Wednesday, June 08, 2011

আশা হতাশার বয়ন by সিলভিয়া নাজনীন

শিল্পীর সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে শিল্প। শিল্পের গঠন, গড়ন ও গভীরতার স্তরে স্তরে বীজের মতো ছড়িয়ে থাকে নানাবিধ সুপ্ত কথকতা। পরিশুদ্ধ আত্মার অনুনাদ ধ্বনিত হয় মহৎ শিল্পের পরম্পরায়। শিল্পীকুলের অভিলক্ষ সেই মহাসারণি। ‘কনটেমপ্লেশন’ শিরোনামে মুর্শিদা আরজু আল্পনার একক প্রদর্শনী। চলছে ধানমন্ডির ঢাকা আর্ট সেন্টারে। বার্লিন প্রবাসী শিল্পী আল্পনা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, নানা বিচ্ছিন্ন অনুভূতিকে একত্র করেছেন তাঁর চিত্রকর্মে।

শিল্প বিশ্লেষিত হয় শিল্পের সৌন্দর্য, রং, ব্যঞ্জনা, ইতিহাস, ভাষা এবং উপস্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আল্পনার চিত্রকর্মে সৌন্দর্যবোধ উজিয়ে জীবনদর্শন প্রকট হয়ে উঠেছে। ঢাকায় বেড়ে ওঠা এবং জার্মানিতে দীর্ঘ সময়ের জীবনযাপন—এই সময়কে তিনি নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর প্রতিটি ক্যানভাসে। তাঁর চিত্রপটে টেক্সটের ব্যবহার দর্শককে আরও একাত্ম হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পকর্মই শিল্পীর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ।
মাধ্যম নিয়ে শিল্পীর বিশেষ কোনো ভাবনা নেই বলেই মনে হয়। ভাবের স্ফুরণই মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাসে। অ্যাক্রেলিক, পেনসিল, কালি, চারকোল, জলরঙের ব্যবহারে বক্তব্য ফুটিয়ে তোলাই তাঁর মোক্ষ। ব্যক্তিগত গণ্ডির বাইরে তাঁর ভাবনার বলয়কে ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি গল্পের মতো বর্ণনা করেন তাঁর চাওয়া-পাওয়া, নারীসত্তার সংকট, প্রেম-বিরহ, স্মৃতি-বিস্মৃতির বহুস্তরিক আখ্যান। তাতে শিল্পগুণ পুরোপুরি রক্ষিত হয়, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
শিল্পী আল্পনার কাজ নারীবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। নারীর দৈনন্দিন সংকট, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিবিধ বর্ণনায় চিত্রতলে মূর্ত হয়ে ওঠে বর্তমান সময়ের বৈরী বিশ্বব্যবস্থা। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে তাঁর কাজ প্রতিবাদের অভিব্যক্তিতে উচ্চকিত। সারফেসকে নানা ধরনের অসংগতিপূর্ণ বিভাজনের মাধ্যমে এবং বর্ণ প্রয়োগের অমার্জিত পদ্ধতিতে তাঁর কাজে তৈরি হয় অসামঞ্জস্য এবং ভাসমানতার অনুভূতি, যা দর্শকের অস্বস্তিকে প্রকট করে তোলে।
শিল্পী তাঁর আত্মজৈবনিক অভিঘাতে উন্মুল। তৃতীয় বিশ্ব, নারী প্রশ্ন, বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ এখনো ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত। দেশ-কাল-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পের ভূমিকা কতটুকু তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিল্পীর ব্যক্তি অনুভূতির একান্ত প্রকাশের চেয়ে শিল্পে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক উপস্থিতিই বিবেচনার বিষয়। শিল্পী বলেন, তাঁর চিত্রপটে পাশ্চাত্যের বড় শহরে বসবাস ছাপ রেখেছে। প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নের উদ্রেক, রহস্যময়তা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, মর্মপীড়া, উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ফ্যান্টাসি, ট্যাবু প্রভৃতির সমাবেশ ঘটেছে।
অভিব্যক্তিবাদী শিল্পধারার সঙ্গে তাঁর কাজের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ইমেজের আপাত বিচ্ছিন্ন উপস্থিতি, রঙের পাতলা পর্দা গলিয়ে বেরিয়ে আসা ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব শিল্পী আল্পনার শিল্পকর্ম বস্তুত সময়ের অস্থির পাণ্ডুলিপি।

No comments:

Post a Comment