Tuesday, January 18, 2011

জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা প্রসঙ্গে by শহীদ আশরাফী

মুদ্রে চলমান জাহাজগুলো কত না বাধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে চলে প্রতিনিয়ত। সামুদ্রিক ঝড় এর অন্যতম। তাকে অতিক্রম করে নাবিকরা সাহসভরে এগিয়ে চলে তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে। সমুদ্রের অনেক স্থানে একটি ঝড় শেষ হবার ক'দিন পর সৃষ্টি হয় আরেকটির।

তথাপি তাদেরকে পাশ কাটিয়ে এবং টাটা বাই বাই জানিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়াও কিন্তু সম্ভব হচ্ছে । এই যেমন ভারত থেকে আফ্রিকার কেপটাউন পেরিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর ধরে ব্রাজিলের স্যান্টোস বন্দরে যাচ্ছিল একটি জাহাজ । দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের বিভিন্ন অংশে এসময় প্রায়শই গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় । ভারত মহাসাগর তখন ছিল শান্ত । অথচ কেপটাউন পেরিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশের পূর্বেই এলো আগাম ঝড়ের সতর্কতা । জাহাজের ক্যাপ্টেন ও চীফ ইঞ্জিনিয়ার দু'জনেই চিন্তিত হলেন বটে। কিন্তু ইতিপূর্বে অনেক ঝড় পাড়ি দেবার অভিজ্ঞতা থাকায় সাহস হারালেন না মোটেও । ঝড়ের সময় ইঞ্জিন বন্ধ হলে জাহাজকে রক্ষা করা ভীষণ দুষ্কর। তাই জাহাজের সকল ইঞ্জিন ও মেশিনারিজকে চীফ ইঞ্জিনিয়ার ঠিকমত মেরামত করে রেখেছেন সেইলিং-এর আগে । আর জাহাজের ব্রীজে স্থাপিত চার্টকো সিস্টেমের কম্পিউটার মনিটর থেকে ক্যাপ্টেন প্রতি মুহূর্তে অবলোকন করতে পারছেন ঝড়ের অবস্থান ও গতিপ্রকৃতি । সমুদ্রের প্রতিটি এলাকার নির্দিষ্ট সময়ের ঝড়ের চিত্র বহু বছর ধরে স্যাটেলাইট ক্যামেরায় ধারণ করে কম্পিউটারে বিশেস্নষণ করা হয়েছে । আর তার উপর ভিত্তি করে এখন আগাম ঝড়ের চিত্র ভেসে উঠছে চার্টকোর মনিটরে । জাহাজের গতিকে হিসাব করে পরবর্তী পথটুকুতে প্রতিদিন দুপুরের অবস্থান চিহ্নিত করা আছে । আর সেই অবস্থানগুলোর সংযোগ রেখাও দৃশ্যমান থাকছে সেই চার্টকো মনিটরে । তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিদিনের অবস্থানে গেলে ঝড়ের গতিপ্রকৃতি বিভিন্ন চিহ্ন ও রেখার দ্বারা চিত্রিত করা আছে । ক্যাপ্টেন সাহেব প্রায় সময় ব্রীজে এসে তা পর্যবেক্ষণ করেন। তা থেকে হিসেব কষে ক্যাপ্টেন সাহেব জাহাজটির পথ ডানদিকে ঈষৎ ঘুরিয়ে দিলেন । এর কিছুক্ষণ পর সেই চিত্রে তিনি দেখতে পেলেন যে সেভাবে গেলে জাহাজটি সাতদিন পর ঝড়টির কাছাকাছি হবে বটে তবে কিনা তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে সে। কেবল যদি চার্টকোর কম্পিউটার বর্ণিত ভবিষ্যৎ চিত্রটি সঠিক হয়। ওদিকে নিয়মিত মহাসাগরের বিভিন্ন অবস্থানের আবহাওয়ার খবর ই-মেইল মেসেজের আকারেও আসছে প্রতিদিন । আশ্চর্যজনকভাবে তা মিলেও যাচ্ছে চার্টকোর চিত্রটির সাথে । আর তাই পূর্ব নির্ধারিত দিনের নির্দিষ্ট ক্ষণে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঝড়টিকে টাটা বাই বাই জানালো জাহাজ ও তার নাবিকরা । মূলত বিশ্বের মেরীটাইম সংস্থাগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সম্মিলিত প্রয়াস ও তার সাথে যুক্ত স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহারের সুফলের ফসল থেকেই নাবিকদের এই নিরাপদ সমুদ্র ভ্রমণের প্রশান্তি। যদিও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় কেবল অন্য একটি ব্যাপারে । বিষয়টি উদাহরণ দিয়েই আলোকপাত করা যাক ।

