Tuesday, February 22, 2011

রক্তাক্ত লিবিয়ায় আক্রান্ত শতাধিক বাংলাদেশি by মেহেদী হাসান

মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলের অবসানের দাবিতে চলা জনবিক্ষোভে লিবিয়ার পরিস্থিতি এখন অগি্নগর্ভ। গাদ্দাফির অনুগত লোকজন গুলি চালিয়ে সরকারবিরোধীদের হত্যা করছে। চরম অরাজক অবস্থার মধ্যে লিবিয়ায় কর্মরত শতাধিক বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েকটি দেশের তিন শর মতো নাগরিক আক্রান্ত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

লিবিয়ায় বেনগাজিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অনেকে 'জিম্মি' হওয়ার কথা গতকাল টেলিফোনে দেশে তাদের স্বজনদের জানায়। অবশ্য ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এর সত্যতা নাকচ করেছে। দূতাবাস সূত্র অবশ্য স্বীকার করেছে, লিবিয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। খোলা তলোয়ার, ছুরি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশিদের উদ্ধার এবং প্রয়োজনে দেশে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা যাচাই করা হচ্ছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, গতকাল সোমবার জঙ্গিবিমান থেকেও বিক্ষোভকারীদের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। গাদ্দাফির সমর্থকরাও ভবনের ছাদ থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। তবে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে গাদ্দাফি সরকারের দেওয়া নির্দেশ অমান্য করে বিমানবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা দুটি জঙ্গিবিমান নিয়ে মালটায় পালিয়ে যান। রাত পৌনে ২টার দিকে জানা যায়, ত্রিপোলিতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
এদিকে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে গাদ্দাফি পালিয়ে ভেনিজুয়েলার পথে রয়েছেন বলেও মনে করছেন
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। তবে ভেনিজুয়েলা কর্তৃপক্ষ খবরটি অস্বীকার করেছে। লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাদ্দাফি দেশেই আছেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের প্রতিবাদে ইতিমধ্যে লিবিয়ার বিচারমন্ত্রীসহ বেশ কিছু ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। জাতিসংঘে নিযুক্ত লিবিয়ার উপরাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম দাব্বাসি পদত্যাগ করে গাদ্দাফিকেও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, লিবিয়ায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ২৩৩ ছাড়িয়ে গেছে। চীন, ভারত ও আরব লিগে লিবিয়ার শীর্ষস্থানীয় তিনজন কূটনীতিক মুয়াম্মার গাদ্দাফির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে পদত্যাগ করে অন্য কূটনীতিকদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের একজন আল জাজিরাকে বলেছেন, গাদ্দাফি হয়তো লিবিয়া ছেড়ে পালিয়েছেন এবং তাঁর ছেলেদের মধ্যে কর্তৃত্ব নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ চলছে। গাদ্দাফিপুত্র সাইফ আল ইসলাম গতকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে সতর্ক করে বলেন, বিক্ষোভকারীদের কারণে তাঁর বাবার শাসনের অবসান হলে গোটা দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে এবং এর মাধ্যমে লিবিয়া ধ্বংস হবে। সরকারের সংস্কার প্রস্তাব না মানলে লিবিয়াজুড়ে রক্তের নদী বয়ে যাবে বলেও হুমকি দেন তিনি।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে নির্বিচার শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়েছেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। অন্যদিকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের জন্য মরিয়া হয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে গাদ্দাফিবিরোধী পক্ষ। সম্প্রতি মিসরে গণবিক্ষোভের পর হোসনি মুবারকের ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণায় লিবিয়ার বিক্ষোভকারীরাও উৎসাহিত হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের একটি অংশ মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জিম্মি করছে বলে বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেছে। গতকাল সোমবার সিএনএন, ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিবিয়ায় পরিচালিত একটি কোরীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১৫ বাংলাদেশি ও তিন কোরীয় শ্রমিকের আহত হওয়ার খবর প্রচার করে। আহত বাংলাদেশিদের মধ্যে দুজন ছুরিকাহত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানায় সংবাদ সংস্থা ইয়োনহাপ।
দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাইক জু হাইয়ুনের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গত রবিবার রাত ১১টার দিকে ত্রিপোলির পশ্চিমে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০০ লিবীয় বিক্ষোভকারী ভাঙচুর করে চলে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর তারা আবার ফিরে এলে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। ওই প্রতিষ্ঠানে এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ও প্রায় ৫০ জন কোরীয় নাগরিক কর্মরত।
বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদ সংস্থা বিডিনিউজ গতকাল রাতে লিবিয়ায় শতাধিক বাংলাদেশিকে জিম্মি করার খবর প্রচার করে। তাদের মধ্যে ১৫ জন আহত হয়েছে বলে জানানো হয়। সংবাদ সংস্থাটি জানায়, লিবিয়ায় দমন-পীড়নের মুখে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা তিন শর বেশি বিদেশিকে জিম্মি করেছে, যার মধ্যে শতাধিক বাংলাদেশি রয়েছে। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজি থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার পূর্বে দারনা সিটিতে কয়েক দিন ধরে তারা আটক রয়েছে বলে একজন বাংলাদেশি জিম্মি জানিয়েছেন। জিম্মিরা ধারণা করছে, নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেই বিদেশিদের আটক করা হয়েছে।
দারনা সিটিতে জিম্মিদের অন্যতম মানিকগঞ্জ জেলার শফিউদ্দিন বিশ্বাস গতকাল দুপুরে টেলিফোনে বিডিনিউজকে বলেন, 'গত শুক্রবার বিকেলে ৩০-৪০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি আমাদের ক্যাম্প অফিস থেকে জিম্মি করে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে একটি মসজিদে নিয়ে যায়। পরের দিন স্থান পরিবর্তন করে পাশের দুটি কমিউনিটি সেন্টারে আমাদের আনা হয়েছে।' আরেক জিম্মি ফরিদপুরের আবদুল আজিজ টেলিফোনে বলেন, 'আমাদের আটকে রাখা হয়েছে। প্রথম কয়েক দিন সারা দিন দুটি করে রুটি খেতে দেওয়া হয়েছে। সামান্য হলেও পানি দিয়েছিল। কিন্তু রবিবার থেকে পানি পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় গতকাল দুপুর ১২টা) কোনো খাবার দেওয়া হয়নি। আমাদের কাছে সামান্য পানি আছে, সেটাই খাচ্ছি।'
আবদুল আজিজ আরো বলেন, 'আমাদের ফোন করতে দিচ্ছে না। তবে ফোন এলে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে। তারা এখনো কিছু দাবি করেনি। শুধু বলছে, গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, এখন আমাদের শাসন চলবে।'
লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের অবস্থা জানতে গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে ৫টার দিকে কালের কণ্ঠ কার্যালয় থেকে টেলিফোনে ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ জানায়, লিবিয়ায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিন দিন আগে তারা নিয়ন্ত্রণকক্ষ খুলেছে। ওই নিয়ন্ত্রণকক্ষে দায়িত্বরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, দিনরাত সব সময়ই বাংলাদেশিদের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগ হচ্ছে। জিম্মি করা বলতে যা বোঝায় সে ধরনের কোনো ঘটনার তথ্য দূতাবাসের জানা নেই। তবে কয়েকজন শ্রমিক অসুবিধার মধ্যে আছে। লিবিয়ায় আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী লুটপাট চালাচ্ছে।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা কী ধরনের অসুবিধার মধ্যে আছেন, জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশিরা কাজ করেন_এমন একটি প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পালিয়েছে। তবে বিক্ষোভকারীদের হামলায় কোনো বাংলাদেশির মারাত্মক আহত হওয়ার খবর দূতাবাসের জানা নেই।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, শুধু বাংলাদেশি নয়, সেখানে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও কোরিয়ার নাগরিকরাও হামলার শিকার হয়েছে। পরিস্থিতি এখন কারো নিয়ন্ত্রণে নেই। রাস্তায় খোলা তলোয়ার ও ছুরি নিয়ে নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। সর্বত্র থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে। দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টেলিফোন যোগাযোগও সীমিত করা হয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ দূতাবাস জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলে বাংলাদেশিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দূতাবাস সূত্র আরো জানায়, বিক্ষোভে উত্তাল বেনগাজিতে প্রায় ছয় হাজার এবং পুরো লিবিয়ায় প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোয় বাংলাদেশিদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানায়, পরিস্থিতি অনুযায়ী সব সম্ভাবনা যাচাই করা হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ এখানে একা কিছু করবে না। লিবিয়ায় অন্য দেশগুলোর দূতাবাসগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে দেশটির অভিবাসনবিষয়ক আইনও। প্রয়োজনে সবাইকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধারের চিন্তাভাবনাও করা হবে।
বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে লিবিয়ায় তুলনামূলক নিরাপদ কোনো স্থানে রাখা হবে নাকি দেশে ফেরত পাঠানো হবে_এ প্রশ্ন করলে দূতাবাস সূত্র জানায়, বিষয়টি পরিস্থিতি এবং ওই বাংলাদেশিদের প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করবে। লিবিয়ায় চলমান পরিস্থিতির কোনো প্রভাব বাংলাদেশ দূতাবাসের ওপর পড়েছে কি না_এ প্রশ্নে সূত্রটি জানায়, লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস এলাকার পরিস্থিতি এখনো বেনগাজি বা অন্য এলাকাগুলোর মতো হয়নি। তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
