Tuesday, January 18, 2011

পুরোপুরি ফিট না হলে মাশরাফির বিশ্বকাপ খেলা উচিত নয়

বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও টেস্ট-পূর্ব সময়ে এ দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রকিবুল হাসান দেশের সেরা বোলার মাশরাফি বিন মুর্তজার ইনজুরিকে একটি দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘পুরোপুরি ফিট না হলে মাশরাফিকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা উচিত নয়।’

রকিবুল হাসান মাশরাফিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘এ সম্পদকে আমাদের দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে হবে। একটি বিশ্বকাপে মাশরাফি যদি না-ও খেলতে পারে, তাহলে সেই ক্ষতি স্বীকার করেও মাশরাফিকে সুস্থ করে তুলতে হবে।’ বিশ্বকাপের মতো একটি বড় আসরে মাশরাফি পুরো ফিট না হয়ে খেললে, সেটা তাঁর ক্যারিয়ারের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে মনে করেন রকিবুল হাসান।
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজিত হচ্ছে, এ ব্যাপারটি রকিবুল হাসানকে দারুণ উদ্বেলিত করেছে। প্রথম আলো অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেমনই খেলুক, আমরা বিশ্বকাপের আয়োজক—এ ব্যাপারটিই আমার কাছে খুব আনন্দময়।’ তিনি আরও বলেন, গত দুই বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ভালো খেলছে, তাই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভালো না করার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল নিয়ে আলাদা কোনো ভাবনা নেই এ দেশের ক্রিকেটের অন্যতম বোদ্ধা রকিবুল হাসানের। তাঁর মতে, নির্বাচকদের জন্য বিশ্বকাপ দল নির্বাচন তেমন কঠিন হবে না। কারণ, একটি দলকে প্রায় দুই বছর ধরেই তাঁরা তৈরি করেছেন। তাঁরা সাম্প্রতিককালে ভালো খেলছে। তবে এবারের ঘরোয়া মৌসুমে কয়েকজন খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স নির্বাচকদের গ্যাম্বলিংয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
রকিবুলের মতে, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস দুজনই স্থান পাবেন। তবে, বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে রকিবুল সুযোগ পান না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘রকিবুলের মধ্যে আমি আমাকে খুঁজে পাই। ও দলে থাকলে আমার ভালো লাগে। আমি আগেও বলেছি, রকিবুল হাসান ও মুশফিকুর রহিম—এ দুজন বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে ভালো টেকনিকের ব্যাটসম্যান। কিন্তু রকিবুলের খেলার ধরনটা ওয়ানডে ক্রিকেটের সঙ্গে যায় না। এ কারণে বিশ্বকাপ দলে সে না-ও থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের টেস্ট দলে রকিবুল অবশ্যই সুযোগ পাবে।’ রকিবুল হাসান রকিবুল সম্পর্কে আরও বলেন, ‘সে উইকেটে সেটল হতে অনেক বেশি বল নষ্ট করে। এরপর তাড়াহুড়া করতে গিয়ে আউট হয়। বর্তমান পাওয়ার প্লের যুগে সেটল হতে বেশি বল নষ্ট করা এক ধরনের অপরাধ।’
বিশ্বকাপ দল থেকে আশরাফুলকে বাদ দেওয়ার কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা বোকার রাজ্যে বাস করেন বলে রকিবুল মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আশরাফুলকে বাদ দেওয়ার কি কোনো কারণ আছে? সে এ দেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। সে এ মুহূর্তে ফর্মে রয়েছে। তাকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ দল ভাবাই যায় না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার যে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ও বড় দলগুলোর বিপক্ষে তার রান করার ইতিহাস রয়েছে।’
সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মো. আশরাফুল—এ তিনজন খেলোয়াড়ের খেলার ধরনই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেয় বলে রকিবুল মন্তব্য করেন। এ তিনজনই বাংলাদেশের ম্যাচ উইনার। তাই সাকিব ও তামিমের সঙ্গে একজন ম্যাচ উইনার হিসেবে আশরাফুলের একাদশে থাকাও বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন।

স্কুলযাত্রায় অন্য আনন্দ by মানসুরা হোসাইন

বাসে উঠতে-নামতে নেই হুড়োহুড়ি। ভেতরেও নেই সিট নিয়ে ঝগড়াঝাটি। নির্দিষ্ট জায়গায় নামার সময়ও বাসের চালক ও সহকারীরা নিচ্ছেন বাড়তি যত্ন। ঢাকা নগরে এমন বাসের অস্তিত্ব আছে, ভাবতে বেশ অবাকই লাগে। তবে নতুন চালু হওয়া স্কুলবাসে এমন দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে।

ফলে যাতায়াতের সমস্যায় পীড়িত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা খুব খুশি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবছেন, সাতসকালে নিত্যদিনের অন্তত একটি ভোগান্তির তো অবসান হলো।
গতকাল সোমবার ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা। শ্যামলীতে এসে থামল একটি স্কুলবাস। অপেক্ষমাণ মা ও মেয়ে ধীরে-সুস্থে বাসে ওঠার পর বাসটি আবার চলতে শুরু করল। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে প্রতিবেদক বাসের চালক ও হেলপারের অনুমতি নিয়ে বাসটিতে উঠলে তীব্র প্রতিবাদ জনালেন অভিভাবকেরা। তাঁদের সোজা কথা, ‘শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ছাড়া অন্য কেউ এই বাসে উঠতে পারবেন না।’ তাঁরা অবশ্য শান্ত হলেন, স্কুলবাসের হালহকিকত কেমন তা জানতেই বাসে ওঠার বিষটি জানানোর পর। সক্ষোভে তাঁরা বললেন, আগে লোকাল বাসে স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তোলা হতো না। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে শিক্ষার্থীর এক পা বাসে, অন্য পা মাটিতে, তখন বাসটি চলা শুরু করে দিয়েছে। নামার সময়ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নামতে হতো। নতুন এই স্কুলবাস চালু হওয়ায় সেই অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। এটি যেন চালু থাকে, সেই দাবি সবার।
গত রোববার থেকে ১৪টি স্কুলবাস নেমেছে রাজধানীর পথে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) তত্ত্বাবধানে পল্লবী থেকে টেকনিক্যাল হয়ে আজিমপুর পর্যন্ত চলছে বাসগুলো। প্র্রতি ১০ মিনিট পর পর সকাল ছয়টা (শীতে সাড়ে ছয়টা) থেকে নয়টা, আবার বেলা ১১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করছে বাসগুলো। থামছে মোট ৩৩টি নির্দিষ্ট স্থানে। নগরের ২৬টি স্কুল এই বাসের সেবা পাচ্ছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখে হাসি: এই বাস সার্ভিস চালুর মূল উদ্দেশ্য নগরের যানজট কমানো। তবে ব্যক্তিগত গাড়িটি বাসায় রেখে সন্তানকে বাসে করে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছেন তেমন একজন অভিভাবককেও পাওয়া গেলো না বাস চালুর দ্বিতীয় দিনটিতে। বিভিন্ন বাসে যাতায়াতকারীরাই সেবাটি নিতে এসেছেন। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা প্রয়োজন বলে অভিভাবকেরা অভিমত ব্যক্ত করলেন। তবে যাঁরা এই সেবা নিচ্ছেন, তাঁরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন।
মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা রায়হানা পারভীনের দুই সন্তান পড়ে গভর্নমেন্ট বয়েজ ও সেন্ট জোসেফ স্কুলে। আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বললেন, ‘সিট তো পাওয়াই যেত না, ভাড়াও বেশি ছিল। সবচেয়ে মুশকিল ছিল বাসে নিতেই চাইত না। এসব ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পেলাম বলেই মনে হচ্ছে।’
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সবুর খন্দকারের মেয়ে ভিকারুননিসা নুন স্কুলের আজিমপুর শাখায় পড়ে। তিনি বললেন, ‘লোকাল বাসে মেয়েকে একা ছাড়তে পারতাম না। কিন্তু এই বাসের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়ে একাই স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে।’
তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা সকালে ১০ মিনিটের বদলে পাঁচ মিনিট পর পর বাসগুলো চালুর দাবি জানান। কোনো কারণে একটি বাস ধরতে না পারলে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া থামার জায়গাগুলোও কিছুটা ভিন্নভাবে নির্ধারণ করলে ভালো হবে বলে তাঁদের মন্তব্য।
বাস নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থামলেই বাসের কর্তব্যরত তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) ওয়াসিমুল হক সহকারীকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ‘বাচ্চাটাকে সাবধানে নামাও।’ শিক্ষার্থীদের বলছেন, ‘তাড়াহুড়ো করবে না। বাস থামার পর ধীরে ধীরে নামবে। আগে আগে বাম পা দেবে।’ তিনি জানালেন, অন্য বাসে কাজ করার সময় এ ধরনের সতর্কতা কখনোই মেনে চলতেন না।
বাসের চালক শামসুল হক জানালেন, বাস চালানোর ক্ষেত্রে তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীর সঙ্গে একজন অভিভাবকও স্কুলবাসে যাতায়াত করতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত।
তবে অনেক অভিভাবকই এখনো স্কুলবাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না। পথে যেখানে যেখানে বাস থামছে, সেখানে এসে অনেকে সময়সূচি জেনে নিচ্ছিলেন। তবে অন্য এলাকার অভিভাবকেরা যখন জানলেন যে এই সেবা তাঁদের কাজে লাগবে না, তখন তাঁরা কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেন প্রথম আলোর কাছে।
কিছু কাজ বাকি: বাসে প্রশিক্ষিত নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। বিআরটিসির পরিচালক (কারিগরি) কর্নেল আকতার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ২৬টি স্কুলে টিকিট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কেউ ১৫ দিন বা এক মাস বা বিভিন্ন মেয়াদের টিকিট নিয়ে রাখতে পারবেন। এর বাইরে যেকোনো স্কুল কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করবে বিআরটিসি। কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে কেউ উঠতে চাইলে নির্দিষ্ট ভাড়া দিয়েও উঠতে পারবেন। যে কাজগুলো এখনো বাকি আছে, সেগুলো দ্রুত করারও আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা। তিনি এই সেবা চালু রাখতে সহায়তা করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।

হবিগঞ্জ : শান্তির শহরে হঠাৎ রেষারেষি

৫ বছর পেরোনো করিমুন্নেছা একটি ভোট দিতে চেয়েছিলেন। ছেলে ফরহাদ এলাহী সেতু মাকে কোলে করে স্থানীয় আবাসিক এলাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে কেন্দ্রটি দখল হয়ে যায়। ওই মাকে ফিরতে হয় ভোট না দিয়েই।

হবিগঞ্জে ২০০৪ সালের পৌর নির্বাচনের ভোট না দিতে পারার এই কষ্টটি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় ছেলে সেতুকে। সেতুর মা কি এবার ভোট দিতে পারবেন? এবারও কি দখল হবে ভোটকেন্দ্র?
ছিমছাম শান্তির শহর হবিগঞ্জে আজ পৌর নির্বাচন। এখানে মূল লড়াই মহাজোট প্রার্থী শরীফ উল্লাহ ও বর্তমান মেয়র এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জি কে গউছের মধ্যে। কিন্তু নির্বাচনের আগের দিন গতকাল শহরবাসীর মনে ও মুখে ছিল শুধুই আতঙ্কের ছাপ। গত ১৩ বছর ধরে পৌর নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি এই আতঙ্কের মূল কারণ। মহাজোট ও বিএনপি সমর্থিত দুই প্রার্থীর মধ্যে হামলা, মামলা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে শান্ত শহরবাসীর মনে এ আতঙ্ক ভর করে। পাশের পৌর এলাকা শায়েস্তাগঞ্জে অফিস পোড়ানো ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা এই আতঙ্ককে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তবে দুপুর ২টা থেকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক তৎপরতায় অনেকে কিছুটা আশ্বস্ত হন।
শহরের স্বনামধন্য সংস্কৃতিকর্মী রুমা মোদক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছিল। এবারও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আমরা চাইছি একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, যেখানে আমরা এবার নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারব।’
শহরবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই হবিগঞ্জ পৌর নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি শুরু হয়। ওই সময় শহীদ উদ্দিন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিভু চৌধুরীকে পরাস্ত করেন ভোটকেন্দ্র দখল করে। পরে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে বর্তমান মেয়র জি কে গউছ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শহীদ চৌধুরীকে পরাস্ত করেন একইভাবে ভোটকেন্দ্র দখলের মধ্য দিয়ে। নিজের আমল থেকে ভোটকেন্দ্র দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে সাবেক আওয়ামী লীগ দলীয় পৌর চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দিন চৌধুরী দোষ চাপাচ্ছেন বর্তমান মেয়র জি কে গউছের ঘাড়ে। শহীদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আমি ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি চালু করিনি। ওই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভু চৌধুরীকে পরাজিত করেছি জনগণের কাছ থেকে পাওয়া ভোটের মধ্য দিয়ে। ২০০৪ সালের পৌর নির্বাচনে বর্তমান মেয়র প্রার্থী জি কে গউছ সাত-আটটি কেন্দ্র দখল করে ‘কেন্দ্র দখলের’ সংস্কৃতি চালু করেন।”
তবে জি কে গউছ বলেন, ‘২০০৪ সালের নির্বাচনে আমি প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছি। আমি কোনো ভোটকেন্দ্র দখল করিনি। বিরোধীরা আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এই প্রচারণা চালাচ্ছে।’
গত দুই বছরে হবিগঞ্জে অন্য রকম সৌহার্দের রাজনীতি চলেছে। ছিল না কোনো হানাহানি। এমনকি বর্তমান মেয়র জি কে গউছ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আবু জাহিরের সঙ্গে গোপনে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলেছেন। কিন্তু পৌর নির্বাচনের কয়েকটি দিন সামনে রেখে শুরু হয়েছে রেষারেষি। হানাহানির আশঙ্কায় খোদ রাজনীতিকরাই ভীত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাবরণকারী, একাধিক মামলার আসামি জি কে গউছ নিজেই ভীত। বললেন, ‘আমি ও আমার কর্মীরা নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। সেনা মোতায়েন না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আমি আজ (গতকাল) প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি।’
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাজোট ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে এখন চরম বৈরি অবস্থান। সর্বশেষ গত শুক্রবার দুপুরে শহরের চৌধুরী বাজারে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জি কে গউছের সমাবেশ চলছিল। ওই সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবনসহ অন্য নেতারা। বিএনপি অভিযোগ করেছে, এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা বিএনপিদলীয় নেতাদের ওপর হামলা চালায়। গউছের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, ওইদিন মহাজোটের প্রার্থী শরীফ উল্লার পক্ষে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির ও অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান শত শত দলীয় কর্মী নিয়ে শহরে মিছিল করেছেন। ওইদিন রাতেই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম রানা বাদী হয়ে জি কে গউছের ভাই জি কে গফফারসহ ৫৩ দলীয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন। জানা গেছে, বিএনপি প্রার্থী গউছ এই হামলার ব্যাপারে থানায় এজাহার দায়ের করলে থানা এটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি শেখ কবিরুল হোসেন বলেন, মহাজোটের দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছি। এরপর বিএনপির অভিযোগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জি কে গউছ গতকাল দুপুরে পরিস্থিতি বর্ণনা করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন আমার কর্মীরা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’ তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে থানার ওসি কবির বলেন, ‘আমরা কাউকে হয়রানি করছি না। ওয়ান্টেড আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
মহাজোট প্রার্থী শরীফ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হবিগঞ্জে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি হামলা চালিয়ে অশান্ত পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপির চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ নেতা ইলিয়াস আলী আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় দুই সংসদ সদস্যকে কটাক্ষ করে গত শুক্রবার উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে সব ধরনের অপতৎপতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আছি।’

গরিবের চাল পাচার by গরিবের চাল পাচার

৬ জানুয়ারি, রবিবার দুপুর ২টা থেকে ৩টা এই এক ঘণ্টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারের ভেতর দিয়ে তেজগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার রাস্তায় একে একে এসে থামে বেশ কয়েকটি ট্রাক। ট্রাকগুলোতে চালের বস্তা। বস্তার গায়ে লেখা ‘খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য’।

