Wednesday, December 15, 2010

সরকারের প্রতি খোন্দকার দেলোয়ারঃ সাহস থাকলে পদত্যাগ করে এখনই নির্বাচন দিন

রকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বিএনপির নেতারা বলেছেন, সাহস থাকলে পদত্যাগ করে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন দিন। তাঁরা দাবি করেন, এতেই সরকারের ভরাডুবি নিশ্চিত। আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সরকারের প্রতি ওই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তাঁরা বলেন, সরকারের সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন যেকোনো সময়ই তাদের পতন হবে।

বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘নির্বাচন দিয়ে প্রমাণ করুন জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে, নাকি খালেদা জিয়ার সঙ্গে আছে? আমরা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম। সাহস থাকলে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন দিয়ে দেখুন। আপনাদের ভরাডুবি নিশ্চিত।’
গণতন্ত্র, দ্রব্যমূল্য, পোশাকশিল্প পরিস্থিতিসহ সব ক্ষেত্রে সরকারকে ব্যর্থ বলে আখ্যায়িত করেন খোন্দকার দেলোয়ার। তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশের মানুষ এখন গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। জনতার এই রোষের সামনে কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না। এই সরকারও টিকবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, দেশ রক্ষায় খালেদা জিয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন এবং এতে তারেক রহমান এসে যোগ দেবেন। দুর্বার আন্দোলনে এই সরকারের পতন নিশ্চিত হয়ে যাবে।
দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর আজ দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দুই বেলা খেতে পায় না। গণতন্ত্রের মুখোশ পরে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হরণ করছে।’
মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলের নেতা-কর্মীদের সমালোচনা করেন। উপস্থিত নেতা-কর্মীরা স্লোগান দেওয়ার সময় সমালোচনা করে গয়েশ্বর বলেন, ‘এখানে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়ে দেখাচ্ছেন, অথচ রাজপথে আন্দোলনের সময় কাউকে খুঁজে পাই না।...পদ রক্ষা, কমিটি দখল, ব্যক্তিসম্পদ দখলে রাখার পাঁয়তারা বন্ধ করে রাজপথ দখলের চেষ্টা করেন।’
মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আপনারা স্লোগান শোনাচ্ছেন! এই স্লোগান এখানে শোনানোর দরকার নেই। পারলে রাজপথে স্লোগান দেবেন। অবশ্য এখানে চর্চা করতে পারেন।’
সভায় ৫০০-এর বেশি নেতা-কর্মী যোগ দেন। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম মিঞা, বেগম সরোয়ারী রহমান, আমান উল্লাহ আমান, রুহুল কবীর রিজভী, সুলতান সালাহউদ্দিন প্রমুখ এতে বক্তব্য দেন।

আমরাও মুক্তিযোদ্ধা: জামায়াতনেতা আজহারুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করলেও এবার নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, ‘জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী যে সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, আমরাও সে সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। তিনি যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস সরকারি চাকরি করে রাজাকার না হন, তাহলে আমরা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে কাজ করে কেন রাজাকার হব। আমরাও মুক্তিযোদ্ধা।’

বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা মহানগর জামায়াত আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ টি এম আজহার এসব কথা বলেন। সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা যা খুশি তা-ই করবেন, যাকে খুশি রাজাকার বানাবেন, এটা হবে না।’
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আল বদর বাহিনী গঠনেও তৎকালীন জামায়াত ও তার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জামায়াতের বর্তমান কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই ছিলেন আল বদর বাহিনীর নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদনে (ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান) দেখা যায়, জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এই বাহিনী সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ টি এম আজহারসহ জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় বর্তমান নেতাদের অনেকেই আলবদর বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
অথচ আজকের আলোচনা সভায় এ টি এম আজহার এসব ভূমিকা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর থেকে মিথ্যা কথা প্রচার করা হচ্ছে। জনগণ এটা বিশ্বাস করলে আমাদের আজ এ অবস্থা হতে পারত না। আমাদের লোকেরা সাংসদ হতে পারত না। বাংলাদেশের লোকরা এসব বিশ্বাস করে না। টেলিভিশনে আমাদের যতই যুদ্ধাপরাধী বলা হোক না কেন, জনগণ তা বিশ্বাস করে না।’
বিজয় দিবসের প্রতি ইঙ্গিত করে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘এই দিবস এলে তারা (আওয়ামী লীগ) একটি কথা বলে, “রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই”। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার নামে তারা আসলে ইসলামমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চায়। জীবন থাকতে আমরা ইসলামমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দেব না।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, আহত ৭

