Thursday, August 11, 2011

সরকার আদিবাসীদের অধিকারের কথা স্বীকার করে নাঃ সন্তু লারমা

দিবাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক দুটি অনুষ্ঠানে গতকাল বুধবার বক্তারা ‘আদিবাসী’ কথাটির বিষয়ে সরকারের সাম্প্রতিক অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এত দিন সমস্যা না থাকলেও এখন এ নিয়ে নেতিবাচক কথা বলায় প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। কয়েকজন বক্তা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনের পক্ষেও মত দেন। ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমি কমিশনের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে সভাপতি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা। তিনি এতে অভিযোগ করে বলেন, এই সরকার গণতন্ত্র আর সুশাসনের কথা বললেও তারা আদিবাসীদের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা স্বীকার করে না। সন্তু লারমা পার্বত্য চুক্তির সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনকে কার্যকর করারও দাবি জানিয়েছেন।
আগারগাঁওয়ের এলজিইডি ভবনে এই সেমিনারের আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্মস ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। বাঙালি-আদিবাসী বিতর্কের প্রসঙ্গ তুলে আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, আমরা নাকি বিদেশি আর বাঙালিরা আদিবাসী। সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, আদিবাসীরাও বাঙালি। আমি যদি বলি, তিনি (শেখ হাসিনা) জাতি হিসেবে চাকমা, তাতে তিনি কি রাজি হবেন? আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলাম কায়েম করার জন্যই এসব করা হচ্ছে।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘জিয়ার আমলে যে বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল, এই সরকার সেই বৃক্ষকে এখনো কেন জিইয়ে রাখছে! ...কাগুজে মালিকানা দিয়ে আদিবাসীদের জমি আত্মসাৎ করা হচ্ছে। তামাক চাষের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির কাছে জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে। এতে জটিলতা বাড়ছে। দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না করলে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে।’
‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবির। তিনি এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তিতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও তা ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা তো তাদের ভোট দিয়েছি ইশতেহার দেখে। এখন এমন কী হলো যে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না? আসলে প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই সরকার এখন আদিবাসী বলতে নারাজ।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, ‘আদিবাসীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আর আমলারা পাহাড় কিনে নিচ্ছেন। ছেলেমেয়ের বিয়েতে তাঁরা পাহাড় উপহার দেন। এসব বন্ধ করতে হবে।’
সামাজিক বনায়ন নীতিমালার মাধ্যমে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তথ্য কমিশনের সদস্য সাদেকা হালিম। তিনি আরও বলেন, ভূমি কমিশনের কাজ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা, ভূমি জরিপ নয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা করে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বহু জাতির বাস। অথচ আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি বলে পরিচিত হবে। এতে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ পেয়েছে।’
সন্তু লারমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা।
‘সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ’: ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নির্বাচিত আদিবাসীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া উপায় নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই শতাধিক আদিবাসী নির্বাচিত হয়েছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদ তাঁদের এই সংবর্ধনা দেয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
শিশু একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাংসদ হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সরকার আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়নি। উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসহ বিভিন্ন নাম দিয়েছে। সরকার যে নামেই ডাকুক, আমি আদিবাসীই বলব। আপনারাও নিজেরা নিজেদের আদিবাসীই বলুন। মূর্খদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। লড়াই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হোন।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘আদিবাসীদের সাংবিধানিক প্রশ্নে সরকার কিছু কিছু প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা আমরা বুঝতে চাই। কেননা, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের বন্ধু। প্রধানমন্ত্রীকে যারা ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কমিশন তাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী শব্দ আছে। আর এখন আদিবাসী মানুষকে বাঙালি বানিয়ে জাতিসত্তাকে অস্বীকার করছে সরকার। এতে করে লড়াইয়ের বাইরে আর পথ দেখি না।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি অনিল মারান্ডি বলেন, ‘সরকার আমাকে কী নামে ডাকবে, তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। আমাকে বাঙালি বানিয়ে আমার সাঁওতাল পরিচয় মুছে দিতে চাচ্ছে। আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই।’
