ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ভাবধারাও প্রভাব বিস্তার করেছিল তাঁর ওপর। পাকিস্তানে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের জন্মলগ্নে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তার সঙ্গেও। তবে, সরাসরি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হয়তো কোনো দিনই সেভাবে ছিলেন না, বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। কিন্তু কোনো সময়ই রাজনৈতিক তথা সামাজিক দায়িত্বকে অবহেলা করেননি। সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের সময়ের কথাই বলি। দৈনিক সংবাদ-এ তাঁর নিয়মিত কলামে ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের গতিধারার সমর্থন জোগাতে চাইত, তার বিরুদ্ধে তিনি যে আপসহীন অবস্থান নিয়েছিলেন, সে জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া হতো তাঁকে। কিন্তু সে হুমকি কোনো দিন তাঁর সংকল্পে বা কাজে কোনো দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ধারার বিস্তার নিষ্কণ্টক হবে, চলার পথে প্রতিপক্ষের আঘাত আসবে না, এটা কোনো দিনই মনে করতেন না তিনি। এই প্রশ্নে তাঁর চিন্তা ছিল খুবই স্পষ্ট। আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের বাংলাদেশ শাখার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাবে স্বীকৃতি দিতে এতটুকুও ইতস্তত করেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশেষ করে মধ্য এশিয়া ঘুরে এসে তাঁর লেখায় সে দেশ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি একবারও।
পারস্পরিক সম্পর্ক যখন গভীর হয়ে উঠেছে, তখন একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বাকশালে শামিল হওয়ার আহ্বান নিয়ে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস যেদিন আপনার কাছে গিয়েছিলেন, সেদিন ও রকম পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছিলেন কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক, যে পদ্ধতিতে সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে যাওয়া হচ্ছিল, তা ছিল ভুল। আর কেন জানি মনে হচ্ছিল, যা তখন করা হচ্ছিল, তা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু না।’
জাফর ভাইয়ের সঙ্গে তখনকার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল এমন একসময়, যখন আরও বেশ কিছুদিন শুধু বেঁচে থাকাই নয়, সক্রিয়ভাবে বেঁচে থাকাটা দরকার ছিল আমাদের জন্যই।
তবে এই সময়টুকুর যেটুকু তাঁকে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, বিশ্বাসের প্রয়োজনে জীবনে যেকোনো ঝুঁকি নিতে ইতস্তত না করাটা একজন বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। ‘সত্য মূল্য’ না দিয়ে শুধু সাহিত্য নয়, কোনো ক্ষেত্রেই খ্যাতি চুরি করে জনমনে স্থায়ী আসন লাভ করা যায় না। সাহিত্যিক হিসেবে আবু জাফর শামসুদ্দিন কতটুকু কালোত্তীর্ণ বলে বিবেচিত হবেন, তা নিয়ে নানা অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন নানাজন। কিন্তু মানুষ আবু জাফর শামসুদ্দিন, সত্যনিষ্ঠ আবু জাফর শামসুদ্দিন যে অতুলনীয়, তা স্বীকার করতে সবাই বাধ্য হবেন বলে মনে করি আমি।

অদক্ষ মন্ত্রী ও আমলাতন্ত্রের ফাঁদে গতিহীন 'দিনবদল'