সোমালিয়ার পশ্চিম উপকূলের রেড সী কিংবা পূর্ব উপকূলের ভারত মহাসাগরে দীর্ঘদিন থেকে জলদসু্যদের ভীষণ উৎপাত । সামপ্রতিককালে ভারত মহাসাগরের দিক থেকে একটি বাংলাদেশী জাহাজ তার ২৬ জন নাবিকসহ সেই জলদসু্যদের কাছে জিম্মি হওয়ার পর থেকে বিষয়টি এদেশের অধিকাংশ নাগরিকের কাছে আর অজানা কোন বিষয় নয়। সেই নাবিকদের পুরো পরিবার এখন ভীষণ নিরাপত্তাহীনতার মাঝে রয়েছে । ইতিপূর্বে এমন দসু্যতার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকেও জানা যায় অনেক তথ্য । যেমন কিনা- একবার রেড সীতে জলদসু্যদের কবলে পড়ল একটি জাহাজ । দসু্যরা সাধারণত দ্রুতগামী বোটে করেই আসে । জাহাজের গতি থাকে তাদের বোটের চেয়ে অনেক কম । তাই আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে জাহাজটি তখন নিজেকে তার সর্বোচ্চ গতিতে ঝিগ-ঝাগ পথে তথা দ্রুত ডাইনে ও বামে ঘুরে এগোতে থাকলো। কারণ এর ফলে বড় জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে যাবার ভয় থাকে ছোট বোটটির। তাই জলদসু্যরা সহজে তখন জাহাজের গায়ে ভিড়তে পারে না । সেই সাথে জাহাজের ডেকের দু'দিকে সারিবদ্ধ পানির কামান থেকে পানি ছোঁড়া হলো সমুদ্রের দিকে । তাকে ডিঙ্গিয়ে জাহাজে ওঠাও কিনা কষ্টসাধ্য । একসময় তাই জাহাজের ব্রীজ বরাবর মর্টার থেকে গুলি ছোঁড়ে দসু্যরা । এতে ভীত হলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন । কারণ আন্তর্জাতিক আইনে বাণিজ্যিক জাহাজে কোনো প্রকার অস্ত্র বহন আইনসম্মত নয় বলে তার অনুগত বাহিনী তথা সকল নাবিকরা যে একেবারে নিরস্ত্র । তাই তিনি বিরত হন জলদসু্যদের বাধাপ্রদান থেকে । তারপর জাহাজে উঠে সহজেই তাকে নিয়ন্ত্রণে নেয় দসু্যবাহিনী । জলদসু্যরা মুক্তিপণ পেলেই জাহাজটি ছেড়ে দেবে বলে জানিয়ে রাখলো ক্যাপ্টেনকে ।

ঘটনাক্রমে জাহাজটিতে কার্গো হিসেবে তখন ছিল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ । দসু্যরা তখনও তা জানতো না। আর খবর পেয়েই ছুটে আসে কাছাকাছি অবস্থানরত মার্কিন নৌবহর ও তার হেলিকপ্টারগুলো। তাদের আগমন অবশ্য নাবিকদের নিরাত্তার জন্য নয় । বরং সেই অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ যাতে জলদসু্যদের হাতঘুরে আশ-পাশের দেশগুলোর গেরিলা গ্রুপগুলোর হাতে না পরে ; সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তাদের এই তৎপরতা। হাইজ্যাক হওয়া জাহাজের খুব কাছে থেকে সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দিতে থাকল তারা । কিন্তু নাবিকদের মুক্তির কোন চেষ্টাই করল না তারা । ক'দিন পর জাহাজের মালিকের প্রতিনিধি সেই জাহাজে এসে অনেক অর্থ মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করল জাহাজ ও তার নাবিকদেরকে । জলদসু্যরা মার্কিন বাহিনীর পাশ দিয়েই বোটে করে নিয়ে গেল তাদের প্রাপ্ত মুক্তিপণের অর্থ। তখনও তাদেরকে কোন গুলি ছুঁড়ে প্রতিহত করল না মার্কিন বাহিনী ।

স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই দসু্যবাহিনীর গতিবিধি ও অবস্থান নিশ্চিত করা কঠিন কোন ব্যাপার নয় । অতঃপর তাদের আটক করাও যে সম্ভব । বিশেষত সমুদ্রে আন্তর্জাতিকভাবে নৌ-টহল চালু করে তাদেরকে প্রতিহত করা যায় খুবই সহজভাবে । কিন্তু সে প্রচেষ্টা নিতে বিশ্বের শক্তিধর কিংবা নেতৃস্থানীয় দেশগুলো মোটেও যে উৎসাহী নন । আর তাইতো এত বেশি বেশি জাহাজ ছিনতাই ঘটনার পরও কিনা রেড সীর নূ্যনতম দৈর্ঘের একটি করিডোরে কেবল দিবা-রাত্রির কয়েকটি সময়ে নৌ -টহলের ব্যবস্থা করা গেছে। কিন্তু অন্য সময়ে কিংবা সেই করিডোরে পেঁৗছা নাগাদ অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে চলাচলকারী সকল জাহাজগুলো । অন্যদিকে সোমালিয়ার অপর পাশের ভারত মহাসাগরের অংশটিতে কোন নৌ-টহল আদৌ শুরু করা এখনও সম্ভব হয়নি। আর সেই ভারত মহাসাগর থেকেই সমপ্রতি ছিনতাই হয়েছে উলেস্নখিত বাংলাদেশী জাহাজটি । নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাই যেন জলদসু্যদের মর্জির উপরেই নির্ভরশীল । মূলত মুক্তিপণ পেলে তারা নাবিকদের ফেরত দেবার প্রথা এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছে । জলদসু্যরা সাধারণত অতি মূল্যবান নতুন জাহাজগুলোকেই হাইজ্যাক করে থাকে । এতে মুক্তিপণের বিরাট টাকাটা সহজেই তারা পেয়েও যায় । কিন্তু বাংলাদেশী জাহাজ মালিক তার সমপ্রতি হাইজ্যাককৃত পুরাতন জাহাজটির জন্য বিরাট ক্ষতিপূরণ নিশ্চয়ই দিতে চাইবেন না । অপহূত বাংলাদেশী নাবিকরা তাই যে আজ নিশ্চিত বিপদের মুখোমুখী । সরকারি অর্থানুকূল্য ছাড়া তাদের ভাগ্যকে রক্ষা করা বুঝি সম্ভব নয় । সেই সাথে বলা চলে যে আন্তর্জাতিক আনুকূল্য ছাড়া বিশ্বের সকল নাবিকদের নিরাপত্তা রক্ষাও কখন যে সম্ভব নয় ।

No comments:

Post a Comment