পূর্বশত্রুতার জের ধরে ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় সাতজন আহত হয়েছেন। আজ বুধবার দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, আজ ক্যাম্পাসে আসেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কর্মীরা। বেলা দেড়টার দিকে তাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছালে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালান। এতে ছাত্রদলের কর্মী আসাদুজ্জামান রানা, মিজানুর রহমান, ইব্রাহিম কবির, মোর্শেদ আলম, মাসুম পারভেজসহ সাতজন আহত হন। তাঁদের স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিত্সা দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইমরান হোসেন বলেন, ‘বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গেলে ছাত্রলীগ অন্যায়ভাবে আমাদের ওপর হামলা চালায়।’
তবে ছাত্রলীগ সভাপতি কামরুল হাসান দাবি করেন, ‘ছাত্রলীগনেতা মনা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে প্রতিহত করা হয়েছে মাত্র।’
প্রক্টর কাজী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। লিখিত অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি ইজহারুল আটক

সলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি ইজাহারুল ইসলামকে আজ বুধবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে আটক করেছে র‌্যাব। চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার এলাকায় অবস্থিত জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে ইজহারুলকে আটক করা হয়। তিনি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।

ইজহারুলকে আটকের প্রতিবাদে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তায় নেমে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করছে।
র্যাব-৭ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সাজ্জাদ হোসাইন এবং ওই মাদ্রাসার শিক্ষক মিজানুর রহমান ইজহারুলের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সাজ্জাদ হোসাইন জানান, গত রোববার চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং গত সোমবার ভোরে রাউজান ও কাউখালী সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার গোদাড়পাড় থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদে ইজহারুল ইসলামের নাম বের হয়ে এসেছে। তাই আজ তাঁকে আটক করা হয়েছে। এদিকে আজ সকালে মুফতি ইজাহারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে ওই পাঁচজনকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।

 হাইকোর্টের রায় কার্যকর না করা পর্যন্ত জাহাজ আমদানি বন্ধ

জাহাজ ভাঙা শিল্পের ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে দেওয়া হাইকোর্টের রায় কার্যকর না করা পর্যন্ত জাহাজ আমদানি বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই রায়ের আলোকে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি এড়াতে তিন মাসের মধ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, পরিবেশবিদ, আইনবিদ, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আজ বুধবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।
এর আগে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ ও চলতি বছরের ১১ মে হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছিলেন। ওই রায়ে জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র ও বর্জ্যমুক্তকরণ সনদ নেওয়ার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত ছয়টি আইনের অধীনে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলা হয়। সেই সঙ্গে এসব বিষয় তদারকি করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
জানা যায়, সম্প্রতি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত একটি খসড়া তৈরি করেছে সরকার। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ২২টি জাহাজ আমদানি করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় অনুসরণ করা হয়নি। তাই হাইকোর্টের ওই রায়ের আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন, নীতিমালা তৈরি না করা পর্যন্ত জাহাজ আমদানি বন্ধ ও ইতিমধ্যে আনা জাহাজগুলো না ভাঙার নির্দেশনা চেয়ে গত রোববার বেলা হাইকোর্টে আবেদন করে। এ আবেদনের ওপর দুই দিনের শুনানি শেষে আজ আদালত আদেশ দেন।
আদেশে আদালত বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জাহাজ আনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ইতিপূর্বে দেওয়া রায় অনুসরণ করতে হবে। ওই রায় অনুসরণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের জলসীমায় কোনো জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না।
আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, ইকবাল কবির, শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আনিসুল হক ও শেখ ফজলে-নূর তাপস মামলা পরিচালনা করেন।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করতে ট্রাইব্যুনালে আবেদন

৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তার বা আটক রাখার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়েছে। এ আবেদনের ওপর আগামী রোববার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আজ বুধবার বেলা ১১টায় আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থার সদস্যরা ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদনটি করেন।

তদন্ত সংস্থার সদস্য মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আটক বা গ্রেপ্তার রাখার নির্দেশনা চেয়ে আবেদনটি করা হয়েছে।
আবেদন দায়ের করার পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিষয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে যে তথ্যাদি রয়েছে, তা আইনের আমলে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। আইনের আমলে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছি, যাতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে আটক রাখা হয়। যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে বক্তব্য ও সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরা ভয়-ভীতি ও শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। যেটুকু তদন্ত হয়েছে তার ভিত্তিতেই আবেদনটি করা হয়েছে। তাঁকে বাইরে রাখলে তদন্তকাজ বিঘ্নিত হবে। সঠিকভাবে এগোনো যাবে না। ন্যায়বিচার, বিচারপ্রক্রিয়া ও তদন্তকাজ বিঘ্নিত হবে। এ জন্যই আবেদনটি করা হয়েছে।’
পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
আবেদন দাখিল-সম্পর্কিত এই ব্রিফিংয়ে তদন্ত সংস্থার সদস্য মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম, মো. আবদুর রাজ্জাক এবং আইনজীবী প্যানেলের সদস্য সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, মোখলেছুর রহমান, আলতাফ উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শাহিনুর ইসলাম জানান, রোববার আবেদনের ওপর শুনানি হবে।

আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় আগুন, নিহত ২২

রাজধানীর সন্নিকটে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় হা-মীম গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছে। এতে ওই কারখানা ভবনের ১১তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে ২২ জন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন চার শতাধিক শ্রমিক। আজ মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে আগুন লাগে। রাত সাড়ে নয়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে জানা গেছে।

নিহত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন, আশুলিয়ার শিনশিন হাসপাতালে চারজন নারী ও চারজন পুরুষ, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালে একজন নারী ও চারজন পুরুষ, নাইটিঙ্গেল হাসপাতালে একজন পুরুষ রয়েছেন। তবে নাইটিঙ্গেল হাসপাতাল থেকে স্বজনেরা আরও দুটি লাশ নিয়ে গেছেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে ওই ভবনের একাদশ তলা থেকে আরও একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং এনাম মেডিকেল কলেজের নিহত পাঁচজনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নজমুল হোসাইন।
শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, আজ দুপুরে কারখানাটির ১০তলায় ফিনিশিং সেকশনে আগুনের সূত্রপাত হয়। শ্রমিকেরা দুপুরের খাবার খেয়ে কাজে যোগ দেওয়ার একটু পরেই আগুন লাগে। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ১১তলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শ্রমিকেরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন এবং অনেকে ভয়ে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েন।
খবর পেয়ে ঢাকা, সাভার, মানিকগঞ্জ ও ইপিজেড থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীও ঘটনাস্থলে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।
এ ঘটনার পরে আশপাশের সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে বর্তমানে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
কারখানার সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান জানান, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কারখানাটির ৯, ১০ ও ১১ তলায় আগুন জ্বলছিল।

ভাঙা সুটকেস জাদুর বাক্স হয়ে গেছে ___খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া রাজনীতি করেন যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী ও তাদের দোসরদের নিয়ে। এ জন্য গণহত্যাকারীদের ডাকা হরতালে তিনি সমর্থন দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যই এ হরতাল ডাকা হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বিএনপি-জামায়ত জোট সরকার যে কী পরিমাণ লুট করেছে এর প্রমাণ গত কয়েক দিনে মানুষ দেখেছে। কয়েক দিন ধরে বাক্সবন্দী করে এই লুটের মাল সরানো হয়েছে। বাক্স খুললে দেখা যেত কত সম্পদ। ভাঙা সুটকেস জাদুর বাক্স হয়ে গেছে। খালেদা জিয়ার যে সন্তানের চেয়ে সম্পদের দরদ বেশি, এটা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমি এটা বলেছি তাই তিনি গোস্বা হয়েছেন। সম্পদ নিতে লজ্জা নেই, চাইতে লজ্জা নেই। বললেই গোস্বা হয়। আমি এখন আর বলতে চাই না। সময় হলে আরও বলব।’
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতা নেওয়ার ২৩ মাস পর কী হয়েছে, তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের ২৩ মাসের তুলনা করতে প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘মিথ্যাচারীরা মিথ্যাচার করবে, এতে কান দিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না। বিএনপি দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে না। এরা শুধু লুটপাট করে। এরা জনগণের প্রতি যে দরদ দেখায়, এটা মাছের মায়ের পুত্রশোক। বিরোধী দলের কাজ হচ্ছে হত্যাকারী ও জঙ্গিদের প্রতিষ্ঠিত করা।’
শেখ হাসিনা দলের নেতা-কর্মীদের ধৈর্য এবং নিবেদিত প্রাণ হয়ে জনগণের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী। আরও বক্তব্য দেন মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মো. নাসিম প্রমুখ।

বিডিআর এখন বর্ডার গার্ড

নাম বদলে গেল বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর এখন থেকে পরিচিত হবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নামে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিডিআর নামেই পরিচিত ছিল বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ২০০৯ সালের বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর বিডিআর আইন পরিবর্তনের দাবি ওঠে। একই সঙ্গে বিডিআর বা বাংলাদেশ রাইফেলস নাম পরিবর্তনের দাবিও ওঠে। সংসদে এ নিয়ে বিল ওঠার পর কণ্ঠ ভোটে তা পাস হয়।