প্রশাসনযন্ত্রের চাকা আর চলে না। থমকে গেছে কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রম। বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা অজুহাত দেখিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাসের পর মাস। সরকারের মেয়াদের প্রায় অর্ধেক চলে গেলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুব সামান্যই। এমনকি বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও সরকারি দপ্তর পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের অবস্থাও নাজুক।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি প্রকল্প (পিপিপি) এবং সরকারের অগ্রাধিকার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয় বলে সরকারের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। জরুরি ভিত্তিতে
এখনই এ অবস্থার পরিবর্তন করা না হলে জনগণের রায়ে মহাজোট সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার মূলমন্ত্র (নির্বাচনী ইশতেহার) 'দিনবদলের সনদ ও ভিশন ২০২১' বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সরকারি কর্মকাণ্ড মন্থর হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ১৩ কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মন্ত্রীদের অতিমাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ও আমলানির্ভরতা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অহেতুক হস্তক্ষেপ, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের আমলাদের হতাশা ও আন্তরিকতার অভাব, শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড সঠিকভাবে কাজ না কারা, নিজ নিজ ডেস্ক থেকে ফাইল নিষ্পন্ন না হওয়া, বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, পুরনো বিধিবিধান অনুসরণ করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শূন্যপদ পূরণের ছাড় পেতে অহেতুক কালক্ষেপণ, দলীয় নেতা-কর্র্মীদের তদবিরে কাজের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়া এবং রুলস অব বিজনেস, সচিবালয় নির্দেশিকা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগের অনুপস্থিতি। এসব সমস্যা নিরসনে গত দুই বছরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উদ্দেশে ১১টি বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি : বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এবং মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১১৬টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশেরই বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রক্রিয়াধীন এসব প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. আবদুল করিমের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ২৩টি প্রক্রিয়াধীন। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বেশির ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, প্রক্রিয়াধীন অথবা পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায়। বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম বা বাধা থাকলেও তা জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানাতে হবে। পাশাপাশি পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্যও মন্ত্রণালয়গুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের চুক্তি : গত প্রায় আড়াই বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭টি দেশ সফরকালে সাতটি দেশের সঙ্গে ৫৭টি সিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করা হয়। চীনসহ পাঁচটি দেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৫টি। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক হয় ছয়টি। তিনটি দেশের সঙ্গে ১৪টি বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মত হয়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছয়টি দেশের কাছ থেকে পাওয়া যায় ১০টি আশ্বাস। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয় একই বছরের ৭ আগস্ট। এ ঋণের আওতায় ২০টি প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। ২০০৯ সালের ২০ থেকে ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরকালে দ্বৈত করারোপ প্রত্যাহার এবং পারস্পরিক বিনিয়োগ বর্ধন ও সংরক্ষণ চুক্তি স্বাক্ষরে দুই দেশ সম্মত হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর পর গত জানুয়ারিতে দ্বৈত করারোপ প্রত্যাহার চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু পরেরটি ঝুলেই আছে। কাতার সফরকালে কাতার এয়ারলাইনসকে দোহা-ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়। পরে এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কাতার দূতাবাসের জন্য ঢাকায় জমি ইজারা প্রদানের বিষয়ে চুক্তি হয়নি এখনো। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কুয়েত সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়ন এবং কুয়েতে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির নতুন সুযোগ সৃষ্টি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কোনো আশ্বাস মেলেনি। আর বাংলাদেশ থেকে কুয়েত দক্ষ জনশক্তি নেওয়ার আগ্রহ দেখালেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। পানিসম্পদ, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; কৃষি, শিল্প, স্বরাষ্ট্র, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় মিলিয়ে ১০টি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য না পাওয়ায় তা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি এ-সংক্রান্ত গত ২৭ ফেব্রুয়ারির সভায়। একইভাবে ২০১০ সালে চীন সফরকালে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তও কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ আছে, বাস্তবায়ন হয়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. আবদুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজের অগ্রগতি তেমন আশানুরূপ নয়। জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এডিপি বাস্তবায়ন : চলতি বছরের এডিপির আকার ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কাটছাঁট করার পর তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ১৭০ কোটি টাকায়। প্রথম ছয় মাসে বরাদ্দের ৩০ শতাংশও খরচ হয়নি। ৯ মাসে খরচ হয়েছে ৫০ শতাংশ, ১০ মাস শেষে ৬০ শতাংশ খরচ করতে সক্ষম হয়েছে সরকারের মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো। এ হারকে 'উৎসাহব্যঞ্জক' বলেছেন তদারকির দায়িত্বে থাকা আইএমইডির সচিব হাবিবুল্ল্যাহ মজুমদার। তবে কাজের গুণগত মান নিয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। বাস্তবায়নে অক্ষমতার জন্য এডিপির আকার কাটছাঁট করতে হয় স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা ও তদারকি বাড়ানোর কথা ২০০৯-১০ সালের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন। আইএমইডির কর্মকর্তারা বলেছেন, 'মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাকেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা ঢাকায় বসে থকেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা বিদেশ ভ্রমণে উৎসাহী হলেও দেশের ভেতর প্রকল্প এলাকায় যান না। এসব কারণে প্রকল্পের কাজে গতি আসে না, কাজের মানও ভালো হয় না। মাঝখানে খরচ হয় জনগণের করের টাকা আর প্রকল্প সহায়তা হিসেবে আসা বিদেশি ঋণ।'
অগ্রাধিকার প্রকল্প : ২০০৯-১০ ও চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ঘোষিত মোট ৩৬৭টি কার্যক্রমের মধ্যে ১০টি মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন করার কথা ১১২টি কার্যক্রম। জানা গেছে, এর মধ্যে মাত্র ৬৫টির অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাকিগুলোর বেশির ভাগেরই বাস্তবায়ন কাজ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা ৭৮টি নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে ৩৩টির বাস্তবায়ন হয়নি।
দুই বছরেও গতিহীন পিপিপি : সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) প্রকল্পে গত দুই অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নানা ঘোষণা এবং বেসরকারি মহলে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও গত দুই বছরে তেমন অগ্রগতি হয়নি। কেবল ঢাকা উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে পিপিপির আওতায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বরাদ্দ করা বাকি অর্থ কোনো কাজে আসেনি।
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি : নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। যোগাযোগ খাতের এমন সাতটি প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারের অপচয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এ রকম উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকল্প রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঋণ সহায়তা হাতছাড়া : প্রকল্প তৈরিতে দেরি, বাস্তবায়নে মন্থরগতি, অদক্ষতা ও অপচয়ের বিষয় বিবেচনায় এনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ ও সহায়তা থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ছেঁটে ফেলেছে।
যেসব কারণে প্রশাসনে গতি নেই
আমলাদের আন্তরিকতার অভাব ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা : বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে বিপুলসংখ্যক যোগ্য আমলাকে বর্তমান সরকার আস্থায় নিতে না পারায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের করা হয়েছে পদোন্নতিবঞ্চিত অথবা ওএসডি। আবার ঘন ঘন বদলির শিকারও হতে হচ্ছে অনেককে। এতে বিভিন্ন স্তরের আমলাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন কাজের স্পৃহা। দায়সারাভাবে কার্যদিবস শেষ করেন তাঁরা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন এবং অদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত প্রশাসনের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৯৫০ জনকে পদোন্নতি দেয়। এতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন ৬৯৭ জন কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের নবনির্বাচিত নির্বাহী কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মন্ত্রণালয়।
চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম : সরেজমিনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, যাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। একজন যুগ্ম সচিব বলেন, 'আমার ডেস্কের উপসচিব চাকরিতে আমার সিনিয়র হওয়ায় তিনি আমার কোনো নির্দেশই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে চান না। ফলে ফাইল নিষ্পত্তির কাজ ঝুলে যাচ্ছে।' প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করলেন আরেক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের (বলা হয় ১৯৮৩ ব্যাচ) একজন অতিরিক্ত সচিব, যাঁর ডেস্কের যুগ্ম সচিব হচ্ছেন ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের প্রথম ১০-এ স্থান পাওয়া কর্মকর্তা। এভাবে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড এক রকম ভেঙে পড়েছে। স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ঝুলে যাচ্ছে।
অতিমাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ও আমলানির্ভরতা : মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর পরিবর্তে অতিমাত্রায় আমলানির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সরকারের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রুলস অফ বিজনেস, সচিবালয় নির্দেশিকা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধানসহ বিভিন্ন বিধিবিধানের বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই বেশির ভাগ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর। ফলে আমলারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী যেভাবে বুঝ দিচ্ছেন, সেভাবেই চলছে সব কিছু। হয় ক্ষমতা নেই অথবা নূ্যনতম আগ্রহ নেই প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করার জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করার। এমনকি কোনো কাজে সামান্যতম জটিলতা দেখা গেলেই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য মন্ত্রীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করার নজিরও আছে। নিজ দায়িত্বে নথি ছাড় করেন না কেউ।
নথি ছাড় না করা : অন্যদিকে দায়িত্ব এড়াতে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবরা নিজ নিজ ডেস্ক থেকে নিষ্পন্ন না করে প্রায় সব নথি মন্ত্রীর ডেস্কে পাঠিয়ে নথিজটের সৃষ্টি করছেন। ভবিষ্যতে মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে_এমন আশঙ্কায় বেশির ভাগ আমলা নিজের এখতিয়ার থাকা সত্ত্ব্বেও সহজেই কোনো নথি ছাড় করেন না। কারণ মামলার আসামি হওয়ার পর দেখা গেছে, সরকারের নীতি-নির্ধারকরা সহযোগিতা করার ব্যাপারে তেমন আন্তরিক হন না। ফলে সচিবালয় নির্দেশিকা অনুযায়ী নথি ছাড় করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৭২ ঘণ্টা কার্যকর হচ্ছে না।
সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া সচিব মো. শরফুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি বর্তমান সরকারের সময় দুটি (সংস্কৃতিবিষয়ক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। দৈনিক ৫০ থেকে ৬০টি নথিতে স্বাক্ষর করতাম। এর মধ্যে মাত্র দু-তিনটি নথি আমার ডেস্কে আসার উপযুক্ত। বাকিগুলো নিচের স্তরে থেকেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা; কিন্তু তা হয় না।'
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ড. মশিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমলাদের অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যাঁরা দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করবেন, তাঁদের কোনো সমস্যা নেই। আগে কী হয়েছে তা জানি না, তবে ভবিষ্যতে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তারাই পদোন্নতি পাবেন_এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে নিশ্চিত করেছেন।' তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো নিবিড় মনিটর করা উচিত। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো আপত্তি এলে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পর সচিবদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'প্রয়োজনে আইন বা বিধি সংশোধন করে দেওয়া হবে, যাতে আপনারা কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারেন।' আইন বা বিধির কারণে কাজ ফেলে না রাখার জন্যও নির্দেশ দেন তিনি।
প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে গত দুই বছরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উদ্দেশে ১১টি বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়। যেমন, ২০০৯ সালের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দেয় তাঁর কার্যালয়। যাঁদের কারণে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় ওই চিঠিতে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা রুলস অব বিজনেসের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে প্রশাসনে ফাইলজটের সৃষ্টি করছেন বলে একই বছর ৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ২৬ এপ্রিল অর্থসচিব এবং ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলাদা তিনটি চিঠি দিয়ে সব সচিবদের স্মরণ করিয়ে দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান এসব ব্যাপারে বলেন, কর্মকর্তাদের আস্থায় নিতে না পারলে তাঁরা সরকারের কাজকে নিজের কাজ মনে করতে পারবেন না। চাকরির বয়স ২৫ বছর হওয়ার পরপরই একজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরের আতঙ্ক পেয়ে বসে। স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেন না তাঁরা। আর যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা প্রশাসনে। কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিদ্যমান এসব সমস্যা জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করা না হলে সরকারের দিনবদলের সনদ ও ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন প্রকৃত অর্থেই দুরূহ হয়ে পড়বে। দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

