Saturday, December 04, 2010

বখাটেদের হাতে এবার বাবা নিহত

এবার চাঁদপুরের এক বাবাকে বখাটেরা কাঠমিস্ত্রির বাটালি দিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছে। বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন বাবা। সেখানেও তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি বখাটেরা। অবশেষে এক সপ্তাহ আগে মেয়েকে তিনি বিয়ে দিয়ে দেন। তারই প্রতিশোধ নিতে ওরা গত মঙ্গলবার রাতে বাটালি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে মেয়ের বাবাকে।
একদিকে সরকারিভাবে প্রতিনিয়ত বখাটেদের দমনের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বখাটেপনা ও নৃশংসতা বেড়েই চলেছে। অনেকটা যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বখাটেদের এমন নৃশংসতায় শুধু নিহতের স্বজনরাই ব্যথিত হচ্ছেন না, পুরো সমাজেরই হৃদয় আজ ক্ষত-বিক্ষত। বখাটেরা শুধু স্কুল-কলেজের মেয়েদের উত্ত্যক্তই করছে না, তারা মেয়েকে, মেয়ের মা-বাবাকে, এমনকি মেয়ের শিক্ষককে পর্যন্ত হত্যা করে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করছে। আর পত্রপত্রিকায় কিংবা টিভি চ্যানেলে বখাটেদের এসব নৃশংসতার দৃশ্য দেখতে দেখতে সমাজের বিবেকবান প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সভা, সেমিনার ও মানববন্ধন করে তাঁরা প্রতিনিয়ত এর প্রতিবাদও জানাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না বখাটেদের পৈশাচিক উল্লাস।
বখাটেদের দমন করা যাচ্ছে না কেন? এর জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ব্যর্থতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা। দায়ী সামাজিক প্রতিরোধের অভাব, দায়ী নৈতিকতাহীন শিক্ষা এবং আরো অনেক কিছু। সবচেয়ে বেশি দায়ী বখাটেদের পরিবারগুলো। কোনো বখাটের মা-বাবাই তাঁদের ছেলের অপরাধপ্রবণতা সম্পর্কে সবার আগে জানতে পারেন। কিন্তু ছেলেকে শোধরানোর চেষ্টা করেন না। এমনকি বখাটেপনার শিকার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলেও অন্যায় অপত্যস্নেহে সেগুলো শুনেও না শোনার ভান করেন। ছেলে যদি শোধরানোর বাইরে চলে যায়, তাহলে মা-বাবার উচিত তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা। কিন্তু তাঁরা তা করেন না। একসময় এই বখাটেরাই খুনিতে রূপান্তরিত হয়। তাই বখাটেদের পাশাপাশি তাঁদের মা-বাবাকেও শাস্তির আওতায় আনা উচিত। বখাটেদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিরোধ বিপজ্জনক বিবেচিত হলে পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে প্রকৃত তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ যদি কোনো ধরনের গাফিলতি প্রদর্শন করে, তাহলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জানাতে হবে এবং দায়ী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার অনেক সময়ই দেখা যায়, বখাটে তথা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হলেও অল্পদিনের মধ্যেই তারা জামিনে বেরিয়ে এসে অভিযোগকারীর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। এ কারণে বখাটেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেও অনেকে ভয় পান। অভিভাবকদের সে ভয় দূর করতে হবে।
এভাবে কোনো সমাজ চলতে পারে না। বিচার বিভাগের শীর্ষস্থানে যাঁরা আছেন, তাঁরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবেন আশা করি। ইতিমধ্যে দ্রুত বিচার আইনে ইভ টিজিংয়ের অপরাধে কিছু অপরাধীকে স্বল্পকালীন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও বখাটেদের দৌরাত্ম্য থামছে না। তাই আইন আরো কঠোর এবং শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হওয়া দরকার। আইন মন্ত্রণালয় ও আইনপ্রণেতাদের আইনের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে আরো কঠোর আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হতে হবে। আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁরা সমাজের এ জ্বলন্ত সমস্যাটির সমাধানে আরো বেশি আন্তরিক হবেন_এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা চাই, চাঁদপুরে এক বাবাকে যারা হত্যা করেছে এবং নিকট অতীতে এ ধরনের আরো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যেসব অপরাধী জড়িত রয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এবং সমাজ এক ভয়ংকর অপরাধ থেকে মুক্ত হোক।

