Tuesday, January 18, 2011

হবিগঞ্জ : শান্তির শহরে হঠাৎ রেষারেষি

৫ বছর পেরোনো করিমুন্নেছা একটি ভোট দিতে চেয়েছিলেন। ছেলে ফরহাদ এলাহী সেতু মাকে কোলে করে স্থানীয় আবাসিক এলাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে কেন্দ্রটি দখল হয়ে যায়। ওই মাকে ফিরতে হয় ভোট না দিয়েই।

হবিগঞ্জে ২০০৪ সালের পৌর নির্বাচনের ভোট না দিতে পারার এই কষ্টটি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় ছেলে সেতুকে। সেতুর মা কি এবার ভোট দিতে পারবেন? এবারও কি দখল হবে ভোটকেন্দ্র?
ছিমছাম শান্তির শহর হবিগঞ্জে আজ পৌর নির্বাচন। এখানে মূল লড়াই মহাজোট প্রার্থী শরীফ উল্লাহ ও বর্তমান মেয়র এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জি কে গউছের মধ্যে। কিন্তু নির্বাচনের আগের দিন গতকাল শহরবাসীর মনে ও মুখে ছিল শুধুই আতঙ্কের ছাপ। গত ১৩ বছর ধরে পৌর নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি এই আতঙ্কের মূল কারণ। মহাজোট ও বিএনপি সমর্থিত দুই প্রার্থীর মধ্যে হামলা, মামলা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে শান্ত শহরবাসীর মনে এ আতঙ্ক ভর করে। পাশের পৌর এলাকা শায়েস্তাগঞ্জে অফিস পোড়ানো ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা এই আতঙ্ককে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তবে দুপুর ২টা থেকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক তৎপরতায় অনেকে কিছুটা আশ্বস্ত হন।
শহরের স্বনামধন্য সংস্কৃতিকর্মী রুমা মোদক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছিল। এবারও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আমরা চাইছি একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, যেখানে আমরা এবার নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারব।’
শহরবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই হবিগঞ্জ পৌর নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি শুরু হয়। ওই সময় শহীদ উদ্দিন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিভু চৌধুরীকে পরাস্ত করেন ভোটকেন্দ্র দখল করে। পরে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে বর্তমান মেয়র জি কে গউছ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শহীদ চৌধুরীকে পরাস্ত করেন একইভাবে ভোটকেন্দ্র দখলের মধ্য দিয়ে। নিজের আমল থেকে ভোটকেন্দ্র দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে সাবেক আওয়ামী লীগ দলীয় পৌর চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দিন চৌধুরী দোষ চাপাচ্ছেন বর্তমান মেয়র জি কে গউছের ঘাড়ে। শহীদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আমি ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি চালু করিনি। ওই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভু চৌধুরীকে পরাজিত করেছি জনগণের কাছ থেকে পাওয়া ভোটের মধ্য দিয়ে। ২০০৪ সালের পৌর নির্বাচনে বর্তমান মেয়র প্রার্থী জি কে গউছ সাত-আটটি কেন্দ্র দখল করে ‘কেন্দ্র দখলের’ সংস্কৃতি চালু করেন।”
তবে জি কে গউছ বলেন, ‘২০০৪ সালের নির্বাচনে আমি প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছি। আমি কোনো ভোটকেন্দ্র দখল করিনি। বিরোধীরা আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এই প্রচারণা চালাচ্ছে।’
গত দুই বছরে হবিগঞ্জে অন্য রকম সৌহার্দের রাজনীতি চলেছে। ছিল না কোনো হানাহানি। এমনকি বর্তমান মেয়র জি কে গউছ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আবু জাহিরের সঙ্গে গোপনে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলেছেন। কিন্তু পৌর নির্বাচনের কয়েকটি দিন সামনে রেখে শুরু হয়েছে রেষারেষি। হানাহানির আশঙ্কায় খোদ রাজনীতিকরাই ভীত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাবরণকারী, একাধিক মামলার আসামি জি কে গউছ নিজেই ভীত। বললেন, ‘আমি ও আমার কর্মীরা নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। সেনা মোতায়েন না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আমি আজ (গতকাল) প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি।’
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাজোট ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে এখন চরম বৈরি অবস্থান। সর্বশেষ গত শুক্রবার দুপুরে শহরের চৌধুরী বাজারে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জি কে গউছের সমাবেশ চলছিল। ওই সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবনসহ অন্য নেতারা। বিএনপি অভিযোগ করেছে, এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা বিএনপিদলীয় নেতাদের ওপর হামলা চালায়। গউছের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, ওইদিন মহাজোটের প্রার্থী শরীফ উল্লার পক্ষে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির ও অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান শত শত দলীয় কর্মী নিয়ে শহরে মিছিল করেছেন। ওইদিন রাতেই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম রানা বাদী হয়ে জি কে গউছের ভাই জি কে গফফারসহ ৫৩ দলীয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন। জানা গেছে, বিএনপি প্রার্থী গউছ এই হামলার ব্যাপারে থানায় এজাহার দায়ের করলে থানা এটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি শেখ কবিরুল হোসেন বলেন, মহাজোটের দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছি। এরপর বিএনপির অভিযোগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জি কে গউছ গতকাল দুপুরে পরিস্থিতি বর্ণনা করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন আমার কর্মীরা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’ তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে থানার ওসি কবির বলেন, ‘আমরা কাউকে হয়রানি করছি না। ওয়ান্টেড আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
মহাজোট প্রার্থী শরীফ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হবিগঞ্জে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি হামলা চালিয়ে অশান্ত পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপির চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ নেতা ইলিয়াস আলী আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় দুই সংসদ সদস্যকে কটাক্ষ করে গত শুক্রবার উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে সব ধরনের অপতৎপতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আছি।’

No comments:

Post a Comment