Tuesday, January 18, 2011

সমাপনী পরীক্ষা : প্রাথমিক শিক্ষার দর্পণ by মো. শহীদ উলল্লাহ

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দুটি সার্টিফিকেট এবং উচ্চ শিক্ষা স্তরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের সুযোগ থাকলেও ইতিপূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা সফল সমাপ্তির পর কোন সার্টিফিকেট লাভের সুযোগ ছিল না।

ফলে পূর্বে তিন স্তর বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্তর বলে মনে হতো না। বরং এ স্তরকে শিক্ষার প্রস্তুতি কাল বলেই বেশি মনে হতো। প্রাথমিক শিক্ষা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান স্তর হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। সমাপনী পরীক্ষা এনে দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পূর্ণতা, বাড়িয়েছে এ শিক্ষা স্তরের গুরুত্ব।

গত বছর প্রথম অনুষ্ঠিত হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের নজর কাড়ে এ পরীক্ষা। তখন থেকে শুরু হয় এ পরীক্ষাকে আরো ঢেলে সাজাবার প্রক্রিয়া। গত বছর প্রতিদিন ২টি করে ৩ দিনে ৬টি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষাথর্ীদের উপর বাড়তি চাপ ছিল। কিন্তু এ বছর প্রতিদিন ১টি করে ৬ দিনে ৬টি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষাথর্ীরা ছিল পূর্বের তুলনায় অনেকটা উৎফুলস্ন। এ বছর সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নেও নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। পরীক্ষকগণ নির্ধারিত তারিখে উপজেলা সদরে এসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের তত্ত্বাবধানে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছেন। এ ব্যবস্থায় শিক্ষকগণের একটু বেশি পরিশ্রম হলেও উত্তরপত্র মূল্যায়নে স্বচ্ছতা ও সমতা বজায় রাখা এবং মূল্যায়ন কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

সমাপনী পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অসাধারণ সাফল্য। একটি সফলতা থেকে জন্ম নেয় আরো সফলতা লাভের অনুপ্রেরণা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের সাহস জোগিয়েছে আরো নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়ার। তারই পথ ধরে এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এতকাল সাধারণ শিক্ষার তুলনায় ইবতেদায়ী শিক্ষা অনেকটা পিছিয়ে ছিল। সমাপনী পরীক্ষা নিঃসন্দেহে ইবতেদায়ী শিক্ষার মানোন্নয়নের পথে মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এ পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মাধ্যমিক স্তরেও। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার আদলে এ বছর প্রথম অনুষ্ঠিত হলো ৮ম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পরিবর্তন যেন সরকারের দিন বদলের অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন।

সমাপনী পরীক্ষাকে আরো যুগোপযোগী ও মানসম্মত করার জন্য কতিপয় বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন- জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমী (নেপ) কর্তৃক প্রণীত প্রশ্ন কাঠামো ও নম্বর বিভাজনের সাথে প্রশ্নপত্রের কিছুটা বৈসাদৃশ্য দেখা গেছে। শিক্ষকগণ নেপ থেকে প্রাপ্ত প্রশ্ন কাঠামো ও নম্বর বিভাজন অনুসারে শিক্ষাথর্ীদের প্রস্তুত করেছেন। প্রশ্নপত্রে কিছুটা বৈসাদৃশ্য থানায় শিক্ষাথর্ী ও অভিভাবকগণের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। নেপ কর্তৃক প্রণীত উত্তরপত্র মূল্যায়ন নির্দেশমালার সাথে প্রশ্নপত্রের অসামঞ্জস্য থাকায় শিক্ষকগণকেও বিপাকে পড়তে হয়েছে। যেমন- ইংরেজী বিষয়ের প্রশ্নপত্রে কবিতা থেকে ৮ লাইন লিখতে বলা হয়েছে এবং উহার মান দেয়া হয়েছে -১০। অপর দিকে উত্তরপত্র মূল্যায়ন নির্দেশমালায় কবিতা থেকে ১০ লাইন নিভর্ুলভাবে লিখলে পূর্ণ ১০ নম্বর দিতে বলা হয়েছে। এ ত্রুটিগুলো ছোট করে দেখা সমীচীন নয়। প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন নির্দেশমালা তৈরির ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয় এমন) শিক্ষাথর্ীদের উত্তর লিখার জন্য বাড়তি সময় চেয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট অভিভাবকগণ আবেদন জানালেও নীতিমালায় এ ধরনের সুযোগ না থাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সে সুযোগ দিতে পারেনি। বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা দরকার। আরো একটি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। বিষয়টি হচ্ছে- থানা হেফাজত থেকে প্রতিদিন পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন পরিবহন ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে থানায় উত্তরপত্র পরিবহনের জন্য কাছে ও দূরের কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সমভাবে পরিবহন খরচ দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে, উপজেলা পরিষদের নিকটবতর্ী ও দূরবতর্ী কেন্দ্রে পরিবহন খরচ একরূপ নয়। এ ব্যবস্থায় কোন কোন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিবহন খরচ বাবদ বরাদ্দ পেয়েছেন। আবার কোন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে উপজেলার জন্য থোক বরাদ্দ দিয়ে উপজেলা কমিটিকে বরাদ্দকৃত অর্থ বিভাজনের দায়িত্ব দেয়া সমীচীন হবে।

সমাপনী পরীক্ষায় ছোট-খাটো ত্রুটি-বিচু্যতি থাকলেও সফলতা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এসব ত্রুটি-বিদু্যতির কথা বিবেচনায় রেখে আগামী দিনে একটি সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সকল পরীক্ষাথর্ীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণসহ প্রশ্নপত্রের মান ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করি।

No comments:

Post a Comment