এর আগে পরিবর্তিত হয়েছে বাহিনীর পোশাক। নাম ও পোশাক পরিবর্তনের পাশাপাশি বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এ বিলে। বাংলাদেশ রাইফেলসের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ করার বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর। সেই দিনই বিলটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ৬ ডিসেম্বর সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১৫০টি সংশোধনীসহ বিলটি সংসদে উপস্থাপন করে। এর আগে গত ১২ জুলাই বিলটি সংসদে উত্থাপনের জন্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায়। বর্ডার গার্ড বিল ২০১০-এ ২৪ ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্রোহসহ ১২টি অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অন্যান্য অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী দুই বছর থেকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বিলের ১১২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে এক বা একাধিক বর্ডার গার্ড আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে এবং তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালে একজন সভাপতি ও দুজন সদস্য থাকবেন। মহাপরিচালকের অনুপস্থিতিতে নূ্যনতম উপমহাপরিচালক পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালের সভাপতি হবেন এবং পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা সদস্য হবেন। এ ছাড়া বাহিনীর কার্যাবলি, ক্ষমতা ও দায়িত্ব আরো বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। সুযোগ রাখা হয়েছে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির। বাকস্বাধীনতা, সংগঠন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান আগে ছিল না, বর্তমান আইনে তা রাখা হয়েছে।
২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সুশৃঙ্খল এ বাহিনী নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। তখনই বাহিনীর ভেতরে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। উদ্যোগ নেওয়া হয় পরিবর্তনের। বিডিআরের নাম ও পোশাক বদলে ফেলার পাশাপাশি বাহিনীর আইন বদলের চিন্তাও করা হয়। সেই চিন্তার ফসল এ বিল। এ বিল পাস হওয়ার পর দীর্ঘদিন বিডিআর নামে পরিচিত বাহিনী এখন থেকে বর্ডার গার্ড নামে পরিচিত হবে। বিডিআরের রয়েছে একটি গৌরবময় ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে শুরুতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বিডিআর। বিডিআর তখন ইপিআর নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পিলখানায় হামলা চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিডিআর সদস্যরা বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাত বীরশ্রেষ্ঠের দুজন এই বাহিনীর সদস্য। নাম বদল হলেও বর্ডার গার্ড অতীতের মতোই দেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি আমরা।

হায় হায় কম্পানি by মোস্তফা কামাল

ত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে নাদের আলী চাকরির জন্য দরখাস্ত করে। সঙ্গে জামানতের তিন হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট পাঠায়। এ জন্য তাকে ধারদেনা করতে হয়। সে ভাবে, চাকরি হলে তিন হাজার টাকা শোধ করা কোনো ব্যাপার হবে না!

একটি বেসরকারি সংস্থায় প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে চাকরির আশায় নাদের আলী প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংক ড্রাফট করে পাঠায় ঢাকায়। এমনিতেই চাকরির বাজার মন্দা, ডিগ্রি পাস করে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে চাকরিটা যদি পাওয়া যায়, মন্দ কী! মা-বাবার সংসারে কিছুটা সহায়তা তো করা যাবে!
চাকরি হওয়ার খবর নেই, ইন্টারভিউ কার্ড পেয়েই নাদের আলী খুশি। বিগত তিন বছরে সে কম দরখাস্ত করেনি। কোনো দিন ইন্টারভিউ কার্ডও পায়নি। আজ কার্ড পেয়ে সে মাকে দেখায়, বাবাকে দেখায়। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে এমনভাবে বলে, যেন তার চাকরি হয়ে গেছে।
ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঢাকায় রওনা হয় নাদের আলী। এত বড় শহরে এসে খেই হারিয়ে ফেলে। ঠিকানা হাতে নিয়ে এর-ওর কাছে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু সেই ঠিকানায় কাউকে খুঁজে পায় না। কেউ বলতেও পারে না। এখন কোথায় যাবে, কী করবেÑকিছুই ভেবে পায় না নাদের আলী। সে চুল ছেঁড়ে আর বলে, এ তো দেখছি হায় হায় কম্পানির পাল্লায় পড়লাম! দেনা করে ব্যাংক ড্রাফট করলাম। এখন শোধ দেব কী দিয়ে! মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে সে।
নাদের আলী ঢাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটে আর ভাবে, ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই, বাড়িতে যাওয়ার উপায় নেইÑএখন কী করি! সে পথচারী হাবলু মিয়াকে বলে, ভাই, আমাকে একটা বুদ্ধি দেবেন?
হাবলু মিয়া বলল, জি না।
কেন?
ফি লাগবে।
কত টাকা?
দুপুরের খাওয়ার পয়সা দিলেই হবে।
ও, আপনার অবস্থাও তো আমার মতো!
মানে!
আমি হায় হায় কম্পানির পাল্লায় পড়ে দেউলিয়া হয়েছি। এখন টাকা-পয়সা হাতে নেই। ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা নেই।
তাই নাকি! আরে ভাই আগে বলবেন না! আমারও তো একই অবস্থা। পত্রিকায় সত্যি সত্যি হায় হায় কম্পানির নামে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, শর্ত সাপেক্ষে লোক নিয়োগ করা হবে। তবে চাকরিপ্রার্থীদের অবশ্যই পাঁচ হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট পাঠাতে হবে। ওই টাকা সিকিউরিটি মানি হিসেবে জমা থাকবে। চাকরি না হলে পুরো টাকা ফেরত দেওয়া হবে। আমি সরল বিশ্বাসে পাঁচ হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট পাঠাই। এসে দেখি, হায় হায় কম্পানির একটি সাইনবোর্ড আছে, কিন্তু কোনো লোক নেই।
কী বলেন! কম্পানির নামই হায় হায় কম্পানি?
হ্যাঁ ভাই, হ্যাঁ!
তাহলে তো ঠিকই আছে।
কী ঠিক আছে?
তারা নিজেদের হায় হায় কম্পানি ঘোষণা করেই আপনার টাকা নিয়েছে। এতে তাদের কোনো দোষ নেই।
কী বললেন! আচ্ছা ভাই, হায় হায় কম্পানি মানে কী?
মানে ভুয়া কম্পানি।
তাই! আমি এত বোকা!
আপনার নামই তো হাবলু! বুদ্ধিমান হওয়ার সুযোগ কোথায়! আপনি আবার আমাকে বুদ্ধি দিতে চান!
হাবলু মিয়া হাবাগোবার মতো নাদের আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। নাদের আলী আর দাঁড়ায় না। সে আপন মনে হাঁটতে থাকে।