চাল ভরা বস্তার পাশাপাশি কিছু খালি বস্তাও থাকে। ট্রাকগুলো সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের জন্য একেকটি দোকানের সামনে থামে। কয়েকজন শ্রমিক দ্রুত চালের বস্তাগুলো নামিয়ে ফেলেন। এরপর খুব তাড়াতাড়ি ট্রাকগুলো চলে যায়। দোকানের শাটার নামিয়ে ফেলা হয়।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় গরিব মানুষের জন্য ওএমএসের চাল বিক্রির একটি ট্রাকের সামনে প্রায় ২০০ মানুষের লাইন। পশ্চিম শেওড়াপাড়ার আমেনা বেগম জানান, সকাল সাড়ে ১০টায় চাল কিনতে এসেছেন। তখন দুটি লাইনে প্রায় আড়াই শ মানুষ ছিল। এখন সামনে আছে তিনজন। আজ তিনি চাল পেতেও পারেন।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, কারওয়ান বাজারে গত রবিবার যে ট্রাকগুলো চাল নামিয়ে গেছে, সেগুলো এই গরিব মানুষদের কাছে কম দামে বিক্রির জন্য সরকারের দেওয়া ওএমএসের চাল। এগুলো পাচার হয়ে চলে আসছে দোকানে দোকানে। বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৩৫ টাকা কেজি দরে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এ চাল খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ডিলাররা পান সাড়ে ২২ টাকা কেজি দরে। দেড় টাকা কমিশন ধরে তাঁদের সেটা দরিদ্রদের কাছে বিক্রি করার কথা ২৪ টাকা করে। কিন্তু তাঁরা ‘ঘুষ দিয়ে আনতে হয়’Ñএ অজুহাতে এই চালের একটা অংশ পাচার করে দেন।
জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ীরা
ডিলারদের কাছ থেকে সেটা কেনে ৩০ টাকা কেজি দরে আর খুচরা দোকানে সেটা বিক্রি হয় কমপক্ষে ৩৫ টাকা দরে। এভাবে চোরাই চক্রের কারসাজিতে
দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হয় কম দামের চাল থেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও তাদের ফিরে যেতে হয় খালি হাতে।
বরাদ্দ পাওয়া চালের বড় অংশ নিয়মিতই এভাবে পাচার করছে ওএমএসের ট্রাকসেল, দোকান ও ফেয়ার প্রাইস কার্ডের (এফপিসি) ডিলাররা। এ অভিযোগে গত ২২ দিনে সারা দেশে ছয়জনের ডিলারশিপ বাতিল করেছে খাদ্য অধিদপ্তর।
শুধু তাই নয়, ওএমএসের চাল নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরো গুরুতর তথ্য। পাচারের এ ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য নিতে গেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তদন্তদল পাঠান কারওয়ান বাজারে। তারা আবার সেখানে গিয়ে উদ্ঘাটন করে যে, ওই চাল পুলিশের রেশনের এবং সেটাও অবৈধভাবে পাচার হয়ে চলে এসেছে বাজারে। কালের কণ্ঠের তোলা ছবিতে চালের বস্তায় খাদ্য অধিদপ্তরের সিল স্পষ্ট দেখা যায়। কর্মকর্তারা বলেন, এই সিল ওএমএস এবং পুলিশের রেশনেরÑদুই রকম চালের বস্তাতেই থাকে।
রাজধানীর ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ পাওয়া যায়, সরকারি চাল বরাদ্দ পেতে খাদ্য অধিদপ্তরের গুদামের দারোয়ান থেকে শুরু করে রেশন অফিসের কর্মকর্তাদের লটপ্রতি ২০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ফলে চাল বিক্রির কমিশনের টাকা প্রায় পুরোটাই চলে যায়। এ খরচ পোষাতেই ডিলাররা কিছু চাল বিক্রি করে দেন ব্যবসায়ীদের কাছে। আর এ কাজে তাঁদের সহায়তা করেন ঢাকা রেশনিং অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে ওএমএস চালুর পর এ পর্যন্ত সারা দেশের ছয়জন ডিলারের ডিলারশিপ ও লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আমরা সর্বাÍক চেষ্টা চালাচ্ছি এসব অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার। খাদ্য অধিদপ্তরের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ডিলার এ কাজ করে থাকতে পারে। তবে এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। যারা এসব কাজ করছে, তারা ধরা পড়ে যাচ্ছে।’
একজন ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিটন চালের ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া পরিদর্শককে দৈনিক ৫০০ টাকা, ডিও লেখাতে ১০০ টাকা, চাল মাপাতে লেবার চার্জের বাইরে অতিরিক্ত ২০০ টাকা, ডিও পোস্টিং করাতে ১০০ টাকা, গেট পাস পেতে ৫০ টাকা, দারোয়ানকে ২০ টাকা, ডিও পোস্টিংয়ের পিয়নকে ২০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে কখনো কখনো এ হার কমবেশি হয়।’
ওই ডিলার আরো বলেন, ‘ট্রাকসেল কর্মসূচির (ট্রাকে ওএমএসের চাল বিক্রি) একজন ডিলার দৈনিক তিন টন (তিন হাজার কেজি) চাল বরাদ্দ পান। প্রতি কেজিতে দেড় টাকা কমিশনে তাঁর লাভ হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। লাভের টাকার চার হাজার টাকা চলে যায় ঘুষের পেছনে। এর সঙ্গে দৈনিক এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা ট্রাক ভাড়া এবং চাল বিক্রির তিনজন শ্রমিকের মজুরি ৬০০ টাকা খরচ যোগ করলে লাভের বদলে উল্টো এক হাজার ৩০০ টাকা লোকসান দিতে হয়।’
ওই ডিলার বলেন, ‘এ কারণেই রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশের বেশির ভাগ ডিলার বরাদ্দ পাওয়া চালের বড় অংশ বিক্রি করে দেন। ২৪ টাকা কেজির চাল গোপনে বিক্রি করা হয় ৩০ টাকা দরে। এক টন চাল গোপনে বিক্রি করতে পারলেই ছয় হাজার টাকা লাভ হয়।’
ফেয়ার প্রাইস কার্ডের একজন ডিলার জানান, প্রতি মাসে চাল ও গম মিলিয়ে পাঁচ টন খাদ্য বরাদ্দ পান তিনি। এগুলো ছাড় করা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাঁর ব্যয় হয় ১০ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু আয় হয় সাড়ে সাত হাজার টাকা। এ কারণে চাল পাওয়ার পরপরই ডিলাররা অল্প কিছু সারা মাসে বিক্রির জন্য রেখে বাকিটা গোপনে বেচে দেন।
ফেয়ার প্রাইস কার্ডের ওই ডিলার বলেন, একটি চক্র আছে, যারা গরিব মানুষকে চাল দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে ফেয়ার প্রাইস কার্ড সংগ্রহ করে রেখে দেয়। পরে ওই কার্ড ব্যবহার করে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে চালের হিসাব দেয়।
কারওয়ান বাজারে যারা এসব চাল কেনে, তাদের মধ্যে দুজন হলো হালিম ও জাহাঙ্গীর। কারওয়ান বাজারের কাছে পূর্ব তেজতুরি বাজারে একটি আবাসিক হোটেলের নিচতলায় তাদের দোকান। ওই হোটেলের সামনে তাদের আরো একটি দোকান রয়েছে। কিন্তু দোকানগুলোর কোনো নাম নেই।
গত রবিবার গোপনে ওই দোকানে খাদ্য অধিদপ্তরের চাল নামানোর ছবি তোলা হয়। পরে ওই দোকানে গেলে হালিম ও জাহাঙ্গীর এ প্রতিবেদককে উৎকোচ সাধেন। তবে তাঁরা দাবি করেন, এসব চাল ওএমএসের নয়। রাজারবাগের পুলিশের মেস থেকে কেনা হয়েছে। পুলিশের মেস থেকে নিয়মিতই এসব চাল ও গম আসে।
কিন্তু রবিবার যে ট্রাকের ছবি তোলা হয়, তার হেলপারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রাকটি এসেছিল খিলক্ষেত বিশ্বরোড থেকে।
হালিম বলেন, ‘আপনি এগুলো নিয়ে পত্রিকায় লিখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরা কিছু করে খাচ্ছি, সন্ত্রাস তো আর করছি না।’
হালিম ও জাহাঙ্গীরের দোকানে গতকাল অভিযান চালান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এনায়েত হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, দোকান মালিকরা পুলিশের কাছ থেকে ডিও কেনার প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, কোনটা ওএমএসের চাল আর কোনটা পুলিশের রেশনের চাল, তা পার্থক্য করা যায় না। পুলিশও আইনত এভাবে চাল বিক্রি করতে পারে না।
এ বিষয়ে পুলিশের জনসংযোগ শাখার এডিসি মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, চালের মান খারাপ হওয়ায় পুলিশের মেস থেকে এভাবে কিছু চাল বিক্রি করে অন্য খাদ্য কেনা হয়।
পুলিশের আরেকজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের রেশনের চাল এভাবে বিক্রি করা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে দীর্ঘদিন ধরে এটা চলে আসছে। চালের মান খারাপ হওয়া এবং কিছু চাল উদ্বৃত্ত থাকে বলে তা বিক্রি করে মেস ব্যবস্থাপকরা পুলিশের জন্য তরকারি ও মাছ-মাংস কিনে থাকে।’
গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে ওএমএস চালু হয়। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সাতটি বিভাগীয় শহরে ও কয়েকটি শ্রমঘন জেলায় ২৬০টি খোলা ট্রাকে ওএমএসের চাল বিক্রি করা হচ্ছে। সারা দেশে দোকান ডিলারের সংখ্যা দুই হাজার ৯০০। দৈনিক প্রতি ট্রাকের জন্য চাল দেওয়া হচ্ছে তিন টন। আর দোকানে বিক্রির জন্য এক টন। এ ছাড়া ফেয়ার প্রাইস কার্ডের ডিলাররা চাল পান সপ্তাহে পাঁচ টন। আগামী মাসের প্রথম দিন থেকে প্রতি কেজি চাল এক টাকা বেড়ে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার কথা।

আমি কসাইদের মতো জবাই করতে পারি

সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সাইদ মজুমদার ও তার সহযোগীরা ১৩-১৪ জন শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছেন এবং তিনজনকে হল থেকে বের করে দিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ঢাবি ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শওকত ইসলাম তৃতীয় সেমিস্টারের ওই শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, 'আমি কসাইদের মতো জবাই করতে পারি।

আমাকে যদি ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করে, তার পরও তোদের জবাই করা কোনো ব্যাপার না। হল থেকে এখনই বের হয়ে যাবি। তোদের যেন ক্যাম্পাসে আর না দেখি।' ছাত্রলীগের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আহত ওই শিক্ষার্থীরা কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকের কাছে গতকাল 'মধ্যরাতের' নির্যাতনের এ কথা জানান।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার রাত ২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের অতিথি কক্ষে শিক্ষার্থী নির্যাতনের এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা জানান, হলের অতিথি কক্ষে প্রতিরাতে ছাত্রলীগের সভা হয়। তারা জানান, সূর্য সেন হলের ২২৬ (ক) নম্বর কক্ষে একত্রে ২২ জন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকেন। এ কক্ষ 'গণরুম' বলে পরিচিত। এ কক্ষের কেউ সেদিন অতিথি কক্ষে না যাওয়ায় হল ছাত্রলীগ সভাপতি তাঁদের ডেকে পাঠান। ওই কক্ষের ১৩-১৪ জন শিক্ষার্থী অতিথি কক্ষে এলে, দরজা বন্ধ করে তাঁদের সভায় না আসার কারণ জানতে চান সভাপতি সাইদ। শিক্ষার্থীরা তখন পরীক্ষার কথা জানালে সভাপতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে সভাপতিসহ ছাত্রলীগের অন্য নেতা-কর্মীরা তাঁদের মারধর করেন। নির্যাতিতরা সবাই তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে জানান, 'আমাদের কয়েকজনের পরীক্ষা থাকায় সেদিন গেস্ট রুমে যেতে পারিনি। আমরা একটা ভালো রুমের জন্য সভাপতির কাছে দাবি করেছিলাম। এ জন্য তারা আমাদের গালিগালাজ করেছে। পরে চেয়ারের পায়া দিয়ে, সোফায় মাথা ঠেকিয়ে, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে মেরেছে।' তিনি আরো অভিযোগ করেন, 'এসব ঘটনা যাতে বাইরে প্রকাশ না হয়, সে জন্য নানাভাবে হুমকিও দিচ্ছে।' এদিকে ঢাবি শাখার ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শওকত ইসলাম তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এ ধরনের কথা বলিনি। একজন ছাত্র হিসেবে এ ধরনের কথা মানায় না। এখানে নিশ্চয় অন্য কোনো যোগসাজশ রয়েছে।' সূর্য সেন হল ছাত্রলীগ সভাপতি সাইদ মজুমদার গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো প্রোগ্রামে তাদের পাওয়া যায় না। তাই গেস্ট রুমে ডেকে সামান্য চার্জ করেছি মাত্র।' কিন্তু এর আগে সকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'বড় ভাইদের সালাম দেয় না, সম্মান করে না, প্রোগ্রামে আসে না, তাদের মারব না তো কী করব?'
এ ব্যাপারে সূর্য সেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. খোন্দকার আশরাফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা আমি সাংবাদিকদের কাছ থেকেই শুনতেছি। আর কিছু জানি না।' প্রসংগত, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর শহীদুল্লাহ হলে প্রায় একই কারণে ৪৪ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ।

দেখা দিক শাশ্বত কল্যাণ by সাযযাদ কাদির

বিদায় ২০১০। স্বাগত ২০১১। ভালয় মন্দয় কেটেছে আমাদের গত একটি বছর। এর চেয়ে যেন ভাল কাটে নতুন বছরটি। আমাদের আশা এই একটিই। মার্কিন প্রবচনবিদ উইলিয়াম আথার ওয়ার্ড (১৯২১-১৯৯৪)-কে অনুসরণ করে এ দিনটিতে বলতে ইচ্ছা করে আহা আরও একটি বছর এলো জীবনে। মনে হয় বাঁচবো আরো একটি বছর।

তাই আর দুশ্চিন্তা নয়, ভয় আর সন্দেহ নয়। অন্তরের সব সাধ নিয়ে যথাসাধ্য করে যাবো এবার । এখন থেকে প্রতিটি দিন বাঁচবো হাসি-আনন্দে, সৃষ্টিতে-সাধনাতে থাকবো মনেপ্রাণে মগ্ন। আরো একটি বছর মানে আরো অনেক সুযোগ। সেসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবার শুদ্ধ করে নেবো সব ভুল, কাজ করে যাবো শান্তির জন্য। অন্তত একটি গাছের চারা লাগাবো পথের ধারে, আর আগের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দে চলবো-বলবো-গাইবো!

গত বছরের অভিজ্ঞতা যা হোক, নতুন বছর শুরুর এই দিনগুলোতে নানা আশা জাগে আমাদের মনে, আমরা ভরসাও করি নানা কিছুতে। বিশেষ করে নিজেদের উদ্যমের ওপরই আস্থা রাখি বেশি। মনে পড়ে স্কুলজীবনে পাঠ্যপুস্তকে পড়া কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪)-এর "জয়যাত্রা" নামের কবিতাটির কয়েক পঙক্তিঃ

যাত্রা তব শুরু হোক হে নবীন, কর হানি' দ্বারে

নবযুগ ডাকিছে তোমারে।

তোমার উত্থান মাগি' ভবিষ্যৎ রহে প্রতীক্ষায়

রুদ্ধ বাতায়ন পাশে শঙ্কিত আলোক শিহরায়!

সুপ্তি ত্যাজি' বরি' লও তারে, লুপ্ত হোক অপমান,

দেখা দিক শাশ্বত কল্যাণ।

তবুও পুরনোকে ফেলে না দিয়ে, ভুলে না গিয়ে তার মূল্যায়ন-বিশেস্নষণ করে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সামনে এগিয়ে যাওয়া ভাল। এজন্যই প্রয়োজন ফিরে দেখা। সে দেখা একবার নয়, মাঝে-মধ্যেই দেখা দরকার। গত বছর কি চেয়েছিলাম, কি পেয়েছি আর কি হারিয়েছি তা নতুন বছরের শুরুর এই সময়টাতেই মনে পড়ে বেশি-বেশি। আমার ভাবনায় এই হারিয়ে যাওয়াদের অ্যালবামটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বারবার। এ বছর অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি বলেই হয়তো এমন হয়। প্রথমেই বলতে হয় কবি ও বহুমাত্রিক লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দের বিদায়ের কথা। এত আকস্মিক তাঁর বিদায় যে বেদনার্ত হওয়ার চেয়ে আমি বুঝি বিমূঢ়ই হয়েছি বেশি। আমার চেয়ে বয়সে ছিলেন কিছু বড়, সাহিত্যিক যাত্রাতেও ছিলেন একটু আগে তবে নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলাম আমরা। বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি তাঁর সঙ্গে আমার অমিলের চেয়ে মিল-ই বেশি। আমাদের বাসাও কাছাকাছি। তাই দেখাও হতো মাঝে-মধ্যে। আর ফোনে তো কথা হতোই। মৃতু্যর মাত্র ক'দিন আগে কথা হয়েছিল একটি লেখার সূত্রে। তাঁকে যে প্রাবন্ধিক-গবেষক নয়, মূলত কবি হিসেবে আমি মূল্যায়ন করি তা তিনি জানতেন। তাঁর মৃতু্যর পর এক শোকনিবন্ধ লিখেছিলাম পত্রিকায়। সে লেখাটির শুরু ছিল এ রকম:

"আবদুল মান্নান সৈয়দকে প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালের শেষদিকে। তখন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের পাট শেষ। শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনের সামনে খোলা ঘাসের চত্বরে বসেছিলেন তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক স্যাড জেনারেশনের কবি-লেখকরা। স্যাড জেনারেশনের মুখপত্রে লেখেননি এমন ক'জন এবং বাইরের বন্ধু-বান্ধবও ছিলেন দু'-একজন। তাঁদের অনেকেই আজ আর নেই। যেমন: আফজাল চৌধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ইউসুফ পাশা, ইনামুল কবির ব্র?হ্মা, মাহবুবুল আলম জিনু। এখনও আছেন রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, প্রশান্ত ঘোষাল, মুহম্মদ মোজাদ্দেদ, রণজিৎ পাল চৌধুরী। মান্নান এসেছিলেন সবার শেষে। সন্ধ্যা ঠেকিয়ে। পরনে খুব অাঁটোসাঁটো টেডি প্যান্ট, বেল্ট, ইন করা ফুলেল ফুল শার্ট। সেখানে ও রকম টেডি প্যান্ট পরা ছিলেন আরো দু'জন _ রফিক আজাদ ও ইউসুফ পাশা।"

এখানে উলিস্নখিত মুহম্মদ মোজাদ্দেদও বিদায় নিয়েছেন এ লেখার কিছুদিন পর, গত ২৬ নভেম্বর। তিনি পরিচিত ছিলেন 'দাদু' নামে। সম্ভবত আড্ডার সবার চেয়ে বয়সে বড়, কিছুটা গাম্ভীর্যমণ্ডিত ও স্বল্পভাষী ছিলেন বলে সম্বোধিত হতেন ওই রকম একটি নামে। ছাত্রজীবনে থাকতেন ঢাকা হলে। রুমমেট ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরীর। ১৯৬৪ সালের প্রথমদিকে একবার দুপুর বারোটায় তাঁদের রুমে গিয়ে দু'জনকে দেখেছিলাম গভীর ঘুমে মগ্ন।

মুহম্মদ মোজাদ্দেদ কখনও কিছু লিখেছেন কিনা জানি না, তবে স্যাড-স্বাক্ষর গোষ্ঠীর আড্ডা ও অন্যান্য তৎপরতায় তিনি ছিলেন অপরিহার্য। সবখানেই তাঁর মতামতের ছিল বিশেষ গুরুত্ব। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ মানতাম তাঁকে। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত "স্বাক্ষর"-এর তৃতীয় সঙ্কলনের প্রকাশক ছিলেন তিনি। তখন তাঁর ঠিকানা ছিল "২৫৭ নং এলিফ্যান্ট রোড, সাউথ ধানমণ্ডী"।

১৯৯৫-২০০৪ সালে প্রায় সকালেই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো আমার। অফিসের গাড়িতে তিনি যেতেন কর্মস্থল বাংলা একাডেমী, আমি যেতাম বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট। দেখা হওয়া মাত্র হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন, হাত নাড়তেন। সেই হাসি, হাত নাড়া মনে আছে। মনে থাকবে।