অনুষ্ঠানে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে ১৫১ জন আদিবাসী জনপ্রতিনিধিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পার্বতীপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের সদস্য বিচিত্রা তিরকি বলেন, ‘আমরা এত দিন কথা বলার সুযোগ পাইনি। পরিষদের বিভিন্ন ভাতা ও কর্মসূচি থেকে আমরা বাদ পড়তাম। এবার কথা বলতে পারব।’ অন্য জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে বিচিত্রা তিরকি বলেন, ‘কার্ড বিতরণে আপনারা টাকা নেবেন না। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সমস্যার সমাধান করবেন। নেটওয়ার্কের যুগ, একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।’
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা জনপ্রতিনিধি নৃপেন্দ্রনাথ মাহাতো, সুনীল কান্তি দেওয়ান, অমলাচিং মারমা প্রমুখ বক্তব্য দেন। জনপ্রতিনিধিরা বেহাত হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার, সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় ও আদিবাসী নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার করেন।
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের দেশীয় পরিচালক বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেন ও পরিষদের সদস্য বিমলচন্দ্র রাজোয়ারও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

পুলিশ বেপরোয়া রুখবে কে by শরীফুল ইসলাম ও সাহাদাত হোসেন

বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। একের পর এক লোমহর্ষক ও বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এ সংস্থাটি। জানমাল রক্ষার পরিবর্তে পুলিশ এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পুলিশকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ সমালোচনাও হচ্ছে। সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। জনমনে প্রশ্ন, বেপরোয়া এ পুলিশকে রুখবে কে? বিশিষ্টজনরা এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নেওয়া বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের প্রথাও বন্ধ করার কথা বলেছেন তারা। এসব ঘটনায় সারাদেশ তোলপাড়। নিরুদ্বিগ্ন শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটায়। ১৬ বছরের এক কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপর গণপিটুনিতে সে মারা
যায়। এ নির্মম হত্যাকা পুলিশের সামনেই ঘটে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও টেপ প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। ঘটনাটি বিবেকমান মানুষকে হতবাক, অশ্রুসিক্ত করেছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে নিয়ে পুলিশের 'প্যাকেজ' নাটক আরেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। এর আগে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ওই ছাত্রদের ডাকাত বানানোর অপচেষ্টা চালায়। এর আগে ঝালকাঠিতে লিমনকে গুলিতে আহত করে র‌্যাব। তাকেও সন্ত্রাসী বানানোর নানা অপচেষ্টা চালানো হয়।
কখনও কখনও স্বতঃপ্রণোদিত উচ্চ আদালত নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। পুলিশকে ভর্ৎসনাও করেছেন। এতেও তেমন সুফল আসছে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা, পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পুলিশের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং এবং চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে পুলিশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধ কমাতে হলে পুলিশকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। অপরাধী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটি না করলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
তবে পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। এগুলোকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, পুলিশ প্রশাসন বিগত সময়ের চেয়ে অনেক ভালোভাবেই চলছে। পুলিশ প্রশাসনের ভালো কাজের কারণেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। নির্বিঘ্নে সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। এতে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব প্রথাসিদ্ধ বক্তব্য।
প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এসএম শাহজাহান সমকালকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। দলীয়করণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। এতে সরকার ও পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। পুলিশকে বিরোধী দল দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঘটনা এক : ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ঘটে এক অকল্পনীয় ঘটনা। মিলন নামে ১৬ বছরের এক কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর গণপিটুনিতে সে মারা যায়। অবিশ্বাস্য এ হত্যাকা ঘটে পুলিশের উপস্থিতিতে। কোম্পানীগঞ্জে ওইদিন ডাকাত সন্দেহে পৃথক স্থানে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছিল। এর মধ্যে টেকেরবাজার মোড়ে মারা হয় তিনজনকে। তাদেরই একজন কিশোর শামছুদ্দিন মিলন। মিলনকে মারা হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। আর বাকি দু'জনকে মারা হয় ভোরবেলায়। মিলনকে হত্যার অভিযোগ এনে তার মা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। এ ঘটনায় 'দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে' শনিবার রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানার তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ এখানেই তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এ ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছে।