২.
হাঁটতে হাঁটতে নাদের আলী তাবানী বেভারেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিশাল গেটের সামনে এক জায়গায় লেখা আছে, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ’। আরেক জায়গায় লেখা আছে, ‘লোক নিয়োগ চলছে’।
নাদের আলী খুব ভালো করে লেখা দুটি পড়ে। তারপর গেটে দাঁড়ানো এক লোককে বলে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
জি, করেন।
আবার ফি দিতে হবে না তো!
কিসের ফি?
কথা বলার ফি।
এই মিয়া, ইয়ার্কি করেন!
না ভাই, ইয়ার্কি করছি না। এক লোক বুদ্ধি দেওয়ার জন্য ফি চাইল তো, তাই বললাম! সরি ভাই, মনে কিছু করবেন না।
ঠিক আছে, করব না। এবার আপনার প্রশ্নটা করেন।
এই যে গেটের এক পাশে লেখা কারখানাটি বন্ধ, আরেক পাশে লেখা লোক নিয়োগ চলছেÑঘটনা কী!
ঘটনা আছে। আপনি চাকরি করবেন?
চাকরির জন্যই তো ঢাকায় এসেছি!
চাকরি পেতে হলে ঘুষ লাগবে!
ঘুষ! এটা আবার কী?
ঘুষ মানে জানেন না? টাকা লাগবে, টাকা! টাকা দিলে চাকরি হবে।
হ্যাঁ, খুব ভালো বলেছেন, আমি টাকা দিই, আর আপনি টাকা নিয়ে ভাগেন! দরকার নেই আমার চাকরির। আমি যাই।
নাদের আলী হাঁটে আর মনে মনে বলে, কী ব্যাপার, ঢাকা শহরে কি সবই হায় হায় কম্পানি!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

বিদ্যুৎ উৎপাদনে শর্ত

বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে সরকার একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এরই অংশ হিসেবে খুলনায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে। একই সঙ্গে মেঘনাঘাট ও কেরানীগঞ্জেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এসব উদ্যোগের শুরুতেই আবার জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কোনোটির আবার ব্যবহার্য কাঁচামাল নিয়েও কথা উঠেছে। বিশেষ করে খুলনায় প্রস্তাবিত কেন্দ্র দুটির অংশীদার প্রতিষ্ঠান ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কম্পানি যেসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে বলে পত্রিকার সংবাদে জানা গেছে, তাতে মনে হয় আরেকটি কাফকো বিতর্ক তৈরির সুযোগ আসছে সামনে।

