Tuesday, January 18, 2011

শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি সময়োচিত সতর্কবার্তা

দেশের শীর্ষস্থানীয় পুষ্টিবিদ ও শিশু-বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেন যে, গুঁড়োদুধসহ কৃত্রিম শিশুখাদ্যই শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বড়ো হুমকি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এইসব অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশই শুধু ব্যাহত হইতেছে না, বরং তাহারা অপুষ্টিসহ নানা ধরনের জটিল রোগেও আক্রান্ত হইতেছে।

সেইসাথে উদ্বেগজনকহারে বাড়িতেছে শিশুমৃতু্যর হার। তাহাদের মতে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ শিশুমৃতু্যর জন্য দায়ী হইল অপুষ্টি। ইহার জন্যও কৃত্রিম খাদ্যের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতাই অনেকাংশে দায়ী বলিয়া তাহারা মনে করেন। দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও খাদ্যের মান সংরক্ষণে নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরও নাজুক। গত ৩০ ডিসেম্বর সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন) আয়োজিত এক কর্মশালায় এই সতর্কবাতর্া উচ্চারিত হইয়াছে। সতর্কবাতর্াটি যে খুবই সময়োচিত তাহাতে সন্দেহ নাই।

বলাবাহুল্য, বিশেষজ্ঞদের উপযর্ুক্ত মন্তব্যের জোরালো ভিত্তিও রহিয়াছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বহু আগেই এই বিষয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করিয়াছিল। তাহাদের মতে, শিশু গুঁড়োদুধ (ইনফ্যান্ট ফমর্ুলা) কোনো জীবাণুমুক্ত খাবার নহে। গুঁড়োদুধকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত রাখার কোনো প্রযুক্তিও অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গুঁড়োদুধ উৎপাদনকারী দেশ নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং নিরাপদ খাবার বিষয়ক কতর্ৃপক্ষও একই অভিমত ব্যক্ত করিয়াছে। এই ব্যাপারে গত কয়েক দশকের বাস্তব অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নহে। গবেষণালব্ধ উদ্বেগজনক ফলাফলের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে উন্নত দেশগুলির স্বাস্থ্য ও খাদ্য প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করিয়াছে। শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হওয়ায় কয়েকমাস আগে যুক্তরাজ্যে শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী নামজাদা একটি প্রতিষ্ঠানের বিপুল অংকের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। বিচারের কাঠগড়ায়ও দাঁড়াইতে হইয়াছে বিশ্বের নামিদামি একাধিক প্রতিষ্ঠানকে। গুনিতে হইয়াছে বড়ো অংকের ক্ষতিপূরণ।

গুঁড়োদুধসহ কৃত্রিম শিশুখাদ্যের উপর নির্ভরতা একটি বিশ্বজনীন বাস্তবতা। ইহার জন্য এককভাবে কাহাকেও দায়ী করা চলে না। ক্যারিয়ার, সাংসারিক চাপ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যাসহ নানা কারণে মায়েরা যেমন ক্রমবর্ধমানহারে এইসব কৃত্রিম খাদ্যের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতেছেন, তেমনি শিশুরাও এইসব খাদ্য গ্রহণেই অধিক আগ্রহী। ইহার পিছনে চটকদার বিজ্ঞাপনের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য হইলেও ইহাই একমাত্র কারণ নহে। শিশুরা সহজেই একঘেয়েমিতে ভোগে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যে, খাবারের ক্ষেত্রে এই কথা বেশি করিয়া প্রযোজ্য। তবে এই ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হইল_মাতৃদুগ্ধ। আর ইহা সর্বজনস্বীকৃত যে, দুই বৎসর বয়স অবধি শিশুর জন্য এই খাবারের প্রয়োজনই সর্বাধিক। আশার কথা হইল, বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা উচ্চারণের পাশাপাশি প্রতিকারের পথও বাতলাইয়া দিয়াছেন। পথটি সহজই শুধু নহে, ব্যয়সাশ্রয়ীও বটে। তাহারা বলিয়াছেন যে, মায়ের দুধ ও ঘরে তৈরি সুষম খাবার শিশুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ শুধু নহে, অধিক কার্যকরও বটে। শিশুর চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী অতি অল্প খরচে সহজে এই খাবার তৈরি করা যায়। সমপ্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত একটি জরিপেও প্রমাণিত হইয়াছে যে, মায়ের দুধ শুধু শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষাই করে না, বিপুল পরিমাণ অর্থেরও সাশ্রয় করে। তবে ইহার জন্য মায়েদের শুধু সচেতন হইলেই চলিবে না, যথেষ্ট সময়ও দিতে হইবে। পাশাপাশি ইহাও অনস্বীকার্য যে, বর্তমান কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া মায়েদের একার পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা সম্ভব নহে।

No comments:

Post a Comment