ঘটনা দুই : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে ডাকাত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। তাকে তিনটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করে। পুলিশের দাবি, ১৫ জুলাই রাতে ঢাবি ছাত্র আবদুল কাদের ও মামুন হোসেন নামে অপর একজনকে গ্রেফতার করা হয়। গাড়িযোগে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের প্রস্তুতিকালে খিলগাঁও বিশ্বরোড এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা চারজন পালিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, স্থানীয় জনতা কাদের ও মামুনকে গণপিটুনি দেয়। তবে গণপিটুনির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাদেরকে গ্রেফতার করে খিলগাঁও থানা পুলিশ নির্মম নির্যাতন চালায়। খিলগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ কাদেরকে কুপিয়ে জখম করেন। সংবাদপত্রে এমন মর্মন্তুদ খবর প্রকাশিত হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জামিনে মুক্তি পান কাদের। অনেকের অভিযোগ, কাদেরের মতো অনেককেই পুলিশ ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। কাদেরের বিষয়টি আলোর মুখ দেখলেও অনেক ঘটনাই থাকে আড়ালে।
ঘটনা তিন : চলতি বছরের ১৮ জুলাই আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পরও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমিনবাজারের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কিশোর আল আমিন জানায়, স্থানীয় জনগণ যখন তাদের বেধড়ক পেটাতে থাকে তখন সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। পুলিশের এক সদস্যকে পা জড়িয়ে ধরে তারা বলতে থাকে, 'ভাই আমরা ডাকাত নই। আমরা ঘুরতে এসেছি।' এরপর এক পুলিশ সদস্য তাকে বলে, 'যদি বাঁচতে চাস, তাহলে ডাকাতির পক্ষে সাক্ষী দিতে হবে। না হলে তোকে গ্রামবাসীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।' আমিনবাজারের ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকাকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা সরকারের কাছে জানতে চান হাইকোর্ট।
ঘটনা চার : ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিমনকে ২৩ মার্চ বিকেলে র‌্যাব-৮-এর একটি দল আটক করে। এ সময় লিমন নিজেকে কাঁঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলে পরিচয় দেন; কিন্তু র‌্যাবের এক সদস্য লিমনের কথা না শুনেই তার বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়। লিমনের এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশি-বিদেশি একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। আদালত লিমনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়। এরই মধ্যে তদন্ত দল তাদের রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে; কিন্তু রিপোর্টটি ফ্রিজে চলে গেছে। আজ পর্যন্ত রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো লিমনকে দোষী বানাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক বক্তব্য দেন।
সমন্বয়হীনতা : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিককালে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করেছে সমকাল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করা হয়। তাদের মতে, পুলিশে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। চেইন অব কমান্ডও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। ফলে এসব ঘটনা ঘটছে।
অভিযোগ রয়েছে, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পুলিশকে কোনো নির্দেশ দিলেও তারা শুনছে না। তারা দোহাই দিচ্ছে কোনো উপদেষ্টা বা দলীয় কোনো উচ্চ পর্যায়ের নেতার। গত জুনে পুলিশের এক কর্মকর্তার ব্যর্থতার কারণে তার কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে বদলি করতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারকে নির্র্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হেডকোয়ার্টার থেকে বলা হয়, সরকারের একজন উপদেষ্টার নির্দেশ রয়েছে তাকে ওই কর্মস্থলে বহাল রাখার। এ ব্যাপারে তারা লিখিত একটি চিঠিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠান। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গটি চেপে যান। এভাবে পুলিশের কিছু কিছু অপরাধের দায়ভার নিতে হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভায় পুলিশের যে পদমর্যাদার কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার কথা তারা উপস্থিত না থেকে প্রতিনিধি হিসেবে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পাঠাচ্ছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। বারবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বৈঠকের জন্য নির্ধারিত কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা তা মানছেন না। বিশেষ করে পুলিশের পদোন্নতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিপিসির বৈঠকে আইজিপির উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত থাকছেন না। আইজিপির প্রতিনিধি দিয়ে মিটিং চালাতে হচ্ছে। ফলে সঠিক মূল্যায়ন করে অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে যে তালিকা পাঠানো হচ্ছে তাদেরই যাচাই-বাছাই না করে পদোন্নতি দিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পদায়নের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। এর প্রভাব পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে পড়ছে।