গণবিক্ষোভের মুখে গত ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর পলায়ন এবং গত ১১ ফেব্রুয়ারি মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ৩০ বছরের শাসনামলের অবসানের পর লিবিয়াসহ বিভিন্ন আরব দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ চলছে। বর্তমানে বিক্ষোভে উত্তাল লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি চার দশক ধরে ক্ষমতাসীন। ১৯৬৯ সালে তরুণ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেন গাদ্দাফি। তখন থেকেই দেশটি তাঁর শাসনে চলছে। করুণ পরিণতির আশঙ্কায় গাদ্দাফি দৃশ্যত মরণ কামড় দিয়ে এখন ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন। অন্যদিকে তাঁকে উৎখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিক্ষোভকারীরা। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ও টুইটারে সংগঠিত হয়ে গত বৃহস্পতিবারকে 'ক্ষোভের দিন' নাম দিয়ে সরকার পতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে কয়েক হাজার মানুষ। বিক্ষোভকারীদের ওপর গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর হামলা ও গুলিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ত্রিপোলির বাসিন্দারা এএফপিকে জানিয়েছে, রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় গতকাল সকালে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এরই মধ্যে চলছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মাত্র চার দিনে (১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি) লিবিয়ায় অন্তত ২৩৩ জন নিহত হয়েছে। সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের পরিচালক সারাহ লিহ হুইটসন বলেছেন, লিবিয়ায় মানবিক বিপর্যয় ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেশটি (লিবিয়া) তথ্য আড়াল করার চেষ্টা করলেও বর্বর হত্যাকাণ্ড আড়াল করতে পারবে না।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, চীন ও ভারতে নিযুক্ত লিবিয়ার জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এবং আরব লিগে নিযুক্ত লিবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি গাদ্দাফি প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন। বেইজিংয়ে লিবিয়া দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব হোসেইন সাদিক আল মুস্তারি পদত্যাগের পর গতকাল কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্য কূটনীতিকদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'গাদ্দাফি হয়তো ইতিমধ্যে লিবিয়া ছেড়েছেন এবং তাঁর ছেলেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ চলছে।' আরব লিগে নিযুক্ত লিবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি আবদেল মোনেম আল-হোনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বিদ্রোহে যোগ দিতেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গতকাল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেন, বিক্ষোভের পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে। সরকারের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাব আগ্রাহ্য করা হলে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। এ পর্যন্ত মাত্র ৮৪ জন নিহত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'সরকারের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবে রাজি না হলে আমরা কেবল ৮৪ জনের জন্য শোক পালন করব না। এ সংখ্যা হাজার ছাড়াবে। লিবিয়াজুড়ে রক্তের নদী বইবে।'
সংঘাত বন্ধের আহ্বান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের : ফ্রান্স, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফিলিপাইন অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের জন্য লিবিয়ার সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে শক্তিপ্রয়োগ বন্ধ ও জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানান।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় ঝুঁকিতে অর্থনীতি

পুঁজিবাজারে ধস, আবাসন শিল্পে স্থবিরতা ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে। গুটিকয়েক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী কার্যক্রম পুরো আর্থিক খাতকেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের প্রারম্ভিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
তাঁদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার, আবাসন খাত ও অনুৎপাদনশীল খাতে অতিমাত্রায় ঋণ সম্প্রসারণের কারণে এশিয়ার অনেক দেশই ওই সময় চরম সংকটে পড়েছিল। জিডিপির প্রয়োজনের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি : ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ব্যাপক বেড়েছে, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি। এ বিষয়ে খোদ মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, 'অর্থবছরের প্রথমার্ধজুড়েই (২০১০ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর) অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ব্যাপক। বিদায়ী ২০১০ সালের জুন থেকে নভেম্বর_এই পাঁচ মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এই ঋণের প্রবাহ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল।' অপরদিকে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২১ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের এই বিপুল ঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য
সরকারের সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেছেন একাধিক ব্যাংক বিশ্লেষক। বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে জানান, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে সহায়ক ছিল কিছু খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩ শতাংশ
নির্ধারণ করে দেওয়া। যেখানে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারছে না, সেখানে শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার বেঁধে দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
তিনি বলেন, এতে সমস্যা হয়েছে ত্রিমুখী। প্রথমত, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে আমানতের বিপরীতে ঋণের সুদহার কমাতে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলো মুনাফা ধরে রাখতে কনজ্যুমার ক্রেডিটে বেশি অর্থায়ন করেছে। তৃতীয়ত, চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদহারে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য লাভজনক খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। লাভজনক খাত ছিল সঞ্চয়পত্র। সেখানেও সুদহার কমানো এবং এর আয়ের ওপর করারোপ করায় সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকেছে অসংখ্য বিনিয়োগকারী।
সরকারি ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ও করারোপ সরকারের অন্যতম একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ এতে বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ধাবিত হয়েছেন। যদি সঞ্চয়পত্রে সরকারের ভর্তুকি দিতেই হতো তাহলে এর পরিমাণ আর কত হতো! নিশ্চয়ই বর্তমানে পুঁজিবাজারে ধসের চেয়ে ভয়াবহ হতো না। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক ঘরোয়া বৈঠকেও সিদ্ধান্তটির সমালোচনা করেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স বিনিয়োগের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় প্রান্তিক মানুষ তা ব্যয় করেছে জমি কেনাসহ নানা অনুৎপাদনশীল খাতে, যা মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং তা প্রবৃদ্ধিকে গিলে ফেলে। সুতরাং সরকারের উচিত ছিল, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর পরিবর্তে কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া। তাতে রেমিট্যান্সের বিপুল পরিমাণ অর্থ হয়তো ব্যাংক খাতেই থেকে যেত। পরবর্তী সময়ে কোনো উৎপাদনশীল খাতে তা বিনিয়োগ করা যেত বলে মনে করেন ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী।
পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়াও ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অর্থায়নে ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়নে প্রায় ২৮, এসএমই ও কৃষিতে প্রায় ১০ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় এ খাতগুলোতে মোট নতুন ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ গেছে। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ (প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা) গেছে সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নয় এমন খাতগুলোতে। এ ছাড়াও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ভোক্তাপণ্য কেনার জন্য দেওয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় যেসব খাত অনুৎপাদনশীল তার মধ্যে গত বছর পুঁজিবাজার ছিল শীর্ষে। অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণের সিংহভাগই পুঁজিবাজারে গেছে বলে ধারণা করছেন তাঁরা। এরই মধ্যে কিছু ব্যাংকের আর্থিক সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কেউ কেউ আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করেও তাদের মার্চেন্ট ব্যাংক শাখায় দিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রমাণ পেয়েছে। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে এসব ব্যাংকের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আটকে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে বিনিয়োগ উঠে না আসায় ব্যাংকগুলোর দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে কলমানি থেকে প্রতিদিন এসব ব্যাংক বেশ বড় অঙ্কের টাকা ধার করে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুঁজিবাজারে ধস অব্যাহত থাকলে কয়েকটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হতে পারে, যা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাই আমরা ব্যাংকগুলোকে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।'
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় চলে এসেছে।'
অপরদিকে তুলনামূলক অরক্ষিত খাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটির মুনাফার অধিকাংশই আসে পুঁজিবাজার থেকে। এদের অনেকেরই পুঁজিবাজারে বড় ধরনের মূলধন আটকে গেছে। বাজারে মন্দাবস্থা এবং ক্রেতা না থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান ট্রিগার সেলেও যেতে পারছে না। এ ছাড়া এ বিষয়ে এসইসির কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল কম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়াম্যান ও লঙ্কা বাংলা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজউদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইং রয়েছে। এদের পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে দেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে আনুমানিক বিনিয়োগ প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে গ্রাহকদের দেওয়া এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশ আগামী প্রান্তিকে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মার্কেটের এ অবস্থায় আমরা ট্রিগার সেলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