বেগম খালেদা জিয়ার বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা

পস্থিত সহকর্মী, সুধী, এক্সেলিন্সিস, সাংবাদিকবৃন্দ,
আস্‌সালামু আলাইকুম।
৭ জুন ২০১০ সালে চলতি অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে আমাদের কিছু চিন্তা-ভাবনা ও বাজেট প্রস্তাবনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলাম। আমাদের এই বাজেট প্রস্তাবনা উত্থাপনের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণা তুলে ধরা। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতির সামনে একটি দিক-দর্শন তুলে ধরা আমরা দায়িত্ব মনে করি। সেই চিন্তা থেকেই আমরা গত বছর বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার আমাদের ধারণাগুলোকে কোনো গুরুত্বই দেয় নি। যার ফলে আজ সামষ্টিক অর্থনীতির সকল সূচক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এক কথায় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। বিগত দুই দশকেও একই অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসমূহ এমন বিপর্যয়ে পড়েনি। যাইহোক, বিদায়ী অর্থছরের মতো আমরা এবারও একই আঙ্গিকে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের উপর বাজেট প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা এমন এক প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের রায়ের অজুহাতে বাতিলের ঘোষণা দিয়ে সুষ্ঠু বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ রূদ্ধ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। আমরা একদিকে যেমন রাজপথের সংগ্রামে রয়েছি, তেমনি তার পাশাপাশি আমাদের জাতি গঠনমুলক কর্মকাণ্ড সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও অব্যাহত রাখতে চাই।


