Tuesday, January 18, 2011

তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন সম্ভাবনা by বকুল আশরাফ

শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলন, ক্ষোভ এবং ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা এবং বছরের শেষে এসে তার বাস্তবায়ন পোশাক তৈরী শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক জিএসপির শর্ত শিথিল করায় এই খাতটি থেকে আরো অধিক রপ্তানি হবার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
এতে করে ভবিষ্যতে এই তৈরী পোশাক শিল্পখাতটির স্থিতিশীল অবস্থা যে বিরাজ করবে তার ইঙ্গিত বহন করে । বর্তমানে বাংলাদেশে পোশাক তৈরী শিল্প থেকে রপ্তানি আয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে বার বিলিয়ন ডলার, যা উত্তর-উত্তর বৃদ্ধি পাবে।

জিএসপি এক ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তি । ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ সমূহে বিশ্বের অন্যান্য স্বল্পোন্নত বিভিন্ন দেশ (প্রায় ১৭৬টি দেশ) থেকে কোন দ্রব্য প্রবেশের সময় টেরিফের ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্ব আরোপ বা এক ধরনের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এই জিএসপির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, বিশ্বের উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশসমূহের সাথে অনুন্নত দেশসমূহের বাণিজ্যের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সাধন এবং সুশাসনের লক্ষ্যে অনুন্নত দেশসমূহকে এক ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে একযোগে কাজ করার কৌশল। বা বলা যায় ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক শুল্ক হার এর ফলে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরো বেশি অংশগ্রহণে ও অতিরিক্ত রপ্তানি রাজস্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থাপনের উন্নয়ন এবং সর্বোপরি দারিদ্য্র হ্রাসে সচেষ্ট করা।

বাংলাদেশ এমন একটি অনুন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সে সুবিধা পেয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে গ্যাট চুক্তির আওতায় এই জিএসপি সুবিধা প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে যখন পোশাক তৈরী শিল্পের বিকাশ এবং রপ্তানি শুরু হয় তখন থেকেই বাংলাদেশও সেই সুবিধা পেয়ে আসছে। তখন জিএসপি সুবিধা পেতে হলে দ্রব্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপের উৎস বা অরিজিন বাংলাদেশে হতে হতো। যেমন সূতা তৈরী, সূতা থেকে কাপড় তৈরী এবং কাপড় থেকে পোশাক তৈরী। পরবর্তীতে আরো শিথিল করে দুই ধাপে করা হয়। অর্থাৎ উপরোক্ত তিন ধাপের যে কোন দু'ইটি ধাপ যদি বাংলাদেশ সাধিত হয় তবে তা জিএসপির আওতায় পরবে এবং তার জন্য শুল্কহারের হ্রাসকৃত সুবিধা উপভোগ করবে।

ইউরোপীয় বাজারে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদিত দ্রব্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশিকাধারের দাবী বহুদিনের। প্রায় ২০০৩ সাল থেকে এই দাবি আলোচিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশন রুলস অফ অরিজিনের ক্ষেত্রে সেই বহু আলোচিত জিএসপি সুবিধা বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের দাবিটি বিবেচনায় এনে ঘোষণা করে যে, মাত্র একটি ধাপ সম্পন্ন করলেই বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। এবং তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে অর্থাৎ ২০১১ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে। বাংলাদেশ থেকে যত তৈরী পোশাক রপ্তানি হবে সে সব দ্রব্যই ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। এই জিএসপির শর্ত শিথিল করায় তৈরী পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক বিশাল সম্ভাবনার দেখা দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় যেহেতু বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরী পোশাক ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে তাই ইউরোপীয় ক্রেতারা বাংলাদেশে থেকে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী আমদানী করবে, শুধুমাত্র এই শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য। কেননা স্বল্পোন্নত দেশ বা অনুন্নত দেশ বাংলাদেশকে দেয়া এই সুবিধা উন্নয়নশীল দেশ যেমন চীন, ভারতের জন্য প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের চেয়ে জিএসপি সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকবে।

অনেকেই ধারণা করছে এই সুবিধার কারণে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রপ্তানি আগামী বছরে বেড়ে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি হয়ে যাবে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে তা প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নত করা সম্ভব। বাংলাদেশের মোট তৈরী পোশাক রপ্তানির প্রায় ৬৯ শতাংশ ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করে যা ভবিষ্যতে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুতরাং এই যে সুবিধা তা অবশ্যই পোশাক তৈরী শিল্পের মালিকদেরকে আরো বেশী সচেতন করে তুলবে।

জিএসপির সুবিধার কারণে সৃষ্ট অন্যান্য দিকগুলোকে ভাবতে হবে। যেমন (এক) বাংলাদেশের টেক্সটাইলস শিল্পে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে কেননা যে কোন দেশ থেকে আমদানী করা কাপড় বাংলাদেশে এনে তা শুধুমাত্র সেলাই করে রপ্তানি করলেই শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। সুতরাং বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলের উৎপাদিত কাপড়ের চাহিদা কমে যেতে পারে। যদি চাহিদা কমে যায় সরকারকে ভাবতে হবে টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বিভিন্ন সুবিধাদি সম্বলিত নতুন নীতিমালা করতে হবে। আবার টেক্সটাইল মালিকদেরকেও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য আরো বেশী প্রতিযোগিতামূলক কি করে হওয়া যায় তা ভাবতে হবে।

(দুই) বাংলাদেশে যেন আরো পোশাক তৈরী শিল্প গড়ে উঠতে পারে সে জন্য অবকাঠামোগত সুবিধাদি গড়ে তুলতে হবে। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো গ্যাস ও বিদু্যতের জোগান দেয়া। মাল আমদানী ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বন্দরের কাজগুলোকে ত্বরান্বিত করা এবং রাস্তাঘাট বৃদ্ধি করা। প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে শুল্ক ছাড়সহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা। এতে উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়বে।

(তিন) পোশাক তৈরী শিল্প যতই বৃদ্ধি পাবে ততোই দক্ষ শ্রমিকদের সংকোট ঘনীভূত হবে। শ্রমিক ধরে রাখা কষ্টকর হবে অনেক ক্ষুদ্র বা মাঝারি ধরনের শিল্প মালিকদের। এমনকি বড় বড় শিল্প মালিকদের মধ্যে আন্ত: প্রতিযোগিতা শুরু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কে কত বেশী সুবিধা প্রদান করে শ্রমিক ধরে রাখবেন বা নতুন গড়ে উঠা শিল্পে শ্রমিকে জোগান করবেন। এতে শ্রমিক সংকটের তীব্রতার কারণে অনেক শিল্প তার রপ্তানির জন্য প্রদেয় কমিটমেন্ট হারাতে পারেন। তখন সৃষ্ট হবে অন্য সব জটিলতা। সুতরাং বাংলাদেশে পোশাক তৈরী ও রপ্তানি সমিতির এখন থেকেই মনিটর করতে হবে এবং সরকারের যাথে যৌথভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউট তৈরী করে শ্রমিকদের এখন থেকেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করা। অন্যথায় এই জিএসপির সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব নাও হতে পারে।

No comments:

Post a Comment