সার্বিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী দুই প্রান্তিক অর্থাৎ মার্চ ও জুন প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিবরণীতে এর প্রতিফলন ঘটতে পারে।
আবাসন শিল্পে মন্দাবস্থা ও বিপুল অর্থ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা : গত কয়েক বছর ধরে জমির মূল্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর সহজ শর্তে অর্থায়নই ছিল দায়ী। সহজে অর্থ পাওয়ার সুবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে হাউজিং ব্যবসার প্রসার বেড়েছে। জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অবস্থায় তৈরি হয়েছে বিপুল উদ্যোক্তা। বিনিয়োগও হয়েছে প্রচুর। ফলে ব্যাংকের অর্থায়নও রয়েছে অনেক।
রিয়্যাল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)_এর তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে আবাসন শিল্পমালিকদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং ফ্ল্যাট ক্রেতাদের প্রায় ১২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়েছে। রিহ্যাবের সদস্য নয় এমন উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের সমপরিমাণ অর্থ বিবেচনা করলে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ডেভেলপার চরম আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে পারছেন না অনেকে। আবার অনেকে সম্পূর্ণ করেও প্রকল্প হস্তান্তর করতে পারছেন না গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকার কারণে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক ডেভেলপারই দেউলিয়া হয়ে যাবেন বলে রিহ্যাব সূত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এশীয় মন্দার সময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার এবং আবাসন খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছিল। তবে আমরা এখনো সে পর্যায়ে যাইনি। কিছু ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা অন্যান্য খাত থেকে ডিভিডেন্ট দিচ্ছে। পুঁজিবাজারে খেলাপি হলে তারা সেখান থেকে প্রভিশন করবে।'
তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশের আর্থিক খাত মন্দাকবলিত হতে পারে বলে এখনো আমি মনে করি না। পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে এটাও বলা ঠিক হবে না। কারণ এটাকে আবার কার্যকর করার প্রচেষ্টা চলছে।'
তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকে। তারা পুঁজিবাজারে স্বল্প মেয়াদি বিনিয়োগের দিকে যেন অতিমাত্রায় ধাবিত না হয় সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তবে মন্দাবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সরকারকে ম্যাক্রো-ইকোনমির দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি জোর দিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এশিয়ান মন্দার কারণ পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন লেখেন ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইউএন-ডেসার সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার ড. আনিছ চৌধুরী। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়, যা তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলো আবাসন খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ করে। এক পর্যায়ে ব্যাংকের মুনাফা কমতে শুরু করে এবং কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারেও অধিক হারে বিনিয়োগ করে। ফলে পুঁজিবাজারে অতিমূল্যায়নের ঘটনা ঘটে। একসময় পুঁজিবাজারে ধস নামে এবং ব্যাংকগুলো বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতেও এসব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন এ বিশ্লেষক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর। আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক বাব্ল বা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির পর্যালোচনায় ড. আনিছ চৌধুরী লিখেছেন, অতিমূল্যায়িত পুঁজিবাজারে ধস সবার জন্যই বেদনাদায়ক। প্রাইস কারেকশন আরো বিলম্বিত হওয়ার কারণে যে ধস নামবে তা আরো বেদনাদায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, পুুঁজিবাজারের মতো অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থায়িত্ব ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেট সেক্টর সঠিকভাবে মূল্যায়িত হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আর্থিক খাতে মন্দা হতে পারে দুটি কারণে। এগুলো হচ্ছে_জ্বালানি সংকট এবং জমির অতিমূল্য। জমির দাম সাংঘাতিক বেড়েছে, এখানে কারেকশন হতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে মাসে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ অবস্থায় এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আর বাড়বে না। এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হওয়ার ফলে চলতি ঋণগুলো খেলাপি হতে পারে। তবে বড় ধরনের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ তাদের অন্যান্য খাতের লভ্যাংশ থেকে এ ঋণ ফেরত আসবে। সমস্যা হবে ছোট উদ্যোক্তাদের নিয়ে।
মন্দা ঠেকাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ানোর পক্ষে মত দেন মাহমুদ সাত্তার। অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে সরকার বিদ্যুতের জোগান বাড়াতে সক্ষম হলেও গ্যাসের জোগান বাড়ানো নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

শীর্ষ পদে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজেরা!