তারপর গাড়ি করে অফিসে যাওয়া নেই ছ'-সাত বছর হলো। মুহম্মদ মুজাদ্দেদের সঙ্গেও দেখা নেই আর। হঠাৎ করে সেদিন বাসা থেকে বেরোতে গিয়ে এক কালো গাড়ির মুখে পড়ে যাই। দেখি বসে আছেন তিনি। বয়সের ছাপ সর্বাঙ্গে। ভাবি, আমাকে চিনবেন কিনা। কিন্তু 'দাদু' বলে যেই ডেকেছি অমনি সেই আগের মতোই উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন হাসিতে। এর ক'দিন পরেই পত্রিকায় পড়ি তাঁর মৃতু্য সংবাদ। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি, ষাট দশকের সুহূদ স্বজন অনেকেই জানতে পারেননি তাঁর বিদায়ের খবর। এ রকম নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছেন নিভৃত স্বভাবের কবি,কথা-সাহিত্যিক আনোয়ারা রহমান এ্যানা। তিনি ছিলেন কবি-সমালোচক আতাউর রহমানের (১৯২৫-১৯৯৯) স্ত্রী। গত ১৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃতু্যর খবর মাত্র একটি পত্রিকায় দেখেছি আমি। আনোয়ারা রহমান এ্যানার একমাত্র উপন্যাস "আমার বঁধুয়া" প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এরপর কবিতা ও ছোটগল্পই লিখেছেন তিনি। তবে সেসব বই প্রকাশিত হয়েছে যৌথভাবে। কয়েকটি সঙ্কলন সম্পাদনাও করেছেন তিনি।

নাট্যকার সাঈদ আহমদকে আমরা হারিয়েছি গত বছরের শুরুতে_ ২১ জানুয়ারি। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম ১৯৭৭ সালে, কবি শামসুর রাহমানের মাধ্যমে। পরিচয় অবশ্য লেখালেখির সূত্রে। তাঁকে নিয়ে আমি লিখেছিলাম "বিচিত্রা"য়। ১৯৭৫ সালে নাটক বিভাগে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পেলেও সাঈদ আহমদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সম্ভবত সেটিই প্রথম কোনও লেখা। পরে তাঁর "প্রতিদিন একদিন" (১৯৭৫) নাটকটি আমি মঞ্চায়নের উদ্যোগ নেই বহুবচন নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে। পরে মজিব বিন হকের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল নাটকটি। ১৯৯২ সালের অক্টোবরে সাঈদ আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ভারতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক সাংস্কৃতিক উৎসবে। ওই দলের সাহিত্য বিভাগে আরো ছিলেন আসাদ চৌধুরী ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। মনে পড়ে আমাদের কলকাতা, বেঙ্গালুরু, তিরুবানন্তপুরম্ ভ্রমণ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা।

সাঈদ আহমদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা তাঁর মৃতু্যর মাত্র কয়েক মাস আগে। তিনি এসেছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে_ ক্লাবের পক্ষ থেকে দেয়া লেখক-সাহিত্যিকদের সংবর্ধনা গ্রহণ করতে। বরাবরের মতো সেদিনও ছিলেন কৌতুকসি্নগ্ধ ঢাকাইয়া ভাষায় রস-রসিকতায় উজ্জ্বল। মনে পড়ছে, সুতলি কাবাব দিয়ে বাকরখানি খাওয়ার মজাটা আমাকে শিখিয়েছেন তিনিই।

আমার প্রিয় লেখকদের একজন আবু রুশদ আমাদের ছেড়ে গেছেন গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনও, তবে তাঁর ভক্ত ছিলাম সেই ষাটের দশকের প্রথমদিক থেকে। ভক্তির শুরু তাঁর উপন্যাস "এলোমেলো" (কলকাতা, ১৯৪৬) পড়ে।

আবু রুশদ ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডমীর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ছোটগল্প বিভাগে। রহস্যজনক কারণে সারাজীবন "আবু রুশদ" নামে লিখলেও ওই পুরস্কার তাঁকে দেয়া হয়েছে "সৈয়দ আবু রুশদ মতিনউদ্দিন" নামে। এখনও বাংলা একাডেমীর বিভিন্ন প্রকাশনায় তাঁর নাম উলেস্নখ করা হয় "আবু রুশদ মতিনউদ্দিন" হিসেবে। উলেস্নখ্য, ১৯৬০-'৬৭ সালে বাংলা একাডেমীর পরিচালক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান।

সাংবাদিক-ব্যক্তিত্ব আখ্তার-উল্-আলম মারা গেছেন গত ২৪ জুন। দৈনিক ইত্তেফাকে তাঁর দীর্ঘ উপ-সম্পাদকীয় এক সময় ছিল ব্যাপক আলোচিত। ওইসব উপ-সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত মতামতের পক্ষে-বিপক্ষে তর্কও হতো খুব। আমিও অনেক বিষয়ে একমত হতে পারিনি তাঁর সঙ্গে, তবে একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম তাঁর তথ্যপূর্ণ লেখার। আখতার-উল-আলমের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনও। একবার ফোনে কথা হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। কথার শেষে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের। কিন্তু সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারিনি কি এক ব্যস্ততায়। সেই না পারার দুঃখ আমার রয়ে গেছে এখনও।

সাংবাদিক প্রফুলস্ন কুমার ভক্তকে হারিয়েছি গত ৪ অক্টোবর। তিনি আমার সহকমর্ী ছিলেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৮৪ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলাম সম্পাদকীয় স্তম্ভে। কিছু কাজ হয়েছিল তাতে। অন্তত আসন্ন বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার বিদায় অত্যন্ত দুঃখপূর্ণ হয়েছে আমাদের জন্য। একদিকে গুরুতর অসুস্থতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক জীবনের ওলট-পালট বিপর্যয়ের মধ্যে এক ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে তাঁকে।

ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র-রাজনীতির সূত্রে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। পরিচয়ের সূত্র ছিলেন অবশ্য কবি-রাজনীতিক বুলবুল খান মাহবুব। তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গণআন্দোলনের দিনগুলোতে তিনিও এক অগ্রজ বন্ধু হয়ে ওঠেন আমার। পরিচয়ের সূত্র ছিল অবশ্য আরো একটি। আমার পিতামহ দেলদুয়ারের পীরসাহেব শাহ সুফি মোহাম্মদ আবদুর রকিব জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন নরসিংদী, শিবপুর, ভবানীপুর অঞ্চলে। ওখানে অনেক মুরিদ ছিলেন তাঁর, এখনও আছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মান্নান ভুঁইয়ার পরিবারের সদস্য ও অন্য আত্মীয়-স্বজনও। তিনি আদর্শবাদী রাজনীতিক ছিলেন কিন্তু নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন আদর্শহীন রাজনীতির মধ্যে। তা-ই ছিল তার জন্য বেশি দুঃখপূর্ণ। দু'-একবার ডেকেছিলেন, দু'-একবার নিজে থেকেও গেছি তাঁর ওখানে। তখন তাঁর আশপাশে দেখেছি একশ্রেণীর ট্যান্ডলদের ভিড়। ওই ভিড় ভাল লাগেনি আমার। তবে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকতে পেরেছেন তাঁদের একজন দেওয়ান ফরিদ গাজীকে আমরা হারিয়েছি গত বছর। মনে পড়ে ২০০২ সালে এক অনুষ্ঠানের সূত্রে সিলেটে গিয়ে একদিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে পেরেছিলাম তাঁর সানি্নধ্যে। তাঁর লামাবাজারের সাধারণ, ছিমছাম কিন্তু ঐতিহ্যমণ্ডিত বাড়িতে অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। কথায় কথায় জেনেছিলাম, শিখেছিলাম কত কিছু। সেসব কথায় রাজনৈতিক বিষয়াদিই ছিল মুখ্য। তবে আমি টাঙ্গাইলের জেনে তিনি বিশেষভাবে কথা বলেন আবদুল মান্নান ও কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধে দু'জনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে এখনও সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না তা তিনি বলেন দুঃখের সঙ্গে। নিজের সম্পর্কে বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের মধ্যেই মিশে থাকতে চাই। আমি আলাদা কোনও পরিচয় নিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে চাই না। পরে একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, আমার জীবনের প্রার্থনা এটাই। সেই থেকে ওই কবিতাটিও প্রার্থনা হয়ে আছে আমার।

আসুন, আজ এক বর্ষকে বিদায় জানিয়ে আরেক বর্ষকে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে আমরা সকলে মিলে পাঠ করি শেখ ফজলুল করিম-এর "প্রার্থনা" নামের সেই কবিতাটি:

প্রভু, করো মোরে শস্যশ্যামল সমতল মাঠ

করিও না তুঙ্গশির গিরি;

ক্ষুধিত আমাতে যেন পায় গো আহার,

ক্ষুণ মনে নাহি যায় ফিরি'।

লবণ-সমুদ্র তুমি করিও না মোরে

করো দেব, সি্নগ্ধ প্রস্রবণ;

তৃষিত তাপিত যেন মোর কাছে আসি'

পিপাসার করে নিবারণ।

নির্মম বীরের করে করিও না মোরে

প্রিয়তম, তীক্ষ্ন তরবারি;

করো মোরে ক্ষুদ্র লাঠি, দুর্বলেরা যেন

চলাফেরা করে হাতে ধরি'।

বিলাসী সম্পদশালী করিও না মোরে

অনুক্ষণ মত্ত অহঙ্কারে

করো দীন, ত্যাগী দাস, সবারই যেন

সেবা আমি পারি করিবারে।

জাহাজ ভাঙা শিল্পে স্থিতিশীলতা আনার অনুরোধ

জাহাজ ভাঙা শিল্পে স্থিতিশীলতা রাখতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ স্টিল ও রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ খাতের স্থিতিশীলতার ওপরই স্টিল ও রি-রোলিং খাতসহ এমএস রডের বাজারের স্থিতি নির্ভরশীল।

গতকাল সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানের সংগে সাক্ষাৎ করে ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, 'দেশে চার শতাধিক রি-রোলিং মিল রয়েছে। কারখানাগুলোতে উৎপাদিত এমএস রড দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করে। এ শিল্পে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ টন কাঁচামালের দরকার হয়। এর ৮০ ভাগ কাঁচামাল আসে দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে।
জাহাজ ভাঙা বন্ধ থাকায় কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে স্ক্র্যাপের দামও বাড়ছে। এভাবে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার অপচেষ্টা চলছে। কাঁচামালের অভাবে ইতিমধ্যে অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেক মিল বন্ধ হওয়ার পথে। শিল্প বন্ধ হওয়ায় লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হচ্ছে। এতে সমাজে নানা অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।'
কাঁচামালের সমস্যার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন-গুলোকে সক্সগে নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংগে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস দেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। তিনি বলেন, 'পরিবেশসম্মতভাবে জাহাজ ভাঙা শিল্প গড়ে তুলতে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। দেশটি সহায়তা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পরিবেশ ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রেখে জাহাজ ভাঙা শিল্প গড়ে তুলতে হবে। এজন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। নীতিমালা প্রকাশিত হলে জাহাজ আমদানিতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।'
এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (আইআইটি) মো. শওকত আলী ওয়ারেসী, রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাবুল, সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুর রহমান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবদুস সালাম, মহাসচিব ড. বশির উল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা প্রসঙ্গে by শহীদ আশরাফী

মুদ্রে চলমান জাহাজগুলো কত না বাধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে চলে প্রতিনিয়ত। সামুদ্রিক ঝড় এর অন্যতম। তাকে অতিক্রম করে নাবিকরা সাহসভরে এগিয়ে চলে তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে। সমুদ্রের অনেক স্থানে একটি ঝড় শেষ হবার ক'দিন পর সৃষ্টি হয় আরেকটির।

তথাপি তাদেরকে পাশ কাটিয়ে এবং টাটা বাই বাই জানিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়াও কিন্তু সম্ভব হচ্ছে । এই যেমন ভারত থেকে আফ্রিকার কেপটাউন পেরিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর ধরে ব্রাজিলের স্যান্টোস বন্দরে যাচ্ছিল একটি জাহাজ । দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের বিভিন্ন অংশে এসময় প্রায়শই গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় । ভারত মহাসাগর তখন ছিল শান্ত । অথচ কেপটাউন পেরিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশের পূর্বেই এলো আগাম ঝড়ের সতর্কতা । জাহাজের ক্যাপ্টেন ও চীফ ইঞ্জিনিয়ার দু'জনেই চিন্তিত হলেন বটে। কিন্তু ইতিপূর্বে অনেক ঝড় পাড়ি দেবার অভিজ্ঞতা থাকায় সাহস হারালেন না মোটেও । ঝড়ের সময় ইঞ্জিন বন্ধ হলে জাহাজকে রক্ষা করা ভীষণ দুষ্কর। তাই জাহাজের সকল ইঞ্জিন ও মেশিনারিজকে চীফ ইঞ্জিনিয়ার ঠিকমত মেরামত করে রেখেছেন সেইলিং-এর আগে । আর জাহাজের ব্রীজে স্থাপিত চার্টকো সিস্টেমের কম্পিউটার মনিটর থেকে ক্যাপ্টেন প্রতি মুহূর্তে অবলোকন করতে পারছেন ঝড়ের অবস্থান ও গতিপ্রকৃতি । সমুদ্রের প্রতিটি এলাকার নির্দিষ্ট সময়ের ঝড়ের চিত্র বহু বছর ধরে স্যাটেলাইট ক্যামেরায় ধারণ করে কম্পিউটারে বিশেস্নষণ করা হয়েছে । আর তার উপর ভিত্তি করে এখন আগাম ঝড়ের চিত্র ভেসে উঠছে চার্টকোর মনিটরে । জাহাজের গতিকে হিসাব করে পরবর্তী পথটুকুতে প্রতিদিন দুপুরের অবস্থান চিহ্নিত করা আছে । আর সেই অবস্থানগুলোর সংযোগ রেখাও দৃশ্যমান থাকছে সেই চার্টকো মনিটরে । তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিদিনের অবস্থানে গেলে ঝড়ের গতিপ্রকৃতি বিভিন্ন চিহ্ন ও রেখার দ্বারা চিত্রিত করা আছে । ক্যাপ্টেন সাহেব প্রায় সময় ব্রীজে এসে তা পর্যবেক্ষণ করেন। তা থেকে হিসেব কষে ক্যাপ্টেন সাহেব জাহাজটির পথ ডানদিকে ঈষৎ ঘুরিয়ে দিলেন । এর কিছুক্ষণ পর সেই চিত্রে তিনি দেখতে পেলেন যে সেভাবে গেলে জাহাজটি সাতদিন পর ঝড়টির কাছাকাছি হবে বটে তবে কিনা তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে সে। কেবল যদি চার্টকোর কম্পিউটার বর্ণিত ভবিষ্যৎ চিত্রটি সঠিক হয়। ওদিকে নিয়মিত মহাসাগরের বিভিন্ন অবস্থানের আবহাওয়ার খবর ই-মেইল মেসেজের আকারেও আসছে প্রতিদিন । আশ্চর্যজনকভাবে তা মিলেও যাচ্ছে চার্টকোর চিত্রটির সাথে । আর তাই পূর্ব নির্ধারিত দিনের নির্দিষ্ট ক্ষণে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঝড়টিকে টাটা বাই বাই জানালো জাহাজ ও তার নাবিকরা । মূলত বিশ্বের মেরীটাইম সংস্থাগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সম্মিলিত প্রয়াস ও তার সাথে যুক্ত স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহারের সুফলের ফসল থেকেই নাবিকদের এই নিরাপদ সমুদ্র ভ্রমণের প্রশান্তি। যদিও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় কেবল অন্য একটি ব্যাপারে । বিষয়টি উদাহরণ দিয়েই আলোকপাত করা যাক ।

সোমালিয়ার পশ্চিম উপকূলের রেড সী কিংবা পূর্ব উপকূলের ভারত মহাসাগরে দীর্ঘদিন থেকে জলদসু্যদের ভীষণ উৎপাত । সামপ্রতিককালে ভারত মহাসাগরের দিক থেকে একটি বাংলাদেশী জাহাজ তার ২৬ জন নাবিকসহ সেই জলদসু্যদের কাছে জিম্মি হওয়ার পর থেকে বিষয়টি এদেশের অধিকাংশ নাগরিকের কাছে আর অজানা কোন বিষয় নয়। সেই নাবিকদের পুরো পরিবার এখন ভীষণ নিরাপত্তাহীনতার মাঝে রয়েছে । ইতিপূর্বে এমন দসু্যতার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকেও জানা যায় অনেক তথ্য । যেমন কিনা- একবার রেড সীতে জলদসু্যদের কবলে পড়ল একটি জাহাজ । দসু্যরা সাধারণত দ্রুতগামী বোটে করেই আসে । জাহাজের গতি থাকে তাদের বোটের চেয়ে অনেক কম । তাই আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে জাহাজটি তখন নিজেকে তার সর্বোচ্চ গতিতে ঝিগ-ঝাগ পথে তথা দ্রুত ডাইনে ও বামে ঘুরে এগোতে থাকলো। কারণ এর ফলে বড় জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে যাবার ভয় থাকে ছোট বোটটির। তাই জলদসু্যরা সহজে তখন জাহাজের গায়ে ভিড়তে পারে না । সেই সাথে জাহাজের ডেকের দু'দিকে সারিবদ্ধ পানির কামান থেকে পানি ছোঁড়া হলো সমুদ্রের দিকে । তাকে ডিঙ্গিয়ে জাহাজে ওঠাও কিনা কষ্টসাধ্য । একসময় তাই জাহাজের ব্রীজ বরাবর মর্টার থেকে গুলি ছোঁড়ে দসু্যরা । এতে ভীত হলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন । কারণ আন্তর্জাতিক আইনে বাণিজ্যিক জাহাজে কোনো প্রকার অস্ত্র বহন আইনসম্মত নয় বলে তার অনুগত বাহিনী তথা সকল নাবিকরা যে একেবারে নিরস্ত্র । তাই তিনি বিরত হন জলদসু্যদের বাধাপ্রদান থেকে । তারপর জাহাজে উঠে সহজেই তাকে নিয়ন্ত্রণে নেয় দসু্যবাহিনী । জলদসু্যরা মুক্তিপণ পেলেই জাহাজটি ছেড়ে দেবে বলে জানিয়ে রাখলো ক্যাপ্টেনকে ।