বাংলাদেশের জন্য এবং বাংলাদেশের অংশীদারে নির্মিত হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, অথচ এর একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এমন শর্ত যে খসড়া চুক্তিতে স্থান পেয়েছে, তাকে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে বর্ণনা করা যায় কি? শুধু তা-ই নয়, এ খসড়া চুক্তিতে কর সুবিধা, পরবর্তীকালে দেশের ভেতরে বিদ্যুৎ বিক্রির ব্যাপারেও তাদের যে শর্ত তাকেও সহজ এবং দেশের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে হয়। যেহেতু অংশীদারির ভিত্তিতে এ প্রকল্প কাজ করবে তাই ভারতের স্বার্থ একচেটিয়া হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মীর কথা বিবেচনা করলেও দেখা যাবে, বাংলাদেশে তেমন জনশক্তি আছে। কিন্তু সেই খসড়া চুক্তিতে এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট জনবলের প্রায় সবাই আসবে ভারত থেকে। চুক্তি সম্পাদনের জন্য যে স্ট্যাম্প লাগবে তা-ও বাংলাদেশকে দিতে হবে_এমন শর্তসহ চুক্তিপত্রটি নিয়ে আরো ভাবা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদন অতি জরুরি বিষয় হলেও দেশের স্বার্থ অগ্রাহ্য করে কোনো কাজ করা হলে তা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, মেয়াদকালে বাংলাদেশ সরকার নীতি-কৌশলের দিক থেকে প্রতিবন্ধক হতে পারবে না। খসড়া চুক্তিটি যাচাই করার সময় দেশের স্বার্থকে অবশ্যই উচ্চে স্থান দিতে হবে।
এদিকে কেরানীগঞ্জ ও মেঘনাঘাটে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে গ্যাস ব্যবহারের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তাও অবাস্তব বলে বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে মত দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ নতুন গ্যাস প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে সরকার যদি গ্যাসনির্ভর কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে তাহলে এটি ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাই প্রকট। আবার কেরানীগঞ্জের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করাও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। দেশের সম্পদ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হলে উৎপাদন ব্যয় কমে আসার পাশাপাশি উৎপাদন ক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কাও কমে আসবে। এ মুহূর্তে দেশের কয়লা উৎপাদন বাড়িয়ে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা সবচেয়ে যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি।

কানকুন জলবায়ু সম্মেলনঃ স্বল্পমেয়াদি সাফল্য, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই

মেক্সিকোর কানকুনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে সাফল্য সামান্যই। কোপেনহেগেনের বহুল আলোচিত সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর এবারের সম্মেলন কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হলে এ ধরনের বহুপক্ষীয় আলোচনা ভবিষ্যতে আদৌ রাষ্ট্রগুলোর কাছে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল। এ সম্মেলনের মাধ্যমে তা অনেকটাই কাটানো গেছে।

তবে জলবায়ু আলোচনার বেশ কিছু মুখ্য প্রশ্ন এবারও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলো। একটি ন্যায্য ও আইনগত বাধ্যবাধকতার চুক্তি করা যায়নি। অন্যদিকে কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ বাড়ানো নিয়েও কোনো সমঝোতা হয়নি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অথচ কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ২০১২ সালে। এটির পরের পর্যায় শুরু করার ব্যাপারে সম্মত হতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এই শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। এই সমঝোতায় ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও অনুপস্থিত। তা ছাড়া শিল্প খাতভিত্তিক কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ফলে আরও এক বছর তারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে দূষণ ঘটিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল।
কানকুন সমঝোতায় শিল্পবিপ্লবপূর্ব সময়ের সাপেক্ষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ব্যাপারে অঙ্গীকার করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এ দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব এড়ানোর জন্য অপরিহার্য। তাই এ অঙ্গীকার ইতিবাচক। যদিও এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কোনো দেশ আইনগতভাবে বাধ্য নয়। গত কোপেনহেগেন সম্মেলনেও বহু অঙ্গীকারের কথা শোনা গেছে, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব মোকাবিলায় গরিব দেশগুলোকে তহবিল প্রদানের ব্যাপারেও মতৈক্যে পৌঁছা গেছে। কোপেনহেগেন সম্মেলনেও ঝুঁকির মধ্যে থাকা দরিদ্র দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তহবিল প্রদানের মুলো ঝুলিয়ে একধরনের আশাবাদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এবারের সম্মেলনেও তার ছায়া অপসৃত হয়নি। আমাদের জলবায়ু কূটনীতিকে আরও সক্রিয় করা প্রয়োজন। মূলত শিল্পোন্নত ও সাম্প্রতিক কালে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। তাই ক্ষতিপূরণের দাবি ন্যায্য। অভিযোজনও বিরূপতা কাঠানোর কৌশল। জলবায়ু পরিবর্তন যে ভয়ানক বিপদ হাজির করে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপরই জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে ন্যায্য তহবিল পাওয়ার চেষ্টা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কার্বন নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নেওয়া।

ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রমিকবান্ধব সিদ্ধান্ত নিনঃ অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা

তৈরি পোশাক কারখানায় মজুরির সমস্যাকে কেন্দ্র করে শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমিকের সংখ্যা এবং পুলিশ-র্যাবের ৫০০ গুলি ও প্রায় শতটি টিয়ার শেল নিক্ষেপ থেকে সংঘর্ষের ব্যাপকতা অনুমান করা যায়। এই মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কী কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। পাশাপাশি কী কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল, তাও সঠিকভাবে চিহ্নিত হতে হবে।

গত জুলাই মাসে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির মাধ্যমে পোশাকশিল্পে নতুন ন্যূনতম জাতীয় মজুরিকাঠামো ঘোষিত হয়। প্রথমত, আশানুরূপ না হওয়ায় শ্রমিকদের বড় অংশই এটা মানতে রাজি ছিল না। দ্বিতীয়ত, সেই মজুরিও চার মাস পর অর্থাৎ গত নভেম্বর থেকে দেওয়ার ঘোষণায় তাঁরা আরও হতাশ হন। এর মধ্যে দুটি ঈদেও তাঁরা কাঙ্ক্ষিত বোনাসও পাননি। তার পরও শ্রমিকেরা ডিসেম্বর মাসের জন্য দিন গুনেছেন। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতেই নভেম্বরের বেতন হাতে পেয়ে তাঁদের একাংশের হতাশা চরমে ওঠে। তাঁদের অভিযোগ, নতুন শ্রমিকদের বেতন কিছুটা বাড়লেও পুরোনো ও দক্ষ শ্রমিকদের বেতন সেই অনুপাতে বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রেই তা নতুন শ্রমিকদের থেকেও কম হয়ে গেছে। এর জের ধরেই গত শনিবার চট্টগ্রাম ইপিজেডের ১৬টি কারখানা এবং ঢাকা বিভাগের ১১টি কারখানা বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুরের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে। গত রোববার রাজধানীর কুড়িলে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেন। একই দিনে চট্টগ্রাম ইপিজেডে শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করতে গেলে ফিরিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে এবং নির্ধারিত বৈঠক না হওয়ার প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের পেছনেও এ কারণটিই প্রধান। তিনটি প্রাণের দুঃখজনক মৃত্যু এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙচুরের পটভূমিও এটি।
পোশাকশিল্পের মজুরি-সমস্যা দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই সবাইকে ভুগিয়ে চলছে। শিল্পটির জন্মের পর থেকেই এ কারণে বিক্ষোভ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন অনেক শ্রমিক, ঘটেছে অজস্র ভাঙচুর ও নৈরাজ্যের ঘটনা। আশা করা হয়েছিল, নতন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর নিরসন ঘটবে। কিন্তু মালিকদের চুক্তি ভঙ্গ করা এবং শ্রমিক ঠকানোর প্রবণতার জন্যই সরকারি চেষ্টা সত্ত্বেও শ্রমিকাঞ্চলে শান্তি আসছে না।
মালিকদের নতুন মজুরিকাঠামো মানতে বাধ্য করার দায়িত্ব বিজিএমইএ ও সরকারের। পোশাক খাত দেশের অর্থনীতিতে তো বটেই, মালিকদের অর্থ-বিত্তকেও বিপুলভাবে বৃদ্ধি করেছে। এই সাফল্যের অংশীদার শ্রমিকেরাও। পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধির হার এ বছর ৩৮ শতাংশ। এত অনুকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও লাভের ভাগ মালিকের, দুর্ভোগের দায় শ্রমিকের—এটা চলতে পারে না।
চট্টগ্রামে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। এ মুহূর্তে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং শিল্পমালিকদের যেকোনো বাড়াবাড়ি মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। একই সঙ্গে শ্রমিকনেতাদের বুঝতে হবে, গঠনমূলক আন্দোলনই দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, নৈরাজ্য নয়। জরুরি ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় কমিটির বৈঠক হওয়া দরকার। সেখানে সরকারের দায়িত্ব বিজিএমইএকে দিয়ে নতুন মজুরিকাঠামোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও শ্রমিক অসন্তোষের ইতি ঘটানো।

স্বাধীন বাংলাদেশ পরাধীন মুক্তিযোদ্ধা by এম আর আলম

গের দিনই খবরটা পৌঁছে যায় দিনাজপুর শহরে। সর্বত্র আতঙ্ক। ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যেই দিনাজপুর আক্রমণ। পাকিস্তানি বাহিনী একটা বিশেষ ট্রেনে চেপে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা দিয়েছে। এ খবর ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দাদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বরাহার মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন ক্যাম্পে। খবরটা শুনে ছটফট করতে থাকেন মাসুম হাসান তোরাব আলী। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার বড় হাশিমপুর গ্রামে। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় দিনাজপুরের হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি মারা যাবে, এ উৎকণ্ঠা তোরাবের মনে ভর করে। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে নিজ এলাকার মানুষকে, স্বজন-বন্ধুদের।