দুর্নীতি করার কথা স্বীকার করে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে (ট্রুথ কমিশন) অর্থদণ্ড দেওয়া কর্মকর্তাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পদসহ শীর্ষস্থানীয় অন্তত পাঁচটি পদে বসানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এক-এগারোর পর ঘুষের টাকা লেনদেনের সময় হাতেনাতে আটক কর্মকর্তাকে।

রেলওয়ের মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমন একজনকে, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলা চলছে এবং আরও দুটি দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত এসব কর্মকর্তাকে বসানোর কারণে প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মকর্তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ কারণে সেখানে কাজের গতি কমে গেছে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়েরই অনেক কর্মকর্তা। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে এই পরিস্থিতি অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রধান প্রকৌশলী: ট্রুথ কমিশনে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির দায় স্বীকার করা মো. শাহাবুদ্দিনকে গত ২৭ জানুয়ারি সওজের প্রধান প্রকৌশলী করা হয়। তাঁকে গত ২৪ জানুয়ারি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের করা তদন্তে শাহাবুদ্দিনসহ ৪১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু এখন তাঁরা শাস্তির বদলে সুবিধাজনক উচ্চ পদে বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে পুরো বিভাগে জেঁকে বসেছেন।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে চারটি বিভাগীয় মামলা হলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু তিরস্কার করে তাঁকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিধিমালা (পিপিআর) অনুসরণ না করা এবং মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজার অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধভাবে বিদেশ সফরের অভিযোগে বিভাগীয় মামলাগুলো করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, শাহাবুদ্দিন ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (এলপিআর) যান। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ালে তিনি পুনরায় যোগ দেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তবে তাঁর মুক্তিযোদ্ধার সনদ অবৈধ দাবি করে হাইকোর্টে রিট করেন বাহারউদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা। ওই মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় শাহাবুদ্দিনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বিষয়ে তিনি খবর রাখেন না। সংসদীয় কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে ভুল বুঝে কথা বলেছে। ট্রুথ কমিশনে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যটা আমি জানি। কী বলেছি আর করেছি, আমি ভালো করেই জানি।’
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ফিরে আসেন তাঁর ব্যাচমেট মোস্তাক হোসেন, আরিফুর রহমান ও আবদুল অদুদ। এই তিনজনের মধ্যে মোস্তাক হোসেন ও আরিফুর রহমান ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করেছিলেন। এঁরা এখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে আছেন। এই পদে নিয়মিত হওয়ার জন্য তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের পরিচালক: আরিফুর রহমানকে সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে গত বছরের জানুয়ারি মাসে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পরও প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়নি। সূত্র জানায়, দরপত্রের শর্তানুযায়ী চার লেন প্রকল্প অনুমোদনের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খানাখন্দ নির্বাচিত ঠিকাদারদেরই করার কথা। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, ঠিকাদারেরা তা করবেন না। এ জন্য মহাসড়কের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মিরসরাই থেকে চট্টগ্রাম গেট পর্যন্ত অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে সরকারের বাড়তি ব্যয় হবে। সারা দেশে সড়ক মেরামতের জন্য এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প শিগগিরই একনেকে অনুমোদন হবে বলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানিয়েছেন। এই প্রকল্পে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামতও রয়েছে।