ঘটনাক্রমে জাহাজটিতে কার্গো হিসেবে তখন ছিল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ । দসু্যরা তখনও তা জানতো না। আর খবর পেয়েই ছুটে আসে কাছাকাছি অবস্থানরত মার্কিন নৌবহর ও তার হেলিকপ্টারগুলো। তাদের আগমন অবশ্য নাবিকদের নিরাত্তার জন্য নয় । বরং সেই অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ যাতে জলদসু্যদের হাতঘুরে আশ-পাশের দেশগুলোর গেরিলা গ্রুপগুলোর হাতে না পরে ; সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তাদের এই তৎপরতা। হাইজ্যাক হওয়া জাহাজের খুব কাছে থেকে সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দিতে থাকল তারা । কিন্তু নাবিকদের মুক্তির কোন চেষ্টাই করল না তারা । ক'দিন পর জাহাজের মালিকের প্রতিনিধি সেই জাহাজে এসে অনেক অর্থ মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করল জাহাজ ও তার নাবিকদেরকে । জলদসু্যরা মার্কিন বাহিনীর পাশ দিয়েই বোটে করে নিয়ে গেল তাদের প্রাপ্ত মুক্তিপণের অর্থ। তখনও তাদেরকে কোন গুলি ছুঁড়ে প্রতিহত করল না মার্কিন বাহিনী ।

স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই দসু্যবাহিনীর গতিবিধি ও অবস্থান নিশ্চিত করা কঠিন কোন ব্যাপার নয় । অতঃপর তাদের আটক করাও যে সম্ভব । বিশেষত সমুদ্রে আন্তর্জাতিকভাবে নৌ-টহল চালু করে তাদেরকে প্রতিহত করা যায় খুবই সহজভাবে । কিন্তু সে প্রচেষ্টা নিতে বিশ্বের শক্তিধর কিংবা নেতৃস্থানীয় দেশগুলো মোটেও যে উৎসাহী নন । আর তাইতো এত বেশি বেশি জাহাজ ছিনতাই ঘটনার পরও কিনা রেড সীর নূ্যনতম দৈর্ঘের একটি করিডোরে কেবল দিবা-রাত্রির কয়েকটি সময়ে নৌ -টহলের ব্যবস্থা করা গেছে। কিন্তু অন্য সময়ে কিংবা সেই করিডোরে পেঁৗছা নাগাদ অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে চলাচলকারী সকল জাহাজগুলো । অন্যদিকে সোমালিয়ার অপর পাশের ভারত মহাসাগরের অংশটিতে কোন নৌ-টহল আদৌ শুরু করা এখনও সম্ভব হয়নি। আর সেই ভারত মহাসাগর থেকেই সমপ্রতি ছিনতাই হয়েছে উলেস্নখিত বাংলাদেশী জাহাজটি । নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাই যেন জলদসু্যদের মর্জির উপরেই নির্ভরশীল । মূলত মুক্তিপণ পেলে তারা নাবিকদের ফেরত দেবার প্রথা এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছে । জলদসু্যরা সাধারণত অতি মূল্যবান নতুন জাহাজগুলোকেই হাইজ্যাক করে থাকে । এতে মুক্তিপণের বিরাট টাকাটা সহজেই তারা পেয়েও যায় । কিন্তু বাংলাদেশী জাহাজ মালিক তার সমপ্রতি হাইজ্যাককৃত পুরাতন জাহাজটির জন্য বিরাট ক্ষতিপূরণ নিশ্চয়ই দিতে চাইবেন না । অপহূত বাংলাদেশী নাবিকরা তাই যে আজ নিশ্চিত বিপদের মুখোমুখী । সরকারি অর্থানুকূল্য ছাড়া তাদের ভাগ্যকে রক্ষা করা বুঝি সম্ভব নয় । সেই সাথে বলা চলে যে আন্তর্জাতিক আনুকূল্য ছাড়া বিশ্বের সকল নাবিকদের নিরাপত্তা রক্ষাও কখন যে সম্ভব নয় ।

সমাপনী পরীক্ষা : প্রাথমিক শিক্ষার দর্পণ by মো. শহীদ উলল্লাহ

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দুটি সার্টিফিকেট এবং উচ্চ শিক্ষা স্তরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের সুযোগ থাকলেও ইতিপূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা সফল সমাপ্তির পর কোন সার্টিফিকেট লাভের সুযোগ ছিল না।

ফলে পূর্বে তিন স্তর বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্তর বলে মনে হতো না। বরং এ স্তরকে শিক্ষার প্রস্তুতি কাল বলেই বেশি মনে হতো। প্রাথমিক শিক্ষা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান স্তর হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। সমাপনী পরীক্ষা এনে দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পূর্ণতা, বাড়িয়েছে এ শিক্ষা স্তরের গুরুত্ব।

গত বছর প্রথম অনুষ্ঠিত হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের নজর কাড়ে এ পরীক্ষা। তখন থেকে শুরু হয় এ পরীক্ষাকে আরো ঢেলে সাজাবার প্রক্রিয়া। গত বছর প্রতিদিন ২টি করে ৩ দিনে ৬টি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষাথর্ীদের উপর বাড়তি চাপ ছিল। কিন্তু এ বছর প্রতিদিন ১টি করে ৬ দিনে ৬টি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষাথর্ীরা ছিল পূর্বের তুলনায় অনেকটা উৎফুলস্ন। এ বছর সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নেও নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। পরীক্ষকগণ নির্ধারিত তারিখে উপজেলা সদরে এসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের তত্ত্বাবধানে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছেন। এ ব্যবস্থায় শিক্ষকগণের একটু বেশি পরিশ্রম হলেও উত্তরপত্র মূল্যায়নে স্বচ্ছতা ও সমতা বজায় রাখা এবং মূল্যায়ন কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

সমাপনী পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অসাধারণ সাফল্য। একটি সফলতা থেকে জন্ম নেয় আরো সফলতা লাভের অনুপ্রেরণা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের সাহস জোগিয়েছে আরো নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়ার। তারই পথ ধরে এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এতকাল সাধারণ শিক্ষার তুলনায় ইবতেদায়ী শিক্ষা অনেকটা পিছিয়ে ছিল। সমাপনী পরীক্ষা নিঃসন্দেহে ইবতেদায়ী শিক্ষার মানোন্নয়নের পথে মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এ পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মাধ্যমিক স্তরেও। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার আদলে এ বছর প্রথম অনুষ্ঠিত হলো ৮ম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পরিবর্তন যেন সরকারের দিন বদলের অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন।

সমাপনী পরীক্ষাকে আরো যুগোপযোগী ও মানসম্মত করার জন্য কতিপয় বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন- জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমী (নেপ) কর্তৃক প্রণীত প্রশ্ন কাঠামো ও নম্বর বিভাজনের সাথে প্রশ্নপত্রের কিছুটা বৈসাদৃশ্য দেখা গেছে। শিক্ষকগণ নেপ থেকে প্রাপ্ত প্রশ্ন কাঠামো ও নম্বর বিভাজন অনুসারে শিক্ষাথর্ীদের প্রস্তুত করেছেন। প্রশ্নপত্রে কিছুটা বৈসাদৃশ্য থানায় শিক্ষাথর্ী ও অভিভাবকগণের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। নেপ কর্তৃক প্রণীত উত্তরপত্র মূল্যায়ন নির্দেশমালার সাথে প্রশ্নপত্রের অসামঞ্জস্য থাকায় শিক্ষকগণকেও বিপাকে পড়তে হয়েছে। যেমন- ইংরেজী বিষয়ের প্রশ্নপত্রে কবিতা থেকে ৮ লাইন লিখতে বলা হয়েছে এবং উহার মান দেয়া হয়েছে -১০। অপর দিকে উত্তরপত্র মূল্যায়ন নির্দেশমালায় কবিতা থেকে ১০ লাইন নিভর্ুলভাবে লিখলে পূর্ণ ১০ নম্বর দিতে বলা হয়েছে। এ ত্রুটিগুলো ছোট করে দেখা সমীচীন নয়। প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন নির্দেশমালা তৈরির ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয় এমন) শিক্ষাথর্ীদের উত্তর লিখার জন্য বাড়তি সময় চেয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট অভিভাবকগণ আবেদন জানালেও নীতিমালায় এ ধরনের সুযোগ না থাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সে সুযোগ দিতে পারেনি। বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা দরকার। আরো একটি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। বিষয়টি হচ্ছে- থানা হেফাজত থেকে প্রতিদিন পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন পরিবহন ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে থানায় উত্তরপত্র পরিবহনের জন্য কাছে ও দূরের কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সমভাবে পরিবহন খরচ দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে, উপজেলা পরিষদের নিকটবতর্ী ও দূরবতর্ী কেন্দ্রে পরিবহন খরচ একরূপ নয়। এ ব্যবস্থায় কোন কোন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিবহন খরচ বাবদ বরাদ্দ পেয়েছেন। আবার কোন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে উপজেলার জন্য থোক বরাদ্দ দিয়ে উপজেলা কমিটিকে বরাদ্দকৃত অর্থ বিভাজনের দায়িত্ব দেয়া সমীচীন হবে।

সমাপনী পরীক্ষায় ছোট-খাটো ত্রুটি-বিচু্যতি থাকলেও সফলতা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এসব ত্রুটি-বিদু্যতির কথা বিবেচনায় রেখে আগামী দিনে একটি সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সকল পরীক্ষাথর্ীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণসহ প্রশ্নপত্রের মান ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করি।

মুদ্রণ শিল্পের আঁতুড়ঘর মিসর

প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার আকুল আকুতি 'চিঠি দিও প্রতিদিন' অথবা 'চিঠি দিও, পত্র দিও, জানাইও ঠিকানা।' আক্ষেপ 'নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম বন্ধুর কাছে মনের কথা কেমনে পৌঁছাইতাম?' হ্যঁযা, মনের ভাব প্রকাশ করবার সহজাত আকাঙ্ক্ষা মানুষের জীবনের একেবারে গোড়ার দিকের কথা।
তখনও ভাষায় উন্মেষ ঘটেনি। ভাষাকে লেখ্য রূপদানে সাংকেতিক চিহ্ন তথা বর্ণমালার আকার দেয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু পারস্পরিক মনের ভাব আদান-প্রদান তখনও থেমে থাকেনি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া, নানান শব্দ ও আওয়াজের মাধ্যমে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করেছে। আনন্দ-বেদনা, ভয়-সংশয়, বিদ্বেষ-বিস্ময় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রকাশভঙ্গি ছিল নিতান্তই ব্যক্তি পর্যায়ে। যা সার্বজনীন রূপ গেয়েছে আরো বহুকাল পরে। ঠিক কতদিন এমন চলেছে তার সঠিক হিসাব না থাকলেও ধারণা করা হয় অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের সময়কাল বেশ কয়েক হাজার বছর তো হবেই। দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু প্রতীকী ভাষা। তাও চলে বেশ কিছুকাল। বিপত্তি দেখা দিল এ ভাষার ব্যবহারের বেলায়ও। কারণ ভাবপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা অগত্যা তৃতীয় ধারায় কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণের উপায় উদ্ভাবন। প্রতীকী ভাষার সীমাবদ্ধ এক্ষেত্রে অনেকাংশই কাটিয়ে ওঠা গেল। তৈরি হতে লাগলো নানা মাত্রার শব্দ। যার গাঁথুনিতে বাক্য এবং পরিশেষে খুব কাছে থেকে মনের ভাব প্রকাশ সহজ। কিন্তু দূরে অবস্থনরত কারো সঙ্গে ভাব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় প্রতিদিনকার লব্ধ অভিজ্ঞতা তথা জীবনের নানা বাঁকের আনন্দ-বেদনা-বিরহের কথা ধরে রাখা। স্থান-কাল-পাত্রের গন্ডি পেরিয়ে বের হওয়া আরো দুরূহ। সে দুরূহ কাজই কথ্য ভাষাকে লেখ্য রূপদান।

শুরুটা পাহাড়ের গুহায়, গাছের কোঠরে কিংবা মাটির জমিনে। সময়কাল নিয়ে রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য। তবে আদিম মানুষের গুহাচিত্র, ছবি অাঁকার কোশেশ, বিভিন্ন অাঁকিবুকি প্রধানত কয়লা, পাথর, গাছের পাতার নির্যাস দিয়েই হতো। অধিকাংশ গবেষক একে লিখন পদ্ধতির সূচনাপর্ব বলে উলেস্নখ করেছেন। তাদের ধারণা, কালের পরিক্রমায় আজ যে সার্বজনীন লিখন পদ্ধতি লিপিকলা অনুসরণ করা হচ্ছে, তার অাঁতুড়ঘর প্রাচীন গ্রীস। এ প্রশ্নে ভিন্নমতও রয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীরা বলেন, গ্রীসে লিপিকৌশল সূত্রপাত হলেও প্রাচীন মিসরীয়রাই লেখার আধুনিক পদ্ধতির সূচনা করে। সময়কাল গুহাচিত্র লিখনের প্রায় তিন হাজার বছর পর। শেষোক্ত দলের অভিমত, প্রাথমিক পর্যায়ে মিসরীয়দের আবিষ্কৃত লিখন পদ্ধতিতে ব্যবহূত হতো বেশকিছু চিহ্ন বা প্রতীক। থাকে বলা হতো 'হিয়োরো গিস্নফিকস্ বা পবিত্র লিখন'। গোড়ার দিকে এ ধরনের লিখন পদ্ধতি ব্যবহূত হতো তাঁবু, মন্দির ও স্মারকস্তম্ভে। কালক্রমে তা অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থান করে নেয়। বিভিন্ন ভাষায়, লেখ্য ভাবপ্রকাশে সাংকেতিক চিহ্ন বা বর্ণমালার আবির্ভাব তার পথ ধরেই। কাগজ ও কালির অাঁচড়ে বর্ণমালায় নিয়মভিত্তিক উপস্থাপন আধুনিক লিখন পদ্ধতি। যার ওপর ভর করে শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির নানা বাহন তরতর করে এগিয়ে চলছে কালের স্রোতে। মলাটবদ্ধ পুস্তকের সেতু বেয়ে ক্যানভাসের দীঘল প্রান্ত ছুঁয়ে যে সভ্যতা আজকের সোপানে পেঁৗছেছে তার মূলে লিখন পদ্ধতি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এ পদ্ধতির নানা শাখার একটি পত্র সাহিত্য। চিঠি বা পত্র মনের ভাব প্রকাশের তথা অক্ষরের ভাষার কথা বলার অন্যতম উপায়। ডাক পিয়নের আবিভাবেরও আগে মানুষ অক্ষরের ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে ভাবে আদান-প্রদান করেছে। টেলিফোন আবিষ্কারের আগে, বলতে গেলে সেটাই ছিল একমাত্র ভরসা। আজ আধুনিক প্রযুক্তিতে লেখ্য রূপে মনের ভাব প্রকাশে না লাগে ডাক-পিয়ন, না লাগে কাগজ-কালি। সেলফোনের বাটন চেপে না বলা কথার মালা গেঁথে ইথারের মাধ্যমে 'এসএমএস' তরঙ্গ চিঠি পাঠানো কঠিন কাজ নয়। কলমের প্রয়োজনীয়তা আজ আর তেমন প্রবল নয়। অথচ আদিম মানুষের সম্বল ছিলো গুহার দেয়াল, গাছের পাতা, ডালপালা কিংবা সহজলভ্য এমন কোন বস্তু। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয়, কালি-কলম এবং বাটন চেপে লেখাও ইতিহাসে পরিণত হবে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, এসবের হাতেঘড়ি আদিম মানুষের হাতেই। মুদ্রণ শিল্পের আজকের চরম উৎকর্ষের মূলে গ্রীক বা মিসরীয়দের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাদের দেখানো পথেই হেঁটে চলছে আধুনিক মুদ্রণ শিল্প।

জাকিরুল ইসলাম

রাত যায় দিন আসে by আতিকুল হক চৌধুরী

সুপ্রিয় পাঠক! আপনাদের সবাইকে আজ ৩ জানুয়ারি ইংরেজী নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি বলে আপনারা কী একটু অবাক হচ্ছেন এই কথা মনে করে যে ১ জানুয়ারি নতুন বছরের শুরু। এই দুই দিন পর আবারও "হ্যাপি নিউ ইয়ার" কেন? কিন্তু নয় কেন? আমি তো এই কথা বলছি না যে, হ্যাটি ফাস্ট জানুয়ারি।