সুধী মন্ডলী,
আমরা বিশ্বাস করি, বাজেট হবে মানুষের জন্য, উন্নয়নের জন্য, উৎপাদনের জন্য। আর বাজেট বরাদ্দের নীতি হবে সামাজিক উৎপাদনশীলতার নিরিখে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। বর্তমান বাস্তব অবস্থার নিরিখে বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্যখাত এবং ভৌত-অবকাঠামো খাত বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের ওপর আমরা বেশ কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম। আমাদের দিক-দর্শন এবং প্রস্তাভাবনা এ বছরেও পুরোনো হয়ে যায় নি। এ কারণে বিদায়ী অর্থবছরের প্রস্তাবনাগুলোও সংক্ষিপ্তরূপে আপনাদের নজরে আনা হলো।

বিএনপির অর্থনৈতিক দর্শন
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী প্রায় চল্লিশ বছরের মধ্যে আওয়ামী শাসনাধীন প্রথম সাড়ে তিন বছরকে বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ আখ্যায়িত করেছিলেন “দি লস্ট মোমেন্টস” বা “হারানো মুহূর্ত” রূপে। সেই সময় বাংলাদেশ একটি “তলাবিহীন ঝুড়ি” বলেও পরিচিতি অর্জন করেছিল। সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের নীতি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনের অবাধ সুযোগ করে দেয়। গড়ে উঠে একটি উৎপাদনবিমুখ লুটেরা শ্রেণী। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া উন্নয়ন ও উৎপাদনের অর্থনীতি প্রবর্তন করে এই ধারা রোধ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু জেনারেল এরশাদের আমলে স্বৈরশাসনের সমর্থনের ভিত তৈরি করার প্রয়াস একটি ঈৎড়হু ঈধঢ়রঃধষরংস এর জন্ম দেয়, যার নেতিবাচক প্রভাব আজও অব্যাহত। বর্তমান সরকারের শাসনামলে ক্ষমতাবানদের আত্মীয়-স্বজন এবং অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে খাজনা বিতরণের (উরংঃৎরনঁঃরড়হ ড়ভ জবহঃ) প্রবণতা দুঃখজনকভাবে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর ফলে অদক্ষ হাতে সমপদ কুক্ষিগত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আয় বণ্টন এবং কর্মসংস্থানের উপর।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ব্যক্তি উদ্যোগ এবং গণসৃজনশীলতা-নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। ব্যক্তি উদ্যোগ ও গণসৃজনশীলতাকে গতিশীল করার জন্য বিএনপি রাষ্ট্রের সহায়ক ভূমিকায় বিশ্বাস করে। বিএনপি আরও বিশ্বাস করে যে, একটি সুঠাম এবং প্রতিযোগিতার শক্তিতে বলিয়ান ব্যক্তি-উদ্যোক্তা শ্রেণী ছাড়া একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শনের বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একটি ব্যক্তি-উদ্যোক্তাগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠীটির মধ্যে সবচাইতে সৃজনশীল ও প্রাণবন- গোষ্ঠীটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মূলতঃ নিজস্ব সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে এবং কোনো প্রকার ব্যাংক ঋণের প্রত্যাশা না করে এরা নতুন নতুন উদ্যোগ সৃষ্টি করছে। এদের মধ্যেই নিহিত আছে আগামী দিনের অর্থনীতির গতিশীল ও প্রাণবন- ধারা। নীচ থেকে গড়ে উঠা এই উদ্যোগ (ঊহঃবৎঢ়ৎরংব ভৎড়স নবষড়) ক্রমান্বয়ে শক্তি অর্জন করে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাকে বেগবান করবে। বিএনপির লক্ষ্য হলো, এদেরকে কার্যকর নীতি সহায়তা দিয়ে স্বাবলম্বী ও আত্ম-মর্যাদাবোধে বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা। যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে উৎপাদন ও উন্নয়নের পথে উত্তরণ ঘটাতে চায় বিএনপি। বিএনপি পরনির্ভরশীলতার অর্থনীতি থেকে দ্রুততম সময়ে বেরিয়ে আসতে চায়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে ৪৯ শতাংশ পর্যন- সংস্থান দেশীয় সম্পদের মাধ্যমে করতে সক্ষম হয়। পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময় জাতীয় উন্নয়নে দেশীয় সমপদ যোগানোর প্রয়াস শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। সেই সময় সরকারের প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর জন্য বৈদেশিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলতার সৃষ্টি হয়। একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশের জন্য এর চাইতে লজ্জ্বাকর অবস্থা আর কি হতে পারে?