তোরাব ক্যাম্পের কমান্ডার ডা. আমজাদ হোসেনের সামনে ঘুর ঘুর করতে থাকেন। কমান্ডার বুঝে যান তোরাবের মনোভাব। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অপারেশনের।
চিরিরবন্দর রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে জগদীশপুর রেলসেতুটি উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে তোরাবের ওপর। মাত্র ছয় সদস্যের মুক্তিবাহিনী নিয়ে অপারেশনে বেরিয়ে পড়েন তোরাব।
ভারতের বরাহার ক্যাম্প থেকে মেশিনগান, কয়েকটি রাইফেল নিয়ে বের হয় তোরাবের বাহিনী। আরও নেওয়া হয় স্থলমাইন। যে মাইনটি পোঁতা হবে ব্রিজের পাটাতনের (স্লিপার) নিচে। দীর্ঘ ৪০ মাইল পথ হেঁটে ছুটলেন তাঁরা।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত তিনটার দিকে পৌঁছে যান সেতুর খুব কাছাকাছি। এর আগে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার পথ চলার ক্লান্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু যেন ছিল না তাঁদের।
ক্লান্ত তোরাবের চোখে স্বপ্ন উঁকি দেয়, দেশটা স্বাধীন হয়েছে। আকাশের বুকে মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকাটি উড়ছে পতপত করে।
দূরে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়। সংবিত ফেরে তোরাবের। আর দেরি করা যায় না। তড়িঘড়ি কাপড়ের পুঁটলি থেকে বের করেন মাইনটি। এরপর ছয় যোদ্ধা ক্রলিং করে এগিয়ে যান সেতুর কাছে। তোরাবের হাতে মাইনটি। সব ঠিক, কেবল সেতুর পাটাতনের নিচে মাটি আলগা করে পোঁতা হবে সেই মাইন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। আর কিছু মনে নেই তোরাবের! যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করলেন শিলিগুড়ির বাগডোকরা হাসপাতালে। সহযোদ্ধারা আহত তোরাবকে কাঁধে করে প্রথমে নিয়ে আসেন ক্যাম্পে। পরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয় হাসপাতালে। ডান হাতের কবজি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ডান চোখটিও নেই তাঁর। চিকিৎসকেরা আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। তোরাবকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় বোম্বের সামরিক হাসপাতাল ও পুনাতে। সেখানে কৃত্রিম চোখ লাগানো হয় তাঁর।
বাংলাদেশ স্বাধীন। তবু তোরাব ঘরে ফিরছেন না। তোরাবের বাবা গহির উদ্দিন ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সুস্থ হয়ে তোরাব ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘরে ফেরেন। মুক্তিযোদ্ধার সেই রেলসেতু অপারেশন কিন্তু বৃথা যায়নি। পরে জেনেছিলেন, মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনী ভড়কে যায়। আর সামনে এগোয়নি তারা। বিশেষ ট্রেনটি পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্যকে ফিরিয়ে নেয় পার্বতীপুর হয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসে। যে বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখেছিলেন দিনাজপুরবাসীকে রক্ষার জন্য, তিনি নিজেই আজ অসহায়-পরাধীন!
মুক্তিযোদ্ধা তোরাবের সঙ্গে কথা বললে কেঁদেই ফেলেন তিনি। জানান, ভিটেমাটির ১২ শতক জমির ওপর নজর পড়েছে তাঁর বিমাতা ভাইদের। গ্রামের একটি দুষ্কৃতকারী চক্রের ষড়যন্ত্রে ভাইয়েরা এখন তাঁকে উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। চক্রটি একাত্তরের পরাজিত শক্তি। যাদের দোর্দণ্ড দাপট এখনো বড় হাশিমপুরে। বারবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে, যেন এখনই চলে যাই সহায়-সম্পত্তি সবকিছু ছেড়ে। রাতে দুষ্কৃতকারীরা বাড়ির সদর দরজার সামনে অস্ত্র হাতে ওত পেতে থাকে। গোটা পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়।
এসএসসি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা তোরাব প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মেধাবী ওই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কি শিক্ষার সুযোগ পাবে না? বড় আতঙ্কে আছে ওরা। স্বাধীনতার জন্য জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন তোরাব, অথচ তাঁর পরিবার আজ স্বাধীন দেশে বড্ড অসহায়। স্ত্রী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে তোরাবের পরিবার আজ নিরাপত্তাহীন।
যাঁর বীরত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে লেখা চিঠি দিয়েছিলেন। সেই তোরাব কি স্বাধীন বাংলাদেশেও এতটা অসহায়ই হয়ে রইবেন?