বলছি হ্যাপি নিউ ইয়ার। নতুন বছরের সবে তো শুরু। ২/৩ দিন পরও নতুন বছরই তো থাকছে, না কী? না, ঈদে ৩/৪ দিন ছুটি বলে কয়েকদিন ধরেই ঈদ মোবারক বলা যায়? নববর্ষে তেমন ছুটির উপলক্ষ নেই বলেই কী আর শুভ নববর্ষ বলা যাবে না কয়েকদিন ধরে? "শুভ" কথাটা বার বার উচ্চারণ করলে ক্ষতি কী? সুপ্রিয় পাঠক।"হ্যাপি নিউ ইয়ার"। শুরু হল আর একটি নতুন বছর। প্রার্থনা করি নতুন বছর যেন শুধু কতগুলো দিন, হপ্তা আর মাসেরই বদল না হয়। দিন বদলের পালায় আমরা যেন সবসময় নেতিবাচক নয়, একটু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েও যেন পথ চলতে পারি। পারি যেন একজন অপর একজনের হাত ধরাধরি করে চলতে। একা নয়, একজন নয়, দু'জনের একসঙ্গে পথ চলার আনন্দই যে আলাদা, একজনে একা হাঁটলে মনে হয় কত পথ যেন আরো বাকী। দু'জনে একসঙ্গে হাঁটলে মনে হয় কতদ্রুত যেন এগিয়ে গেলাম। আমরা একত্রে ওঠাবসা করি কিন্তু আমাদের মধ্যে একতা কম। এটাই দুঃখজনক। দুর্ভাগ্যজনক। কথায় আছে যার শেষ ভাল তার সব ভাল। ইংরেজী ২০১০ সালের শেষ দিনটি আমার খুব আনন্দে কেটেছে। বহুদিন পর আমার একমাত্র মেয়ে নেহার তার জামাতা মাহমুদসহ বিদেশ থেকে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। আমার কাছে, আমার স্ত্রীর কাছে ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে। উৎসবের দিন-রাত্রি যেন। মেয়েরা বয়সে যতই বড় হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা আসলে ছোট্টটিই থেকে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই কাবুলিওয়ালা গল্পের ছোট্ট মিনির মতো। কাবুলিওয়ালাদের বুক পকেটে সযতনে রক্ষিত ভূসা মাখানো কাগজে ছোট্ট হাতের ছোট্ট ছাপ কোনদিন আর বড় হয় না। মুছেও যায় না। রহমতদের "খোকীদের" খোশুবুর মধ্যে সত্যি খোদার এক রহমত ঝরে পড়ে। যা হোক বছরের শেষ দিনটিতে বেশকিছু ছোট্টমণিদের সাহচর্যে আসার সুযোগ হয়েছিল আমার। আনন্দ আলোর সম্পাদক নাট্যকার ও নাট্যনির্মাতা রেজানূরের আমন্ত্রণে জাতীয় গ্রন্থাগারে ছোট্টমণিদের এক চিত্রাংকন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। খুব ভাল লাগল। ভাল কাটলো দিনটি। ছোট্ট-মণিদের অাঁকা ছবিতে বাংলাদেশ যেন কথা বলছিল। ছবি গান গেয়েছিল, ছবি নেচেছিল ময়ূরের মতো পাখা মেলে। ছবিতে ফুটে উঠেছিল গ্রামবাংলার অপরূপ রূপ। একা নয়, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে সবাইকে সাথে নিয়ে কিছু করার একটা আনন্দই আলাদা। এই আনন্দ ছোট্টমণিরা যতটা পায় বোঝে আমরা বড়রা ততটা পাই না। বুঝি না। একসঙ্গে বসে বড়রা ছবি অাঁকছে _এটা কী ভাবা যায়? অথচ বড়রা যদি ছোট্টমণিদের অনুকরণ করে একসঙ্গে একাগ্রচিত্তে কিছু করতে পারতো আমাদের এ দেশটা আরো এগিয়ে যেতো না সামনে? মেরিডিয়ান ও আনন্দ আলোকে ধন্যবাদ।

পৌষের অপরাহ্নে ৩১ ডিসেম্বরের মনোরম সন্ধ্যাটিকে আমার কাছে মনে হয়েছিল বসন্তের মন রাঙানো একটি সন্ধ্যা। মাছরাঙা নদীর বুকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভেজা রংধনুর প্রতিফলন যেন দেখে এলাম। চোখ জুড়ালো। মনও ভরে গেল। আনন্দ পেলাম। আলোও দেখলাম। ঘুরে এলাম একটি রংধনুর দেশ থেকে। পরদিন ১ জানুয়ারিও ছিল নিজের সত্যিকার সংস্কৃতিকে, গণমানুষের সংস্কৃতিকে গণসঙ্গীতকে আর একবার প্রাণ ভরে উপলব্ধি করার দিন। দেশের নন্দিত গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর প্রতিষ্ঠিত ঋষিজ-এর ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর একটি জ্বলজ্বলে দিন। উন্মাদনা নয়, উদ্দীপনাময় একটি সুমহান দিন। পতিত অন্ধকারের পথে সূর্যরশ্মির বর্শাফলক হাতে সাহসী অশ্বারোহীর ছুটে চলার দিন। অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয়েছিল বাংলার বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফীকে যিনি সারাটা জীবন আমাদের শুনিয়ে গেছেন বিশ্বমানবের চিরন্তনী সংগীত। আমাদের এক প্রিয় মানুষ আমাদের একা ফেলে আমাদের ঘর শূন্য করে চলে গেলেন। কলিম ভাইর নামের আগে প্রয়াত বা মরহুম কথাটা ইচ্ছে করেই সংযুক্ত করলাম না। শিল্পীর অবস্থান মানুষের হূদয়ের অতি কাছে। সত্যিকার শিল্পী কখনো মরহুম হন না। কোনদিন অবসরে যান না। এল.পি.আর-এও যান না। বছরের শুরুতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানের সেই দুটো লাইন কলিম ভাইর দরাজ ভরাট গলায় শোনা সেই গান, বহু অনুষ্ঠানে বহুবার শোনা সেই পরিচিত গান কেন যেন আজ আর একবার শুনতে ইচ্ছে করছে 'আছে দুঃখ আছে মৃতু্য, বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি তবু আনন্দ_তবু অনন্ত জাগেঃ"

এই সাফল্য উৎসাহব্যঞ্জক

প্রথম শ্রেণী হইতে নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মধ্য দিয়া শনিবার সারাদেশে 'পাঠ্যপুস্তক উৎসব' পালিত হইয়াছে।

এ উপলক্ষে ঢাকার মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল ও কলেজে আয়োজিত পাঠ্যপুস্তক উৎসবের কেন্দ্রীয় কর্মসূচীতে শিক্ষামন্ত্রী বলিয়াছেন, বইয়ের অভাবে যাহাতে আর কোন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় হইতে ঝরিয়া না পড়ে, সে লক্ষ্যে চলতি বৎসর ৩ কোটি ২২ লক্ষ পাঠ্যপুস্তক বিতরণের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। উলেস্নখ্য, ২০০৯ সাল হইতে বর্তমান সরকার প্রথম হইতে নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে। বই ছাপাইবার প্রযুক্তির দিক দিয়া বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব হইতে পিছাইয়া থাকিলেও এই অসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সকলের নিকট শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ পাইতে পারে উহাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথম দিনে সারাদেশে সকল স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা নূতন বই হাতে পাইয়া আনন্দে উদ্বেল হইয়াছে। অবশ্যি সকল স্থানে সকলেই পূর্ণাঙ্গ সেট বই পাইয়াছে এমন নহে; তবে মন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানাইয়াছেন যে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই সারা দেশের প্রতিটি স্কুল ছাত্র-ছাত্রীর নিকট নূতন বই পেঁৗছিয়া যাইবে। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ তাঁহার উদ্যম, নিষ্ঠা এবং কর্মতৎপরতা দিয়া প্রমাণ করিলেন যে, 'ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়।'

দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিশুই যাহাতে একই ধরনের শিক্ষা লাভ করে সেজন্য বর্তমান সরকার দৃঢ়তার সহিত কাজ করিয়া যাইতেছে। ইহা অত্যন্ত আশার কথা। কেননা, চারিদিকে যখন অব্যবস্থা, নীতিহীনতা, পরিকল্পনার অভাব, নিষ্ঠা ও কর্মোদ্যমের একান্তই ঘাট্তির কারণে সম্ভাবনা ও সাফল্য মুখ থুবড়াইয়া পড়ে তখন শিক্ষামন্ত্রীর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রত্যয়দৃঢ় অবস্থান সকলের মনে নূতন আশার বীজ বপন করিয়াছে বৈ কি! শিক্ষামন্ত্রী শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে তাহাদের পাঠ ভাল করিয়া বুঝাইবার এবং নোট বইয়ের পরিবর্তে পাঠ্যপুস্তক অনুসরণপূর্বক শিশুদের প্রস্তুত করিবার জন্য যে তাগিদ দিয়াছেন উহা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়িয়া তুলিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মনে শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করা একান্তই আবশ্যক। শিক্ষকরা নিজ পেশাকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করিলে শিশু মনে এই আগ্রহ সঞ্চার কোন কঠিন ব্যাপার নহে। সময়মতো বই ও শিক্ষার উপকরণাদি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পেঁৗছাইতে পারিলে এ কাজটি সহজতর হইতে পারে নিশ্চয়ই। সে লক্ষ্যেই সরকার এই বিশাল কার্যক্রমটি হাতে লইয়া ছাত্র-ছাত্রী ও তাহাদের অভিভাবকদের নিকট প্রদত্ত ওয়াদা পূরণ করিয়াছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে শৃংখলা এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ গড়িয়া তোলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ। এক্ষেত্রে বিদ্যমান বা বিরাজমান যে কোন অব্যবস্থা, সংকট কিংবা সমস্যা দূরীভূত করিয়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে সেতুবন্ধন রচনার উপরই শিক্ষার সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে।

ইতোপূর্বে সরকারী প্রকাশনা সংস্থার গুদামে অগি্নকাণ্ড, কালোবাজারে পুস্তক বিক্রয়ের জন্য সিন্ডিকেটের অপতৎপরতাসহ শিক্ষা-বিনাশী নানান অপকীর্তি সাহসিকতা এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত মোকাবেলা করা হইয়াছে। ইহার মাধ্যমে দেশে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও স্থাপিত হইয়াছে। আর তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ জানাইতে কেহই কোন প্রকার দ্বিধা করিবেন না নিশ্চয়ই। আমরাও সাধুবাদ জানাই। বই লইয়া কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রী আর তাহাদের অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার এই সাফল্য আগামী বৎসরগুলিতে অব্যাহত থাকিবে ইহাই সকলের কামনা।

পণ্যের মানোন্নয়ন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ

ত ১লা জানুয়ারি শনিবার প্রতি বৎসরের ন্যায় এইবারও মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরু হইয়াছে শেরে বাংলা নগরে। সেখানকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১৬তম এই বাণিজ্য মেলা-২০১১ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি, শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও নূতন নূতন বাজার সম্প্রসারণের তাগিদ দিয়াছেন। দেশ-বিদেশের পণ্য প্রস্তুতকারকদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শনীর সবচাইতে বড় আসর এই মেলায় ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, জাপান ও মালয়েশিয়াসহ ১৪টি দেশ অংশগ্রহণ করিয়াছে। মেলার কার্যক্রম রাজধানীর ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও বিভাগীয় শহরগুলিতে অনলাইন ভিডিও মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হইতেছে। মেলার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বাড়াইতে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

এই ধরনের মেলার উদ্দেশ্য বাণিজ্যের দিগন্ত প্রসারিত করা। বিদেশী পণ্যের সাথে দেশীয় ভোক্তাদের পরিচিত করিয়া তোলার পাশাপাশি দেশের পণ্যের প্রচার-প্রসারেও এই মেলা ভূমিকা রাখিয়া থাকে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে তো বটেই, বিদেশী আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সাথে মেলাসূত্রে যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। আমদানির তুলনায় রফতানির ভলিউম বাড়িতেছে না। ২০০৯-২০১০ অর্থ বৎসরে ২৩৭৩৮ মিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রফতানি আয় হইয়াছে ১৬২০৪.৬৫ মিলিয়ন ডলার। ইহাছাড়া অপ্রচলিত পথে যে বাণিজ্য হইতেছে, সেখানেও আমরা বড় ধরনের ঘাটতির মুখে রহিয়াছি। এখন চা বাদ দিলে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও হিমায়িত খাদ্যই আমাদের প্রধান রফতানি পণ্যের তালিকায় অবশিষ্ট থাকে। এখানে উলেস্নখ্য, এসব রফতানি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের অবদানই সর্বাধিক প্রায় ৭৭%। আর এই খাতের যে অন্তহীন সমস্যা বিদ্যমান, তাহাতে সব দিক দিয়া আমরা ঝুঁকির সম্মুখীন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতার প্রভাব আমাদের রাজনৈতিক উন্নয়নকেও এখন বাধাগ্রস্ত করিতেছে।

বাংলাদেশ আয়তনের দিক দিয়া ক্ষুদ্র হইতে পারে, তবে এখানকার বাজারটি নেহায়েত ছোট নহে। ১৬ কোটি মানুষের দেশ অনেক সম্ভাবনাময়। কাঁচামাল ও বিশেষত শ্রমিকের সহজলভ্যতা বিভিন্ন শিল্পের বিকাশে সহায়ক। কিন্তু আমরা বাস্তবে ইহার বিপরীত চিত্রই দেখিতে পাইতেছি। আমরা অনেক বৎসর ধরিয়া চা রফতানি করিলেও নিজস্ব কোন ব্র্যান্ড তৈরি করিতে পারি নাই। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চা অন্য দেশের চায়ের পরিচয়ে বিক্রি হইয়াছে। এতসব হতাশা থাকা সত্ত্বেও আমরা যদি অব্যাহতভাবে চেষ্টা করিয়া যাই, তাহা হইলে বিশ্ববাজারের অভিরুচি অনুযায়ী পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করিতে পারি। জাপান, ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বাজার সম্প্রসারণ করিতে পারি। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় রফতানি করি মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্যও জোরদার করিতে হইবে। এ জন্য প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি নানা অপ্রচলিত পণ্য রফতানি এবং ঔষধ, ফার্নিচার ও জাহাজ শিল্পের বিকাশে আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আমাদের যথাসম্ভব নিজ দেশের বাজারও ধরিয়া রাখার চেষ্টা করিতে হইবে। তাহা না হইলে বাণিজ্যে ভারসাম্য আসিবে না। গ্যাস ও বিদু্যতের সংকট দূর করিতে পারিলে এখানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ সব রকম শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হইতে পারে। পরিশেষে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হউক, ইহাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।

শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি সময়োচিত সতর্কবার্তা

দেশের শীর্ষস্থানীয় পুষ্টিবিদ ও শিশু-বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেন যে, গুঁড়োদুধসহ কৃত্রিম শিশুখাদ্যই শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বড়ো হুমকি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এইসব অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশই শুধু ব্যাহত হইতেছে না, বরং তাহারা অপুষ্টিসহ নানা ধরনের জটিল রোগেও আক্রান্ত হইতেছে।

সেইসাথে উদ্বেগজনকহারে বাড়িতেছে শিশুমৃতু্যর হার। তাহাদের মতে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ শিশুমৃতু্যর জন্য দায়ী হইল অপুষ্টি। ইহার জন্যও কৃত্রিম খাদ্যের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতাই অনেকাংশে দায়ী বলিয়া তাহারা মনে করেন। দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও খাদ্যের মান সংরক্ষণে নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরও নাজুক। গত ৩০ ডিসেম্বর সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন) আয়োজিত এক কর্মশালায় এই সতর্কবাতর্া উচ্চারিত হইয়াছে। সতর্কবাতর্াটি যে খুবই সময়োচিত তাহাতে সন্দেহ নাই।

বলাবাহুল্য, বিশেষজ্ঞদের উপযর্ুক্ত মন্তব্যের জোরালো ভিত্তিও রহিয়াছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বহু আগেই এই বিষয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করিয়াছিল। তাহাদের মতে, শিশু গুঁড়োদুধ (ইনফ্যান্ট ফমর্ুলা) কোনো জীবাণুমুক্ত খাবার নহে। গুঁড়োদুধকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত রাখার কোনো প্রযুক্তিও অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গুঁড়োদুধ উৎপাদনকারী দেশ নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং নিরাপদ খাবার বিষয়ক কতর্ৃপক্ষও একই অভিমত ব্যক্ত করিয়াছে। এই ব্যাপারে গত কয়েক দশকের বাস্তব অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নহে। গবেষণালব্ধ উদ্বেগজনক ফলাফলের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে উন্নত দেশগুলির স্বাস্থ্য ও খাদ্য প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করিয়াছে। শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হওয়ায় কয়েকমাস আগে যুক্তরাজ্যে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী নামজাদা একটি প্রতিষ্ঠানের বিপুল অংকের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। বিচারের কাঠগড়ায়ও দাঁড়াইতে হইয়াছে বিশ্বের নামিদামি একাধিক প্রতিষ্ঠানকে। গুনিতে হইয়াছে বড়ো অংকের ক্ষতিপূরণ।

গুঁড়োদুধসহ কৃত্রিম শিশুখাদ্যের উপর নির্ভরতা একটি বিশ্বজনীন বাস্তবতা। ইহার জন্য এককভাবে কাহাকেও দায়ী করা চলে না। ক্যারিয়ার, সাংসারিক চাপ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যাসহ নানা কারণে মায়েরা যেমন ক্রমবর্ধমানহারে এইসব কৃত্রিম খাদ্যের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতেছেন, তেমনি শিশুরাও এইসব খাদ্য গ্রহণেই অধিক আগ্রহী। ইহার পিছনে চটকদার বিজ্ঞাপনের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য হইলেও ইহাই একমাত্র কারণ নহে। শিশুরা সহজেই একঘেয়েমিতে ভোগে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যে, খাবারের ক্ষেত্রে এই কথা বেশি করিয়া প্রযোজ্য। তবে এই ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হইল_মাতৃদুগ্ধ। আর ইহা সর্বজনস্বীকৃত যে, দুই বৎসর বয়স অবধি শিশুর জন্য এই খাবারের প্রয়োজনই সর্বাধিক। আশার কথা হইল, বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা উচ্চারণের পাশাপাশি প্রতিকারের পথও বাতলাইয়া দিয়াছেন। পথটি সহজই শুধু নহে, ব্যয়সাশ্রয়ীও বটে। তাহারা বলিয়াছেন যে, মায়ের দুধ ও ঘরে তৈরি সুষম খাবার শিশুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ শুধু নহে, অধিক কার্যকরও বটে। শিশুর চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী অতি অল্প খরচে সহজে এই খাবার তৈরি করা যায়। সমপ্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত একটি জরিপেও প্রমাণিত হইয়াছে যে, মায়ের দুধ শুধু শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষাই করে না, বিপুল পরিমাণ অর্থেরও সাশ্রয় করে। তবে ইহার জন্য মায়েদের শুধু সচেতন হইলেই চলিবে না, যথেষ্ট সময়ও দিতে হইবে। পাশাপাশি ইহাও অনস্বীকার্য যে, বর্তমান কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া মায়েদের একার পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা সম্ভব নহে।

জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফলাফল

জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হইয়াছে গত বৃহস্পতিবার। যুগপৎ বাহির হইয়াছে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার ফল। জেএসসি-তে পাসের গড় হার ৭১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। জেডিসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ৮১ দশমিক শূন্য ৩।

জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাসের হার দেখা যাইতেছে কম। এই পরীক্ষায় শতকরা প্রায় তিরিশজন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হইয়াছে। যাহারা উত্তীর্ণ হইয়াছে তাহাদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই পাইয়াছে 'সি' গ্রেড। এইবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম। এই ফলাফল উচ্ছ্বসিত হওয়ার মত না হইলেও ইহাকে নৈরাশ্যজনক বলা যাইবে না। কেননা, অষ্টম শ্রেণীতে এই প্রথম একযোগে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাও আবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নূতন অবস্থায় কিছুটা অসুবিধা হওয়ারই কথা। এমতাবস্থায় অনেকেই হয়ত আশানুরূপ ফল করিতে পারে নাই। ক্রমান্বয়ে এই অবস্থাটি কাটিয়া যাইবে। প্রাথমিক ও জুনিয়র পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের নিমিত্ত পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থাটি অদূর ভবিষ্যতে সুফল আনিয়া দিবে বলিয়া আশা করা যায়।