বিএনপি একটি কল্যাণমুখী দরিদ্রবান্ধব কর্মসংস্থান সৃজনকারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। আয় বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস করে দেশীয় বাজার সম্প্রসারণের নীতিতে বিশ্বাসী বিএনপি। বিএনপি কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাতে সমৃদ্ধ জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চায়। এই লক্ষ্য দ্রুততম সময়ে পুরণের জন্য একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে চায় বিএনপি। বিএনপি তাই শিক্ষা, গবেষণা, কৃৎ-কৌশল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং গবেষণা ও উন্নয়নের প্রতি যথাসাধ্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রদানের নীতিতে বিশ্বাস করে। আমরা মনে করি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অব্যাহত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে খাদ্যে স্বয়ম্ভর হওয়ার কোনো বিকল্প জনবহুল বাংলাদেশের নেই।

বিএনপি বাজার প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্রের ভূমিকার সর্বোত্তম সমন্বয়ে বিশ্বাসী। জাতীয় অর্থনীতিকে সর্বোত্তমভাবে সংগঠিত করতে ব্যক্তি মালিকানা, সমবায়ভিত্তিক মালিকানা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার পারস্পরিক পরিপূরকতায় বিশ্বাসী বিএনপি। সামাজিকভাবে অনগ্রসরগোষ্ঠীসমূহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ সহায়তা প্রদানের নীতিতে বিশ্বাসী বিএনপি। শিক্ষার বিস-ার, স্বাস্থ্যসেবা, আয়বর্ধন, সামাজিক বৈষম্য নিরসন প্রভৃতি নানামুখী কর্মসূচির বাস্তবায়ন করে সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার নীতিতে বিশ্বাস করে বিএনপি। নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী পুরুষকে সমভাবে দেশ গড়ার সৈনিকে পরিণত করতে চায় বিএনপি।

বিএনপি সবসময় নন-গভ:সংস্থাসমূহকে জাতীয় উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত হতে সুযোগ করে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিএনপি চায় এমন একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা কোনো গোষ্ঠীকে এড়িয়ে যাবেনা, প্রতিটি মানুষ মানুষের মর্যাদা পাবে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা এবং বাছাই ও পছন্দের অধিকার (ঈযড়রপব)  নিশ্চিত হবে। সম্পূর্ণ অবসান ঘটবে ধর্মীয় ও জাতিগত ভেদ বৈষম্যের। বাংলাদেশের মাটিতে এবং এর উন্মুক্ত আকাশের নীচে প্রতিটি মানুষ হবে একে অপরের স্বজন। উন্নত জীবনবোধের নৈতিকতায় প্রত্যেক নাগরিক হবে মানুষের মতো মানুষ। সকল প্রকার বৈষম্য, শোষন বঞ্চণা এবং অবহেলার বিরুদ্ধেই বিএনপির রাষ্ট্রীয় নীতি পরিচালিত হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত নাজুক। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জমি ইজারা নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মন-ব্য করেছে তাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা বলেছে “বৈদেশিক মুদ্রার মজুত মূলতঃ কয়েকটি পণ্য রপ্তানি এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো আয়ের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে রয়েছে খুবই স্বল্প পরিমানে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ। সম্প্রতি রপ্তানি বাড়লেও এর চেয়ে বেশি বেড়েছে আমদানী (রপ্তানি বেড়েছে ৪১%, কিন্তু আমদানি বেড়েছে ৫১%)। প্রবাসী আয়ে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি থাকলেও মূলধন হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ পরিস্থিতি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ফলে বৈদেশিক দায় পরিশোধে দেশে বিদেশী মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) চাপের মধ্যে ও তা নিম্মমুখী। এই পরিস্থিতিতে টাকার মূল্যমান ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

গত মার্চ ২০১১ পর্যন্ত (বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য) সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি ৫২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। চলতি হিসেবে ৬৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত থাকলেও তা চলতি জুন মাসের হিসাব সমন্বয়ের পর ঘাটতিতে পরিণত হবে। সূত্রমতে, বুধবার (১.৬.১১) দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমান ছিল এক হাজার তেতাল্লিশ কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমান বৈদেশিক মুদ্রা।
সারের দাম বৃদ্ধি
যেখানে উৎপাদনের উপকরণ সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করে কৃষককে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য প্রণোদনা দেয়ার কথা, সেখানে ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি ১২ টাকা থেকে ২০ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে, অর্থাৎ দাম বাড়ানো হয়েছে ৬৭ শতাংশ। এর ফলে গত বছরের তুলনায় একই পরিমান সার ব্যবহার করলে শুধু এই উপকরণের জন্য উৎপাদন খরচ বাড়বে প্রায় ৪০ শতাংশ। কেননা কৃষকরা ইউরিয়া ব্যাপক হারে ব্যবহার করে। এর ফলে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ারও ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

‘ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। লাভ ফড়িয়া মজুদদারদের’ - প্রথম আলো, ২রা জুন, ২০১১। খবরে প্রকাশ সরকারিভাবে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় ঠাকুরগাঁয়ের মজুদদারেরা ফড়িয়াদের মাধ্যমে কমদামে ধান কিনে পরবর্তী সময়ে সরকার ঘোষিত দরে বিক্রির আশায় গুদামজাত করছেন। মজুদদারেরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফড়িয়াদের সঙ্গে আলোচনা করে ধানের দর নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে শ্রম ও পুঁজি খাটিয়ে কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেলেও ফড়িয়া মজুদদাররা শস্য সংগ্রহ নিয়ে সরকারের সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে ফায়দা তুলে নিচ্ছে। সরকারই ফড়িয়া মজুদদারদের স্বার্থে কাজ করছে।
মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি
চলতি অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে স্থিতিশীল রেখে তা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতির ধারে কাছে নেই মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ এপ্রিল মাসে ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার ১০.৬৭, মার্চ ২০১১ এ হার ছিল ১০.৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে চলমান গড় হিসাবে ২০১১ এর এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৮.৫৪ শতাংশ। দরিদ্র দেশগুলোর জনগণের আয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় খাদ্য ক্রয়ে। ফলে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে খাদ্যপণ্যের দামের উপরই নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির উঠানামা। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখন আতঙ্কজনক পর্যায়ে চলে গেছে। গত এপ্রিলে (২০১১) খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৪.৩৬ শতাংশ। আগে মার্চে ছিল ১৩.৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ৩.৯৭ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৪.৩২ শতাংশ।