মাঠ পর্যায়ে পুলিশ : তৃণমূলে ওসি শুনছেন না এসপির কথা, আবার এসপি শুনছেন না ডিআইজির কথা। তারা কথায় কথায় এমপি-মন্ত্রীদের দোহাই দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে পুলিশের অপরাধপ্রবণতা। অপরাধ করলেও শাস্তি দেওয়ার মতো কেউ থাকছেন না। এসব অপরাধ তদন্তে পুলিশের কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পুলিশের এসব অপরাধী। এমনকি অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব পুলিশ কর্মকর্তাকে শাস্তি না দিয়ে প্রাইজ পোস্টিংও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাৎক্ষণিক এসব কর্মকর্তাকে লঘু শাস্তি দেওয়া হলেও পরে এ শাস্তি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আর অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশকে গুরুদণ্ড না দেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এ বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট হওয়ায় ওসিসহ কর্মকর্তা নিয়োগ হচ্ছে স্থানীয় এমপিদের ইচ্ছায়। বিনা বাক্যব্যয়ে এমপির হুকুম তালিম করা না হলে তাকে শাস্তিমূলকভাবে বদলি করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসহায়।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের বক্তব্য : পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তবে মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়াচ্ছে_ এটা অস্বীকার করছি না। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে আপস করে না, যার প্রমাণ পুলিশের বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নজির। বাংলাদেশ পুলিশের যে সংখ্যক সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা জনপ্রশাসনে নজিরবিহীন।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, সাভারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কাদেরের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
পুলিশ প্রায়ই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে_ এটা এড়ানো সম্ভব কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে তারা কী ভাবে জনগণের বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। পুলিশের প্রশিক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীতে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সমঅধিকার, লিঙ্গ ইত্যাদি অনেক বিষয়েই আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। কাদের ও সাভারের বড়দেশী গ্রামের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশেই থাকবে কী ভাবে পরে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের ভালো সমঝোতা রয়েছে। আমরা বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই কাজ করছি।
এমন অভিযোগ পাওয়া যায় ওসিদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের 'মধুর' সম্পর্কের কারণে পুলিশের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে_ এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। পুলিশের প্রত্যেক সদস্য তার কাজের বিষয়ে অবগত। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যক্তিগত বিষয়।
সাবেক দুই মহাপরিদর্শকের বক্তব্য : সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এম আজিজুল হক সমকালকে বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের গোটা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। নোয়াখালীতে পুলিশের সামনে গণপিটুনিতে এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক ও নিষ্ঠুর ।
এক প্রশ্নের জবাবে আজিজুল হক আরও বলেন, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। এতে পুলিশের চেইন অব কমান্ড কিছুটা হলেও বিঘ্ন হয়। সব কিছুর পরও বিপদে পড়লে মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পুলিশের কাছেই যায়। সেখানে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। এটা ঠিক, যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় ওসির শাস্তি হয়েছে। নোয়াখালীর ঘটনায়ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাভারের আমিনবাজারের ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, পুলিশের বর্তমান কিছু কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তাদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে কোথাও যেন একটা গলদ রয়েছে। নোয়াখালী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় মনে হয় পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের আইন-কানুন সম্পর্কে জানা নেই। সব পুলিশ সদস্যকেই তাদের দায়িত্ব ও আইন-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দেওয়া হয়।