প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত জেএসসি এবং জেডিসি পরীক্ষার ফলাফল বিশেস্নষণে দেখা যায় অকৃতকার্য ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই খারাপ করিয়াছে ইংরেজি ও অংক বিষয়ে। সত্য বটে, ইংরেজি বিদেশি ভাষা। এই বিষয়ে সব সময়ে, সব পরীক্ষাতেই ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত কম নম্বর পাইয়া থাকে। জুনিয়র পরীক্ষাতেও তাহা পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াছে, খানিকটা বেশিমাত্রায়। তাহার পরও আমরা বলিব এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। বর্তমান বিশ্বের কর্মজগতে প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকার জন্য ইংরেজি বলিতে ও লিখিতে পারা অত্যাবশ্যকীয়। এই ভাষাটি জানা না থাকিলে বিশ্বায়নের যুগে বিভিন্ন পেশায় প্রকৃত দক্ষ-যোগ্য ব্যক্তিও অনেক সময় নিজেকে তুলিয়া ধরিতে পারেন না। কাজেই এই ভাষাটি ভাল করিয়া শেখা দরকার। মাতৃভাষাও সঠিক-শুদ্ধভাবে বলিতে ও লিখিতে পারিতে হইবে। অন্যদিকে, অংক বিষয়টি জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে কম-বেশি সকলেরই প্রয়োজন। তদুপরি অংক শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি বাড়ায়। ইহা মস্তিষ্কের চমৎকার ব্যায়াম।

বলাই বাহুল্য, মানুষের জানাশোনা ও জ্ঞানার্জনের ভিত্তিভূমিটি নির্মিত হয় শৈশবে-কৈশোরে, স্কুল পর্যায়ে। অনুশীলনের মাধ্যমে শেখার ক্ষমতা বাড়াইবার ইহাই সর্বোত্তম সময়। স্কুল পর্যায়ে ইংরেজি ও অংকসহ অন্যান্য বিষয়ে জোর দেওয়া হইলে ভবিষ্যতে তাহারা আরও ভাল করিবে। ক্রমান্বয়ে আরও বেশি জানা, বেশি শেখা তাহাদের জন্য সহজ হইয়া আসিবে। এবারের ফলাফলের আলোকে বলা বাঞ্ছনীয় যে, দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও অংক বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

এইবারের জেএসসি এবং জেডিসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাই। তাহাদের শিক্ষাজীবন সুন্দর ও সার্থক হউক।

স্বাগত ২০১১ সাল

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দিন যায় ও দিন আসে। কাল-মহাকালের উপর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কাহারও হাত নাই। দেখিতে দেখিতেই বিদায় নিল সুখ-দুঃখের আরেকটি বৎসর_ ২০১০ সাল।

বিশ্ব জুড়িয়া কত ঘটনা, কত হাসি-কান্না, বিষাদ ও উত্তেজনা। সবকিছুকে ছাপাইয়া আজ নূতনের কেতন উড়ে। বুকে বাঁধে আশা ও স্বপ্নের বাসা। নববর্ষের ঊষার আলোকে সম্পূর্ণ নূতন রঙ্গে শুরু হউক আমাদের পথচলা। তাই নূতন বৎসরের নূতন দিনে সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।

বাংলাদেশে গত বৎসরটি নানা দিক দিয়াই আশার আলো ছড়াইয়াছে। এমন সব সাফল্য অর্জিত হইয়াছে যাহা সহসা ভুলিবার নহে। আইটি খাতের অগ্রগতি, প্রথম বাংলাদেশী নাগরিক হিসাবে মুসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয় ও গলফে সিদ্দিকুর রহমানের ঈর্ষণীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতি হিসাবে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করিয়াছে। সারা বৎসর জুড়িয়া ক্রিকেটের গৌরবময় বিজয়ের সহিত আমরা আনন্দে আত্মহারা হইয়াছি। এ বৎসর সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখিয়াছে। একটি নূতন শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী এবং জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করিয়াছে। বৎসরের শেষপ্রান্তে আসিয়া আমরা সকলেই সেই সাফল্য ভাগাভাগি করিয়া নিয়াছি। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনে গবেষকদের কৃতিত্বের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে কৃষকদের ভালভাবে ধরিয়া রাখাও সম্ভব হইয়াছে। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতির চাকা ছিল সচল। যদিও বৎসরের শেষে আসিয়া কয়েকটি হরতাল হইয়াছে ্এবং রপ্তানির প্রধান খাত গার্মেন্টস সেক্টরে কিছুটা অস্থিরতা ছিল। অন্যদিকে অ্যানথ্রাক্স আতংককে সফলভাবে মুকাবিলা করিতে পারিলে চামড়া শিল্পের বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হইত। গ্যাস ও বিদু্যতের সংকট দূর করিতে পারিলে আরও ত্বরান্বিত হইত শিল্পোন্নয়ন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সারা বৎসরের আলোচিত বিষয় ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ট্রাইবুনাল গঠন, কয়েকজন বিরোধী রাজনীতিকের গ্রেফতার, বিরোধী নেতার মইনুল রোডের বাড়ি ত্যাগ ইত্যাদি। নানা কারণেই এ বৎসর দেশের আদালতপাড়া ছিল সরগরম। ইহাছাড়া নিমতলির ট্রাজেডি, ভূমিকম্প আতংক, কয়েকটি মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনা, শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন ও দ্রব্যমূল্যের বাজারে সময়-সময়ান্তরে উত্তাপ প্রভৃতি বিষয়ও ছিল সাধারণের আলোচনার কেন্দ বিন্দুতে।

২০১০ সালে বরাবরের ন্যায় আন্তর্জাতিক অঙ্গন ছিল উত্তাপ ও উত্তেজনায় ভরা। প্রকৃতপক্ষে নাইন ইলেভেনের পর বিশ্ব পরিস্থিতিতে যে অস্থিরতার ছোঁয়া লাগে, তাহা অবসানের কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না এখনও। বরং দিন দিন ইহা আরও জটিল আকার ধারণ করিতেছে। গত বৎসর বিভিন্ন দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলার চাইতেও বড় খবর ছিল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রতিষ্ঠান উইকিলিকসের চাঞ্চল্যকর তথ্য বিস্ফোরণ। হাইতিতে ভূমিকম্পে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, পাকিস্তানের এক-পঞ্চমাংশ এলাকায় বন্যা, রাশিয়ায় পোল্যান্ডের বিমান দুর্ঘটনা, চিলির আটকাইয়া পড়া খনি শ্রমিকদের রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার, ব্রিটেনের জোট সরকার, ইরাক ও আফগানিস্তানের নির্বাচন, ব্যাংককে লালশার্টের বিক্ষোভ, সোমালিয়ার জলদসু্যদের দৌরাত্ম্য, অমীমাংসিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া, কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা ইত্যাদি বিষয়ও ছিল আলোচনার পাদপীঠে। তবে বিজ্ঞানীদের আইপ্যাড আবিষ্কারসহ মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির মুক্তিলাভ আমাদেরকে অনেকটা আশান্বিত করিয়াছে।

নূতন বর্ষের শুরুতেই বাংলাদেশ ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অন্যতম আয়োজকের দায়িত্ব পালন করিবে। আমাদের জাতীয় সম্মান, সুনাম, গৌরব রক্ষায় ইহা সহায়ক হইবে বলিয়া আমরা আশা করি। অন্যদিকে আর কয়েকদিন পরেই বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করিবে। তাই জাতীয় সংসদ কার্যকরসহ নানা ক্ষেত্রে আগামীর দিনগুলিতে সরকার সাফল্য অর্জন করুক এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত থাকুক_ ইহাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট ীয়_সকল পর্যায়ে ২০১১ সালের প্রতিটি দিন হউক সুন্দর ও কল্যাণময়। শুভ নববর্ষ।

শিং মাছের বিপর্যয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে

ত ১২ ও ১৯ ডিসেম্বর তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের মাটি ও মানুষের কৃষি পাতায় "বিপর্যয়ের মুখে শিং মাছের চাষ" বিষয়ক দু'পর্বে দুটি লেখা লিখেছিলাম।

মাছের রোগ সমাধানকল্পে গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মামুন চৌধুরী কৃষি পাতায় আমার লেখাটির গুরুত্ব ও দেশের মৎস্য খামারিদের কথা চিন্তা করে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। তবে মামুন চৌধুরী শিং মাছের এ রোগটিকে "ইএসসি" বা এন্টেরিক সেপটিসেমিয়া অফ ক্যাটফিস রোগ বলে শনাক্ত করেছেন যা এডওর্য়াডসিয়েলা ইকটালুরি নামক পরজীবী প্রোটোজোয়ার এর সংক্রমণে হয়ে থাকে বলে উলেস্নখ করেছেন। তিনি আরো লিখেছেন, এ রোগের জীবাণু ১৮০ থেকে ২৮০ সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রায় অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি এ রোগটিকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন বাস্তবে তারচেয়ে বেশি বলে মনে হয়েছে আমার কাছে যেমন-

১. যে তাপমাত্রায় এ রোগটির জীবাণু অতিদ্রুত বংশ বিস্তারের কথা উলেস্নখ করেছেন আমাদের দেশের পানির বা আবহাওয়ার তাপমাত্রা এর ধারের কাছেও নেই তারপরেও এটি অতিদ্রুত বংশ বিস্তার করছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব এটা পরিবর্তনশীল জীবাণু?

২. প্রাথমিক পর্যায়ে একধরনের পরজীবীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এ রোগের সৃষ্টির কথা উলেস্নখ করেছেন। যদি পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এ রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে ওই নির্দিষ্ট পরজীবীর ঔষধ প্রয়োগ করে অভিমুখেই পরজীবী নিধন করে এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব কিন্তু বাস্তবে কোনো ঔষধেই এ রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না।

৩. আর এ রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্নজাতের এন্টিবায়োটিক এর কথা উলেস্নখ করেছেন এবং এর প্রয়োগবিধি খাবারের সাথে মিশিয়ে প্রয়োগের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই-কোনো মাছ যখন রোগাক্রান্ত হয় তখন স্বাভাবিক কারণে খাবারের প্রতি অনিহা দেখা দেয় আবার কখনো কখনো একবারেই খায় না। সে জন্য খাবারের সাথে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে কতটুকু কাজে লাগবে তা বলা কঠিন।

আমার এ কথাগুলো বলার অর্থ হল মামুন চৌধুরীর যে সব চিকিৎসার কথা উলেস্নখ করেছেন আমাদের দেশের শিং মাছ চাষিদের এ সব চিকিৎসা সব সময় করছেন কিন্তু কোনো ফল আসছে না।

আমি কয়েকটি পর্যবেক্ষণ এখানে উলেস্নখ করছি-

১. পর পর ২ বছর পুকুরে শিং মাছের চাষ করার পর তার পরের বছরে পুকুরের তলা ভাল করে শুকিয়ে যথারীতি চুন প্রয়োগ দিয়ে প্রায় ২ মাস পর শিং মাছের মজুদ করা হয় কিন্তু বাজারজাত করার ঠিক আগে প্রায় ৩ টন শিং মাছ মারা যায়।

২. সম্পূর্ণ নতুন করে খনন করা পুকুরে শিং মাছের পোনা মজুদ করা হয়। মজুদের ৪ মাস পর ৩ দিনের মধ্যেই সমস্ত মাছ মারা যায়। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের চিকিৎসা করা হয়।

৩. কৈ এবং তেলাপিয়ার সাথে মিশ্রভাবে যদি শিং মাছের চাষ করা হয় এ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মাছ মারা গেলেও পরবতর্ীতে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।

মামুন চৌধুরীর পুকুর ব্যবস্থাপনার উপর যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রত্যেক মৎস্য খামারির অনুসরণ করা উচিৎ। কেননা এ ব্যবস্থাপনায় দেশি মাগুর ও পাঙ্গাস চাষ খুব ভাল হয়ে থাকে। পরিশেষে বলতে চাই সামপ্রতিক সময়ে শিং মাছের এ রোগ নিয়ে সবাই একসঙ্গে কাজ করার এখনই সময় নইলে শিং মাছের এ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার কোনো উপায় থাকবে না ।

এ. কে. এম. নূরুল হক

সৌদি খেজুরের অর্থকরী ও পরিবেশগত দিক

মাদের দেশে যে খেজুর দেখা যায় তা বুনো বা পাতি খেজুর। বুনো খেজুরের বীজ থেকে সহজেই চারা গজায়। খোরমা খেজুরের বীজ থেকে সহজে চারা গজায় না বলে আমাদের দেশে খোরমা খেজুরের বিস্তৃৃতি হয়নি এবং খেজুর চাষ যে বহুমুখী অর্থকরী ফসল তা কখনো কেউ বিবেচনায় আনেনি।

সকলের একটি বদ্ধমূল ধারনা খেজুর মরুর দেশের ফসল। আসলে ধারনাটি সত্যি নয়, খেজুর উষ্ণ মণ্ডলীয় ফল এবং মরুর দেশের চাইতে আমাদের দেশে খেজুরের ফলন অধিক হবে পাশাপাশি ফলের মান হবে উন্নত। আর এর পেছনের কারণ হিসেবে কাজ করছে পানির প্রাপ্যতা। খেজুরই একমাত্র ফল যা স্বাভাবিকভাবে ৩ থেকে ৪ বছর সংরক্ষণ করা যায় আর তাই বিকল্প খাদ্য হিসেবে খেজুরের গুরুত্ব্ব অপরিসীম। চিনি: খেজুর ফলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চিনি থাকে তাই খেজুর পরিশোধন করে চিনি উৎপাদন করা যায়। রস: নারী-পুরুষ উভয় প্রকার খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করা যায়, যা থেকে সহজেই বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা যায়- ক) রাব; খ) গুড়; গ) চিনি; ঘ) ডরহব; ঙ) অষপড়যড়ষ; চ) অপবঃরপ ধপরফ বা ভিনেগার (প্রাকৃতিক)। কাগজ: খেজুর গাছের পাতা বিভিন্ন প্রকার মণ্ড ও কাগজ তৈরির এক উত্তম উপকরণ। কারণ এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার আলফা সেলুলোস (৫০-৫০%) ও হেমিমেলুলোস (২৬-৩০%)। অাঁশের দৈর্ঘ্য ১.২৫ মিঃ থেকে ২.৫ মি. মি. পর্যন্ত হয়। তাই খেজুর পাতা দিয়ে কাগজ তৈরিতে কোনো প্রকার সিন্থেটিক পলিমার যোগ করার প্রয়োজন হয় না। এই কাগজ ১০০ ভাগ পরিবেশবান্ধব। মাটিক্ষয় রোধ: খেজুর গাছের রয়েছে প্রকাণ্ড মূলতন্ত্র যা সোজা ও আড়াআড়িভাবে প্রায় ৫০ ফুট এবং মাটির গভীরে যায় ৭০ ফুট। পাশাপাশি অনেক খেজুর গাছ থাকলে সেগুলোর মূল মাটির গভীরে পরস্পর আড়াআড়িভাবে এক ধরনের জাল সৃষ্টি করে যা মাটি ধরে রাখতে সহায়তা করে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ: বিশাল ও মজবুত মূলতন্ত্রের কারণে খেজুর গাছ তীব্র ঝড় প্রতিরোধ করতে পারে। ঝড়ের তীব্রতা কমাতে উপকূলীয় এলাকায় খেজুরের বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সিডোর আইলা ইত্যাদির মত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা অনেক কমিয়ে দেয়। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় হারকেন এন্ড্রিউ। সেখানে তীব্র ঝড়ের পর যে ক'টি গাছ দাঁড়িয়েছিল তার প্রায় সবগুলোই ছিল পাম জাতীয় গাছ এবং তার অন্যতম ছিল খেজুর গাছ। মরুকরণ প্রতিরোধ: অন্য যেকোনো গাছের তুলনায় খেজুর গাছ মাটির গভীর থেকে অধিক পরিমাণে পানি শোষণ করে উপরে তুলে আনে বলে পানির স্তর নিচে নামতে পারে না।

তিউনিসিয়ার গণবিক্ষোভে অস্বস্তিতে ভুগছে আরব বিশ্বের নেতারা

তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলীর ক্ষমতাচ্যুতির পর আরববিশ্বের সরকারগুলো উদ্বিগ্নভাবে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আরববিশ্বে এই আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে যে গণবিক্ষোভের ধাক্কা শেষ পর্যন্ত আরববিশ্বের অন্যান্য দেশেও লাগতে পারে।
দীর্ঘ ২৩ বছর লৌহকঠিন হাতে দেশ শাসনের পর গত শুক্রবার গণবিক্ষোভের কাছে নতি স্বীকার করে সৌদি আরবে পালিয়ে যান বেন আলী। এই প্রথম কোনো আরব নেতা গণবিক্ষোভের কাছে হার মেনে দেশ ছাড়লেন।
বেন আলীর ক্ষমতাচ্যুতি সম্পর্কে মন্তব্য করার ব্যাপারে সতর্ক মধ্যপ্রাচ্যের প্রশাসনগুলো। উত্তর আফ্রিকার ওই দেশটিতে গণ-অভ্যুত্থানের সুবিধা নিতে চাইছে বিরোধী পক্ষগুলো। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ক্রমবর্ধমান অস্বস্তিতে ভুগছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
আরববিশ্বের ঘটনাবলি থেকে দূরে থাকতে পশ্চিমাবিশ্বকে সতর্ক করে দিয়েছেন মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ আবুল ঘেইত। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন চলতি সপ্তাহে সংস্কারের জন্য জনগণের সঙ্গে কাজ করতে আরব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানোর পর তিনি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন।
এদিকে তিউনিসিয়ার মতো গণ-অভ্যুত্থান অন্যান্য আরব দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে—এই আশঙ্কাকে ‘অর্থহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্গানাইজেশন অব দ্য ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) তিউনিসিয়ার ঘটনাবলিকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে ও দেশের ভিত্তি দুর্বল করার যেকোনো অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার জন্য তিউনিসীয়দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এদিকে বেন আলীর পতন ইয়েমেনি তরুণদের মনে সাহসের সঞ্চার করেছে বলেই মনে হচ্ছে। দেশটির প্রায় এক হাজার তরুণ নেমে আসেন রাজধানী সানার রাজপথে। নিজ নিজ নেতাদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার জন্য আরবদের প্রতি তাঁরা আহ্বান জানান।
সানা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের একটি শোভাযাত্রা তিউনিসিয়া দূতাবাস অভিমুখে যায়। নিজ নিজ ‘সন্ত্রস্ত ও কপট নেতাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের জন্য’ তাঁরা আরব জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
শোভাযাত্রায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যানার বহন করেন। একটি ব্যানারে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর নাম উল্লেখ না করে বলা হয়, ‘ক্ষমতাচ্যুত করার আগেই ক্ষমতা ত্যাগ করুন।’ সিরিয়ার সরকারপন্থী দৈনিক আল-ওয়াতান-এ বলা হয়, তিউনিসিয়ার ঘটনাবলি এমন একটি শিক্ষা, যা কোনো আরব সরকারেরই উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
জর্ডানের শক্তিশালী ইসলামি সংগঠন সত্যিকারের সংস্কার সাধনের জন্য আরব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির প্রতিবাদে পার্লামেন্টের বাইরে আয়োজিত এক সমাবেশে ব্রাদারহুডের প্রধান হাম্মাম বলেন, ‘তিউনিসিয়ার জনগণ যেভাবে ভুগেছিল, জর্ডানে আমরাও একইভাবে ভুগছি।’ এএফপি।