ব্যবধান বেড়েছে শহর আর গ্রামের মানুষের মধ্যেও। গ্রামে দারিদ্র্যের হার বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপও বেশি। গত এপ্রিলে পল্লী অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যসূচকে ১৫.৩৮ শতাংশ ও খাদ্য বহির্ভূত সূচকে ৩.৯২ শতাংশ। অন্যদিকে এপ্রিলে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৬২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে খাদ্যসূচকে ১২.০৪ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত সূচকে ৪.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ গরীব মানুষের উপর বাজেটের আগেই কর বসেছে ১০.৬৭ শতাংশ।
অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বলা হয়েছিল, “দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।”

অথচ টিসিবির মূল্য তালিকা (মার্চ ২০১১) অনুযায়ী বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ, আটার দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ এবং ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৫ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দরিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য ক্রয়ে। এর মধ্যে কেবল চালই কিনতে হয় ৩৩ শতাংশ আয় দিয়ে। সুতরাং চালের দাম বাড়লে জনগোষ্ঠী খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যায়। দারিদ্র্য বাড়ে। উচ্চ-মূল্যস্ফীতি আয় বৈষম্য বৃদ্ধি করে। আন-র্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই,এম,এফ) মনে করে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়াই বিপদজনক। সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশ সেই বিপদজনক পরিস্থিতিতে পড়েছে।

দ্রব্যমূল্যের প্রভাব নিয়ে পরিচালিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ২০১০-১১ স্ট্যাডি থেকে ২০১০ এর জুলাই থেকে ২০১০ এর ডিসেম্বর পর্যন- খাদ্যমূল্যের বিশ্লেষণে জানা যায়, খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ায় নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং কিছু মানুষ এ সীমা অতিক্রম করায় (০.৪৯%), সার্বিকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ মানুষ। এ পরিসংখ্যান ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের। অবস্থার দ্রুত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে আরও ৩ শতাংশ মানুষ যে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। উল্লেখ্য যে, ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন- বিএনপির শাসনামলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪৯ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছিল।

বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ
বর্তমান অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিশ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি আশা করা হয়েছিল। কিন্তু, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এই খাতে পাওয়া গেছে মাত্র ৪,৬২৭ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরে প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমান ছিল ৯,১৪৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান আর্থিক বছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশী ঋণ পাওয়া গেছে ১২৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, কিন্তু বিগত অর্থবছরে একই সময়ে পাওয়া গিয়েছিল ১৭৭ কোটি ডলার যার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে তুলনামূলকভাবে বেশ কম সাহায্য পাওয়া গেলেও পরিশোধ করতে হয়েছে বেশি। দুর্নীতি, মানবাধিকার, সুশাসন প্রভৃতি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দাতাগোষ্ঠীর দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় দাতাগোষ্ঠী পূর্বের ন্যায় অর্থ ছাড় করছে না। বৈদেশিক ঋণের প্রবাহের পরিমান কমেছে ৩৮%।
স্পেশাল ইকনমিক জোন
ভারতীয় বাণিজ্য সংস্থার পক্ষ থেকে সিলেটের ছাতকে শুধু মাত্র ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘স্পেশাল ইকনমিক জোন’ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন। এই স্পেশাল ইকনমিক জোনের জন্য ৪০০ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। যেসব ভারতীয় ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এই স্পেশাল ইকনমিক জোনে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহ দেখাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে টাটা, বিরলা, টিভিএস গোষ্ঠীসহ অন্যান্য বড় বড় ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী। এদের লক্ষ্য হল উত্তর পূর্ব ভারতের শিল্প পণ্যের চাহিদা পুরণ করা। বাংলাদেশের শিল্পপতিরা ধারণা করেছিলেন ট্রানজিট ব্যবস্থা চালু হলে তারাই সীমান-বর্তি অঞ্চলে কলকারখানা স্থাপন করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। ভারতীয় ব্যবসায়ী মহলের প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশী শিল্পপতিদের আশাআকাঙ্খা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমার মনে করি এ ধরণের প্রস্তাব অনুমোদনের পূর্বে বাংলাদেশী শিল্পপতিদের স্বার্থ সরকারকে অবশ্যই বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।
ভারতের সংগে ১ বিলিয়ন ডলারের কঠিন শর্তযুক্ত ঋণচুক্তি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারত থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই ঋণচুক্তির অধীনে যে সব প্রকল্প বাস-বায়িত হবে তার লক্ষ্য হল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের করিডোর সুবিধা ব্যবহার সহজতর করা। এই ঋণের জন্য ১.৭৫% হারে সুদ দিতে হবে। অথচ বিশ্ব ব্যাংক এ ধরণের ঋণ দেয় ০.৭৫% সুদে। ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সহ ১৫ বছরে এই ঋণ শোধ করতে হবে। বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষেত্রে শর্তটি হলো ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছরে পরিশোধ। কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে ০.৫ শতাংশ হারে। এই শর্তটিও বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। ভারতই প্রকল্পের পরামর্শক সেবা দেবে। ৮৫ শতাংশ উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ভারত থেকেই কিনতে হবে, বাকী ১৫ শতাংশ উপকরণ অন্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করা গেলেও ভারতের এক্সিম ব্যাংকই তা সংগ্রহ করবে। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী পার্টিগুলোর পাওনা ভারতের এক্সিম ব্যাংক সরাসরি পরিশোধ করবে। প্রকল্পের কোনো অর্থ বাংলাদেশের হাতে আসবে না। প্রকল্পের কন্ট্রাক্টরগণও হবেন ভারতীয়। জয়েন্ট ভেনচারের ক্ষেত্রে ৫১ শতাংশ মালিকানা থাকবে ভারতীয় কোম্পানীর। সকল পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ নিজ উদ্যোগে ভারতীয় অনুমোদন ছাড়া এই ঋণের অধিনে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে না। এই ঋণ চুক্তি শতকরা ১০০ ভাগ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী। কারণ কঠিন শর্তের ভারতীয় ঋণ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের করিডোর সুবিধা ব্যবহারের জন্যই ব্যয়িত হবে। ইতোমধ্যে সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ব্যবহারের জন্য ফি দাবি করাকে ‘অসভ্যতা’ বলে মিডিয়ার কাছে উল্লেখ করেছেন। অথচ বর্তমান সরকারের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা ইতিপূর্বে দাবি করেছিলেন ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিংগাপুর হয়ে যাবে। বাস-বে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস- হয়ে আরো নিঃস্ব হয়ে পড়বে।
এ, ডি, পি বাস্তবায়ন
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে এখন চলছে নৈরাজ্যকর অবস্থা। মন্ত্রী পরিষদ ও উপদেষ্টা মন্ডলীর দ্বৈত শাসনের ফলে সিদ্ধান্তহীনতা, স্থবিরতা এবং সরকারের অভ্যন্তরে চিন্তার ঐক্যের অভাব প্রশাসনকে এমন স্তরে নিয়ে গেছে যে এর দ্বারা জনগণের কোন মঙ্গল আশা করা যায় না। জানা যায়, বর্তমান সরকারের কর্মকর্তারা ভয়ভীতি ও ত্রাসের মধ্যে থাকার ফলে এবং তাঁদের উপর অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক খবরদারি ও হস্তক্ষেপের ফলে এ,ডি,পি বাস্তবায়নে আশানুরূপ উদ্যোগ গ্রহনে তাঁরা সাহস পাচ্ছে না। বর্তমানে এডিপি বাস্তবায়নে অদক্ষতা সরকারের ব্যর্থতারই একটি নজির।