চামড়া নিয়ে বিপাকে

চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। কোরবানির ঈদের সময় বেশি দামে চামড়া কিনে এখন বিক্রি করতে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, ট্যানারির মালিকরা চামড়া কিনছেন না। অন্যদিকে ট্যানারি মালিকদের দাবি, পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীরা যে দামে ঈদের সময় চামড়া কিনেছেন, সে দামে চামড়া কেনার সামর্থ্য নেই তাঁদের। এক পক্ষ এখন আরেক পক্ষকে দুষছে। এই চামড়া কেনাবেচার আড়ালে কেউ কেউ খুঁজতে চাইছে অদৃশ্য কোনো সিন্ডিকেটের ছায়া। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বাস্তবতায় এটা অস্বাভাবিকও নয়। যেকোনো বাজারে যখনই কোনো অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন তার আড়ালে সিন্ডিকেটের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া আবিষ্কার হয়েই যায়।
চামড়া নিয়ে যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে, সেটা কিন্তু অনেক আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছিল, যে অবস্থা চলছে, তাতে চামড়া পাচার হয়ে যেতে পারে। ঈদের তিন সপ্তাহ পরও দেখা যাচ্ছে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না। যা বিক্রি হচ্ছে, তাতেও তাঁদের লোকসান হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের ক্ষোভটা এসে পড়ছে ট্যানারি মালিকদের ওপর। পাইকারি ব্যবসায়ীদের ধারণা, ট্যানারি মালিকরা ইচ্ছে করেই চামড়া কেনা বন্ধ রেখেছেন। চামড়া পচনশীল। নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে পাইকারি ব্যবসায়ীদের চামড়া বিক্রি করতেই হবে। কাজেই ট্যানারি মালিকরা একজোট হয়ে দাম বেঁধে দিয়েছেন, এমনটিই ধারণা করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। সেই দামে চামড়া বিক্রি করলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়বেন। অন্যদিকে কেনা চামড়া বিক্রি না করলেও বিপদ। কাজেই পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভিন্ন পথ বেছে নেওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। কারণ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হবে তাঁদের। অন্যদিকে ট্যানারি মালিকরা তাঁদের নির্ধারণ করে দেওয়া দামের বাইরে যেতে চান না। দুই পক্ষের এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে অবিক্রীত থাকছে চামড়া। এদিকে দেশের চামড়ার দাম বেশি হওয়ায় ভারত থেকে চামড়া আনার জন্য ঢাকার বাইরে এলসি খোলা হয়েছে_এমন খবর এসেছে পত্রিকান্তরে।
চামড়া নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসন হওয়া দরকার। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চামড়া কেনার জন্য ঋণ দিতে প্রস্তুত। এখন প্রয়োজন শুধু পাইকারি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের মধ্যে সমন্বয় ও সমঝোতা। উভয়পক্ষের সমঝোতা হলেই চামড়া নিয়ে যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা শুধু নয়, চামড়াশিল্পের স্বার্থেও এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দূর করতে হবে অস্থিরতা। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে গত বুধবার শুরু হইয়াছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই বৎসর মেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হইয়াছে রূপকল্প-২০২১ এবং গতবারের শেস্নাগান ছিল দিন বদলের জন্য বই। এই মেলা চলিবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ষোলো দিনব্যাপী এই বইমেলায় তিনটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানসহ ১৫১টি সংস্থা অংশগ্রহণ করিতেছে। নামে আন্তর্জাতিক হইলেও এখন পর্যন্ত এই বইমেলা সার্বিক অর্থে তাহা হইয়া উঠে নাই। প্রতিবেশি ভারতের বুক ট্রাস্ট ছাড়া বিদেশী কোনো প্রকাশনা সংস্থা এই মেলায় নাই। তবে ইরান কালচারাল সেন্টার মেলায় স্টল নিয়াছে। এই স্টলে ওই দেশের শিল্প-সাহিত্য এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সংক্রান্ত কিছু বই হয়তো পাওয়া যাইবে।
১৯৯৫ সাল হইতে প্রতি বৎসর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র এই মেলার আয়োজন করিয়া আসিতেছে। শুরুতে এই মেলার নাম ছিলো ঢাকা বইমেলা। ২০০৮ সাল হইতে আন্তর্জাতিক শব্দটি যোগ করা হইয়াছে, যদিও মেলাটি এখন পর্যন্ত বহির্বিশ্বের প্রকাশক, বই বিপণন সংস্থা এবং লেখকদের মনোযোগ খুব একটা আকর্ষণ করিতে পারে নাই। এমনকি বাংলাদেশের বাজারে বিদেশী যে সকল প্রকাশনা সংস্থার বই বহুল প্রচলিত, সেই সকল সংস্থারও প্রতিনিধিত্ব এই মেলায় নাই।