২০০৯ সালে ভারতে ১৭ হাজার কৃষকের আত্মহত্যা

ভারতে ১৭ হাজারেরও বেশি কৃষক ২০০৯ সালে আত্মহত্যা করেছে। আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা সাত শতাংশ বেশি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) গতকাল সোমবার তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা জানায়।

'ভারতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও আত্মহত্যা' শীর্ষক প্রতিবেদনে এনসিআরবি জানায়, ২০০৯ সালে ১৭ হাজার ৩৬৮ কৃষক আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি ছিল মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে। কিন্তু কী কারণে কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নেয়, সে ব্যাপারে কিছু জানায়নি ব্যুরো।
টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (টিআইএসএস) জানায়, ৩৭ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালের বর্ষাকাল ছিল সবচেয়ে বৃষ্টিহীন। এতে দেশব্যাপী বিশেষ করে, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ঠিকমতো ফলন ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক। তাদের মাথায় ঋণের বোঝা বেড়ে যায়।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয় বলে মনে করে টিআইএসএস। সংস্থাটির দাবি, ভারতে শহরাঞ্চলে আর্থিক উন্নয়ন হলেও এখনো তিনজনের দুইজন গ্রামে বাস করে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে ভারতে দেড় লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। সূত্র : এএফপি।

পাংশায় ভয়! এজেন্টকে দেখিয়ে সিল মারতে হলো ভোটারদের

'দেশ স্বাধীনের পর কখনোই এমন পরিস্থিতি হয়নি। অব্যাহত হুমকির কারণে ভোটের আগে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল; আর আজ ভোট দিতে হলো প্রকাশ্যেই।' কথাগুলো বলছিলেন পাংশা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঢেঁকিপাড়া গ্রামের ৭০ বছর বয়সী জামালউদ্দিন।

গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে শাহজুই মাদ্রাসাকেন্দ্রে তিনি ভোট দেন। সাংবাদিক পরিচয় জেনে ক্ষোভের সক্সগে অভিযোগ করলেন_স্বাধীন রাষ্ট্রে গোপন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও পাংশা পৌরসভার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যতিক্রম ঘটেছে। ভয়ে তাঁর মতো অনেককেই
'নির্ধারিত প্রার্থীর এজেন্টদের দেখিয়ে' ব্যালট পেপারে সিল মারতে হয়েছে। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন এই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা পারনারায়ণপুর গ্রামের ৬০ বছর বয়সী শের আলী বিশ্বাস, আবুল বিশ্বাসসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত ১৫ ভোটার।
জামালউদ্দিনের অভিযোগ, শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ওয়াজেদ মাস্টারের ভাই ইদ্রিসসহ ১০-১২ জন তাঁর বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে এসেছেন। বলেছেন, বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকলে এজেন্টের সামনেই 'আনারসে' ভোট দেবেন। না হলে পরিণাম ভয়াবহ হবে। চাপের মুখে গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়বাড়ি কলিমহরে গিয়ে দুই দিন থাকার পর গতকাল সকালে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরামর্শে বাড়ি ফিরে ওয়াজেদ মাস্টারের এজেন্টের সামনেই ভোট দিয়েছেন।
জামালউদ্দিন, শের আলী, আবুলসহ একাধিক ব্যক্তির অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে কেন্দ্র থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের পারনারায়ণপুর গ্রামে গেলে একাধিক বাসিন্দা প্রকাশ্যেই করেন নানা অভিযোগ। আলী শেখের বৃদ্ধা মা আমেনা খাতুন, স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম এবং ছোটভাইয়ের স্ত্রী নয়ন বেগম বলেন, গত শনিবার রাতে ১০-১২ জন মুখে কাপড় বেঁধে তাঁদের বাড়ি গিয়ে দরজায় লাথি মেরে ও হুক্সকার দিয়ে ডেকে বের করে। সবাইকে ঘুম থেকে তুলে আনারস প্রতীকে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তা না হলে গ্রামছাড়া করা হবে বলে শাসিয়ে যায়। একই অভিযোগ পারনারায়ণপুর গ্রামের যুবক রেজাউল, খোকন, মাসুদ, রমজানসহ আরো অনেকের। তাঁরা জানান, এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া অন্য দলের কেউ কথা বলতে পারছে না।
কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা কালিকাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার বাসিন্দা সুরজ মুন্সী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শাহজুই মাদ্রাসা কেন্দ্রটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর নিজস্ব এলাকা হওয়ায় অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা এখানে কোণঠাসা। হুমকি ও ভয় দেখানোর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সত্যতা আমিও জেনেছি। এলাকায় উৎসবের আমেজে ভোটগ্রহণ দেখা গেলেও সাধারণ অনেক ভোটারেরই মনে রয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও কষ্ট।'
শাহজুই মাদ্রাসা কেন্দ্রে কথা হয় বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাবিবুর রহমান রাজার সক্সগে। তিনি দুপুর ১টার দিকে অভিযোগ করে বলেন, 'আমি স্থানীয় ছয় বিএনপি কর্মীকে কেন্দ্রটিতে পোলিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের হুমকির কারণে মাত্র একজন যোগ দিয়েছেন। নিরুপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনজনকে ডেকে এনে তাঁদের সক্সগে আমি নিজেও পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করছি। ভোট গণনার সময়ও এখানেই থাকব।' তিনি জানান, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পাংশা জজ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করা তাঁর ভাই এলাহী হোসেনকেও প্রতিপক্ষের লোকজন তাড়িয়ে দিয়েছে। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম কেন্দ্র পরিদর্শনের নামে এখানে অবস্থান করে প্রিসাইডিং অফিসারের সক্সগে চা-নাস্তা খাওয়াসহ খোশগল্প করেছেন। এ সময় তাঁর সক্সগে ছিলেন ১৫ জনেরও বেশি নেতা-কর্মী।
অভিযোগের সত্যতা জানতে প্রিসাইডিং অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ আহমেদ জমসেদের কক্ষে গেলে এমপি জিল্লুল হাকিমকে সেখানে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সকাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। কোথাও কোনো অনিয়ম দেখিনি।' ভোটারদের হুমকি ও ভয় প্রদর্শন প্রসক্সগে তিনি বলেন, পৌরসভার ভেতরে তেমন চরমপন্থী নেই; তবে চর এলাকায় রয়েছে। যদিও এখন তাদের ক্ষমতা কমে গেছে।
অভিযোগ প্রসক্সগে প্রিসাইডিং অফিসার সৈয়দ আহমেদ জমসেদ বলেন, 'এই কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ হচ্ছে। কেন্দ্রের দুই হাজার ১১ ভোটারের মধ্যে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছয়টি বুথে প্রায় ১২০০ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ভয়ভীতি থাকলে এটা সম্ভব হতো না।'
নির্বাচনী আচরণবিধি ভক্সগ : পৌনে ১২টার দিকে শাহজুই মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ওয়াজেদ আলী মাস্টারের নাম ও প্রতীক সংবলিত সাদা টি-শার্ট ও ক্যাপ পরিহিত দুই শিশুকে। শিশু দুটির পরিচয় জানতে গিয়ে কথা হয় ওয়াজেদ আলী মাস্টারের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের সক্সগে। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, 'ভোটারদের আকৃষ্ট করতে মাত্র ১৮ জোড়া ক্যাপ ও টি-শার্ট ছাপানো হয়েছে। যদিও আমাদের ফ্যামিলি অনেক বড়।'
দেখা গেছে, একই ধরনের শার্ট ও ক্যাপের কারণে ওই ভোটকেন্দ্রের অধিকাংশ ভোটারেরই শিশু দুটির দিকে বাড়তি মনোযোগ ছিল। এ ছাড়া মাইক্রোবাস নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপির উপস্থিতি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে।
এই কেন্দ্রে ভ্যানে চড়ে ভোট দিতে আসেন পারনারায়ণপুর গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা আকিরুন বেগম। কথা প্রসক্সগে একই গ্রামের ভ্যানচালক জামাল জোয়ার্দ্দার জানান, ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রইচউদ্দিন ৫০০ টাকায় দিনব্যাপী ভ্যানটি ভাড়া নিয়েছেন। এই ভ্যানে করে তাঁর সমর্থিত ভোটারদের কেন্দ্রে আনা-নেওয়া হচ্ছে।
বেলা ২টার দিকে কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার জানান, পৌরসভার কেন্দ্রগুলোর সার্বিক অবস্থা সুশৃক্সখল। আচরণবিধি ভক্সগের তেমন অভিযোগ মেলেনি। পরে টি-শার্ট ও ভ্যান ভাড়া প্রসক্সগ তুললে আশপাশে তিনি তাঁদের খুঁজতে থাকেন।
পাংশা জজ স্কুলকেন্দ্রে অবস্থানরত ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী গোবিন্দচন্দ্র কুণ্ড অভিযোগ করেন, প্রতিপক্ষ রামদাস দত্তের লোকজন তাঁর সমর্থকদের মাঠের আশপাশে থাকতে দেয়নি।
পাংশা পৌরসভার আওয়ামী লীগ প্রার্থী ওয়াজেদ আলী মাস্টার গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নিশ্চিত পরাজয় জেনেই অভিযোগ করেছে বিএনপি প্রার্থী। পাংশা এলাকায় প্রশাসনের তদারকি কঠোর ছিল। ফলে ভয় দেখিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে ভোট নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।' ছাপানো ক্যাপ ও টি-শার্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কিছু অতি উৎসাহী সমর্থক এটা করে থাকতে পারে। তবে তা আমার জানা নেই।'
জেল-জরিমানা : নির্বাচনী আচরণবিধি ভক্সগের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল রাজবাড়ী পৌরসভা এলাকায় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সুমন হোসেন, ২ নম্বর ওয়ার্ডের হেলাল উদ্দিন ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিদ্দিকুর রহমানকে ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। পাংশা পৌর এলাকায় দুটি ট্রাকের অবাধ চলাচলের কারণে চালকদের দেড় হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া গোয়ালন্দে ভোট কেনার জন্য টাকা দেওয়ার সময় মাজেদ নামের এক যুবককে ছয় মাসের, জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে বিল্লু বিশ্বাস এবং মাসুদ নামের এক পোলিং এজেন্টকে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক সৈয়দা সাহানা বারী গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশাসনের নানা পদক্ষেপ ও তদারকির ফলে রাজবাড়ী, পাংশা ও গোয়ালন্দ পৌরসভায় শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। তিনটি পৌরসভার কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আর নির্বাচনী আচরণবিধি ভক্সগকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।'

নির্বাচকদের দলে মাশরাফি নেই

নির্বাচকরা বিশ্বকাপ দল চূড়ান্ত করে সেটা জমাও দিয়ে দিয়েছেন বোর্ডে। আর তাই নিয়ে কাল উত্তপ্ত হলো টেকনিক্যাল কমিটির সভা। কারণ তাদের চূড়ান্ত ১৫ জনে মাশরাফি নেই। এখনো বিশ্বকাপের বাকি এক মাস, ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেখানে চাইলে ১৬ জন রাখা যায়, সেখানে কেন মাশরাফির বিষয়ে নির্বাচকদের এমন কঠোর অবস্থান।

সেই প্রশ্ন ওঠে সভায়। দেওয়ান শফিউল আরেফিনের মতো কেউ কেউ কঠোর অবস্থান নেওয়ায় তর্ক হয় পক্ষে-বিপক্ষে। আর তাই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সময় নিতে এক দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা। আজকের বদলে সেটা আগামীকাল ঘোষণা করা হবে বলে নিশ্চিত করেছে বিসিবি।
মাশরাফিকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বাইরে আরো দুটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্বাচকরা। ফিরিয়ে এনেছেন শাহরিয়ার নাফীসকে। দলে রাখা হয়েছে আশরাফুলকেও। এর বাইরে বাকি সম্ভাব্যদের সবাই আছেন তালিকায়। এই তালিকাটা নিয়ে কাল সন্ধ্যায় বিশেষ কমিটির সভায় উপস্থিত হন প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলম এবং তাঁর দুই সহকারী আকরাম খান ও জাহিদ রাজ্জাক মাসুম। বিশ্বকাপ দল নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার এ আলোচনায় যুক্তি-পাল্টাযুক্তির এক পর্যায়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সে সভা। মাশরাফি বিন মর্তুজাকে কেন স্কোয়াডে রাখা হয়নি? আবার রকিবুল হাসানকে দলে রাখা নিয়েও কঠোর জেরার মুখে পড়তে হয়েছে নির্বাচকদের। এ ব্যাপারে অবশ্য নির্বাচকদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি।
তবে সভাশেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন বিসিবি পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজ। বিশ্বকাপ দল কবে ঘোষণা হবে_এ প্রশ্নে তাঁর উত্তর, 'আমাদের হাতে সময় আছে। তাই আরো একটি দিন সময় নিচ্ছি।' নির্বাচকরা দল হাতে তুলে দেওয়ার পরও তা ঘোষণায় এ বিলম্বের কারণ, 'দলে কিছু ইনজুরি সমস্যা আছে। আরো কিছু বিষয় আছে। তাই ১৯ জানুয়ারি দল ঘোষণা করা হবে।' দল নির্বাচনে ইনজুরি সমস্যা আছে শুধু একজনের। তাহলে কি মাশরাফির জন্যই এ অপেক্ষা? তা স্বীকার করলেও বাস্তবতা সম্পর্কে এনায়েত হোসেন যে ইক্সগিত দিয়েছেন, তাতে ঘরের মাঠে মাশরাফির বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা ক্ষীণ, 'আমি খুব একটা আশাবাদী নই। তবু সময় যখন হাতে আছে, একটু অপেক্ষা না হয় করলামই।' আবার বিকল্প পথও দেখিয়েছেন তিনি, 'ইচ্ছা করলে স্কোয়াডটা ১৬ জনের করতে পারি। তবে সেটি ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কারণ এরপর বিশ্বকাপ স্কোয়াড চলে যাবে আইসিসির অধীনে। তখন নিজেদের খরচেও বাড়তি ক্রিকেটার দলে রাখার সুযোগ নেই। তবে ১৫ জনের দলেও মাশরাফিকে রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিতান্তই সম্ভব না হলে মাশরাফিকে ইনজ্যুরড দেখিয়ে আইসিসির অনুমতি সাপেক্ষে আমরা যে কাউকে দলে নিতে পারব।' ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যখন অপেক্ষা করা যাবে এবং যখন অন্য দলগুলোর সবাই সময় আছে বলে (ভারতের টেন্ডুলকার-শেবাগ-গম্ভীর সবাই ইনজুরিতে, তবু দলে আছেন) শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করছে, সেখানে নির্বাচকদের মাশরাফি-বিষয়ক এই অবস্থান একটু অবাক করা। মাশরাফি যেখানে দলের অন্যতম প্রধান সম্পদ, বড় কিছু করতে হলে তাঁর প্রয়োজন যেখানে প্রশ্নাতীত, সেখানে সবার উচিত কোনোভাবে তাঁকে রাখা যায় কি না সেই চেষ্টা করা। বোর্ডের বড় অংশটা সেটা বোঝে বলেই প্রশ্নটা তুলেছে। নির্বাচকরা অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন ফিজিও মাইকেল হেনরির রিপোর্টকে। তাঁর রিপোর্টে খুব একটা আশার বাণী না থাকাতেই নাকি তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই রিপোর্ট নিয়েও প্রশ্ন থাকে। যে খেলোয়াড়টি এখন ব্যাটিং প্র্যাকটিস করছেন, দৌড়াচ্ছেন, এক মাস পরও তিনি বল হাতে নিতে পারবেন না_এই নিশ্চয়তা যে কী করে একজন দিয়ে দেন কে জানে! আর মাশরাফি ক্রাচে ভর করে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হওয়ার তিন সপ্তাহ পরই কিন্তু বল হাতে নেমেছেন। যা-ই হোক, এখন বোর্ডের সিদ্ধান্তই মাশরাফির বিশ্বকাপ স্বপ্ন সত্যি করতে পারে। বোর্ড সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে রকম সিদ্ধান্ত নিলে বাদ পড়বেন কে? রকিবুল হাসান? তাঁকে বাদ দিলে মিডল অর্ডারে বিকল্প ব্যাটসম্যানের সংখ্যা কমে যায়। তাহলে কি ওই পজিশনে ব্যাট করার অতীত অভিজ্ঞতার কারণে রকিবুলের চেয়ে শাহরিয়ারের কদর বেড়ে যাবে? নাকি শাহরিয়ারের ওপরই খৰহস্ত হবে বোর্ড? এমন অনেক দুর্ভাবনার ভিড়ে উঁকি দিচ্ছে নাঈম ইসলামের নামও। সাকিব-মাহমুদউল্লাহ যখন আছেন, তখন আরেকজন স্পিনার-অলরাউন্ডারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। অবশ্য এ কন্ডিশনে তিন পেসারই যথেষ্ট_এই বিবেচনায় বাদ যেতে পারেন নাজমুল।
এ নাটকীয়তায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সম্ভবত একটু আগেভাগেই শুরু হয়ে গেল!