পরবর্তী এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা ১০৩৯ এর মধ্যে ৯৬২টি প্রকল্প বর্তমান অর্থবছর থেকে স্থানান্তরিত। ৭৭টি প্রকল্পের জন্য নতুন অর্থায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩৪টি বিনিয়োগ প্রকল্প, ১৪৩টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প এবং ৬২টি জেডিসিএফ দ্বারা অর্থায়নকৃত।

চলতি অর্থবছরে প্রথম ১০ (দশ) মাস শেষে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি মাত্র ৬০ শতাংশ বাস-বায়ন হয়েছে। ৮৭টি প্রকল্পে কোন অর্থই ব্যয় করা হয়নি। অর্থাৎ জুলাই থেকে এপ্রিল ২০১১ পযনর্- ২০ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, শেষ দুই মাসে ১৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। প্রতি বছরেই সরকার যে আকারের এ, ডি, পি, করে, তা বাস-বায়ন না করতে পেরে সংশোধন করা হয়। সংশোধিত এ,ডি, পিও শেষ পযনর্- বাস-বায়ন হয় না।

এ দিকে গত দুই অর্থবছর ধরে বাজেটে সরকারী বেসরকারী অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় বিনিয়োগের ব্যাপক আশাবাদ প্রকাশ করা হলেও এখন পর্যন- কোন অগ্রগতি নেই। গত বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও নীতিনির্ধারণী কাঠামো প্রণয়নে ব্যর্থতার কারণে একটি টাকাও খরচ করা সম্ভব হযনি। আগামী অর্থবছরেও শুনছি তিন হাজার কোটি টাকা এই খাতে বরাদ্দ দেয়া হবে। এমনকি পিপিপির দপ্তর গঠনের ঘোষনা দেওয়া হলেও তা’ও করতে পারেনি সরকার। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে খরচ না করে অন্যান্য প্রকল্পে খরচ করার ফলে উন্নয়ন ব্যয়ের মান ব্যাহত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের সময়ে গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম হাই-ওয়ে চার লেন প্রকল্প, যাত্রাবাড়ী ফ্লাই-ওভার ও রেলওয়ের ডাবল লাইন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শুরু না করে বর্তমানে নতুন করে কার্যাদেশ দিয়ে এগুলোর ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় কয়েকগুণ। উল্লেখ্য যে, আমাদের সময় প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কমিটির (চওঈঙগ) নীতি কাঠামোর আওতায় ১৬টি বিনিয়োগ প্রস-াব প্রক্রিয়াকরণ করে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।


আমরা মনে করি, সরকারী কর্মকান্ডের উপর রাজনৈতিক হস-ক্ষেপ বন্ধ করে আস্থার মনোভাব ফিরিয়ে আনতে হবে। সময়মত অর্থছাড় করে প্রকল্পের বাস-বায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। বছর ব্যাপী সুষম হারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে বছরের প্রথম থেকেই রাজস্ব সংগ্রহের গতি বাড়াতে হবে। রাজস্ব প্রশাসনের ভিন্নতা বিবেচনায় রাজস্ব প্রশাসন পরিচলনায় নীতি পরিবর্তন ও সংস্কার করতে হবে।

উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়ের মধ্যে সম্পন্ন না হওয়ায় একদিকে যেমন ব্যয়, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপও বৃদ্ধি এই দ্বি-মুখী নেতিবাচক চাপ প্রতিহত করার লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রশাসনকে তৎপর করে তোলা প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্পের বাহুল্য কাঙ্খিত উন্নয়ন অর্জনের পরিপন্থি।