এ বিষয়ে আরিফুর রহমান বলেন, সে সময় সওজের ঢাকায় কর্মরত সব কর্মকর্তাকে জোর করে ট্রুথ কমিশনে নেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে যারা আছেন, সে সময় তাঁরা ঢাকায় থাকলে কেউ বাদ যেতেন না। তিনি দাবি করেন, তাঁর পদোন্নতিতে সওজে কোনো অস্বস্তি নেই।
পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান: ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা আরেক প্রকৌশলী মোস্তাক হোসেনকে করা হয়েছে সওজের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান। সওজের কোন প্রকল্প নেওয়া হবে, কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, কোনটিতে কত অর্থায়ন হবে, তা নির্ধারণ করা পরিকল্পনা বিভাগের কাজ।
মোস্তাক হোসেন দাবি করেন, তাঁদের ট্রুথ কমিশনে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কিছু লোক খারাপ প্রচার চালাচ্ছে। তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ায় সওজের কাজ দ্রুতগতিতে হচ্ছে। অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো অস্বস্তি নেই।
প্রশাসন ও সংস্থাপন বিভাগের প্রধান: স্বেচ্ছায় দুর্নীতির কথা স্বীকার করা আবদুল আজিম জোয়ার্দারকে বর্তমান সরকার পদোন্নতি দিয়ে সওজের প্রশাসন ও সংস্থাপন বিভাগের প্রধান করেছে। গত বছরের আগস্ট মাসে ঈদুল ফিতরের আগে একসঙ্গে সওজের ৪৪ জনকে বদলি করা হয়। সে সময় ‘বদলি বাণিজ্য’ আলোচনায় আসে। সম্প্রতি সওজের প্রকৌশলীদের সমিতির নির্বাচনে পরাজিত হন জোয়ার্দার। এই পরাজয়ের পেছনে সেই বদলি বাণিজ্যের একটা প্রভাব আছে বলে মন্তব্য করেন কয়েকজন প্রকৌশলী।
এসব বিষয়ে আবদুল আজিম জোয়ার্দারকে বক্তব্য জানার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। শুধু বললেন, ‘আমি অফিসের কাজে বাইরে আছি।’ তিনি পরে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করার পরামর্শ দেন।
আরও যাঁরা বড় দায়িত্ব পেয়েছেন: আরেক কর্মকর্তা সোহরাব উদ্দিন মিয়াকেও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদমর্যাদায় বেশ কয়েকটি সড়ক নির্মাণ ও মেরামতসংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে।
সোহরাব উদ্দিন মিয়া জানান, তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে আছেন। ট্রুথ কমিশনে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এভাবে গত দুই বছরে সওজের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসিয়েছে মন্ত্রণালয়।
সেতু বিভাগ: যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আরেক বিভাগ সেতু বিভাগ। সরকারের সর্বাধিক অগ্রাধিকার ও বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে সেতু বিভাগ। এই প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে সওজের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে। তিনি এক দিনের জন্য সওজের প্রধান প্রকৌশলীও হয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ধানমন্ডির এক রেস্তোরাঁয় ঠিকাদারদের কাছ থেকে নেওয়া কমিশনের টাকা ভাগাভাগির সময় তাঁকেসহ আরও সাত প্রকৌশলীকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হাতেনাতে ধরে ফেলেন। পদ্মা সেতুর নকশার কাজ চূড়ান্ত না হওয়ার আগেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির পুরো প্রায় ১১৬ কোটি টাকা দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক: এই পদে নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক আছে। বর্তমান মহাপরিচালক টি এ চৌধুরীর বিরুদ্ধে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। তাঁকে মহাপরিচালক এবং শাহাবুদ্দিনকে সওজের প্রধান প্রকৌশলী না করার জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছিল কমিটি। এর পরও টি এ চৌধুরীকে মহাপরিচালক করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে, তিনি রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে ইঞ্জিন ও কোচের যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ৫৩ লাখ টাকায় ক্রয় এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। দুদক তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য গত ১২ জানুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণলয়ে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