বোর্ড ক্ষুব্ধ
নির্বাচকদের চূড়ান্ত করা তালিকায় মাশরাফি নেই। তাতে ক্ষুব্ধ বোর্ড। কেন তাঁকে রাখা হয়নি এই প্রশ্নে বিধ্বস্ত হতে হয়েছে নির্বাচকদের। পরে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সময় বের করতে দল ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এক দিন। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল ঘোষিত হবে আগামীকাল

নির্বাচকদের দল
তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, জুনায়েদ সিদ্দিকী, শাহরিয়ার নাফীস, মোহাম্মদ আশরাফুল, রকিবুল হাসান, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, আবদুর রাজ্জাক, শফিউল ইসলাম, নাজমুল হোসেন, রুবেল হোসেন, সোহরাওয়ার্দী শুভ ও নাঈম ইসলাম

তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন সম্ভাবনা by বকুল আশরাফ

শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলন, ক্ষোভ এবং ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা এবং বছরের শেষে এসে তার বাস্তবায়ন পোশাক তৈরী শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক জিএসপির শর্ত শিথিল করায় এই খাতটি থেকে আরো অধিক রপ্তানি হবার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
এতে করে ভবিষ্যতে এই তৈরী পোশাক শিল্পখাতটির স্থিতিশীল অবস্থা যে বিরাজ করবে তার ইঙ্গিত বহন করে । বর্তমানে বাংলাদেশে পোশাক তৈরী শিল্প থেকে রপ্তানি আয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে বার বিলিয়ন ডলার, যা উত্তর-উত্তর বৃদ্ধি পাবে।

জিএসপি এক ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তি । ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ সমূহে বিশ্বের অন্যান্য স্বল্পোন্নত বিভিন্ন দেশ (প্রায় ১৭৬টি দেশ) থেকে কোন দ্রব্য প্রবেশের সময় টেরিফের ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ বা এক ধরনের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এই জিএসপির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, বিশ্বের উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশসমূহের সাথে অনুন্নত দেশসমূহের বাণিজ্যের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সাধন এবং সুশাসনের লক্ষ্যে অনুন্নত দেশসমূহকে এক ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে একযোগে কাজ করার কৌশল। বা বলা যায় ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক শুল্ক হার এর ফলে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরো বেশি অংশগ্রহণে ও অতিরিক্ত রপ্তানি রাজস্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থাপনের উন্নয়ন এবং সর্বোপরি দারিদ্য্র হ্রাসে সচেষ্ট করা।

বাংলাদেশ এমন একটি অনুন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সে সুবিধা পেয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে গ্যাট চুক্তির আওতায় এই জিএসপি সুবিধা প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে যখন পোশাক তৈরী শিল্পের বিকাশ এবং রপ্তানি শুরু হয় তখন থেকেই বাংলাদেশও সেই সুবিধা পেয়ে আসছে। তখন জিএসপি সুবিধা পেতে হলে দ্রব্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপের উৎস বা অরিজিন বাংলাদেশে হতে হতো। যেমন সূতা তৈরী, সূতা থেকে কাপড় তৈরী এবং কাপড় থেকে পোশাক তৈরী। পরবর্তীতে আরো শিথিল করে দুই ধাপে করা হয়। অর্থাৎ উপরোক্ত তিন ধাপের যে কোন দু'ইটি ধাপ যদি বাংলাদেশ সাধিত হয় তবে তা জিএসপির আওতায় পরবে এবং তার জন্য শুল্কহারের হ্রাসকৃত সুবিধা উপভোগ করবে।

ইউরোপীয় বাজারে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদিত দ্রব্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশিকাধারের দাবী বহুদিনের। প্রায় ২০০৩ সাল থেকে এই দাবি আলোচিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশন রুলস অফ অরিজিনের ক্ষেত্রে সেই বহু আলোচিত জিএসপি সুবিধা বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের দাবিটি বিবেচনায় এনে ঘোষণা করে যে, মাত্র একটি ধাপ সম্পন্ন করলেই বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। এবং তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে অর্থাৎ ২০১১ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে। বাংলাদেশ থেকে যত তৈরী পোশাক রপ্তানি হবে সে সব দ্রব্যই ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। এই জিএসপির শর্ত শিথিল করায় তৈরী পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক বিশাল সম্ভাবনার দেখা দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় যেহেতু বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরী পোশাক ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে তাই ইউরোপীয় ক্রেতারা বাংলাদেশে থেকে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী আমদানী করবে, শুধুমাত্র এই শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য। কেননা স্বল্পোন্নত দেশ বা অনুন্নত দেশ বাংলাদেশকে দেয়া এই সুবিধা উন্নয়নশীল দেশ যেমন চীন, ভারতের জন্য প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের চেয়ে জিএসপি সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকবে।

অনেকেই ধারণা করছে এই সুবিধার কারণে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রপ্তানি আগামী বছরে বেড়ে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি হয়ে যাবে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে তা প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নত করা সম্ভব। বাংলাদেশের মোট তৈরী পোশাক রপ্তানির প্রায় ৬৯ শতাংশ ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করে যা ভবিষ্যতে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুতরাং এই যে সুবিধা তা অবশ্যই পোশাক তৈরী শিল্পের মালিকদেরকে আরো বেশী সচেতন করে তুলবে।

জিএসপির সুবিধার কারণে সৃষ্ট অন্যান্য দিকগুলোকে ভাবতে হবে। যেমন (এক) বাংলাদেশের টেক্সটাইলস শিল্পে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে কেননা যে কোন দেশ থেকে আমদানী করা কাপড় বাংলাদেশে এনে তা শুধুমাত্র সেলাই করে রপ্তানি করলেই শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। সুতরাং বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলের উৎপাদিত কাপড়ের চাহিদা কমে যেতে পারে। যদি চাহিদা কমে যায় সরকারকে ভাবতে হবে টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বিভিন্ন সুবিধাদি সম্বলিত নতুন নীতিমালা করতে হবে। আবার টেক্সটাইল মালিকদেরকেও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য আরো বেশী প্রতিযোগিতামূলক কি করে হওয়া যায় তা ভাবতে হবে।

(দুই) বাংলাদেশে যেন আরো পোশাক তৈরী শিল্প গড়ে উঠতে পারে সে জন্য অবকাঠামোগত সুবিধাদি গড়ে তুলতে হবে। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো গ্যাস ও বিদু্যতের জোগান দেয়া। মাল আমদানী ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বন্দরের কাজগুলোকে ত্বরান্বিত করা এবং রাস্তাঘাট বৃদ্ধি করা। প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে শুল্ক ছাড়সহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা। এতে উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়বে।

(তিন) পোশাক তৈরী শিল্প যতই বৃদ্ধি পাবে ততোই দক্ষ শ্রমিকদের সংকোট ঘনীভূত হবে। শ্রমিক ধরে রাখা কষ্টকর হবে অনেক ক্ষুদ্র বা মাঝারি ধরনের শিল্প মালিকদের। এমনকি বড় বড় শিল্প মালিকদের মধ্যে আন্ত: প্রতিযোগিতা শুরু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কে কত বেশী সুবিধা প্রদান করে শ্রমিক ধরে রাখবেন বা নতুন গড়ে উঠা শিল্পে শ্রমিকে জোগান করবেন। এতে শ্রমিক সংকটের তীব্রতার কারণে অনেক শিল্প তার রপ্তানির জন্য প্রদেয় কমিটমেন্ট হারাতে পারেন। তখন সৃষ্ট হবে অন্য সব জটিলতা। সুতরাং বাংলাদেশে পোশাক তৈরী ও রপ্তানি সমিতির এখন থেকেই মনিটর করতে হবে এবং সরকারের যাথে যৌথভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউট তৈরী করে শ্রমিকদের এখন থেকেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করা। অন্যথায় এই জিএসপির সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব নাও হতে পারে।

অব্যাহত রাখতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে সূচিত অগ্রগতি

র্তমান সরকারের গত সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল সর্বাধিক সক্রিয় ও আলোচিত। শিক্ষাক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে অনেক অগ্রগতি।

আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা, মাদ্রাসা শিক্ষাকে কর্মক্ষম নাগরিক তৈরির উপযোগী করা, কারিগরি শিক্ষা সমপ্রসারণের ব্যবস্থা করা, অন-লাইনে ভর্তি ও রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালু করা, লটারির মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করা, সরকারি স্কুলগুলোতে ডবল শিফট চালু করা, শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিন থেকে ক্লাস শুরু করা, সঠিক সময়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা, মানসম্পন্ন সহপাঠ বই নির্দিষ্ট করে দেয়া, পাঠ্যবইয়ে দেশ ও জাতির সঠিক ইতিহাস সংযোজন করা, জাতীয় দিবসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে তাৎপর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা, দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে একই রুটিনে অভ্যন্তরীণ/ সাময়িক পরীক্ষাগুলো গ্রহণ করে ফলাফল প্রকাশ করা, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির প্রবর্তন করা, নোট-গাইড মুখস্থ/নকল করার পরিবর্তে মূল বইভিত্তিক মেধাচর্চা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা, প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিংনির্ভর শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা প্রবর্তন করে বৃত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা প্রবর্তন করা, স্বল্প সময়ে বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করে অন-লাইনে প্রকাশ করা, মোবাইল ফোনে এস.এম.এস. এর মাধ্যমে বোর্ড পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা, ভালো স্কুল/ কলেজ বাছাই পদ্ধতি অধিকতর যুক্তিযুক্ত করা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে ১১টি করে কম্পিউটার সরবরাহ করা, আধুনিক পদ্ধতিতে পাঠদানের সুবিধার্থে বিনামূল্যে ল্যাপটপসহ প্রজেক্টার প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করা, প্রায় দুই হাজার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এম.পিওভুক্ত করা, তিন শতাধিক দাখিল ও আলিম মাদ্রাসাকে পাঠদানের অনুমতিসহ একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান করা, দেড় শতাধিক মাদ্রাসায় ভোকেশনাল ও অনার্স কোর্স চালু করা, ত্রিশ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান করা, সরকারি কলেজে নতুন পদ সৃষ্টি করে শিক্ষকদের প্রাপ্য পদোন্নতি প্রদান করা, বেসরকারি শিক্ষকদের টাইম-স্কেল প্রদান করা, বিপুল সংখ্যক মাধ্যমিক শিক্ষকসহ প্রায় ৩২ হাজার সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করা, তিন সহস্রাধিক স্কুল-কলেজের একাডেমিক ভবন নিমর্াণ প্রকল্প গ্রহণ করা, সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় আরো দেড় হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনসহ শতভাগ উপবৃত্তি ও খাদ্য সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা, উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ প্রণয়ন করা, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া, প্রতি বিভাগে একটি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ নেয়া, তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা এবং আরো ছয়টি স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেয়া, শিক্ষা সংশিস্নষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়নের চেষ্টা করা ইত্যাদি কার্যক্রমের ফলে দীর্ঘদিন পর আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে লক্ষণীয় অনুকূল পরিবর্তনের আবহ। এর জন্য আমাদেরকে আন্দোলন, সংগ্রাম ও অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক। মূলত আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক যুগোপযোগী উৎপাদনসহায়ক একমুখি জাতীয় চেতনাসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সত্যাদর্শপূর্ণ একটি শিক্ষানীতির অভাবেই সর্বক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি। বিনষ্ট হয়েছে বাঙালি জাতির সেই বজ্রকঠিন ঐক্য। তৈরি হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সোনার মানুষ। বৃদ্ধি পেয়েছে পরাজিত শক্তির আস্ফালন। পরিপূর্ণ সফলতা পায়নি আমাদের রক্তে কেনা স্বাধীনতা।

আজো অনেক সাধারণ মানুষ অনুধাবন করতে পারছে না অথবা আমরা তাঁদেরকে অনুধাবন করাতে পারছি না এই বাস্তব সত্য। অথচ আমাদের এই অধোগতির পিছনে বিরামহীন কাজ করেছে যাদের কালো হাত, তারা বোঝে ঠিকই। তারা জানে শিক্ষাক্ষেত্রে সূচিত আজকের এই অনুকূল পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকলে, আরো বেগবান হলে নিশ্চিত হবে দেশের অগ্রগতি, শানিত হবে জাতীয় চেতনা।

বৃদ্ধি পাবে সুশিক্ষিত ও সচ্ছল মানুষ। দ্রুত হ্্রাস পাবে তাদের অপ-রাজনীতির ক্রীড়নক হতদরিদ্র ও সুশিক্ষার আলোবঞ্চিত দূরদৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা। সেইসাথে হ্্রাস পাবে তাদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা।

শিক্ষা-সংশিস্নষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দ্রুত কার্যকর করতে হবে ডিজিটাল ব্যবস্থা। নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। নির্ধারণ করে দিতে হবে সকল স্তরে নিয়োজিত শিক্ষকদের কর্মঘন্টা। সেইসাথে বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা। কেননা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে শিক্ষকদের স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতা।

বার্মা কিংবা বর্মা এখন মিয়ানমার by লিয়াকত হোসেন খোকন

কেউ বলেন মিয়ানমার, আবার কেউবা 'মায়ানমার' বলেন। তবে একদা ছিল বর্মা বা বার্মা। সবার মনের মানচিত্র থেকে বার্মা বা বর্মা নামটি চিরতরে মুছে গেলেও বর্মার কাঠ, বর্মার চাল, বমর্ী চপ্পলের কথা কিন্তু ভোলা সম্ভব হয়নি। একদা ভেলভেটের ষ্ট্র্যাপ লাগানো বমর্ী চপ্পল বাংলাদেশে সহজলভ্য ছিল।

শুধু তাই নয়, বর্মার সিল্কের লুঙ্গিও ছিল এক সময় বাংলাদেশে জনপ্রিয়। বমর্ীরা ওই লুঙ্গিকে বলতো, লুঞ্জি।

১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ আর বর্মা এক ভাইসরয়ের শাসনে ছিল। এর পরেই বর্মা এবং ভারতবর্ষ ইংরেজের শাসনে সুবিধা করার জন্য আলাদা হয়ে গেল।

এক সময়ে বর্মায় বাঙ্গালিরা যেতো ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য। তখন ওখানে যারাই যেতেন তাদের অধিকাংশেরই ভাগ্য ফিরে যেতো। কত শত হাজারো বাঙালি ওখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। বর্মা সেটেল্ড হওয়া তখন তেমন কোনো কষ্টই ছিলো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিরা যত এগুতে লাগল তা শুনে তো বাঙালিরা পেলো ভয়। যুদ্ধের ভয়ে কী আর করা বাঙালিরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বর্মা ছাড়তে লাগলেন। সেই সময় প্রায় সব পরিবারই ফিরে এসেছিল নিজ দেশে। ফিরে এসে কত শত মানুষ চোখের জল ফেলে বলতে বাধ্য হয়েছিল এমন শান্ত নির্বিরোধী মানুষের দেশ, প্রাকৃতিক সবুজ আর নীল আকাশের দেশ কী আর এ জীবনে দেখা হবে। এনিয়ে কতই না ছিল বিলাপ। এদিকে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগি হয়ে গেলো। বাঙালিরা আর ফিরলো না বর্মায়। একদা বাঙালি যারা বর্মায় ছিলেন তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তারাও এই বৃদ্ধ বয়সে বর্মা ছেড়ে আসার দুঃখ ভোলেননি!

সেই বর্মা এখন মিয়ানমার। সম্প্রতি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সুচির মুক্তি ও এর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশটির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। অং সান সুচির মুক্তির মধ্য দিয়ে তাই আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে মিয়ানমারের নামটি। মিয়ানমারের যে নাম ছিল বর্মা- একথা কেউ আর বলে না।

১৯৪৮ সালে বর্মা স্বাধীন হবার আগে যুব নেতা আউং সান এবং তার ক'জন সহকমর্ী আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন। এই আউং সানের মেয়েই হলেন অং সান সুচি। তিনি নির্বাচনে প্রচণ্ড জিতেও সামরিক কর্তাদের শাসনে গৃহবন্দী হয়েছিলেন। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরও পুরস্কার আনতে যেতে পারেননি। এ থেকে আঁচ করা যায় মিয়ানমারের সামরিক কর্তারা যে কত নিষ্ঠুর, কত জালিম। শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে বর্মাকে বাঙালির কাছে এনে দিয়েছিলেন। তার গল্পের নায়ক আর পাঁচজন বাঙালি ভাগ্যান্বেষীর মতে শ্রীকান্তও বর্মা গিয়েছিলেন। তার বাসস্থান ছিল রেঙ্গুনের বাঙালি পাড়ায়। সেই রেঙ্গুন এখন ইয়াঙ্গুন নামে খ্যাত। ইয়াঙ্গুন বা রেঙ্গুনের প্রতীক হলো শোয়ে ডাগন প্যাগোডা। এই শহরে দু'টি লেক আছে। লেকের পাশে রয়েছে প্রশস্ত রাস্তা। লেকে ভাসে বড় বড় বজরা। বজরায় বসেছে রেস্টুরেন্ট।

শোয়েডাগন প্যাগোডা সম্পূর্ণ সোনায় মোড়া রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এটি দু'হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর আশ্চর্যতমের মধ্যে এটি এখন অন্যতম বলে মায়ানমারবাসী মনে করেন। শেষ বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আশ্চর্য সুন্দর দেখায় এই প্যাগোডাটি। এটি ছাড়াও ইয়াঙ্গুনে ছোট-বড় অনেক প্যাগোডা ও মন্দির রয়েছে। প্রতিটিতেই গৌতম বুদ্ধ নানা রূপে বিভিন্ন মন্দিরে অবস্থান করছেন।

অতীতে বর্মা জাহাজে যাওয়া ছাড়া যাওয়ার আরেকটা পথ ছিল, তাহলো পদব্রজ। ভয়াল নির্জন পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে একশ বছর আগে কত শত লোক বার্মা যেতো। তখনতো বর্মার মেয়েরাই এসব কাজ করতো। সংসার এবং সংসারের বাইরে পুরুষরা বর্মা চুরুট মুখে দিয়ে অলস সুখে দিন যাপন করতো। এখন আর সেই দিন নেই।