আগামী অর্থবছরের জন্য ৪৬ হাজার কোটি টাকার নতুন এ,ডি,পি অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এন,ই,সি)। এই অর্থ আপাতঃদৃষ্টিতে বিগত বছরের এডিপির তুলনায় বড় দেখালেও বর্তমান মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করলে এই অর্থ তেমন বেশি নয়। এর মধ্যে সরকার যোগান দেবে ২৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী সহায়তার প্রত্যাশা ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এই সরকারের আমলে চলতি অর্থ বছরের সময়মত বৈদেশিক সাহায্য না আসার ফলে এডিপি বাস্তবায়ন মন্থর হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা যায় না। স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ যোগান দিতে ব্যাংক ব্যবস্থার উপর অতি নির্ভরশীলতায় একদিকে বেসরকারী খাতে ঋণের সরবরাহ সংকুচিত হবে, অন্যদিকে বেসরকারী খাতে উৎপাদন ব্যাহত হবার ফলে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।
কী রকম বাংলাদেশ দেখতে চাই

সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা তরুণ গণযোদ্ধা ও সৈনিকেরা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপর তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিল। অগণিত মানুষের রক্ত, অশ্রু, শ্রমের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই স্বৈরব্যবস্থার ভস্মস্তূপ থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ করেছিলেন। তবে ১৯৮২ এবং ২০০৭ সালে এই গণতন্ত্র ব্যাহত করে স্বৈরশাসন প্রবর্তিত হয়েছিল। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদেরকে সংগ্রামের পথে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে হয়েছে।

শহীদ জিয়ার লক্ষ্যই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নির্যাস-সঞ্জাত। সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং উন্নয়ন ও উৎপাদনের পথে সমৃদ্ধি অর্জন।

আমাদের ভবিষ্যত স্বপ্ন ও লক্ষ্য হচ্ছে, পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় সক্ষম এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে ক্ষুধা, অপুষ্টি, অশিক্ষা, সামাজিক অবিচার, মানবাধিকার লঙঘন এবং শোষণ, বঞ্চনা ও কোনো ধরণের বৈষম্য থাকবে না। আমরা আগামী দশকের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্ব সভায় সম্মান ও মর্যাদার আসনে আসীন দেখতে চাই। সেই লক্ষ্য ও স্বপ্ন বাস-বায়নকল্পেঃ

ক    বিশ্বাসযোগ্য এবং পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা
খ    কার্যকর এবং জবাবদিহিতামূলক সংসদের নিশ্চয়তা
গ    একটি স্বাধীন, দক্ষ, রাজনৈতিক হস-ক্ষেপ বিবর্জিত এবং দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা
ঘ    মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং আইনের শাসনের নিশ্চয়তা
ঙ    দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত এবং দল-নিরপেক্ষ গণ এবং পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলা
প্রশাসনিক
আমরা একটি দক্ষ, গতিশীল, যুগ-উপযোগী ও গণমুখি প্রশাসন গড়ে তুলতে চাই।

সেই লক্ষ্যে
ক    স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক নীতিনির্ধারনী প্রক্রিয়া চালু করা
খ    স্বচ্ছ এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা
গ    সকল পর্যায়ে ব-মড়াবৎহধহপব চালু।
ঘ    স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা
আমরা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও নীতি কাঠামো গড়ে তুলতে চাই যার মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দ্রুত দারিদ্র্যমুক্ত একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার পথে এগিয়ে যাবে।

সেই লক্ষ্যে
ক    কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিকীকরণ এবং বহুমুখীকরণ
খ    শিল্পখাতে অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জন
গ    সেবা খাতকে দরিদ্র মানুষের নিছক টিকে থাকার আশ্রয়স্থল থেকে সর্বাত্মক সমৃদ্ধির বাহনে রূপান্তরিত করা
ঘ    রপ্তানী খাতের বহুমুখীকরণ
ঙ    বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চাহিদার নিরিখে বিশ্বায়নের বাস-বতার সংগে সঙ্গতি রেখে দেশীয় বাজারমুখী শিল্পায়ন
বৈদেশিক শ্রমবাজার
আমরা এমন একটি মানব সম্পদ উন্নয়ন নীতি চাই যার মাধ্যমে সম্ভব হবে
ক    বিদেশে রপ্তানিযোগ্য শ্রমিকদের দক্ষ শ্রমিকরূপে গড়ে তোলা।
খ    বিদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ নার্সদের বিরাট চাহিদার সুযোগ গ্রহণের জন্য দেশে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে উচ্চ মানের নার্সিং ইনস্টিটিটিউট গড়ে তোলা।
ঘ    এক কথায় বিদেশে প্রেরণযোগ্য শ্রমশক্তির কারিগরি ও প্রযুক্তিগত মান উন্নয়ন।
স্বাস্থ্যবান জাতি
আমরা একটি স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনকল্পে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি বাস্তবসম্মত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ নীতি প্রণয়ন করতে চাই।

যার লক্ষ্যে হবে
ক    আগামী দশকের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরো উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য প্রণোদনা ও বস্তুগত সহায়তা প্রদান।
খ    গরিব ও বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে নাগরিকদের জন্য নিবারণ ও নিরাময়মূলক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ, আওতা ও পরিধি এবং মান উন্নত করা।
গ    শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার আরও নামিয়ে আনতে এবং তাদেরকে অপুষ্টি থেকে বাঁচাতে শিশু ও মাতৃসেবার উন্নয়ন।

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।