তবে, এখনই ইহা পুরাপুরি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করিতে সক্ষম না হইলেও, ভবিষ্যতে যে ইহা যথার্থ আন্তর্জাতিক হইয়া উঠিবে না, সে কথা বলা যায় না। অমর একুশে বইমেলাও শুরুতে ছিলো জাঁকজমকহীন। অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন ছিল হাতে গোনা, তেমনই দর্শক-ক্রেতার সংখ্যাও ছিলো নগণ্য। সেই একুশের বইমেলা এখন কী বিপুল ও বিশাল হইয়া গিয়াছে, তাহা কাহারও অজানা নহে। আন্তর্জাতিক বইমেলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকিলে একদিন হয়ত ইহাও বৃহৎ ও সার্থক রূপ লাভ করিবে।

ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলা হইতে অনেকটাই ভিন্ন। এই মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থাসমূহ কেবল তাহাদের নিজেদের প্রকাশিত গ্রন্থই প্রদর্শন ও বিক্রয় করিতে পারে। যথেষ্টসংখ্যক বই যেইসব প্রকাশনীর নাই, তাহারা এই মেলায় সাধারণত অংশগ্রহণ করে না। ফলে প্রকৃত প্রকাশকদের বই বিপণনে এই মেলা সবিশেষ সুযোগ আনিয়া দেয়। তাহাদের নিকট এই মেলার আলাদারকমের গুরুত্ব রহিয়াছে। কিন্তু, ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলার একটি বড় সমস্যা এই যে, তাহার কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গা নাই। একেক বৎসর একেক জায়গায় মেলা বসিয়া থাকে। গত বৎসর মেলা হইয়াছিল সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানে। এইবার হইতেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। এই মেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকা দরকার । বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক কি জাতীয়, যেই পর্যায়েই হউক বইমেলা আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হইল মানুষকে বইমুখী করা, বইয়ের পাঠক সৃষ্টি করা। জ্ঞানভিত্তিক উন্নত সমাজ বিনির্মাণে ্লবইয়ের কোনো বিকল্প নাই। বই সুন্দরতর জীবনের দিশা দেয়। বিকাশ ঘটায় জীবন বোধের। আমরা মনে করি, বইমেলা বইপড়া আন্দোলনেরই একটা অংশ। আমাদের বাংলা ভাষায় বহু-বিচিত্র বিষয়ে আরও অনেক ভাল বই চাই, ভাল পাঠক চাই। বিদেশী সাহিত্য-দর্শন এবং নিত্য-নূতন চিন্তার সহিত আমাদের পরিচিত হইতে হইবে। বই-ই হইতে পারে সেই পরিচয়ের বাহন। ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা এই ক্ষেত্রে কিছু না কিছু ভূমিকা যে রাখিয়া যাইবে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা প্রশমনে চাই আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগ

কোরীয় সংকট নিরসনে চীনের ছয় জাতির বৈঠক করার প্রস্তাবের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করিয়াছে। বিতর্কিত সমুদ্রসীমার কাছাকাছি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ছোট দ্বীপে ২৬ নভেম্বর উত্তর কোরিয়ার গোলা বর্ষণে ৪ ব্যক্তি নিহত হওয়ার পর হইতে দেশ দুইটির মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতেছে। পীত সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ নৌমহড়া চালানোর ঘটনা এই উত্তেজনায় যোগ করিয়াছে নতুন মাত্রা।
উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে চীনের ছয় জাতির আলোচনা প্রস্তাব নূতন নহে। উলেস্নখ্য, একই লক্ষ্যে ২০০৩ সালে শুরু হয় ছয় জাতি সম্মেলন। ৬ জাতিভুক্ত দেশগুলি হইল চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া। কিন্তু ২০০৬ সালে সমঝোতার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যায় উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাইলে। তখন উত্তর কোরিয়া ছয় জাতি আলোচনায় আর যাইবে না বলিয়াও ঘোষণা দিয়াছিল। তবে ২০০৭ সালে জ্বালানি সহায়তার বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া তাহার পারমাণবিক কর্মসূচী বন্ধে সম্মত হইয়াছিল। বর্তমানে চীনের প্রস্তাবিত ৬ জাতি সম্মেলনে তাহাদের আপত্তি থাকিবার কথা নয়। আলোচনার টেবিলে দর কষাকষি ও জরুরি সহায়তার চাপ দিতেই তাহারা পারমাণবিক সক্ষমতা বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করিয়াছে বলিয়াছে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পীত সাগরে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নৌমহড়া এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বিষয়ে তথ্য প্রকাশের কূটনৈতিক তাৎপর্য যাহাই হউক, কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে শান্তিপ্রিয় মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পাইতেছে। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার।

এই ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার তিন জাতি, বিশেষ করিয়া উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র চীনের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত। আমরা মনে করি, কোরীয় উত্তেজনা প্রশমনে দুই কোরিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে হইবে। চীন যে ছয় জাতি বৈঠকের প্রস্তাব দিয়াছে, উহার অনুষ্ঠান ও সাফল্যের ব্যাপারেও সংশিস্নষ্ট সকল পক্ষের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। ইরাক ও আফগানিস্তানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অশান্তির পর, বিশ্ববাসী নূতন করিয়া যুদ্ধ দেখিতে চায় না। কাজেই দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়ার উত্তেজক সম্পর্ক এবং পারমাণবিক ইসু্যতে উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমস্যার সমাধানকে গুরুত্ব দিবে_ইহাই প্রত্যাশিত। আমরা মনে করি, তিক্ততা না বাড়াইয়া আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে সমঝোতায় পেঁৗছিতে সংশিস্নষ্ট সকল পক্ষকেই আগাইয়া আসিতে হইবে।

প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে হামলাঃ সাংসদ-স্থানীয় সরকার বিরোধ কাম্য নয়

মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের কারও গাড়িতে হামলার বিষয়কে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায় না। বুধবার শেরপুরে এমন ঘটনা ঘটেছে। হামলার শিকার হয়েছে পানিসম্পদমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমানের গাড়ি। শেরপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যানকে সভামঞ্চে কথা বলার সুযোগ না দেওয়াকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে। শুধু প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে হামলাই নয়, এ নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, পুলিশ সুপার, সাংবাদিকসহ প্রায় ২৫ জন। আইনপ্রণেতা অর্থাৎ সাংসদ ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে যে ভারসাম্যহীন ও বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে, তারই একটি দুঃখজনক বহিঃপ্রকাশ ঘটল এ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ঘটনার দিন শেরপুর সদর উপজেলায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ ও ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এ বিষয়গুলোতে উপজেলা চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান ইলিয়াছ উদ্দিন অভিযোগ করেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনগণের সমস্যার কথা তিনি প্রতিমন্ত্রীকে দুবার বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেননি। কারণ এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় সাংসদ আতিউর রহমানের বিরোধিতা। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংঘাত ও তার জের ধরে প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। বিরোধের বিষয়টিকে শুধু শেরপুরের ঘটনা হিসেবে না দেখে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
দুই পক্ষ থেকে যতই অভিযোগ ও পাল্টা-অভিযোগ করা হোক, স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাংসদের মধ্যে বিরোধের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটেছে। আর এই বিরোধের মূল কারণ কর্তৃত্ব। আমাদের সংবিধানের ৫৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সকল স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘স্থানীয় শাসন’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই নির্দেশনা উপেক্ষিত থেকেছে। নানামুখী চাপে শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন হলেও এই প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করতে সরকারের অনীহা ও টালবাহানার বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উপজেলা পরিষদে স্থানীয় সাংসদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান নির্বাহী করার মধ্য দিয়ে সরকার এ ক্ষেত্রে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
আমরা বুধবার শেরপুরে ঘটে যাওয়া সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে হামলার নিন্দা জানাই। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাংসদকে এ ঘটনার দায় নিতে হবে। তাঁরা দুজনই জনপ্রতিনিধি, নিজ এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা তাঁদের দায়িত্ব। তাঁরা দুজন যদি এ ব্যাপারে সচেতন থাকতেন, তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। তবে সবচেয়ে বড় দায়টি সরকারের, যারা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে এ ধরনের একটি বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। আমরা আশা করব, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা প্রয়োজনঃ ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতি

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন-দিন সংঘাতময় হয়ে উঠছে। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে অনেকেই শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। রাজধানীর ব্যবসায়ী সমাজের সংগঠন মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের এক সভায় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের তেমন উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উঠে এসেছে। বিষয়গুলোর প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া উচিত।
প্রধান অতিথি হিসেবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি হিসেবে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশিও ছিলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। সভায় জানানো হয়েছে, পাকিস্তানের মতো রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দেশেও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের হার মাথাপিছু ৩২ মার্কিন ডলার কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র সাত মার্কিন ডলার।
অবশ্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কম আসার আরও কতকগুলো কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে: সুশাসনের অভাব, প্রশাসনিক ঘুষ-দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, অকার্যকর নীতিকাঠামো এবং জ্বালানিসংকট। সভাটির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু উল্লিখিত দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতাগুলো শুধু যে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে, তাও নয়। স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিও এসব কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ আমাদের বেশির ভাগ বিনিয়োগই স্থানীয় বিনিয়োগ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অতি সামান্য। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এমন যে শুধু বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যেই নয়, স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর পথ সুগম করতেও উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান যেমনটি বলেছেন, দেশে অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেরও বড় সুযোগ রয়েছে। অথচ সঞ্চয়ের অর্থ যাচ্ছে শেয়ারবাজারে, হাজার কোটি টাকার প্রবাসী-আয়ও বিনিয়োগ না হয়ে ব্যয় হচ্ছে ভোগবিলাসে ও আবাসন খাতে। বিনিয়োগনীতির দুর্বলতা রয়েছে বলে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বিনিয়োগবান্ধব শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন এবং মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের শিল্পনীতি কীভাবে কার্যকর হবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার যথার্থই মন্তব্য করেছেন, স্থানীয় বিনিয়োগকে এড়িয়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর জোর দিলে চলবে না, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ এলে দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া যাবে। জ্বালানিসংকট লাঘবের ব্যাপারে কিছু আশাব্যঞ্জক খবর জানানো হয়েছে, সেসব বাস্তবায়িত হলে দেশি-বিদেশি উভয় প্রকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গতিসঞ্চার ঘটতে পারে।
তবে সব আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির প্রত্যাশার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির শঙ্কাও রয়ে যাচ্ছে, যা দূর করার দায়িত্ব প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলোর। ব্যবসায়ীদের অনেকেই উভয় বড় দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এমনকি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠনগুলোতেও প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা রয়েছেন। বিনিয়োগবান্ধব ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে দলগুলোর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্তত সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এমন এক ন্যূনতম মতৈক্য গড়ে তোলা জরুরি যে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষতিকর হয়, এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি সবাই পরিহার করবেন।