টি এ চৌধুরীসহ রেলওয়ের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রেলওয়ের চট্টগ্রামের সরঞ্জাম শাখার কেনাকাটায় দুর্নীতির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়েছিল দুদক। গত বছরের ৩০ মার্চ শাহবাগ থানায় এ বিষয়ে একটি মামলাও করে দুদক।
জানেত চাইলে টি এ চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘এগুলো সব পুরোনো অভিযোগ। আমাকে এসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
বিআরটিএ: যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গুরুত্বপূর্ণ পদেও আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজেরা আসীন। ২০০৭ সালে মোটরযানের কর ও ফি বাবদ গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের দায়ে বরখাস্ত হওয়া সহকারী পরিচালক কাজী মাহবুবুর রহমান বর্তমান সরকারের সময়ে দিনাজপুর কার্যালয়ের প্রধান হন। এখন তিনি বিআরটিএর টাঙ্গাইল কার্যালয়ের প্রধান।
২০০৭ সালে বিআরটিএর এক তদন্ত কমিটি কাজী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় এবং সেই টাকা তাঁর কাছ থেকে উদ্ধারেরও সুপারিশ করে। সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাও হয় তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন।
এ ছাড়া ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা সহকারী পরিচালক আমিনুল হক সরকারকে ঢাকার পরই গুরুত্বপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ রকম ৪১ জন কর্মকর্তা ট্রুথ কমিশনে হাজির হয়ে দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেও এখন সরকারি চাকরি করছেন। তাঁদের অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন, অনেকে সুবিধাজনক স্থানে বদলিও হয়েছেন।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি উল্টো।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে ট্রুথ কমিশন গঠন করা হলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ৪৫২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বেচ্ছায় গিয়ে নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন এবং অনেকে অর্থদণ্ড দেন।
যোগাযোগ খাতে অব্যবস্থার মূলে: মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে কাউকেই পাত্তা দেন না। তাঁদের কোনো কাজে তাগিদ দেওয়ারও সাহস পান না মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কারণ তাঁরা প্রকাশ্যে বলে বেড়ান, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ। কেউ তাঁদের কিছু করতে পারবে না।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, দেশের রাস্তাঘাট উন্নয়ন করবে কে? সওজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পদোন্নতির বিষয়টি সুপেরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) দেখে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি হয়। দুর্নীতিবাজদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘নিয়মের বাইরে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয় না।’
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রেলওয়ের মহাপরিচালক এবং সওজের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর ব্যাপারে তদন্ত করতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে প্রতিবেদন নিয়ে এখনো আলোচনা হয়নি।
প্রথম আলোয় ২০১০ সালের ৬ মার্চ প্রকাশিত এক কলামে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনের সদস্য মনজুর রশীদ খান লিখেছিলেন, ‘...আমরা সর্বমোট ৪৫২ জনের শুনানি করেছিলাম। এর বেশির ভাগই এসেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা, ডেসা, দুটি গ্যাস কোম্পানি, সাব-রেজিস্ট্রার, ডাক বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিআরটিএ থেকে। কয়েকটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, তাঁদের দপ্তরগুলোতে পিসি (পার্সেনটেজ) নামের ছদ্মাবরণে ঘুষ নেওয়ার প্রথাকে কেউ দুর্নীতি মনে করেন না।...অনেক সংস্থায় বিশেষ করে প্রকৌশল সংস্থাগুলোতে পিসি নেওয়াটা একটা সাধারণ ব্যাপার। অর্থাৎ তাঁরা একে দুর্নীতি মনে করেন না। যিনি নেন না, তিনি চাকরির সিঁড়ির ধাপে বেশি দূর এগোতে পারেন না।’
বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা ট্রুথ কমিশনে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই অর্থদণ্ড দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন কয়েক কোটি টাকা করে জরিমানা দিয়েছেন। নির্দিষ্ট প্রকল্পে বা কাজে দুর্নীতির কারণে তাঁরা এই দণ্ড দিয়েছিলেন বলে সূত্র জানায়।